#ঘুণপোকা
#পর্ব_৯
সোফা ছেড়ে উঠে টেবিলের একপাশে থাকা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢাললো সৈকত৷ চেয়ার টেনে বসে থেমে থেমে পানি খাচ্ছে সে। সৈকতের দিকে তাকিয়ে আছে ইমরান। নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে সে এই মানুষটার মাঝে। সৈকত নবনীর সাথে যেমন আচরণ করতো সেও তো একই আচরণ অনন্যার সাথে করে৷ রুপন্তি আর অনন্যার ক্যারেক্টারে খুব মিল। সে যেই কারণে অনন্যার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ঠিক একই কারণে সৈকতও করতো। তাহলে আজ কেন রুপন্তির প্রতি সৈকতের এতখানি অবহেলার গল্পগুলো শুনে রুপন্তির জন্য কষ্ট হচ্ছে? সৈকতকে কেন দোষী মনে হচ্ছে? আপন দোষগুলো কেউ নিজ চোখে দেখতে পায় না বলে?
পানি খাওয়া শেষে সৈকত উঠে এলো চেয়ার ছেড়ে। সোফায় আবারও গা এলিয়ে বসলো। মাথার চুলগুলো এলোমেলো করতে করতে বললো,
– পরদিন শুক্রবার ছিলো। ঘুম থেকে উঠলাম দেরী করে। নাস্তার জন্য ডাইনিংরুমে যেতেই ফুফুর সাথে দেখা৷ টেবিলে বসে উনি চা খাচ্ছিলো। উনাকে দেখে কোনোমতে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে দায়ভার শেষ করলাম। রুপন্তি এসে নাস্তা দিলো। রুটি মুখে দিতে যাবো ঠিক এমন সময় উনি বলে বসলো,
– তুমি যে একটা সভ্য পরিবারের ছেলে তা কি তুমি জানো?
উনার প্রশ্ন শুনে চমকে গেলাম। খুঁজতে লাগলাম আবার কি করলাম আমি? কোন ইস্যু নিয়ে আমাকে এই সকালবেলা ধোলাই করা হবে? উনি ধমকে আমাকে বললেন,
– রাত বিরাতে বউয়ের সাথে চেঁচামেচি করে তুমি আশপাশের লোকজনকে কি প্রমান করতে চাও? তুমি অশিক্ষিত জংলী পরিবারের ছেলে? পরিবার থেকে কোনো শিক্ষা পাও নাই?
উনার কথা শুনে আমার মনে পড়লো আগের রাতের কথা৷ আমি চুপ করে রইলাম। আমার তখন কিছু বলার ছিলো না। কি বলতাম আমি? এক হিসেবে দোষ তো আমারই ছিলো৷ এতরাতে চিৎকার চেঁচামেচি করা আসলেই অসভ্যতা৷ মনে মনে খুব রাগ হচ্ছিলাম রুপুর উপর। ওর কারনে আমি দিনদিন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যাচ্ছিলাম। কখন কোথায় কি করা উচিত এসব কিছু ভুলে ম্যানারলেস হয়ে যাচ্ছিলাম।
– এখানে ভাবীর দোষ দিচ্ছেন কেন?
– তখন সবকিছুতেই ওকে আমার দোষী মনে হতো। কারণ ও নবনীর মত পারফেক্ট না।
– নবনীকে আপনার কেন পারফেক্ট মনে হতো? উনিও তো পারফেক্ট ছিলো না।
– হ্যাঁ ও পারফেক্ট ছিলো না৷ কিন্তু ও আমার মত ছিলো। তাই ওকে আমার কাছে পারফেক্ট মনে হতো।
– আপনার ফুফু আর কিছু বলেনি আপনাকে?
– বলার বাকি রেখেছে নাকি! নবনীর পায়ের যোগ্য রুপু না এটা ফুফু শুনেছিলো৷ দাঁতে দাঁত চেপে আমাকে বললো, রুপন্তিকে তুমি ঐ মেয়েটার পায়ের যোগ্যও মনে করো না! সাহস কত তোমার এই কথা আবার রুপন্তিকে মুখের উপর শুনিয়ে দাও! এত মিষ্টি বউ পেয়েও তোমার সুখ নাই! কি চাও তুমি? জিন্স পড়া চাকরি করা বউ দরকার তোমার? তোমার নবনীর চাকরি করা ছাড়া আর কি যোগ্যতা আছে? অহংকারী মেয়ে একটা! ঘরের কাজ জানে না, মানুষের সাথে মিশতে জানে না, মেহমান আদর আপ্যায়ন করতে জানে না। শ্বশুর শ্বাশুড়িকে আপন করতে জানে না৷ তোমার ঐ বউ তো হাসতেও জানে না। হাসতে গেলেও তার কষ্ট! তোমার ঐ বউর সাথে রুপন্তিকে কেমনে মিলাও তুমি? অন্ধ হইছো? তোমার মায়ের কাছেও আমি শুনছি তুমি রুপন্তির সাথে খারাপ ব্যবহার করো সবসময়৷ কেন করো? কি করছে সে? জিন্স পড়া বউ দরকার তোমার? আজকেই রুপন্তিকে মার্কেটে নিয়ে জিন্স কিনে দিবো। চাকরি করা বউ লাগবে? রুপন্তি মূর্খ না। শিক্ষিত মেয়ে। মাস্টার্সটা শেষ করুক। তোমার ফুফাকে দিয়ে আমি ওর চাকরি ব্যবস্থা করাবো৷ তারপর দেখি তুমি কেমনে নবনীর পায়ের সাথে ওকে তুলনা করো।
ফুফু কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে শেষ করলো। আমিও চুপচাপ শুনলাম। কথা শেষে উনি চায়ের কাপে চুমুক দিতেই আমি বললাম,
– এক নিঃশ্বাসে তো এতগুলো কথা বলে দিলেন। এত আবেগপ্রবণ হওয়াও ভালো না৷ কিছু তো বাস্তবতার সাথে মিল রেখে কথা বলেন। এই যে বললেন রুপন্তি চাকরি করবে, এটা কিভাবে সম্ভব? কে ওকে এপোয়েন্ট করবে? এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে ও? কথা বলেই তো সময় পার করবে, কাজ করবে কখন? হাসতে হাসতে লোকজনের গায়ের উপর পড়ে যায়। যাকে পায় তার সাথেই গল্প শুরু করে দেয়। অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে বেড়ায়। এমন আজব ক্যারেক্টারকে কে এপোয়েন্ট করবে আমাকে একটু বলেন। মিনিমাম সেল্ফ রেসপেক্ট আছে ওর? কোনো পারসোনালিটি নাই এই মেয়ের। এসব ক্যারেক্টারের মেয়েদের ক্যারিয়ার নামক কিছু থাকে না ফুফু। এদের জন্য ঘর সংসারই উপযুক্ত। রুপন্তি তো সেটাও ঠিকঠাক করতে পারে না। রান্নাবান্না তো কিছুই জানে না। এখানে আসার পর রান্না করতে গিয়েছে পাঁচদিন। দুইদিন হাত পুড়েছে, একদিন হাত কেটেছে, একদিন পুরো পাতিলসহ তরকারী ফেলে দিয়েছে আরেকদিন তো রান্নাঘরেই আগুন ধরানোর ব্যবস্থা করেছিলো। আর টেস্টের কথা নাইবা বলি। মা দেখিয়ে দেয়া সত্ত্বেও গড়মিল করে ফেলে। তো ওকে আমি গতরাতে ঐসব কথা শুনিয়ে কি খুব অন্যায় করেছি?
– রুপন্তিকে নিয়ে এত সমস্যা হলে আমার কাছে দিয়ে দাও। আমি ওকে নিয়ে যাই। থাকতে হবে না তোমার সাথে৷
– কথায় আর পারছেন না ফুফু তাই না?
– থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো। বেয়াদবির শেষ প্রান্তে চলে গেছো। আমাকে তোমার মা বাবা পাও নাই। কথায় পারি না মানে কি? বলবো কথা তোমাকে? শুনলে তো আবার তেলে বেগুনে জ্বলবা। রুপন্তির সেল্ফ রেসপেক্ট নাই তাই তোমার পছন্দ না। তোমার তো অনেক সেল্ফ রেসপেক্ট। তোমার আগের বউয়ের তো পা থেকে মাথা পর্যন্ত সেল্ফ রেসপেক্ট ছিলো। সেল্ফ রেসপেক্টের ঠ্যালাঠেলিতে তো ডিভোর্সই হয়ে গেলো৷ এই মেয়ের সেল্ফ রেসপেক্ট নাই দেখে তোমার সংসারে পড়ে আছে। আর নয়তো তোমার আগের বউয়ের মত লাত্থি মেরে তোমাকে রেখে চলে যাইতো৷ শুকরিয়া করো এমন বউ পাইছো। আর নয়তো ডিভোর্স আরো একবার হইতো। তোমার মত বেয়াদবের সাথে কে করবে সংসার? কোনো মেয়েকে তুমি জীবনে সুখ দিতে পারবা না৷
ফুফুর কথায় কতটুক ক্ষেপে গিয়েছিলাম তা বলে বুঝানো সম্ভব না৷ নবনী যেই দোষগুলো আমার ঘাড়ে চাপিয়ে আমাকে ডিভোর্স দিয়েছিলো একই দোষ ফুফুও দিলো। নাস্তা টেবিলে রেখেই চলে এলাম নিজের ঘরে৷ রুপন্তিকে আমার একটা ডাইনি মনে হচ্ছিল। মানুষ বশ করা ডাইনি৷ ফুফুকে কিভাবে সে একরাতে কন্ট্রোলে এনে ফেললো সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সবকিছু হচ্ছিল রুপন্তির জন্য। ইচ্ছে হচ্ছিলো নিজের চুল সব টেনে নিজেই ছিঁড়ে ফেলি৷
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সৈকত। সৈকতের দু’চোখের দিকে তাকিয়ে আছে ইমরান। চোখজোড়ায় যেন হঠাৎ করেই খুব ক্লান্তিরা ভর করেছে। অনুশোচনার ক্লান্তি….
সৈকত চোখজোড়া নিচে নামিয়ে ফেললো৷ ক্ষীণ হয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো,
– আমি ঘরে যাওয়ার পরই রুপু চলে এলো। হাতে খাবারের প্লেটটা নিয়ে বসে পড়লো আমার পাশে। রুটি ছিঁড়ে আমার মুখের সামনে তুলে বললো,
এত্ত রাগ করো কেন? ফুফু মুরুব্বি মানুষ। কত কথাই বলবে। তাই বলে তুমিও এভাবে মেজাজ দেখাবে! ঠিক না সিকু। আবার নাস্তাটাও ফেলে চলে এলে৷ নাও, হা করো।
একে তো আমি রাগে ফুঁসছিলাম। তারউপর রুপু আমার সামনে এসে এসব বলে আগুনে আরো ঘি ঢেলে দিলো। ওকে আমি সেই কথাগুলো বললাম যেগুলো আমার বলা উচিত হয়নি।
– কি বলেছিলেন?
– নাদিমের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলেছিলাম।
– নাদিম কে?
– রুপু যার জন্য বাসা থেকে পালিয়েছিলো সে। ও আমার দিকে খাবার বাড়িয়ে দিতেই ওর হাতে থেকে প্লেটটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম ফ্লোরে। প্লেট ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে গেলো। এরপর শুরু করলাম ওর প্রেমিককে নিয়ে টানাটানি। বললাম, গিয়েছিলো তো প্রেমিকের সাথে সংসার করতে। পরদিনই তো প্রেমিক ফেরত পাঠালো তোমাকে। উচিত কাজ করেছে। ঐ ছেলে তোমাকে ছাড়বে না তো কি করবে? তোমার মত জোকারের সাথে সংসার করবে? তুমি সংসার করার উপযুক্ত? দিনভর মানুষকে বিরক্ত করা ছাড়া আর কি করতে পারো? ঐ ছেলে তোমাকে ছেড়ে দিয়ে বিপদ থেকে বেঁচে গিয়েছে। বাঁচতে পারেনি তোমার বাবা, বাঁচতে পারছিনা আমি। তোমার বাবা তো তোমার দেয়া মেন্টাল স্ট্রেস সহ্য না করতে পেরে স্ট্রোক করে কতগুলো দিন অসুস্থ ছিলো৷ বেচারা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না৷ আর আমি? আমার তো মন চায় দেয়ালে মাথা ঠুকতে থাকি। মাঝেমধ্যে তো মনে হয় মাথার রগ ছিঁড়ে আজই মারা যাবো। কি করে পারো রুপন্তি লোকজনকে এত যন্ত্রনা দিতে! মুক্তি চাই এসব থেকে! মুক্তি! প্লিজ আমাকে মুক্তি দাও। চলে যাও আমার জীবন থেকে। আমি আর তোমাকে সহ্য করতে পারছি না। আমার দ্বারা আর সম্ভব না।
প্রথম! সেদিনই প্রথম আমি রুপুর চোখে পানি দেখেছিলাম! রুপু কষ্ট পাচ্ছিলো, আমি দেখছিলাম। নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলো মেয়েটা আমার দিকে৷ একটা টু শব্দও ও করেনি৷ নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছিলো শুধু। অদ্ভুত এক শীতল প্রশান্তি লাগছিলো আমার। ওর চোখের পানিকে আমার বিশাল বড় অর্জন মনে হচ্ছিলো। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে এই চোখের পানি আমি দেখেছি। রুপন্তি কষ্ট পায়। সে তার সাবেক প্রেমিকের জন্য কষ্ট পায়৷ আমি পেয়ে গেলাম আমার সেই বহু আকাঙ্খিত প্রশ্নের উত্তর। আমি খুব মনোযোগে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম৷ ওর কান্না দেখছিলাম আমি৷ সুখ পাচ্ছিলাম। ভীষণ সুখ! তবে সুখটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি৷ মা এসে রুপুর হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল তার ঘরে। আর ফুফু চিৎকার করে বলছিলো, এই মেয়ের লাজ লজ্জা থাকলে তোর মত বদমাইশের ঘরে আর থাকবে না। গাট্টি বেঁধে আজকেই তোর সংসার ত্যাগ দিবে।
আমিও চিৎকার করে বলে দিলাম,
– খুবই ভালো হবে। গাট্টি বাঁধা হয়ে গেলে আমাকে খবর দিতে বলবেন। আমি রিকশা ভাড়া করে দিবো।
সেদিন আমার সুখ ছিলো আকাশ ছোঁয়া। এত ফুরফুরে মেজাজে আমি শেষ কবে সময় কাটিয়েছি আমার মনে নেই। ভাবলাম দিনটা আমি খুব সুন্দর করে কাটাবো। বাসায় আগুন ধরিয়ে আমি সেজেগুজে চলে গেলাম বাহিরে। কাছের এক বন্ধু্কে নিয়ে চলে গেলাম লং ড্রাইভে৷ সারাদিন বাহিরে কাটিয়েছি।
ফিরেছি রাত সাড়ে নয়টায়৷ দরজা খুললো আমার মা৷ দেখলাম নাক চোখ ফুলে আছে। কান্নাকাটি করে চোখ মুখ ফুলিয়েছে। ড্রইংরুম ফাঁকা। সাবিহার ঘরের দরজা আটকানো। বাবা নিজের ঘরে শুয়ে আছে। মা দরজা খুলে দিয়েই চলে গেলো নিজের ঘরে। আমি আমার বেডরুমে গেলাম। দেখি রুপু নেই৷ ভাবলাম হয়তো সাবিহার ঘরে৷ কিছুক্ষন পর আমার রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমে গেলাম পানি খেতে। পুরো বাসা নীরব। ভূতুড়ে অবস্থা। বুঝলাম ফুফু নেই। থাকলে এতক্ষণে উড়ে চলে আসতো আমাকে কথা শোনাতে৷ আর রুপু বোধহয় শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তাই এখনো সাবিহার ঘরে বসে আছে। আর নয়তো চলে আসতো আমার সাথে ঘ্যানরঘ্যানর করতে৷ পানি গ্লাসে ঢালবো ঠিক তখন সাবিহা ঘরের দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো। মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললো,
– ভাবী ঠিকমত পৌঁছে গেছে মা। ফুফু বাসা পর্যন্ত ওকে দিয়ে এসেছে।
আমি আমার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না৷ রুপু চলে গেছে! আমি মুক্তি পেয়েছি! মনভরে নিঃশ্বাস নিয়েছিলাম আমি৷ মনে হচ্ছিল কত জনম পর এমন মনভরে আমি নিঃশ্বাস নিচ্ছি।
– আপনি এমন কেন করলেন? কি এমন করেছিলো উনি? যত যাই হোক, ঐ ছেলের প্রসঙ্গে কথা বলা উচিত হয়নি। তারমধ্যে উনার বাবার ব্যাপারটা নিয়েও এভাবে বললেন। একটা মানুষের কষ্ট দেখার জন্য এত মরিয়া হয়ে গেলেন আপনি যে নিজের লিমিটেশনই ভুলে গেলেন?
– হুম ভুলেই গেলাম। সেদিন রাতে আমার ঘরে কেউ খায়নি৷ কেউ আমার সঙ্গে কথাও বলেনি৷ ড্রইংরুমে বসে অনেকমাস পর আমি একটু শান্তিতে মুভি দেখেছি৷ কেউ ছিলো না বিরক্ত করার মত। এমনকি রাতে খুশিতে আমার ঘুমও হয়নি৷ মনের আনন্দে সিগারেট খেয়ে, গান শুনে, ছাদে ঘুরে রাত পার করে দিয়েছি।
– একটা মানুষ আপনার সংসার ছেড়ে চলে গেলো অথচ আপনি কষ্ট পেলেন না?
– কেন পাবো? আমি তো চাচ্ছিলাম ও চলে যাক। আমার চাওয়া পূরণ হয়েছে। কষ্ট পাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।
– ভাবী বাসায় যেয়ে কল করেছিলো?
– না।
– উনি রাগ করে কথা না বলার মানুষ না৷ তারমানে সেইবার সত্যিই রাগ করেই ফেললো।
– উহুম। রুপু অতটাও রাগ করেনি। তবে কষ্ট পেয়েছিলো খুব! ততটুকু কষ্ট যতটা সে আমার কাছে আশা করেনি। পরদিন খুব ফুরফুরে মেজাজে অফিস গেলাম। অফিসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার পাশের ডেস্কের মেয়েটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– রুপন্তি কি অসুস্থ? গতকাল থেকে একবারও চ্যাট করলো না। কল করলাম রিসিভও করলো না।
– কি উত্তর দিয়েছিলেন? ঝগড়া হয়েছে সেটা বলেছিলেন?
– না৷ বলেছিলাম কাজিনের বিয়ে এটেন্ড করতে বাবার বাড়ি গিয়েছে। ব্যস্ত আছে।
ঠিক এই প্রশ্নটা অফিসের কয়েকজন আমাকে জিজ্ঞেস করলো। সবাইকে একই উত্তর দিলাম। সবাই আমার কথা মেনে নিলো। আমি অফিস পৌঁছানোর একঘন্টা পরই হাসিব ভাইয়া তার কেবিনে আমাকে ডাকলো। আমি উনার কেবিনে পা রাখতে না রাখতেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– রুপন্তি চ্যাট গ্রুপ থেকে লিভ নিলো কেন? তুই কিছু বলেছিস ওকে?
– আপনি কি বললেন?
– আমি প্রথমেই কিছু বলিনি৷ আমি আগে জানতে চাচ্ছিলাম রুপন্তি ঝগড়ার ব্যাপারে হাসিব ভাইয়াকে কিছু বলেছে কি না? যদি ও কিছু না বলে থাকে তাহলে আমি কেন আগ বাড়িয়ে বলতে যাবো?
– তারপর?
– জিজ্ঞেস করলাম রুপু উনাকে কি বলেছে। বললো, ও নাকি ম্যাসেজের রিপ্লাই দিচ্ছে না৷ তাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে। পরে আমি বললাম, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আমি রুপুকে কিছু বলিনি। ভাইয়ার মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম ভাইয়া আমার কথা বিশ্বাস করেনি। উনি অবিশ্বাসটুকু উনার মন পর্যন্তই আটকে রাখলো। আমাকে আর কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। ভাইয়ার রুম থেকে বের হতেই অফিসের সবাই আমার ডেস্কে এসে একই প্রশ্ন করা শুরু করলো। সবাইকে আমি উত্তর দিলাম, এ ব্যাপারে আমি জানি না৷ কেউই আমার কথা বিশ্বাস করলো না৷ কেউ কেউ আমার সাথে কিছুক্ষণ তর্ক করলো আর কেউ কেউ আমার উত্তর শুনে চুপচাপ চলে গেলো৷
– হয়তো ওরা বুঝতে পারছিলো আপনার জন্যই উনি চ্যাট গ্রুপ লিভ নিয়েছে।
– হ্যাঁ, এটা ওরা সবাই বুঝতে পেরেছিলো।
– ভাবী আপনাকে আর কল করেনি?
– না। যেই মানুষটার ফোনকলে আমি বিরক্ত হয়ে যেতাম সেই মানুষটা সেদিন আমাকে একটা কলও করেনি৷ আর আমি কি করেছিলাম জানো?
– কি?
– মনের অজান্তেই বারবার পকেট থেকে মোবাইল বের করে চেক করছিলাম রুপু আমাকে কল করলো কি না?
– ভাবীর কল আসবে এটা যেন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো তাই না?
– হ্যাঁ। পাশের ডেস্কে তখন তামান্না বসতো। পুরো অফিসে আমার সবচেয়ে ক্লোজ ছিলো এই মেয়েটা। সারাদিন ও আমাকে অবজার্ভ করলো। রাতে যখন অফিস থেকে বের হবো ঠিক সে সময় ও আমাকে বললো,
– আজ সারাদিন রুপন্তির ফোনের অপেক্ষা করেছো। অথচ একটা ফোনও আসলো না। খুব ঝগড়া করেছো মেয়েটার সাথে তাই না?
ওর কাছে আমি আর অস্বীকার করিনি৷ বললাম রুপু বাবার বাড়ি চলে গিয়েছে। তামান্না সেদিন রাতে আমাকে নিয়ে গেলো কফি শপে। কফি খাওয়ানোর বাহানায় অনেক কথা বলেছিলো রুপন্তিকে নিয়ে। সেদিন আমি ওর একটা কথাও পাত্তা দেইনি৷ এক কানে ঢুকিয়েছি আরেক কান দিয়ে বের করেছি।
– কি বলেছিলো?
– এত কথায় না যাই। শুধু ছোট্ট একটা কথা বলি। প্রচন্ড অবহেলায় ভালোবাসার মানুষগুলো একদিন হারিয়ে যায়। আমাদের চোখের সামনে মানুষগুলো থাকা সত্ত্বেও আমরা তাদের হারিয়ে ফেলি। তুমি চাইলেই তাকে সামনে বসিয়ে একনজর দেখতে পারো কিংবা একটুখানি ছুঁয়ে দিতে পারো৷ কিন্তু তুমি পারবে না। তোমাদের মাঝে অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরী হয়ে যাবে। একদিন খুব ইচ্ছে হবে দেয়ালটা ভেঙে তাকে পরম মমতায় বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতে অথবা নিজের সবটা উজাড় করে সেই মানুষটাকে ভালোবাসতে। তুমি শত চেষ্টায়ও দেয়াল ভাঙতে পারবে না৷ অবহেলা বাদ দাও সৈকত। রুপন্তি তোমাকে ভালোবাসে। ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা দিতে শেখো।
(চলবে)
#মিম