কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে পর্ব -০২

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২.
সন্ধ্যার পর আবারও যে বর্ষণের শুরু হলো, তারপর আর থামাথামির আভাসমাত্র নেই। গ্রামের বাড়ির জং ধরা পুরোনো টিনের চালে বর্ষণ আলাদা এক সুরেলা আওয়াজ তুলেছে। বৃষ্টির প্রতিটা পানিকণা যেন নৃত্যের তালে ‘টুপটাপ’ সুরে গান ধরেছে। তারই সাথে পাল্লা দিয়ে রৌদ্রুপ গুনগুনিয়ে সুর তুলেছে,

ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে,
ওহে ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে,
ওহে হারাই-হারাই, সদা হয় ভয়
হারাই-হারাই, সদা হয় ভয়
হারাইয়া ফেলি চকিতে,
আঁশ না মিটিতে হারাইয়া
পলক না পড়িতে হারাইয়া
হৃদয় না জুড়াতে
হারাইয়া ফেলি চকিতে।

এটুকু গেয়েই রৌদ্রুপ চুপ মে’রে গেল। আর গাইতে ইচ্ছে করছে না যে। বর্ষণের সময়টাতে বোধ হয় কিছু মানুষের মন বুঝা বড়োই দায়। এ সময়টাতে মানুষের মন আবহাওয়ার সঙ্গে প্রায় সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। কখনও বর্ষণের কান্নার গুঞ্জনের মতো বিষাদময়। কখনও উচ্ছল বৃষ্টি কণার নৃত্যের ছন্দের মতোই হাসিখুশি, চাঞ্চল্যকর। কখনও বা চমকিত ব’জ্রপাতের মতো উত্তাল। আবার কখনও মেঘলা আকাশের মতো থমথমে। রৌদ্রুপের মনের বর্তমান অবস্থা ঠিক কেমন, তা খুঁজতে গিয়েও সে ব্যর্থ হলো। গ্রামের বাড়িতে বৃষ্টি উপভোগ এটাই তার প্রথম। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে উপভোগ করতে দিচ্ছে না। এভাবে পালিয়ে বেড়ানোটা সে ঠিক মেনে নিতে পারছে না। গত দুদিন আগে রৌদ্রুপের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিয়াদ খু’ন হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই রৌদ্রুপ খবর পায় রিয়াদ নিজ বাসভবনে খুন হয়েছে। তাকে কে বা কারা ম’দের সাথে বি’ষ সেবন করিয়েছে। রিয়াদের বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই গ্রামে থাকে। শহরের বাসায় একা থাকায় রিয়াদ হ’ত্যার সন্দেহের তালিকায় পড়েছে তার সব ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা। তাদের মধ্যে রৌদ্রুপও একজন। অথচ রৌদ্রুপ এ বিষয়ে একদমই অবগত ছিল না। রিয়াদ যে রাতে খু’ন হয়েছিল, সে রাতে রৌদ্রুপ নিজের বাসায় গভীর ঘুমে মগ্ন ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন এমন খবর পেয়েছিল, তখন রৌদ্রুপ ছুটে যেতে চেয়েছিল একবার বন্ধুকে শেষবারের মতো দেখার জন্য। কিন্তু তার পরপরই খবর পেয়েছিল তার সব বন্ধুদের একে-একে গ্রে’ফতার করা হচ্ছে। এ খবর শোনামাত্র রৌদ্রুপের মা-বাবা তাকে শহর ছাড়ার কথা বলে। কিন্তু রৌদ্রুপ এককথায় নাকচ করে দেয়। তার কথা একটাই, আইন এর সঠিক বিচার করবে। সমস্যাটা হয়েছে তার বাবা-মাকে নিয়ে। তাদেরকে কোনো কথাতেই দমানো যায়নি। বরং হ’ত্যা মামলা থেকে ছেলেকে বাঁচানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। রৌদ্রুপকে বাধ্য করেছিলেন শহর ছাড়তে। শহরের বাইরে রৌদ্রুপদের তেমন কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই। এমন কোথাও যেতে হবে যেখানে পুলিশি ঝামেলায় পড়ার নিশ্চয়তা নেই। এই নিয়ে ভাবতে-ভাবতে রৌদ্রুপের মায়ের হঠাৎ মনে পড়েছিল শহর থেকে অনেকটা দূরে এক গ্রামে বাস করা তার চাচাতো বোনের কথা। বিয়ের পর আর বোনের সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। তখন ভেবেছিলেন চাচাতো বোনই তো, নিজের বোন নয়। দুজনের পারিবারিক অবস্থানের মাঝেও ছিল বেশ ব্যবধান। বলা যায় আত্মগরিমাকে কেন্দ্র করেই বোনের সাথে যোগাযোগ করার ইচ্ছেটা তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তখন কে জানত ভবিষ্যতে তাকে এই বোনেরই দ্বারস্থ হতে হবে? বিপদে পড়লেই বুঝি মানুষ মানুষের গুরুত্ব টের পায়। তার আগে ভাবেও না কাকে কখন তার প্রয়োজন পড়তে পারে। নিজের সব আত্নীয়-স্বজনদের ফোন করে চাচাতো বোনের ফোন নাম্বার জোগাড়ের চেষ্টা করেছিলেন রৌদ্রুপের মা। একে-একে সবার থেকে খোঁজ নেওয়ার পর অবশেষে বোনাইয়ের ফোন নাম্বার জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বোন-বোনাইয়ের সাথে কথা বলে ছেলের বিপদের কথা খুলে বলেছিলেন। সেই সাথে এটাও বলেছিলেন যে, তারা যদি রৌদ্রুপকে আশ্রয় দেয় তাহলে ছেলেকে তিনি তাদের গ্রামে পাঠাবেন। শহরের বোনের ছেলের এত বড়ো বিপদের কথা শুনে আফিয়া বেগমের মনে মায়া হয়েছিল। এই অছিলায় এতদিন পর বোনের সাথে সম্পর্কটাও একটু ভালো হবে ভেবে বেশ খুশি মনে তারা রাজি হয়েছিলেন। রৌদ্রুপের মা সঙ্গে-সঙ্গেই গ্রামের নাম, ফোন নাম্বার আর বোন-বোনাইয়ের নাম মুঠোয় পুরে দিয়ে ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন অচেনা গন্তব্যে। শহর, পরিবার, অফিস ফেলে রেখে রৌদ্রুপ ছুটে আসে অচেনা, অজানা গ্রামে। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে গন্তব্য খুঁজে পেতেও তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। গ্রামে পৌঁছে অনেক খুঁজে একজন বৃদ্ধর থেকে জানতে পেরেছে তার খালার বাড়ির ঠিকানা। গ্রামের বাড়িতে এটাই তার প্রথম আগমন। গ্রামীণ পরিবেশে সে অভ্যস্ত নয়। তার ওপর সব অপরিচিত মুখ। এই পরিবারের মানুষের ব্যাপারে সে তেমন কিছু জানেও না। তাদের জীবনযাত্রা, আচার-আচরণ সম্পর্কেও অবগত নয়। মায়ের এই আত্মীয়দের সাথে কখনো দেখাসাক্ষাৎ হয়নি যে। এই বাড়িতে আসার পর সেই যে তার খালা তাকে এই ঘরে ঢুকিয়ে রেখে গেছেন, তারপর কেবল ওই মেয়েটি ছাড়া আর কেউ আসেনি। সামনের অনিশ্চিত দিনগুলোর কথা ভাবতে-ভাবতে রৌদ্রুপ গায়ের চাদরটা মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি মে’রে শুয়ে চোখ বন্ধ করল, একটু ঘুমিয়ে নিয়ে মনটা শান্ত করার আশায়। কিন্তু দরজায় টোকা পড়ায় তা আর হলো না। একরাশ অনিচ্ছা নিয়ে রৌদ্রুপ বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজার কপাট খুলে দিলো। দরজা খুলতেই দেখল আফিয়া বেগম একটা গামছা মাথায় দিয়ে আধভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি নিজের বড়ো ঘোমটাটা আরেকটু টেনেটুনে হাসিমুখে বললেন,
“আপনের লাইগা খাওন আনছি বাপ। রাইত তো কম হইল না।”
রৌদ্রুপ এবার আফিয়া বেগমের হাতে থাকা স্টিলের প্লেটের দিকে তাকাল। একটা প্লেট আরেকটা প্লেট দিয়ে ঢাকা দেওয়া। রৌদ্রুপ দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে যথেষ্ট বিনয়ী কন্ঠে বলল,
“ভেতরে আসুন আন্টি। ভিজে যাচ্ছেন তো।”
আফিয়া বেগম ভেতরে ঢুকে বিছানায় খাবারের প্লেট রাখলেন। পরক্ষণেই কিছু একটা মনে করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় হাঁক ছাড়লেন,
“ও রিতা, এক জগ পানি আর একখানা গেলাস নিয়া আয়।”
রৌদ্রুপ অদূরে দাঁড়িয়ে আফিয়া বেগমকে প্রশ্ন করল,
“আঙ্কেল বাড়িতে নেই?”
আফিয়া বেগম ফিরে তাকিয়ে বললেন,
“না, অহনই আইয়া পড়ব।”
“এই বৃষ্টির মধ্যে কীভাবে ফিরবে?”
“গরীবের আবার ঝড়-বাদল,” মলিন হেসে বললেন আফিয়া বেগম।
“রাতেও মাঠে কাজ করে না কি?”
“না, না। রাইতে আন্ধারের মইধ্যে কাম করব ক্যামনে? মনে হয় তালুকদার বাড়ি গেছে। আমি কামের চাপে আপনের লগে কতা কওয়ার সময় পাই নাই বাপ। তা আপনের আব্বা-আম্মার শইল ভালা আছে?”
রৌদ্রুপ হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো।”
“আপনের ভাই-বইনের কী খবর?”
“ভালো।”
“তাগো কি বিয়া হইছে?”
“হ্যাঁ। বড়ো ভাইয়ার একটা মেয়েও আছে। আর গত মাসেই ছোটো বোনকে বিয়ে দিয়েছি।”
“মাশাল্লা, তয় জামাই কী কাম করে?”
“ইঞ্জিনিয়ার।”
“আর আপনেরা দুই ভাই কী করেন?”
“ভাইয়া বাবার সাথেই ব্যবসা দেখাশোনা করে। আমি পড়াশোনা শেষ করে আপাতত ছোটো-খাটো একটা চাকরি করছি।”
“ভালা। দোআ করি বাপ, অনেক বড়ো হন।”
“আন্টি, আমাকে ‘আপনি’ ডাকবেন না। আমি তো আপনার ছেলের মতো। মায়েরা কি ছেলেদের ‘আপনি’ ডাকে?”
আফিয়া বেগম সন্তোষ দৃষ্টি নিয়ে রৌদ্রুপের মুখের দিকে তাকালেন। কত সুন্দর করে কথা বলে ছেলেটা! তারও তো একটা ছেলে আছে? কই? এত সুন্দর করে তো কখনও কথা বলে না। সবসময় ঝাড়ি মে’রে কথা বলে। অথচ বয়সে সে নৈঋতার চেয়ে দুই বছরের ছোটো। দরজার ওপাশ থেকে হঠাৎ ডাক পড়ল,
“মা, পানি আনছি।”
আফিয়া বেগম বললেন,
“ভিতরে আয়।”
নৈঋতা একটা সিলভারের জগ, একটা মগ আর মোমবাতির প্যাকেট হাতে ঘরে ঢুকল। সামনে তাকাতেই পুনরায় চোখাচোখি হলো রৌদ্রুপের সাথে। রৌদ্রুপের কপালে হালকা ভাঁজ পড়ল। মেয়েটা তাহলে কথা বলতে জানে। তার ধারণা ভুল। আফিয়া বেগম নৈঋতাকে বললেন,
“বিছনায় রাখ।”
নৈঋতা এগিয়ে গিয়ে হাতের জগ, মগ আর মোমবাতির প্যাকেটটা বিছানায় রেখে নিচু স্বরে বলল,
“আব্বায় আইছে মা।”
আফিয়া বেগম প্রশ্ন করলেন,
“কহন?”
“এইমাত্রই। আব্বার ক্ষুধা লাগছে। আমি খাওন দেই গিয়া।”
নৈঋতা দরজার দিকে পা বাড়াতেই আফিয়া বেগম ব্যস্ত হয়ে বললেন,
“থাক, তোর যাওয়া লাগব না। আমি যাইতাছি। তুই এইহানে থাক। মেহমানের কী লাগে, না লাগে দেখ।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও নৈঋতা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। আফিয়া বেগম রৌদ্রুপের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“খাও বাবা। কিছু মনে কইরো না। আমরা তোমাগো মতন বড়োলোক না। একটু মানায়া নিয়ো।”
রৌদ্রুপ মুচকি হেসে বলল,
“আপনি আমাকে নিয়ে এত ভাববেন না আন্টি। আমিও তো আপনাদের মতোই মানুষ। পারিবারিক অবস্থার কথা বলে আমায় লজ্জা দিবেন না।”
আফিয়া বেগম পুনরায় মুগ্ধ হলেন। ছেলেটা আসলেই অনেক ভালো। হাসিমুখে আফিয়া বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে রেখে গেলেন। কাঠের নড়বড়ে টেবিলের ওপরে রাখা মোমবাতিটা ফুরিয়ে আসার পথে দেখে নৈঋতা এগিয়ে গিয়ে প্যাকেট থেকে একটা মোমবাতি বের করল। সেটা নিয়ে টেবিলের কাছে গিয়ে জ্বা’লানো মোমবাতির আ’গুনে হাতেরটাও জ্বা’লাল। তারপর সেটা ঠিকমতো টেবিলে রেখে ঘুরে দাঁড়াল। রৌদ্রুপ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে কিছুটা জড়তা নিয়ে বলল,
“আপনার খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে। খেয়ে নিন।”
“খাচ্ছি।”
কথাটা বলেও রৌদ্রুপ খেতে বসল না। এগিয়ে গিয়ে বিছানার একপাশ থেকে তার লাগেজটা খুলল। ভেতর থেকে একটা তোয়ালে বের করে নৈঋতার দিকে এগিয়ে ধরল। নৈঋতা দুচোখে বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই রৌদ্রুপ বলল,
“তুমি তো অনেকটা ভিজে গেছ। মাথাটা মুছে নাও। নইলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
নৈঋতা মাথা দুলিয়ে বলল,
“না, না। এটুকু ঠান্ডায় আমার কিছু হয় না।”
“নাও।”
“লাগবে না।”
“আরে নাও না।”
“আপনার জিনিস আমি ব্যবহার করব?”
“এক কথা বারবার বলা পছন্দ করি না আমি।”
নৈঋতা একটু ইতস্তত করে রৌদ্রুপের হাত থেকে তোয়ালেটা নিল। এই ধরনের তোয়ালে সে এর আগে কখনও ব্যবহার করেনি। লোকটার মনটা বোধ হয় ভালো। নইলে নিজের ব্যবহৃত জিনিস অপরিচিত একটা মেয়েকে কেউ দেয়? কোনোরকমে মাথাটা মুছে তোয়ালেটা সে রৌদ্রুপের হাতে ফিরিয়ে দিলো। রৌদ্রুপ তোয়ালেটা নিয়ে ঘরে টাঙানো দড়িতে ঝুলিয়ে রেখে দিলো। তারপর সে বিছানায় উঠে বসল। ঢাকা দেওয়া প্লেটটা সরিয়ে দেখল প্লেটের একপাশে মোটা চালের ভাত, সাথে আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি। ছোটো একটা বাটিতে একটু ডালও আছে। নৈঋতা মাথানত করে লাজুক মুখে বলল,
“কিছু মনে করবেন না। আব্বা আজ বাজার করতে পারেনি। তাই ঘরে যা ছিল তা-ই রান্না করেছে।”
রৌদ্রুপ হেসে বলল,
“কিছু মনে করার মতো কিছু হয়নি। আলুভর্তা, ডিম ভাজি, ডাল, এসব আমি প্রায়ই খাই। ভালো লাগে আমার। শুধু মোটা চালের ভাত খাওয়া হয় না কখনও। এবার এটাও ট্রাই করা হয়ে যাবে।”
নৈঋতা অবাক হলো। এসব খাবারও কারো ভালো লাগে? তার তো এই খাবার খেতে-খেতে অভক্তি এসে গেছে। সে আরও ভেবেছিল শহরের অতিথির এসব খাবার দেখলে মুখ চুপসে যাবে। রৌদ্রুপ হাত ধুয়ে খাওয়া শুরু করল। ভাতটা গিলতে একটু অসুবিধা হলেও স্বাদটা তার কাছে মন্দ লাগেনি। খেতে-খেতে রৌদ্রুপ হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,
“এখানে বসো।”
নৈঋতা ডানে-বায়ে মাথা দুলিয়ে বলল,
“না, ঠিক আছে।”
“বড়োদের কথা শুনতে হয়। জানো তো?”
নৈঋতা ওপর নিচে মাথা ঝাঁকাল। রৌদ্রুপ পুনরায় ‘বসো’ বলতেই নৈঋতা ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানার এক কোণে পা ঝুলিয়ে বসল। কোলের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে হাতের নখ খুঁটতে লাগল। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে তার। মা তাকে ফেলে রেখে গেল কোন বিবেকে? কিছু মুহূর্ত পর রৌদ্রুপ হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল,
“তখন ওভাবে পালিয়ে গিয়েছিলে কেন?”
নৈঋতা হোঁচট খেল। এই প্রশ্নটা না করলে কী হত? নিমেষেই যুক্তিযুক্ত উত্তর না পেয়ে মাথা না তুলেই সে পালটা প্রশ্ন করল,
“জি? কখন?”
“আসার সময় পথে যখন দেখা হয়েছিল। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম যে সামসুদ্দীন বেপারীর বাড়ি কোন দিকে। অথচ তুমি কথা না শুনেই ছুটে পালালে। কেন বলো তো?”
নৈঋতা কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। সে তো ভয়ে পালিয়েছিল। ওমন পরিবেশে অচেনা পুরুষ মানুষের থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু এই সত্যি কথাটা এখন সে কীভাবে বলবে? খানিক ভেবে নিয়ে নৈঋতা আমতা-আমতা করে বলল,
“আসলে তখন আমি দোকানে যাচ্ছিলাম মোমবাতি আনতে। বৃষ্টির মধ্যে এমনিতেই দেরী হয়ে যাচ্ছিল। আবার রাস্তাঘাটে কোনো মানুষজনও ছিল না। যদি দোকান বন্ধ হয়ে যায়? তাই আর কী।”
“তাই বলে কথাই বলবে না? কিছুক্ষণ আগে যখন মোমবাতি দিয়ে যেতে এলে, তখনও তো কথা বললে না। ছুটে পালালে।”
নৈঋতা কোনো উত্তর না দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল। রৌদ্রুপ হেসে বলল,
“লজ্জা পাচ্ছিলে না কি? এদিকে আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি কথাই বলতে পারো না।”
নৈঋতা মাথানত অবস্থায় ঠোঁট টিপে হাসল। মোমবাতির আবছা আলোয় নৈঋতার ঠোঁটের কোণের চিকচিকে হাসিটুকু রৌদ্রুপের দৃষ্টিতে দারুণ লাগল। কথায়-কথায় রৌদ্রুপ কিছুটা ভাত খাওয়ার পর আর খেতে ইচ্ছে করল না। প্লেটের কিনারায় কিছু ভাত বাকি রেখে হাত ধুয়ে পানি খেল। নৈঋতা জগ আর মগটা নিয়ে টেবিলে রাখল। প্লেট দুটো নিয়ে দরজার দিকে দুপা বাড়াতেই রৌদ্রুপ পিছু ডাকল,
“শোনো মেয়ে।”
নৈঋতা দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
“জি?”
“কারেন্ট কি আসবে না আজ?”
“আমাদের বাড়িতে কারেন্ট নেই।”
“ঘরে তো ইলেকট্রিক তার আর লাইট দেখছি।”
“এসব আগের। পাশের বাড়ি থেকে সাইড লাইন এনেছিল। তারা লাইন কে’টে দিয়েছে।”
“ওহ্ আচ্ছা। তুমি তো বেশ সুন্দর করে কথা বলতে জানো। পড়াশোনা করো?”
“আগে করতাম। এখন আর করি না। বাদ দিয়ে দিয়েছি।”
“কেন?”
“সমস্যা ছিল।”
“কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছ?”
“এক বছর আগে মেট্রিক পাস করেছি।”
“তাহলে তো এখন তুমি কলেজে পড়তে।”
নৈঋতা একটু বিষণ্ণ মুখে মাথা দোলালো। পড়াশোনাটা যে তাকে বাধ্য হয়েই ছাড়তে হয়েছিল। প্রসঙ্গ না বাড়িয়ে নৈঋতা বলল,”
“আপনার কিছু দরকার পড়লে ডাকবেন।”
“আচ্ছা।”
নৈঋতা রৌদ্রুপের দিকে না তাকিয়েই দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। রৌদ্রুপ পুনরায় পিছু ডাকতে গিয়েও থেমে গেল। মেয়েটার নামটাই তো জানা হলো না। কী যেন বলে ডেকেছিল তখন ওর মা? মনে পড়ছে না। রৌদ্রুপ বিছানা থেকে নেমে গিয়ে তোয়ালেটা নিয়ে হাত মুছল। যেই না মুখ মুছতে যাবে, ওমনি একটা মেয়েলি চুলের গন্ধ এসে নাকে লাগল। একটু আগে যে তোয়ালে দিয়ে নৈঋতা ভেজা চুল মুছেছিল, তারই গন্ধ এটা। ঠিক খেয়াল ছিল না তার। ভ্রু কুঁচকে রৌদ্রুপ আরও একবার গন্ধটা শুঁকে দেখল। তারপর কী ভেবে ঠোঁট বাঁকিয়ে মৃদু হেসে মুখ না মুছেই তোয়ালেটা পূর্বের জায়গায় রেখে দিলো।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here