#চাদোঁয়া_মহল
পর্বঃ০২
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
চন্দ্ররেখার মোলায়েম হাত জোড়া শারাফের বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় আঁটকে আছে।রেখা মধ্যে সেই হাত ছুটানোর বিন্দুমাত্র তাড়া নেই।সে উদাসীন চোখে সামনে থাকা মানবটির দিকে তাকিয়ে আছে।চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন।
—–“আপনি আমাকে এভাবে কতদিনই বা আঁটকে রাখতে পারবেন?”
শারাফের সোজাসাপ্টা উত্তর,
—-“আজীবন”।
চন্দ্ররেখার মেজাজ টচে গেলো।বিতৃষ্ণায় মুখ তেঁতো হয়ে উঠলো। সে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
—–“একটা মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে বিয়ে করেছেন আপনি।এখন আবার তার ওপরে অহেতুক জোর খাটাচ্ছেন।লজ্জা বলতে কিছু নেই নাকি আপনার??”
শারাফের মুখে বাঁকা হাসি দেখা দিলো।মুখে সেই হাসি ঝুলিয়ে বললো,
——ছেলেদের লজ্জা থাকতে নেই, আপনি তা জানেন না বুঝি??লজ্জা থাকলে বাবা হবো কি করে!
—–“আর মাত্র তো বিয়ে করলাম, বউকে বশে আনতে হলেও তো লজ্জা শরম বিসর্জন দিতে হবে।তাকে আদর সোহাগ দিয়ে,পরিপূর্ণ করে তোলার একান্ত দায়িত্ব যে কেবল আমার।”
চন্দ্ররেখার মুখচ্ছবিতে লালচে আভার সঞ্চার হলো। তার ওষ্ঠদ্বয়ের নিবিড় কম্পন শারাফের নজরে ধরা দিলো।রেখার মনে হলো তার কান থেকে গরম বাষ্প নির্গত হচ্ছে।
—-“ছি!দোহায় লাগে চুপ করুন”।কিসব বলছেন!!”
চন্দ্ররেখার লাজুক মুখশ্রী শারাফের হৃদয়ে ঝড় তুলে দিলো।নিষিদ্ধ কিছু ইচ্ছে মাথায় চড়ে বসলো।তার হাতের মুঠোয় থাকা রেখার হাত ধরে হেঁচকা টান দিলো।তাল সামলাতে না পেরে রেখা শারাফের বক্ষে আঁছড়ে পড়লো।রেখা জানে সে শারাফের সাথে ধস্তাধস্তিতে জয়ী হতে পারবে না।তাই নিস্তেজ হয়ে শারাফের বুকপটে মিশে রইলো। সেখানে মাথা রাখাতেই তার সমস্ত কায়া চঞ্চলচিত্তে মেতে উঠলো।শারাফের সুঠাম পুরুষালি বক্ষে বিড়ালছানার ন্যায় পড়ে রইলো।শারাফ রেখার চুলের ভাঁজে ভাঁজে আঙ্গুল ডুবিয়ে দিলো,মাথার ওপরে চুমু খেলো।রেখা মনে মনে প্রমোদ গুণলো,
——“ভালোবাসা অমূলক,একে বরণ করা মানে মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় সম্ভাষণ করা।”
———-
শারাফের মা মোহিনী মির্জা ছেলের অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ের খবরে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও,বিষয়টা তিনি নরমাল ভাবেই গ্রহণ করেছেন। দু’বছর যাবৎ ছেলেকে বিয়ে করানোর জন্য পিড়াপিড়ি করেছিলেন।ছেলের বিয়ে নিয়ে নিস্পৃহতা দেখে ধরেই নিয়েছিলেন,ছেলেকে হয়ত এ জন্মে বিয়ের জন্য রাজি করাতে পারবেন না।কিন্তু গতকাল রাতে ছেলের পাশে অনিন্দ্যসুন্দরী রমনীকে দেখে তিনি হতবাক হয়ে পড়েছিলেন ।প্রথমে খানিকটা দুঃখ অনুভব করলেও চন্দ্ররেখার নির্মল,স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে যান।বলা যায়,ছেলের রুচিতে বেশ মুগ্ধ হয়েছেন তিনি।কিন্তু তার চিন্তা নিজের স্বামী আর শাশুড়ীকে নিয়ে। কাল থেকে শারাফের দাদি দোয়া মির্জা ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছেন।এতে অবশ্য কারো তেমন মাথাব্যথা নেই।
সবাই ভেবেছিলো সুধা মির্জা হয়ত এ নিয়ে বেশ চোটপাট করবেন। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে তিনি চন্দ্ররেখাকে বুকে আগলে নেন।শারাফের পাশে রেখাকে দেখে,তার চেহারায় এক ভিন্ন ধরনের উদবেগ ফুটে উঠেছিলো।হয়ত কিছুটা আতংক!!! কিছু সময়ের জন্য সকলের মনে হয়েছিলো যেন নতুন এক সুধাকে তারা আবিষ্কার করেছেন।
শারাফের বাবা ব্যবসায়ের কাজে আজ এক মাস যাবৎ দেশের বাহিরে অবস্থান করছেন।ছেলে বিয়ে করেছে সেই খবর এখনো তার কানে যায় নি।আসতে আরো সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে তার।মোহিনী মির্জা কিছু সময় ভাবলেন,
সুধা মির্জা যেহেতু বিয়েটা মেনে নিয়েছেন তাহলে শারাফের বাবাকে সামলাতে তেমন বেগ পোহাতে হবে না।
আজ সকাল থেকে চাঁদোয়া মহলের কোনায় কোনায় চন্দ্ররেখার চর্চা হচ্ছে। সকলেই চন্দ্ররেখার রূপে বেশ আবির্ভূত হয়েছে। সকলের মুখের এক বুলি সে যেনো সুধা মির্জার যৌবন বয়সের কার্বন কপি।
রকিং চেয়ারে বসে আছেন সুধা মির্জা।একটু পর পর দুলছেন। গভীর ভাবনাতে তিনি নিমজ্জিত।জানালা দিয়ে দিনের আলো ঘরে ডুকছে।সেই রশ্মিতে তার কারুকাজখচিত রাজকীয় বিছানা যেনো ঝলমলিয়ে উঠছে। চন্দ্ররেখাকে দেখার পর থেকে তিনি এক প্রকার চিন্তায় ডুবে আছেন। তার হিসাব কোনোভাবেই মিলছে না,কি করে সম্ভব?এই মেয়ের সাথে তার চেহারার এতো মিল কি করে?আজকে তার সন্তান পাশে থাকলে হয়তো ঠিক এর মতোই হতো!! সন্তানের কথা মনে হতেই চেহারায় তাচ্ছিল্য ভর করলো।যেদিন থেকে এই চাঁদোয়া মহলের সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন,সেদিন থেকে বিয়ে,সংসার,সন্তান এসব সুধা মির্জা জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।তাই তো ছেচল্লিশ বছরে এসে,তিনি এখনোও অবিবাহিত। পার্থিব কোনো কিছুতে কেন জানি আজকাল তার আগ্রহ কাজ করে না।সব কিছুই আজকাল বোঝা মনে হয়!!ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি।
চাঁদোয়া মহলে প্রবেশ করে নওশিন বুঝতে পারলো,পরিবেশ কিছুটা মিইয়ে গেছে। আজকের আবহওয়া বেশ থমথমে।নওশিনকে দেখলে স্বাভাবিক মনে হলেও,তার ভেতরটা বেশ অস্থির হয়ে আছে। মনটা বেশ খচখচ করছে। বড় মায়ের সাথে ফোনে কথা বলার পর থেকে উৎকন্ঠা যেনো বেড়ে গেছে।
চশমা ঠিক করলো সে।ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকালো।না,কাউকেই তো দেখছে না!!নওশিন এসেছে ইতিমধ্যে দশ মিনিট পার হয়ে গেছে।এখন সে লিভিং রুমে বসে আছে।কাজের মেয়েটা সেই যে মাসুকে ডাকতে গেলো,তার আর কোনো হদিসই পাওয়া গেলো না।ভুলবশত তার ফোনটাও সে বাড়িতে রেখে এসেছে। মাসুকের ওপরে এখন তার বেশ রাগ লাগছে,তাকে আসতে বলে নিজেই হাওয়া।তার ফুফুই বা কোথায়?
সম্পর্কে মাসুক তার ফুপাতো ভাই। শারাফের ছোট চাচা হাফিজ মির্জার সাথে তার ফুপু তৃণা খন্দকারের বিয়ে হয়েছে। সে আর মাসুক দুইজনই প্রায় সমবয়সী,তাদের মধ্যে তুই-তুকারির সম্পর্ক।ছোট থেকে তারা এক সাথে বড় হয়েছে।সেই সুবাদে চাঁদোয়া মহলে তার অবিরাম আসা যাওয়া চলতেই থাকে। নওশিন ও মাসুকের পড়াশোনাও একসাথে,সামনেই তাদের অনার্স চতুর্থ বছরের ফাইনাল পরীক্ষা।নওশিনের চাঁদোয়া মহলে ঘনঘন আসার যাওয়ার আরেকটা কারণ হলো সুধা মির্জা।বোঝার পর থেকে মায়ের পরে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তার বড় মাকে।সুধা মির্জার এককথায় সে নিজের জীবন দিতেও রাজি।
নওশিনের ভাবনার মাঝে পাশের সোফায় কেউ ধপ করে বসলো।নওশিনের দিকে তাকিয়ে আরিফ দাঁত কেলিয়ে হেঁসে যাচ্ছে। লোকটাকে নওশিনের একদম সহ্য হয় না।
—-“কি ব্যাপার ফুলটুসি?? নতুন ভাবীকে দেখতে এসেছো নাকি?নতুন ভাবি দেখতে একদম পরীর মতো সুন্দর।”
বিরক্তিতে নওশিনে কপাল কুঁচকে এলো।সবার মুছে খালি এক কথা পরী,পরী আর পরী!!!নওশিন কিছু বললো না। সোফা থেকে উঠে থপথপ পায়ে সিঁড়ি দিকে এগিয়ে গেলো।হলরুম পাড় হয়ে সোজা জিমি-সিমির রুমে প্রবেশ করলো। আরিফ সেদিকে মলিন মুখে তাকিয়ে রইল।বিরবির করে কিছু আওড়ালো।
প্রেমের মরা জলে ডোবে না…
তুমি সুজন দেইখা
তুমি সুজন দেইখা কইরো পিরিত
মরলে যেনো ভূলে না দরদী…
প্রেমের মরা জলে ডোবে না…
————
জিমি তখন ফোনে তার হবু বরের সাথে কথা বলছিলো,সিমি থিসিস পেপারে তার রিসার্চের ফলাফল লিখছিলো।বিনা অনুমতিতে নওশিন তাদের ঘরে ঢুকায় দুজনেই বেশ অসন্তোষ প্রকাশ করলো।বিশেষ কারণে তারা নওশিনকে তেমন পছন্দ করে না।বাজখাঁই গলায় সিমি বলে উঠলো,
—–“কারো রুমে অনুমতি ব্যতিত প্রবেশ করা যে ব্যাড ম্যানার, সেটা জানো না তুমি??”
সিমির চিৎকারে নওশিন বেশ অপমানবোধ করলো। তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কাঁপা কাঁপা গলায় সরি বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
বিধ্বস্ত মন নিয়ে পুনরায় লিভিং রুমে গিয়ে বসে পড়লো।আরিফ নামের লোকটিকে সেখানে দেখতে না পেয়ে বেশ স্বস্তি বোধ করলো।মিনিট খানেক পর সিঁড়িতে কয়েক জোড়া পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো।আওয়াজের উৎসের দিকে তাকাতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।নওশিনের মনে হলো তার হাত,পা অসার হয়ে আসছে।বুক প্রচন্ড চাপ অনুুুভব করলো সে।
জিমি,সিমি ও মাসুকের সাথে থাকা অবয়বের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নওশিন।
চলবে
আপনাদের রেসপন্স দেখে আমি নির্বাক🙂