#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৪
ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে।আলোকিত হয়ে আসছে চারিপাশ।আকাশের নীলাভ আভায় নীলবর্ণ ধারণ করেছে প্রকৃতি।নিরব,শান্ত পরিবেশ।পাখিদের এখনো ঘুম ভাঙেনি।ঘুম ভাঙেনি তোহারও।
নিজের রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় রেলিংয়ে হেলান দিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তোহা।ঠান্ডা বাতাসে তার কোমড় পযর্ন্ত ছড়ানো ঘনকালো খোলা চুলগুলো স্নিগ্ধভাবে উড়ছে।চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে আছে।
চোখে মুখে বিচরণ করছে শুভ্র সৌন্দর্য।
তার বারান্দার পাশাপাশি বারান্দাটাই তিহানের।মাঝখানের ব্যাবধান খুব একটা বেশি না।কারেন্ট এসেছে আধঘন্টা আগে।সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি।কারেন্ট আসতেই শাওয়ারে ঢুকেছিলো তিহান।ঘেমে চুপচুপে ছিলো তার শরীর।
আধঘন্টায় শাওয়ার নিয়ে গলায় সাদা তোয়ালে ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলো সে।পরণে শুধু কালো ট্রাওজার।গা না মুছেই বেরিয়েছে সে।পানি গড়িয়ে পরছে উন্মুক্ত সাদা ফর্সা শরীর থেকে।
সোফায় শুয়ে আছে সাইফ।আর নুহাশ বিছানার এককোণে।মূলত রুম শেয়ার করা তার বিশেষ পছন্দ নয়।তবুও উপায় না পেয়ে করতে হচ্ছে।ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় যেয়ে দাড়ালো তিহান।
ভেজা গায়ে ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে যেতেই লেপ্টে থাকা পশম গুলো পর্যন্ত দাড়িয়ে গেলো।অদ্ভুততো!আজকে এতো ঠান্ডা কেনো?কালইতো গ্রীষ্মের পঁচা গরম ছিলো।দরদরিয়ে ঘাম ছুটে যাচ্ছিলো।আর আজকে কি শীতল পরিবেশ!রীতিমত কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে!
আকাশের দিকে চোখ গেলো তিহানের।হাল্কা হাল্কা ধূসর কালো মেঘের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ দিকটায়।বৃষ্টি হবে নাকি?গ্রীষ্মের স্বস্তিদায়ক বৃষ্টি?
চুলের পানি ঝেড়ে যেইনা রুমে ঢুকতে যাবে তখনই তার চোখ যায় পাশের বারান্দায়।তোহাকে সেখানে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে যায়।মৃদু স্বরে সে ডাকে,
—“তিহু?এই ভোরবেলা এখানে বসে আছিস কেনো?এই তিহু?”
তোহার সাড়াশব্দ পাওয়া গেলোনা।মেয়েটাকি ঘুমিয়ে আছে?তার দিকে পিঠ দেয়া তাই বুঝতেও পারছেনা।
কোনো উওর যেহেতু দিলোনা তারমানে ঘুমিয়েই আছে।কারণ তার কথার জবাব না দিয়ে সে বসে থাকবে এত সাহস এই মেয়ের নেই!কিন্তুএই ঠান্ডার মধ্য বারান্দায় ঘুমাচ্ছে কেনো?তারপরতো সর্দি জ্বর বাঁধিয়ে বসবে।
তিহান রুমে ঢুকলো।গলার টাওয়ালটা টেবিলে রেখে জামা না পরেই ড্রয়ার থেকে তোহাদের ফ্ল্যাটের এক্সট্রা চাবিটা নিয়ে নি:শব্দে বেরিয়ে গেলো।
_____________
ধীরপায়ে তোহার রুমে প্রবেশ করলো সে।দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে।
ততক্ষনে মাথাটা আরো একটু কাত হয়ে গেছে তোহার।মুখের উপর এসে পরেছে এতগুলো চুল।মাথাটা আরেকটু হেলে পরে যেতে নিলেই দ্রুতহাতে তা ধরে ফেলে তিহান।একহাঁটু গেড়ে বসে নিজের বুকের উপর ঠেঁকিয়ে রাখে।চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে গালে কপালে হাতের উল্টোপিঠের ছোঁয়া দেয়।তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা করে।মেয়েটার শরীর বরফ শীতল হয়ে আছে।
পরণে আকাশী রংয়ের কামিজ।গায়ে ওড়না নেই।অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে রাতে নিচে নামার আগে তোহার গায়ে সাদা ওড়না জড়ানো ছিলো।
সন্দেহবশত রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে নিচে তাকাতেই তিহান লক্ষ্য করে তোহার সাদা ওড়না ঝুলছে তাদের নিচের ফ্ল্যাটের বারান্দার গ্রিলে।হতাশ দৃষ্টিতে কিছুক্ষন সেদিকে চেয়ে থেকে তোহাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নেয় তিহান।রুমে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সরার আগেই তোহা একটু নড়েচড়ে দুহাতে তিহানের গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁটজোড়া কিন্চিৎ ফাঁক করে অস্ফুষ্ট স্বরে বলে,
—“আপনি কেনো রোজ রোজ আমার সপ্নে আসেন?”
তিহান শব্দহীন হাসি হাসে।তোহা আষ্টেপিষ্টে তার গলা জড়িয়ে রেখেছে।মধ্যেকার দুরত্ব নেই।তোহার ঠোঁট বারবার তার গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে।
তিহান তোহার কানের কাছে মুখ এগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
—“তুমি বাস্তবে যা নিয়ে ভাববে তাই তোমার সপ্নে প্রতিফলিত হবে।তুমি আমাকে নিয়ে ভাবো সেজন্যই আমি রোজ তোমার সপ্নে আসি।বুঝলে?”
তোহা ঠোঁট উল্টায়, জড়ানো কন্ঠে বলে,
—“আমি আপনাকে নিয়ে কেন ভাববো?”
—“হয়তো আমি তোমার ‘বিশেষ’ কেউ,সেজন্যই।”
—“বিশেষ কেউ”?
তিহান আর উওর দিলোনা।তোহার হাত ছাড়িয়ে উঠে পরলো।দু’বার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই তোহা আবারো ঘুমে তলিয়ে গেলো।
কাঁধের কাছটায় হালকা জ্বলছে তিহানের।তোহার নখগুলো খুবই ধাঁরালো।
ঘরের ফ্যান ছেড়ে দিয়ে তার গায়ে কাঁথা দিয়ে দিলো তিহান।বারান্দার দরজা লক করে,জানালার পর্দা টেনে দিলো।অত:পর তোহার কপালে অঁধরের ছোঁয়া দিয়ে নিশব্দে রুম ত্যাগ করলো।
__________________
সকালে বাইরের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙলো তোহার।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই খেয়াল হলো,সে তো রাতে কারেন্ট নাই বলে গরমে বারান্দায় যেয়ে বসেছিলো।তারপর?তারপর কি সে নিজেই এসেছে ঘরে?মনে পরছেনা তো।ধুর!
চুলগুলো হাতখোঁপা করতে করতে আয়নার সামনে যেয়ে দাড়ালো সে।একটা কাঁটা দিয়ে তা আটকে নিয়ে আয়নার দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো তার গায়ে ওড়না নেই।বিছানায়ও নেই।বারান্দায় যেতে নিলেই দেখলো দরজা ভেতর থেকেই লক।সে কি ঘুমের মধ্য দরজাও লক করেছে?স্ট্রেন্জ!
বারান্দায়ও ওড়নাটা নেই।তার খুব প্রিয় ছিলো ওড়নাটা।কোথায় গেলো সেটা?নিচে ঝুঁকে দেখলো কোথাও পড়েছে নাকি।কিন্তু নাহ্।কোথাও নেই।সকাল সকালই মনটা খারাপ হয়ে গেলো তোহার।তার প্রিয় ওড়নাটাই কেনো হারাতে হলো?
________________
বের হতেই শুনলো খালামনি ডেকে পাঠিয়েছে তাকে।শুধু তাকেই নয়,নিশা-স্বর্ণালি আর তূর্য কেউ যেতে বলেছে।
সাইফ এসে খবর দিতেই তারা বাধ্য ছেলেমেয়ের মতো সেখানে যেয়ে উপস্থিত হলো।
॥
ডাইনিং টেবিলে সাজানো সাদা রুটি আর গরুর মাংসের ভুনা।সাথে ঝোল করা খাসির মাংস।বাসার বাচ্চাদের জন্য নাস্তা বানিয়েছে আফিয়া।যদিও তারা বাচ্চা নেই তবুও আফিয়ার কাছে সবসময় এরা বাচ্চাই।নিশার শেষ নাস্তা এ বাড়িতে তার জন্যই এ আয়োজন করা।
সবাই টেবিলে বসতেই তোহা কাঁচুমাচু করে বললো,
—“খালামনি,আমিতো…”
তার বাক্য পূর্ন করার আগেই আফিয়া বললো,
—“হ্যাঁ,আমি জানি তুই গরু,খাসি খাসনা।তোর জন্য আলাদা মুরগি করেছি।এনে দিচ্ছি।”
তোহা দ্রুত উঠে দাড়িয়ে বললো,
—“আমি আনছি,তুমি বসো।”
—“তোর আনা লাগবেনা,তবে উঠেই যখন পরেছিস একটু কষ্ট করে তিহানকে ডেকে আননা মা।সবাই নাস্তা করছে অথচ ও এখনো ঘুমোচ্ছে।”
তোহা কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলোনা।চুপচাপ পা বাড়ালো তিহানের রুমের দিকে।দরজার লক ঘুরাতেই তা খুলে গেলো।
রুম অন্ধকার।তোহা লাইট জ্বেলে দিলো।খালি গায়ে উল্টো হয়ে ঘুমাচ্ছে তিহান।গায়ের কাঁথা কোমড় পর্যন্ত নেমে গেছে।
চোখ নামিয়ে বিছানার পাশে যেয়ে দাড়ালো তোহা।ক্ষীণ স্বরে ডাকলো,
—“তিহান ভাই?উঠুন।”
তোহা হাল্কা ঝুঁকে গেলো।আলতো করে তিহানের বাহুতে হাত রেখে ঝাঁকিয়ে বললো,
—“তিহান ভাই?খালামনি ডাকছে আপনাকে।উঠুননা।”
তিহান চোখ মেললো।তার চোখের সাদা অংশগুলো লাল হয়ে আছে।তোহা হাত সরিয়ে ভাবলো,”উনি কি ঘুমাননি রাতে?চোখ এত লাল কেনো?”
তিহান সোজা ঘুরতে ঘুরতে বিরক্তিকর কন্ঠে বললো,
—“সমস্যাটা কি তোর?সারাক্ষণ খালি মায়ের চামচামি করা।উঠাতে বলেছে বলেই উঠাতে হবে?দেখছিস না ঘুমাচ্ছি,তারপরও কেনো ডাকলি?থাঁপড়ে গাল লাল করে দিবো একদম।”
চোখজোড়া একটু ছলছল করে উঠলো তোহার।লোকটা সপ্নের মধ্য কি সুন্দর করে কথা বলে আর বাস্তবে শুধু ধমকায় কেন?
চোখের পানি গুলোকে আটকে নিয়ে সে ভারি কন্ঠে বললো,
—“নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।জলদি আসবেন।”বলেই দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলো সে।
_______________
নাস্তা শেষে খালামনির সাথে সব হাতে হাতে গুছিয়ে দিচ্ছিলো তোহা।বাকি সবাই ওদের ফ্ল্যাটে গেছে।
সব গুছিয়ে সেও বেরোতে যাবে তার আগেই তিহানের ডাক শুনে থেমে যেতে হলো।তাকে রুমে ডাকছে তিহান।ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে পিছিয়ে যেয়ে রুমে উঁকি দিলো তোহা।তিহান শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে এগিয়ে এলো।তোহার হাত টেনে রুমের ভেতর নিয়ে এসে সাদা রংয়ের ওড়নাটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—“কালরাতে বারান্দায় ঘুমিয়েছিলি কোন খুশিতে?”
~চলবে~