চাদোঁয়া মহল পর্ব -১৭

#চাঁদোয়া_মহল
পর্বঃ১৭
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

(১৮+ সতর্কতা)

-‘তোমার কানাডা যাওয়া কি কনফার্ম?’
-‘হুম…….এইতো এক মাস পরেই ফ্লাইট।’
-‘জিমি আপুর বিয়ে পর্যন্তও কি অপেক্ষা করবে না?’

সিমি মাসুকের দিকে শান্ত চোখে তাকাল।গলার স্বরে কাঠিন্য বজায় রেখে বললো,

-‘জিমিকে আপু আর আমাকে নাম ধরে ডাকার মানে কি…মাসুক!’

-‘তুমি জানো না?’

মাসুক সোজাসাপটা প্রশ্ন করলো।সিমির চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।

-‘জানিও না জানতে চাইও না।তুমি আমার রুম থেকে বের হও।’

মাসুক কয়েক সেকেন্ড শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল।তার ভেতরটা ভেঙে আসছে।এই মেয়ে তার মনের অবস্থা জেনেও কি করে এমনভাবে কথা বলতে পারে?আগাগোড়া আস্ত একটা পাষাণ নারী!মাসুকের কপালের রগ ফুলে উঠেছে।ধপধপ করে সিমির একদম নিকটে যেয়ে দাঁড়ালো।লম্বা দেহখানা আধা ঝুঁকিয়ে সিমির মুখের কাছাকাছি নিজের রক্ত বর্ণ বদনখানা এগিয়ে নিয়ে গেল।সিমি হকচকিয়ে গেল।খাটের সাথে সেঁটে রইল।মাসুক খাটের দুপাশে হাত রেখে,সিমিকে এক প্রকার নিজের বন্দি বানিয়ে নিলো।দাঁত কিড়মিড় দিয়ে, চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

-‘তোর দু’বছরের ছোট হওয়ায় এতো অবহেলা করিস তাই না!সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকিস।বয়সে পার্থক্যই কি সব তোর কাছে?আমার এই বেশি বেশি ভালোবাসাটা কি তোর নজরে পড়ে না?আমি জানি তুই কেবল আমার জন্যই এদেশ ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিস।’

মাসুক চুপ হয়ে গেল।ভেতরে ভেতরে রাগ কমানোর অব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।সিমি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল।মাসুক এমন তুই তোয়াক্কারি শুরু করে দিবে সে ভাবতেও পারে নি।

-‘সে ছোট থেকে তোমাকে আমি ভালোবেসে আসছি।তোমার এই অবহেলা আমি নিতে পারছি না!মেরে ফেল না আমাকে?না হয় আমাকে বিয়ে করে নেও।কথা দিচ্ছি তোমার কানাডা যাওয়া সব ব্যবস্থা আমি নিজ থেকে করবো।আটকাবো না তোমাকে।সবাইকে রাজি করানোর দায়িত্বও আমার।প্লিজ রাজি হয়ে যাও!’

মাসুকের কন্ঠ নমনীয় হয়ে এসেছে।সিমির বুকটা হুহু করে উঠলো।ছোট থেকে তারা একসাথে বড় হয়ে এসেছে।যখন সে কলেজে পড়তো প্রায় সময় মাসুককে তার দিকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখতো।ইনফ্রাচুয়েশন ভেবে গুরুত্ব দেয় নি কোনোদিন।এছাড়া ঝিল্লিপুরে তাদের আলাদা একটা সম্মান আছে।নিজের থেকে দুই বছরের ছোট একজন ছেলেকে বিয়ে করার বিষয়টি কেউ স্বাভাবিকভাবে দেখবে না।তাই সবসময় এড়িয়ে গেছে।এতোদিন তো মাসুক দূর থেকে ভালোবেসে আসছিলো, তাই কিছু বলার প্রয়োজন মনে করে নি।এখন কি করবে?দূরন্ত, হাসিখুশি,এই দুষ্টু ছেলেটার ভিতরে যে একটা বেপরোয়া প্রেমিকের অস্তিত্ব আছে, সিমি কোনোদিন টেরই পায় নি।সিমির নিশ্চুপতায় মাসুক ভীষণ আহত হলো।কিছু না বলেই তড়িঘড়ি করে সিমির রুম থেকে বের হয়ে গেল।

——-

মায়েদের হচ্ছে যতো জ্বালা।মোহিনী মির্জার কান্না পেয়ে গেল।ছেলেটা না জানিয়ে বিয়ে করে বসে আছে।তাও এমন একজনের মেয়েকে বিয়ে করেছে,যার নাম নেওয়া চাঁদোয়া মহলের সবার জন্য বহু আগেই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।মোহিনী মির্জা স্বামীর কথা এক প্রকার ভুলেই গিয়েছিলেন।এক সপ্তাহ পর হামিদ মির্জার আসার কথা থাকলেও,ব্যবসায়িক কাজের জন্য তিনি আঁটকে গিয়েছিলেন।ফোন করে জানিয়েছেন যে তিনি আগামী কাল আসছেন।স্বামীকে কি করে সামলাবেন এই সেই চিন্তা বিভোর তিনি।এর মধ্যে একটু আগে মাসুক আর সিমির মধ্যকার সবকথা তিনি শুনে ফেলছেন।মোহিনী মির্জা একশত পারসেন্ট সিউর মাসুক যে করেই হোক সিমিকে বিয়ে করেই ছাড়বে।এতে অবশ্য তিনি খুশিই।এক মেয়ে চলে গেলে অন্তত, আরেক মেয়ে তো তার চোখের সামনেই থাকবে!সব চিন্তা তার স্বামীকে নিয়ে।শারাফটাও হয়েছে বাপের মতো একগুঁয়ে।

—–

এ কয়েকদিনে নওশিন ও আরিফের সম্পর্ক আগের চেয়ে বেশ গভীর হয়েছে।নওশিন মাঝে মাঝে অবাক হয় এই লোকটিকে সে কয়েকদিন আগেও সহ্য করতে পারতো না!অথচ এখন এক বেলা না দেখলেই কেমন অস্থির লাগে। আজকে সকাল সকাল আরিফ শারাফ ও চন্দ্ররেখার সাথে কোর্টে গিয়েছে,নওশিন ঘুমে থাকায় তাকে ডাকে নি।ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে নওশিনের মন ভার হয়ে আছে।এসব কার জন্য!একমাত্র আরিফের জন্য।নওশিন জানে না সে আরিফকে ভালোবাসে কি না।কিন্তু সে এতোটুকু জানে আরিফের সঙ্গ তার ভীষণ ভালো লাগে!তার সবকথা সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে।চন্দ্ররেখার তার কারণে আহত হয়েছে এটা ভেবেই মনে মনে সে বেশ অনুতপ্ত হয়েছিল।এতোবড় কান্ড করে এখন ক্ষমা চাইবে কি করে?এ নিয়ে সে কি না অস্থির হয়েছিলো!অথচ আরিফ যখন তার হাত ধরলো সবকিছু তার কাছে সহজ হয়ে গেল।চন্দ্ররেখার কাছে সে তার অপরাধের জন্য মন থেকেই ক্ষমা চেয়েছে।সে ভীষণ অনুতপ্ত হয়েছে।নওশিন আজ অবদি যতোবার চন্দ্ররেখার মুখের দিকে তাকিয়েছে ঠিক ততোবারই বিমুগ্ধ হয়েছে।মেয়েটির কি মায়ামোহ বদন,টলটলে চোখ দুটি যেন সুধা মির্জার নয়ন জোড়ার অনুরূপ।মেয়েটা তার চেয়ে কতো ছোট,কি করে তাকে আঘাত করলো সে!মেয়েটির মা পাশে থেকেও তো পাশে ছিলো না।নওশিন একটা হিসাব মেলাতে পারছে না।সুধা মির্জা তো বিয়ে করে নি।তাহলে চন্দ্ররেখার তার মেয়ে হয় কি করে!সুধা মির্জার ভালোবাসার মানুষ তো তাজওয়ার চৌধুরী।তাজওয়ার চৌধুরী যেহেতু বিবাহিত তাহলে তার স্ত্রী কোথায়?সুধা মির্জা যে তার স্ত্রী না এটা নওশিন খুব ভালো করেই জানে।তাহলে উনি চন্দ্ররেখার মা হয় কি করে!!উফফ……. এতো কিছু ভাবতে ভাবতে মাথাটা ধরে যাচ্ছে।নওশিন তার চশমাটি খুলে বিছানার পাশে থাকা ছোট টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।বড় মায়ের সাথে কথাটা বলাটা বেশ জরুরি।

——-

চন্দ্ররেখার ক্ষত পুরোপুরি ঠিক হয়ে গেছে।ঠিক হবেই না কেন!এ কয়দিন শারাফ আর মোহিনী মির্জা মিলে সামান্য এই ক্ষতের যেই যত্ন করেছে,তাদের এই যত্ন বৃথা যায় কি করে!এতোদিন চন্দ্ররেখার শ্বাশুড়ি নিজ হাতে অতি সাবধানে তাকে গোসল করিয়ে দিয়েছে।সেই সাথে শারাফের সীমাহীন পাগলামি তো আছেই!চন্দ্ররেখা ইদানীং তার প্রতি বেশ আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে।হয়ত শারাফের প্রেমে পড়েছে!সব ঠিক থাকলেও রেখার কপালে বেশ গাঢ় একটা স্পট পড়ে গেছে।এই দাগ সহজে মিটবে বলে মনে হয় না!চন্দ্ররেখা চাপা শ্বাস ছাড়লো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কপালের স্পট পর্যবেক্ষণ করছিলো সে।প্রতিবিম্বে শারাফকে তার পিছনে এসে দাঁড়াতে দেখে সেও ঘুরে দাঁড়ালো। দু’জন মুখোমুখি।শারাফ খানিকটা কাছে এসে চন্দ্ররেখার সেই স্পটে গাঢ় চুমু খেল।কপাল থেকে ঠোঁট না সরিয়ে ফিসফিস করে বললো,

-‘এই দাগ আপনাকে কতোটা মনোরম করে তুলেছে আপনি কি তা জানেন?’
চন্দ্ররেখা মাথা নাড়ালো অর্থাৎ সে জানে না।শারাফ মোহনীয় গলায় বলে উঠলো,

-‘আস্ত একটা চাঁদ আপনি।চাঁদের গায়ে দাগ থাকবে না তা কি হয়!আজ থেকে আপনাকে আমি চন্দ্রপ্সরা বলে ডাকবো।এই দাগ যে আপনার বদনের নির্মলতা অগণিত পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।’

চন্দ্ররেখার চোখের কার্নিশ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে অথচ ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির হাসি।শারাফের মুখনিঃসৃত প্রতি বাক্য তার বুকে ঝড় তুলে দিয়েছে।কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।শারাফের প্রতি আজ সে ভীষণ কৃতার্থ।এই মানুষটি তার জীবনে আসার পর থেকে দুঃখ কি জিনিস সে ভুলে গেছে।সেদিন যদি শারাফের সাথে তার বিয়ে না হতো,সে কি কখনো তার বাবাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারতো!এই দুই সপ্তাহে চাঁদোয়া মহলের প্রতি মানুষের কাছ থেকে সে যে ভালোবাসা,স্নেহ আদোও কি কখনো পাওয়া হতো!সে তার দাদীকেও ভুল বুঝেছে।আজকেই তার দাদী সাথে সে যোগাযোগ করবে।দাদী সেদিন জোর না করলে তো তার শারাফকে পাওয়াই হতো না।একা একা লড়াই করে কি সে এতোদূর আসতে পারতো!সারোয়ার আজ তার সমস্ত অন্যায় স্বীকার করেছে।জানোয়ারটির জন্য কোর্ট থেকে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।শারাফের কারণেই আজ সবকিছু সম্ভব হয়েছে।বাবার সম্মান সে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে।এবার শুধু তার মাকে খুঁজে বের করতে পারলেই হলো।চন্দ্ররেখা জানে শারাফ তার মাকে তার কাছে এনে দিবে।চন্দ্ররেখা আচমকা শারাফের ডান হাতের উপরে চুমু খেল।শারাফের নিশ্বাস আঁটকে এলো।বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল চন্দ্ররেখার দিকে।এই মেয়ে কি তাকে উম্মাদ করতে চাইছে!তাকে ক্ষণিকের জন্য বেসামাল করে কি মজা পাচ্ছে সে?চন্দ্ররেখা নিজের কাজে বেশ লজ্জা পেল।শারাফ সরে দাঁড়াতে চাইলো,তার আগেই চন্দ্ররেখা তাকে জাপটে ধরলো।শারাফ বহুকষ্টে ভাঙা গলায় বলল,

-“কেন এমন করছেন আপনি?”
-“আপনাকে চাই।”

চন্দ্র রেখার সোজাসাপ্টা উত্তর।শারাফ ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিলো।শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতার বশে কি চন্দ্ররেখা এমন করছে তার সাথে?সে তার চন্দ্রপ্সরাকে বাজিয়ে দেখতে চাইলো।

-‘আমি আপনার জন্য যা করেছি সম্পূর্ণ আমার দায়িত্ব থেকে করেছি।আপনার প্রতি আমার হৃদয়ে গভীর এক অনুরাগ আছে।দৈহিক সম্পর্ক অপেক্ষা আমার কাছে আত্মিক সম্পর্কের মর্যাদা অত্যধিক।আপনি এখন এক অদৃশ্য ঘোরে আছেন চন্দ্রপ্সরা!ঘোর কেটে আপনার কাছে সব তুচ্ছ মনে হবে।প্লিজ এমন…..’

শারাফ তার সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগে চন্দ্ররেখা তার হাত দিয়ে শারাফের মুখ চেপে ধরলো।তারপর ধীর স্বরে স্বরে বললো,

-‘হুশশ….আনমনে,বিনা নোটিশে আপনি যে আমার মন কোণে স্থান গেড়ে বসে আছেন সেই খবর কি আছে আপনার?কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আপনার জন্য কিছুই করছি না আমি।আমি সদ্য প্রেম রোগে আক্রান্ত এক রোগী।এই রোগ সারাতে চাই না আমি।একদমই চাই না।এই প্রেমরোগ চিরকাল বহন করে বেড়াতে চাই।এরজন্য আমার আপনাকে প্রয়োজন।আপনি যে আমার জন্য অমূলক জরুরি!’

শারাফের বুক শীতলতায় ভরে গেল।মনের মাঝে এতোদিন যাবৎ চলতে থাকা দহন আচমকাই নিভে গেল।সে আর কিছু শোনার প্রয়োজন মনে করলো না।নিবিড় ভাবে আলিঙ্গন করলো তার চন্দ্রপ্সরাকে।প্রগাঢ়তার সহিত তার কন্ঠদেশে শৃঙ্গার করলো!চন্দ্ররেখা সুঠাম দেহী মানুষটির সংসর্গ নিশ্চুপে সম্ভোগ করে গেল।ভয়,দ্বিধা,প্রবল চিত্তচাঞ্চল্যতা সব মিলেমিশে একাকার করে তুললো চন্দ্রেরেখাকে।দেহপিঞ্জরের ঝংকারে নিজের মাঝেই নিরূদ্দিষ্ট হয়ে পড়লো।অসামাল শারাফের ঘনিষ্ঠতায় চন্দ্ররেখা নিজেকে তার বক্ষ মাঝে সন্নিহিত করল।দুর্গম রজনীর শেষ প্রহরে উভয়ের ঘনিষ্ঠতা,ব্যাকুলতা,উৎকন্ঠতা প্রখর হয়ে উঠলো।শারাফ তার চন্দ্রপ্সরার দেহ ও মনোগত সান্দ্রতার মাঝে হারিয়ে গেল।

——

-‘কাজ হয়ে গেছে বড়মা।’
-‘জায়গা মতো পৌঁছে দিয়েছো তো?’
-‘জি,বড়মা।’
-‘তাহলে অপেক্ষা কিসের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করো।আর শোনো,শারাফের কাছে যাতে কোনোভাবে এই খবর না পৌছায়!’
-‘জি,ঠিক আছে।’
ফোন কেটে এক দৃষ্টিতে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন সুধা মির্জা।আযানের সময় হয়ে গেছে।নিকষ কালো আঁধার খুব শীঘ্রই কাটতে চলেছে।আচমকাই সুধা মির্জা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।হাসির দমকে রক্তবর্ণ চোখ থেকে নিমক জল ঝরছে।শরীর হিম করে দেওয়া এক দৃশ্য।

চলবে
পরের পর্ব দিতে কয়েকদিন দেরি হতে পারে।আপনারা অপেক্ষা করবেন না।ভুল ত্রুটি গুলো অবশ্যই ধরিয়ে দিবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here