মিনহাজ যখন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে আমার গালে একটা চড় মারলো সেই মুহূর্তে আমি অনুধাবন করলাম আমার পায়ের নিচে শক্ত মাটি বলে কিছু নেই।আমার অপরাধ ছিল, অনেকদিন থেকে মিনহাজ এর শার্টে মেয়েলি পারফিউম এর গন্ধ পাচ্ছিলাম।আজকে সহ্য না করতে পারায় ব্যাপারটা নিয়ে প্রতিবাদী গলায় কথা বলি।বিনিময়ে সে আমাকে চড়টা দেয়।সাথে এটাও বলে, আমি যাতে আমার সীমার মধ্যে থাকি।সীমা ভালোমত না বুঝলেও, আমার সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট বুঝে ফেললাম। চড় টা খাওয়ার সাথে সাথে আমার বাসা ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত ছিল।আমার ইচ্ছে ও তাই করছিল কিন্তু ওই যে বললাম শক্ত মাটি।বাবা বাড়ির আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো কিন্তু তাতে কি ভাই ভাবির সংসারে ছেলেকে নিয়ে আমাকে তো তাদের অনুগ্রহেই থাকতে হবে। আলমারিতে ধূলো পড়ে যাওয়া সার্টিফিকেট এর কথা মনে আসে।কিন্তু চাকরির বয়স তো আর বসে নেই। সেদিন এর মত অসহায় নিজেকে এর আগে কখনো মনে হয় নি।আমি আর কোন উচ্চবাচ্য না করে, আকাশ পাতাল চিন্তা করতে করতে রুমে চলে আসি।ছেলেটা ওর নিজের রুমে পড়ছে। আমি চাচ্ছিলাম না সে কিছু জানুক।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো মত লক্ষ্য করলাম। অযত্নে এক সময়ের চকচকে চেহারা কেমন জেল্লা হীন হয়ে গেছে। চুল গুলো রুক্ষ সূক্ষ্ম।শরীরের কিছু জায়গায় বাড়তি মেদ স্পষ্ট। কিন্তু এই সব কিছু ছাপিয়ে আমি আমার অস্তিত্ব নিয়ে ভয় পেয়ে যাই। এই সংসারে প্রথম থেকেই মিনহাজের কথায় সব ঠিক হয়।এমন কি বাচ্চা নেওয়াটা ও সে ঠিক করেছিলো। আমার খুব ইচ্ছে ছিল দ্বিতীয়বার মা হওয়ার। ফুটফুটে একটা মেয়ে বাবুর। যাকে মনের মত করে সাজাতে পারব।কথাটা মিনহাজকে বলাতে সে এমন একটা চাহনি দিল যে মনে হচ্ছিল আমি অন্যায় কোন আবদার করছি।আসলে সে যে আমার ছেলের বাবা হতে রাজী হয়েছিল সেটাও শুধু এটা প্রমাণ করার জন্য যে তার পৌরুষত্বে কোন সমস্যা নেই। আমার একে একে অনেক কথা মনে হয়ে গেল যেটা মিনহাজ আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছিল।বুক ভেঙে কান্না আসছে। দরজায় টোকা পড়াতে নিজেকে সামলে নিলাম।আমার ছেলে আয়ান রাতের খাবার জন্য এসেছে। চোখে মুখে পানি দিয়ে টেবিলে খাওয়া দিলাম।আয়ান বুদ্ধিমান ছেলে, ক্লাস সেভেনে পড়ে আমার কান্না মাখা মুখ দেখে ঠিকই অনুমান করে নেয় আম্মুর মন ভালো নেই। বারবার আমার মুখের দিকে তাকায়, আমি কিছু বলি কিনা। সে ও নিজ থেকে কিছু বলে না। খাওয়া শেষ করে আমাকে হাগ দিয়ে ওর রুমে চলে যায়।
সেদিন এর পর থেকে আমাকে একটা চিন্তাই অস্থির করে রাখে কিভাবে পায়ের মাটি টা শক্ত করব।ছোট বোনের সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করি। সে আমাকে অনেক রকমের বুদ্ধি দেয়। তার মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে খাবারের বিজনেস এর আইডিয়া। ছোট কাল থেকেই আমার রান্না করতে এবং মানুষকে খাওয়াতে খুব ভালো লাগে। আর অনলাইনে এটা চালিয়ে যাওয়া ও সহজ।আমার বাইরে যেতে হচ্ছে না।আমার ছোট বোনকে বললাম এসব অর্ডার নেয়া, জায়গা মত পৌঁছানোতে তুই সাহায্য করবি।সে নির্দ্বিধায় রাজী হয়ে গেল।বলল অনলাইনে সে অর্ডার নিবে আর ডেলিভারির জন্য লোক ঠিক করে দিবে।কোন খাওয়া নিয়ে কাজ করব এটা নিয়ে ও অনেক দোটানায় ছিলাম।ফ্রোজেন খাওয়া, পোলাও বিরিয়ানি এসব পেইজ এর তো কোন অভাব নেই।আমাকে এমন কিছু নিয়ে কাজ করতে হবে যেটা অনেক কম মানুষই করে।হঠাৎ আমার বানানো ফলের আচার এর কথা মনে পড়ে। আয়ান একদম ফল খায় না।তাই আমি ওকে ফল খাওয়ানোর জন্য অনেক রকমের ফল দিয়ে এই আচারটা বানাই।এই জিনিস খাওয়ার পর সে এটা ছাড়া ভাতই খেতে পারে না।প্রতি মাসে এই আচার আমাকে বানাতে হয় অনেক গুলো করে।যারা যারা এটা খেয়েছে প্রত্যেকে এটার ভক্ত হয়ে গেছে। ছোট বোন ইরাকে বলাতে সে ও খুব সমর্থন করে।
শুরু হয়ে যায় আমার অনলাইন বিজনেস। শুরুতে পথ একদমই মসৃণ ছিল না। এত কম অর্ডার পেতাম হতাশ লাগত।দেখা যেত নিজেদের পরিচিত জনরাই নিচ্ছে।ইচ্ছে হত বিজনেসই বন্ধ করে দেই। পরে আবার ভাবতাম আমার তো কোন লোকসান হচ্ছে না। অগ্রিম অর্ডার নিয়ে আচার দেই। দেখি না কি হয়।তবে যেই ব্যাপারটা আমাকে অনুপ্রেরণা দিত কেউ আমার আচার খেলে বার বার অর্ডার দিত।অনেক লম্বা সময় আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে সফলতার পেতে। একবার আমার একজন পুরানো কাস্টমার তার মেয়ের গায়েহলুদ এর অনুষ্ঠানের জন্য অনেকগুলো আচার নেয়।ওইটা আমার ব্যবসার জন্য একটা বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল। সেদিন অনেকেই আমার সেই আচার খায়।পরে আমার পেইজে অর্ডার দেয়।পরবর্তী তে আরো অনেকগুলো অনুষ্ঠানে আমার আচার তার জায়গা করে নেয়। এত এত অর্ডার আসতে থাকে যে একার পক্ষে ম্যানেজ করা সম্ভব হচ্ছিল না।দুজন লোক রাখি সাহায্যের জন্য।
মিনহাজ অবশ্য এর কিছু ই টের পায় নাই। সে বাসায় ফিরে অনেক রাতে। আর তার আচরণ আমার প্রতি আগের চেয়ে আরও বেশি নিগৃহীত। হওয়ারই কথা ওর সেই থাপ্পর খেয়ে ও এই বাসায় পড়ে আছি। সে বুঝে নিয়েছে আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই। আমাকে যত খুশি আঘাত করা যাবে।আগে মাঝে মাঝে সে আমার কাছাকাছি আসত এখন সেটাও হয় না। এতে অবশ্য আমার কোন দুঃখ নেই। এত ঘৃণা নিয়ে এই সম্পর্ক করা কষ্টকর।সে যে আসে না আমি তাতে আরো স্বস্তি পেতাম।আমাদের সম্পর্কের এই শীতলতা আয়ান ও খুব ভালো মত বুঝতে পারে।বাবার সাথে ওর সম্পর্কটা কখনোই সহজ ছিল না। আর আমাদের এই দূরত্ব ওকে মিনহাজের থেকে আরও দূরে সরিয়ে দেয়। মিনহাজ এর কাছে অবশ্য সম্পর্ক জিনিস টা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।
দেখতে দেখতে পাঁচ বছর চলে যায়। আয়ান খুব ভালো রেজাল্ট করে কলেজে ভর্তি হয়। আর আমার ব্যবসা সেটা আর ছোট নেই। অনেক অনেক বড়।নিজস্ব ফ্যাক্টরি আছে,অফিস আছে।অনেকগুলো লোকের কর্মসংস্থান আমার এই প্রতিষ্ঠান। আচার এর পাশাপাশি আরো কিছু প্রডাক্ট ও এখন জনপ্রিয়। আমার পায়ের মাটি একদম শক্ত। মিনহাজ এর সাথে সেই দিনের বোঝাপড়াটা করার একদম উপযুক্ত সময়। আমি আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র গুটিয়ে মিনহাজ এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।ছেলেকে আগেই আমার কেনা ২৫০০ স্কয়ার ফিটের নতুন ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিয়েছি।সে ওখানে তার খালা ইরা , নানির সাথে নতুন বাড়ি গুছানো তে ব্যস্ত। মিনহাজ অনেক রাতে বাসায় ঢুকলো। আমাকে পরিপাটি হয়ে এমন বসে থাকতে দেখে বাঁকা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল – এত রাতে এমন পরিপাটি হয়ে কোথায় যাচ্ছ?
– আমি ওর সামনে এসে বাসার চাবিটা ওর হাতে দিয়ে বললাম- বাসার চাবিটা রাখ।আমি এই বাসা ছেড়ে নিজের ফ্ল্যাটে চলে যাচ্ছি। ডিভোর্স পেপার বেড সাইড টেবিলে রাখা আছে।সাইন করে দিও।আর না করলেও তিন মাস পরে এমনি ডিভোর্স হয়ে যাবে। মিনহাজ আমার এই কথাগুলো শুনে রাগে কাঁপতে কাঁপতে তার হাত তুলল আমাকে চড় মারার জন্য। আমি আজকে একদম প্রস্তুত, পায়ের নিচের মাটি পাথরের মত শক্ত। ওর হাত টা আটকালাম আর অন্য হাত দিয়ে আমার বুকে জমে থাকা এতদিনের সমস্ত ঘৃনা দিয়ে মিনহাজের গালে একটা চড় মারলাম।ওর মুখ টা হা হয়ে গেল ।আমি এই অবস্থায় বাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম।
( সমাপ্ত)
গল্পঃচড়
লেখিকাঃনিম্নী হাসিন