চাদোঁয়া মহল পর্ব -০১

——“আপনাদের পরিবারের এই এলাকায় বেশ মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থান রয়েছে।আমার মতো একজন মাদক মামলায় গ্রেফতার আসামির মেয়েকে আপনাদের মহলে শোভা পায় না।আমি শীঘ্রই চলে যাবো।তারপর আপনি আপনার পরিবারের ইচ্ছে মতো বিয়ে করে”……….

চন্দ্ররেখার সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার আগেই,শারাফ তার ডান হাতের দুই আঙ্গুল দ্বারা চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরলো।তার লাল আভাযুক্ত চোখ যেন সবকিছু জ্বালিয়ে দিবে।রেখার মনে হলো, সে সামনে থাকা মানুষটির রাগান্বিত নিশ্বাসের ফোঁসফোস শব্দ শুনতে পাচ্ছে।পর মূহুর্তে গর্জে উঠলো শারাফ

——“খবরদার চন্দ্ররেখা!!! আপনার মুখ থেকে যদি আর একটি শব্দ বের করেছেন,তাহলে আজকে আমার সর্বাপেক্ষা অপকৃষ্ট রূপের দেখা পাবেন।শারাফ মির্জার অর্ধাঙ্গিনী আপনি, আপনার সমগ্র জীবৎকালে আমার থেকে মুক্তি মিলবে না।”

শারাফ যেমন হুট করে রেখাকে চেপে ধরেছিলো তেমনি হুট করে ছেড়েও দিলো। বেড সাইড টেবিলে থাকা মিডিয়াম সাইজের সাকুলেন্ট প্লান্টের টবটি আছড়ে ফেলে দিলো। মূহুর্তে টবে থাকা মাটিগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। চন্দ্ররেখা সেদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।তার চোখে ধীরে ধীরে পানি জমতে লাগলো।

————

—- শারাফ ভাই বিয়ে করেছে,জানিস!!!বউ দেখতে একটা পরীর বাচ্চা।”মাসুকের কন্ঠে উৎফুল্লতা ঝরে পড়ছে।তার হাবভাবে মনে হলো সে এই বিয়েতে বেশ খুশি হয়েছে।

——“বলিস কি!!কবে?কখন?কিভাবে?

নওশিন বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলো। পরক্ষণে মুখ ফুলিয়ে দুঃখী দুঃখী কন্ঠে বললো,

—–“আমার ক্রাশ বিয়ে করেছে,অথচ আমিই জানলাম না।কিভাবে,কি করে হলো রে??”

মাসুকের ঠোঁটে মৃদু হাসি।রহস্যময় ভঙ্গিতে চোখের ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠলো,

—–“ভাই,এক সপ্তাহ আগে শহরে যাওয়া কথা বলে বেরিয়েছিলো।গতকাল রাতে ফিরে আসার কথা ছিলো।এসেছে তো এসেছে,সাথে করে নিজের জন্য একটা পরীর বাচ্চাও এনেছে।আমি কি দোষ করলাম বলতে পারিস!!ছোটভাই হিসেবে তো আমিও একটা পাওনা ছিলাম,তাই না??মাসুকের কন্ঠে আফসোসের স্বর বেরিয়ে এলো।

পর মূহুর্তে আগেই সেই উৎফুল্লতার সহিত বললো,

—-“শোন, বিকালে চাঁদোয়া মহলে এসে পরিস।সবাই মিলে ভাইকে চেপে ধরবো নে।সত্যি ঘটনা তো জানতে হবে তাই না!!”

নওশিন কিছুটা বিরক্ত হলো।

——-“বারবার এক কথা কেনো বলছিস?তুই কোনোদিন পরী দেখছিস?দেখিস নি তো তাই না!!!”

——“পরী দেখিনি তো কি হয়েছে?? পরীর বাচ্চা তো দেখেছি!!রেখা ভাবি হলো সেই পরীর বাচ্চা। বিশ্বাস কর,নতুন ভাবিকে দেখলে তুই নিজেও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবি।আমি হলফ করে বলতে পারি আমাদের ঝিল্লিপুরে এমন সুন্দরী কেউ নেই।”

নওশিন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললো,

—-“বড় মায়ের থেকে বেশি সুন্দরী?”

মাসুক খানিক চিন্তা করলো।

——“বড় মায়ের সাথে তার চেহারার অদ্ভুত একটা মিল আছে।ভাবীকে দেখলে মনে হয় যুবতী বয়সের বড় মা দাঁড়িয়ে আছে ।তাদের মিলটা আমি ধরতে পারছি না,তুই আসলেই বুঝতে পারবি।তুই তো আবার মানুষকে এক দেখায় চিনে ফেলতে পারিস।”

নওশিন এবার নিজের প্রশংসায় কিছুটা খুশি হলো।চোখের চশমা ঠিক করে,মৃদু হেঁসে মাসুককে বিদায় জানিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিলো।রিকশায় চড়ে হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো কেবল দুপুর দেড়টা বাজে।কখন বিকাল হবে?আর কখন সে চাঁদোয়া মহলে যাবে!!এই ভেবে নওশিন দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তার যে আর দেরি সইছে না।

———

সুস্থিরতার অপর নাম ঝিল্লিপুর।এই পরগনা মনোহর রূপমাধুরীতে পরিপূর্ণ।সেই সাথে ঝিল্লিপুরের অধিবাসীদের মধ্যে এক ধরনের অদৃশ্য মান্যতা,শৃঙ্খলতা লক্ষ্য করা যায় যা নজরকাঁড়া ব্যাপার। এখানকার সবচেয়ে রহস্যময় ও আকর্ষক জিনিস হলো #চাঁদোয়া_মহল। চাঁদোয়া মহলে মহলের ছিটেফোঁটা বৈশিষ্ট্যও নেই।দেখতে ট্রেডিশনালি মাল্টিপল ফার্ম হাউসের মতো।বিশাল বড় এলাকা জুড়ে এই ফার্ম হাউস সিস্টেম ডুপ্লেক্স বাড়িটি তৈরি হয়েছে।চারদিকে প্রাচীর দ্বারা ঘেরা।প্রাচীর ঘেঁষে বিভিন্ন জাতের গাছ দাঁড়িয়ে আছে।এর মধ্যে নারিকেল গাছের সংখ্যা যেন কিছুটা বেশি!বাড়ির বাহিরে থাকা প্রাচীরের এক কোণায় আবদ্ধ কিং সাইজ আয়ন গেইটের পাশের দেয়ালে এক্রাইলিক রেকট্যাংগুলার নেইম প্লেট।সেখানে অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে “চাঁদোয়া মহল” নামটি সেঁটে রয়েছে।সম্পূর্ণ বাড়ি তৈরিতে মূল ভূমিকা পালন করেছেন বাড়ির প্রণেত্রী সুধা মির্জা।আর তার বড় দুই ভাই হামিদ মির্জা ও হাফিজ মির্জা।

মানুষের মতে,সুধা মির্জা হলেন চাঁদোয়া মহলের মহামূল্যবান চাঁদ। যেই চাঁদ দৃঢ় অনুরাগের সহিত তার স্নিগ্ধ রশ্মি পুরো ঝিল্লিপুর গ্রামে অর্পণ করে চলছে। ছেচল্লিশ বছর বয়সী সুধা মির্জা কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক মানবী।যাকে দেখলে মনে তার আগাগোড়া রহস্যে আবৃত। তার ব্যক্তিত্বই যেনো তার বিশেষত্ব। গ্রাম মানুষ যদি দুঃখের চিঠি হয়,সেক্ষেত্রে সুধা মির্জা হলেন সেই চিঠির ডাকবাক্স।সম্প্রতি তিনি গ্রামীণ মহিলা কল্যাণ পরিষদের সভাপতি পদে নিযুক্ত হয়েছেন। গ্রামের নিঃসঙ্গ মহিলাদের একমাত্র সঙ্গী হলেন সুধা মির্জা।

গ্রামের মানুষ আরো বলে,সুধা মির্জা যদি চাঁদোয়া মহলের চাঁদ হন, তাহলে সেই চাঁদের প্রজ্জ্বলিত নক্ষত্র হলো সুধা মির্জার বড় ভাই হামিদ মির্জার একমাত্র পুত্র শারাফ মির্জা। যার আপাদমস্তক জুড়ে গাম্ভীর্যতা আর শৌর্যের সমাহার। চেহারা জুড়ে শোভাপায় এক অনবদ্য বৈরাগ্য। ত্রিশ বছর বয়সী এই সুঠামদেহী সুদর্শন পুরুষ ঝিল্লিপুরের অধিকাংশ নারীর স্বপ্নপুরুষ।

চাঁদোয়া মহল সহ পুরো গ্রামের বর্তমান হট টপিক হলো শারাফ মির্জা।যে বিনা নোটিশে বিয়ে করেছে এবং বউ নিয়ে চাঁদোয়া মহলে হাজির হয়েছে। আর কিছু সময় পূর্বে তার একদিনে বিবাহিত স্ত্রীর সাথে রাগ দেখিয়ে পুরো ঘরে ভাংচুর করেছে।

——–

কাউচে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে শারাফ।হয়ত কিছু ভাবসে!! হাতের তালুতে কাঁচ বিঁধে আছে। টুপটুপ করে মেঝেতে রক্ত ঝরছে।দেখে বুঝা যাচ্ছে ক্ষত বেশ গভীর।চেহারায় কিছুক্ষণের পূর্বের সেই কঠোরতা নেই। চোখ মেলে তাকালো।নজর আটকে গেলো সম্মুখে বসে থাকা অপ্সরার অবিন্যস্ত কৃষ্ণাভ বর্ণের কেশে।

বিছানার একপাশে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে চন্দ্ররেখা।নিঃশব্দে কাঁদছে সে।কি থেকে কি হলো! তার মাথায় কিছুই খেলছে না!সে তো আর ভুল কিছু বলে নি? এখানে আসার পর থেকে তার নিজেকে চাঁদোয়া মহলের কলঙ্ক মনে হচ্ছে।কোথায় সে, আর কোথায় শারাফ!!!পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকায় সে আজ এই চাঁদোয়া মহলের অঘোষিত সদস্য হয়ে গেছে। চুলে উষ্ণ এক ছোয়া পেতে তড়াক করে মাথা তুললো রেখা।শারাফকে এতো নিকটে বসে থাকতে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলো। শারাফের দৃষ্টি রেখার ঠোঁটের দিকে। শারাফ প্রগাঢ় দৃষ্টিতে রেখা কেমন যেনো কেঁপে উঠলো।

#চাদোঁয়া_মহল
সূচনা পর্ব
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here