-“ধুর বা*, এত কথা না কইয়া আদিত্য স্যারের রুমে যাইয়া এই মাইয়ারে রাইখা আয়। আর কাইল সক্কাল সক্কাল আমি গিয়া হুদাই চিল্লাপাল্লা শুরু করুম। তারপর দেখ ওই শা/লার কী অবস্থা হয়।”
– “ভাই এডা রিস্কি হইয়া যাইতাছে না? স্যার জানতে পারলে আমগোরে গিল্লা খাইয়ালাবে।”
-“করলে কর না করলে সর, বা/লে/র প্যাঁচাল পারিস না। ওই শা/লাকে বহুত সহ্য করছি আর না।”
উক্ত কথাটি বলে শাওন আরেকটি বি/শ্রী গা/লি ছুঁড়ে দিলো তার বন্ধুদের দিকে। গালি শুনে বন্ধুরা গাঁইগুঁই করলেও পরে তার কথাতে একমত হলো। তারপর নিজেদের মধ্যে গোপন আলোচনা সেরে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে সরে পড়ল সেখান থেকে। তখন বাজে রাত দুইটা। লং জার্নি করে এসে ক্লান্ত হয়ে সকলে জলদি ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাঁচদিনের সফরে
ঢাকা থেকে বান্দরবনে এসেছে তারা।যদিও কলেজকর্তৃপক্ষ
এতদূর আসতে রাজি হচ্ছিল না পরে অনেক রিকুয়েষ্ট করে এসেছে। কিন্তু আসার পথে বেঁধেছে আরেক বিপত্তি। মেয়ের তুলনায় ছেলেদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ছেলেদের বাসে ছয় জন ছেলের বসার জায়গা ছিল না। সেই ছয়জন মেয়েদের বাসের পেছনের সিটে বসেছিল। দুইজন স্যারকে সেই বাসের ছাত্র- ছাত্রীর দেখাশোনার দায়িত্বে রাখা হয়েছে। আর দু’জন
স্যার হচ্ছেন আদিত্য স্যার ও সাব্বির স্যার। দু’জনেই জয়েন করেছেন মাস দু’য়েক হচ্ছে। সাব্বির স্যার খুব মজার মানুষ হলেও আদিত্য স্যার স্বল্পভাষী। উনি অতিরিক্ত কথা বলেনও
না আবার বলা পছন্দও করেন না। অথচ সাব্বির স্যার আর
আদিত্য স্যার নাকি ছোট বেলার বন্ধু। এ বিপরীতমুখী মানুষ বন্ধু হয় কীভাবে তা বোধগম্য হয় না কারোই। আদিত্য স্যার থাকায় কেউ মজা করতে পারছিল না। এখানে অন্য স্যাররা থাকলে এতক্ষণ উরাধুরা গান বাজিয়ে, নেচে, গেয়ে, আনন্দ করতো সবাই। মনমতো আনন্দ করতে না পারায় কেউ গল্প করছিল, কেউ বসে ফোন স্কল করছিল, কেউবা ঘুমাচ্ছিল।
সবার কাছে বোরিং এই জার্নি। তখন পেছনের ছেলেগুলো স্যারদের সামনে দেখে সিগারেট জ্বা/লি/য়ে চুপিচুপি টানতে শুরু করল। সেই সিগারেটের গন্ধে হঠাৎ’ই মেধা কেশে উঠে গলগল করে বমি করে ফেলল। সে একদম সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। তারউপরে মাইগ্রেনের সমস্যার কারণে এতক্ষণ কাপটি মেরে বসে ছিল। প্রচন্ড বমি পাচ্ছিল কক্ষণ থেকে। মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়লে তার একাধিকবার বমি হয়।
কাহিল হয়ে যায় পুরো শরীর। চোখ দিয়ে ঝরতে থাকে অশ্রু ধারা। বসে ছাড়ার পর থেকেই ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করছে। যত সময় যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে নিজের প্রতি। তার উপরে লাইটের আলো, গাড়ির শব্দ, আরো বিরক্ত লাগছে।
এতক্ষণ এক টুকরো লেবু মুখে রেখে সে নিজেকে কনট্রোল করছিল। কিন্তু সব প্রচেষ্টায় বৃথা গেল সিগারেটের গন্ধ নাকে এসে। মেধার বমি বন্ধ হচ্ছিল না দেখে নাতাশা ঘাবড়ে গিয়ে স্যারদের ডাক দেয়।তার ডাক শুনে সাব্বির নাতাশার সিটের কাছে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞাসা করে সমস্যা হচ্ছে নাকি। তখন সে খেয়াল করে একটা মেয়ে জানালা বাইরে মাথা বের করে অনবরত বমি করছে। ততক্ষণে আদিত্য ড্রাইভারকে জলদি বাস থামাতে বলে দিয়েছে, বাসওথেমে গেছে।নয়তো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তাছাড়া চলন্ত বাসে মাথা বের করে রাখা রিস্ক।
ততক্ষণে মেধা নেতিয়ে পড়ে সিটে হেলান দিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে নিয়েছ। তখন আদিত্য পানি এনে মেধাকে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে বলে তাতে একটু ভালো লাগবে। মেধা বোতল হাতে নিলেও নড়ার শক্তি পেলো না সেভাবেই রইল।
তখন নাতাশা পেছনে বসা ছেলেদের দেখিয়ে বলল,
“স্যার পেছনের ছেলেগুলোকে কিছু বলুন প্লিজ।”
একথা শুনে আদিত্য ভ্রু কুঁচকে ছেলেগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে নাতাশাকে বলল, “কেন কি করেছে তারা?”
নাতাশা এবার সাহস করে বলে দিলো ছেলেগুলো পেছনের সিটে বসে সিগারেট টানছে। মুখে কেমন শব্দ করছে, টিজও করছে, ইঙ্গিতে কথা বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে।
মেয়েদের ড্রেস নিয়েও কীসব আলোচনা করছে। মা/ল টা/ল
বলে কাকে যেনো সাইজ টাইজ বলে কখন থেকে হাসাহাসি করছে। সত্যি কথা এভাবে বলে দেওয়াতে ছেলেগুলোর মুখ চুপসে গেল।ততক্ষণে বাকিরা উঁকিঝুঁকি মেরে ছেলেগুলোর
চেহারা দেখতে শুরু করছে। নাতাশার কথা শুনে সাব্বির চট ছেলেগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। আদিত্যের রাগ ভালো না তাকে এদিকে আসতে না দেওয়ায় উত্তম। সাব্বির স্যারকে দেখে ছেলেগুলোর মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাও গেল না। তারা সিনা টান করে পূর্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তখন কন্ঠে বিরক্ত এনে সাব্বির স্যার বলল,
“এটা সিগারেট খাওয়ার জায়গা?”
ছেলেগুলো জবাবে টু শব্দও করল না দেখে সাব্বির নিজেই বলে উঠল, ” সবাই কান ধরে সরি বলো। ”
একথা শুনে একটা ছেলে দাঁত বের করে হেসে বলল, “স্যার মেয়েদের সামনে…? বলছি যে, আমাদের একটা প্রেস্টিজ আছে না?”
কথাটা শুনে আদিত্য সেখানে দাঁড়িয়ে বেশ কড়াভাবে জবাব দিলো,
“প্রেস্টিজের কথা আগে মনে রাখা উচিত ছিল না? তাছাড়া ইভটিজারের প্রেস্টিজ থাকা য, না থাকাও তা। বাই দ্যা ওয়ে, আমাদের উপস্থিতিতে টিজ করার সাহস কোথায় পেলে?এই সাহস আমার সামনে দেখাও দেখি? আমিও পরখ করি কত ইঞ্চি বুঁকের পাটা তোমাদের। কি হলো দেখাও? নয়তো এই মুহূর্তেই তোমাদের লিগ্যাল গার্জিয়ানকে কল করা হবে।”
একথা শুনে ছেলেগুলো নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইল। কারণ আদিত্যের ব্যাপারে তাদের ধারণা আছে তাই বিপরীতে কিছু না বলায় উত্তম। এই ঘটনা এখানেই সমাপ্ত করা প্রয়োজন নয়তো সত্যি সত্যিই সাফার করতে হবে। তখন ছেলেগুলো একে একে কান ধরে বিনয়ী ভাবে সরি বলল। মুখে স্বীকার করল তারা ভুল করেছে আর এমন করবে না। তাদের অনুতপ্ত হতে দেখে আদিত্যও লাস্ট ওয়ানিং ছুঁড়ে দিলো। তারপর নাতাশার কাছে গিয়ে মেধাকে একবার দেখে বলল, “মেডিসিন খেয়ে ঘুমাও। ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে।”
একথা বলে তারা নিজেদের সিটে গিয়ে বসে পড়ল। বাসও পুনরায় চলতে শুরু করল। নিশুতি রাতে বাস চলছে আপন গতিতে। রাতের আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। এখন বাসের লাইট অফ। জানালার পর্দা অনবরত উড়ছে। ভুরভুর করে ঢুকছে বে/হা/য়া বাতাস। বাসের অনেকেই তখন ঘুমে কাদা।এদিকে
মেধা মাথার ব্যথায় ছটফট করছে কিছুতেই ঘুম আসছে না।
নিঃশব্দে ঝরছে অশ্রুফোঁটা। তার নাকসহ পুরো মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। সে মুখে ওড়না গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নাতাশা কানে ইয়ারফোন গুঁজে ঘুমিয়ে পড়েছে। এই মেয়েটা ভীষণ ঘুম কাতুরে। যে কোনো পরিস্থিতিতে চট করে ঘুমিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতাও তার আছে। মেধার অল্প একটু পানি পান করল। পেটের মধ্যে খুব গুলাচ্ছে বোধহয় আবার বমি হবে।
বাসের সবাই ঘুমাচ্ছে এখন বমি করলে সবার ঘুমের ডিস্টার্ব হবে। একথা ভেবে মেধা আল্লাহকে স্মরণ করে জোর করেই ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, পনেরো মিনিট, করতে করতে এক ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও ঘুম এলো না। সে চোখ খুলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। না আসলেই ভালো হতো এমন কষ্ট পেতো হতো না। তাড়াহুড়োয় মাইগ্রেন এর ওষুধ নিতেও ভুলে গেছে। ওষুধ খেয়ে ঘুমালে এতক্ষণে ব্যথা থেকে মুক্তি পেতো। এখন দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করার ছাড়া উপায়ও নেই। এসব ভেবে আফসোস করছিল মেধা। তখন বাসের মধ্যে লাইট জ্বলে উঠল। হঠাৎ লাইটের আলো চোখে পড়াতে ভ্রু কুঁচকালেও চোখ খুলল না সে বরং চোখের উপর একহাত দিয়ে রাখল। তখন পুরুষালি গম্ভীর এক কন্ঠ তার কানে ভেসে এলো,
“হেডেক কমে নি তোমার?”
মেধা চোখ খুলে দেখে সামনে আদিত্য স্যার দাড়িয়ে আছে।
যেটা সে কল্পনাও করে নি। এই নাক উঁচু স্যার কী না খোঁজ নিতে এসেছে, ভাবা যায়? নিজের ভাবনা দেখে সে নিজেই বিরক্ত হলো। ছাত্র- ছাত্রীকে দেখে রাখার জন্যই তো উনাকে
এখানে রাখা হয়েছে। দায়িত্ববোধ থেকে খোঁজ নিচ্ছে অবাক হওয়ার কিছু নেই এখানে। তাই সে মাথা নাড়াল অর্থাৎ কমে নি। তখন স্যার একটা ওষুধ এগিয়ে দিয়ে খেতে নিতে বলল। এটাতে নাকি দ্রুত কাজ হবে। মেধা ওষুধ নিয়ে খেতে গেলে আদিত্য বেশ বিরক্ত হয়ে বলল, ” কিছু খেয়ে খাও। ”
মেধা জানাল কিছু খেলেই বমি হয়ে যাচ্ছে। কোনো খাবারই পেটে থাকছে না। একথা শুনে আদিত্য নিজের ব্যাগ থেকে স্যালাইন এনে গুলিয়ে মেধাকে দিলো তারপর খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে ঘুমাতে বলল। আদিত্যের কথা শুনে মেধা ঠিক তাইই করল। একটুপরে তার চোখে ঘুম নেমে এলো সে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়ল। আদিত্য তার সিটে হেলান দিয়ে মস্ত বড় চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছে। কেন জানি তার দুচোখেও ঘুম নেই। অস্থির লাগছে ভীষণ। পাশে সাব্বির ভুশভুশ করে নাক
ডেকে ঘুমাচ্ছে। সে আরো একবার লাইট জ্বালিয়ে সবাইকে দেখে নিয়ে মেধার দিকে এগিয়ে গেল। মেয়েটা এখন গভীর ঘুমে মগ্ন।
তারপর সে নিজের সিটে বসে পুনরায় চাঁদটার সৌন্দর্য অবলোকন করতে লাগল। একটুপরে ড্রাইভার রবিঠাকুরের একটা গান ছাড়ল। গান বাজছে মৃদু ভয়েজে। এ পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে গেছে গানটা। আদিত্য গান শুনতে শুনতে চোখজোড়া বুজে নিলো।নানান ভাবনায় বিভোর থেকে ধীরে
ধীরে পাড়ি জমাল ঘুমরাজ্যে।
পরেরদিন সকালবেলা বান্দরবন পৌঁছানোর কথা থাকলেও তা সম্ভব হলো না। বাস নষ্ট হয়ে যাওয়াতে তিন তিনটে বাসই দাঁড়িয়ে রইল। সেখানেই ঘন্টা পর ঘন্টা কাটাতে হয়েছে পরে মেকানী খুঁজে গাড়ি ঠিক করে অতঃপর পৌঁছেছে বান্দরবন। তখন দুপুর। রান্নাবান্নার কাজে লেগে পড়েছে বাবুর্চিরা। ছাত্র ছাত্রীরা আশপাশটা ঘুরে দেখতে চাইলে স্যাররা জানান দূরে যেন না যায়। তারপর রান্না হলে সবাই খেয়ে নেই খানিকক্ষণ বিশ্রাম করে। বিকালবেলা কাছের একটা পাহাড় ঘুরতে যায় তারা। কত রকমের ছবি তোলে, মজা করে, পাহাড়ি ফলমূল কিনে খায়। অতঃপর সন্ধ্যা নামার পূর্বে বরাদ্দকৃত রিসোর্টে
ফিরে আসে। সন্ধ্যার পর খেলার আয়োজন করা হয়,খেলার মাঝে কেউ গান গায়, কেউ নাচ দেখায়। এভাবেই সন্ধ্যা পার হয়ে রাত নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পড়ে। আগামীকাল থেকে নাহয় বান্দরবনের সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে দেখবে। তখন বাসের ওই ছেলেগুলো ও তার বন্ধুরা পরিকল্পনা আঁটে আদিত্যকে শা/য়ে/স্তা করার।
(বি:দ্র: রেসপন্সের উপর নির্ভর করবে পরবর্তী অংশ)
“গোধূলির নিমন্ত্রণ”
নূরজাহান আক্তার আলো
[০১]