১৯+২০ ও অন্তিম
ক্যাকটাস
পর্ব-১৯
Writer Taniya Sheikh-Tanishq
মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়, তখন দুটো রাস্তা তার সামনে খোলা থাকে। এক. বাঁধা হয়ে থাকা দেয়াল ভেঙে ফেলা।দুই. নিজের পিঠ অর্থাৎ মেরুদণ্ড ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা আমৃত্যু। নীরার সম্মুখে এখন তেমনই সিচুয়েশান। হয় মরো নয় মারো। মারবে! এতো সাহস কী এই তুচ্ছ ভীরু রমণীর আছে? ওর মতো ভীরু মেয়েদের পদে পদে মরতে হয়৷ আচ্ছা নীরা! এমন জীবন রেখে লাভ ই কী আছে তোর? মরে যা! সকল ঝামেলার অবসান হোক। নীরার মতোই মেয়েটি ধিক্কার দিতে দিতে হাত বাড়িয়ে গলা চেপে ধরলো। নীরা গোঙানি করতে করতে দূর্বল চোখের পাতা মেলে। দুঃস্বপ্ন ছিল মেয়েটি। সে মরে নি বেঁচে আছে৷ আরও একবার নিজেকে জীবিত আবিষ্কার করে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। ঘাসের মধ্যে মুখ থুবরে পড়ে আছে নীরা। নড়নচড়নের খুব একটা শক্তি তার মধ্যে নেই এখন৷ কাটা ঘায়ে মরিচ লাগলে কিংবা শরীর পুড়লে যেমন জ্বলে তেমনি করে জ্বলছে পিঠটা। ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগছে সেখানে। ক্রমশ জমে যাচ্ছে অনুভূতি। নীরা থুতনি ঠেকিয়ে মুখ তুললো। একটু দূরে সামনে কাঠ-খড় জ্বালিয়ে বসে আছে বাবলু। মুখ ভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি মোচ, হাতে সেই খরগোশটা। নীরার দিকে যখন তাকাল বাবলু বড়ো ভয়ানক দেখাল তার মুখ। কাঠ-খড়ের লেলিহান শিখায় চোখ দু’টো হিংস্র হায়েনার মতো জ্বলছে। নীরাকে মুখ তুলতে দেখে পাগলাটে হাসি হাসলেন। ভ্রু তুলে বললেন,
” এইডা ধরবার চাইছিলা বউমা? ধরো!” খরগোশটা এগিয়ে ধরলো বাবলু। নীরা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে। বাবলুর হাতে বসা খরগোশটাও ভীত চোখে টালুমালু করে তাকাচ্ছে কর্ণ উচিয়ে। নীরা মায়াভরা দৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতিটি মানুষের কিছু শখ থাকে। কৈশোরে নীরার শখ ছিল খরগোশ পালার। ওদের পাশের বাসার ইফতির অনেকগুলো খরগোশ ছিল। সাদা তুলতুলে লোমশওয়ালা খরগোশ। নীরা ওদের বাসায় এই খরগোশ দেখতেই যেত বেশি। তার সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল সেগুলো। ইফতি তাকে কথা দিয়েছিল একটা খরগোশ দেবার। সেকথা ইফতি পরে আর রাখে নি। ইফতির বাবা বদলি হতেই ওরা চলে গেল। যাওয়ার সময় এমন একটা ভাব করল যেন নীরাকে সে চেনেই না। খুব কষ্ট পেয়েছিল নীরা সেদিন। ভেবেছিল টিউশনি করে কিনবে একটা,সেটাও হয়নি৷ দেড় রুমের ভাড়া বাসায় তাদেরই ঠিকমতো জায়গা হতো না, সেখানে অন্য জীব এনে কী করে রাখবে? নীরার বাবা দিলই না অনুমতি৷ নীরার সেই আক্ষেপ আজও ঘোচে নি। আজ যখন এই খরগোশটা সামনে এলো। নিজের অতীত আকাঙ্ক্ষা পুনরায় জেগে ওঠে। একটা খরগোশই তো চেয়েছে সে? তাতে কী খুব বেশি লোভ করে ফেলেছিল? নীরা ডুকরে কেঁদে ওঠে খরগোশটার দিকে তাকিয়ে। নীরাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল বাবলু। করুন মুখে বললেন,
” ওকি! কান্দো ক্যা? খরগোশ পছন্দ হয়নাই? হয়নাই পছন্দ? ” মাথা নাড়িয়ে কথা শেষ করেই হাতের খরগোশটা ছেড়ে দেয় নিচে। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের উপর খরগোশটা দাপাদাপি করে বেরিয়ে এলো আগুন গায়ে। তাতে লাভ আর হলো না। ততোক্ষণে লোমশ পুড়ে চামড়ায় আগুন ধরে গেছে। কিছুক্ষণ কাতরাতে কাতরাতে দম ছাড়ল খরগোশটা। নীরা অশ্রুসিক্ত বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইল প্রাণহীন আধাপোড়া খরগোশটার দিকে। তার নেত্র পল্লব স্থির,স্ক্লেরা এবং টেয়ার ডাক্ট রক্তিম। নীরা কতোক্ষন এভাবে ছিল তার মনে নেই। বাবলু নীরার চুলের মুঠি ধরে টেনে ওঠায়। একটা গাছের দিকে ছুঁড়ে মেরে গলা চেপে ধরে। হুঙ্কার দিয়ে বলে,
” ভাবছিলি বাইচ্যা যাবি তুই? আমি বাবলু! সারাটা জীবন গোলাম হয়ে থাকছি রইস চৌধুরীর। তার জন্য কতো খুনখারাবি করছি,মানুষ পিটাইছি। তার অপরাধে নিজে জেল খাটছি। কেন এতো কিছু করছি জানোস? সে আমার মালিক! আমি তার গোলাম। আর আমি বাইচ্যা থাকতে তারে তোরা মিইল্যা পাগল বানাইছস? পয়লা তোরে মারমু। কেমনে মারমু জানোস? গলা কাইট্যা! এক্কারে আহনাফ বাবারে যেমনে তোরা মারছোস ওমনে। তারপর ঐ উকিল আর সাংবাদিকরে মারুম। তোগোরে মাইরা আমি আমার মালিকের কাছে যাইয়া সব কমু। আমার মালিক ভালা হইয়্যা যাইব হেরপর!” বাবলু দাঁত বের করে হাসছে। ভয়ংকর সে হাসি। গলা চেপে ধরায় কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে নীরার। তবুও অস্ফুটে বললো,
” চাচা বিশ্বাস করেন আমি আহনাফকে মারি নাই। আমি তো ওর স্ত্রী ছিলাম চাচা। আমি কী করে মারতে পারি বলেন?”
” চুপ! নাটক করবি না। ইসত্রি ছিলি না তুই ওর। তোরে তো নিরুপায় হয়ে বিয়া করছিল বাবায়। তোর ভাগ্য ভালো ছিল, নয়ত আমি তহন বাইরে থাকলে তুই আজ জিন্দা থাকতি না। তগো ফুসলানিতেই জরিনা ওরে মারছে। সব দোষ তগো। তোরে তো মরতে হইবোই। কেউ বাঁচাইতেই পারত না তোরে।” বাবলু চাদর সরিয়ে কোমর থেকে ধারালো ছুরি বের করে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নতুন শান দেওয়া ছুরি। নীরা মৃত্যুকে দেখছে সন্নিকটে। চোখ খিচে বন্ধ করে আছে। বুকের ভেতটা ঢিপঢিপ করছে প্রচন্ড বেগে। দু’চোখে অবাধে ঝরছে নোনাজল।
দীর্ঘ দিন খুনখারাবি করে বাবলুর মধ্যে একধরনের পৈশাচিকতা কাজ করে। এখন সহজে মানুষ মারে না সে। একটু জ্বালা যন্ত্রণা দিয়ে দাপাদাপি করিয়ে মজা নেয় প্রথমে। তারপর মারে। আজও তাই করল। নীরার দু বাহুতে ছুরির সূক্ষ্ণ কোনা লাগিয়ে টান দেয়। নীরা ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে। গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে, দু’হাত রক্তে রঞ্জিত। মাথা ঝুঁকে গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে নীরা। বাবলু হো হো করে হাসছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে সে হাসির রোল পাহাড়ে পাহাড়ে বারি খেয়ে ভূতুরে শব্দের সৃষ্টি হয়। বাবলু একহাতে নীরার গলা ধরে আছে অন্য হাতে ছুরি দিয়ে গলার নিচ বরাবর টানতে টানতে পেটের কাছে এসে থামল। নীরা অর্ধ বিবস্ত্র হয়ে পড়েছিল প্রায়। নিজের লজ্জা ঢাকতে সকল ব্যথা ভুলে বাবলুর তলপেট বরাবর কষিয়ে লাথি মারে সে। বাবলু দূর্বল নয়। বয়স বায়ান্ন হলেও হাট্টা খাট্টা শরীর তার। নীরার দূর্বল লাথিতে একটু দূরে সরে গেল কেবল। নীরা ব্যথায় রক্তাক্ত অবশ প্রায় হাত দু’টো দিয়ে বুকের সম্মুখের ছেঁড়া কামড় জড়িয়ে বললো,
” জানোয়ার! একবারে মেরে ফেল।”
” একবারে মারলে তো মজা নাই।” বাবলু এগিয়ে আসতেই নীরা পা টেনে টেনে দূরে সরে। একটু দূরেই ওর নতুন কেনা বার্মিজ চাদরটা পড়া। নীরা চাপা গোঙাতে গোঙাতে এগিয়ে গেল সেখানে। চাদর গায়ে জড়িয়ে দম নিল জোরে জোরে। পেছনে বাবলুর আগানোর পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। নীরা তো হার মেনেই নিয়েছিল, তবুও কেন তাকে ফের বিবস্ত্র করবে এরা? নীরার চোখের জল থেমে যায়। এই ক্ষণে মনে পড়ল বাসে বসে বলা আমরিনের কথা। মনে পড়ল তার বোন শারমিন এবং মেহেরের দেওয়া সাহসের কথা। নিজের দূর্বলতাকে ধিক্কার দিল নীরা। ঘুরে দাঁড়াল টালমাটাল পায়ে। বাবলু থেমে গেল। সে দেখল ভয়ের নাম নিশানাও নেই নীরার মুখে। রক্তাক্ত, ক্ষত বিক্ষত ঠোঁটে একচিলতে হাসি ফুটে আছে।
বাবলুও হাসে। বলে,
” পাগল হইয়্যা গেছস গা? মজা পাইলাম। বহুত মজা পাইলাম। এইডাও কমুনে মালিকরে যাইয়্যা।” বাবলু ছুটে আসে ছুরি নিয়ে নীরার দিকে। নীরা নিশ্চল, স্থির।
রাত এগারটা পর্যন্ত লাইট মেরে পুলিশ এবং কিছু স্থানীয় লোক খোঁজাখুজি করল। এরমধ্যে রাফসানও চলে আসল সেখানে। বিধ্বস্ত চেহারা তার। অস্থিরতা তার সবকিছুতে প্রকাশিত। পুলিশদের সাথে নিজেও খুজল। এগারোটা পর্যন্ত খুঁজে শেষে সবাই ক্ষান্ত দিল খোঁজা খুজিতে। রাফসান এবার একাই যাবে বলে স্থির করল। সে আরও গভীরে গিয়ে খুঁজবে নীরাকে। উপস্থিত কেউ তার সিদ্ধান্ত মেনে নিল না। কারন এমনিতেও গভীরে যাওয়াটা রিস্ক তারউপর এখন রাত। পুলিশ বুঝাল সকালে দরকার হলে তারা সেখানে যাবে। রাফসান কারো কথা শুনতে রাজি নয়। এক সেকেন্ড ব্যয় না করে একপ্রকার সবার সাথে ধস্তাধস্তি করে ছুটে গেল জঙ্গলের ভেতর। হাতে টর্চ আর লাইন্সেসকৃত রিভলভার। কিছুদূর যেতেই সাপের ফোঁস ফোঁস শব্দে থেমে গেল সে। ভালো করে চারপাশে টর্চ মারতেই দেখতে পেল চার/পাঁচ কদম দূরের গর্তে সাপ ঢুকছে। রাফসান বুঝল তাকে কতোটা সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে হবে। রাত হওয়ায় ঘাসে শিশিরকণা জমতে শুরু করেছে। হাঁটুপর্যন্ত ভিজে গেছে ঘাস মাড়িয়ে চলতে চলতে। আশেপাশে বন্য হাতি আছে। রাফসান লাইটটা চাদরের তলে নিল। তাতে আলোটা বেশ ক্ষীণ মনে হচ্ছে এখন। এভাবেই সতর্কে এগিয়ে চললো দিশাহীন পথে। মনের ভেতরে কালবৈশাখীর তান্ডব চলছে। মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছে মনোযোগ হারিয়ে রাফসান। নীরার কিছু হয়ে গেলে সে বাঁচবে কী করে? ইতোমধ্যে বেরিয়ে গেছে তার অর্ধেক প্রাণ। যতোদূর এসেছে চিহ্ন এঁকে এঁকে এসেছে। ফেরার সময় যেন জলদিই সেই চিহ্ন অনুসরণ করে ফিরতে পারে তাই। বেশকিছুটা পথ অতিক্রম করতেই কোথাও মনুষ্য হাসির শব্দ শুনতে পেল রাফসান। চমকিত চোখে কান খাড়া করে শুনলো সে হাসি। ভালো করে খেয়াল করতেই সে টের পেল হাসির উৎসস্থল কোনদিকে। তীব্র গতিতে ছুটছে সেদিকে রাফসান। এই ক্ষণে ভুলেই গেল এই শ্বাপদসংকুল অরন্যের কথা। যা থাকল মনে তা কেবলই নীরাকে নিয়ে ভাবনা। রাফসান ঠিক পথেই এগিয়েছে। ঘাসের উপর কাউকে হেঁচড়ে নেওয়ার চিহ্ন দেখতে পেল এগিয়ে। টর্চের আলোয় ঘাসের উপর ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখে থমকে গেল সে। হঠাৎ পাশ থেকে ভেসে এলো আর্তচিৎকার । আবার ছুটছে রাফসান। বুকটা ভার হয়ে আসছে। যতো এগোচ্ছে ততোই ভারী হচ্ছে শ্বাস। রাফসান এসে থামল কাঠ-জ্বলা সেই জায়গাটায়, যেখানে একটু আগে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়েছে নীরার উপর। এক আঙ্গুল ঘাস বিছানো এখানটাজুড়ে। অদূরে ছাই চাপা আগুন। রাফসান নিজেকে সামলে টর্চের আলো ঘুরাতেই দু’কদম দূরে আবার রক্ত দেখল। পা নড়ছে না রাফসানের। বুক ফেটে কান্না আসছে। গাছটার কাছে এসে দাঁড়ায় রাফসান। পুরোটা জায়গার ঘাসে, গাছের গায়ে রক্ত আর রক্ত। অস্পষ্ট স্বরে নীরাকে ডাকে প্রথমে তারপর চিৎকার করে ওঠে নীরার নাম ধরে। হন্যে হয়ে খোঁজে জায়গাটার ঝোপঝাড়। শূন্য হাতে ফিরে আসে সেই রক্তমাখা গাছের কাছে ফের। হাঁটু ভেঙে কান্নায় ভেঙে পড়ে। রাফসানের কান্না থামে কারো টেনে টেনে চলার আওয়াজে। রাফসান ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। কতোক্ষন ওভাবে তাকিয়ে ছিল তার খেয়াল নেই।
নীরা বাঁচবে না জেনেও এই শেষ সময়ে লড়তে চাইল। তাকে এই বাঁধার দেয়াল ভাঙতে হবে, এই কথাটাই শুধু এলো ভাবনায়। কাঠ-খড়ের আলোয় সে ঝাপসা চোখে সামনে খাদ দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ায়। সে মরবে কিন্তু তার আগে এই মানুষ নামের জানোয়ারটাকে শেষ করতে হবে তাকে। জরিনা খালা নিজের জীবন দিয়ে দিল তারই জন্য। হ্যাঁ তারই জন্যে মরেছে জরিনা খালা। তাকে ঐ যন্ত্রণার জীবন থেকে মুক্তি দিতে নিজেকে শেষ করেছে জালিমের হাতে। তবুও স্বেচ্ছায় নত মস্তকে আবার জালিমের জুলুম সইবে? তাকে বাঁচার আশা যারা দিল তাদের জীবন এই পশুর হাতে শেষ হতে দেবে? না! না! নীরাও জরিনা হবে আজ! নিজ হাতে জালিম বধ করবে। নীরার ভয়, ডর একনিমেষে দূরীভূত হলো। অবিন্যস্ত চুলে, রক্ত মাখা ক্ষত বিক্ষত মুখশ্রীতে ফুটল নির্ভিক হাসি। অত্যাচারী জালিমেরা কখনোই মজলুমের সে হাসি সহ্য করতে পারে না৷ রক্ত গরম হয়ে ওঠে,মাথা খারাপ হয় ওদের। বাবলুরও তাই হলো। ছুটে গেল নীরারকে শেষ করতে। নীরা স্থির দাঁড়িয়ে ছিল বাবলুর সামনে। বাবলুকে ছুটতে দেখে দ্রুত সরে গেল পেছনে নীরা। বাবলুর কোনো খেয়াল নেই সেদিক। সে বদ্ধ উন্মাদের মতো হুঙ্কার দিয়ে ছুটে আসে। পাহাড়ের একদম কোনায় দাঁড়িয়ে রইল নীরা। শেষবারের মতো এইটুকু জীবনে সকল পাওয়া না পাওয়ার স্মৃতি ভেসে উঠল চোখে৷ আজ কোনো দুঃখ নেই ওর। দু’চোখে আনন্দ অশ্রু। জীবনের অর্থ ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকায় নয়, তা যে আজই বুঝেছে সে। আরও কিছুকাল এমন সাহসী হয়ে বাঁচতে পারলে ভালোই হতো হয়তো। নীরা চওড়া হাসি হাসল। বড়ো প্রশান্তির সে হাসি। দেহের ব্যথা সব ধুয়ে গেল সেই আনন্দ অশ্রুর জলে। নীরার পেট ছুঁয়ে ছুরি সমেত নিচের খাদে পড়ে গেল বাবলু। আর্তচিৎকারে মুখরিত এই নিস্তব্ধ গভীর রাত। নীরা উবু হয়ে পড়ে ছিল অনেকক্ষণ। ভেবেছিল সহজে মরে যাবে। কিন্তু মরল না সে। ভীরুতা ঘুচিয়ে বাঁচার সাধ যে এখনো বিদ্যমান। গায়ে চাদর জড়িয়ে পড়ে থাকা ছেঁড়া কাপড়ে ক্ষতস্থান বেঁধে নেয়। টেনেটুনে এগিয়ে বড় একটা গাছে হেলান দিয়ে অচেতন পড়ে ছিল। রাফসানের গলারস্বরে চেতনা জাগ্রত হয় নীরার। প্রথম দিকে নড়তে পারছিল না। অনেক কষ্টে গাছ ধরে উঠে দাঁড়ায়। টালমাটাল পায়ে এগিয়ে আসে সমস্ত শক্তি দিয়ে। রাফসান হারানো প্রিয় মানুষটাকে এইরূপে ফিরে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে ছিল কিছুক্ষণ। নীরা আর দু’কদম এগোতেই কোনোকিছুর সাথে বেঁধে হুমড়ে পড়ে ঘাসের উপর। রাফসান “নীরা” বলে ছুটে এসে নীরার দেহটা বুকে টেনে নেয়। নিজ হাতে নীরার মুখের উপর পড়া অবিন্যস্ত চুলগুলোকে সরিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে,
” নীরা! কিছুই হবে না তোমার। চোখ খোলো প্লীজ!”
রাফসানের ঝাকুনিতে নীরা টিপটিপ করে তাকায়। রাফসান বার বার অভয় দিচ্ছে তাকে। নীরা অপলক চেয়ে আছে রাফসানে অশ্রুভেজা মুখে। রাফসান কালক্ষেপণ না করে যে পথে এসেছিল সেপথে রওনা হয় নীরাকে কোলে তুলে। নীরা তখনও দূর্বল নেত্র পল্লব তুলে রাফসানকে দেখছিল। মৃদু হাসল নীরা হঠাৎ। ছুটন্ত রাফসান ভ্রুকুটি করে রেগে বললো,
” হাসছ কেন?”
” কী অদ্ভুত আমার জীবন। যেই ভালোবাসাকে এতোকাল চেয়ে আসলাম; আজ তাকে পেলাম আমার এই শেষ সময়ে।” কথাটা অস্ফুটে বললো নীরা। এই টুকু বলতেই তার কষ্ট হচ্ছিল। রাফসান ধমক দিয়ে বললো,
” একদম ফালতু কথা বলবে না। শেষ সময় কী হ্যাঁ? কিছুই হবে না তোমার। আমি কিছু হতেই দেব না।” কাঁদছে রাফসান। কান্নার কারনে শরীরের শক্তি কমে আসছে। থেমে হাঁটু মুড়ে শ্বাস নিল জোরে জোরে। তারপর আবার ছুটতে লাগল। নীরা দূর্বল হাতটা বাড়িয়ে রাফসানের গাল ছুঁয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠে। রাফসান সকরুণ স্বরে বলে,
” কষ্ট হচ্ছে খুব? ”
নীরা ঘাড় নাড়িয়ে না বলে। রাফসান বললো,
” মিথ্যা বলছ আমাকে?”
” আপনি এতো কেন ভালোবাসলেন আমাকে? আমি যে এখন মরেও শান্তি পাব না।” নীরা টেনে টেনে বলে।
” চুপ! একদম কথা বলবে না আর। যতোসব ফালতু কথা বলো শুধু। বললাম না কিছু হবে না তোমার।”
রাফসান ছুটতে ছুটতে অনুুভব করল নীরার চুপ হয়ে গেছে। একবার বুকে মাথা রাখা নীরার দিকে তাকাল সে। নীরা চোখ মুদে, নিথর পড়ে আছে তার বুকে। রাফসান কয়েকবার ডাকল নীরাকে কিন্তু সাড়া পেল না। পাগলপ্রায় রাফসান নগ্ন পায়ে ছুটছে সামনে। চোখের চশমাটা কখন পড়ে গেছে খেয়াল নেই। তার সম্মুখ ক্রমশ ঝাপসা হতে লাগল। দেহশক্তি কমে আসছে ধীরে ধীরে। ঝাপসা চোখে অদূরে ক্ষীণ আলো দেখতে পেয়ে অন্ধকারেই ছুটছে শক্তি জুগিয়ে। অল্প কিছুদূর গিয়েই পড়ে গেল রাফসান নীরাকে বুকে নিয়ে। দু’চোখ বন্ধ হওয়ার পূর্বে অশ্রুবিসর্জন হলো নীরার মুখটা দেখে,,,
চলবে,,,
ক্যাকটাস
২০(অন্তিম পর্ব)
Writer Taniya Sheikh-Tanishq
বাংলাদেশে এ বছর সফল নারী উদ্যোক্তাদের সম্মানে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে উত্তরায়। সারাদেশ থেকে মোট পাঁচ জন নারীকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হবে আজ। উপস্থাপক মেহের একে একে চার জনের নাম বলে থেমে গেলেন। দর্শক সারিতে চাপা গুঞ্জন আরম্ভ হলো তাতে। মেহের মুচকি হেঁসে প্রথম সারিতে বসা নীরার দিকে তাকাল। নীরার বুকটা ঢিপঢিপ করছে। বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে। মেহের হালকা কেঁশে উঁচু গলায় বললো, ” এবার মঞ্চে আসবেন আমাদের এ বছরের সেরা নারী উদ্যোক্তা মিসেস নাহিদা নিজাম নীরা।” নীরা বিস্ময়ে অভিভূত নিজের নাম শুনে। দর্শক সারি করতালিতে মুখর। পাশে বসা শারমিন নীরার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। নীরা কাঁদছে, প্রাপ্তির আনন্দে তাকে আজ বহুদিন পর কাঁদতে দেখা গেল। নীরা টিস্যুতে চোখ মুছে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাওকে খুঁজছে। অনেক খোঁজা খুঁজি করেও যখন কাওকে পেল না, হতাশ দৃষ্টি আর মনে একরাশ অভিমান নিয়ে উঠে দাঁড়াল। মঞ্চে ওঠার সিঁড়ি দু’কদম পাড় হতেই আবার ঘুরে তাকায় সে। চারিদিকে তারই জয়ধ্বনির করতালি। তার মাঝেও বিশেষ এবং অতি আপন কাওকে খুঁজল সে। না সে নেই এখানে। এই তার ভালোবাসা! ভালোবাসা না ছাই! নীরা কপট রাগে মনে মনে ফুঁসছে। আনমনা হয়ে সিঁড়ি ডিঙাতে গিয়েই শাড়িতে পা বেঁধে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। একটা হাত! সেই প্রিয় মানুষটার ভরসার হাত। নীরা অভিমানে ছলছল তার হাতে ভর দিয়ে মুখ তুললো। চিরচেনা মুচকি হাসি রাফসানের ঠোঁটে। চোখে দুষ্টুমি বিরাজিত। নীরার হাতটা ধরে মঞ্চে উঠে এলো সে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। নীরা মুখ ফুলিয়ে রয়েছে। রাফসান নীরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। মুখটা ওর কানের কাছে নিয়ে চাপা স্বরে বললো,
” উফ! মারডালোগি কিয়া বধূয়া! এই নীল শাড়িতে কিন্তু হৃদয়হরণীয়া লাগছে তোমায়!”
” ওহ! লাগছে তাই না? এতোদিন লাগে নি?”
” এতোদিন, ততোদিন, সবদিনেই তুমি আমার হৃদয়হরণীয়া। এই হৃদয় আমাতে নয় তোমাতে করে বাস। আমি তো আমার নয় তোমার যতোটুকু। ”
” হয়েছে আর আদিখ্যেতা করো না। আসলে কেন? না আসলেই তো পারতে।” চাপা স্বরে কটমট করে তাকায় নীরা।
” চলে যাই তাহলে।” রাফসান দুষ্টুমি করে বলে।
” তোমার ইচ্ছা! ” সবার আড়ালে সতর্কে ভেংচি কাটে নীরা।
” বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে আছ দেখছি। থাকো! কাল যখন দৈনিক পত্রিকাগুলোতে তোমার গোলআলু মার্কা ছবি আসবে, তখন কিন্তু আমাকে কিছু বলতে পারবে না।”
নীরা দাঁত কামড়ে রাফসানের মুখের দিকে রেগে তাকায়। রাফসান মুখে হাত রেখে হাসছে। নীরা কিছু বলবে তখনই পাশ থেকে মেহের বলে ওঠে,
” মিসেস আহমেদ!” নীরা স্বাভাবিক হয়ে তাকায় মেহেরের দিকে। মেহের হাসছে নীরার চুপসে যাওয়া মুখ চেয়ে। রাফসানকে ইশরায় শাসায় মেহের। রাফসান নাক কুঁচকে হাসল শুধু নীরার দিকে তাকিয়ে। যথারীতি পুরষ্কার দেওয়া হলো রাফসানের হাত দিয়ে নীরাকে। নীরার এমনই ইচ্ছা ছিল যেটা মেহের জানত। পুরষ্কার টা নীরা রাফসানের হাতে দিয়ে মঞ্চে বসল সকল উদ্যোক্তাদের সাথে। তাদের প্রশ্ন পর্ব চলবে এখন। শারমিন এবং শোয়েবের মাঝের চেয়ারে গিয়ে বসল রাফসান। শোয়েব মেহেরের দ্বিতীয় সন্তান আড়াই বছরের শ্যামা বাবার কোলে বসেছিল। রাফসান শোয়েবের সাথে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে শ্যামাকে কোলে তুলে নেয়। শ্যামা রাফসানের কোলে বসে পুরষ্কারের ট্রফিটা নাড়তে নাড়তে জিজ্ঞেস করে,
” আঙ্কেল, নিলাভ ভাইয়া আতে নাই?”
রাফসান হেঁসে শ্যামার গালে চুমু দিয়ে বলে,
” না মা! তোমার নিরাভ ভাইয়া তার দাদুকে ছেড়ে কোথাও আসে না।”
শ্যামা ঠোঁট উল্টে বসে বসে ট্রফি নাড়াচাড়া করতে লাগল। শোয়েব রাফসানের দিকে তাকিয়ে বললো,
” আন্টি এলো না কেন?”
” সবই তো জানেন শোয়েব ভাই। সেদিন কেবলমাত্র আমার মুখ চেয়েই মা নীরাকে মেনে নিয়েছিল। আজও নীরা তার পছন্দের মানুষ হতে পারে নি। চেষ্টা নীরা কম করে নি তবুও মায়ের মন পেল না ও।”
” তাই বলে তোমার ছেলেকেও এখানে আসতে দেবে না? নিরাভ দেখবে না তার মায়ের জীবনের এতোবড় মুহূর্তটা?”
” আমার মা এতোটাও নির্দয় নয় শোয়েব ভাই। মা খুব চেয়েছিল নিরাভ এখানে আসুক। নিরাভই আসে নি। সে তার দাদিমনি ছাড়া কোথাও যাবে না। তারউপর মায়ের শরীরটা খুব একটা ভালো নয়। নীরা কিংবা আমিও আসতে চাইনি। মা জোর করে রাগারাগি করে পাঠিয়েছেন আমাদের। নিরাভকে তিনি বলেও রাজি করাতে পারেন নি। সে বলেছে টিভিতে দেখবে তার মা’কে। বাচ্চাদের মনের বিরুদ্ধে জোর করাটা তো উচিত না তাই না?”
” সেটা ঠিক।” শোয়েব হাসল। রাফসান মৃদু হেঁসে মোবাইল অন করে বাসায় কল করে। কল রিসিভ করে ওপাশে নিরাভ হাসিমুখে বলে,
” আসসালামু ওয়ালাইকুম আব্বু!”
” ওয়ালাইকুম আসসালাম মাই বয়! কী করছে আমার আব্বুটা!”
” আমি! আমি তো দাদুমনির কপাল টিপে দিচ্ছিলাম আর তোমাদের দেখছিলাম। আব্বু তুমি রাগ করেছ আমার উপর?” নীরাভ বিষন্ন স্বরে বললো।
রাফসান বললো,
” না তো আব্বু! আমার এতো ভালো আব্বুটার উপর কী রাগ করতে পারি আমি বলো?”
” না মানে! আমি তখন তোমাদের সাথে গেলাম না সেজন্য রাগ করো নি?”
” না!”
” সত্যি?
” হুমম তো!”
নীরাভ খুশি হয়। বলে,
” ইউ আর গুড আব্বু! আমি কেন যাই নি বলি আব্বু?”
” বলো!”
” তোমরা চলে গেলে দাদুমনি একা হয়ে যাবে তাই। দাদুমনির জন্যেই তো তোমরা এক হয়েছ তাই না আব্বু? মা বলেছ দাদুমনিকে একটুও যেন কষ্ট না দেই। তাই তো গেলাম না। তুমি আমার উপর রাগ করো প্লীজ আব্বু!”
রাফসানের পাঁচ বছরের ছেলের কথা শুনে অভিভূত হয়। মুচকি হেঁসে বললো,
” তুমি জানো নিরাভ তুমি আমাদের জন্যে কী?”
” না তো!”
” আল্লাহ তাআ’লার নেয়ামত। এমন নেয়ামত যা সবাই পায় না সোনা। তুমি আমাদের জান, কলিজা সব। জান,কলিজার উপর কেউ রাগ করতে পারে বলো?” রাফসান ভঙ্গি করে বলে কথাটা।
নিরাভ বাবার শেষ কথা শুনে খিলখিল করে হেঁসে ওঠে। বলে,
” তুমি না আব্বু! কী যে বলো আমার শুধু হাসি পায়!”
ছেলের হাসির শব্দ শুনে রাফসানের বড়ো ভাল লাগে। বাবা ছেলেতে আরও কিছুক্ষণ দুষ্টুমি করে কথা শেষ করে। নিরাভ ছুটে গিয়ে দাদুমনির কোলে শুয়ে সব বলতে লাগল। দাদি নাতি গল্প করছে আর টিভিতে নীরা এবং রাফসানকে দেখছে।
সাংবাদিকেরা মঞ্চে বসা প্রত্যেক উদ্যোক্তাদের সাফল্যের পেছনের গল্প শুনতে চাইল। সবাই বললো নিজেদের এ পর্যন্ত আসার গল্প। হঠাৎ এক সাংবাদিক নীরাকে বললো,
” মিসেস আহমেদ, আপনি নাকি ধর্ষিতা ছিলেন?”
পুরো হলে কোলাহল শুরু হলো সাংবাদিকের এই প্রশ্নে। রাফসান রাগে বসা থেকে উঠতে গেলে শারমিন, শোয়েব বাঁধা দিল। সবাই নীরার দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যে সাংবাদিক প্রশ্নটা করেছিল, অনেকে তাকে তিরস্কার করল এমন অশোভন প্রশ্ন করায়। নীরা প্রথমে কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে নিল। রাফসান,মেহেরকে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বললো সে। নীরা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে মুচকি হেঁসে জবাব দিল,
” জি ছিলাম আমি ধর্ষিতা তবে এখন আমি আমিই। এই আমিতে ধর্ষিতা বলতে কিছুই নেই। আশা করি আপনার প্রশ্নের জবাব পেয়েছেন? ”
সাংবাদিক অপ্রতিভ হয়ে পড়ে। তার বাকি সহকর্মীরা চোখ রাঙিয়ে বসতে বললে বসলো সে। পাশ থেকে আরেক নারী সাংবাদিক দাঁড়িয়ে বললো,
” ম্যাডাম আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত আপনার অতীত কষ্টকে জাগানোর জন্য। আমি কিংবা আমরা কী জানতে পারি এই সাফল্যের পেছনের গল্পটুকু?”
নীরা নড়েচড়ে বসলো। রাফসানের আশ্বাস সাহস সঞ্চার করে মৃদু হাসল। বললো,
” জি অবশ্যই। আমার নিজস্ব পরিচয় তো আপনারই সবাই জানেন তবুও আরেকবার বলছি। আমি মিসেস রাফসান আহমেদ। ব্যারিস্টার রাফসান আহমেদকে চেনে না এমন সাংবাদিক হয়তো নেই। এই ব্যারিস্টার রাফসান আহমেদ আমার স্বামী। আমার সাফল্যের পেছনে তার হাত সবচেয়ে বেশি। তিনি না থাকলে আজ হয়তো আমি এখানে থাকতাম না। আমার জীবন যখন নরকসম তখন আল্লাহ পাক তাকে পাঠিয়েছিলেন রহমত স্বরূপ। এই যে মিসেস ইব্রাহীম!ইনি এবং ঐ যে আমার হাজবেন্ডের পাশে বসা আমার বোন। এরাই আমাকে সাহস,শক্তি জুগিয়েছে। আমার চলার পথে ছায়া হয়ে থেকেছে গত দশ বছরে। আমার মতো অনেক মেয়েই ধর্ষণের স্বীকার হয়। যারা মরে যায় তারা তো যন্ত্রণাময় জীবন থেকে মুক্তি পায়। আর যারা বেঁচে থাকে তাদের প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা অতিবাহিত হয় মৃত্যুসম কষ্টের মধ্যে দিয়ে। অনেকে লড়াই করতে চেয়েও পারে না পরিবার,সমাজের কাছে দায়বদ্ধ থেকে। এক এক সময় মনে হতো মরলেই বুঝি মুক্তি আমার। আদৌতে তেমন কিছুই হয় না। পরাজয়ের মধ্যে কোনো মুক্তি নেই। আছে শুধু লাঞ্ছনা, গ্লানি। আমি একটা সময় নিজেকে জীবনযুদ্ধ পরাজিত ভেবে নিয়েছিলাম। মেনে নিয়েছিলাম এই লাঞ্ছনাময় জীবনই আমার নিয়তি। আসন্ন মৃত্যুর সামনে কিছুসময়ের জন্য নিজেকে স্বেচ্ছায় তুলে দিয়েছিলাম। আজ মনে হয় সেটা যদি হতো হবে আত্মহত্যা হতো একপ্রকার। আপনারা অনেকেই জানেন সাত বছর আগে হিমছড়িতে ঘটে যাওয়া আমার দূর্ঘটনার কথা। সেই সেদিনই বদলে গিয়েছিল আমার জীবন। আমি মুমূর্ষু অবস্থায় যখন মৃত্যুর অপেক্ষায় পড়ে ছিলাম ঐ গহীন অরন্যে। ঐ যে দর্শক সারিতে বসা মানুষটাকে দেখছেন! তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে ছুটে গিয়েছিল আমার খোঁজে। জীবনসায়াহ্নে ছিলাম আমি। সেই প্রথম তার চোখে আমার প্রতি ভালোবাসা দেখলাম। নিজের জীবন তুচ্ছ করে কোলে তুলে ছুটছিল আমাকে নিয়ে। তার মাঝে কেবল আমাকেই দেখছিলাম আমি। আল্লাহ পাক আমাকে সুন্দর পৃথিবী,সুন্দর জীবন দেখাতে চেয়েছিলেন। পুরো ছয়টা মাস আমার আপনজনদের, আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার সেবায় সুস্থ হলাম আমি। এরপর তাকে নিজের করে পাওয়াটা ছিল মিরাকলের মতো। আমার জীবন সার্থক তাকে পেয়ে। তার এবং আমার আপনজনদের সহযোগিতায় আজ আমি এই স্থানে। আজ হাজারজন নারী পুরুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আল্লাহ পাকের ইশারায় আমি করতে সক্ষম। একটু একটু করে গড়ে তোলা আমার বুটিক হাউজ, আজ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে রূপ নিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। দেশ বিদেশে সুনাম ছড়িয়েছে। সবই সম্ভব হয়েছে এই মানুষগুলো পাশে থাকায় এবং আমার দৃঢ় মনোবল আর কঠোর শ্রমের দ্বারা। বহু বাঁধা এসেছিল সব বাঁধা টপকে আজ আমি এখানে। সে সময় যদি এই মানুষগুলো পাশে না থাকত, তবে এতো তাড়াতাড়ি এখানে আসাটা সত্যি সম্ভব ছিল না। আমার অনুপ্রেরণা, আমার আদর্শ আমার স্বামী। সবার এমন একটা রাফসান থাকে না। আমি লাকি।ভীষণ রকম লাকি। তবে যারা একলা এতোদূর আসতে পারবে। আমার মতে তারা আমার চেয়েও বেশি লাকি। বিপদে পড়লেই আমাদের ভেতরকার শক্তি সম্পর্কে ধারণা হয়। কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্যে সৃষ্টিকর্তা আমাদের বিপদ দেন না। নিজেকে খুঁজে পেতে,নিজের আসল শক্তি উৎস খুঁজতেই পরীক্ষায় ফেলেন। হতাশার কথা, আমরা সেটা অনেকাংশেই উপলব্ধি করতে পারি নি। পরাজয় মেনে হয় সয়ে যায় নয়ত আত্মোৎসর্গ করি। তারপর উঠতে বসতে দোষ দেই ভাগ্যের,রবের। ধৈর্যশীলদের আল্লাহ পাক নিরাশ করেন না। ভরসা রাখুন একদিন আপনিও হবেন আমারই মতো সফল জীবনে। সুখ দুঃখ চিরকাল স্থায়ী হয় না। দুঃখের মধ্যেও স্বস্তি পাওয়া সম্ভব। সম্ভব দুঃখ ভেঙে সুখী হওয়া। স্বনির্ভর হোন,নিজেকে চিনুন, নিজেকে বুঝুন। কেবল আপনিই পারেন আপনার অবস্থার পরিবর্তন করতে। বিশ্বাস রাখুন রবের প্রতি এবং অবশ্যই আপনার নিজের প্রতি।
মঞ্চ করতালিতে আরেকবার মুখরিত। রাফসান ইশারায় বোঝায় সে গর্বিত তার স্পিস শুনে। সাংবাদিক সারিতে বসা সবাই, এমনকি একটু আগে যে নীরাকে বিব্রতকর পরিস্থিতি ফেলতে চেয়েছিল। সেও করতালি দেয়। সাংবাদিক মেয়েটিও করতালি দিয়ে ফের হাসিমুখে বললো,
” সমাজের মানুষের উদ্দেশ্যে কী বলতে চান?”
নীরা মুচকি হাসল। বললো,
“দেখুন আমি নিজেকে মহান কেউ ভাবছি না। সমাজের কাওকে জ্ঞান দেওয়ার কর্ম আমার না। আমি নিজেকে তেমন বিশেষ কেউ ভাবিও না। তবুও নিজের কিছু আক্ষেপ বলতে চাই। আমরা সবাই জানি এককালে পরিবারে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে পরিবারের লোকেরা অপমানিত বোধ করতেন। কারন সেকালে মেয়ে জন্ম নেওয়াটা অসম্মানের মনে করা হতো। মেয়েদের কোনো অধিকারই ছিল না। এটা বেশি হতো অসচ্ছল, গরিব পরিবার গুলোতে। মেয়ে শিশুর জন্মের পর তাদের ভেতর আশঙ্কা তৈরি হতো সেই মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে। নারীদের পণ্যের মতো ক্রয়- বিক্রয় করা হতো তখন। ভোগ করা হতো যেন সে নামেমাত্র এক জীব। ছোট বেলায় একটা ঘটনা শুনেছিলাম,একটি শিক্ষণীয় ঘটনা, জাহেলি যুগে অনেকে নিজের দশ দশটি কন্যা সন্তানকেও জীবিত কবর দিয়েছে। হাদীস শরীফে এক ব্যক্তির একটি আশ্চর্য ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এক ব্যক্তি মুসলমান হয়েছেন। মুসলমান হওয়ার পর সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের জাহেলী যুগের ঘটনা শুনিয়েছেন। হে আল্লাহর রাসূল! আমার একটি কন্যা সন্তান ছিল। সে দিনে দিনে বড় হতে থাকে। কিন্তু তার জীবিত থাকার বিষয়টি আমার সহ্য হচ্ছিল না। আমি একদিন তাকে তার মায়ের কাছ থেকে কোনো এক বাহানায় নিয়ে গেলাম। আমি তাকে বললাম, চলো একটু ঘুড়ে আসি। পরে আমি তাকে এক খোলা প্রান্তরে নিয়ে গেলাম। সেখানে পূর্বেই আমি একটা গর্ত করে রেখেছিলাম। সেখানে গিয়ে আমি তাকে বললাম, আমি এ কূপটি খনন করব যেন পানি পাওয়া যায়। আমি তোমাকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছি, তুমি বালতিতে মাটি ভরে দিবে আর আমি তা উপরে তুলে নিব। আমার মেয়ে আমার কথা মেনে নিল। সে নিচে নেমে গেল। কিন্তু যখনই সে নিচে নামল আমি তার উপর মাটি দিতে শুরু করলাম। মেয়েটি আমাকে বলল, আব্বা! আপনি কী করছেন? আমার উপর মাটি দিচ্ছেন! কিন্তু আমি এতটাই কঠিন দিলের ছিলাম যে, তার কথায় আমার কোনো আছর হল না। আমি মাটি দিতেই থাকলাম। প্রথমে মাটি তার হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে নিল। পরে পেট, এরপর বুক, তারপর ঘাড়, অবশেষে মাথা পর্যন্ত ঢেকে নিল। এমনকি মাটি যমিনের সমান হয়ে গেল। আমার মেয়েটি চিৎকার করছিল, আমাকে ডাকছিল। এক সময় তার চিৎকার ও ডাকাডাকি শেষ হয়ে গেল। আমি তাকে এভাবে জীবিত দাফন করে ফিরে এলাম। তিনি বলেন, আমি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ ঘটনা শুনিয়েছি তখন তাঁর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। তিনি বললেন, এ কেমন পাষন্ডতা! (আলওয়াফী বিলওয়াফায়াত ২৪/২১৫, কায়েস ইবনে আছেম ইবনে সিনান ইবনে খালেদ-এর জীবনী দ্রষ্টব্য)
এমন বহু নির্মম প্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন আমাদের নবীজি। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাযিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- لاَ يَكُونُ لأَحَدِكُمْ ثَلاَثُ بَنَاتٍ أَوْ ثَلاَثُ أَخَوَاتٍ فَيُحْسِنُ إِلَيْهِنّ إِلاّ دَخَلَ الجَنّةَ. যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান বা তিনজন বোন আছে। আর সে তাদের সাথে উত্তম আচরণ করেছে তাদেরকে নিজের জন্য অসম্মানের কারণ মনে করেনি সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১২। আল্লাহ তাআলা সূরায়ে নাহলে তাদের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন- وَ اِذَا بُشِّرَ اَحَدُهُمْ بِالْاُنْثٰی ظَلَّ وَجْهُهٗ مُسْوَدًّا وَّ هُوَ كَظِیْمٌ یَتَوَارٰی مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوْٓءِ مَا بُشِّرَ بِهٖ اَیُمْسِكُهٗ عَلٰی هُوْنٍ اَمْ یَدُسُّهٗ فِی التُّرَابؕ اَلَا سَآءَ مَا یَحْكُمُوْنَ তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার মুখম-ল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনোস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সুসংবাদ দেয়া হয়, তার গ্লানী হেতু সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে; সে চিন্তা করে যে, হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে রেখে দিবে, না মাটিতে পুঁতে দিবে। লক্ষ্য কর, সে কত নিকৃষ্ট সিদ্ধান্ত স্থির করেছিল। -সূরা নাহল
অথচ আজ দেখুন। চারিদিকে এতো উন্নতি, শুধু নারীদের বেলায় এখনও ভাবনাটা অনেকাংশে আগের মতো আছে। অন্যের দ্বারা লাঞ্ছিত, নিপীড়িত হয়েও আমরা আপনাদের চোখে অসম্মানিত। আজ আমি এখানে তবুও কারো কারো চোখে আমি ধর্ষিতা। আমাকে এতোটা ত্যাগ, এতোটা কষ্টের পরও শুনতে হচ্ছে আমি ধর্ষিতা ছিলাম কিনা? আমাকে ধর্ষিতা হয়েও পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে বাধ্য হতে হয় ধর্ষকের স্ত্রী হতে। এটাও তো এক প্রকার জীবন্ত কবর তাই না? নারী আছে বলেই এই ধরা এতো সুন্দর, নারী আছে বলেই আপনি এতো সুখী। ভুলে গেলে চলবে না আদম (আ)এর সঙ্গী হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছিল মা হাওয়া( আ)কে। আল্লাহ পাক কী পারতেন না সেদিন শুধুমাত্র ভোগ্য বস্তু হিসেবে হাওয়া (আ) সৃষ্টি করতে? তিনি রব। সৃষ্টিকে তিনি সমানভাবে ভালোবাসেন৷ হাওয়া ( আ) কে প্রথম মানবের অর্ধাঙ্গিনী রূপে সৃষ্টি করলেন। সম্মান দিলেন,মর্যাদা দিলেন৷ আমার রব তো আমাদের সম্মানিত করল তবে আপনি কেন পারেন না? নাকি নিজেকে খুবই উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন জীব ভাবেন? যদি ভেবেও থাকেন তো শুনুন। যেই নারীকে আপনি বিবস্ত্র করছেন, লাঞ্ছিত করছেন মিনিট খানেকের আবেগের বশে। সে আপনার মতোই কারো বোন, মেয়ে, কিংবা কারো মা হবে। আপনার মিনিট খানেকের যৌন কামনা কারো পুরোটা জীবন শেষ করে দেয়। যারা বিকারগ্রস্থ তাদের নীতিকথা বলা বাহুল্য। কিন্তু যারা জ্ঞানী, স্বাভাবিক তাদেরকে বলছি নারীকে ভোগের চোখে নয় সম্মানের চোখে দেখুন।আদৌতে সে যেটার হকদার।” নীরার বক্তব্যের উপস্থিত সবাই প্রশংসা করে। রাফসান সহ বাকি নীরার পরিবারের লোক গর্বিত নীরাকে নিয়ে। নীরার বাবা মা টিভির সামনে বসে চোখ মুছল। একদিন যেই মেয়েকে অস্বীকার করেছিলেন গ্রহন করতে। আজ সেই মেয়ের পরিচয়ে পরিচিত হোন তিনি। এই বাড়ি সেটাও মেয়ের তৈরি। নীরার বাবা অনুতপ্ত হোন। ছোট্ট নিরাভ টিভির ওপাশে চুপচাপ মায়ের কথা শুনল। অনুষ্ঠান শেষ হতেই ছুটে গেল নিজের রুমে। আরমান,শিলা এবং আমরিন, মিনহাজ দম্পতি মোবাইলে নীরাকে শুভেচ্ছা জানাল। মেহের সহ সবাইকে নিয়ে চলে আসে বাড়ি নীরা। সবাই মিলে নীরার বক্তব্যের প্রশংসা করছে। নীরা বেশ বিব্রত হলো এতো প্রশংসা শুনে। ফ্রেশ হতে উপরে চলে এলো সে। পিছু পিছু এলো রাফসান। দরজা লাগিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল নীরাকে সে। নীরা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে অবনত মুখে। রাফসান ভীত চোখে নীরাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে থুতনি ধরে নীরার অবনত মুখটা তোলে। বলে,
” ঐ সাংবাদিকের কথা শুনে কষ্ট পেয়েছ?”
নীরা মাথা নাড়িয়ে না বলে। রাফসান কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
” তাহলে?”
নীরা আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে রাফসানের বুকে। দু’হাতে রাফসানকে শক্ত বাঁধনে বেঁধে বলে,
“ঐ দিনের কথা মনে পড়েছে। সেদিন যদি মরে যেতাম তবে এতো সুখ আমার দেখা হতো না।” নীরা ফুঁপিয়ে কাঁদে রাফসানের বুকের শার্ট খামচে ধরে। রাফসান মুচকি হেঁসে বলে,
” কথা দিয়েছিলাম তো কিছুই হবে না তোমার। আমার আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছ সে’কথা রাখতে। সেদিন চোখে জল চলে এসেছিল অচেতন হওয়ার আগে। যখন জ্ঞান ফিরল আমি হাসপাতালের বেডে। চোখ খুলতেই দেখলাম মা পাশে বসে কাঁদছেন। ততক্ষণে সবার বোঝা হয়ে গেছে তুমি আমার জন্য কী! তিনটা মাস তুমি আমার সাথে কথা বলেছিলে না। কী নিদারুণ কষ্টের ছিল। কী করে বোঝাব বলো?”
” আ’ম স্যরি! আমি চাইনি তুমি আমার জীবনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে আরও কষ্ট পাও। মা আমাকে মন থেকে মানতে পারে নি। কোনো মা’ই চাইবে না এমন বিধবা পুত্রবধূ? তাই তো আমি সরে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারলাম কই?”
” আর পারবেও না কোনোদিন। মাকে নিয়ে ভেবো না তুমি। সেদিন যেমন আমার মুখ চেয়ে তোমাকে পুত্রবধূ করতে রাজি হয়েছিল। একদিন দেখবে ঠিক মন থেকেও মেনে নেবে।”
নীরা চোখ মুছে বলে,
” মা আমাকে মেনে নিয়েছে তো?”
” রিয়েলি?” রাফসান বিস্মিত হয়।
” হুমম! এই যে শাড়িটা দেখছ। নিজে এসে দিয়ে গেছে সকালে। আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছেন তিনি। আমি সব পেয়েছি গো! আমার ষোলো আনায় পাওয়া হয়েছে জীবনের।” নীরা নাক টেনে টেনে প্রশান্তির হাসি হাসে। রাফসান হুট করে কোলে তুলে নিয়ে খাটে শুইয়ে দেয় নীরাকে। নীরার ঠোঁটে গভীর চুম্বন দিয়ে বাহুডোরে জড়িয়ে ধরে। বেশকিছুক্ষণ পর রাফসান হাতের উপর ভর দিয়ে শুয়ে নীরার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে,
” আমার যে এখনও এক আনা বাকি নীরা।”
নীরা ভ্রুকুটি করতেই রাফসান ফের নীরার ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,
” একটা প্রিন্সেস চাই আমার নীরা।”
” পাগল! এখন না। নিরাভ আরেকটু বড় হোক তারপর।”
” না এখনই।প্লীজ লক্ষী, সোনা বউটা আমার।”
” না মানে না। সরো আমি নিচে যাব।” নীরা রাফসানকে ঠেলে সরিয়ে অবিন্যস্ত শাড়ির আঁচল গুছিয়ে উঠে দাঁড়াল। রাফসান চোখ ছোট করে ঠোঁট ফুলিয়ে তখনও তাকিয়ে আছে নীরার দিকে। নীরা চোখ পাকাতেই আঁচল টেনে ধরে রাফসান। নীরা শব্দ করে হেঁসে ওঠে। বলে,
” দেখো বেশি হচ্ছে কিন্তু। ছাড়ো !”
” আগে হ্যাঁ বলো।”
” না বলব না।”
” আমিও তাহলে ছাড়ব না।” রাফসান আঁচল ধরে হেঁচকা টানতেই নীরা হুড়মুড় করে পড়ে রাফসানের বুকের উপর। নীরা গাল ফুলিয়ে রাফসানের বুকে মৃদু কিল দিয়ে বলে,
” তখন দেরি করে এলে কেন তুমি? আমার বুঝি ভয় করে না একা।”
” আমি তো আশেপাশেই ছিলাম। দেখছিলাম আমার বউটা আমাকে খোঁজে কী না?” রাফসান নীরার কানে ফু দিতেই নীরা আরও লেপ্টে যায় রাফসানের বুকে। লজ্জা রাঙা হয়ে বলে,
” তো কী দেখলেন?”
” দেখলাম,,,,! ” রাফসান নিজেও আর কিছু বলে না নীরাকেও কিছু বলার সুযোগ দেয় না। মধুর সময় হয়েছে মধুর মিলন ঘটাতে। দিকে দিকে বসন্তের দখিনা পবন সেই গানই কেবল গায়।
রাতে ডিনারের আয়োজন করা হয়েছে। নীরা নীরাভকে ডাকতে ছেলের রুমের দরজায় টোকা দেয়। দরজা খুলতেই মাথার উপর ফুলবৃষ্টি হয় নীরার। পায়ের তলায়, নীরাভের ঘরের সবখানে বাগানের গোলাপ সহ নানা রঙিন ফুলের পাপড়ি ছড়ানো। নীরা পুলকিত হয়। সামনে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীরাভ। মায়ের সামনে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে মাকে ফুলগুলো দেয়। নীরা খুশিতে কেঁদেই ফেলে।ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অজস্র চুমু খায়। ছেলের কোমল হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দু’হাতে তুলে বলে,
” এতোকিছু কেন করলে বাবা?”
” এতোকিছু কই মা? আমার ফুলের মতো মায়ের জন্য এ অনেক সামান্য। আমি বড় হই তারপর আরও বেশি ফুল তোমাকে উপহার দেব।”
” আমার আর কিচ্ছু চায় না সোনা। তুমি অনেক বড় হও এই শুধু চাওয়া।”
নীরাভ মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি মা।”
” আমিও সোনা!”
শারমিনের সাথে গল্প করতে করতে নীরা রান্না ঘর গোছায়। শারমিন এখন একসন্তানের জননী। স্বামী সন্তান নিয়ে ভালোই আছে সে। নীরা বোনের সাথে কথা শেষ করে শ্বাশুড়ির ঘরে আসে। রাহেলা তখন টুসির সাথে কথা বলছিল। টুসি এখন আমেরিকা প্রবাসী। বিয়ের পর ওর স্বামীর সাথে ওখানেই সেটেল হয়েছে। নীরা রুমে আসতে রাহেলা মোবাইল বাড়িয়ে দেয়। ননদ ভাবি বেশ গল্প করে কিছুক্ষণ। নীরার সাফল্যে আনন্দ প্রকাশ করে টুসি। কথা শেষ করে নীরা শ্বাশুড়ির ওষুধ এগিয়ে দেয়। রাহেলা হঠাৎ নীরার হাতটা ধরে কেঁদে ওঠে। নিজের অতীত ব্যবহারে ক্ষমা চায় সে। নীরা হাসিমুখে শ্বাশুড়ির হাতটা মাথার উপর নিয়ে বলে,
” আপনার হাতটা এখানেই থাকুক মা। মায়েদের ক্ষমা চাইতে দেখলে সন্তানের লজ্জা হয়। ভুল ত্রুটি নিয়েই তো জীবন। আপনি আমাকে মেনে নিয়েছেন তাতেই সব ভুলে গেছি আমি।” রাহেলা পুত্রবধূকে আশির্বাদ করে। মন ভরে দোয়া করে নীরার জন্য।
নীরা শ্বাশুড়িকে শুইয়ে দিয়ে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে আসে। মেহের রাফসান পাশাপাশি দাঁড়ানো ব্যালকনিতে। নীরা ওদের দেখে রুম থেকে বেরিয়েই যাচ্ছিল কী নীরা এসে হাত টেনে ধরে। চোখ ছোট করে বলে,
” চলে যাচ্ছিস কেন?”
” না এমনি। তোমরা গল্প করছ তাই। ”
” এভাবে নিজের সম্পদ ফেলে চলে যেতে নেই। যেটা তোর সেটাকে তোরই রাখবি বুঝেছিস?”
” হুমম!” নীরা লাজুক হাসি হাসে। মেহের নিচে মেনে আসে ওদের দুজনের কাছে বিদায় নিয়ে। নিচে ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে শোয়েব৷ তাকে দেখামাত্রই হাসল। কী প্রশান্তির সেই হাসি। মেহেরের জীবন কানায় কানায় পূর্ণ সেই হাসির মানুষটার ভালোবাসায়।
নীরা ব্যালকনিতে আসতেই রাফসান জড়িয়ে ধরল। নীরার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বললো,
” নীরাভ ঘুমিয়েছে?”
” হুমম।”
আকাশে একফালি চাঁদের আলোয় জোস্না ঝরছে। নীরা রাফসান আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে একে অপরকে। হঠাৎ নীরার চোখ পড়ল ব্যালকনির এককোনের ক্যাকটাস গাছে। উচ্ছ্বাসিত হয়ে বললো নীরা,
” এই দেখো ক্যাকটাসে ফুল ফুটেছে।”
” এই গাছে প্রথম কবে ফুল ফুটেছিল মনে আছে?” রাফসান বললো।নীরা হেঁসে রাফসানের বুকে মাথা রেখে বলে,
” হুমম! আমাদের বিয়ের দিন। তুমি একটা ফুল ছিঁড়ে আমার খোঁপায় গুঁজে দিয়েছিলে আর বলেছিলে,
এই কন্টকাকীর্ন জীবনে এই ফুল পরম পাওয়া। ক্যাকটাস! আমার ক্যাকটাস এবার শুধু ফুলের ছোঁয়া,,,
সমাপ্ত