গাংচিল পর্ব শেষ

#গাংচিল
#অন্তিম_পর্ব

অনুভূতিগুলো এক ভয়ংকর কাজ করার উৎসাহ জাগাতে লাগলো। পায়ের পাতার উপর দাঁড়িয়ে আলতো হাতে স্পর্শ করলো সীমান্তের গাল। মৌপ্রিয়ার এমন কাজে হতভম্ব হয়ে গেলো সীমান্ত। তার চোখের দিকে তাকাতেই ভয়ংকর কাজটা ইশারা পেলো সে। ধীর গলায় বললো,
“আমরা রাস্তায় মৌপ্রিয়া, লোকে দেখলে কি ভাববে?”
“লোকে কি ভাববে সেটা আমরা ভাবলে লোকে কি ভাববে।“

বলেই ঠোঁটজোড়ায় নিজের দখল করে নিলো মৌপ্রিয়া। সীমান্ত তখন স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শিরদাঁড়া বেয়ে গরম রক্ত ছলকে উঠে। আবেশে চোখ বুঝে আসে। হাত চলে যায় মৌপ্রিয়ার কোমরে। সময়, সমাজ, মানুষ তাদের যেনো কিছুই খেয়াল নেই। নিজেদের মাঝে বিলীন হয়ে রয়েছে তার। হৃদস্পন্দন বাড়ছে। বৃষ্টির ছিটা ভিজিয়ে দিচ্ছে সীমান্তের পিঠ, কিন্তু নড়ারে ইচ্ছে হচ্ছে না। হঠাৎ করেই বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হলো সীমান্তের। শ্বাস নিতে যেনো খুব কষ্ট হচ্ছে, দম আটকে আসছে। তার শরীর জানান দিচ্ছে, তোমার অন্তিম ক্ষণ সন্নিকটে। অহেতুক কেনো আশা বাড়াচ্ছো? কথাটা মনে হতেই এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো মৌপ্রিয়াকে। সীমান্তের এমন আচারণে হতাবাক হয়ে গেলো মৌপ্রিয়া। তার চোখে হাজারো প্রশ্ন, বিস্ময়। সীমান্তের শীতল দৃষ্টি নজরে পড়তেই থমকে গেলো সে। রক্ত মাংসের হৃদয়টাকে কেউ যেনো খুবলিয়ে খুবলিয়ে চিরে খাচ্ছে। সীমান্ত কোনো কথা বললো না, শুধু বৃষ্টির মাঝে নেমে পড়লো। হনহন করে হাটতে লাগলো বৃষ্টিতে। বুকের ব্যাথাটা বাড়ছে। এটা শরীরের ব্যাথা নয়, হৃদয় ভাঙ্গার ব্যাথা। পিছে থাকাবার ইচ্ছে হলো না, ভয় হলো শ্যামলীর ছলছল নয়নে বিষাদসিন্ধু দেখার। মৌপ্রিয়া ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। নিজের উপর নিজের রাগ হতে লাগলো। এভাবে নিজেকে নিচে না নামালেই পারতো সে_______________

চায়ের ট্রে নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই থমকে গেলো তিয়াশা। বা পাশের বেতের সোফায় বসা নীল শার্ট পড়া যুবকটি হাসি মুখে কথা বলছে রহিমা বেগমের সাথে। যুবকটি আর কেউ নয় তিয়াশার প্রাক্তন এবং স্বামী অন্তু। ছেলেটা তাকে বলেছিলো, কোন শালায় তাকে বিয়ে করবে দেখে ছাড়বে। কিন্তু নিজেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে উপস্থিত হবে এটা ভাবতে পারে নি। তিয়াশার পা যেনো জমে গেলো ট্রে হাতে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো সে। অন্তু তখন দৃষ্টি তার দিকে প্রয়োগ করলো, বাঁকা হাসি দিয়ে জানিয়ে দিলো সে চ্যালেঞ্জ জিতে গেছে। রহিমা বেগম তিয়াশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন, বললেন,
“ভাবি এই যে আমার মেয়ে, আমার মেয়ে কোনো ছেলের চেয়ে কম নয়। একা হাতে আমার সংসার চালায় সে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, ও আমার মা।“

শাহানা বেগম আলতো হেসে বললো,
“মা, আমার কাছে এসে বসো। দেখি তো চাঁদমুখখানা।“

তিয়াশা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো বসলো শাহানা বেগমের পাশে। অন্তু তখন আয়েশ করে চা খাচ্ছে। শাহানা বেগম তাকে নানা প্রশ্ন করছে। তিয়াশা উত্তর দিচ্ছে। এর মাঝেই রহিমা বেগম বললেন,
“ভাবি, ছেলে মেয়ে দুটোকে আলাদা কথা বলার সুযোগ দিলে হয় না?”
“নিশ্চয়ই ভাবী, এ আবার বলতে।“
“তাহলে তিয়া, তুই অন্তু বাবাকে নিয়ে ছাঁদে যা। ওখানে কথা বলঅলি। বৃষ্টি থেমে গেছে, রোদ ও নেই। যা”

তিয়াশা কথা না বাড়িয়ে মাথা কাত করেই উঠে দাঁড়ালো। অন্তুর অপেক্ষা না করে হাটা শুরু করলো। অন্তু ও পিছু নিলো তার।

ছাঁদের কর্ণিশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে তিয়াশা। তার ঠিক পেছনে অন্তু। সে ঝলঝলে আকাশের কুসুম আভা দেখতে ব্যাস্ত। মেঘের ফাঁকে একটা রংধনু ডানা মেলেছে। কি চমৎকার লাগছে। এর মাঝেই তিয়াশা বলে উঠে,
“এসবের মানে কি?”
“কোনসবের?”
“এই যে, বলা নেই কওয়া নেই। চলে এসেছো আমার বাড়ি”
“নিজের বউ কে নিতে এসেছি। তুমি তো বলেছিলে ছয়শ টাকার বিয়ের দাম নেই। তাই এলাম দাম আছে এমন বিয়ে করতে। এতে এতো আপত্তি কেনো তোমার?”

এবার তিয়াশা আর আটকাতে পারলো না নিজেকে। কেদে উঠে বললো,
“কেনো পাগলামী করছো অন্তু? আমাকে ভালোবেসে কি পাবে তুমি? আমার অনেক দায়িত্ব। আমার কাছে আমার দায়িত্বগুলো সবার আগে থাকবে। তোমাকে হয়তো আমি কিছুই দিতে পারবো না।“

তিয়াশার কথা শুনে এগিয়ে আসে অন্তু। আলতো হাতে স্পর্শ করে মায়াবী মুখশ্রী। আবেগজড়ানো কন্ঠে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
“লাগবে না আমার কিছু,, আমার যে শুধু তোমাকে চাই। আমি জানি তোমার উপর অনেক দায়িত্ব। আমি শুহদু চাই সেই দায়িত্ব, কষ্ট, শ্রমটুকু ভাগ করে দিতে। তিয়াশা সাত বছর আগে আমার যেই যোগ্যতা ছিলো না তোমার পাশে দাঁড়ানোর। ইচ্ছা থাকলেও আমি অপারগ ছিলাম। কিন্তু আজ আমি সটান দাঁড়াতে পারবো, বাঁধা আসুক, ঝড় আসুক আমাকে পাশে পাবে তুমি। ঠিক এই ভাবে আগলে নিবো আমি তোমায়। একটা বার আমায় বিশ্বাস করো। আর কত একা একা এই তুফানের সাথে লড়বে। একবার নাহয় একসাথে লড়লাম।“

তিয়াশার কপালে এখনো কপাল ঠেকিয়ে আছে অন্তু। তার দৃষ্টি তিয়াশার সুগাঢ় ছলছল নয়নে। তিয়াশার শীতল হৃদয় বহুবছর পর অন্তুর উষ্ণতায় গলতে শুরু করলো। মোম যেমন আগুনের স্পর্শে গলে বিলীন হয়ে যায়, আজ তিয়াশার শক্ত খোলস ও ভেঙ্গে চুরে যাচ্ছে অন্তুর আকুল প্রেমে। দুজন মানব মানবী নিজেদের মাঝে সমায়িত হয়ে রইলো বহুক্ষণ। রক্তিম সূর্য দাঁড় প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এখনই আধারকে নিমন্ত্রণ জানাবে সে, সেই অপেক্ষায় রয়েছে পৃথিবী।

১০.
অনুপমা প্রকাশনীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মৌপ্রিয়া। গত তিন দিন আগে এখানের এক প্রকাশকের ফোন এসেছে তার কাছে। তারা তার পান্ডুলিপিটা চাচ্ছিলো। তার পেজ থেকে তার খোজ পেয়েছে। তার লেখা নাকি খুব ভালো লেগেছ প্রকাশনী। তার সাথে কাজ করার বিশাল আগ্রহ প্রকাশনীর। মৌপ্রিয়ার কাছে ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হবার মতো। এমনিতেও পান্ডুলিপিটা শেষ। এখন প্রকাশনী থেকে প্রকাশনী ঘুরতো সে। এর চেয়ে যখন প্রকাশনী নিজ থেকে তাকে ফোন দিয়েছে তখন এই প্রকাশনীর কাছেই প্রথম পান্ডুলিপিটা দেওয়া উচিত। তাই নিজেই স্বশরীরে এসেছে প্রকাশনীর অফিসে। আয়াতুল কুরসী পড়ে প্রবেশ করলো বিল্ডিং। বিশাল বিল্ডিং এ ছোট একটা অফিস। সেখানে একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো,
“প্রকাশক সাহেব আছেন?”
“জ্বী অই রুমে গিয়ে বসুন”

মৌপ্রিয়া মেয়েটির দেখানো রুমে যেয়ে বসলো। সময় পার হতে লাগলো কেউ আসার নাম নেই। সামনেই শেলফের সাজানো বই গুলো দেখে তার মনে লোভ জাগলো। এমনেই বসে রয়েছে, বই পড়লে ক্ষতি কি। তাই এগিয়ে গেলো শেলফের দিকে। সাজানো বই এর একটি নাম দেখে থমকে গেলো সে। তা হলো “সীমান্ত ইসলাম”। নামটি দেখেই মনে পড়ে গেলো সীমান্তের কথা। লোকটি যেনো হাওয়া হয়ে গেলো। সেই বৃষ্টিস্নাত বিকেলের পর থেকে আর তাকে দেখে নি মৌপ্রিয়া। হাসি খুশী মনটা হুট করে বিষাদে ভরে গেলো। কেউ সত্যি বলেছে,
“প্রেম মানে সুখ নয়; বরং বিষাদ, বিষাক্ত নীল বিষাদ”

কাঁপা হাতে একটা বই হাতে নিলো সে। মনোযোগে পড়তে লাগলো। লোকটির লেখনী বড্ড পরিচিত লাগছে। কোথায় যেনো পড়েছে সে। উলটে পালটে লেখক পরিচিতিতে গেলো সে। নাহ কোনো ছবি নেই। তবে একটা লাইনে আটকে গেলো মৌপ্রিয়া। সেখানে লেখা,
“মানুষ তাকে ফেসবুকে “ব্যার্থ মানুষ” হিসেবে চিনে।“

এটা “ব্যার্থ মানুষ” এর লেখা বই। সে যে মৌপ্রিয়ার অনুপ্রেরণা। অবশেষে তাকে পেলো মৌপ্রিয়া। তখন ই দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে টগর। পেছনে ফিরে টগরকে দেখেই থমকে যায় সে। সব কিছু যেনো এলোমেলো লাগছে তার কাছে। টগর এই প্রকাশনীতে কাজ করে, সেই টগর সীমান্তের অন্তরঙ্গ বন্ধু, আবার সেই প্রকাশনীর একজন লেখক “ব্যার্থ মানুষ”। যার আসল নাম সীমান্ত ইসলাম। মৌপ্রিয়াকে হতবাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে টগর বলে,
“অবশেষে সীমান্তের পরিচয় উদ্ভাবন করলে তুমি?”

টগরের কথাটাই যথেষ্ট ছিলো সব সন্দেহের উত্তর পেতে। সব গুলো প্রশ্ন এক বিন্দুতে এসে জড়ো হয়ে তা হলো, সীমান্তই ব্যার্থ মানুষ, আর ব্যার্থ মানুষ ই সীমান্ত। ম্যাজেসের জবাব না দিলেও সেই তাকে উপদেশ দিতে হাজির হয় তার মাস্টার হিসেবে। নিজের পরিচয় গোপন করে ঢুকে পড়ে মৌপ্রিয়ার অগোছালো জীবনে। টগর স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“পান্ডুলিপিটা এনেছো?”
“আমি মিথ্যুক, ঠকদের সাথে কাজ করি না। “

কথাটা বলেই বেরিয়ে যায় মৌপ্রিয়া। সীমান্তের মিথ্যের প্রকাশ যেনো তার হৃদয়কে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। পৃথিবীতে মিথ্যুকদের সে পছন্দ করে না। আর তার জীবনের অতিপ্রিয় মানুষটি ই মিথ্যুক। টগর বাঁধা দিতে চায়। কিন্তু পারে না। মৌপ্রিয়া ছুটে বেড়িয়ে যায়। দম আটকে আসছে তার। কষ্টে বেদনা বুক ঝাজড়া হয়ে যাচ্ছে। কেনো মিথ্যে বলতে হলো সীমান্তকে? কেনো? কেনো?

রাত ৩টা,
হুট করেই ঘুম ভেঙ্গে যায় সীমান্তের। শ্বাস নিতে পারছে না সে। দম আটকে আসছে। বুকে ব্যাথাটা প্রকট হয়ে গিয়েছে। মৃত্যু যেনো তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সময় বুঝি শেষ হতে চললো। নাক দিয়ে শীতল তরল বের হচ্ছে। হাত দিতেই দেখলো রক্ত, টাটকা লাল রক্ত। পাশেই টগর ঘুমাচ্ছে। কিন্তু তাকে জাগাতে পারছে না। স্বর ই বের হচ্ছে না গলা থেকে। মনে মনে বললো,
“আল্লাহ, একটু সময়। একটু সময়। আমাকে এখন নিও না”

খুব কষ্টে ধাক্কা দিলো সে টগরকে। ধাক্কা খেতেই তড়াক করে উঠে গেলো টগর। পাশে তাকাতেই মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো তার। সীমান্তকে এমন অবস্থায় মোটেই আশা করে নি। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো সে। জোরে জোরে বললো,
“দোস্ত আমি এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাবো তোকে, এখনই”

বলেই উঠে চিৎকার করতে লাগলো সে। সবাই জড় হতে লাগলো। সীমান্তের দৃষ্টি ঝাপসা হচ্ছে। আশেপাশের কোলাহল ক্ষীন হচ্ছে। তার মনে হলো সে তলিয়ে যাচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে অতল সাগরে________

তিনদিন পর,
তিয়াশার পাশে বসে রয়েছে মৌপ্রিয়া। দিন পাঁচেক বাদে তার বিয়ে অন্তুর সাথে। বান্ধবীর সুখে তার পাশে থাকবে না এতোটা নিষ্ঠুর নয় মৌপ্রিয়া। নিজের দুঃখকে বড় করে দেখার সময় এখন নয়। তিয়াশাটা বহুকাল বাদে সুখ পাচ্ছে। ভেবেই ভালো লাগছে মৌপ্রিয়ার। তিয়াশা শাড়ী গুলো দেখিয়ে বললো,
“কোনটা পড়বো রে? আমি সত্যি ই খুব কনফিউজড”
“লালটা পড়, তোকে পুতুলের মতো লাগবে।“
“তুই না থাকলে আমার কি হতো বলতো?”
“এখন তোমার জীবনে আমার দরকার নেই, সে তোমাকে দেখে রাখবে।“

মৌপ্রিয়ার কথায় তিয়াশার গালজোড়া রক্তিম হয়ে উঠে। লাজুক কন্ঠে বলে,
“আর ঠেকাতে পারলাম নারে। মানুষটাকে আর ফেরাতে পারলাম না। অনুভূতিপ্রবণ মনের কাছে হেরে গেছি। অন্তুর ভালোবাসার কাছে মাথা ঠেকেছি।“
“যা যথার্থ তাই করেছিস। প্রকৃত ভালোবাসাকে ঠেলে দিতে হয় না তিয়া। তাকে শক্ত করে আঁচলে বাঁধতে হয়। বেশ ঠেলে দিলে সেই ভালোবাসা হারিয়ে যায়। আর প্রকৃত ভালোবাসা কজন পায় বল।“

মৌপ্রিয়ার কথায় সুপ্ত বেদনা লুকায়িত, সেটার উপস্থিতি ঠিক টের পেয়েছে তিয়াশা। সে কথা ঘুরিয়ে নিলো। আবারো শাড়ীর দিকেই ঘুরিয়ে দিলো মনটা। মৌপ্রিয়া ঠোটের কোনে হাসি ফুটিয়ে শাড়ি দেখতে লাগলো।

রাত ৯টা,
ইফতেকার সাহেব বাড়ি ফিরলেন কলেজের মিটিং সেরে। আজ জ্যামটাও বেশ ছিলো। আজ কলেজে টগর এসেছিলো। সীমান্তের অসুস্থতার কথা জানিয়েছে। হয়তো ছেলেটা বেশিদিন বাঁচবে না। আকুতি কলো ছেলেটা যেনো মৌপ্রিয়া বই টা বের করে। ইফতেকার সাহেব উত্তর দেন নি। সময় চেয়েছে কিছুদিন।

বাড়িতে ঢুকেই দেখা হলো নীলুর সাথে। তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“মৌ কোথায় রে?”

নীলু হিনহিনে কন্ঠে বলল,
“আর কই থাকবো, যায়ে দেখেন কালা শাড়ী পিন্দা, চুল ছাইড়ে পেত্নীর মতো বারান্দায় বইয়ে আছে।“
“তোর কাছে কথা বলেছে?”
“আমাকে পাগলায় কামরাইছে আমি তারে কিছু কই, ডর লাগে না মনে?”
“হুম, বুঝলাম। যা দুকাপ চা নিয়ে আয়। বাপ বেটি এক সাথে চা খাবো।“
“জে, আচ্ছা।“

বলেই নীলু চলে গেলো রান্নাঘরে। ইফতেকার সাহেব গেলেন মৌপ্রিয়ার রুমে। সত্যি মেয়েটা বারান্দায় বসে আছে। ঘর অন্ধকার, কালোর মাঝে যেনো মিলিয়ে যেতে চাচ্ছে সে। শান্ত নজরে তাকিয়ে আছে সে বাহিরের দিকে। ইফতেকার সাহেব মেকি উৎসাহ নিয়ে বললেন,
“কি রে মৌরানী, তারা গুনছিস? তা এই জন্য কয়টাকা দিচ্ছে তোকে তোর ভক্তরা।“

মৌপ্রিয়া উত্তর দিলো না। সে এখনো বাহিরেই তাকিয়ে থাকলো। ইফতেকার সাহেব পাশে বসতে বসতে বললেন,
“জানিস, ওই পাজি টগরটা এসেছিলো। আমাকে রিকুয়েস্ট করতে। আমি ঐ মিথ্যুকটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছি।“
“মিথ্যে বলছো বাবা?”
“আমি আর মিথ্যে? অসম্ভব”
“আমি জানি তুমি তাকে বের করো নি। এখন আমার কাছে রিক্যুয়েস্ট করবে যেনো আমি বই টা বের করি।“
“তুই সত্যি বই টা বের করবি না?”

মৌপ্রিয়া চুপ করে রইলো উত্তর দিলো না। বরং শূন্য আকাশের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,
“বাবা, আমাদের বাপ বেটির ভালোবাসার গল্পগুলো এতো বেদনাদায়ক কেনো? কেনো আমাদের ভালোবাসার ভাগ্যটা খারাপ? আমরা কি ভালোবাসতে পারি না?”

মেয়ের প্রশ্ন শূনে থমকে গেলেন ইফতেকার সাহেব। ইফতেকার সাহেব নিজেও জানে না এই উত্তর। বাবাকে চুপ করে থাকতে দেখে কথা পালটায় মৌপ্রিয়া। ধীর স্বরে বলে,
“কি যেনো বলতে এসেছিলে তুমি বলো।“
“সীমান্ত হাসপাতালে, খুব অসুস্থ। লিউকোমিইয়া তার শরীর ঝাঝড়া করে দিয়েছে। একটা চিঠি পাঠিয়েছে তোর জন্য। আমি টেবিলে রেখে যাচ্ছি, ইচ্ছে করলে পড়িস।“

তখন ই নীলুর প্রবেশ ঘটে। লাইট জ্বালায় ঘরে। তীব্র আলোতে চোখ ধাধিয়ে যায় মৌপ্রিয়ার। নীলু চা নিয়ে এসেছে। মৌ উঠে বাবাকে বলে,
“চলো চা খাই। কত দিন বাও বেটিতে চা খাই না।“

মৌ এর স্থির থাকা দেখে মনটা কেঁদে উঠে ইফতেকার সাহেবের। মেয়েটা তার সত্যি ই পাথর হয়ে গেছে। তাই তো সীমান্তের অসুস্থতাও কাঁদাচ্ছে না তাকে।

ইফতেকার সাহেব যাবার পর চিঠিটা হাতে নেয় মৌপ্রিয়া। সাদা দামী কাগজে গোটা গোটা হাতে লেখা। সীমান্তের হাতের লেখা তার মতোই সুন্দর। মৌপ্রিয়া পড়তে শুরু করে,
“ “প্রিয়” শব্দটি ব্যাবহার করার খুব ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু তোমার আমার সম্পর্কটা এতোটাই জটিল যে প্রিয় শব্দটা আমি ব্যাবহার করতে পারবো না। এই চিঠিটা যেহেতু তুমি পড়ছো এর মানে আমার অন্তিম ক্ষণের কাছাকাছি আমি পৌছে গেছি। এখন আমি তোমার কাছে কিছু লুকাবো না। কারণ এখন যদি আমি তোমার থেকে লুকিয়ে যাই, হয়তো কথাগুলো কোনোকালেই বলা হয়ে উঠবে না। হয়তো, আমি আশা ছাড়ছি না বাঁচার।

তোমার জন্য এই চিঠিটা যখন লিখতে বসেছি, তখন মস্তিষ্ক অজস্র শব্দ আমার দিকে ছুড়ে দিচ্ছিলো। কিন্তু কেনো যেনো কিছুই সাজাতে পারছিলাম না। ক্লান্ত আমি চোখ বুঝলাম, চোখ বুঝতেই তোমার সাথে কাটানো ক্ষুদ্র জীবনের মূহুর্তগুলো জীবন্ত হয়ে উঠলো। হাসি,কান্না,অভিমান, রাগ সমস্ত অনুভূতিগুলো জড়ো হতে লাগলো। অজান্তেই আমার ঠোঁটে তোমার মনের ব্যালকনির এক চিলতে কুসুমপ্রভাত ঠাই নিলো। জীবনের অন্তিম সময়টায় তুমিহীন কাটানোর ভয় চোখের কোনায় জড়ো হলো। আমি কিন্তু মরতে ভয় পাই না। তিনবছর রোগের সাথে যুদ্ধ করে করে আমি নিজের মনকে অসীম শক্তিশালী করে তুলেছিলাম, ভেবেছিলাম মৃত্যুর মুখোমুখি বীরের মতো হবো। পিছুটান রাখি নি কেবল এই বীরত্ব দেখাতে। কিন্তু এই প্রথম আমার ভয় হচ্ছিলো। কালো বিশ্রী ভয় আমাকে নাড়িয়ে দিচ্ছিলো। তখন আমার বুকের ভেতরে তোমার প্রতি সদ্য জন্ম নেওয়া নবঃ ভালোবাসাটুকু বেঁচে থাকার আকুতি মিনতি করতে লাগলো। আমি সত্যি ই ভাষা হারালাম। কলমটা চলতে চাইছে না, আমি কিভাবে তোমার জন্য চিঠিটা লিখবো বলো তো?

আমি চোখ মেললাম, আমার সাদা কাগজে তোমার মায়াবী মুখশ্রীটা ভেসে উঠলো। শ্যামলী মুখের ক্যানভাসের যেই অব্যক্ত অনুভূতিগুলো আমি যেনো অনুভব করছি। সেই বৃষ্টির দিনের স্পর্শ এখনো ঠোঁটে লেগে আছে জানো তো। আমি সেদিন তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি একরাশ বিষ্ময়, প্রশ্ন এবং কান্ন নিয়ে আমার পানে চেয়েছিলে। তোমার ভালোবাসাটার প্রতিত্তোরে আমি কেবলই তোমাকে শীতল চাহনী দিয়েছিলাম। ঠান্ডা বর্ষাস্নাত বিকেলে আমার শীতল চাহনী তোমার উষ্ণ হৃদয়কে চুরমার করে দিয়েছিলো। আমি কে অপারগ ছিলাম কাজললতা, একজন মৃত্যু পথযাত্রী ব্যাক্তি কাউকে ভালোবাসা মিথ্যে আশা দিতে পারে না। সেটা যে নিষ্ঠুর হতো! অন্যায় হতো!

তুমি ভাবছো আমি ঠক, আমি তোমাকে ঠকিয়েছি। হ্যা, আমি মিথ্যে বলেছি। তবে তোমাকে ঠকাই নি। “ব্যার্থ মানুষ” কাউকে ঠকায় না। তুমি তো আমার সাহায্যই চেয়েছিলে। আমার মতামত, তোমার লেখনী। আমি “ব্যার্থ মানুষ” হিসেবে আড়ালে তোমাকে সাহায্য করতে চাই নি। চেয়েছি, নিজস্ব পরিচয়, স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে তোমাকে সাহায্য করতে। আর আমি সফল। তুমি এখন কেবল শব্দ লিখো না, তুমি সেই রঙ্গ বেরঙ্গের শব্দের অনুভুতি গুলো অনুভব করতে পারো। এটাই তো চেয়েছিলো। শুনেছি তুমি নাকি বইটা বের করবে না। আমার উপর অভিমান করেছো এক সাগর। অভিমানটা জমা থাক, যদি বেঁচে ফিরে আসতে পারি তবে নিজ হাতে ভাঙ্গিয়ে দিবো। স্রষ্টা করুনা করলে তোমার ওই শ্যামা মায়াবী মুখের ক্যানভাসে আমার সৌভাগ্য লেখা থাকতে পারে। হয়তো কোন এক গোধুলীতে আমি ফিরে এলাম তোমার কাছে, আবেগজড়ানো কন্ঠে বললাম,
“কাজললতা, আমি ফিরে এসেছি। শুধু তোমার জন্য”

স্বপ্ন দেখতে দোষ কি বলো! তবে তোমার কাছে আমার এক একটা আর্জি, “গাংচিল” বইটা তুমি ছাঁপাবে। বইটায় শুধু তোমার সঞ্চিত শব্দই নয়, আমার আর তোমার কাটানো অজস্র মূহুর্ত রয়েছে। তুমি আমার এই আর্জিটুকু রেখো। এই বইটাই আমার আর তোমার গল্পের সূচনা অধ্যায়। বইটা তুমি ছাপিও। এতোটুকু আর্জি রইলো।

ইতি
তোমার আবালচন্দ্র মাস্টারমশাই”

মৌপ্রিয়া খেয়াল করলো তার গাল ভিজে গেছে। ঠিক কতোদিন পর কাঁদছে জানা নেই। তবে সে কাঁদছে। আজ বুকফেটে বিষাদ সিন্ধু মুক্তি পাচ্ছে। সে কাঁদছে। কাঁদছে তার সীমান্তের জন্য____________________

১১.
“বসন্তের প্রথম সপ্তাহ,
শীতের ক্ষরতা কেটে আমগাছটায় নতুন পাতার জন্ম হচ্ছে। রুক্ষ্ণ পরিবেশটা সতেজ হয়ে উঠছে। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের স্প্রিং অর্থাৎ বসন্ত খুব ভালো লাগে। কিন্তু আমার কেনো জানে বসন্তটা ভালো লাগে না। সে মানুষের অন্তরেই শীতলতা বিরাজমান তার মনে বসন্ত ঠায় পাবে কিভাবে। ব্যাপারটা অবাককর কিন্তু সত্যি। রাসেল ভাই এর চলে যাবার পর আমার জীবনটা অনেক অংশেই বদলে গেছে। আমার জীবনের উষ্ণতাকে কেড়ে দিয়ে এক রুক্ষ্ণ শীতলতার জন্ম দিয়েছে তার সাথে বিচ্ছেদ। আমার হৃদমন্দিরের দরজায় বড় তালা ঝুলিয়েছি আমি। তার সাথে কাটানো সেই ক্ষুদ্র জীবনের হাসি, কান্নার মূহুর্তগুলোই আমার বাঁচার একমাত্র মাধ্যম। এটা ভাবার কোনো মানে নেই যে আমি হাসতে ভুলে গেছি। না আমি হাসতে ভুলি নি; তবে আমি কাঁদতে ভুলে গেছি। আমার বুকের ভেতর জমাট বাধা কান্নাগুলো পাথর হয়ে গেছে। এক কোনে জন্ম নেওয়া ভালোবাসার ফুলটা বাঁচার আর্জি জানাচ্ছে। কিন্তু আমি তাকে তোল্লাই করছি না। কেনো করবো? যে মানুষটার জন্য এই ফুলের পরিচর্যা করতাম সে তো নেই। সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। সেদিন যদি তিনি একটু আমার উপর বিশ্বাস রাখতেন তাহলে হয়তো এই বিয়োগটা হতো না। কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরিবারের খুশির জন্য, আমার খুশির জন্য। আমাকে অন্য পুরুষের আলিঙ্গনে দেখতে পারবেন না বলে নিজেই পাড়ি দেন অজানাতে। অথচ আমি তো সেদিন বিয়েটাই করি নি। বিয়ের আসর থেকে চলে এসেছিলাম তার জন্য। কিন্তু হয়তো আমার সময়ের হিসেবটা ভুল ছিলো। মানুষটা ততক্ষনে চলে গেছে বহুদূর। আমি জানি না রাসেল ভাই বেঁচে আছেন কিনা, তিনি ভালো আছেন কিনা! তবে এটুকু জানি আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ পুরুষটি ঐ নাক উঁচু, খিটখিটে, জীরাফটাই ছিলো, আছে এবং থাকবে। আমার ভাবনায় ছেদ করলো বাবা। ভারী কন্ঠে বললেন,
“মৌ মা, তুমি কি ব্যাস্ত?”
“না তো বাবা, কিছু বলবে?”
“স্টাডি তে একটু আসো। তোমার সাথে দেখা করবে বলে একটা যুবক এসেছে।“
“আমার সাথে কেনো?”
“সেটা তো বলতে পারবো না, তবে সে বলছিলো তোমার সাথে চট্টগ্রামের ক্যাম্পে দেখা হয়েছে। বন্যা পীড়িতদের সেবা করার সময় সেই ব্যাক্তি তোমাকে দেখেছিলো। খুব কৃতজ্ঞ তোমার কাছে সে।“

বাবার কথায় বুঝলাম যুবকটি হয়তো, “সুবোধপুর” গ্রামের কেউ। আমি ওড়নাটা ঠিক করে বললাম,
“চলো”

বাবার পিছু পিছু গেলাম স্টাডি রুমে। একটা সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত যুবক আমাদের দিকে পিঠ করে বসে আছে। লোকটাকে পেছন থেকে দেখেই আমার হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগলো। শীতল হৃদয়ে হুট করে এক রাশ আশা জড়ো হলো। আমি জানি এগুলো মিথ্যে তবুও মন মানতে নারাজ। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। বাবা আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকলো। আমি ধীর স্বরে বললাম,
“কে?”

যুবকটি পেছনে ফিরলো। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি স্তব্ধ, পা জোড়া মাটিকে আকড়ে ধরলো। দৃষ্টি অজান্তেই ঝাপসা হয়ে গেলো। ছয়মাসের শীতলতা যেনো গলতে লাগলো মোমের মতো আমার চোখ বিশ্বাস করতে চাইছে না। আমার সামনে আমার হৃদমন্দিরের সেই দেবতা দাঁড়িয়ে আছে। আমার সামনে রাসেল ভাই দাঁড়িয়ে আছে। মুখ থেকে অস্পষ্ট স্বরে বেড়িয়ে এলো,
“রাসেল ভাই?”

রাসেল ভাই তার ভুবনভূলানো হাসি হাসলেন। এগিয়ে এলেন আমার কাছে। মুখশ্রী আলতো হাতে স্পর্শ করলেন। আমি কেঁপে উঠলাম। তারপর তিনি আবেগজড়ানো কন্ঠে বললেন,
“কাজললতা, আমি ফিরে এসেছি। শুধু তোমার জন্য”
____________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
হাসপাতালের সাদা বিছানায় শায়িত যুবক বইটা বন্ধ করলো। বই এর নামটা আবারো দেখে নিলো সে; “গাংচিল”। যুবকের মুখে তৃপ্তির হাসি, সে বইটা আবারো খুললো। আগ্রহ নিয়ে পড়তে লাগলো উৎসর্গের পাতাটি। সেখানে লেখা,
“উৎসর্গ
আমার জলসমুদ্রের মাঝের ক্ষণস্থায়ী গাংচিল তিনি।
আমার জীবনকে নতুন দিক দেখিয়ে হারিয়ে গেছেন দূর অজানায়।
তার নামটি বললে পৃথিবী জেনে যাবে, তাই আমার লুকায়িত প্রকোষ্ঠেই থাক।
শুধু বললো, আমি অপেক্ষায় আছি শুধু তার জন্য।“

লাইন কটি পড়ে তার ঠোঁট বিস্তৃত হলো। হাসিটা চোখে প্রতিবিম্ব ফেলছে। এর মাঝেই এক কৃষ্ণ যুবকের আগমন ঘটলো। পরণে সাদা কোর্ট। কালো হলেও লোকটা দেখতে বেশ সুদর্শন। সে এই হাসপাতালে ডিউটি ডাক্তার। লোকটির নাম “সুব্রমান্নিয়াম চাইতাইন্নিয়া”। তামিল নামটা উচ্চারণ করতে কষ্টই হয়। লোকটি হিন্দি পারেন না, তামিলে কথা বলেন। কিন্তু শায়িত যুবক তামিলের ত টাও পারে না। তাই তাদের কথাগুলো ইংলিশেই হয়। সেগুলোকে বাংলায় ট্রান্সলেট করলে যা দাঁড়ায় তা হলো,
“কি মিষ্টার ইসলাম? এখন শরীর কেমন?”
“জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালো।“
“কোথাও কোনো অস্বস্তি তো নেই?”
“না, ডাক্তার। আমার রিপোর্ট কি এসে পড়েছে।“

এবার ডাক্তার সুব্রমান্নিয়াম কিঞ্চিত হাসেন তারপর বলেন,
“বাড়ি যাবার খুব তাড়া বুঝি?”
“জ্বী, সেটা তো থাকবে। একজন যে আমার অপেক্ষায় আছে।“
“গার্লফ্রেন্ড।“
“আজ্ঞে না”
“তাহলে?”
“আমার হৃদয়ের মাঝে বিস্তারকারী মহারানী, আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ নারী।“

ডাক্তার সুব্রমান্নিয়াম কি বুঝলেন জানা নেই। তবে একটা স্বচ্ছ হাসি হাসলেন। যুবক এবার বাহিরের দিকে তাকালো। বসন্ত সত্যি ই এসে গেছে। ঝরা পাতার বদলে নতুন সজীবতায় সাজছে প্রকৃতি। হাসপাতালের জানালা দিয়ে আকাশটা বড্ড ছোট মনে হয়। সে অপেক্ষায় রয়েছে, কবে এই জানালার শিকল ভেঙ্গে প্রকৃতিতে আবারো পা রাখবে________________

গাড়িতে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে মৌপ্রিয়া। আজ অনেক বেশি ক্লান্ত সে। অবশেষে বই মেলার দিন চলে এসেছে সন্নিকটে। প্রস্তুতি চলছে সেই সাতদিনের। মৌপ্রিয়ার বইটা অবশেষে বের হচ্ছে। বেশ ভালো মার্কেটিং করেছে অনুপমা প্রকাশনী। পাঁচশত বই ছাঁপিয়ে ছিলো তার মাঝে দুশত এর বেশি বিক্রয় হয়েছে প্রি অর্ডারে। এখন বই মেলার অপেক্ষা, এবার হয়তো তাকে হতাশ হতে হবে না। বইটা নিয়ে সবাই খুব ভালো রিভিউ ও দিয়েছে। একটু আগেও একটা লাইভ করে এসেছে সে। লাইভটা ছিলো প্রকাশনী থেকে। সূবর্ণার বাসায় বই এর কপি পাঠানো হয়েছে। বইটা তার ও বেশ মনে ধরেছে। মায়ের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে বেশ তৃপ্তি হাসি ফুটে উঠলো মৌপ্রিয়ার মুখে। আজকাল অনুপমা প্রকাশনীর সাথেই অতঃপ্রতভাবে জড়িয়েছে সে। সামনের বই গুলোও এই প্রকাশনী থেকেই বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। যতই হোক, প্রকাশনীর সাথে যে তার হৃদয়ের টান। এখন আর পান্ডুলিপি নিয়ে তিয়াশাকে যন্ত্রণা করে না মৌ, তিয়াশা মন দিয়ে তার সংসার করছে। এই তো গত সপ্তাহেই সে এবং অন্তু গিয়েছে হানিমুনে। তিয়াশার জীবনটা অবশেষে রঙ্গিন হতে লেগেছে। ভাবতেই ভালো লাগে। একা একা কতই না কষ্ট করতো মেয়েটা।

জীবনের অনেক অগোছালো অংশগুলো এখন সসজ্জিত হয়ে উঠেছে। ভেবেই ভালো লাগে মৌপ্রিয়ার। কিন্তু এখনো একটা এলোমেলো অংশ এলোমেলোই রয়েছে। তার হলো তার মাস্টারমশাই। লোকটা কোথায় যে আছে তার এখনো জানে না মৌপ্রিয়া। দেখতে দেখতে কতগুলো মাস পেরিয়ে গেলো। সেই বৃষ্টিস্নাত গোধূলীটাই ছিলো তাদের শেষ দেখা। এরপর হাজার খুজেও তাকে পায় নি মৌপ্রিয়া। হৃদয়ের একটা অংশ কেমন যেনো হাহাকার করে। আচ্ছা লোকটা কি বেঁচে আছে। গাড়ির ব্রেক কষাতে স্বম্বিত ফিরে তার। বাড়ি চলে এসেছে। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আছে। কলিংবেল বাজাতেই নীলু দরজা খুলে। মেয়েটার উজ্জ্বল মুখখানা দেখে মাথা থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মৌপ্রিয়া। ব্যাগটা ওর হাতে দিয়ে বলে,
“বাবা কোথায়?”
“খালুজানে এস্টাডি রুমে। আপনের জন্য বয়ে রইছে।“
“আমার জন্য কেনো?”

নীলু হাসতে হাসতে বলে,
“যায়ে দেখেন কি এক কান্ড করছে খালুজান”

নীলুর হাসির রহস্য অজানা মৌপ্রিয়ার। সে পা বাড়ায় স্টাডির দিকে। স্টাডি রুমে যেতেই মৌপ্রিয়া দেখে তার বাবা মোটা বইয়ের মাঝে মুখ গুজে বসে রয়েছেন। ইফতেকার সাহেবের সামনে বসতে বসতে মৌপ্রিয়া বলে,
“নীলু বললো, তুমি নাকি আমার অপেক্ষায় বসে আছো?”
“তুই এসেছিস। যাক ভালোই হলো। বেশ ইম্পোর্টেন্ট কাজ আছে তোর সাথে। বয় বয় সামনে বয়।“
“বলো কি কাজ?”
“আমি তোর জন্য নতুন “স্টেনোগ্রাফার” খুজেছি, তোর রুমেই বসে আছে ছেলেটা।“

বেশ উৎসাহিত কন্ঠে কথাটা বললেন, ইফতেকার সাহেব। বাবার মুখে তাজ্জব কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো মৌপ্রিয়া। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“মানে টা কি?”
“মানে আবার কি হবে, লেখিকাদের স্টেনোগ্রাফার প্রয়োজন। তোর বই মাশাআল্লাহ বেশ ভালো করেই বিক্রি হচ্ছে। আমার মনে হয়, সামনে বই মেলাতে আরেকটা ভালো বই লিখতে পারবি। সেজন্য ই এই স্টেনোগ্রাফার। যা উপরে যা, ছেলেটা অপেক্ষা করছে।“
“তাই বলে আমার রুমে পাঠিয়ে দিবে? একটা অজানা ছেলেকে?”
“আরে ধুর, ও তো তোর সাথে কাজ করবে। তাই তো সরাসরি তোর রুমে পাঠিয়েছি। তোর বইগুলো পড়লে তোর একটা ধারণা হবে তুই লেখিকা কেমন। যা যা দের করিস না।“

মৌপ্রিয়ার রাগ হচ্ছে, কিন্তু রাগকে দমন করে রাখলো। সত্যি ই তার স্টেনোগ্রাফার দরকার।সীমান্তের যাবার পর থেকে লেখায় খিল হারিয়ে ফেলেছে সে। যদি এই যুবক তাকে নতুন করে লিখতে সাহায্য করে! ধীর পায়ে হেটে নিজের রুমের কাছে গেলো মৌপ্রিয়া। একটা মিহি কন্ঠ কানে এলো,
“এক জনে ছবি আকে এক মনে
ও রে মন
আর এক জনে বসে বসে রং মাখে
ও আবার সেই ছবিখান নষ্ট করে কোন জনা কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা
তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা”¬______

কন্ঠটা খুব চেনা। বুকের মাঝে অসংখ্য আশা এসে ভর করে মৌপ্রিয়ার। মনের ভেতরের মুর্ছা যাওয়া ভালোবাসাটা জীবন্ত হয়ে উঠে। পা জোড়া এগোতে চাইছে না, একচিলতে ভয় ও উকি দিচ্ছে। যদি আশাহত হয়, যদি সে যাকে কল্পনা করছে সে না হয়। কি করবে তখন। নিজেকে ভুল্ভাল বুঝিয়ে শান্ত করে মৌপ্রিয়া। এক রাশ সাহস নিয়ে দরজা ঠেলে দেয় সে। মূহুর্তেই স্তব্দ হয়ে যায় সে। শিরদাঁড়া বেয়ে এক অনন্য শিহরণ বয়ে যায়। গলার কাছে সকল অনুভূতিগুলো জড়ো হয়। এ যে তার মনমন্দিরের সেই মানুষটা, যাকে হারিয়েছিলো পাওয়ার আগেই। তার মনের জলসমুদ্রের খাবি খাওয়া গাংচিল। অস্পষ্টস্বরে বলে,
“সীমান্ত?”

সীমান্ত দৃষ্টি ঘোরায়। বাহিরের আকাশ থেকে দৃষ্টি নিয়ে যায় মৌপ্রিয়ার ভেজা আখিতে। ঠোটে সেই চিরচেনা হাসির প্রলেপ। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে মৌপ্রিয়ার দিকে। দাঁড়ায় তার প্রেয়সীর মুখোমুখি। সময়টা যেনো থমকে গেছে। আলতো হাতে স্পর্শ করে মৌপ্রিয়ার গাল। মৃদু স্বরে আবেগজড়ানো কন্ঠে বলে,
“কাজললতা, আমি ফিরে এসেছি। শুধু তোমার জন্য”

।।সমাপ্ত।।

[ আসসালামু আলাইকুম, আজ অবশেষে গল্পটার ইতি টানলাম। গল্পটা আমার মনের খুব কাছের, এই গল্পটা ভীন্ন ধরণের করতে চেয়েছিলাম। পেরেছি কতোটা জানি না। কোনো আহামরি কাহিনীর সংযোগ নেই এই গল্পে। তাই অনেকের ই ভালো লাগে নি। আমি বুঝতে পেরেছি তাদের আক্ষেপ। যাই হোক, গল্পটি মঙ্গলবার থেকে আমার পেজে পাবেন না। আমি ডিলেট করে দিবো। সিদ্ধান্ত নিয়েছি যখন সেটাই হবে। ইনশাআল্লাহ আগামী শুক্রবার নতুন গল্প নিয়ে ফিরে আসবো। দয়া করে গল্পটি কপি করবেন না]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here