যার সাথে আজ আমার বাসর তিনিই গতকাল আমাকে ধর্ষণ করেছেন। হ্যাঁ আগে আমি ধর্ষিতা তারপর বধূ! মহল্লার প্রভাবশালীর পুত্র আহনাফ চৌধুরী । তাদের প্রভাব, প্রতিপত্তি সবার উপরে । আর আমি! আমি সাধারণ স্কুল শিক্ষকের মেয়ে। না আছে ক্ষমতা, আর না আছে সাহস। যদিও একদিন এই সাহস দেখাতে গিয়েই আজ আমার এ দশা। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান ও প্রতিনিয়ত তার জোর জবরদস্তিতে বিরক্ত হয়ে সাহস যুগিয়ে চড় মেরেছিলাম। ব্যস সেটাই কাল হলো আমার জীবনের। তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে ফেলে দিয়ে গেল বাড়ির সামনে।
লোকলজ্জায় মরণমুখী আমার বাবা- মা। থানা,পুলিশ করার সাহস তাদের নেই। জলে বাস করে কুমীরের সাথে লড়াই করার মতো সাহসী নয় তারা। কলেজ প্রিন্সিপালের পরামর্শে প্রভাবশালী রইস চৌধুরী এবং তার পুত্রের হাতে পায়ে ধরে বিয়ের অনুরোধ করে।
আজকাল মিডিয়া সব ক্ষেত্রেই সরব। আমার বিষয়টাও এক কান, দু’কান হতে হতে দু’একজন সাংবাদিকের কানে পৌঁছায়। নিজেদের মানসম্মান রক্ষার্থে, পুত্রের কুকর্ম ঢাকতে, অবশেষে তারাও বাধ্য হয়ে বিয়েতে মত দেয়।
সর্বাঙ্গে ক্ষত বহন করে বধূসেজে বাসর ঘরে বসে কাঁদছিলাম৷ বার বার নিজের নিয়তিকে ধিক্কার জানাচ্ছি। জীবনে বেশি কিছু কোনোদিন প্রত্যাশা করি নি। তবে কোন পাপে এমন শাস্তি আমার? ভাবনায় ছেদ হলো তার আগমনে। গোল্ডেন শেরওয়ানি পরিহিত আহনাফ ভেতরে প্রবেশ করলো। ঘোমটার আড়াল থেকে এদৃশ্য দেখা মাত্রই আতঙ্কে কাঁপছিলাম আমি। দরজা বন্ধ করে এলোমেলো পায়ে পাশে এসে বসলো আহনাফ৷ তার হাবভাবে পরিলক্ষিত সে নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। গলা শুকিয়ে চৈত্রের খরা । বুকের ভেতর ধুপধাপ শব্দে হৃদপিণ্ডটা বাজছে। নাক টেনে ফুঁপিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ বিছানার কোনায় সরতে সরতে। খুব বেশিদূর সরা হলো না। তার আগেই হেঁচকা টানে বুকে নিয়ে এলো আহনাফ। কানের কাছে মুখ এনে চাপা স্বরে বললো,
” সেই তো এলি বুকে। শুধু শুধু এতো প্যাঁরা কেন দিলি।”
কথা শেষ করে আচমকা বুক থেকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিল। চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরে রাগে গজগজ করে বললো,
” থাপ্পড় দিয়েছিলি,শালিসের হুমকি দিয়েছিলি তাই না? কী হলো তার? আরও থাপ্পড় দিবি? দে? দে না?”
যে হাতে আহনাফের অসভ্যতায় অতিষ্ঠ হয়ে একদিন চড় দিয়েছিলাম, সে হাতটা টেনে ধরলো সে। সিগারেট জ্বালিয়ে নির্দয়ভাবে পুড়াতে লাগলো সম্পূর্ণ হাতের তালু। ব্যথায় আর্তনাদ করতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। সকল দুয়ার আজ আমার জন্য বন্ধ। আহনাফ সমস্ত শক্তি ব্যয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার উপর। গতকালের চেয়েও বেশি নির্মমতা আজ সে দেখালো। তার আত্মতৃপ্তির পরিসমাপ্তি হতেই সজোরে লাথি দিয়ে বিছানার থেকে ফ্লোরে ফেলে দিল। চোখের সম্মুখে সব ধোঁয়াশা হয়ে ক্রমশ ঘোর আঁধার নামল আমার।
ভোরের সূর্য উদয় হয়। ঘুমন্ত পৃথিবী ধীরে ধীরে জাগছে। পাখির কিচিরমিচির ডাক, বাতাসে মৃদু মন্দ আবেশ সবই মনে হলো আজ তিক্ত, বড় যন্ত্রণার। ব্যথায় শরীরের হাড় পর্যন্ত বিদ্রোহ করে বসেছে। কিছুতেই নড়বে না তারা। নিরুপায়, অসহায় আমি কাঁদতেও পারছি না। কন্ঠস্বর প্রচন্ড ভয়ে আড়ষ্ট। দুুর্বল চোখের পাতা ঢলে ঢলে পড়তে মরিয়া। ঠোঁটের, নাকের ক্ষতের জমাট বাঁধা আঠালো রক্তে মাছি,মশা উড়ে উড়ে বসছে। হাতটা নাড়িয়ে তাড়াব সে ক্ষমতাও আজ আর নেই আমার। এভাবে মরার মতো বেশ কিছুক্ষন পড়ে থেকে পুনরায় জ্ঞান হারালাম।
বাইরে শোরগোলের শব্দে দ্বিতীয় দফায় জ্ঞান ফিরলো আমার। এবার নিজেকে তুলতুলে বিছানার উপর আবিষ্কার করলাম। একপাশ হয়ে কাত শুয়ে আছি। নড়াচড়া করার মতো বিন্দুমাত্র শক্তি আমার ভেতর সঞ্চিত নেই। শুয়ে শুয়ে শুনলাম বাইরে কেউ একজন গলা চড়িয়ে চিৎকার করছে। ব্যথা, আতঙ্ক আমাকে এতোটাই দুর্বল করে দিয়েছে যে সব কথা শুনেও শুনছি না। মস্তিষ্ক কাজ করছে ধীর গতিতে। এভাবেই পড়ে রইলাম সাতদিন। কাজের লোক মারফত নিয়মিত খাবার,ওষুধ সব পাঠানো হচ্ছে। জোর করে গিলছিও সেগুলো আমি। কী করবো বলুন? মরতে যে ভয় হয়। এই সুন্দর ধরণী ছেড়ে কে যেতে চায়? ধরণী সুন্দর তবে ধরণীর মানুষ কেন অসুন্দর, ভয়ানক? কী দোষে আজ আমি এমন দিন অতিবাহিত করছি? কী দোষ আমার? প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি সেকেন্ড বিধাতার কাছে জবাব চেয়ে কাঁদছি আমি। একসময় দেখা গেল কান্নাজল শুকিয়ে গেছে। আক্ষেপগুলোও ভেতরে দুর্বল হয়ে মাথা নুয়ে সব মেনে নিচ্ছে। আমি তবে বাদ থাকব কেন? মেনে নিলাম ললাট লিখন মনে করে।
আহনাফকে আজকাল আর জোর করতে হয় না। সেচ্ছায় সব দিয়ে দেই। স্বামী হিসেবে যা পাওনা সবই। সবই? না সব নয়। ভালোবাসা তো দেই নি তাকে। অত্যাচারী কে ভয় করা, ঘৃণা করা সাজে, ভালোবাসা নয়।একই বিছানায়, অতি নিকটে তবুও তার আমার মনের মাঝে যোজন যোজন দুরত্ব।
ঘর, গৃহস্থালির টুকিটাকি কাজ সেরে গোসলে ঢুকব বলে রুমে এসেছিলাম। এসে দেখি আহনাফ আধশোয়া হয়ে আছে বিছানায়। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমাকেই দেখছিল। আমি সবসময়ের মতোই নিরব। কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকব তখনই দরজা ধরে দাঁড়িয়ে গেল। চমকে তাকালাম ওর মুখের দিকে। আজ প্রথমবার হাসতে দেখলাম। তার হাসিতে আমি অভ্যস্ত নই। স্বভাবতই অপ্রস্তুত হয়ে মুখ নুয়ে রইলাম।
” তোকে খুব কষ্ট দিয়েছি তাই না নীরা?”
তার ব্যাঘ্র কন্ঠস্বরের স্থলে শীতল কন্ঠস্বর আমাকে যারপরনাই ভাবিয়ে তুললো। নত মাথায় ভ্রুকুটি করলাম আমি। আমায় ভাবতে দেখে অতি সন্নিকটে এলো আহনাফ। একচিলতে ফাঁক রাখলো না দু’জনের মাঝে। থুতনি তুলে বললো,
” রাগের বশে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোকে। অনেক বড় ভুল করেছি রে। ক্ষমা করে দিবি না?”
এবারও চুপ রইলাম। গত সাতদিনের অসহনীয় অত্যাচার, নির্যাতনে গলার স্বর আমার রুদ্ধ প্রায়। সহজে কথা বেরুচ্ছে না।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সূক্ষ্ম চোখে তার হাতে তোলা মুখটা আমার দেখছে সে। নিরবতা ভেঙে ফের বললো,
” আমি নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চাই নীরা। তোর ভালোবাসায় ধন্য হতে চাই। ভালোবাসবি তো আমায় বল?”
নারী মন আমার। সমাজ,পরিবার বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় সবসময়ই ছিল। আহনাফের আবেগে ঢালা প্রেম নিবেদন প্রত্যাখ্যান করে দ্বিতীয়বার জীবন কন্টকাকীর্ন করতে চাই না আমি। ভেবেছি এই তো সুখ এসেছে পায়ে হেঁটে। দুঃখ বুঝি ঘুঁচবে এবার। শীর্ণ দু’হাতে জড়িয়ে নিয়েছি আহনাফকে। তার দেওয়া কষ্টে রুদ্ধ হওয়া কন্ঠস্বর আমার ফের সরব হলো তার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে। অপ্রত্যাশিত পাওনাই খুশিই হলাম। অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে বললাম,
” হ্যাঁ ভালোবাসব।”
ভাগ্য ফের প্রহসন করলো আমার সাথে। এতোক্ষণ সুখ ভেবে যাকে আঁকড়ে ধরেছি বিষের কাটা হয়ে অন্তরে বিঁধলো তা। বাথরুমের ফ্লোরে সজোরে ফেলে দিয়ে বাড়ি কাঁপিয়ে হাসছে আহনাফ। হাসতে হাসতে কুঁজো হয়ে হাত তালি দিচ্ছে। ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বললো,
” আমাকে তোর ভালোবাসায় ধন্য করবি বল নীরা? হ্যাঁ ভালোবাসব।”
হাসি থামিয়ে চোখ মুখ কঠিন করে বললো,
“ভালোবাসা মাই ফুট। তোর মতো ফকিন্নিকে আহনাফ জুতার ফিতা পর্যন্ত বানাবে না। অথচ বউ হয়ে জোকের মতো বসে আছিস মাথার উপরে। গুনে গুনে তিনমাস থাকবি। তারপর দেখি কী করে থাকিস এ বাড়ি। আমাকে অপমান করার সাধ জনমের মতো বুঝাব তোকে এই তিনমাস।”
আহনাফ কথা শেষ করলো আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে বিছানায় ফেলে। তারপর যা গত সাতদিন ধরে করে আসছে, তাই করল। যতোটা আঘাত দেওয়া সম্ভব দিল সে। পুরোনো ক্ষত গভীর ক্ষতে রূপ নেয়। লাঞ্ছনা, অপমানে লাশের ন্যায় পড়ে রইলাম বিছানায়। আহনাফ একদিন ভালো হবে, তার দেওয়া আঘাত তারই ভালোবাসার স্পর্শে বিলীন হবে, এই শেষ আশা বুকে বাঁধলাম।
চলবে,,,
#ক্যাকটাস🌵
সূচনা পর্ব
Writer Tanishq Sheikh