গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে ২ পর্ব ৩+৪

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩ (২য় খণ্ড)

রাগিনীর ভেজা স্নিগ্ধ মুখশ্রী দেখে ভীষণ সুস্থিরতা অনুভূত করল কোহিনূর। তবে তার প্রেয়সীর এই শুকনো এবং ফ্যাকাসে মুখ সেই সাথে চোখের আশপাশটা ফোলা দেখে কিছুটা দ্বিধান্বিত হলো সে। তবে রাগিনীর এই অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখতে বেশ ভালো লাগছে তার। চোখে অন্তরীক্ষের সমান বিস্ময় এবং টলটল চোখে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে সে। দূরে দাঁড়িয়েই শব্দহীন হেসে ঘাড় কাত করে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করল রাগিনীর অভিমুখে। তার ইশারা যেন রাগিনীর নিকট এক অদ্ভুত প্রশ্ন হয়ে এসে পৌঁছাল তা হলো, ‘কেমন চমকে দিলাম?’

নিজের সমস্ত অভিমানগুলো মিইয়ে পড়ল কোহিনূরের এই হাসোজ্জল চেহারা দেখে। প্রতিক্ষা বৃথা ছিল না তবে! কোনোকিছু না ভেবেই এবং লোক সমাগমের তোয়াক্কা না করেই সে একপ্রকার ছুটে এসে দাঁড়াল কোহিনূরের সংলগ্নে। এখন চোখ দুটো বিশ্বাস করল মানুষটি সত্যিই তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে এসেছে। তাকে দেখে হাসতে গিয়েও থামল রাগিনী। চোখমুখ জড়িয়ে ফেলল সে। মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সঙ্গে সঙ্গে কোহিনূর তার দিকে একটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,
“বেশি অপেক্ষা করিয়ে ফেললাম?”

“কেন এসেছেন? আপনি কী করে জানলেন আমি এখানে আছি? কে বলেছে আপনাকে?”

“আমি তোমার পায়ের প্রতিটা ধাপ সম্পর্কে খবর রাখার ক্ষমতাটুকু রাখি ডিয়ার!”

চোখমুখটাতে আরো বেশি রাগের ছাপ ফুটিয়ে তুলল রাগিনী। চোখ রাঙিয়ে প্রশ্ন করল,
“আমি বলেছি এসবের খবর রাখতে? সব তো শে’ষ করে দিয়েছেন। আর এখন এসেছেন দরদ দেখাতে?”

কোহিনূর হেসে রাগিনীর ডান গালটা টেনে ধরল।
“তুমি গেলে তো বিয়ের আগেই বউ হারা হয়ে যাব আমি! সেকারণেই তোমায় সর্বশক্তি দিয়ে হলেও আঁটকে রাখছি আপাতত।”

“আপনি হেড অফিসে কী বলেছেন বলুন তো? বলেছেন আমরা স্বামী-স্ত্রী? আমাদের বিয়ে হয়েছে?”

সোজা হয়ে দাঁড়াল কোহিনূর। পকেটে হাত দিয়ে এমন ভান ধরল এই ভয়ানক মিথ্যে বলার জন্য তার কোনো অনুশোচনা নেই। বরং বেশ কনফিডেন্স নিয়েই বলল,
“মাঝে মাঝে অনেক বড়ো কাজ সম্পাদনের জন্য একটু-আধটু মিথ্যে বলতে হয়।”

ভ্রু কুঁচকায় রাগিনী। তারপর তেতে উঠে বলে,
“কী এমন বড়ো কাজ সম্পাদন করবেন আমায় বউ হিসেবে পরিচয় করিয়ে?”

“আমার এই মনের রানির মান ভাঙাব। এটাই বা কম কীসে? এটা তো আমার রাজকার্য!”

রাগিনী দাঁত কটমট করে প্রতিত্তোরে বলল,
“নিকুচি করেছি আপনার রাজকার্যের। আমার মতো অবিবাহিত মেয়েকে বিবাহিত বানিয়ে দিলেন লজ্জা করে না আপনার?”

কোহিনূর মৃদু হেসে রাগিনীর আরেকটু নিকটে আসে। একটু নিচু হয়ে ধীর গলায় বলে,
“তুমি হ্যাঁ বললে এখনি এই মূহুর্তে বিয়েটা সেরে নিতে রাজি আছি। একদম নাচতে নাচতে তোমায় কোলে তুলে কাজি অফিসে যাব। বিলিভ মি!”

রাগিনী কিছু বলার আগেই কোহিনূর আপনাআপনি হকচকিয়ে কিছুটা দূরে সরে গেল। মাথা নিচু করে নেত্রপল্লব বড়ো করে মেলে তাকাল রাগিনীর হাতে থাকা ছোট্ট রিও এর দিকে। এই ফা’জিল বিড়াল ছানা আবারও আঁচড়ে দিয়েছে তাও কোহিনূরের পেটে। এই কান্ড বুঝতে পেরে রাগিনীও দুম করে বলল,
“দেখেছেন? রিও নিজেও বুঝে গিয়েছে আপনি চূড়ান্ত লেভেলের অসভ্য একটা লোক। ঠিক সেকারণেই বিয়ের কথা তুলতেই সে আপনাকে বুঝিয়ে দিয়েছে।”

“এই ছোটু আমাকে সহ্যই করতে পারে না তোমার মতোই।”

রাগিনী এবার ঠোঁট টিপে হাসে। পরক্ষণেই কালো হয় মুখ। তার বাবা তাকে যেতে বলেছে। অথচ এই মানুষটা এখন তার সামনে। এখন তার সামনে দিয়ে যাওয়া কি সম্ভব হবে? এই মানসিক উদ্বেগ তাকে রেহাই দিতে চাইছে না। কারোর মন রাখতে কারোর মন ভাঙতে হবে। নিজের লাগেজ জোরে চেপে ধরল রাগিনী। এবার ঘোষণা হলো, ‘আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ছাড়তে চলেছে। যাত্রীরা দ্রুত নিজের আসন গ্রহণ করে নিন।’

রাগিনীর এই নীরবতা কোহিনূরকে অন্য কিছু বোঝালো। মেয়েটা যে এখন ট্রেনে ওঠার চিন্তাভাবনা করছে সেটা বোধগম্য হলো তার। তাই সে কৌশলে রাগিনীর কোমল হাতটা স্পর্শ জোরে জোরে বলল,
“স্বামী-স্ত্রী মাঝে একটুআধটু মনমালিন্য তো হতেই পারে রাগিনী। তাই বলে তুমি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারো না। আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ!”

এত জোরে এমন ধরনের কথা বলায় ফ্যালফ্যাল করে কোহিনূরের পানে চাইল রাগিনী। তারপর আঁড়চোখে দেখে নিলো আশপাশ। লোকজনের বর্তমানে মূল কৌতূহল যেন তারাই। সে কথায় ঝাঁঝ মিশিয়ে বলল,
“একদম সিনক্রিয়েট করবেন না। সকলে আমাদের দেখছে। ছাড়ুন আমাকে।”

“সেটাই তো বলছি। সবাই দেখছে আমাদের। তাহলে কেন সিনক্রিয়েট করছ? ফিরে চলো আমার সাথে। সামান্য ঘটনায় স্ত্রী কখনো স্বামীকে ছেড়ে যায়?”

“উফফ…বাড়াবাড়ি করবেন না খবরদার। কী স্ত্রী স্ত্রী করছেন?”

এরই মাঝে দুজনের কথোপকথনের মাঝে এক বয়স্ক মহিলা বলে উঠলেন,
“ও মেয়ে! কী হইছে গো? তোমার সোয়ামিরে দেখে মনে হইতেছে তোমারে অনেক ভালোবাসে। সংসারে একটু ঝামেলা হয়। আমরা আমাদের সময় কতো মানিয়ে চলছি। তোমরা আধুনিক মাইয়ারা সব একটু কিছু হইলেই সংসার ছাড়ো! এইডা ঠিক না বাপু!”

রাগিনী একেবারেই হতবিহ্বল এবং বেক্কল হয়ে গেল! মাথাটা ভনভন করছে তার। সে কিছু বলতে চেয়েও পারল না। তার পূর্বেই কোহিনূর সুযোগ পেয়ে গড়গড় করে বলে দিল,
“আপনি একটু বোঝান তো আমার বউটাকে। ভুল করেছি। ক্ষমাও চেয়েছি। তবুও সে বোঝে না। তাকে ছাড়া ছন্নছাড়া হয়ে যাব যে!”

বয়স্ক মহিলাটি সব শুনে মাথা নাড়ালেন। ফের রাগিনীর দিকে চেয়ে বললেন,
“শোনো মেয়ে! বাড়ি ফিরে যাও। এমন সোয়ামির ভালোবাসা সবাই পায় না।”

এবার রাগিনী চোখ রাঙাল কোহিনূরের দিকে। লোকটি ফা’জিলের মতো ঠোঁট কামড়ে হাসছে। রাগিনীর ইচ্ছে করছে নাকে ঘু’ষি দিতে। বয়স্ক মহিলাটি চলে গেলেন। কোহিনূর ধীর সুরে বলে উঠল,
“এবার না গেলে কিন্তু তোমার এই ছোটু বিড়াল ছানা সহ তোমায় কোলে তুলব। আমার লাজলজ্জার বালাই কম। তুমি কিন্তু শরমে মুখ লুকানোর জায়গা নাও পেতে পারো।”

রাগিনী বেশ ভালোই বুঝতে পারল লোকটি এবার ভয়া’নক কাহিনী ঘটিয়ে ফেলতে পারে। সুড়সুড় করে হাঁটা ধরল সে মাথা নুইয়ে। মনও যে টানছে না ট্রেনের দিকে। মনের কথায় শোনা যায়। কোহিনূর মুচকি হাসে। রাগিনীর হাতের লাগেজ নিজের হাতে নেয়। আঁড়চোখে তাকায় রাগিনী। আজ যখন ঘোষণায় কোহিনূর কথাগুলো বলছিল সে উপলব্ধি করেছে তার ভালোবাসা একদম খাঁটি। মানুষটির ভালোবাসা কখনো খাদ ছিল না!

গাড়ির জানালার পাশে একমনে বসে থাকা রাগিনী ভাবছে তার বাবার প্রতিক্রিয়ার কথা। বাবা নামক মানুষটাকেও প্রচণ্ড রকম ভালোবাসে সে। তার কথার অমান্য করে তাকে চিন্তায় ফেলে দিতে সে কখনোই চায় না। কিন্তু তার বাবাও তো তাকে সবসময় বুঝত! হঠাৎ কেন বুঝছে না কে জানে?

পাশেই বসে থাকা রিও আর কোহিনূর রীতিমতো যুদ্ধ করছে। কোহিনূর চাইছে রাগিনীর কাছে গিয়ে একটু বসতে। কিন্তু এই বিড়াল ছানাটা কি তা হতে দিচ্ছে? রাগিনীও ইচ্ছে করে তাদের মাঝে রিও কে রেখে দিয়েছে। কোহিনূর তাকে হাত দিয়ে অন্যপাশে সরিয়ে নিতে চাইলে সামনের পা তুলে হা করে তাকাচ্ছে সে। এমতাবস্থায় সে বিরক্তি হয়ে বলল,
“শোনো রাগিনী, আমাদের বিয়ের পর মোটেও এই ছোটুটাকে আমার বাড়িতে জায়গা দেব না। ওকে তোমার বাড়িতেই রেখে আসবে।”

অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকা রাগিনী কোহিনূরের কথায় সরু চোখে তাকিয়ে বলে উঠল,
“কী শখের বাহার! আমি ওকে নিয়েই যাব।”

কোহিনূর এবার রিও কে তুলতে সক্ষম হয়। তাকে অন্যপাশে রেখে রাগিনীর পাশ ঘেঁষে বসে সে। তাকে আলতো ধা’ক্কা দিয়ে বলে,
“তাহলে স্বীকার করলে আমার বাড়িতে আমার বউ হয়ে যাচ্ছো?”

“সেটা কখন বললাম?”

থতমত খেয়ে বলে রাগিনী। কোহিনূর প্রতিত্তোরে না বলে চুপ রইল কিছু মূহুর্ত। ফের জিজ্ঞেস করল,
“তোমার না দ্যা গ্রেট সিঙ্গার অভিরূপ চৌধুরীর সঙ্গে এঙ্গেজমেন্ট হওয়ার কথা? আমি তো গতকাল তোমার এঙ্গেজমেন্টের লাইভ টেলিকাস্ট দেখব বলে কতক্ষণ ওয়েট করলাম! কিন্তু তেমন তো কিছুই হলো না।”

বলেই একটা হতাশ হওয়ার ভাবভঙ্গি ধরল কোহিনূর। রাগিনী এবার বেশ চটে গেল। কোহিনূরের দিকে ঝাঁঝালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকে হাত দিয়ে বাহুতে চাপড় দিয়ে বলল,
“কেমন প্রেমিক পুরুষ আপনি? অন্যের সঙ্গে নিজের প্রেমিকার এঙ্গেজমেন্ট এর লাইভ টেলিকাস্টে দেখার জন্য অপেক্ষা করেন!”

বলতে বলতেই গতকাল রাতের কথাগুলো ভেবে আবারও পানিপূর্ণ হলো রাগিনীর আঁখি জোড়া। তার মাথায় হাত রেখে আলতো করে বুলিয়ে দিয়ে কোহিনূর নিজের কাঁধের সঙ্গে তার মাথা লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“আরে বাবা, মজা করছিলাম তো।”

“আপনি প্রেমিক হিসেবে খুবই বা’জে! কোথায় আমার এঙ্গেজমেন্ট শুনে ছোটাছুটি করবেন কী! তা না করে ডোন্ট কেয়ার ভাব ধরে বসে ছিলেন। আজ এলেন তাও দেরি করে।”

কোহিনূর এবার শব্দ করে হেসে দিল। রাগিনীর চিবুক ধরে ঝাঁকিয়ে আদুরে সুরে বলল,
“আমি যে জানতাম তুমি জেদের বশে সব বলেছ। তুমি যে প্রেমিকা হিসেবে নিখুঁত ছিলে। আমি প্রেমিক হিসেবে বা’জে না হয় হলাম একটু। কিন্তু আই প্রমিস, স্বামী হিসেবে সবচেয়ে ভালো স্বামী হয়ে দেখাব!”

রাগিনী এবার খানিকটা লজ্জা পায়। মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“কিন্তু বাবা…”

“কী হয়েছে তোমার বাবার? প্রত্যাখান করেছেন আমাকে তো? কোনো ব্যাপার না। সকলের উপস্থিতিতে এবং তোমার বাবার অনুমতিতে তোমায় আমি আমার গৃহিণী বানাব। উনার আদেশেই আমি তোমায় আমার বউরানি করতে চাই।”

“যদি রাজি না হয়?”

ছলছল নয়নে তাকিয়ে কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল রাগিনী। কোহিনূর তার গাল দুটো দুহাতে ছুঁয়ে বলল,
“ধরে নাও রাজি হয়ে গিয়েছেন।”

“এহেম, এহেম!”

দুজনের এই সুন্দর কথাবার্তার মাঝে এবার মেহরাজের কণ্ঠে তারা দুজনই নড়েচড়ে বসল। মেহরাজ সামনের সিটে গাড়ি ড্রাইভ করছিল। এই অবস্থায় সে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
“বলছিলাম যে স্যার, আপনার সামনে একজন সিঙ্গেল আর হতভাগা মানুষ বসে আছে। সেদিকে একটু খেয়াল রাখবেন স্যার প্লিজ!”

কোহিনূর ভ্যাবাচেকা খেয়ে একটু দূরে সরে বসে গাম্ভীর্য ধারণ করে বলল,
“ভালো করে সামনে তাকিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করো মেহরাজ!”

চশমা টেবিলে রেখে চোখটা বুঁজে মাথা হেলে চেয়ারে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছেন রাশেদ সাহেব। কাজে মন বসছে না উনার। পেশেন্টদের সাথে ভালো করে কথাও বলতে পারছেন না। বিরক্তি কাজ করছে। যদিও আজ উনার কাজে আসার কথা ছিল না। তবুও ব্যস্ত থাকলে চিন্তামুক্ত থাকবেন এই ভেবে আজকে নিজের চেম্বারে বসেছেন উনি। তার নিজের বন্ধু নাদিম সাহেবের সঙ্গে সম্পর্কটা বোধহয় আর রইল না। গত রাতে বেশ কথা শুনিয়েছেন উনাকে। এসব আকাশপাতাল চিন্তায় দরজায় টোকা পড়ল। রাশেদ সাহেব তাড়াহুড়ো করে নিজের চশমা চোখে দিলেন। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে শুকনো গলায় বললেন,
“ভেতরে আসুন।”

ভেতরে প্রবেশ করল দুজন মহিলা। রাশেদ সাহেব নিচু হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। দুজনের উদ্দেশ্যেই তখন বললেন,
“বসুন আপনারা।”

বলেই দুজন মহিলার দিকে তাকালেন রাশেদ সাহেব। প্রথম মহিলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“পেশেন্ট কে?”

প্রথম মহিলাটি নির্দ্বিধায় বললেন,
“আমার ছোটো বোন। কয়েকদিন ধরে কেমন কেমন করতেছে ডাক্তার সাহেব। অনেক ডাক্তার দেখাইছি। লাভ হয়নি। আপনার তো অনেক নাম ডাক শুনছি। অনেক আশা নিয়ে আমার বোনটারে নিয়ে আসছি।”

রাশেদ সাহেব মাথা ঘুরিয়ে দ্বিতীয় মহিলাটির দিকে তাকালেন। শিরদাঁড়া সোজা হলো উনার। সমস্ত শরীর শিরশির করে কেঁপে উঠল। চোখে ভুল দেখছেন না তো? চশমাটা একটু নড়াচড়া করলেন। নাহ, সেই একই মুখ। গায়ের লোম শিউরে উঠল এবার। এত বছর পর এই মুখটির দেখা পাবেন কখনোই ভাবেন নি তিনি। বিড়বিড়িয়ে বললেন,
“শামীমা!”

রাশে সাহেবের বলা নামটি কারো কান অবধি গেল না। দ্বিতীয় মহিলাটিও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর চোখে স্পষ্ট ফুটে উঠল অশ্রু! তিনিও যেন আশা করেন নি এই ভদ্রলোকের দেখা আবার কখনো পাবেন। অবিশ্বাস্য লাগল মহিলাটির! লোকটার চেহারার কোনো পরিবর্তন হয়নি তেমন। শুধু চামড়া কুঁচকে গিয়েছে আর চুল পাক ধরেছে। সেই সঙ্গে জুটেছে চোখে চশমা!
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪ (২য় খণ্ড)

মুখ লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে গেলেন রাশেদ সাহেব। এসি এবং ঠাণ্ডা আবহাওয়ার মাঝেও দরদর করে ঘামছেন তিনি। আচমকা পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকা মহিলাটি বললেন,
“মুখ লুকিয়ে যাচ্ছেন কেন? আমি আপনাকে চিনে ফেলেছি।”

এমন কথায় মহিলাটির বড়ো বোন হকচকিয়ে তাকালেন। উনিও ঠিক বুঝতে পারছিলেন না তার ছোটোবোন কী বলছে। বোনের কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন,
“কী বলছিস এসব শামীমা? মাথা গেছে নাকি তোর? ডাক্তার সাহেব! আপনাকে বলছিলাম আমার বোনটার কিছু হইছে। এমন ভাব ধরে মনে হচ্ছে আপনারে চিনে। এটাও নির্ঘাত ওর মাথার সমস্যার কারণে। আপনিই কিছু করেন।”

রাশেদ সাহেব স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছেন না। অস্থির ভঙ্গিতে বললেন,
“এই মহিলার মেন্টাল হেলথ্ একেবারেই খা’রাপ হয়ে গিয়েছে। এভাবে উনার ট্রিটমেন্ট হবে না। আপনি উনাকে কোনো মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করুন।”

শামীমার বড়ো বোন কিছু বলার আগেই শামীমা উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। চোখমুখ লাল করে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
“খবরদার আমাকে তাড়ানোর চেষ্টা করবেন না। আমাকে ইচ্ছেকৃত পা’গ’ল প্রমাণ করতে চাইছেন? না চাইতেও আজ আপনার দেখা পেয়েছি। এত সহজে আমি যাব না।”

“দেখুন! রিল্যাক্স! সিনক্রিয়েট করবেন না। মাথা ঠাণ্ডা করুন।”

“করতে তো চাইনি। আপনি বাধ্য করছেন। এতগুলো বছর আমি একা একা বেঁচেছি। আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমার অংশটুকুও রাখেন নি। ছি’নিয়ে নিয়েছেন সব। আজ যখন হাতের নাগালে পেয়েছি তখন আমি এত সহজে সব ছাড়ছি না। আপনার সন্তান আমায় ফিরিয়ে দিন শাহ্ রাশেদ।”

রাশেদ সাহেবও হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ান। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন এক মায়ের দিকে যে নিজের সন্তানের দাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে। চোখ দিয়ে স্পষ্ট ক্রো’ধের আ’গুন যেন বেয়ে পড়ছে শামীমার। তার বড়ো বোন এবার তাকে থামাতে ম’রিয়া হয়ে উঠলেন। তাকে চেপে ধরে রাশেদ সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“কিছু মনে করবেন না। ও আসলে সন্তান হারাইছে। তারপর থেকে এমন করে মাঝে মাঝে। আর সমস্যা বেশি হওয়ায় আপনার কাছে নিয়ে আসছিলাম। আমি ওরে হসপিটালে ভর্তি করাব।”

“আপা! এই লোকটাই আমার বাচ্চারে গায়েব করছে। দেখতে সাদাসিধা হলেও নিজের এই মুখটা বাঁচাতে আমারে নিঃস্ব করে দিছে আপা! এই লোক! এটা অন্তত বলেন আমার বাচ্চাটা বেঁচে আছে তো? নাকি মে’রে দিছেন? ও ছেলে ছিল? নাকি মেয়ে? নার্স বলছিল আমার চাঁদের টুকরা ছেলে হইছিল। ওরে নিজের কাছে রাখছেন? আমার কাছে ফিরিয়ে দেন।”

রাশেদ সাহেব কী বলবেন কূল কিনারা পেলেন না। শুধুমাত্র উনি বাঁচতে চাইছেন এই শামীমা নামটি থেকে। হাঁসফাঁস করে চলেছেন এই ভয়া’বহ বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে। শামীমার এমন চিৎকার চেঁচামেচিতে রাশেদ সাহেবের চেম্বারে ঢুকে এলো নার্স এবং ওয়ার্ড বয়। সঙ্গে সঙ্গেই বিচলিত এবং পা’গলা’টে আচরণ করা শামীমাকে জোর করে ধরে বের করলেন। তারা বিদায় নেওয়া মাত্র বুকে হাত দিয়ে বসলেন রাশেদ সাহেব। বুকে যেন পাথর চাপা পড়েছে। দম নিতে ক’ষ্ট হচ্ছে ভীষণ। চোখ বুঁজে কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। এরপর একজন ওয়ার্ড বয়কে ডেকে বললেন,
“শোনো, একটু আগেই যেই অসুস্থ মহিলা এখান থেকে বেরিয়ে গেলেন উনি যেন কখনোই আর আমার চেম্বারে ঢুকতে না পারে। মনে থাকবে?”

ওয়ার্ড বয় মাথা নাড়াল বাধ্য মতো। তারপর চলে যেতেই স্বস্তির শ্বাস ফেলে একমনে চেয়ে রইলেন উপরদিকে। এত বড়ো পৃথিবীতে বুঝি আর জায়গা ছিল না? আবারও কেন মুখোমুখি হতে হলো?

সোফায় মাথা নুইয়ে চোখমুখ শক্ত করে বসে রয়েছে অভিরূপ। সামনে গাম্ভীর্য নিয়ে বসে থাকা তার বাবা অর্থাৎ নাদিম সাহেবও রা’গ নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
“তুমি কি নিজের সিদ্ধান্ত বদলাবে না অভি?”

“না বদলাব না। আমি তোমাদের সাথে ফিরব না। তোমরা ফিরতে হলে ফিরতে পারো। আমি এখানে আরো কয়েকদিন থাকব।”

নাদিম সাহেব চরম বিরক্ত হলেন। বিতৃষ্ণা নিয়ে বললেন,
“চাইছ টা কী তুমি? আর এই দেশে কী কারণে থাকবে? আর কী পাওয়ার আছে এখান থেকে? যথেষ্ট পাওনি? অপ’মানিত হওয়া বাকি আছে তোমার?”

“কীসের অপ’মান বাবা? কে অপ’মান করেছে আমায়? রিজেক্টেড হওয়া মানে কি অপ’মানিত হওয়া? রাশেদ আঙ্কেলের উপর রে’গে আছো ঠিক কী কারণে? উনার মেয়ে বিয়ে ভেঙেছে সে কারণে? ভুলটা কোথায় করেছে? ও নিজের ভালো থাকার ব্যাপারে ভাববে না? ও তো আমার কথাও ভেবেছে। তুমি একজন ডক্টর আর সনামধন্য পরিবারের হয়েও সেইসব টিপিক্যাল ফ্যামিলির লোকজনের মতো আচরণ করছ না যারা বিয়ে ভেঙে যাওয়ার জন্য মেয়েকে আর মেয়ের পরিবারকে প্রতিটা মূহুর্ত দো’ষারোপ করে যায়?”

অভিরূপের মা মিসেস. সুরভী এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় কথা বলে ব্যাপারটা মেটানোর চেষ্টা করলেন।
“বিষয়টা সেটা নয় বাবা। আমাদের কথা বোঝার চেষ্টা করো। এখানে থেকে আর কোনো লাভ নেই। কেন শুধু শুধু এখানে পড়ে থাকবে? গতকাল যা হলো তারপর তোমায় রেখে কী করে চলে যাব? তোমার লাভ কী এখানে থেকে? দেশে চলো! তারপর নিজের ইচ্ছেমতো চলাফেরা করবে আমরা বাঁধা দেব না তোমায়।”

অভিরূপ আবারও ভণিতা ছাড়াই বলল,
“আমি আর কয়েকদিন এখানে থাকতে চাই। কিছু কাজ আছে আমার। আমি এখনি দেশে ফিরছি না। এটা আমার লাস্ট আর ফাইনাল ডিসিশন। আমার উপর কেউ জোর খাটাবে না, মা! বাবাকেও বলে দাও।”

বলেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অভিরূপ। নাদিম সাহেবের বারণ এবং কথা কিছুই কানে না তুলে হনহনিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। সে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাদিম সাহেন রা’গ ঝেড়ে বললেন,
“দেখেছ তোমার ছেলেকে? দিন দিন কথার অবাধ্য হচ্ছে। অবশ্য বাধ্য তো কোনোদিন ছিলই না। এখন নিজের ভালোটাও বোঝে না। আর কী করার বাকি আছে তার সেটাই বুঝছি না আমি।”

মিসেস. সুরভী দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লেন। উনি নিজেও বুঝতে পারছেন না ছেলেকে। তাদের সামনে এসে দাঁড়াল নোমান। ধীর গলায় বলল,
“আঙ্কেল!”

নোমান শান্তভাব নাদিম সাহেবকেও এবার নীরব করালো।
“তুমি? কী বলবে বলো!”

“অভির মানসিক অবস্থা খুব একটা ভালো নেই। গত রাতে ঘুমোয় নি ঠিক করে। ছটফট করেছে। উঠে উঠে বারান্দায় গানের সুর তুলেছে। তাল মিলিয়ে গিয়েছে। তার প্রিয় গিটার ছুঁড়ে ফে’লেছে। ও এখন একটা রাগ আর জেদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় ওকে সময় দেওয়া প্রয়োজন। ওকে জোরাজোরি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। ওর জেদ উঠলে আরো বেশি ব্যাপারটা বিগড়ে যাবে।”

“তো কী করতে বলছ আমাকে? ওকে রেখে যাব? নাকি থেকে যাব? এখানে থেকে যাওয়া যায় আর?”

নাদিম সাহেবের কথার বাক ভঙ্গিতে নোমান বুঝল তিনি আবারও রাগছেন। তবে নোমানও যথাসম্ভব নিবৃত হয়ে বলল,
“আপনি বোধহয় রাশেদ আঙ্কেলের প্রতি রাগ থেকে এখান থেকে যেতে চাইছেন। কিন্তু এটাও তো ভাবুন উনার দোষটা ঠিক কোথায়? উনিও তো নিরুপায় ছিলেন! তাছাড়া অভিরূপকে দেখে মনে হয় সে যাবে এখন?”

নাদিম সাহেব এবার নিভলেন। থমথমে হয়ে গেল মুখটা। নোমানকে উনার একারণেই ভরসা হয়। ছেলেটা সব বোঝে। এমনকি এই জেদি অভিরূপকে সামলাতেও পারে সে। এতবছর তো সামলে আসছে। কথায় আছে যেই কাজ মা-বাবা করতে পারে না সেটা বন্ধু করতে পারে। তাছাড়া ছেলেদের বন্ধুত্ব নিবিড় হয়। মা-বাবার সঙ্গে সব অনুভূতির খোলাসা করা যায় না।
“তাকে একটু সময় দিন আঙ্কেল। আর তাকে বোঝানোর সব চেষ্টা আমি চালাচ্ছি। সে বুঝবে। ওর মন শান্ত হলেই ফিরবে আমাদের সাথে।”

নোমানের কথায় শেষমেশ সম্মতি জানালেন নাদিম সাহেব। সময় গড়াতে থাকুক। দেখা যায় কী হয়!

রাতে ফিরতে আজ একটু দেরি হয়েছে রাশেদ সাহেবের। সদর দরজায় কলিংবেল বাজানোর পর রাগিনী বেশ ভয়ে ভয়েই দরজা খুলে দিল। দ্বার খুলে যাওয়ার পরে নিজের মেয়েকে দেখে একটুও চমকালেন না রাশেদ সাহেব। নিজের হাতের ব্যাগটা নিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বাড়িতে ঢুকে বললেন,
“কখন বাড়ি ফিরলে?”

রাগিনী নতদৃষ্টি নিয়ে থমথমে সুরে বলে উঠল,
“বাবা আমি…”

হাতের ইশারায় তাকে থামতে বললেন রাশেদ সাহেব। চাপা সুরে বললেন,
“নো এক্সকিউজ। জানতে চাইছি ট্রেনে উঠেছিলে বাকি তার আগেই ফিরেছ?”

“তার আগেই চলে এসেছি।”

“বাড়ির সবাই কি খাওয়াদাওয়া সেরে নিয়েছে? নাকি বাকি আছে?”

রাগিনী ফ্যালফ্যাল করে দৃষ্টিপাত রইল উত্তর না দিয়ে। বাবার এত স্বাভাবিকতা মেনে নিতে পারছে না সে। ভেবেছিল আবার রাগারাগি করবেন। কিন্তু তা না করে রাশেদ সাহেব রোজকার দিনের মতোই রাগিনীর হাতে তার ব্যাগটা তুলে দিল। রাগিনী চমকে উঠে বলে উঠল,
“সবাই খেয়েছে। আমি আর তুমি বাদ আছি।”

“তাহলে ব্যাগটা রেখে এসে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করো। একসাথে খেতে বসি।”

রাগিনী আরেক দফা অবাক হলো। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। পরমূহুর্তেই নিজেকে ধাতস্থ করল সে। ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলল হাসির রেখা। সে যেন তার আগের বাবাকে দেখতে পাচ্ছে। তার হাসির রেশের উজ্জ্বলতা দেখা গেল চোখেও। সে মাথা নাড়িয়ে দ্রুত ছুটল খাবার ব্যবস্থা করতে।

নিশুতি রাত। চারিদিকে নীরবতার মাঝে হালকা ঝিঁঝিপোকার ডাক। মৃদু হাওয়া ভেসে আসছে জানালা দিয়ে। ঘুমন্ত রিওটার মাথায় আস্তে করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রাগিনী। আর রিও ঘুমের মাঝে ঘড়ঘড়ে আওয়াজ করছে। তার মায়াভরা মুখটা দেখে কেউ বলবেই না এই ছোটো বিড়ালও কারোর সঙ্গে তুমুল যু’দ্ধ পাকিয়ে ফেলতে পারে! রাগিনীর মাথায় চিন্তা এলো এবার। আসলেই কোহিনূরের বাড়িতে যাওয়ার পর সারাদিন দুজনের মাঝে কত প্রকারের তা’ণ্ডব লেগে থাকবে সেটা নিয়েই দুঃশ্চিন্তা ওর। এই উৎকণ্ঠার মাঝে ফোনের রিংটোনটা নিজ ছন্দে যখন বাজতে শুরু করল তখন তড়িঘড়ি করে উঠে বসল রাগিনী। এত রাতে কার ফোন? রিও-এর ঘুম ভাঙবে ভেবে তেমন কিছু না ভেবেই দ্রুত ফোনটা রিসিভ করল সে।
“হ্যালো কে?”

“আমি গো বউরানি! আমি!”

আশ্চর্য হয়ে ফোনটা কান থেকে সরিয়ে নম্বরটা পরখ করে নেয় রাগিনী। কোহিনূরের নম্বরটা তার ফোনে সেভ নেই। আগে তো কখনো ফোনে কথা হয়নি তাদের। আবারও কানের কাছে ফোন নিয়ে বলল,
“কাজকর্ম ফেলে ফাঁকিবাজি করা হচ্ছে সিক্রেট অফিসার?”

“এত কাজকর্মের ভিড়ে তোমার সিক্রেট অফিসার অবসাদগ্রস্ত। তাই শান্তি গ্রহণ করতে নিজের সিক্রেট শান্তির উৎসের কাছে ছুটে এসেছে।”

রাগিনী এবার মুখ নিচু করে মৃদু হাসে। মিনমিন করে বলে,
“বাড়িতে পৌঁছেছেন?”

“বাড়িতে তো পৌঁছে গিয়েছি। তবে কোন বাড়ির কথা বলছ সেটা ক্লিয়ার করো! আমার বাড়িতে নাকি শ্বশুরবাড়িতে?”

“অবশ্যই নিজের বাড়িতে। এখন আপনাকে শ্বশুরবাড়ি কে ঢুকতে দেবে? আপনার শ্বশুর তো আগেই বয়’ক’ট করবে।”

বলেই শব্দ করে হেসে ফেলে রাগিনী। তার হাসির একেকটা প্রতিধ্বনি যেন ছন্দানুগমন হয়ে কোহিনূরের হৃদয়ে পৌঁছায়। আনমনে কোহিনূর বলল,
“বিশ্বাস করো! তোমার হাসির শব্দে কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।”

“তাই? তাহলে বিয়ের পরে খাবার না দিয়ে একটা করে হাসি দিয়ে দেব। সেটা দিয়ে কলিজা আর পেট দুটোই ঠাণ্ডা করে নেবেন।”

কোহিনূর ঠোঁট টিপে হেসে বলে,
“খাবার লাগবে না তখন তোমায় লাগবে।”

বোকা বনে গেল রাগিনী। মূহুর্তেই বাকশক্তি হারিয়ে একহাতে চোখমুখে হাত দিয়ে রাখল সে। লাজহীন প্রেমিক জুটেছে তার। কথা বলাটাই বন্ধ করে দিলো একেবারে। রাগের ভাব দেখিয়ে দ্রুততার সঙ্গে রাগিনী বলল,
“ফোন রাখুন তো আপনি।”

“আরে শোনো!”

কে শোনে কার কথা! অবিলম্বে কলটা কেটে দিয়ে ঘনঘন শ্বাস ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। মুখটা লুকালো বালিশের ভাঁজে।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন নিস্তব্ধতা বাড়তে থাকে তখন শোনা যায় এক চাপা গোঙানির আওয়াজ। শক্ত চৌকির উপর শুধুমাত্র বালিশ আর চাদর নিয়ে শুয়ে আছে রূপাঞ্জনা। চাদরটা খামচে ধরে থরথর করে কাঁপছে সে। গা জ্বরে পু’ড়ে যাচ্ছে। দেখার মতো কেউ নেই। সে একা! এক নিঃসঙ্গ, অসহায় জীবের মতোই দেখাচ্ছে তাকে। যার মৃ’ত্যু ধীরে ধীরে ঘটছে। মাথাটা অসহনীয় য’ন্ত্রণায় ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে তার। প্রয়োজনে ডাকলেও কেউ আসে না। কাতরাতে কাতরাতে হালকা আওয়াজে ডাক দেয় পানি খাওয়ার জন্য। কেউ আসে না। হঠাৎ করেই তার এই অসুস্থতা তাকে ভাবিয়ে তুলছে বেশ। নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে ওঠার চেষ্টা করে সে।

তার এই অসহায়ত্ব দরজার বাহিরে থেকে দেখে বেশ ভালোই পৈ’শা’চিক আনন্দ লুটছে মুখোশের আড়ালে থাকা এক মানবের। এই তো সবে শুরু। সামনে নিকটে একজন লোক এলো। জিজ্ঞেস করল,
“লেডি বসকে যখন বাঁচিয়ে রাখতেই চাইছেন না তখন একবারে মে’রে দিলেই তো হয় বস! এত ধৈর্য ধরার কী দরকার?”

ডার্ক ম্যাক্স কিছুটা বিরক্ত হয়। চোখমুখ কুঁচকে বলে,
“এত তাড়া নেই আমার। দেখতে পাচ্ছো ওর মাঝে ধুঁকে ধুঁকে ম’রার য’ন্ত্রণা? অনুভব করতে পারছ আনন্দ? আমি পারছি। রি’ভল’বার চালিয়ে একবারে শেষ করে দিলে আনন্দটা পাবো কোথায়? ওকে আর আমার কোনো কাজে লাগবে না। তাই একটু আনন্দ দেওয়ার কাজেই লাগুক। কবিরের জীবনাবসান তো নিশ্চিত করে এসেছি। তবে তাকে মা’রার ইনটেনশন আমার ছিল না। কিন্তু আমার লোকজনের বাঁচার ভাগ্য ততদিনই সহায় থাকবে যতদিন আমি চাইব। নয়ত নয়।”

“লেডি বসকে দেখে আমিও অবাক হয়েছি অনেক। হঠাৎ করে তার এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারছি না। আমাদের সঙ্গে কাজ করতে করতে তার কী এমন হলো?”

ডার্ক ম্যাক্স বড়ো একটা নিশ্বাস নেয়।
“আমি জানতাম এই পরিস্থিতি আসবে। যার নিজের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না তাকে তো অন্যকেউ পরিচালনা করবেই। এতদিন আমি করেছি। এখন অন্যকেউ করবে। সিম্পল!”

চলবে…

[বি]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here