কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে পর্ব -০৪

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৪.
আজ সকাল আর দুপুরের খাবারে মাছ-ভাত বেশ ভালোই লেগেছে রৌদ্রুপের কাছে। দিনটাও কে’টেছে বেশ। সারাদিনে সামসুদ্দীন আর নসিবের সাথে অনেক আলাপ হয়েছে। নসিব তাকে গ্রামের অনেক জায়গা ঘুরিয়ে এনেছে। এমনকি তার সাথে নদীতে গিয়ে একসঙ্গে গোসল করেছে। রৌদ্রুপ খেয়াল করেছে, নসিব খুব আগ্রহ নিয়ে তার সাথে গল্প করে। হয়তো রৌদ্রুপ তার কাছে আগ্রহের বিষয়। তবে আজ সারাদিনে নৈঋতা ভুল করেও রৌদ্রুপের মুখোমুখি হয়নি। সামনে পড়লেই মাথা নিচু করে সরে পড়েছে। মেয়েটা বোধ হয় একটু বেশিই লজ্জায় পড়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই সন্ধ্যা নেমেছে। রৌদ্রুপ হাতে ফোন নিয়ে গম্ভীর মুখে বিছানায় বসে আছে। ফোনটা চার্জের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে। আজ বিকাল পর্যন্ত সে বাড়িতে যোগাযোগ করতে পেরেছে। ফোন বন্ধ হওয়ার পর এখন পর্যন্ত একবারও বাড়িতে ফোন করা হয়নি। না জানি মা কত দুশ্চিন্তা করবে! ঝড়বৃষ্টির কারণে গ্রামের বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়েছে। এসব কবে ঠিক হবে কারোর জানা নেই। সামসুদ্দীন বেপারীর ছোটো ফোনটারও একই অবস্থা। পরিবারের সবাই যে কতটা দুশ্চিন্তায় আছে, তা রৌদ্রুপের অজানা নেই। তার নিজেরই প্রচুর খারাপ লাগছে সবার কথা ভেবে। যোগাযোগ করার সব উপায় বন্ধ। সন্ধ্যা থেকে সে উস-খুস মনে বসে আছে। দরজায় টোকা পড়েছে, হয়তো নসিব এসেছে। কিন্তু উঠে গিয়ে দরজা খুলতে ইচ্ছে করছে না। পরপর চারবার টোকা পরার পর একপ্রকার বাধ্য হয়ে গিয়ে দরজা খুলতে হলো। দরজার ওপাশে দাঁড়ানো মানবীর সঙ্গে এক মুহুর্তের দৃষ্টি বিনিময়ে রৌদ্রুপের উস-খুস মনটা ঝুপ করেই কেমন বদলে গেল। হয়তো একটু ভালো বোধ হলো। অথচ সে মানবী জানলও না তার অকস্মাৎ আগমন কারো মন খারাপটা উবে যাওয়ার কারণ হতে পারে।
“মা আপনের লাইগা পেয়ারা পাঠাইছে।”
নিজের হাতের বাটিটা রৌদ্রুপের দিকে বাড়িয়ে ধরল নৈঋতা। রৌদ্রুপ হাত বাড়াল না। বরং দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
“ভেতরে এসো, গল্প করি। নসিবকেও তো দেখছি না। একা-একা ভালো লাগছে না।”
মুখের ওপর নাকচ করতে না পেরে নৈঋতা চুপচাপ ঘরে ঢুকল। বাটিটা বিছানায় রেখে বলল,
“নসিব বাড়ি নাই।”
তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল,
“মমবাতির আলোয় থাকতে আপনের খারাপ লাগে?”
“ঠিক খারাপ লাগে না। আবার তেমন ভালোও লাগে না। অভ্যাস নেই তো। ফোনটা অন থাকলে ভালো হত। এত অলস সময় কা’টাতে হত না।”
রৌদ্রুপ বিছানায় উঠে বসে নৈঋতাকেও বসতে বলল। এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে নৈঋতা মাথা নিচু করে রইল। রৌদ্রুপ বাটি থেকে একটা পেয়ারা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে-দেখতে প্রশ্ন করল,
“এগুলো কি তোমাদের উঠানের ওই গাছের পেয়ারা?”
“হুঁ”, মৃদু স্বরে উত্তর দিলো নৈঋতা।
পেয়ারায় কামড় বসিয়ে রৌদ্রুপ সন্তুষ্ট হলো। বেশ মিষ্টি পেয়ারা। আরেকটা পেয়ারা নৈঋতার দিকে বাড়িয়ে ধরতেই সে নাকচ করে বলল,
“আমি খামু না।”
“এখন না খেলে পরে খাবে। নাও। বলেছিলাম না বড়োদের কথা শুনতে হয়?”
হাত বাড়িয়ে রৌদ্রুপের হাত থেকে পেয়ারাটা নিয়ে নৈঋতা পুনরায় মাথা নত করল। রৌদ্রুপ পেয়ারা খেতে-খেতে বলল,
“আঙ্কেলের থেকে তোমাদের ফ্যামিলির ব্যাপারে অনেক কথা জানলাম। সত্যিই খুব খারাপ লেগেছে। কিছু মনে কোরো না। শুনলাম তুমি না কি স্কুলের বেতন দেওয়ার জন্য কাজ করতে?”
নৈঋতা লজ্জা পেলেও মাথাটা মৃদু ঝাঁকিয়ে বলল,
“হ, তালুকদার বাড়ি পানি নিয়া দিতাম নদীর থিকা। মাসে যা টেকা দিত, তা দিয়া চইলা যাইত। কলেজ তো একটু দূরে। অত খরচও করতে পারমু না। তাই পড়াও ছাড়ছি, কামও ছাইড়া দিছি।”
নৈঋতার মুখে মলিন হাসি। রৌদ্রুপের মনটা আবারও একটু বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। একটু চুপ থেকে প্রশ্ন করল,
“এখনও পড়াশোনা করতে ইচ্ছা করে তোমার?”
“আর ইচ্ছা! এক বছর তো কাইটাই গেল। আব্বার কামাই আবার একটু ঠিক হইলেই হয়তো আমারে বাড়ি থিকা বিদায় করব।”
নৈঋতার তাচ্ছিল্যের স্বর শুনে রৌদ্রুপ ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কখনও সুযোগ পেলে আবার পড়াশোনা করবে?”
নৈঋতা এবার মৃদু শব্দ তুলে হেসে বলল,
“সুযোগ? যেইহানে দুইটা টেকা কেউ ধার দিতে চায় না, সেইহানে আমারে পড়ার সুযোগ দিবো কে? আমরা গরিবের ঘরের মাইয়া। কোনোরকম বড়ো হমু, তারপর কোনো পোলার গলায় ঝুলাইয়া দিতে পারলেই বাপ-মা নিশ্চিন্ত। সারা গ্রাম জুইড়া এমনটাই দেইখা আইছি। তা-ও তো আমি নিজে কাম কইরা পড়াশোনা করছি, অন্যরা তা-ও করেনায়।”
রৌদ্রুপের আবারও নিরব হয়ে গেল। হঠাৎ এসে মন ভালো করা রমণী নিজেই আবার নিজ দায়িত্বে মনটা খারাপ করে দিয়েছে যে। প্রসঙ্গ ঘুরানোর চেষ্টা করে নড়েচড়ে বসে মুখে কিঞ্চিত হাসির রেখা টেনে বলল,
“তোমাদের গ্রামটা কিন্তু খুব সুন্দর। মনোরম পরিবেশ। আমার ভালো লেগেছে।”
“পদ্মদিঘী দ্যাখছেন?”
“পদ্মদিঘী! না, তা তো নসিব দেখাল না।”
“দ্যাখলে মন ভইরা যাইত। অনেক সুন্দর দৃশ্য। আমি মাঝেমাঝে যাই”, মুচকি হেসে বলল নৈঋতা।
“আমাকে নিয়ে যাবে?” একপ্রকার বায়না করে বসল রৌদ্রুপ।
নৈঋতা আবারও পড়ল বিপাকে। রৌদ্রুপ যেহুট করে এমন বায়না ধরে বসবে কে জানত? মেহমান মানুষ, না-ও বলা যাবে না। কিন্তু সে কীভাবে নিয়ে যাবে। গ্রামের মানুষ দেখলে তিল থেকে তাল করে ছাড়বে। তবু সে ঘাড় কাত করে বলল,
“আইচ্ছা।”
“কবে যাবে?”
“আগে মায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করতে হইব।”
“ওকে, আমি নিজেই বলব আন্টিকে। তুমি আমাকে পদ্মদিঘী দেখাবে, বিনিময়ে আমি তোমাকে এত্তগুলো চকোলেট খাওয়াব।”
নৈঋতা এবার ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে ফেলল। তার মুখের অভিব্যক্তিই প্রকাশ করল সে চকোলেট পছন্দ করে। তার এটুকু খুশির কারণ হতে পেরেই রৌদ্রুপ যেন মনে এক আলাদা প্রশান্তি অনুভব করল। আনমনে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নৈঋতার প্রাণবন্ত বদনপানে। সামনের যুবকের দৃষ্টির প্রখরতা নৈঋতার কোমল মনে উদ্বেগের সৃষ্টি করল। ‘হৃদপিন্ড’ নামক যন্ত্রটা হঠাৎ করেই কাঁপুনি দিয়ে উঠল। লজ্জায় নত মুখটা তুলে দ্বিতীয়বার আর তাকানোর সাহস হলো না। আবার যদি ওই স’র্বনা’শা চোখ দুটোর সাথে দৃষ্টি বিনিময় হয়ে যায়! আশ’ঙ্কি’ত মনে নিয়ে সহসা উঠে দাঁড়িয়ে সবেমাত্র দুপা বাড়াল দরজার দিকে। তখনই আবার সেই পিছুডাক,
“শোনো মেয়ে।”
নৈঋতা দাঁড়াল। ঘুরে না দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল পরবর্তী বাক্যটুকু শোনার। নৈঋতার দুরুদুরু বুকে উত্তাল ঢেউ তুলে রৌদ্রুপ মোহনীয় কন্ঠে বলল,
“মন ভালো করার দায়িত্ব নিবে? ভূ’মিক’ম্পের মতো হুট করে আসবে, ক্ষণিকের জন্য মুখোমুখি বসবে, চোখে চোখ রেখে ওষ্ঠ জোড়া প্রসারিত করবে। ব্যাস, এটুকুই।”
এত ভারী কথা বুঝি নৈঋতার কোমল মন সইতে পারে? তাকে তো জগতের সমস্ত লজ্জারা এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরেছে। নিঃশ্বাসটাও যেন নাসারন্ধ্রে আটকে পড়েছে। পা দুটো আর থামিয়ে রাখা হলো না। চঞ্চল হরিণীর ন্যায় ছুটে পালাল। যেন পালাতে পারলে তবেই সে প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারবে। শ্বাসটুকু যে আটকে দিয়েছে ওই শহুরে অতিথির স’র্বনা’শা বাক্য।

আজ সকালে আবার নৈঋতার সাথে নদীর ঘাটে গিয়েছিল রৌদ্রুপ। বাড়ি ফিরতেই দেখল বাড়িতে গন্ডগোল বেঁধেছে। একজন মহিলা আর একজন পুরুষ নৈঋতার বাবা-মায়ের সাথে চেঁচামেচি করছে। রৌদ্রুপ কিছু বলার আগেই নৈঋতা কাঁখের কলস উঠানে রেখে সেদিকে ছুটে গেল। অগত্যা রৌদ্রুপও তার পিছু নিল। তারা গিয়ে ওই মহিলা-পুরুষকে থামানোর চেষ্টা করল। এতে মহিলা আরও ক্ষেপে গেল। রৌদ্রুপ কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারল এদের থেকে নৈঋতার বাবা টাকা ধার এনেছিলেন আরও দেড় মাস আগে। কিন্তু এখনও শোধ করতে পারেননি। তবু তারা এ কদিন টাকার জন্য তেমন তাগাদা দেননি। কিন্তু গতকাল না কি তাদের স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে নসিব নে’শা করিয়েছে। সে কারণেই তারা চরম খেপে গেছেন। নসিবসহ তার বাবা-মাকে গা’লিগা’লাজ করে এখন পাওনা টাকা ফেরত চাইছেন। সামসুদ্দীন বেপারী দিশা না পেয়ে তেড়ে গেলেন ছেলেকে মা’রতে। অদূরেই নসিব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। সামসুদ্দীন বেপারী তাকে মা’রতে উদ্যত হতেই রৌদ্রুপ দৌড়ে গিয়ে তাকে থামিয়ে দিলো। নসিবের সামনে থেকে সামসুদ্দীন বেপারীকে সরিয়ে এনে রৌদ্রুপ ঝগড়ায় মগ্ন মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“দয়া করে থামুন। এভাবে তো কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। আপনারা কত টাকা পাওনা?”
মহিলার রাগত চেহারা দেখে মনে হলো এই মূহূর্তে রৌদ্রুপের ওপরও তিনি বিরক্ত। তেতে উঠে বললেন,
“দ্যাড় আজার টেকা আনছে আরও এক মাস আগে। অহনও ফিরত দেওয়ার নাম নাই। হেরপর আবার ওনাগো ওই ছ্যাঁ’চড়া পোলায় আমার পোলাডারে নষ্ট করার তাল করছে। বাপের নাই দুই আনা কামাই, আর পোলায় অহনই গা’ঞ্জা খাওয়া শুরু করছে।”
রৌদ্রুপ অবাক চোখে একবার নসিবকে দেখল। হাত তুলে বলল,
“আচ্ছা থামুন, আর ঝগড়া করবেন না। চুপ করে একটু দাঁড়ান এখানে।”
কারো প্রত্যুত্তরের আশা না করে রৌদ্রুপ দ্রুত পায়ে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। তবে মহিলা বা পুরুষ কেউই থামলেন না। দ্বিগুণ হারে চেঁচাতে লাগলেন। দুই মিনিটের মাথায় রৌদ্রুপ ফিরে এল। তার হাতে ওয়ালেট। ওয়ালেট থেকে একটা এক হাজার আর একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে মহিলার দিকে এগিয়ে ধরল। উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে রৌদ্রুপের দিকে তাকিয়ে রইল। সামসুদ্দীন বেপারী ব্যস্ত হয়ে বললেন,
“আরে বাবা, তুমি টেকা দিতাছো ক্যান?”
রৌদ্রুপ মহিলাকে বলল,
“টাকাটা নিয়ে চলে যান আন্টি। ওনাদের দেনা পরিশোধ হয়ে যাবে।”
মহিলা রৌদ্রুপের হাত থেকে টাকাটা নিয়ে আফিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে কঠিন কন্ঠে বললেন,
“আপনের পোলা যেন আর কোনোদিন আমার পোলার ধারেকাছে না ঘেঁষে। সাবধান কইরা দিয়েন। এইবারের মতো ছাইড়া দিলাম। এরপর কিন্তু আমরা এত সহজে ছাইড়া দিমু না।”
মহিলা আর তার স্বামী হনহন করে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। সামসুদ্দীন বেপারী অপরাধীর মতো তাকিয়ে বললেন,
“তোমার পকেটের টেকা ক্যান খরচ করলা কও তো? তুমি আমগো মেহমান। আমরা একটু ভালা খাওন পর্যন্ত খাওয়াইতে পারি না, আর তুমি-”
“আমি কিন্তু আপনাদের ছেলের মতো আঙ্কেল। মেহমান বলে কি সাহায্য করতে পারি না?” সামসুদ্দীনকে থামিয়ে দিয়ে বলল রৌদ্রুপ।
সামসুদ্দীন বেপারী অনেকটা সময় উস-খুস করলেন। নৈঋতা নিরব চোখে চেয়ে রইল মানুষটার দিকে। তার দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা। আফিয়া বেগম বললেন,
“তোমার বাপ-মা ভাইগ্যবান গো বাপ। এমন সোনার টুকরা পোলা পাইছে। কত ভালা মানুষ তুমি!”
রৌদ্রুপ মুচকি হাসল। রৌদ্রুপের সাথে কথা বলার সময় হুট করেই সামসুদ্দীন বেপারী উঠানের থেকে একটা গাছের ডালা কুড়িয়ে নিয়ে তেড়ে গেলেন নসিবের দিকে। নৈঋতা আর রৌদ্রুপ দ্রুত তাকে ধরে আটকে দিলো। সামসুদ্দীন ওদের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে-করতে ছেলের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন,
“কুলাঙ্গার পোলা। তোরে কতবার কইছি এইটুকুন বয়সে ছাইপাশ গিলিস না? তোর লাইগা কি আমি গেরামে মুখ দেহাইতে পারমু না?”
নসিব কোনো কথা না বলে চুপচাপ এক জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। রৌদ্রুপ আফিয়া বেগমকে বলল,
“আন্টি, আঙ্কেলকে এখান থেকে নিয়ে যান।”
আফিয়া বেগম সামসুদ্দীন বেপারীর হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে যেতে-যেতে বললেন,
“লন, পোলা তো অমানুষ হইছে কবেই। অহন আর চিল্লাইয়া নিজের শইল খারাপ করা ছাড়া আর কিছুই হইব না।”
তারা চলে যেতেই নৈঋতা এগিয়ে গিয়ে নসিবের এক বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে শক্ত মুখে বলল,
“তোরে বারবার মানা করছি না ওইসব খাবি না? তোর বয়স কত খেয়াল আছে? এইবার কে খাওয়াইছে তোরে?”
নসিব গোমড়া মুখে উত্তর দিলো,
“কায়েস ভাই।”
সঙ্গে-সঙ্গে নৈঋতা সজোরে এক থা’প্পড় বসাল নসিবের গালে। নসিব অভিযোগ না তুলে মাথা নিচু করে একহাতে গাল ঘষতে লাগল। সচরাচর ভাইয়ের গায়ে হাত তোলার অভ্যাস নেই নৈঋতার। তাই ভাইকে মে’রে তার নিজের চোখেই পানি এসে গেল। শক্ত মুখ করে ধরা গলায় বলল,
“ওই জা’নোয়ারের কাছে গেছস কোন আক্কেলে? তুই জানস না ও কেমন? আমার লগে কেমন ব্যবহার করে জানস না? তারপরও ওর কাছে গেলি? ওর মতো হইতে চাস তুই? পথেঘাটে মাইনষের মা’ইর খাবি কইলাম।”
নৈঋতার কথা সম্পূর্ণ না বুঝলেও কিছু একটা আঁচ করতে পারল রৌদ্রুপ। সে এগিয়ে গিয়ে নৈঋতার থেকে নসিবকে ছাড়িয়ে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করল,
“তুমি সবসময় নেশা করো?”
নসিব ডানে-বায়ে মাথা দোলালো। রৌদ্রুপ পুনরায় প্রশ্ন করল,
“তাহলে? কতদিন পর-পর করো?”
“মাঝে-মাঝে গেরামের বড়ো ভাইরা দিলে করি।”
“তোমার বয়স কত?”
“ষোলো বছর।”
“এত কম বয়সে এসব বাজে অভ্যাস কত খারাপ তা জানো না? এতে তো তোমার নিজেরই ক্ষ’তি হবে। অসুস্থ শরীর নিয়ে বাঁচতে চাও তুমি?”
“আমগো আবার সুস্থ শইল! বাপের নাই এক টেকা কামাই। জীবনে ভালা কিছু পাইছি? লেহাপড়া করমু তা-ও করতে পারি নাই। কাম করমু, তা-ও পাই নাই কোনোহানে। হেরপর চাইছি শহরে গিয়া কাম করতে। আমার মায় তা-ও যাইতে দিব না। তয় এই গেরামে বইয়া থাইকা আমি কী করমু? আজীবন খালি ডাইল-ভাত খামু আর নেশা করমু?” তাচ্ছিল্যের স্বরে নিজের মনের ক্ষোভ ঝাড়ল নসিব।
নৈঋতা চোখের পানি মুছতে-মুছতে বলল,
“মা কি সাধে তোরে যাইতে দেয় না? এইটুকুন বয়সে তুই একলা শহরে যাইতি ক্যামনে? গেলে তোরে কাম দিত কে, আর তুই থাকতিই কই?”
“রাস্তাঘাটে থাকতাম। তবুও তো তোগো ঠা’ডা পড়া সংসারে পইড়া থাকতে হইত না।”
খ্যাপা নসিবকে শান্ত করার চেষ্টা করে রৌদ্রুপ বলল,
“থামো নসিব। আমার কথা শোনো। তুমি এখনও খুব ছোটো। বুঝলাম তুমি পড়াশোনা করতে পারোনি বা ভালো কিছু পাওনি। তাই বলে নেশা করবে? তোমার বাবাকে দেখো। সে তো ভালো কিছু না পেয়েও তোমাদের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দেওয়ার জন্য সারাদিন কত পরিশ্রম করেন। তার তো তোমার থেকে দ্বিগুণ কষ্ট হয়। তাই বলে কি সে নেশা করে? আর বাবা-মায়ের কথার অবাধ্য হওয়া উচিত না, জানো না তুমি? তুমি এভাবে বাউণ্ডুলে হয়ে না ঘুরে যদি তোমার বাবার কাজে সাহায্য করতে, তাহলে তার কষ্টটা অনেক কমতো। তাছাড়া দুজন মিলে কাজ করলে তোমাদের সংসারেরও উন্নতি হত।”
নসিব গাল ফুলিয়ে বলল,
“আমি ওই ক্ষেতে কাম করতে পারমু না। আমার অভ্যাস নাই।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি ভালো কাজ করবে তো? আমি তোমাকে কাজ দিব। আমি ঢাকায় ফিরে তোমার জন্য কোনো ভালো কাজ খুঁজব। পেলেই তোমাকে নিয়ে যাব।”
নসিবের দুচোখ খুশিতে চকচক করে উঠল। গদগদ কন্ঠে সে বলে উঠল,
“হাছা-হাছাই নিবেন ভাই?”
“হ্যাঁ, কিন্তু একটা শর্ত আছে”, মুচকি হেসে বলল রৌদ্রুপ।
নসিব আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল,
“কী শর্ত?”
“তোমাকে কথা দিতে হবে যে এখন থেকে ভালো ছেলে হয়ে চলবে। কোনোভাবেই নে’শা করা যাবে না, আর খারাপ ছেলেদের সাথে মেশা যাবে না। তুমি এতে রাজি থাকলে তবেই আমি তোমার জন্য ভালো কাজ খুঁজে দিবো। বলো, রাজি আছো?”
নসিব কোনো কিছু না ভেবেই দ্রুত ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল। আনন্দিত হয়ে বলল,
“হ ভাই। আপনে আমারে ভালা কাম ঠিক কইরা দিলেই হইব। আমি সব কতা হুনমু। কতা দিলাম।”
“আচ্ছা”, হাসিমুখে বলল রৌদ্রুপ।
নৈঋতা বেশ খুশি হলেও পরমুহূর্তেই তার কিছু একটা মনে পড়ল। নসিবের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করল,
“নসিব, কায়েস বাই নিজেই তোরে ডাকছিল?”
“হ।”
“ক্যান ডাকছে? খালি নে’শা করানের লাইগা?”
“না।”
“তাইলে?”
“শহরের থিকা আমগো বাইত কে আইছে আর ক্যান আইছে তা জিগানের লাইগা।”
“তুই কী কইছোস?”
“কইছি আমগো এক আত্মীয় বেড়াইতে আইছে। পরে আবার তোর কতাও জিগাইছে।”
“কী জিগাইছে?”
“তুই মেহমানের ধারেকাছে যাস কি না তা জিগাইছে। আমি কইছি মেহমানের দেহাহুনা করার লাইগা তো যাইতে হয়ই।”
নৈঋতা মুখ ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। মুখ দেখে মনে হলো সে রাগে ফেটে পড়ছে। শক্তপোক্ত মুখে সে হনহন করে ঘরে চলে গেল। রৌদ্রুপ এসবের কিছুই বুঝতে পারল না। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে নৈঋতার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইল। নৈঋতা চলে যেতেই রৌদ্রুপ নসিবকে বলল,
“নসিব, চলো তো আমার সাথে।”
“কই?”
“বাজারে যাব একটু। তোমাদের এখনকার বাজার কতদূর?”
“বেশি দূরে না। দশ মিনিটের পথ। কী করতে যাইবেন?”
“দরকার আছে। চলো।”

ব্যাগ ভর্তি বাজার দেখে আফিয়া বেগমের চোখ কপালে উঠে গেল। তিনি মাথায় হাত দিয়ে আহাজারি করে বললেন,
“হায় হায়! এ কী করছো বাপ? এত টেকা খরচ কইরা বাজার করতে গেছ ক্যান? মেহমান হইয়া তুমি বাজার করতে গেছ! আমগো টেকা-পয়সা নাই দেইখা এই কাম করবা তুমি?”
রৌদ্রুপ মুচকি হেসে বলল,
“এসব বলবেন না আন্টি। আমি হঠাৎ এসে আপনাদের কত বিপদে ফেলে দিয়েছি, তা বুঝতে পারছি আমি। সবসময় তো আর সবার সাংসারিক অবস্থা এক থাকে না। এটুকু করতে দিন আমায়। আমি চাই না আপনারা আমার জন্য কষ্ট পান। এই নৈঋ, ব্যাগগুলো নিয়ে যাও।”
নৈঋতা পাশে দাঁড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। রৌদ্রুপের ডাকে এগিয়ে গিয়ে বাজারের ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। নসিবের মাথায় চালের বস্তা ছিল। সে-ও তা রাখার জন্য নৈঋতার পিছু নিল। নৈঋতাকে ‘নৈঋ’ নামটা আজ সকালেই রৌদ্রুপ দিয়েছে। নদীর ঘাটে যাওয়ার সময় রৌদ্রুপ বলেছিল সে নৈঋতা না, নৈঋ বলে ডাকবে। নৈঋতা আপত্তি করেনি, বরং ব্যাপারটা তার বেশ লেগেছে। কারণ বাবা-মাসহ গ্রামের সবাই তাকে সংক্ষেপে রিতা বলে ডাকে। শুধু তালুকদার বাড়ির দু-এক জন নৈঋতা বলে ডাকে। রৌদ্রুপের মুখে ‘নৈঋ’ নামটা খুব মিষ্টি লাগে নৈঋতার কাছে। ডাক শুনলেই মুখে আপনা-আপনি হাসি ফুটে ওঠে। নৈঋতার ধারণা এই অসাধারণ লোকটা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে দক্ষ।
আজ দুপুরের ভোজনটা সবারই বেশ জমজমাট হয়েছে। যদিও সামসুদ্দীন বেপারী খেতে বসে রৌদ্রুপের কাণ্ডের জন্য আফিয়া বেগমের মতোই আহাজারি করেছেন। তবু অনেকদিন পর যেন সবাই খুব তৃপ্তি সহকারে খেয়েছেন। খেতে বসেই রৌদ্রুপ নৈঋতার বাবা-মায়ের সামনে পদ্মদীঘি দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। তাতে কেউই আপত্তি জানায়নি। নৈঋতা অবশ্য আগেই আফিয়া বেগমকে বলে রেখেছিল যে মেহমান পদ্মদিঘী দেখতে যেতে চায়। আফিয়া বেগম সঙ্গে-সঙ্গে নৈঋতাকে বলে দিয়েছেন রৌদ্রুপ যেখানে যেতে চায় সেখানেই নিয়ে যেতে। সঙ্গে করে নৈঋতা বা নসিব যাকে নিতে চায়, সে-ই যেন যায়। মোটকথা মেহমানের কোনো কথা ফেলা যাবে না।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here