#কোনো_এক_বসন্তে
#Khadija_Akter
#পর্ব_০৬
এবার আর নক না দিয়ে সরাসরি দরজার হাতল ঘুরিয়ে দরজাটা একটুখানি ফাঁক করে মাথাটা ভিতরে ঢুকিয়ে উঁকি দিলাম।
রুমের সমস্ত ফ্লোর জুড়ে সিগারেটের শেষ হওয়া অংশ ও নিঃশেষিত ছাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।সব জিনিসপত্রই অগোছালো হয়ে আছে।
সোফার কুশনগুলো নিচে সিগারেটের ছাইয়ের সাথে গড়াগড়ি খাচ্ছে।কম্পিউটার ডেস্কের উপর থেকে কীবোর্ডটা নিচে পড়ে গিয়েও যায়নি,তারের সাথে লটকে আছে।
বিছানার চাদর সমস্তটা কুচকে মাঝামাঝি এসে জড়ো হওয়া,দেখা যাচ্ছে ম্যাট্রেস।
আর এরই মাঝে চার হাত পা ছড়িয়ে উবু হয়ে শুয়ে আছেন আহিল ভাই।
এই কি অবস্থা ঘরের!এই তাহলে উনার ইম্পোর্ট্যান্ট কাজের নমুনা!এটা কি সত্যিই সেই গুছালো ছিমছাম সিরিয়াস মাইন্ডের আহিল ভাই ও তার রুম!
আমি বিস্ময়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়ে দরজাটা আরেকটু খুলতেই ক্যাচক্যাচ করে আওয়াজ করে উঠলো।সেই শব্দে আহিল ভাই মাথাটা সামান্য একটু উঠিয়ে মাদকময় জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলেন,
–কে?
…..ও তনু!
তুমি আবার এসেছ জ্বালাতে আমাকে?কতবার বলেছি,আর আসবে না।তুমি শুধুই আমার কল্পনা আর কিছু নও,আমি তা বুঝে গেছি।আর বিশ্বাস করছি না তোমায়….যাও প্লিজ চলে দাও।একা থাকতে দাও আমায়।
নিচু স্বরে আরও কিছু বলতে বলতে আহিল ভাই আবারও মাথাটা নামিয়ে আগের মতোই পড়ে রইলেন।আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম,কি হচ্ছে!
আয়রা এতক্ষণ চুপচাপ আমার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল।ভাইয়ার কন্ঠ শোনামাত্রই এবার ওর ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙে গেল।সেও আমার মতো দরজার ফাঁক গলিয়ে মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিতে চাইলো।
আমি সাথে সাথেই থামিয়ে দিলাম আয়রাকে।দরজাটা টেনে বাহিরে থেকে লাগিয়ে দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলাম আয়রা সামনে।
–আয়রা মনি,আমরা তো চলেই এসেছি এখন ভাইয়ার কাছে তাইনা বলো?
খুশিতে আয়রার চোখ চকচক করে উঠে,হাততালি দিয়ে উঠে সে।গদগদ হয়ে বলে,
–হ্যাঁ তনয়া আপ্পি।ইয়েএএএ আমরা চলে এসেছি।আসো যাই রুমের ভিতর।
–হুম যাব তো।কিন্তু আয়রা তুমি তো অনেক্ষন অপেক্ষা করেছো ভাইয়ার জন্য,তোমাকে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে যে পাখি?
আহিল ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দিব আমরা,কেমন?
–কিন্তু কিভাবে আপ্পি?
–শুনো,আমি আগে রুমে যাব,আহিল ভাইয়াকে বলবো আমি একাই এসেছি।একটুপর তোমাকে যখন ডাকবো,তখন তুমি রুমে আসবে আর আহিল ভাইয়া তোমাকে দেখে চমকে যাব।
আইডিয়াটা কেমন বলো তো?
–ওয়াও!দারুন আইডিয়া তো আপ্পি।
অক্কে তুমি আগে যাও,আমি ওয়েট করছি এখানে।
আয়রাকে রেখে এবার আমি উঠে দাঁড়ালাম।আসলে আমি চাচ্ছিলাম না,আয়রা ওর আইডল আহিল ভাইয়াকে এই অবস্থায় দেখুক!এরকম এলোমেলো আহিলকে নিশ্চয়ই এর আগে কখনো দেখেনি ও।হঠাৎ করে এরকম দেখলে,ওর বাচ্চা মনে চাপ পড়তে পারে।
আহিল ভাইয়ের কি হয়েছে আগে সেটা জানতে হবে আমায়।আমাদের বাসা থেকে আসার সময় তো বেশ ভালোই ছিলেন,এই দুইদিনে কি এমন হয়ে গেল!
আস্তে করে রুমে ঢুকে ভিতর থেকে দরজাটা আটকে দিলাম।
ধীরপায়ে বিছানার কাছে গিয়ে,আলতো করে আহিল ভাইয়ের পিঠে হাত দিয়ে মিহি সুরে ডাকলাম,
–আহিল ভাই!
একইসাথে স্পর্শ আর কন্ঠ শুনে যেনো ২২০ ভোল্টের শক খেলো আহিল ভাই।মাথাটা তুলে আমাকে দেখেই,এক লাফে বিছানায় উঠে বসলো।
–তনু তুই?এটা কি সত্যি তুই?
–আজব!মিথ্যা হতে যাব কেন আমি?আর এই কি অবস্থা করে রেখেছেন আপনি নিজের! রুমের অবস্থাটাও একদম যাচ্ছেতাই।আর আপনি সিগারেটও খান?কই আগে দেখিনি তো!
আপনার কি হয়েছে বলুন তো?এতো এলোমেলো লাগছে কেন?
আমি যতক্ষণ কথা বলছিলাম আহিল ভাই এক পলকে নির্নিমেষ চেয়ে রইলো আমার দিকে।আমার কথা শেষ হতেই যেনো সম্বিৎ ফিরে পেলেন উনি।
রুমের চারদিকে একবার একনজর দেখে নিয়ে,যেনো সেও এতক্ষণে বুঝতে পারলো।আসলেই তো,কি অবস্থা করে রেখেছে সে!
পরক্ষণেই আমার চোখে চোখ রেখে আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে এলো আহিল ভাই।
দুইহাত চুলের মধ্যে চালান দিয়ে,এলোমেলো চুলগুলোকে ঠিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে উনি আমার দিকে এগিয়ে আসছেন।।আমি এক পা,দুই পা করে পিছাতে পিছাতে কম্পিউটার ডেস্কের সাথে এসে ভীড়লাম।
অসম্ভব লাল হয়ে আছে আহিল ভাইয়ের চোখ,নাক-মুখও কেমন ফোলা ফোলা।একটা থ্রী কোয়ার্টার প্যান্টের সাথে পাতলা নীল টি-শার্ট পড়ে পাহাড়সম দেহ নিয়ে আহিল ভাই যখন একদম আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।আমি অজানা একটা অনুভূতিতে কেমন যেনো সিটিয়ে গেলাম।
আমাকে এরকম গুটিয়ে যেতে দেখে আহিল ভাই বুঝলেন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই আমার কাছাকাছি চলে এসেছেন তিনি।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই আরেকটু পেছনে সরে গেলেন উনি।
তারপর আচমকাই দুইহাত বাড়িয়ে আমার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে ব্যগ্র কন্ঠে উনি এক প্রকার আর্তনাদ করে উঠলেন,
–তুই জানতে চাস না,আমার এই অবস্থা কেন?বললে কি বিশ্বাস করবি?যদি বলি “আমার এই অবস্থা শুধু তোর জন্য তনু!” বিশ্বাস করবি বল?
আমি এবারে গুলিবিদ্ধ হরিণীর মতো চমকে গিয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকালাম আহিল ভাইয়ের দিকে।উনার চোখে যেনো রাশি রাশি বেদনারা খেলাধুলা করছে।কি স্বচ্ছ কিন্তু গভীর এই চোখ আর চোখের ভাষাগুলো। সাথে সাথেই আমি আবার চোখ নামিয়ে নিলাম।এই চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাচ্ছিল মা।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবারও মাথা তুললাম আমি।চোখ দুটিকে নাচিয়ে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে জানতে চাইলাম,
–কি বলেন আহিল ভাই!আমার জন্য?
আহিল ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার বাহু থেকে হাত সরিয়ে নিলেন।তারপর জানালা দিয়ে বাহিরের গাঢ় অন্ধকার দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিলেন,
–হ্যাঁ তোর জন্য।
জানিস তনু,আমার জীবনে একে একে ২৮টি বসন্ত এসে আবার বিদায় নিয়ে চলে গেছে।
আমি এখন পর্যন্ত আমার বাগানে ফুল ফোটাতে দেইনি কোনো মেয়েকে।
প্রথম ১৮টি বসন্ত গেল,তখন আমার বাগান পরিপক্ব হয়নি ফুলের শোভায় মন্ডিত হওয়ার জন্য।
কিন্তু গত ১০টি বসন্ত!
কত মেয়ে আসতে চাইলো আমার জীবনে,কাউকেই আমি অনুমতি দিলাম না আমার মনের বাগানে ফুল ফোটানোর জন্য।
কারণ আমি অপেক্ষা করছিলাম,সেই মেয়েটির যাকে আমি আমার ১৩বছর বয়স থেকেই কামনা করে আসছি একমনে।
ছোট বেলায় যখন আমাদের বিয়েটা হয়,তোর বয়স ছিল মাত্র ৩ বছর তনু;আর আমার ১৩।
তখন তুই কিছু না বুঝলেও আমি অনেক কিছুই বুঝতাম,জানতাম।
সেই ১৩ বছর বয়স থেকে আমি অপেক্ষা করে আসছিলাম,তুই কবে পরিপক্ব হবি আমাকে বুঝার জন্য।
আর অবশেষে যখন মনে হলো,এই বুঝি বহু প্রতীক্ষার পর আমার জীবনে সেই প্রত্যাশিত বসন্তটি আসতে চলেছে।
সময় এসেছে এবারে তোকে সামাজিক রীতিনীতি মেনে বিয়ে করে সারাজীবনের জন্য আমার নামের সাথে জড়িয়ে নেওয়ার।
কিন্তু আমার গত ১৫ বছরের নীরব ভালোবাসা প্রকাশ করার আগেই তুই পরিষ্কার জানিয়ে দিলি তুই আমাকে চাস না!তুই এই আহিলকে চাস না!চাস না তুই এই রোবটকে।
কথার মাঝখানেই মনের ক্ষোভে সজোরে দেওয়ালে একটা একটা ঘুষি মেরে বসে আহিল।তারপর দেওয়ালের উপর হাতটা রেখেই তার উপর নিজের মাথাটা ভর করে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চোখ বন্ধ করে।
এদিকে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।কান ঝা ঝা করছে আমার!আমি কি শুনছি এগুলো!আহিল ভাই আমাকে ভালোবাসে!
একটু পর খুব শান্ত গলায় আহিল ভাই আবার বলতে শুরু করে,
–যাকে ভালোবাসি তার মরা মুখ কি করে দেখি বলতো তনু?আমি তো তোকে জোর করে বিয়ে করতে গেলে তুই সুইসাইড করতি তাইনা?
আমি এখন আর কি করতে পারি বল ?আমিও তো মানুষ, আমারও মন আছে,অনুভূতি আছে আর আমিও কষ্ট পাই!আমি রোবট নই রে!
আমি চেয়েছিলাম তুই আসার আগে আগেই নিজের জীবনটা যতটা পারি গুছিয়ে নেই,প্রতিষ্ঠিত করে নেই নিজেকে।তাই সারাদিন কাজ নিয়েই পড়ে থাকতাম।
তুই আসলে নাহয় আমি আমার মনের অনুভূতির সব দরজাগুলো খুলে দিব।সবটা উজার করে তোকে ভালোবেসে ভরিয়ে দিব।
জানিস তনু,সময়ের আগে তোকে আমি আমার মনের অনুভূতিগুলো জানতে দিতেও চাইনি,বয়স কম যদি বিগড়ে যাস!
কিন্তু যখন মনে হলো উপযুক্ত সময় এসেছে তোকে সবটা জানাবার। তখন বুঝতে পারলাম আমি হেরে গেছি ইতিমধ্যে। আমি ব্যর্থ হলাম তোকে নিজের করে পেতে।
বিয়ে নামক যেটুকু সম্পর্কই এখনো যুক্ত আছে তোর আমার নামের সাথে,ঐটুকুও তিন্নির বিয়ের পর শেষ হয়ে যাবে রে।
আমি মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে থ হয়ে শুনছিলাম আহিল ভাইয়ের কথা।প্রতুত্তরে উনাকে কিছু বলার মতো শক্তিও আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই।মনে হচ্ছে আমি কোনো বিষাক্ত ঘোরের মধ্যে আছি।আর কোনোভাবেই এই ঘোর থেকে বের হতে পারছি না!
সম্বিত ফিরে পেলাম দরজায় নক করার শব্দে।
আহিল ভাইও সচকিত হয়ে দরজার দিকে তাকালো।তার পরপরই আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখের ভাষায় জানতে চাইলো,’বাহিরে কে?’
দীর্ঘ সময় পর আমি এবার কথা বললাম।কাঁপা কাঁপা একদম মিহিয়ে যাওয়া কন্ঠে বললাম,
–আয়রা এসেছে আমার সাথে।আপনার সাথে দেখা করার জন্য জেদ করছিল সকাল থেকে।সবার কাছ থেকে লুকিয়ে ওকে আমি নিয়ে এসেছি আপনার কাছে।
তারপর দুজনে ঝটপট মিলে রুমটা যতটা গুছানো যায় গুছিয়ে ফেললাম।আহিল নিজেও পরিপাটি করে নিল নিজেকে।
দরজা খুলে দিয়ে আয়রাকে দেখেই নিজের কোলে তুলে নিল আহিল।
যতক্ষণ এই বাসায় থাকলাম,দুই-ভাইবোনের খুনসুটি দেখে গেলাম চুপচাপ।
আব্দুল চাচার আনা নাস্তা খেতে খেতে আহিল-আয়রার বিপরীত পাশের সোফায় বসে আজ প্রথমবারের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলাম আহিল ভাইকে।
আমার দিকে ধ্যান নেই উনার,আয়রাকে নিয়ে মজা করতে ব্যস্ত আছেন।
তাই নির্বিঘ্নে আহিল ভাইকে পর্যবেক্ষণ করে গেলাম আমি।
————————
রাত প্রায় ৯টা।
আমি আয়রাকে তাড়া দিলাম,এবার যেতে হবে।
আয়রা কিছুতেই আসতে চাইছে না আহিলকে ছেড়ে।
আহিল ভাই বললো,
–থাক না আর কিছুক্ষণ।
–না,আহিল ভাই।বললামই তো বাসায় না বলে এসেছি।সবাই তো চিন্তা করবে।আপনিই বরং চলে আসুন না একেবারে?তাহলেই তো আয়রা আর ঝামেলা করবে না।
–নাহ্,আজ না।কাজ শেষ হয়নি আমার এখনো।
২দিন পর যাচ্ছি আমি ঐ বাসায়।
আসার সময় আর রিকশায় করে আসতে হলো না।কারণ আহিল ভাই এই রাত্রিরে আমাদের একা ছাড়তে চাইলেন না।আহিল ভাইয়ের বাইকে করে যাচ্ছি বাসায় এখন।
আহিল ভাইয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে আহিল পিছনে বসেছে আয়রা,আয়রা পিছনে আমি।
যদিও আমি বাইকে আসতে চাইনি,কখন কে আবার দেখে ফেলে বলা তো যায় না!কিন্তু আহিল ভাই আশ্বস্ত করলো,”বাসার বেশ কিছুটা আগেই আমাদের তিনি নামিয়ে দিবেন।চিন্তার কিছু নেই।”
অর্ধেক রাস্তায় আসতেই শীতে আমার শরীর শিরশির করতে শুরু করেছে।এই কিছুদিনে শীত একদম ঝাঁকিয়ে বসেছে যেনো।
যখন বাসা থেকে বেরিয়েছিলাম,এতো বেশি শীত ছিল না,তাই সোয়েটার নেওয়ার কথাও মাথায় আসেনি।আর এখন একে তো রাতের বেলা আবার বাইকে চড়াতে শা শা করে বাতাস বয়ে যাচ্ছে শরীরের উপর দিয়ে।দাঁতে দাঁত ঠকঠক করতে করতে বললাম,
–আহিল ভাইয়া,একটু আস্তে চালান প্লিজ।
শীতের চোটে আমার কথা একজন মুমূর্ষু রোগীর মতো শুনালো।কি কারণে আস্তে চালাতে বলেছি,কারণটা না বললেও যে কেউ বুঝে যাবে আমার বর্তমান অবস্থাটা।
বাইকের গতি কমাতে কমাতে কিছুদূর গিয়ে থেমে গেল বাইকটা।আহিল ভাই বাইক থেকে নেমে নিজের গায়ের মোটা ভারী জ্যাকেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
–এটা গায়ে জড়িয়ে বস।
–না,না লাগবে না।আমার অত শীত লাগছে না।বাইক একটু আস্তে চালালেই হয়ে যাবে।
আহিল ভাইয়া চোখ লাল করে বেশ কড়া সুরে একটা ধমক দিয়ে বললেন,
–তোকে গরম করার জন্য দিচ্ছি না এটা।তুই এটা গায়ে দিলে দুইপাশ থেকে বাতাসটা কম আসবে, আয়রার শরীরে বাতাসটা লাগবে না আর।
আমি বিনা বাক্যব্যয়ে জ্যাকেটটা নিয়ে এবার নিজের গায়ে জড়িয়ে নিলাম।তর্ক করে লাভ নেই শুধু শুধু এই রোবট মার্কা।লোকটার সাথে।
কিন্তু একি!জ্যাকেটটা কোনোভাবেই ঠিকঠাক করে পড়তে পারছি না।
এক হাত জ্যাকেটে ঢুকাচ্ছি তো অন্য হাতা খুঁজে পাচ্ছি না।অনেকক্ষণ অনবরত চেষ্টা করেও যখন পারছিলাম না তখন চোখ তুলে আহিল ভাইয়ার দিকে তাকালাম অসহায় দৃষ্টিতে। দেখি উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছেন।আমি এবার বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম,এ বাবাহ্!উনি তাহলে এতোক্ষণ আমার এই অপারগতাই মনোযোগসহকারে দেখছিলেন!
অবশেষে আহিল ভাইয়ার সহোযোগিতায় জ্যাকেটটা পড়ে নিতে পারলাম।
এদিকে বাইক স্টার্ট দিতেই আয়রার চোখ গিয়ে পড়লো রাস্তার ওপারে ভ্যানের উপরে থাকা গরম গরম ভাপ উঠা ভাপা পিঠার দিকে।অমনি ও আহিলের টি-শার্ট ধরে টানাটানি শুরু করে দিল,ভাপা পিঠা কিনে দেওয়ার জন্য।
আসলে বাইক থামানোর সাথে সাথেই আমারও চোখ গিয়েছিল মজাদার ঐ ভাসমান পিঠার দোকানে।কিন্তু আহিল ভাইয়ের চোখ রাঙানি আর বাসায় যেতে দেরী হয়ে যাচ্ছে,ভেবেই আমি চুপ ছিলাম।এখন আয়রার বায়না দেখে,আবারও আমার লোভাতুর মনটা জেগে উঠলো।মনে মনে ভাবছিলাম,ইশ যদি খেতে পারতাম।
আমাকে আশ্চর্যজনক ভাবে অবাক করে দিয়ে আহিল ভাইকে দেখলাম হনহন করে পিঠার ভ্যানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।আমি চিন্তাও করতে পারিনি,আহিল ভাইয়া এতো সহজেই মেনে যাবে এভাবে রাস্তার পাশের খাবার খাওয়ার ব্যাপারে।
একটু পর ২হাতে দুটো ঠোঙা নিয়ে ফিরে আসলেন তিনি।
আমি আর আয়রা পিঠা খেলাম নেশ খেলাম করে
আর এই সময়টাতে উনি রাস্তায় এদিক সেদিক পায়চারী করছিলেন আর ঘড়ি দেখছিলেন বারবার।
বাসার থেকে একটু দূরে থাকতেই আহিল ভাইয়া নামিয়ে দিলেন আমাদের।আমাকে একপাশে সরিয়ে এনে নিচু গলায় বললেন,
–তনু,আমি সাময়িক ভাবে ভেঙে পড়েছি ঠিকই কিন্তু নিজেকে আবার সামলেও নিব।তুমি আমাকে যেভাবে এসে দেখেছো,ঐটা ভুলে যাও।আমার মা যেনো কিছুতেই জানতে না পারে আমি নেশাপানি করছি ওখানে গিয়ে।প্লিজ তনু..মাকে কিছু বলো না যেনো।
বিয়েটা বানচাল হয়ে যাওয়ায় মা ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন।কিন্তু এখনো যতটুকু স্ট্রং আছেন,তা উনি আমাকে শক্ত থাকতে দেখেই আছেন।উনি যদি জানতে পারেন,আমি একটু হলেও ভেঙে পড়েছি তবে উনিও ভেঙে পড়বেন।
সো প্লিজ…….
–আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আহিল ভাইয়া।খালামনি কে আমি কিছু বলবো না।আর কিভাবে বলবো বলুন তো,আমি যে আপনাদের বাসায় গিয়েছি এটা তো আর কেউ জানে না।
–ওহ্ তাইতো!
–কিন্তু একটা কথা আহিল ভাই….
আপনাকে সবসময় অনুভূতিহীন একটা রোবটের মতোই দেখে আমি অভ্যস্ত।একটা সামান্য মেয়ের জন্য এভাবে ভেঙে পড়া আপনাকে মানায় না।প্লিজ এতোটা নাজুক হবেন না।প্লিজ ভাইয়া….
আহিল মুচকি হাসলো,
–সামান্য মেয়ে!হুহ..
আচ্ছা বাদ দে।রোবট আরও কঠিন রোবট হয়ে যাবে খুব শীঘ্রই দেখে নিস।
যা এখন..রাত বাড়ছে।
আহিল ভাইয়ার জ্যাকেটাটা ফেরত দিয়ে আয়রার হাতটা ধরে বাসার দিকে হাঁটা দিলাম।আহিল ভাই কি স্প্রে ইউজ করে কি জানি,উনার গায়ের গন্ধটা অসম্ভরকম ঘোর লাগানো।মনে হচ্ছে জ্যাকেটটা আমি এখনো গায়ে দিয়ে রেখেছি……।
একদম বাসার সামনাসামনি এসে পিছন ফিরে তাকালাম একবার।আহিল ভাই বাইকের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এদিকেই চেয়ে আছেন।
সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বাসার গেইটের ভিতরে ঢুকে গেলাম।
——————————
ঘড়ির কাঁটা রাত ১০টা ছুইছুই করছে।
কে কি জিজ্ঞেস করে এসব ভাবতে ভাবতেই দুরুদুরু মনে কলিং বেল বাজালাম।
সাইকা এসে দরজা খুলে দিল।অবাক করার ব্যাপার হলো,ও একবারও জিজ্ঞেস করলো না আমরা এতক্ষণ কোথায় ছিলাম বরং আমি আর আয়রা ঘরের ভিতর ঢুকতেই দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ও চলে গেল।
আস্তে আস্তে ড্রয়িং রুমের সামনে এসে দাঁড়ালাম।বাসার সবাই-ই প্রায় উপস্থিত আছে এখানে।আমমি আসার পর তাদের মধ্যে কেউ আমার দিকে এক নজর তাকালো আবার কেউবা তাকালো না।
সবার মুখই কেমন থমথমে,এমনকি দুষ্ট শুভ পর্যন্ত মুখ মলিন করে বসে আছে সোফার এক কোণে।
আমার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না।এই অল্প সময়ের ব্যাবধানে কি এমন হয়ে গেল,যে সবাই এমন মুখ করে বসে আছে যেনো এটা কোনো মরা বাড়ি।
বিস্তারিত জানতে আমি সাইফাকে অনুসরণ করে ওর রুমে ঢুকে গেলাম।
সাইফার অগোছালো দীর্ঘ বর্ণনার পর যতটুকু বুঝলাম তা হলো,
“সন্ধ্যার দিকে ছোট ফুপি ড্রয়িং রুমে সবাইকে উপস্থিত করিয়ে সেখানে আহিল ভাই আর আমার ব্যাপারটা তুলেছেন।সেই গোলমিটিং এ অনুপস্থিত ছিলেন শুধু আমার আব্বু।তিনি কোনো একটা কাজে বাহিরে ছিলেন।
‘আমি আত্মহত্যার মতো এমন বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছি,অথচ উনাকে কেউ এটা ইনফর্ম করেনি’ এটাই ছিল ছোট ফুপির ক্ষোভ।
এক কথায়,দুই কথায় কথা বাড়তে বাড়তে একসময় ছোট ফুপি আমার আম্মুকে বেশ অপমান করেন ‘কেমন মেয়ে জন্ম দিছেন ছোট ভাবী?এই বয়সেই এদ্দুর?বড়দের কথা শুনবে না,নিজের মর্জি মতো চলবে।এমন একটা প্রতিষ্ঠিত ছেলেকে পায়ে ঠেলেযায় আত্মহত্যা করতে!ছিঃছিঃছিঃ! দেখেন গিয়ে কোথায় কোন ছেলের সাথে পিরিত করে বসে আছে।’
আমার ছোট ফুপির মুখ চলে একদম চড়কির গতিতে।একবার কথা শুরু করলে আর থামাথামির নাম থাকে না।উনার সাথে কথায় পারেন,এমন মানুষ এখনো জন্মায়নি আমাদের এই বাড়িতে।
আজকেও তার মুখ কেউ থামাতে পারছিলেন না।এদিকে ছোট ফুপির এসব ধারালো ধারালো কথা শুনে মা একসময় কেঁদে ফেলেন লজ্জায় আর অপমানে।ঘটনাটা সেখানেই হয়তো থেমে যেতো।
কিন্তু ঠিক সেই সময়েই আব্বু চলে আসেন বাসায়।আম্মুকে কাঁদতে দেখে,উনার মাথা গরম হয়ে যায়।
অনেক চিল্লাচিল্লি করেন তিনি বাসার সবার সাথে।সবশেষে উনি জানতে চান,তনয়ার ব্যাপারটা সেইদিনের পর ক্লোজ হয়ে গিয়েছিল।আবার নতুন করে এই কাহিনী তুলেছে কে?
যখন জানতে পারেন সোহেলী খালামনির কাছ থেকেই জেনেছে সবটা ছোট ফুপি।তখন রাগের মাথায় আব্বু সোহেলী খালামনিকে ইচ্ছেমতো অপমান করে বসেন,
‘ আমার মেয়ে ছাড়া দুনিয়াতে কি আর কোনো মেয়ে নাই আপনার ছেলের জন্য সোহেলী আপা?আপনি এখনো তনয়ার পিছনেই পড়ে আছেন যে!আপনি কি ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন,আপনাদের জন্য আমার মেয়েটা মরতে বসেছিল,মরতে!এবার তো একটু ক্ষ্যামা দেন!আর আশায় না থেকে ছেলের বিয়ের ব্যবস্থাটা করেন অন্য কোথাও।’
আব্বুর কাছ থেকে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমানিত হওয়ার পর সোহেলী খালামনি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি।অনাকাঙ্ক্ষিত এই অপমানে একটু আগেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে যান তিনি।
এখনো জ্ঞান ফিরেনি তার,ডাক্তার ডাকা হয়েছে ইতিমধ্যে। ”
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম সবটা শুনে।আমার অনুপস্থিতিতে আমাকে নিয়েই এতো বড় ঝড় বয়ে গেছে আমার পরিবারে!নিজেকেই এখন সবচেয়ে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে।আমার জন্যই তো এসব হলো।
সোহেলী খালামনির জন্য সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে আমার।আমাকে তিনি নিজের মেয়ের মতো করেই দেখেন,আদর করেন। আর আমার কারণেই আজ এতো বাজেভাবে অপমানিত হলেন তিনি!
লজ্জা আর অপরাধবোধে ভিতটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমার।
———————
রাত ২টার বেশি কিছু বাজে।
কারো চোখেই ঘুম নেই,যে যার মতো করে মনমরা হয়ে বসে আছে।এর মধ্যে একটু স্বস্তির বিষয় হলো,একটু আগেই সোহেলী খালামনির জ্ঞান ফিরে এসেছে।
এদিকে সোফার উপর গা এলিয়ে দিয়ে অনুতপ্ত মুখে আব্বু বসে আছেন।মাথা ঠান্ডা হওয়ার পর উনি হয়তো এখন বুঝতে পারছেন,রাগের মাথায় কত বড় ব্লেন্ডার তিনি করে ফেলেছেন।এতোদিনের পারিবারিক সম্পর্ক সোহেলী খালামনিদেএ সাথে,আর সেটা এক নিমিষেই একদম ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছেন তিনি।
কিছুক্ষণ যাবৎ একটানা কলিং বেল বেজে যাচ্ছে এই রাতের বেলায়।মনে হচ্ছে কেউ ঝড়ের বেগে এসে পাগলের মতো কলিং বেল বাজিয়ে চলেছে;হাতে একদম সময় নেই তার!
কেউই উঠে গিয়ে দরজা খোলার ব্যাপারে ইন্টারেস্ট দেখালো না।
অবশেষে আমিই গেলাম।এতো রাতে কে আসতে পারে!
দরজার কী-হোলে চোখ রেখে দেখলাম দরজার বাহিরে আহিল ভাই উদ্ভ্রান্তের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছেন;কখন দরজা খুলবে আর তিনি ভিতরে আসবেন সেই অপেক্ষায় ।
আহিল ভাইকে দেখেই আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো।তারমানে খালামনি ইতিমধ্যে ফোন করে আহিল ভাইকে সমস্ত কিছু বলে দিয়েছে!আহিল ভাই নিয়ে যেতে এসেছে এই বাড়ি থেকে আয়রা আর খালামনিকে!
কিন্তু একবার এই বাসা থেকে তারা চলে গেলে তো এই ভুল বোঝাবুঝির অবসান আর কোনোদিনই হবে না বরং
দূরত্ব আরও বেড়ে যাবে।
বিয়ের ব্যাপারটা তো আগেই বানচাল হয়ে গেছে।তবে কি আহিল ভাইদের সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্কটারও আজকে এখানেই ইতি ঘটবে!
মনের ভিতর কেমন একটা করুন সুর বাজতে লাগলো।বুকটা খালিখালি লাগছে….খুব খালি খালি।হঠাৎ করেই বুকের কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে আমার।
আলতো করে দরজাটা খুলে দিলাম আমি।
#চলবে