গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে ২ পর্ব ২৬+২৭

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৬ (২য় খণ্ড)

নিজের ঘাড়ে হাত বুলাতে ব্যস্ত ফাহমিদ। ঘাড় ব্য/থা করছে ভীষণ। কম ধকল যায়নি তার উপর দিয়ে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পড়লেও নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে তার। আজ একটুর জন্য ধরা পড়েনি তারা। বুদ্ধি করে তখনি স্থান ত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছে তারা। পুলিশের লোক কোনোভাবে খবর পেয়ে গিয়েছিল তাদের থাকার জায়গার। আর সঙ্গেই সঙ্গেই তারা হা/মলা করতে আসছিল ডেরায়। আগেই খবর পেয়ে তাড়াহুড়ো করে সবাইকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময় রূপাঞ্জনা হাজির হলো তার সামনে। মেয়েটির গম্ভীর মুখের পানে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে চাইল ফাহমিদ। রূপা কোনোরকম কুণ্ঠাবোধ না করে বলল,
“একটা সমস্যা হয়ে গেছে। আমাদের আগের ডেরায় আমরা ভুল করে সিটি হসপিটালের এরিয়ার পুরো নকশা ছেড়ে এসেছি। তাড়াহুড়ো করে সেটা নিতে ভুলে গেছি।”

“তো?”

ফাহমিদের এমন দায়সারা কথায় ভ্রু কুঁচকায় রূপা। অকপটে জবাব দেয়,
“এতে তো অনেক সমস্যা হতে পারে। ওরা তো বুঝে যাবে আমাদের মি/শন কী! ওরা তো সতর্ক হয়ে যাবে।”

“হবে না। সতর্ক হওয়ার চান্স নেই।”

“কেন?”

বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল রূপা। ফাহমিদও আগের মতো দায়সারা হয়ে বলল,
“দেখ, আমরা আমাদের প্ল্যানিং চেঞ্জ করব না। যেমনটা আছে তেমনটাই থাকবে। কাল সকালে প্ল্যান মাফিক আমাদের মি/শন শুরু করব। গেট রেডি।”

“ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাচ্ছে না?”

ফাহমিদ এবার শুনেও না শোনার ভান করে নিজের প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করল। সিগারেট ধরিয়ে দুবার সিগারেট টেনে রূপার দিকে সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“খাবি?”

রূপা অন্যদিকে ফিরে অপ্রসন্ন হয়ে জবাবে বলল,
“না।”

“আচ্ছা শোন তাহলে। যেহেতু হসপিটালের এরিয়ার মার্ক করা কাগজ সেখানে ছাড়া পড়েছে সো পুলিশ সেখানে গিয়ে তা পাবে আর সন্দেহ করবে আমরা ওখানেই কিছু একটা করতে চলেছি। কিন্তু পরক্ষণেই ওরা এটাও বুঝতে পারবে যে আমরা কাজটা করব না। কারণ নকশা ওখানে ছাড়া পড়েছে ওটা সেটা জানে। তাই ওরা বুঝে নেবে আমরা সেখানে কাজটা করব না। কিন্তু আমরা ওখানেই নিজেদের শেষ এবং সবচেয়ে ভয়/ঙ্কর মিশন কমপ্লিট করব।”

এবার বিষয়টা বোধগম্য হলো রূপাঞ্জনার। কিছুক্ষণ নীরব থেকে কিছু ভেবে আবার বলল,
“তারমানে ওরা যেটা বুঝবে আমরা তার উল্টো কাজ করব। ওরা বুঝবে, নকশা সেখানে ফেলে আসার কারণে আমরা নিজেদের পরিকল্পনা বাতিল করব। কিন্তু আমরা সেটা করব না।”

ফিচেল হাসি দিয়ে ফের সিগারেট মুখ দিয়ে চাপা গলায় বলে,
“উমম…দিন দিন ব্রিলিয়ান্ট হচ্ছিস।”

রূপাঞ্জনা নিরুত্তর থেকে নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইল। এই ফাহমিদ যে মানুষ নামক সম্পূর্ণ অমানুষ। যে কিনা র/ক্তখে/কো মানুষের চেয়েও ভ/য়ানক! রূপা অনেক চায় নিজ হাতে তাকে তিলে তিলে মা/রতে। তবে সেই আশা পূরণ হবার নয়। তাকে বাঁচিয়ে রাখার মাঝে তার নিজেরও স্বার্থ আছে। সে নিজের পরিবারকে একবার নিজের চোখে দেখার জন্য মরিয়া! সেকারণেই সেদিন থেকে সে আস্তে আস্তে আবারও ফাহমিদের বিশ্বাস জুগিয়েছে। অপেক্ষায় আছে কবে সে ফাহমিদের মুখ থেকে কাঙ্ক্ষিত সত্যি শুনতে পাবে। সে একবার হলেও নিজের জন্মদাত্রী মা-বাবার মুখোমুখি হতে চায়।

সাদা রঙের গাড়িটা যখন বিস্তর এক ফার্মহাউজের সামনে এসে দাঁড়াল তখন গাড়ি থেকে রিওকে কোলে নিয়ে নামল রাগিনী। পাশ থেকে ফিওনাকে নিয়ে নেমে এলো নয়নতাঁরা। একতলা ফার্মহাউজ। তবে বাড়িটা বেশ প্রসারিত। সামনে বড়ো করে ঘেরা। পাতাবাহারের গাছগুলো দেখা যাচ্ছে বাহির থেকে। তার মাঝ দিয়ে রাস্তা। সোজা চলে গেছে সদর দরজা অবধি। তারা দুজন এবার বড়ো দরজা পেরিয়ে সদর দরজায় এলো। গার্ডেনেই বসে ছিলেন মিসেস. রমিলা। নয়নতাঁরা এবং রাগিনীকে দেখামাত্র উচ্ছ্বসিত হয়ে তাদেরকে চেঁচিয়ে ডাকলেন। ডাক শুনতে পেয়ে উনার নিকটে এলো দুজন। মিসেস. রমিলা খুশি চেপে না রাখতে পেরে জড়িয়ে নেন দুজনকেই। একা মানুষ তিনি। কথা বলার কোনো মানুষ পান না। তাই কাউকে পেলেই খুশির সীমা থাকেনা উনার। আর নয়ন আর রাগিনীকে বেশ পছন্দ করেন তিনি।
“কেমন আছো তোমরা?”

“এইতো অনেক ভালো আছি আন্টি। আপনি এখানে কখন এলেন?”

নয়নের চাঞ্চল্যের সাথে বলা কথাগুলোর উত্তরে মিসেস. রমিলা উদাস কণ্ঠে বললেন,
“আর বলো না! কাল রাতেই এসেছি। রায়ান ছেলেটা কেন যেন জোর করে এখানে পাঠিয়ে দিলো। নতুন জায়গায় ঠিকঠাক ঘুমও হয় না। একারণে ভোরবেলা উঠে বসে আছি।”

“তোমার ছেলেটা হুটহাট বুঝে হুটহাট কাজ করতে ভালোবাসে আন্টি। আগে থেকে কিছু বোঝার দায় হয় না।”

মিসেস. রমিলা এবার মন খুলে হাসতে লাগলেন। তারপর শুধালেন,
“আচ্ছা? তুমি দেখি তাকে বেশ ভালোভাবে চিনে গিয়েছ!”

নয়নতাঁরা এবার দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল,
“চিনতে আর কোথায় পারলাম! আমার বিগ ব্রাদার আর উনার ক্যাটাগরি পুরো এক। কাউকে বুঝতে পারি না। আমার মতো সহজসরল মনের মেয়ে কি ওসব প্যাঁচালো মনের মানুষকে বুঝতে পারবে? তুমিই বলো?”

মিসেস. রমিলা সায় দিয়ে বললেন,
“তাই তো। নয়ন তো ছোটো থেকেই একেবারে সরল একটা মেয়ে। যাই হোক। এখন আর বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। রাগিনী! অনেকটা জার্নি করে এলে! চলো ভেতরে চলো তোমরা।”

“জি, আন্টি।”
মিসেস. রমিলার কথায় সম্মতি জানিয়ে তারা প্রবেশ করে ফার্মহাউজে।

ফ্রেশ হয়ে ফোনটা নিয়ে বসে রাগিনী। চেক করে নেয় কোহিনূর কল করেছিল কিনা! কিন্তু, না। সে কল করেনি। সে এত কাজ তার? ভেবে পায় না সে। রিও আর ফিওনাকে খেতে দিয়েছে সে। এখন তার ক্লান্ত লাগছে। ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে গা এলিয়ে দিলো এবার। ছাঁদের দিকে নজর যেতেই খেয়াল করল বাড়ির প্রতিটা জিনিসই আগের যুগের। পিতলের জিনিসপত্র দিয়ে সজ্জিত প্রতিটা কোণা। উপরে থাকা ফ্যানটাতেও কারুকার্য দেখে মনে হচ্ছে সেটাও আগের। আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করে ফোন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল রাগিনী। একপাশ হয়ে শুয়ে ফোনে ফেসবুকে ঢুকল সে। এক পর্যায়ে নিউজফিড দেখতে দেখতে চোখ আঁটকে গেল একটা নিউজ পোর্টালের লিংকে। তার ক্যাপশনে স্পষ্ট লেখা, ‘কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে এলো কেউটে। অপ/রাধীকে খুঁজতে গিয়ে এই বিষয়ে জড়িয়ে গেলেন শহরের বিখ্যাত এবং সম্মানিত সাইকোলজিস্ট ড. শাহ্ রাশেদ।’

একমুহূর্তের জন্য সবটা অন্ধকার হয়ে এলো রাগিনীর। চোখে ঝাপসা দেখল। মাথার ভেতরে ধরল আ/গুন। নিজের উত্তেজনা সামলাতে না পেরে নিউজ পোর্টালের সেই লিংকে প্রবেশ করল সে। বিড়বিড়িয়ে দ্রুত পড়তে লাগল পুরো ঘটনা। ‘প্রমাণ অনুযায়ী গতকালকেই বিখ্যাত সাইকোলজিস্ট শাহ্ রাশেদকে ডাকা হয় পুলিশ স্টেশনে। কিন্তু আসলে পুলিশ এবং তাদের মধ্যে কী জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তা এখনো জানা না গেলেও ইন্সপেক্টর রায়ানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। রাতে হঠাৎ করেই ক্যামেরায় ধরা পড়েন শাহ্ রাশেদ। উনার হাতে ছিল হ্যান্ডকাপ। বুঝতে বাকি রইল না ঘটনাটা কী! তবে কী কারণে উনাকে এ/রেস্ট করা হয়েছে তা এখনো প্রকাশ করেনি পুলিশ টিম।’

আর স্থির থাকা সম্ভব হলো না রাগিনীর পক্ষে। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল সে। সবটা অস্থির লাগছে এবার। মাথাটা কেমন করছে। এ কী ঘটেছে তার বাবার সাথে? সে মানতে পারল না। বিলম্ব না করে সে ফোন থেকে কোহিনূরের নম্বর ডায়াল করে কল করল। কোহিনূর নিশ্চয় জানে তার বাবার সঙ্গে হওয়া এই ঘটনার কথা। লোকটি জেনেও কি তার বাবার জন্য কিছুই করলেন না? রাগিনী বিশ্বাস করে এবং তার বাবার উপর সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে তার বাবা কখনো কোনো ভুল কাজ করতেই পারে না। নিশ্চয় কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। কোহিনূর কল রিসিভ না করায় রাগ, চিন্তা সব একজায়গায় হয়ে চোখে অশ্রুর উৎপাত শুরু হলো। কোনোরকমে ঠোঁট চেপে কান্না আঁটকাতে পারলেও ব্যাকুলতার চোটে হাত থেকে ফোনটা ছুঁ;ড়ে মা/রল নিচে। নিজের মাথার চুল চেপে ধরে বিড়বিড় করে বলল,
“আমার বাবা কিছু করেনি। আমি জানি। আমার বাবা বেস্ট! নিশ্চয় কোনো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে।”

নিজের চোখমুখ কচলে উঠে দাঁড়াল রাগিনী। ফোনটাকে খণ্ডবিখণ্ড হতে দেখে সেদিকে আর তাকিয়ে ছুটল ঘরের বাহিরে। এখানে এভাবে বাবার কোনো খবর না পেলে সে ম;রে যাবে। একদণ্ড শান্তি পাবে না সে। সে ঢাকায় ব্যাক করবে। তাও এখনি, এইমূহুর্তে।

সূর্য ওঠার আগ মূহুর্ত। ঠান্ডা বাতাস সৃষ্টি করেছে কনকনে শীত। খোলা মাঠে যেন শীতটা আরো প্রখর! শিশিরও পড়ছে বেশ। তবুও কেউ কাঁপা-কাঁপি না করে একেবারে সোজা হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ ডেপুটি ইনস্পেকটর জেনারেল অব পুলিশ অর্থাৎ ডিআইজি রাতিব উদ্দীন। লাইনের চারিদিকে পায়চারি করছেন তিনি। হাঁটতে হাঁটতে কোহিনূরের কাছে গিয়ে তিনি থমকান। কোহিনূরকে বেশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেন। এই ছেলেটাকে দেখে তিনি বেশ অবাক হন। তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জোর অবশেষে তাদের কেইস এর শেষ প্রান্তে এনে দাঁড় করালো। সামনের দিকে পলকহীন হয়ে শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কোহিনূর। তার হাত দুটো মুঠো করা। রাতিব উদ্দীন জিজ্ঞেস করলেন,
“আর ইউ রেডি অফিসার নির্জন?”

এবার সামনে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে রাতিব উদ্দীনকে দেখল কোহিনূর। জোর গলায় বলল,
“ইয়েস স্যার।”

“ভয় করছে না তোমার?”

“কীসের ভয় স্যার?”

রাতিব উদ্দীন হাসলেন কিছুটা। তারপর গম্ভীর মুখেই বলে উঠলেন,
“আমি জানি তুমি নিজেকে নিয়ে কখনো ভয় পাও না। তুমি নিজেকে ভাবোই না। শুনলাম, তোমার বিয়ে হয়েছে। মাত্র একদিন হলো বিয়ের। তুমি তোমার স্ত্রীকে ভালোবাসো। তোমার বোনকে ভালোবাসো। তাদেরকে নিয়ে তোমার অজস্র আতঙ্ক আমি নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি।”

না চাইতেও ঢক গিলে নিলো কোহিনূর। নিজের শুকনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিলো চট করে। আসলেই তার ভয় লাগছে। সে জানে তাদের কিছু হবেনা। তবুও ভয় করছে। কিন্তু সেটা বুঝতে না দিতে চায় না কাউকেই। কোহিনূর দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,
“এই আতঙ্ক, এই সংশয় আমার কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। আমি নিজ সিদ্ধান্তে অটল।”

“তুমি কি সিউর যে সিটি হসপিটালেই হা/মলা করার চান্স আছে?”

কোহিনূর আগের ন্যায় দৃঢ় গলায় বলল,
“হুমম। আমি নিশ্চিত। এতদিন তারা আমাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে জেনে নিয়েছে। আমাদের পরিকল্পনার উপর দিয়ে পরিকল্পনা করেছে। তাই আমার বিশ্বাস ওরা ওখানেই নিজেদের কাজ করতে যাচ্ছে।”

রাতিব উদ্দীন শুধু কোহিনূরের কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন এবার। তারপর পিছিয়ে গিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
“র‌্যা/ব টিম থেকে শুরু করে সবাই তৈরি। আমরা কি সবাই তৈরি?”

সকলের সম্মতিসূচক প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল মাঠ। শোনা গেল মেহরাজ, রায়ান এবং কোহিনূরের আস্থাশীল কণ্ঠ। রাতিব উদ্দীন আবারও বললেন,
“আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের জীবনের চেয়ে জনগণের জীবনের দাম বেশি। আমরা যখন নিজেদের কাঁধে এই দায়িত্ব নিয়েছি সেই মূহুর্ত থেকে নিজের প্রাণ সমর্পণ করেছি। তাই আমাদের প্রাণের পরোয়া করলে চলবে না।”

সকলে নিজেদের মনে গেঁথে নিলো কথাগুলো। বুকে রাখল হাত। প্রতিজ্ঞা করল, নিজেদের সবটা দিয়ে তারা লড়বে এবং জিতবে।

তখন বেলা প্রায় দশটা! পুলিশ স্টেশনে হাজির হলো রাগিনী। সেখানে রায়ান উপস্থিত না থাকলেও শেখর উপস্থিত ছিল। নিজের চেয়ারে বসে খবর কাগজ পড়তে মগ্ন ছিল সে। এমন সময় নারীর হম্বিতম্বি আগমনে চমকে তাকায় শেখর। বিনীতভাবে জানতে চায়,
“এনি প্রবলেম ম্যাডাম?”

“আমার বাবা কোথায়?”

রাগিনীর করা প্রশ্ন ঠিক বুঝতে পারল না শেখর। কপালে পড়ল কিঞ্চিৎ ভাঁজ। সংশয়িত হয়ে বলল,
“সরি! কে আপনার বাবা?”

রাগিনী চটপটে প্রতিত্তোরে বলল,
“সাইকোলজির ডক্টর শাহ্ রাশেদ। উনি আমার বাবা হোন।”

“ওহ হো! ওই লোকটা? আপনি ওই ক্রি/মিনা/লের মেয়ে?”

শেখরের তাচ্ছিল্যের সাথে বলা কথায় ধম/কে উঠল রাগিনী। দুঃসাহস করে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল,
“হাউ ডেয়ার ইউ? আপনি আমার বাবাকে ক্রি/মিনাল বলেন কোন সাহসে? হি ইজ নট ক্রি/মিনা;ল। হি ইজ মাই ফাদার, মাই এঞ্জেল। হি ইজ অ্যা গুড পারসন!”

রাগিনীর অনুভূতি দিয়ে বলা কথাগুলো শুনে বেশ মজা পেল শেখর। আয়েশ করে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে বুকে হাত জড়িয়ে বলল,
“এতই যখন ভালো তখন কুখ্যাত জেল নামক জায়গাতে আজ আপনার বাবার অবস্থান কেন?”

“নিশ্চয় কোনো সমস্যা হয়েছে। বাবাকে কেউ ফাঁ/সিয়েছে। আমি বাবার সাথে এখনি কথা বলতে চাই।”

“ওকে দেন। অ্যাজ ইউর উইশ।”

শেখর একজনকে ডেকে বলল, রাশেদ সাহেবকে যেন রেস্টরুমে আনা হয়। উনার মেয়ে উনার সাথে দেখা করতে চান। কথাটি শুনে চলে গেল লোকটি সেই অনুযায়ী কাজ করতে। তবে কিছুক্ষণের ব্যবধানেই ফিরে এসে জবাব দিলেন,
“স্যার, ডক্টর রাশেদ কারোর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন না। উনার মেয়ের সাথে তো একদমই না। উনি বলেছেন আমি যাতে উনার মেয়েকে চলে যেতে বলি।”

তাজ্জব হয়ে গেল রাগিনী। ফ্যাকাসে মুখটা একেবারে চুপসে গেল। কেন এমন ব্যবহার করছে তার বাবা? বাবা কি বুঝতে পারছে না তার মেয়ে তার সঙ্গে কথা না বলতে পারলে অশান্তিতে ভুগবে? অগত্যা রাগিনী জেদ ধরে বলে ওঠে,
“বাবার সঙ্গে কথা না বলে আমি কোথাও যাবো না। নিশ্চয় বাবা ভেঙে পড়েছে। আমাকে বাবার নিয়ে চলুন।”

শেখর দূর থেকে কনস্টেবলকে ইশারা করে বলে যাতে রাগিনীকে তার বাবার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ রাগিনীকে এই অনুমতি প্রথমেই দিয়েছিল ইন্সপেক্টর রায়ান। কনস্টেবল পথ ছেড়ে রাগিনীর উদ্দেশ্যে বলে,
“চলুন আমার সাথে।”

কাস্টারির বেঞ্চে একমনে বসে আছেন রাশেদ সাহেব। কী থেকে কী হয়ে গেল উনার জীবনে! নিজের অবস্থা দেখে তিনি নিজেই হতবাক। হয়ত কখনো না কখনো এমনটা হওয়ারই ছিল। অপ/রাধ, মিথ্যে হাজার চেষ্টা করলেও ঢাকা যায় না। আর যখন আসল সত্য বেরিয়ে আসে তখন সেটা মিথ্যাচারীকে চোরাবালির মতো টেনে নেয়। এসব চিন্তাভাবনার দরুণ বুকে চিনচিনে ব্য/থা শুরু হয় উনার। বুকের হাত দিয়ে কাশতে কাশতে তিনি নিজের চেনা কণ্ঠ পেলেন। টিমটিমে আলোতে দেখলেন জেল নামক প্রাচীরের ওপারে প্রাণপ্রিয় রাজকন্যা দাঁড়িয়ে। চোখে অশ্রু টলমল করছে তার। মুখচোখ শুঁকিয়ে গিয়েছে একেবারে। তবে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন রাশেদ সাহেব। চেয়েও পারলেন না নিজের মেয়েকে শান্তনা দিতে। তিনি এই মুখ দেখাতে পারবেন না মেয়েকে। লজ্জা লাগবে। মাটিতে মিশে যাবে।

“বাবা! কেন মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছো আমার থেকে? আমি কী কোনো দোষ করেছি? যদি তাই হয় তাহলে আমাকে বকো। পানিশমেন্ট দাও!”

তবুও বসে রইলেন রাশেদ সাহেব। জবাব দিলেন না কোনো কথারই। রাগিনীর কান্না পেল। তবুও তা দমিয়ে আটকা আটকা গলায় বলল,
“তুমি যতক্ষণ না আমার সাথে কথা বলবে ততক্ষণ আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব।”

ঢক গিলে চুপ রইলেন রাশেদ সাহেব। তবুও মেয়ে নাছোড়বান্দা হওয়ায় নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। ভার মুখে বললেন,
“কী হয়েছে রাগিনী? কেন এসেছ? আমি তো বলেছিলাম কারোর সঙ্গে দেখা করতে চাইনা।”

“কেন বাবা? আমি তো তোমার মেয়ে। কেন কথা বলতে চাও না? আমি কোনো অ/ন্যায় করেছি?”

রাগিনীর এমন বোকা প্রশ্নে নরম না হয়ে পারলেন না রাশেদ সাহেব। ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে মেয়ের মাথায় রেখে নিস্তেজ গলায় বললেন,
“তুমি কেন অ;ন্যায় করবে? আমি করেছি যা করার। সেকারণেই তো এই অবস্থা।”

“তুমি কী করেছ বাবা?”

কাঁদো কাঁদো হয়ে শুধাল রাগিনী। রাশেদ সাহেব নিজের কুকর্মের কথা বলার মুখ পেলেন না। মলিন চোখে তাকিয়ে রইলেন রাগিনীর অনুজ্জ্বল মুখশ্রীর পানে। উত্তর না পেয়ে বাবার হাত ধরল রাগিনী। অনুরোধ করে বলল,
“প্লিজ বলো! কিছু লুকিয়ো না।”

“অতীত আমার পিছু ছাড়েনি, মা। সেই অতীত আজ আমায় গ্রাস করল। তুমি তখনও পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হওনি। আমার মাথায় শ/য়তা/ন জেগেছিল। কুচিন্তার উদ্ভব হয়েছিল। তোমাকে ঠকিয়েছি, তোমার মাকে ঠকিয়েছি। একটা অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছি। যার ফলাফল হিসেবে একটা সন্তান হয়েছিল। তাকে আমি এমন একজনের হাতে তুলে দিয়েছি যে কিনা নিজহাতে অপ/রাধী হিসেবে গড়ে তুলেছে। আজকে সে আত/ঙ্কবা/দী হয়ে উঠেছে। পুরো শহর তার জন্য তটস্থ! তুমি আমার একমাত্র সন্তান নও রাগিনী। একটা অবৈধ সন্তান জন্ম দিয়েছিলাম আমি। ক্ষমা করো আমাকে। ঘৃণা করো না আমায়।”

বাবার হাত ছাড়িয়ে কয়েকধাপ পিছিয়ে গেল রাগিনী। নিজের কানে হাত রাখল। সে কি আসলেই ঠিকঠাক শুনল? কেন যেন দুঃস্বপ্ন লাগছে। নিজের কপালে পা/গলের মতো কয়েকবার থাবা দিল সে। নাহ্, ঘুম তো ভাঙছে না। তাহলে কি যা শুনেছে সব সত্যি? মানতে কষ্ট হচ্ছে। কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে রাগিনী বলল,
“বাবা, তুমি মিথ্যে বলছ। মজা করছ?”

রাশেদ সাহেব মাথা নাড়ালেন। তিনি মজা করছেন না। সঙ্গে সঙ্গে হাতজোড় করলেন তিনি। মাথা নত করে বললেন,
“প্র/তারণা করেছি আমি জানি। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার মা চলে যাওয়ার পর সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি তোমায়। তোমায় সবসময় বুকে আগলে রাখতে চেয়েছি। আমি চাইনি আমাদের বাবা-মেয়ের সম্পর্কে অতীতের হাতছানি পড়ুক। কারণ যেই মেয়ের চোখে আমি আমার জন্য অজস্র ভালোবাসা এবং সম্মান দেখেছি সেই চোখে আমি ঘৃণা, লাঞ্ছনা দেখতে পারতাম না।”

রাগিনীর আর সহ্য হলো না রাশেদ সাহেবের কোনোরূপ কথা। মাথার প্রতিটা রগ যেন ছিঁ/ড়ে যাচ্ছিল কোনোরকমে। একটা সময় নিজেকে সামলাতে না পেরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“আই হেইট ইউ বাবা! আই হেইট ইউ।”

আর এক মূহুর্তও অপেক্ষা করল না সে। ছুটে বেরিয়ে এলো হাত দিয়ে ভরাট দুচোখের পানি মুছতে মুছতে। বুকের বা পাশে অবিরামভাবে যেন কেউ ছু/রি চালিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে শে/ষ করে দিতে ইচ্ছে করছে।

অটোতে বসে আছে ফাহমিদ। পাশে থাকা ছেলেটাকে সে তড়িঘড়ি করে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“সব ঠিকঠাক রেডি তো? বো/ম জ্যাকেটে সবকয়টা সেট করেছিস?”

দেরি না করে ছেলেটা নিজের পরনের জ্যাকেটটা হালকা খুলে মেলতেই সেটা চেপে ধরল ফাহমিদ। চোখ গরম করতেই জ্যাকেটের চেইনটা লাগিয়ে নিলো সে। ছেলেটার কপাল বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে লাল রঙা র/ক্তের ন্যায় একটা পদার্থ। সেটা দেখতে র/ক্তের মতো মনে হলেও সেটা আসলে র/ক্ত নয়। এটা শুধু হসপিটালের নার্স এবং ডক্টরকে দেখাতে হবে যে তার মাথায় আ/ঘাত লেগেছে। অর্থাৎ কোনো না কোনো বাহানা নিয়ে পুরো টিমকে ঢুকে যেতে হবে হসপিটালে। তারপর সবটা সহজ হবে তাদের পক্ষে। ফাহমিদ নিজের কানে থাকা ব্লুটুথে হাত দিয়ে তার দলের সবাইকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
“গাইজ আর ইউ রেডি?”

সকলেই সম্মতি জানালে নিজের ধূর্ত হাসিটা দিয়ে পাশে থাকা ছেলেটির দিকে তাকায় ফাহমিদ। নিজের আত্মবিশ্বাসের উচ্চতার সীমা পেরিয়েছে সে। একেবারে নিশ্চিত হয়েছে আজ এই শহরে হবে তারই রাজত্ব!

ভরা হসপিটাল। নার্স, পেশেন্ট, ডক্টর দিয়ে জমজমাট। ফাহমিদ আবারও জয়ের হাসি হাসল। এত লোকজনের প্রা/ণ নিয়ে খেলতে বেশ মজাই লাগবে। হসপিটালে নেমেই আ/হত হওয়ার ভঙ্গি করে এলোমেলো পায়ে ফাহমিদের দিকে ভর দিয়ে হাঁটা শুরু করল ছেলেটি। সুযোগ বুঝে ফাহমিদ দ্রুত চিল্লিয়ে নার্সকে ডেকে বলল,
“প্লিজ হেল্প! আমার ভাইয়ের কপালে লেগেছে প্রচণ্ড ব্লি/ডিং হচ্ছে। হেল্প করুন।”

নার্স ছেলেটির এই দশা দেখে দ্রুত ওয়ার্ডবয়কে ডেকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিলো। নিয়ে যেতে লাগল কেবিনের দিকে। উদ্দেশ্যে সফল হয়ে চাপা হাসি দিয়ে নিজের বৃদ্ধ আঙ্গুল উঠিয়ে ছেলেটিকে ইশারা করল সে। আস্তে আস্তে সেখানে আসতে শুরু করল তারই দলের লোকজন। তারাও বিভিন্ন বাহানা দিয়ে এসেছে। ফাহমিদ ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল।

একটা কেবিনে নিয়ে যাওয়া হলো ছেলেটিকে। নার্স তাড়াহুড়ো করে তুলো সহ বিভিন্ন মেডিসিনের জোগাড় করতে শুরু করলে ছেলেটি আশেপাশে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিলো। তার বেডের পাশে আরেকটা বেড রাখা। সেই বেডে একজন লোক শুয়ে আছে ওপাশ হয়ে। মাথায় তার ব্যান্ডেজ। আর নার্স ছাড়া কেউ নেই ঘরে। নিজের ব্লুটুথে ফাহমিদের আদেশ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই উঠে বসল ছেলেটি। নার্স আ/হত অবস্থায় এভাবে উঠে বসতে দেখে কিছু বলতে গেলে নিজের রি/ভল;বার বের করে নার্সের দিকে তাক করে বলল,
“চালাকি করার চেষ্টা করবি না তাহলে এখানেই লা/শ ফেলে দেব তোর।”

নার্সের হাত থেকে তুলো সহ পুরো ট্রে পড়ে গেল। ভয়ে থরথর করে কেঁপে নিজের দুহাত উপরে তুলে স্থির দাঁড়িয়ে রইল সে। এবার ছেলেটি বেড থেকে নেমে অন্য বেডে শুয়ে থাকা সেই লোকটির দিকে। সুযোগ বুঝে সেই লোকের মাথা রি/ভল/বার ঠেকিয়ে বলল,
“অনেক ঘুমিয়েছিস। উঠে পড় তাড়াতাড়ি।”

লোকটা তবুও উঠল না। রি/ভলবারের মাথা দিয়ে লোকটির মাথায় গুঁতো দিলে তাকে চমকে দিয়ে চোখের পলকে উঠে দাঁড়িয়ে লোকটি ছেলেটার হাতে আ;ঘাত করে রি/ভলবা/র ফেলে দিয়ে গলা চে/পে ধরল। অন্যহাত দিয়ে নিজের নকল ব্যান্ডেজ খুলে নিলো সে। হিসহিসিয়ে লোকটি বলল,
“তোরা অ্যাক্টিং করতে পারিস আর নির্জন আহমেদ কোহিনূর অ্যাক্টিং করতে পারে না? ভুল করেছিস এখানে এসে।”

নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় ছটফট করল ছেলেটা। সে কোহিনূরকে চেনে। ভালো করে তাকিয়ে দেখল কোহিনূরের দৃঢ় মুখখানা। কোহিনূরের সঙ্গে পেরে না উঠে তৎক্ষনাৎ নিজের জ্যাকেটের চেইন খুলে তার সঙ্গে ফিট করা বো/ম দেখিয়ে বলল,
“ছাড় আমাকে নয়ত বো/ম ব্লা/স্ট হয়ে যাবে।”

উপায়ন্তর না পেয়ে দ্রুত ছেলেটাকে ছাড়ল কোহিনূর। তবে নিজের রি/ভলবা/র বের করে তাক করল সেদিকে। ছেলেটি কিটকিটে হাসি দিয়ে বলল,
“ভয় পেলি? যতই অ্যাক্টিং করিস না কেন! লাভ নেই। ম/রতে হবে তোদের।”

কোহিনূর ঘাড় বাঁকিয়ে দৃঢ় হাসি ফুটিয়ে জবাবে বলল,
“হয়ে যাক কিছু একটা। হয় ম/রব নয় মা/রব!”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৭ (২য় খণ্ড)

মায়ের ছবিটা সামনে রেখে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে রাগিনী। চোখমুখ ফুলে একাকার করে ফেলেছে। সারা রাস্তা কান্না থামেনি তার। মাথার প্রতিটা রগ যেন একটা একটা করে ছিঁ/ড়ে যাচ্ছে। বুকের বা পাশে যত্নে থাকা সেই হৃৎপিণ্ডকে কেন্দ্র করে বারংবার তীর ছুঁ/ড়ছে কেউ। সহ্য হচ্ছে না এই বাস্তবতার যন্ত্র/ণা। যেন মনে হচ্ছে ম/রণই একমাত্র এই পীড়া থেকে মুক্তি দিতে পারে। মাথা উঠিয়ে ম্লান মুখে মায়ের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটাতে আলতো করে হাত বুলায় রাগিনী। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে নিজের বুকের ভার হালকা করে আনমনে বলে,
“তোমার অস্তিত্ব, তোমার শারীরিক উপস্থিতি বিলীন হয়ে গিয়েছে তুমি যেদিন শেষ নিঃশ্বাস নিয়েছ, মা! কিন্তু কী জানো? তুমি তার আগেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলে যেদিন তুমি ব্যতীত অন্যকোনো নারীর প্রতি তোমার স্বামী আকৃষ্ট হয়েছিল। যেমন স্ত্রীর মাঝে স্বামীর গোপন অস্তিত্ব লুকায়িত থাকে ঠিক তেমনই স্বামীর মাঝে স্ত্রীর গোপন অস্তিত্ব লুকায়িত থাকে। তুমি তো তখনি সর্বহারা হয়ে গিয়েছ মা।”

রাগিনী থামল এবার। মায়ের ছবিটা জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। থুঁতনি বেয়ে গড়িয়ে পড়ল পানি। যেই বাবা নামক মানুষটি তার চোখে পানি আসতে দেওয়ার আগেই তার সব চাহিদা পূরণ করেছে সেই বাবাই আজ তাকে এতটা কষ্ট দিল যে তাকে হয়ত সারাজীবন এই কষ্টে তড়পে যেতে হবে।
“আমি সবসময় আফসোস করেছি এই ভেবে যে আমি তোমার আদরে বড়ো হতে পারিনি। তোমাকে কাছে পাইনি, মা। তার আগেই তুমি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছো। কিন্তু আজকে সবটা জানার পর মনে হচ্ছে যা হয়েছে ঠিক হয়েছে। এই নিষ্ঠুর সত্যি জানার আগে তুমি চলে গিয়েছ। ভালো করেছ। কোনো নারী তার ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে পরনারীর নাম পাশে দেখতে পারেনা। জানো মা? আমি পুলিশের থেকে জানতে পেরেছি আমার একটা বোনও আছে। হয়ত সে তোমার সন্তান নয়। কিন্তু সেও তো কারোর সন্তান। আমি মনে করি বোনের সম্পর্ক অবৈধ হতে পারে না। আরো অবাক করার বিষয় কী জানো? বোনের সঙ্গে আমিও একবার দেখা করেছি। তার সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। কিন্তু বুঝতে পারিনি রূপাই আমার সেই বোন। পুলিশের মুখে সবটা শুনে রূপার জন্য কষ্ট হচ্ছে আমার। সাইকোলজিস্ট শাহ্ রাশেদ! যাকে আমি সারাজীবন নিজের এঞ্জেল ভেবে এসেছি। সে নিজে রূপা যখন সদ্যজাত সন্তান তখন একবারও না ভেবে কারোর হাতে তুলে দিলো। কষ্ট হয় মেয়েটার জন্য। আমিও শাহ্ রাশেদের মেয়ে আর সেও তারই মেয়ে। কিন্তু দুজনের ভাগ্য কতটা আলাদা! অদ্ভুত তাই না?

একা একা অনেকক্ষণ ধরেই প্রলাপ বকে গেল রাগিনী। মানসিক দিক থেকে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে সে। তাকে সামলানোর কেউ নেই বর্তমানে। ঠান্ডা ফ্লোরে অনেকক্ষণ হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকতে থাকতে তার মনে হলো, কোহিনূরকেও তো সে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। কোহিনূরও কি তার সঙ্গে এমন করবেন? কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে টলমল করতে করতে ঘরে টাঙানো কোহিনূরের বড়ো ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রাগিনী। তার এক হাত কোহিনূরের ছবিতে রেখে বলল,
“আপনিও এমন করবেন না প্লিজ। তাহলে আমি ম/রেই যাব।”

বিকট শব্দে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল রাগিনীর। তার হাতে থাকা মায়ের ছবিটা পড়তে গেলে ধরে ফেলল সে। বিষণ্ণ মুখে তাকাল দরজার দিকে। এলোমেলো পায়ের ধাপ ফেলে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। করিডোরে পৌঁছাতেই রেলিং-এর কাছাকাছি যাওয়া মাত্র কয়েকটা লোকের দেখা পেল সে। মুখচোখ ঢেকে রীতিমতো ড্রয়িংরুমের জিনিসপত্র ভাঙচুর করছে। রাগিনীর বুঝতে খুব একটা সময় লাগল না এরা নিশ্চিত তার বা নয়নেরই খোঁজে এসেছে। এই মূহুর্তে তাদের কাছে ধরা দেওয়া মানে কোহিনূরকে অর্ধেক নিজেদের কবলে নিয়ে আসা। নিচে থাকা লোকদের মধ্যে একজন উপরে তাকাতেই মাথা নিচু করে বসে পড়ল রাগিনী। বুকটা ঢিপঢিপ করছে তার। কোথাও একটা আত্মগোপন হতে হবে! কিন্তু কোথায়?

রাগিনী অথবা কোহিনূরের বাড়ির কাউকে ধরে আনার জন্য আদেশ করেছে ফাহমিদ। কথা অনুযায়ী তার লোকজন ঢুকে পড়েছে কোহিনূরের বাড়িতে এবং সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে চলেছে। সবশেষে কোহিনূরের ঘরটার সবজায়গা খুঁজেও পাওয়া গেল না কারোর উপস্থিতি। পুরোটাই ফাঁকা বাড়ি। খোলা ঘরগুলো সার্চ করেও যখন কিছু পাওয়া গেল না তখন লক করা স্টোররুম খোঁজাও বাদ দিলো না তারা। সেখানেও কিছু না পেয়ে তাদের মধ্যে একজন গড়গড় করে বলল,
“আমার মনে হয় ওই কোহিনূর আগে থেকেই চালাকি করে নিজের বাড়ির লোকজনকে কোথাও সরিয়ে দিয়েছে।”

“আমার তাই মনে হচ্ছে। ওই অফিসার আমাদের ভাবনার চেয়েও দুই ধাপ আগে চলে। বস তো বলল, কোহিনূরের টিম নাকি হসপিটালেও উপস্থিত হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের লোকজন আজকে কিছু একটা করেই ছাড়বে। বুঝলি? ওই হসপিটালকে উ/ড়িয়ে দেবে।”

হাসিঠাট্টা চলল লোকগুলোর মাঝে। ফাঁকা হাতেই চলে গেল তারা। সঙ্গে সঙ্গেই লক করা ওয়্যারড্রব থেকে একটা টেডি গড়িয়ে পড়ল। টেডিবিয়ারের পেছনের চেইন খুলে নিজের মাথা বের করে বড়ো বড়ো শ্বাস নিতে লাগল রাগিনী। মুখের উপর পড়া এলোমেলো চুল সরিয়ে দেয়ালের গায়ে পিঠ লাগিয়ে দিলো সে। আরেকটু হলে যেন দম আঁটকে কিছু একটা হয়ে যেত তার। কিন্তু লোকগুলোর কথাবার্তা কান অবধি এসেছে তার। কোহিনূরের নাম নিতেই আঁতকে উঠেছিল সে। টেরো/রিস্ট টিমের নেক্সট আর ফাইনাল টার্গেট যে সিটি হসপিটাল সেটা বোধগম্য হলো তার। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“তারমানে কোহিনূর ওখানে আছেন। আর আমাকে বলেছেন ছোটোখাটো একটা মি/শন আছে? আবারও মিথ্যে বললেন আমাকে? এই লোকটা কখনো শুধরাবে না। কখনোই না। আচ্ছা, রূপাও কি ওখানে আছে? থাকার তো কথা! কিন্তু নিশ্চিত হবো কী করে? ওর সঙ্গে দেখা করা খুবই দরকার!”

হসপিটালের চারিদিকে শোরগোল হচ্ছে। সকলে আতঙ্কে এদিক থেকে ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। যদিও খুবই কম রয়েছে রোগী এবং ডাক্তারের সংখ্যা। গতকাল রাত থেকেই রোগীদের অন্য হসপিটালে শিফট করার ব্যবস্থা শুরু করা হলেও সবাইকে সরানো যায়নি। কারণ অন্য হসপিটালেও এত জায়গা নেই। এখন যারা আছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই পুলিশের লোকজন এবং বাকিরা হচ্ছে উ/গ্রপ/ন্থী। পুলিশ চেয়েও কিছু করতে পারছে না। কারণ শত্রুপক্ষের কাছে বো/ম আছে। তাও আবার তাদেরই গায়ের সঙ্গে ফিট করা। তাই তারা সকলে চেষ্টা করে যাচ্ছে কোনোমতে যেন হসপিটালের সকল পেশেন্টকে বের করে দেওয়া যায়। ইতিমধ্যেই র/ক্তার/ক্তি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। উ/গ্রপ/ন্থীদের পাল্টা আক্র/মণের জন্য রি;ভল/বার চালাতে বাধ্য হচ্ছে পুলিশ টিম। র‌্যাবের টিম বাহিরে উপস্থিত রয়েছে।

কপালের বাম দিক থেকে র/ক্ত গড়িয়ে কোট অবধি পড়েছে। আ;ঘাত পেয়ে মাথাটা ঝিমঝিম করছে কোহিনূরের। এলোমেলো পায়ে হাঁটছে করিডর দিয়ে। এমন সময় শ্যু/টের বিকট শব্দ শুনে চমকে সামনে তাকাল সে। রি;ভল/বার সামনের দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছে মেহরাজ। মাটিতে নিথর হয়ে পড়ে আছে একজনের দেহ। বুঝতে বাকি রইল না মেহরাজ তাকে শু/ট করেছে। কোহিনূরকে কভার করেছে সে। তার এই অবস্থা দেখে দৌড়ে এলো মেহরাজ।
“স্যার আপনি ঠিক আছেন?”

“ইয়েস। আই এম অলরাইট। কতজন পেশেন্টকে বাহিরে পাঠাতে পেরেছে সবাই?”

“এইতো। অনেকজনকেই এরমধ্যে সেফলি বাহিরে নিয়ে যেতে পেরেছি। বাট স্যার চাইল্ড ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছিলাম। ওখানে অনেক বাচ্চা আছে।”

চোখ কপালে উঠে গেল কোহিনূরের। অনেকগুলো বাচ্চা মানে অনেকগুলো প্রাণ! যদি না উদ্ধার করতে পারে তারই জীবন বৃথা। চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,
“সেটা এখন বলছ তুমি? চলো সেদিকে।”

মেহরাজের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ছুটতে ধাতস্থ হলো কোহিনূর। তবে মেহরাজ তার হাত ধরে আটকালে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকালে মেহরাজ নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে উঁচু হয়ে কোহিনূরের কপালে বেঁধে দিলো। কিছু মূহুর্তের জন্য নীরব হলো কোহিনূর। এই ছেলেটা সবখানে যত্ন দেখাতে ছুটে আসে। অতঃপর দ্রুত দুজন ছুটল চাইল্ড ওয়ার্ডের দিকে।

কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছে দরজার কাছেই আটকালো কোহিনূর। ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল দুজন লোককে। তারা রি/ভলবা/র হাতে নিয়ে পায়চারি করছে। ওয়ার্ডে আছে অনেক বাচ্চা! কোনো রিস্ক নেওয়া যাবে না। কোহিনূর মেহরাজকে বলে,
“লিসেন, তুমি বাহিরে থেকে আমাকে কভার করবে। আমি সামনে গিয়ে ওদের মনোযোগ সরাব বাচ্চাদের থেকে। ওরা আমাকে শু/ট করতে লাগলে কভার করবে।”

মেহরাজ ঢক গিলে সম্মতি জানালেই কোহিনূর গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ায়। বিলম্ব না করেই দুটো লোক কোহিনূরের দিকে তাক করলে সঙ্গে সঙ্গেই মেহরাজ বু/লেট ছুঁড়ে দেয় তাদের দিকে। মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে কোহিনূর। প্রতিটা বাচ্চার নিষ্পাপ চেহারার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
“এখানে কয়েকজনকে ডেকে নাও। বাচ্চাগুলোকে উদ্ধার করতে হবে।”

“ইয়েস স্যার।”

প্রতিটা কেবিন ভালো করে পরিদর্শন করছে এক নারী। পরনে শার্ট তার উপরে কোট আর মাথায় টুপি। চুলগুলো পেছন দিকে বাঁধা। সেই মানবী স্বয়ং রূপাঞ্জনা। সে খেয়াল রাখছে কোথাও কোনো রোগী বাদ থাকল না তো? উপায় করে ফাহমিদের থেকে লুকিয়ে সেও বেশ কিছু রোগীদের এই হসপিটাল থেকে বের হতে সাহায্য করেছে। এখনো সেটাই করে চলেছে। হঠাৎ একটা কেবিনে গিয়ে থমকাল সে। নজরে এলো দুটো বয়স্ক মহিলা। তারা ভয়ে সিটিয়ে গিয়েছে তার। তাদের দিকে ছু/রি ধরে আছে ফাহমিদের দুটো লোক। চোয়াল শক্ত করে কেবিনে প্রবেশ করল রূপা। তাকে দেখে দুটো লোকের মনোযোগ ভড়কে গেল। তাদের উদ্দেশ্য করে রূপা শক্ত গলায় বলল,
“তোমরা অন্যদিকে যাও। এদের আমি দেখে নিচ্ছি।”

রূপাঞ্জনার কথা অমান্য করার সাহস নেই তাদের। রূপার কথা মেনে দুজনই প্রস্থান নিলে এক দুর্বল মেয়েলি কণ্ঠ কর্ণগোচর হলো তার। কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েই বিছানার এক কোণে রুগ্ন হয়ে বসে থাকা মহিলার দিকে তাকাল সে। মহিলাটি তাকে ইশারায় কাছে ডেকে ধীর সুরে বলল,
“এই মেয়ে শোনো!”

রূপা প্রথমে ইতস্ততবোধ করল। ঠাঁই দাঁড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল,
“আপনাদের ভয় নেই। এদিক দিয়ে আপনারা সোজা পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যান। ভাঙা একটা জানালা আছে। ওদিক দিয়ে এখান থেকে বের হয়ে যান।”

শামীমার কানে যেন রূপার কথা গেলই না। সে আবার ইশারা করে ডাকল,
“এখানে আমার কাছে একটু আসো।”

শামীমার বোন তৎক্ষনাৎ শামীমাকে বাঁধা দিলে শুনল না সে। রোগা শরীর নিয়েই হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে রূপার কাছে আসতে নিলে সামলাতে পারল না সে। তবে রূপা তাকে ধরে নিলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শামীমা। সব সত্যিটা জানার এবং শোনার পর অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল শামীমা। যার কারণে তাকে এখানে ভর্তি করা হয়েছিল। রূপার দিকে কিছুটা সময় অপলক চেয়ে থেকে হঠাৎ করেই চিৎকার দিয়ে তাকে জড়িয়ে নিলেন শামীমা। চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলেন। প্রথমে থতমত খেলেও রূপা পরক্ষণেই শুনতে পায় শামীমার বলা কথা।
“আমার মেয়ে! আমার মেয়েকে পাইছি। আমার মেয়ে তুমি।”

রূপাঞ্জনার হৃদকম্পন কিছুক্ষণের জন্য যেন একেবারেই থেমে গিয়েছিল। শিথিল হয়ে উঠেছে আপাদমস্তক। মহিলাটির বলা কথাগুলো ভ্রম মনে হচ্ছে তার। নিজেকে কোনোরকমে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে ছিটকে এলো রূপা। অস্ফুটস্বরে বলল,
“কে আপনার মেয়ে? আমি আপনার মেয়ে কী করে? আপনি আমাকে চেনেন?”

শামীমা ডুকরে কাঁদলেন। অস্পষ্ট সুরে বলতে লাগলেন,
“আমি আমার মেয়েকে চিনতে ভুল করব? পুলিশ আমাকে বলেছে, তোমার ছবি দেখিয়েছে। তুমি ভুল পথে চলে গেছো সেটাও বলেছে। আমার মেয়েকে আমি ঠিক চিনে নিয়েছি। আমি তোমার মা। বিশ্বাস করো আমি তোমাকে জন্ম দিয়েছি।”

রূপার কাছে অবিশ্বাস্য লাগল সবটা। স্বপ্ন নয়ত কল্পনা মনে হলো তার কাছে। মাথায় তড়িৎ খেলছে যেন! সর্বাঙ্গ কাঁপছে তার। এই মহিলা সত্যিই যদি তার মা হয় তবে এত বছর কোথায় ছিল সে? কেন নেয়নি তার খোঁজ? তাই বিশ্বাস করল না সে। সেই অবিশ্বাসের জের ধরে বলল,
“আপনি আমার হলে এতদিন আমি অন্য কারোর বাড়িতে বড়ো হয়েছি কেন? আপনি আমায় জন্ম দিলে আমি আজ ক্রি/মি/নাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি কেন?”

শামীমা বাকরুদ্ধ হলো। বসে পড়ল ফ্লোরে। রূপা যেন নড়াচড়া করার ক্ষমতা হারিয়েছে। এমন সময় শামীমার বোন বলে উঠলেন,
“আমার বোনকে সময় দাও। কাহিনীটা অনেক বড়ো। বাহিরে এত বিপদ! ও ঠিকঠাক বলতে পারবে না।”

রূপাঞ্জনা শক্তি জোগাল। দম নিয়ে দরজার কাছে ঘুরে গিয়ে লক করে দিলো। ফের শামীমার কাছে নিজেও ফ্লোরে বসে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি আমার মা হলে আমি নিজের সব প্রশ্নের উত্তর চাই।”

শামীমা কোনোরকম কথা না বলে প্রথমেই রূপাঞ্জনার গাল দুটো ধরে টলমল চোখে তাকিয়ে রইল। কলিজা ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত ছাড়বে না সে। এত প্রতীক্ষার ফল সে অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে যাবে ভাবেনি কখনো। হুট করেই রূপাঞ্জনার মুখ নিচু করে গালে, মুখে, কপালে চুমুতে ভরিয়ে দিলো শামীমা। রূপা মায়ের প্রথম আদুরে স্পর্শে নিভতে শুরু করল। মনে হলো না এই স্পর্শের ভাষা মিথ্যে। এটা নিশ্চয়ই মায়ের স্পর্শ! চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে লাগল তার। মায়ের এই স্নেহের ছোঁয়া পেতে সে কত মূহুর্ত তড়পেছে! আজ অবশেষে হৃদয়ে বইতে লাগল শান্তির হাওয়া।

একটা বয়স্ক মহিলাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল রায়ান। ঠোঁট ফেটে র/ক্ত নামক তরল পদার্থটি বেরিয়ে থুঁতনিতে এসে তা শুঁকিয়েও গিয়েছে। কথা বলার সময় ঠোঁট নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে তার। একজনের সঙ্গে হাতাহাতি করতে গিয়ে সে রায়ানকে সরাসরি দেয়ালে ছিটকে ফে/লে দিয়েছিল। তারপর এক বয়স্ক মহিলাকে একটা কেবিনে থাকতে দেখে তাকে উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে হসপিটালের পেছনে নিয়ে যাচ্ছে সে। সাইড থেকে আচমকাই গু/লির শব্দ পেলে সরে যাওয়ার আগেই কাঁধের কিছু অংশে আ/ঘা/ত লেগে যায় তার। হালকা আর্তনাদ দিয়ে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালে প্রতিপক্ষ দলের একজনকে দেখে রি/ভ/লবার দিয়ে তাক করার আগেই কোত্থেকে কোহিনূরের উদয় হয়। দ্রুত ট্রিগার চেপে পরপর দুটো বু/লেট চলে যায় লোকটির বুকের ভেতর। তারপর দ্রুত পায়ে কোহিনূর রায়ানের কাছে এগিয়ে এসে কাঁধে লাগা চোট দেখতে চাইলে রায়ান তাকে ইশারায় বারণ করে বলে,
“তুই এই আন্টিকে বাহিরে নিয়ে যা। আমি ঠিক আছি। এখন এসব চোট দেখার সময় নেই।”

কোহিনূর রায়ানের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে দ্রুত হুইলচেয়ার ধরে বাহিরের দিকে এগিয়ে যায়।

একটা দশ বছরের বাচ্চার হাতে গু;লি লেগেছে। আরো আ;ঘাত করার আগে মেহরাজ ক্রি/মিনা/লটিকে ধরাশায়ী করে ফেলে। তার রি/ভল/বারে বু/লেট আর নেই। তাই কাঁচের বোতল দিয়ে বা/ড়ি মে/রেছে লোকটির মাথায়। তারপর বাচ্চাটিকে কোলে তুলে দৌড়াতে শুরু করলে হুট করেই কেউ একজন তার পায়ে শু/ট করে দেয়। সরাসরি ফ্লোরে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় মেহরাজ। বাচ্চা ছেলেটাকে আগলে ধরে পেছনে তাকায় সে। প্রতিপক্ষ টিমের আরেকজন তাকে গু;লি মে/রেছে। তার হাতের কাছে আরেকটি রি/ভল/বার পেয়ে সেটা মূহুর্তেই নিজের কাছে নিয়ে সেই মানবটিকেও পরপর তিনবার গু/লি চালিয়ে নিঃশেষ করে দিলো সে। উপস্থিত হলো তার দলের দুজন। তাদেরকে মেহরাজ বলে দিলো বাচ্চাটাকে উদ্ধার করতে। তারপর নিজে দাঁড়াতে গিয়ে পায়ের তীব্র ব্য/থায় আবারও আধশোয়া হয়ে কাতরাতে থাকল সে। বুঝতে পারল এই পা নিয়ে সে বেশিদূর যেতে পারবে না। ইতিমধ্যে মেঝে র/ক্তে মাখামাখি অবস্থা!

বৃদ্ধ মহিলাটিকে বাহিরে বের করে দিয়েই আন্ডারগ্রাউন্ড রুমের দিকে হাঁটা দিলো কোহিনূর। সেখানে সে কাউকে যেতে দেখেছে। যেটা কোহিনূরের কাছে সুবিধাজনক লাগেনি। জায়গাটির কাছাকাছি পৌঁছে উদ্ভট আওয়াজ পেল সে। এক প্রান্তের আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো সে ভেতরের দিকে। দেখা গেল একটা লোককে বো/ম ফিট করতে। বো/মের পুরো ধরণটা দেখে মনে হচ্ছে এটাই মেইন অ/স্ত্র তাদের। দেরি না করেই নিজের রি;ভল/বার বু/লেট লোড করে তড়িঘড়ি করে ভেতরে ঢুকে লোকটিকে জোর গলায় বলল,
“হ্যান্ডস আপ! আর একটাও কিছু করলে এখানেই শু/ট করব।”

লোকটি আচমকা চমকে উঠে দুটো হাত উপরে তুলল। তারপর কোহিনূরের দিকে ফিরতেই বিস্ময়ে চক্ষু চড়কগাছ হলো কোহিনূরের। যদিও সে ধারণা করেছিল এই লোকটা সম্পর্কে। তবুও পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলো না। দাঁতে দাঁত চেপে রি;ভ/লবার আরো শক্ত করে চেপে ধরে কোহিনূর বলল,
“সৈয়দ!”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here