চন্দ্রাণী(১৯)

0
288

#চন্দ্রাণী(১৯)
টগর বসে আছে কাদের খানের সামনে। সাদা ধবধবে একটা পাঞ্জাবি পরে কাদের খান একটা বই নিয়ে বসে আছেন।
উঁকি দিয়ে টগর দেখলো শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর লিখা দূরবীন উপন্যাসটি হাতে নিয়ে বসে আছেন তিনি।
মনে মনে ভাবলো টগর এদের বাপ ছেলের অবস্থা ও ধ্রুব আর তার বাবার মতো। ধ্রুবর বাবার নামটা কি ছিলো যেনো?
মনে পড়ছে না টগরের।আশ্চর্য, এরকম তো হয় না কখনো। মা মারা যাওয়ার আগেও তো পড়েছে টগর।এই তো সেদিন,অথচ এখনই ভুলে গেলো!
মাথার ভেতর আটকে রইলো ব্যাপারটা। ধ্রুবর বাবার নাম না জানা অবদি স্বস্তি পাবে না টগর।
আচ্ছা কাদের খানকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে?
না তা কেমন দেখাবে আবার!

এসব ভাবতে ভাবতে কাদের খান বই থেকে চোখ নামিয়ে টগরের দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি এখানে?তা তোমার গুরু কোথায়? ”

টগর লাজুক হেসে বললো, “কাকা আপনি তো সবই জানেন গ্রামের অবস্থা। নিয়াজ ভাই আমাকে পাঠিয়েছে আপনার কাছে। একজন ভালো উকিলের সাথে যাতে আপনি কথা বলে রাখেন।”

কাদের খান হাসলো। টগর অবাক হয়ে দেখছে।এই লোকের ছেলের মাথায় কতো বড় বিপদ ঝুলে আছে তিনি তা বুঝতে পারছেন না?
লোকটার হাসি সুন্দর, মুখ থেকে জর্দার খুব সুন্দর একটা ঘ্রাণ পাচ্ছে।
কাদের খান হেসে বললো, “দেখো বাপু,আমি এসবের মধ্যে নেই।আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। আমার শান্তি আমি আমার এই সঙ্গী বইয়ের মধ্যে খুঁজে পাই।আমি নিয়াজকে বলেছি তার কাজ করতে, আমার কাজ আমি করবো।সে আমার ছেলে হতে পারে কিন্তু আইনের উর্ধ্বে কেউ না।নিয়াজ যদি কোনো দোষ করে থাকে তাহলে তার শাস্তি পাওয়া উচিত তার।আমার ছেলে বলে কি সাত খুন মাফ হয়ে যাবে না-কি! ”

টগর চমকে গেলো কাদের খানের কথা শুনে। সে জানতো বাপ ছেলের মধ্যে বনিবনা নেই তাই বলে এতটা কড়াকড়ি আশা করে নি টগর।

টগর কিছু বলার আগে কাদের খান বললো, “তুমি এখন যাও,আমি পড়ছি।পড়ার সময় কোনো কথা আমি পছন্দ করি না।”

টগর উঠে দাঁড়ালো।তারপর বের হয়ে এলো।বাড়িতে এসে দেখে চন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে ঘরের সামনে। চন্দ্রকে দেখে টগরের মনটা হঠাৎ করেই ভালো হয়ে গেলো। চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বসে আছি আপনার জন্য। ”

টগর ঘরের দরজা খুলতে খুলতে বললো, “কোনো বিশেষ প্রয়োজন? ”

চন্দ্র চোখ নাচিয়ে বললো, “কেনো,বিশেষ প্রয়োজন না হলে কি আপনার সাথে দেখা করা যাবে না?”

টগর হেসে ফেললো চন্দ্রর কথা বলার একসেন্ট শুনে।
তারপর বললো, “না তা না,আপনি তো ব্যস্ত মানুষ। কোনো কাজ ছাড়া যে আমার সাথে আড্ডা দিতে আসবেন না তা আমি জানি।”

চন্দ্র বললো, “হ্যাঁ, কাজেই তো এসেছি। আপনার হাতের পিৎজা খেতে এলাম।আর হ্যাঁ, এই যে আপনার জন্য আমার মা কিছু খাবার পাঠিয়েছে। রাতে গরম করে খেয়ে নিবেন।”

টগর বক্সটা হাতে নিয়ে খুললো।পোলাও আর রোস্টের মিষ্টি একটা সুঘ্রাণ নাকে এসে নাড়া দিতেই টগর লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে বললো, “এক্সট্রিমলি সরি,রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব না বুঝলেন।এতো দারুণ স্মেল আসছে খাবারটা থেকে আমি এখনই খেতে বসে যাচ্ছি। ”

চন্দ্রর দুই চোখ আনন্দে চকচক করে উঠলো। টগরকে বসতে বলে চন্দ্র ছুটে গিয়ে কিচেন থেকে প্লেট চামচ নিয়ে এলো।
প্লেটে বেড়ে নিয়ে ওভেনে দিয়ে গরম করে নিলো।সেই ফাঁকে রান্না ঘর থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে নিজের ব্যাগে পুরে ফেললো।
টগর এক লোকমা মুখে নিয়ে বললো, “ভীষণ ভালো হয়েছে। ভাববেন না বাড়িয়ে বলছি,সত্যি বলছি।”

খাবারের স্বাদে টগর অভিভূত হয়ে গেলো। চন্দ্রর কেমন যেনো মায়া হতে লাগলো টগরের জন্য। এই মানুষটা যতই খারাপ হোক,কেউ চোখের সামনে খাবার কষ্ট পাচ্ছে চন্দ্রর তা সহ্য হবে না।তাই টগরের বাড়ি আসতে গেলে খালি হাতে আসতে ইচ্ছে করে না।চন্দ্রর ইচ্ছে করে অনেকগুলো আইটেম রান্না করে টগরকে খাওয়ায়।টগরের তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া মুখটা দেখে।
নিজের হাতে কি খায় না খায় কে জানে,ভাতটুকু যদি শান্তি মতো খেতে না পারা যায় প্রতিদিন তাহলে কি ভালো লাগে না-কি!
অথচ এই লোকটার সে সুবিধা নেই।
সৃষ্টিকর্তা কেনো মানুষকে এতো তাড়াতাড়ি বাবা মা হারা করে দেয়?মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো চন্দ্র টগরের দিকে।

টগর হেসে বললো, “আপনি কিন্তু আমার অভ্যাস খারাপ করে দিচ্ছেন। এখন আর আমার নিজের রান্না খাবার মুখে রোচে না,আপনার খাবার ছাড়া। প্রতিদিন আপনার আনা খাবার আমি কই পাবো বলেন? ”

চন্দ্র মন্ত্রমুগ্ধের মতো বললো, “আমামে রেখে দিন আপনার কাছে, আপনাকে রান্না করে খাওয়াবো প্রতিদিন আমি। ”

চন্দ্রর কথা শুনে টগর বিষম খেলো।চন্দ্রর ও ঘোর কেটে গেলো টগরের বিষম খাওয়া দেখে।তাড়াতাড়ি টগরকে গ্লাসে করে পানি এগিয়ে দিলো চন্দ্র।টগর পানি খেয়ে স্বস্তির শ্বাস নিলো।

চন্দ্র বুঝতে পারলো না সে কি বলে ফেললো যা শুনে টগর বিষম খেয়েছে!
টগরকে জিজ্ঞেস করতেই টগর হেসে ফেললো। কিছু বললো না।

চন্দ্র কিছুক্ষণ উসখুস করে বললো, “আপনার ওয়াশরুমটা?”

টগর বললো, “আমার রুমেই এটাচড আছে,ওই যে ওটা আমার রুম।”

চন্দ্র চলে এলো টগরের রুমে।বইয়ের ফাঁক থেকে ক্যামেরাটা বের করে দ্রুত নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো।তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে নিজের চোখেমুখে পানি দিয়ে বের হয়ে এলো।
কাজ উদ্ধার করে চন্দ্র বললো, “আমি আসি এবার তাহলে? ”

টগর খাওয়া শেষ করে প্লেট চামচ কিচেনে নিতে নিতে বললো, “আরেকটু বসুন না,পিৎজা খাবেন বলেছিলেন।”

চন্দ্র হেসে বললো, “আরে না,আমি এমনিই বলেছিলাম।”

টগর বললো, “চলুন আপনাকে এগিয়ে দিই,সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ”

চন্দ্র কিছু বললো না। ক্যামেরাগুলো যেভাবে রেখে গিয়েছিলো সেভাবেই আছে দেখে স্বস্তি পেয়েছে চন্দ্র।টগর টের পায় নি ক্যামেরার কথা। অবশ্য চন্দ্র এমনভাবে রেখেছে টগর আর ১ সপ্তাহ থাকলেও টের পেতো না।

কিছুটা পথ যেতেই চন্দ্র বললো, “কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?”

টগর হেসে বললো, “নিশ্চয়। ”

চন্দ্র আমতাআমতা করে বললো, “আপনার সাথে মিশলে বুঝা যায় আপনি খুব ভদ্র একজন মানুষ, শিক্ষিত। তাহলে কেনো মদের নে*শায় আকণ্ঠ ডুবে থাকেন আপনি? আমি যতোদূর জানি নিয়াজ খুব একটা ভালো মানুষ না অথচ তার সাথে আপনি মেলামেশা করেন। কেনো জানতে পারি?হতে পারে অতিরিক্ত অধিকারবোধ দেখাচ্ছি। কিন্তু না জেনে ও শান্তি পাচ্ছি না আমি।”

টগর বিমর্ষ হয়ে বললো, “কি করবো বলুন?এভাবে বেঁচে থাকা যায়?বাবাকে হারিয়েছি খুব অল্প বয়সে। মা’কে নিয়েই আমার পৃথিবী ছিলো। মা’কে হারিয়ে ফেলার পর আমার সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। আমি আসলে অনেক বেশি মা’য়ের ন্যাওটা ছিলাম।মা ছাড়া আমি একেবারে অচল হয়ে যাই।
জানেন,বড় হওয়ার পরেও আমি কখনো নিজে পছন্দ
করে একটা শার্ট পরি নি।মা আমার সব কিছু করে দিতো।আমি ছাড়া মা’য়ের ও কেউ ছিলো না। বাবা হটাৎ করে মারা যাওয়ায় মা ও আমার উপর নির্ভর হয়ে যায়। কি এক অজানা ভয়ে আমাকে চোখের আড়াল করতেন না কে জানে। এমনকি আমি মা মারা যাওয়ার পরেই সর্ব প্রথম গ্রামে আসি আমার জীবনে। তার আগে আমি জানতাম আমাদের গ্রামের বাড়ি আছে। কিন্তু ঢাকার বাড়ি ছেড়ে মা কখনো আসেন নি।নানার বাড়ি,মামার বাড়ি কারো বাড়িতে যাই নি আমি কখনো। সবাই আমাদের বাসায় যেতো ঢাকায়,আমরা কোথাও যেতাম না।
মা ভয় পেতো যদি আমার কিছু হয়ে যায়।

অথচ আমার মা আজ আমাকে ছেড়ে কোথায় শুয়ে আছে কে জানে!
আমি পুরো এলোমেলো হয়ে গেলাম।মা’কে ছাড়া আমি অচল।নিজেকে ভীষণ নিঃস্ব লাগতো। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করতো না। কষ্ট ভুলে থাকার জন্যই আমাকে এলকোহল নিতে হয়।”

চন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “আপনি নিজেও নিশ্চয় বুঝতে পারেন যে এলকোহল কোনো সমাধান না।”

টগর বললো, “বুঝতে তো পারি কিন্তু নিজেকে মানাতে পারি না। একদিন হয়তো পারবো,সেদিন একেবারে ভালো হয়ে যাবো।”

চলবে……
রাজিয়া রহমান

জয়েন করুন আমার ফেসবুক গ্রুপ রাজিয়ার গল্প কুটির এ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here