#চাঁদোয়া_মহল
পর্বঃ১৮
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
-‘দেড় মাস চাঁদোয়া মহলে ছিলাম না,এরই মধ্যে নিজেকে রানী ভেবে নিয়েছো?নিজের হুকুমে সবাইকে নাচিয়ে মজা পেয়েছ নিশ্চয়ই!ভাইয়ের ছেলেকে নিজের পছন্দে বিয়ে করিয়েছ ভালো কথা।আমার অবর্তমানে শারাফকে বিয়ে করানোর স্পর্ধা পেলে কোথা থেকে!মেয়ে দু’টোকেও বিয়ে করিয়ে দিতে,রেখে দিলে কার জন্য?আমার জন্য!’
হামিদ মির্জার রাগান্বিত কন্ঠে হলরুমে উপস্থিত সকলে কেঁপে উঠলো।মোহিনী মির্জার ভেতরটা ভেঙে আসতে চাইছে।চোখ থেকে টপটপ পানি পড়ছে।শারাফের ব্যাপারে হামিদ মির্জা চিরকালই সতর্ক।ছেলের জন্য বিজনেস পার্টনারের মেয়েকে ঠিক করে রেখেছিলেন।এখানে তার দোষটা কোথায়?একবার জিজ্ঞেস ও করতে পারতেন!শারাফ যে বিয়ে করবে সেটা কি তিনি আগে জানতেন নাকি?ছেলে মেয়ে কোনো ভুল করলে সবসময় তা মায়ের ঘাড়েই কেন পড়বে?মেয়েদের জীবনটাই হাজারো রঙের কথার সমাহারে ভরপুর!স্বামী কথা না শুনলে স্বামীর কাছে খারাপ,সন্তানের কথা না শুনলে সন্তানের কাছে খারাপ।স্বামীর আচরণে মোহিনী মির্জা বেশ কষ্ট পেলেন।দোয়া মির্জা ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন।এখানে থাকলে ছেলেকে রাম ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিতেন!নিজের পাশে শাশুড়ীকে না পেয়ে মোহিনী মির্জার মন আরো খারাপ হয়ে গেল।কিছু না বলে রান্না ঘরে চলে গেলেন।স্ত্রীর অভিমান বুঝতে পেরে হামিদ মির্জাও চুপ হয়ে গেলেন।বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতেই রানা কাছ থেকে শারাফের বিয়ের খবর পেয়েছেন।সেই থেকে তার মেজাজ বেশ চটে আছে।ছেলে বিয়ে করেছে ভালো খবর,তাই বলে বাবাকে একবারও খবর দিবে না!বিয়ে করার পর ও তো জানাতে পারতো।ছেলে,মেয়ে,মা,বোন,স্ত্রী সকলে মিলে তাকে বয়কট করে দিয়েছে এমন ভাব!হামিদ মির্জার ধারণা এসবের সাথে তার বোন কোনো না কোনোভাবে জড়িত।এছাড়া ছেলেও তার কম ঘাড়ত্যাড়া না!কানাডা থেকে আসার পর এই দু’বছরে ব্যবসায় যেই খেল দেখিয়েছে।
——–
আচ্ছাদন ভেদ মিহির কিরণ বিছানার কোণে আছড়ে পড়ছে।সেখানে হাত পড়তেই হালকা তাপ অনুভূত হলো।চন্দ্ররেখা ঘুম থেকে উঠেছে ইতিমধ্যে এক ঘন্টা হয়ে গেছে।লজ্জা,উত্তেজনা তাকে ঘিরে ধরেছে।কাঠ কাঠ হয়ে বিছানার সাথে লেপটে আছে।শারাফ মাথা তার কাঁধে।সে গভীর ঘুমে বিভোর।তার উষ্ণ নিশ্বাস রেখার কপোলে ধাক্কা খাচ্ছে।কাল রাতের কথা মনে হতেই লাজে চন্দ্ররেখার গাল ও কান উভয় গরম হয়ে গেল।শারাফ যে কি পরিমাণ নির্লজ্জ ও ঠোঁটকাটা চন্দ্ররেখার কাল রাতেই সেটা টের পেয়েছে।হঠাৎ নিচ থেকে চিৎকারের শব্দ ভেসে আসলো।সে শব্দে শরাফের ঘুম ভেঙে গেল।ঘুমন্ত চন্দ্ররেখার কপালে চুমু খেয়ে,ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো।বেশ সময় নিয়ে ফ্রেশ হলো।রুমে থাকা অন্য ওয়াশরুমে পানি শব্দ পেল।তার ধারণাই ঠিক। সে-সময় চন্দ্ররেখা ঘুমের ভান ধরছিলো।চন্দ্রপ্সরাকে লজ্জা দিতে তখন কেন যেন তার মন সায় দিলো না!শারাফ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নিজেকে পরিপাটি করে নিলো।কাঙ্ক্ষিত ঝড় সামলাতে নিজেকে মানসিকভাবেও তৈরি করে নিলো।চন্দ্ররেখা এখনো ওয়াশরুমে।শারাফ চাপা শ্বাস ছাড়লো।যতোক্ষণ সে রুম থেকে বের হবে না, চন্দ্ররেখাও কি ততোক্ষণ ওয়াশরুমেই থেকে যাবে?শারাফ একাই নিচে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।সে চায় না চন্দ্ররেখা কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হোক।
——
-‘বিয়ে করেছ?’
-‘হ্যা!’
-‘কার পারমিশন নিয়ে তুমি বিয়ে করেছ?’
-‘বিয়ে করতে পারমিশন লাগে?’
অবাক চোখে শারাফ তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।হামিদ মির্জা ছেলের প্রশ্নে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলেন।আসলেই তো!প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে বিয়ে করেছে,এতে পারমিশন নেওয়ায় কি আছে!হালকা কেশে স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করলেন,
-‘তা মেয়ের বাবা কি করে?আমাদের ঝিল্লিপুরের কেউ নাকি?’
-‘চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রির মহাপরিচালক, তাজওয়ার চৌধুরীর একমাত্র কন্যাকে চন্দ্ররেখা চৌধুরীকে আমার অর্ধাঙ্গিনী বানিয়েছি।’
ডাইনিং টেবিলে শারাফের মুখোমুখি বসে ছিলেন হামিদ মির্জা।ছেলের কথা কানে প্রবেশ করতেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।মুহূর্তেই চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন।টেবিল ক্লথে টান পরায় তরকারিসহ কয়েকটি কাঁচের বোল মেঝেতে ছিটকে পড়লো।ঝনঝন শব্দে কাঁচের বাটি গুলো ভেঙে,কয়েক টুকরো কাঁচ এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়লো।হামিদ মির্জা এসব কিছুই তোয়াক্কা করলেন না,রাগান্বিত গলায় চিৎকার করে উঠলেন,
-‘ডু ইউ নো,হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান?’তুমি একটা বাস্টার্ডের মেয়েকে বিয়ে করে,চাঁদোয়া মহলে নিয়ে এসেছ?’
শারাফের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।সে খুব আয়েশী ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে।সম্পূর্ণ ঘটনা তো সেও জানতে চায়!ইতিমধ্যে চন্দ্ররেখা ব্যতিত সকলেই হলরুমে উপস্থিত হয়েছে। সুধা মির্জা সিড়ি বেয়ে কেবল নিচে নেমে এসে দাঁড়িয়েছেন।হামিদ মির্জা তখন রাগে দিশেহারা,শারাফের চন্দ্ররেখাকে বিয়ের ব্যাপারটি তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না।সুধা মির্জা ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে গেলেন।আজকে হয়ত অতীতের অনেক কিছু খোলাসা হবে!তারপর তো অনেক কিছু সকলের আড়ালেই থেকে যাবে।মনে মনে হাসলেন সুধা মির্জা।সে ব্যবস্থা তো তিনিই করে রেখেছেন।হাফিজ মির্জা ভাইকে থামানোর জন্য এগিয়ে আসতে চাইলেন।কিন্তু বাবা ছেলের মাঝে ইন্টারফেয়ার করা ঠিক হবে না ভেবে দমে গেলেন।এদিকে হামিদ মির্জা ছেলের এরূপ উদাসীনতা সহ্য করতে না পেরে পুনরায় চিৎকার করলেন,
-‘তুমি আমার বাবার খুনির মেয়েকে বিয়ে করেছ!তাজওয়ার চৌধুরীর কারণেই আজকে বাবা এই পৃথিবীতে নেই।পঁচিশ বছর আগে আমাদের বংশের মুখে কালি মেখে,আমার বোনকে নিয়ে সে পালিয়ে ছিল।সহ্য করতে না পেরে বাবা সে সময় হার্ট অ্যাটাক করেন।’
-‘এতে আপনার বোনও কিন্তু সমানভাবে দোষী।নিজের ইচ্ছাতেই তিনি পালিয়েছিলেন।’
শারাফের এমন সোজাসাপ্টা কথায়,হামিদ মির্জার মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো।ছেলে আদোও জানে,সে কি বলছে!তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে গিয়ে ছেলের চেয়ারের সামনে দাঁড়ালেন তিনি।শারাফ স্বাভাবিকভাবে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন তারা।
-‘আমার সহজ সরল বোনকে কাপুরুষটা ম্যানিপুলেট করেছিলো।সো কলড ভালোবাসার দেখিয়ে সবকিছু উলটপালট করে দিয়েছিলো।কেবল তার জন্য আমাদের বিজনেসে অনেক বড় লস হয়েছিল তুমি জানো?একদিকে বাবার মৃত্যু,অপরদিকে বিজনেসে এতো ক্ষতি।সব মিলিয়ে আমরা পথে বসতে নিয়েছিলাম।সে সময় সুধার আপ্রাণ চেষ্টা ও দিনরাতের পরিশ্রমে,আজকের এই মির্জা ইন্ডাস্ট্রিকে তোমরা দেখতে পাচ্ছো।’
এ পর্যায়ে শারাফের প্রশ্ন করার কথা থাকলেও সে কেবল শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল।অদ্ভুত শীতল তার দৃষ্টি।সে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো সুধা মির্জার ওপরে।শারাফের চোখের দিকে তাকিয়ে সুধা মির্জার ভেতরটা শিরশির করে উঠলো।হামিদ মির্জার চোখের কার্নিশ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।কম্পিত স্বরে বলে উঠলেন,
-‘আমাদের সবার আদরের ছিলো নিধি।সুধার জন্মের আঠারো মিনিট পর নিধির জন্ম হয়েছিল।আব্বা দুইজনকে একসাথে কোলে নিয়ে বলেছিলেন,দেখে যা সকলে আমার বাড়িতে দু’দুটো জ্যোৎস্নার মেলা বসেছে।চাঁদের সাথে মিলিয়ে দুজনের নাম রেখেছিলেন সুধা-নিধি।তাদের জন্মে সবচেয়ে বেশি খুশি ছিলেন আব্বা!দুইজন দেখতে এরকম হলেও,নিধি ছিল শান্ত।বাবা নিধিকে দূ…
হামিদ মির্জার কথা আঁটকে আসছে। চুপ হয়ে গেলেন। হয়ত নিজেকে ভেতর থেকে স্বাভাবিক করতে চাইছেন।হাফিজ মির্জা ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখলেন।জিসি,সিমি,মাসুক সকলে এক প্রকার বজ্রহতের মতো দাঁড়িয়ে আছে।তাদের আরেকটা ফুপু আছে,অথচ তারা জানতোই না!তাদের দাদীকে প্রায়ই দেখত লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে।সে কান্নার পেছনে লুকিয়ে থাকা কারণ তাদের নিধি ফুপু!যার ব্যাপারে তারা এতো বছরে কাউকে একটা কথা বলতেও শুনে নি! মাসুক তার মায়ের দিকে তাকাল।তৃণা মির্জা ডাইনিং টেবিলের এক পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মোহিনী মির্জাও নির্লিপ্ত।এর মানে বাড়ির বড়রা সকলেই এ ব্যাপারে সমস্তটুকই জানে।অথচ এতোবছর যাবৎ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলো তারা।না!তাদেরকে আসলে অজ্ঞাত রাখা হয়েছিল।’
নিজেকে সামলে হামিদ মির্জা পুনরায় বলে উঠলেন।
-“আমাদের নিধিকে ফুসলিয়ে নিজের প্রেমের ফাঁদে ফেলে কেঁড়ে নিয়েছিলো তাজওয়ার চৌধুরী।বাবার মৃত্যুর পর মনে থাকা ক্ষোভের কারণে নিধির সাথে কেউ যোগাযোগ রাখি নি।ছ’বছর পর যখন জানতে পারলাম নিধির মেয়ে হয়েছে,আমি গিয়েছিলাম দেখতে। সেখানে যাওয়ার পর আমাকে নিধির সাথে দেখা করতে দেওয়া হলো না।বলা হলো, নিধি নাকি তার দেবরের সাথে অবৈধ প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে,নিজ থেকেই তাজওয়ারকে ডিভোর্স দিয়েছে।অথচ আমাদের মধ্যে সবচেয়ে কোমল হৃদয়ের ছিল নিধি!নিজের সন্তান রেখে পরপুরুষের সাথে পালিয়ে যাওয়ার মতো মেয়ে নিধি না।মিথ্যা বলেছে সেই প্রতারকটা,সে নিজেই আমার বোনের ক্ষতি করেছে।অনেক খুঁজেও আমি আমার বোনকে আমি পাই নি।’
হামিদ মির্জার মুখনিঃসৃত শেষোক্ত বাক্যে সকলে পুনরায় চমকে উঠলো।এতো এতো শক নিতে না পেরে মাসুক ধপ করে সোফায় বসে পড়লো।সব শুনেও শারাফের মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটলো না।তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এই ব্যাপারে আগে থেকেই অবগত।
চলবে
গল্পটা শেষ করে দিবো কি?😐