#গোধূলী_বেলার_স্মৃতি (Unexpected story)
#পর্ব- ৮
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
সবাই আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। ছোট সাহেব বাদে। তিনি শুধু নীচের দিকে সকলের আড়ালে নিজের বাঁকা দাঁতের হাঁসি দিলেন। যা সকলের নজরে না পড়লেও আমার নজরে ঠিক-ই’ পড়েছে।হয়তো তিনিও আন্দাজ করতে পেরেছিলেন আমার উত্তর। আমি সবার হাঁসি থামানো দেখে চোখ-জোড়া ছোট ছোট করে বলে উঠলাম,
“কি হলো তোমাদের? হাঁসাহাঁসি বন্ধ করে দিলে কেন? হাঁসো সবাই আরো জোড়ে হাঁসো। ”
সবাই চুপ হয়ে রয়েছে। সিথি ও সাদি ভাইয়া মুখ টিপে হাঁসছে।
জেনি আপু আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন,
“এইসব করে কী ভেবেছো? আমরা তোমাকে সিলেক্ট করে নিবো। ”
আমি জেনি আপুর চোখের দিকে তাঁকিয়ে বলে উঠি-
“আমার যোগ্যতা থাকলে অবশ্যই আপনি সিলেক্ট করতে বাধ্য। এমনকি ভার্সিটির ভিপির সাধ্য নেই। ”
কথাটা বলেই উনি আমার দিকে তাঁকালেন।
—–“ওহ তার মানে তুমি মনে করো তোমার যোগ্যতা আছে?
আমি এইবার জেনি আপুর দিকে এগিয়ে গিয়ে হাঁসিমুখে বললাম,
“যদিও গানে আমার নাম দেওয়ার ইচ্ছে ছিলো নাহ। কিন্তু এইবার আমি সত্যি দিবো কিন্তু কাউকে প্রমাণ করার জন্যে নয় বরং নিজের কাছে নিজেকে কিছু প্রমাণ করার সুযোগ এসেছে। সেইটাই করবো। আপনি বরং এইটা ভাবুন আমাকে এতো কথা বলছেন আপনার কী এমন যোগ্যতা আছে? ”
জেনি আপু দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠে-
“যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। ড্রাইভারের মেয়ে কিনা আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করছে। এই জেনি আহসানের যোগ্যতা নিয়ে?রুদ্রিকের বাবা দয়া না করলে তো এই ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ-ই’ পেতে নাহ।
কথাটি শুনেই সাদি ভাইয়া বলে উঠে-
“জেনি তুই এখুনি চুপ যা। ”
—-“চুপ না হলে কী করবি তুই? ”
সিথিও বলে উঠে,
“কাজলকে অপমান করার অধিকার কিন্তু তোমাকে কেউ দেয়নি। ”
জেনি কটু স্বরে বলে,
“এই থার্ড ক্লাস মেয়ে আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস পাই কোথা থেকে? হাও ডেয়ার সি। ভিক্ষারি ঘরের মেয়ে একটা। ”
—–“জাস্ট শাট আপ জেনি। ”
কথাটা বলেই রুদ্রিক উঠে দাঁড়ায়। রাগে যেনো তার নাকের ঢগা লাল হয়ে গিয়েছে। থরথর কাঁপছে সে।
—–“রুদ্রিক! ”
জেনিকে থামিয়ে রুদ্রিক সকলের দিকে তাঁকিয়ে বলে,
“আজকের মতো সবাই চলে যাও। আমরা কালকে অডিশন কনটিনিউ করবো। ”
রুদ্রিকের কন্ঠ শান্ত লাগলেও সবার কাছে কেমন যেনো ভয়ংকর লাগছে। তার সবাই আস্তে আস্তে চলে যেতে শুরু করে।
আমি শুধু চুপ হয়ে সব দেখে যাচ্ছি। একদম স্বাভাবিকভাবেই দাঁড়িয়ে আছি। এখন অডিটোরিয়ামে শুধু আমি, সাদি ভাইয়া, সিথি,জেনি আপু ও ছোট সাহেব।
——“জেনি এখুনি তুমি তিনতলায় চলে এসো। এখুনি মানে এখুনি।”
কিছুটা ধমকের সুরে কথাটি বলে আমার দিকে এক পলক তাঁকিয়ে চলে গেলেন ছোট সাহেব।
জেনি আপু যত দ্রুত সম্ভব উনার পিছন পিছন চলে গেলেন।
আমাকে নীরব থাকতে দেখে সিথি কিছুটা অবাকের সুরেই বলে,
“জেনি আপু তোকে এতো কিছু বলে গেলো আর তুই চুপ ছিলি কেন? ”
সাদি ভাইয়াও তাল মিলিয়ে বলে উঠলেন,
“আমিও তাই ভাবছি। কাজল তো শান্ত থাকার মেয়ে নয়। সবসময়-ই’ উচিৎ জবাব দেয়। ”
আমি ওদের কথা শুনে কিছুটা মিয়ে যাওয়া-ই গলায় বলে উঠলাম,
“এইবার আমাকে কিচ্ছু করতে হবে নাহ। আমার হয়ে
উচিৎ জবাব দেওয়ার মানুষ চলে এসেছে আমার জীবনে। ”
—-” কে সে? ”
সিথির প্রশ্নে আমি কিছুটা মুচকি হেঁসে উত্তর দিলাম,
“আছে একজন। ”
___________ লেখিকা ঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি
জেনি তিনতলায় চলে আসে কিন্তু রুদ্রিককে না দেখতে পেয়ে বলে উঠে-
“রুদ্রিক! কোথায় তুমি? আমাকে শুনতে পারছো? ”
জেনির কথার সাথে সাথে পিছন থেকে কেউ তার হাত মোচরে ধরে।
জেনি ব্যাথায় চিৎকার করতে যাবে কিন্তু তার আগেই
রুদ্রিক তার মুখ চেপে ধরে বাঁকা হেঁসে বলে উঠে-
“জেনি ডার্লিং লাগছে বুঝি? আমারো লেগেছিলো জানো বুকের ভিতরে গিয়ে সোজা লেগেছিলো। কাজলকে বলা তোমার প্রত্যেকটা অপমানজনক কথা আমার বুকের মাঝখানে লেগেছিলো। ঠিক এইভাবেই। ”
কথাটা বলে রুদ্রিক আরো জোড়ে মোচরে ধরে জেনির হাত।
জেনি শুধু মুখ দিয়ে উম উম করছে। ব্যাথায় বোধহয় এখুনি মারা পড়বে। জেনি নিজের হাত ধরে রুদ্রিকের হাতে খামচে ধরছে কিন্তু রুদ্রিক আরো চেপে ধরছে জেনির হাত।
রুদ্রিকের বন্ধুরা উপরে এসে এইসব দৃশ্য দেখে কোনোরকম রুদ্রিকের হাত থেকে জেনিকে ছাড়িয়ে নেয়। জেনি জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে নিতে তন্ময়ের কাঁধে ঢলে পড়ে। জেনির হাত পুরো কাচলে রং ধারন করেছে।
পলক রুদ্রিকের কাঁধ ঝাকিয়ে বলে ইঠে-
“কি হয়েছে রুদ্রিক? তুই এইভাবে জেনিকে কেনো টর্চার করছিস? ”
শোভন এক পলক জেনির দিকে তাঁকিয়ে রুদ্রিকের উদ্দেশ্যে বলে উঠে-
“তুই কী সত্যি মানুষ রুদ্রিক? না মানে তুই দেখেছিস কি হাল করেছিস তুই জেনির?”
রুদ্রিক এইবার দ্বিগুন চিৎকার করে বলে ইঠে-
“কাজলকে অপমান করার আগে জেনির মাথায় রাখা উচিৎ ছিলো এর পরিমান কতটা ভয়াবহ হতে পারে। ওর সাহস কী করে হলো? কাজলকে থার্ড ক্লাস বলার? ”
তন্ময় উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“বি কুল রুদ্রিক! তুই হঠাৎ এতো রেগে যাচ্ছিস কেন?তাও ওই কাজলের জন্যে। কি আছ কী কাজলের মাঝে? ”
তন্ময়ের কথায় রুদ্রিক কিছুটা শান্ত হয়ে এক পলক জেনির দিকে তাঁকায়। রাগের মাথায় সে কী করেছে নিজেও বুঝতে পারছে নাহ। রুদ্রিক হাল্কা সুরে বলে,
“জেনিকে তোরা ওর বাড়ি পৌছে দিয়ে আয়। ”
কথাটা বলেই রুদ্রিক গটগট করে নীচে চলে যায়।
শোভন কিছুটা অবাক হওয়া গলায় বলে,
“আমি সত্যি বুঝতে পারছি নাহ রুদ্রিক ঠিক কী চায়।”
জেনি কোনোরকম উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় বলে,
“রুদ্রিককে নিয়ে ভাবার অনেক সময় তোরা পাবি। আপতত আমাকে বাড়ি পৌছে দিয়ে আয়। ”
—-“দেখ জেনি রুদ্রিক নিজের রাগের মাথায়-ই’। ”
পলককে থামিয়ে জেনি বলে,
“আমাকে দয়া করে আপতত বাড়ি পৌছে দিয়ে আয়। রুদ্রিকের সাথে বাকি হিসেব আমি পরে বুঝে নিবো। ”
_____________
দিয়া লেপটপে টাইপ করতে করতে আপনমনে বলে উঠে,
–“ভাইয়া আপতত জরুরী মিটিং এ গিয়েছেন। এই সুযোগে একটা সেল্ফি তুলে নেয়।”
দিয়া কাজের ফাঁকে আরেকটা সেল্ফি তুলে নেয়।
——-“ম্যাম সারাদিন শুধু সেল্ফি তুললেই চলবে? নাকি কিছু কাজও করবেন? ”
কারো কন্ঠস্বর শুনে দিয়া পিছনে তাঁকিয়ে দেখে সুদর্শন একজন দাঁড়িয়ে আছেন।
দিয়া শুকনো গলায় বলে,
” নাকবোচা হ্যান্ডসাম এ্যাসেসটেন্ট! আপনি এতোক্ষন আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলেন?কত্ত বড় সাহস আপনার? ”
কথাটা বলেই দিয়া কোমরে হাত গুজে দেয়।
—” হ্যান্ডসাম নাম টা ঠিক আছে তাই বলে নাকবোচা এ্যাসেসটেন্ট?”
কিছুটা হতাশার সুরে বলে লাজুক।
____________
সিথিকে বিদায় দিয়ে আমি তাঁকিয়ে দেখি, ভার্সিটির কিছুটা দূরে ছোট সাহেব সানগ্লাস পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বলে উঠি,
“কি এতো ভাবছেন? ”
আমার কন্ঠস্বর শুনে ছোট সাহেব আমার দিকে তাঁকিয়ে বলে উঠেন,
“তুই এখানে কেনো? ”
—“আপনাকে দেখলাম চলে এলাম। মন খারাপ? ”
—-“আমার মন খারাপ তোকে আমি বলেছি দূর হও সামনে থেকে। ”
ছোট সাহেবকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে তিনি যথেষ্ট রেগে আছেন।
আমি কিছুটা আস্তে করে বলে উঠলাম,
“আপনার কোনো এক কারনে মন খারাপ। তা আমাকে বলে দিতে হবে নাহ। আমি নিজেই বুঝে যাই। ”
ছোট সাহেব হাত দুটো ভাজ করে বলেন,
“তাই নাকি সব বুঝিস? আমাকে বুঝা এতে সহজ নাহ। ”
আমি উনার চোখের দিকে গভীরভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলি,
—-“কাউকে বুঝতে হলে তার চোখ গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করতে হয়। এতে অপরদিকে থাকা মানুষের জমে থাকা সকল লুকিয়ে থাকার কথা খুব সহজেই চোখে ধরা দিয়ে দেয়। চোখ কখনো মিথ্যে বলেনা। আপনি নিজের ক্ষতগুলো যত-ই’ লুকানোর চেস্টা করুন না কেন তা আপনার চোখে ঠিক ধরা দিবে।”
ছোট সাহেব নিজের নজর সরিয়ে ফেললেন।
—–“নজর সরিয়ে ফেললে কী চোখের ভাষা লুকানো যায় ছোটসাহেব? ”
আমার কথায় ছোট সাহেব ক্ষিপ্ত গলায় বলেন,
“তুই যাবি আমার সামনে থেকে। ”
হুম মশাইয়ের মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে রয়েছে কিন্তু তাতে কী? কাজল এখুনি তার ছোট সাহেবের মন ভালো করে দিবে। কথাটি ভেবেই আমি চট করে বললাম,
“ছোট সাহেব একটা জায়গায় যাবেন? প্রমিস মন ভালো হয়ে যাবে। ”
—–“কোন জায়গা? ”
—“আহা এতো প্রশ্ন করেন কেন? গেলেই দেখতে পাবেন। ”
—-“তা আমার গাড়িতে যেতে পারবি তো? না মানে আমার গাড়ীতে তোর আবার এলার্জি। ”
ছোট সাহেবের কন্ঠে কিছুটা অভিমান স্পষ্ট। আমি মুচকি হেঁসে বললাম,
“আপাতত এলার্জির প্রব্লেম হবে নাহ। ”
রুদ্রিকে কাজলের হাঁসির দিকে তাঁকিয়ে থাকে। মেয়েটি এতো অদ্ভুদ সুন্দরভাবে হাঁসে কীভাবে? সুন্দরের ও অনেক প্রকার ধরণ আছে। এই মেয়ে অদ্ভুদ সুন্দরভাবে হাঁসে। এই অদ্ভুদ হাঁসি দেওয়ার ব্যাখা দেওয়া বোধহয় রুদ্রিকের সাধ্য নয়।
____________
গাড়ি আপনমনে ছুটে চলেছে।আমি জানালার পাশে বাইরের দৃশ্য দেখে যাচ্ছি। ছোটসাহেব নিজের মতো গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। এখুনি বোধহয় গোধূলী বেলা পড়বে মনে হয়। আমি হুট করে বলে উঠলাম,
“গাড়ি থামান! ”
রুদ্রিক জোড়প ব্রেক কষে। কাজল তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ে।
—-“কাজল আস্তে এতো তাড়াহুড়োর কি আছে? ”
আমি যত সম্ভব নদীর পাড়ে ছুটে এলাম। প্রকৃতির মৃদ্যু বাতাসে নদীও সমানতালে বয়ে চলেছে। পানি গুলো আমার বড্ড ছুতে ইচ্ছে করছে। আকাশে তাঁকিয়ে দেখি
আকাশটা গোধূলীর রঙে রঙিন হয়ে রয়েছে। যেনো রঙের উৎসব চলছে।
রুদ্রিক গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে গোধূলী উপভোগ করছে কিন্তু তার দৃষ্টি শুধুমাত্র কাজলে সীমাবদ্ধ। গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করছে কাজলকে।।
হঠাৎ করে রুদ্রিকের ফোন বেজে উঠে। রুদ্রিক ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে দেখে আফজাল শেখ ফোন করেছেন। রুদ্রিক তাড়াতাড়ি ফোনটি কেটে দেয়। রুদ্রিক আবারো তাঁকিয়ে দেখে কাজল নেই। কাজল কোথায় গেলো? রুদ্রিকের মনে অজানা ভয় ঢুকে যায়। তখনি কেউ…….#গোধূলী_বেলার_স্মৃতি (Unexpected Story)
#পর্ব- ৯
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
রুদ্রিকের মনে অজানা ভয় ঢুকে যায়। কাজল কোথায় গেলো? রুদ্রিক আশাপাশে তাঁকিয়ে কাজলকে খুঁজতে শুরু করলো। রুদ্রিক চিৎকারের সুরে বলে উঠে,
“কাজল কোথায় তুই? ”
তখনি একটা বাচ্ছা পিছন থেকে রুদ্রিকের হাত ধরে বলে,
“ভাইয়া। ”
রুদ্রিক পিছনে তাঁকিয়ে দেখে একটা ছোট বাচ্ছা ছেলে। পড়নে তার ঢিলা জামা-কাপড়। রুদ্রিক বলে উঠে-
“তুমি কে? তোমার হাতে কী?
—-” আমাকে ভালো আপা পাঠাইছে এবং কইয়াও দিছে আপনারে আইস্ক্রিম টা দেওয়ার লেইগা। আপা-ই’ আমার দোকানে বইয়া আছে। আপনিও আইসা পড়েন। ”
ছোট বাচ্ছাটা দুটো আইস্ক্রিম বের করে রুদ্রিকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়।
রুদ্রিক আইস্ক্রিম হাতে নিয়ে এগিয়ে যায় পিচ্ছির সেই দোকানে।
হ্যা কাজল বসে আছে সেই দোকানে। কাজলকে দেখে এখন কিছুটা হাল্কা লাগছে রুদ্রিকের। কত্ত বড় দায়িত্বহীন মেয়েটা। কতটা ভয় পেয়েছিলো সে। মেয়েটা কী এইবার ও বুঝে নাহ।
কাজলকে এইবার চরম ধমক দিবে কথাটি ভেবেই রুদ্রিক এগিয়ে গেলো। কিন্তু মুহুর্তের জন্যে রুদ্রিকের চোখ-জোড়া যেনো নিষ্পলক ভাবে আটকে গেলো কাজলের দিকে। কাজল বাচ্ছাদের মতো আইস্ক্রিম খাচ্ছে। মুখ একেবারেই ভরে গেছে আইস্ক্রিম দিয়ে। কাজলের গোলাপের মতো লাল গালে আইস্ক্রিম লেগে গিয়েছে। রুদ্রিক শুকনো ঢুক গিলে মনে মনে বিড় বিড় করতে থাকে,
“তুই ভয়ংকর হরনকারী! সব তুই। হ্যা হ্যা কাজল তুই ভয়ংকরী। ”
গালে কিছুর স্পর্শ পেয়ে আমি পাশে তাঁকিয়ে দেখি, ছোট সাহেব টিস্যু পেপার দিয়ে আমার গাল পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। আমি নড়েচড়ে উঠতেই উনি ধমকে বলেন,
“ডোন্ট মুভ! মুখ কী করেছিস দেখেছিস? তুই কী বাচ্ছা হ্যা?
কথাটা বলেই উনি আমার আরো এগিয়ে যত্ন সহকারে টিস্যু দিয়ে মুখটা পরিষ্কার দিতে থাকেন।
আমি খোলা চুল হওয়ায় উনার মুখে সব গিয়ে পড়ছে। আমি শুধু উনার কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছি। উনি আমার দিকে একপলক তাঁকিয়ে দূরে সরে যান।
কিছুটা ঝাঝালো কন্ঠে বলেন,
“তুই আমাকে না বলে চলে এসেছিস কেন? জানিস আমি কত্ত… “বাকি কথাটুকু বলতে গিয়ে থেমে যান উনি।
——-” ভয় পেয়েছিলেন বুঝি? ”
আমার প্রশ্নে উনি কিছুটা থতমত খেয়ে বলেন,
—-“আমি আবার কীসের ভয় পাবো? রুদ্রিক শেখ কোনো কিছুর ভয় পাইনা। ”
—-“হয়তো আমাকে হারানোর ভয় পেয়েছিলেন।”
উনি আমার কথায় উঁচু গলায় বললেন,
“তোকে হারানোর ভয় আমি পাবো? কেনো তুই আমার কে? তোর যা ইচ্ছে হোক আই ডোন্ট কেয়ার। তুই শুধু আমাদের বাড়ির সামান্য ড্রাইভারের মেয়ে। ”
——“ছোট সাহেব! কোনো কোনো সময় সামান্য মানুষ আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
আমার জীবন বড়ই অদ্ভুদ। আমাদের জীবনে কিছু মানুষ অপ্রত্যাশিতভাবে ‘কেউ’ হয়ে উঠে। ”
—-“কেউ বলতে ঠিক কাকে বুঝাতে চাইছিস? ”
আমি মুচকি হেঁসে বললাম,
“আপতত না বলা-ই’ থাক। আপনার হাতের আইস্ক্রিম টা তো গলে যাচ্ছে। খেয়ে নিন। আইস্ক্রিম খেলে একটু হলেও মাথার রাগ কমবে মনে হয়। ”
—-“কি বললি তুই? ”
কথাটা বলে উনি আইস্ক্রিমের কামড় বসান।
—“না মানে কি জানি বাবা আপনার যা রাগ। আমার মনে হয়না এইটুকুনি আইস্ক্রিম খেলে আপনার মতো বদমেজাজির মাথার রাগ কমবে।”
উনি আমার দিকে শাসিয়ে কন্ঠে বলেন,
“কাজল তুই কিন্তু বড্ড বেশি করছিস। ”
উনার কথার মাঝেই আমি বলে উঠি,
“আজকের গোধূলী বড্ড সুন্দর না?
উনি মাথা নাড়িয়ে বলে উঠে,
” তোর কী এই গোধূলী বড্ড ভালো লাগে?”
—“হুম নদীর পাশে বসে গোধূলী দেখায় এক আলাদা সৌন্দর্য আছে। আমার কাছে এই জায়গাটা বড্ড পছন্দের।”
সত্যি আজকের গোধূলীটা বড্ড সুন্দর।
নদীর স্বচ্ছ জল। সূর্যরশ্মির নিবিড় সখ্যতায় ঝলমল করে স্রোত। কখনও জোয়ার, কখনও ভাটা। মন মিশে একাকার হয় এই রুপালি জলে। আর সময়টা যদি পড়ন্ত বিকেল হয় তাহলে তো কথাই নেই। পড়ন্ত বেলায় পশ্চিম আকাশে তেজ কমে যাওয়া সূর্যটা নদীর জলে ছড়িয়ে দেয় রক্তবর্ণ আভা।
আমি দোকানের পাশে থাকা গিটারের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠি,
“এই গিটার কাদের? ”
আমার কথায় সেই পিচ্ছি দোকানদার ছেলে হুট করে বলে উঠে,
“ভালো আপা জানেন আইজকা নাহ একখান গিটার পাইছি৷ কারা জানি রাইখা চইলা গেছে। এইডা দিয়া কী করমু বুঝতে পারতাছিনা। ”
আমি উঠে দাঁড়িয়ে গিটারটা হাতে নিয়ে চট করে উনার কাছে গিয়ে বলে উঠি,
“একটা গান গাইবেন?
উনি আমার চমকে বলেন,
” কি বলছিস কী? আমি গাইতে পারবো নাহ। ”
—-“আমার একটি অনুরোধ রাখবেন নাহ? ”
কাজলের অনুরোধ কেনো যেনো ফেলতে পারলো নাহ রুদ্রিক।
উনি গিটারটা হাতে নিয়ে , আমার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে গাইতে শুরু করলেন—
দেখলে তোকে, বদলায় দিন
বদলায় রাত, বদলায় ঘুম
সঙ্গে সময়।
সন্ধ্যে হলে, বন্ধ ঘরে
মনে পড়ে তোরই কথা এমনই হয়।
কেন যে তোকে পাহারা,
পাহারা দিল মন।
কেন রে এতো সাহারা,
সাহারা সারাদিন।
কেন যে তোকে পাইনা,
পাইনা মনে হয়, সারাটা দিন।
কেনো যেনো আমার মনে হচ্ছে এই গানটি আমার জন্যে। উনার চোখে গভীর কিছু আছে যা দেখার সাধ্য নেই আমার। আমি আবারো ভাসমান নদীর দিকে তাঁকালাম। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
___________________
দিয়ার কথায় লাজুক হতাশার সুরে বলে,
-” হ্যান্ডসাম নাম টা ঠিক আছে তাই বলে নাকবোচা এ্যাসেসটেন্ট?”
দিয়া মুখটা বেঁকিয়ে বলে,
“আপনি দেখতে মোটামোটি হ্যান্ডসাম কিন্তু আপনার নাকটা বোচা। তাই নাকবোচা এ্যাসেস্টেন্ট বললাম। ভুল কিছু বলেছি কী? ”
লাজুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দিয়া বলে,
“কি হলো নাকবোচা হ্যান্ডসাম এ্যাসিস্টেন্ট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবছেন? চলুন একটা সেল্ফি তুলি।
—-
লাজুক মাথা নাড়ায়। দিয়া হেঁসে লাজুকের সাথে একটা সেল্ফি তুলে।
লাজুক জানে দিয়াকে বলে কিছু বুঝানো যাবে নাহ। তার কপালে জুটেছে এক সেল্ফি পাগল বস। কী আর করবে কপাল খারাপ হলে হলে যা হয় আর কী। লাজুকের ভাবনার মাঝেই দিয়া বলে উঠে,
” নাকবোচা হ্যান্ডসাম এ্যাসিস্টেন্ট আপনি কিন্তু কালকে আমার সাথে শপিং এ যাবেন। আমাকে কিন্তু ভুলেও মানা করবেন নাহ। ভুলে যাবেন নাহ আমি আপনার বস হুহ। ”
—-” না ম্যাম আমি আপনাকে মানা করার কে?আপনাকে মানা করার সাধ্য কী আমার আছে? ”
দিয়া হেঁসে বলে,
“গুড। ”
______________________
ছুটকি বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছে। আমি ছুটকির মাথায় টুকা মেরে বলে,
“তোর না সামনে পরীক্ষা? যা পড়তে বস। এখন নো টিভি। ”
তখনি বাবা বাড়িতে ঢুকেন।
ছুটকি নিজের মাথা বুলিয়ে বাবার কাছে গিয়ে কিছুটা নালিশের সুরে বলেন,
“বাবা দেখো আপাই শুধু সারাদিন পড়তে বস পড়তে বস করে। আমি কিন্তু সারাদিন পড়ি।
—” হুম কী পড়ো তা তো বুঝা-ই’ যাচ্ছে। ফাঁকিবাজ একটা। ”
আমার কথায় বাবা হেঁসে বলেন,
“তোমার আপাই তো ঠিক-ই’ বলেছে মা। সামনে পরীক্ষা পড়তে হবে তো। ”
কথাটা বলেই বাবা সোজা রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের কাছে গিয়ে বললেন,
“রাহেলা তুমি আজকে তোমার হাতের স্পেশাল পায়েশটা বানিয়েছো তো? ”
বাবার কথায় মা মাথা নেড়ে বলে,
“হুম বানিয়েছি। ”
—–“মা আজকে হঠাৎ পায়েস? ”
আমার কথা শুনে বাবা বলে উঠলেন,
“তুই তো জানিস মা। বড় সাহেবের তোর মায়ের হাতের পায়েস কত পছন্দ। আজকে বড় সাহেব আবদার জুড়ে দিলেন তিনি তোর মায়ের হাতের পায়েস খাবেন। তাই আর কি তোর মাকে বলেছি পায়েস করতে। ”
মা পায়েস টিফিন বক্সে প্যাক করে বলেন,
” কাজল তুই বরং গিয়ে পায়েসের বাটিটা নিয়ে শেখ বাড়িতে দিয়ে আয়। ”
আমি সম্মতির সুরে বলে উঠি,
“ঠিক আছে মা! ”
_________________
রুদ্রিক বাড়িতে এসে সোজা আফজাল শেখের মুখোমুখি এসে পড়বে তা হয়তো ভাবতে পারেনি। আফজাল শেখ সোফায় বসে,খবরের কাগজ পড়ছিলেন। ছেলেকে দেখে তিনি যেনো শান্তি পান। কতদিন পরে ছেলেকে দেখছেন উনি। ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে উনার। কিন্তু আফসোস ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। রুদ্রিক আফজাল শেখকে উপেক্ষা করে উপরে চলে যেতে নিলে, আফজাল শেখ হতাশার সুরে বলেন,
“এতোদিন পরে আমাদের দেখা হলো কিন্তু তুমি আমাকে উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছো রুদ্রিক? বাবা হিসেবে এইটুকু কী আমার পাপ্য নয় কী? তুমি আমার সাথে একটু হলেও কথা বলবে। কেনো এইভাবে এড়িয়ে যাচ্ছো?
রুদ্রিক পিছনে না ঘুড়ে-ই’ ক্ষিপ্ততার সুরে বলে,
” নিজেকে আর যা-ই’ বলুন। আপনি আমার বাবা হওয়ার যোগ্যতা অতীতে হারিয়ে ফেলেছেন। আপনার সাথে কথা বলা তো দূর, আপনার মতো ঘৃনিত এক লোকের সাথে একই ছাদে থাকতে হচ্ছে এইটাই আমার জন্যে সব থেকে বড় কষ্টদায়ক বিষয়। ”
কথাটা বলেই রুদ্রিক গটগট করে উপরে চলে যায়।
আফজাল শেখ বসে পড়ে। বড্ড কস্ট হচ্ছে উনার। জেসমিন শেখ এসে আফজাল শেখের কাঁধে হাত রেখে বলে উঠে,
“আপনি ঠিক আছেন তো? আপনি রুদ্রিকের কথায় কিছু মনে করবেন নাহ। ”
আফজাল শেখ নিজেকে কোনোরকম ঠিক করে বলে উঠেন,
“নাহ নাহ আমি রুদ্রিকের কথায় কিচ্ছু মনে করিনি। তুমি কিচ্ছু চিন্তা করো নাহ। ”
এদিকে,
শেখ বাড়িতে ঢুকতেই ছোট সাহেবের সব কথা আমি শুনে ফেলি। ছোট সাহেবের সাথে একমাত্র ইশানি মেমসাহেব ছাড়া কারো তেমন ভালো সম্পর্ক নেই এইটা জানতাম,কিন্তু ছোট সাহেব কেনো বড় সাহেব কী ঘৃণা করে? কী হয়েছিলো অতীতে?