#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-০৪
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
পুরো বিছানা জুরে কসমেটিকস এ ভরপুর! সাথে দুটো শাড়ি তিনটা সেলোয়ার কামিজ রয়েছে।দু-বছর আগে এগুলো নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। কত্ত গুলো কসমেটিকস একসাথে হবে আমার ভাবা যায়? বিয়ের দিন ই শুধু এত্ত গুলো জিনিস একসাথে পাওয়া যায়।তা ছাড়া তো একসাথে সব কিছু ক্রয় করা হয় না, আজকে তিনটা তো অন্যদিন শপিং মলে যাওয়ার সুযোগ হলে, আরো পাঁচ ছয়টা। এভাবে করেই জমে আমাদের কসমেটিকস। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো ধরনের ফিলিংস হচ্ছে না আমার এসব নিয়ে। কি থেকে কি করবো কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
সকাল বেলা ভাইয়া যখন বিয়ের কথা বললো, তখন আমি বিষ্ময়ে কিংবদন্তি হয়ে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।আপু তখন রেগে গিয়ে বললো,
– তুমি কি এসব করার জন্য,একমাসের ছুটি নিয়ে দেশে এসেছো? আমি কিন্তু কখনো এই বিয়ে মেনে নিতে পারবো না।ঐ ছেলেটার জন্য আমার আম্মু প্রতিটি মূহুর্ত কষ্ট পেতে পেতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। আব্বু ও কারো সাথে তেমন কথাবার্তা বলে না! সবসময় নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে। তুমি প্লিজ এই বিষয়টা এখানেই সমাপ্তি টানো।
ভাইয়া তখন বললো,
– অনা তুমি কি বলছো এসব? তুমি তো অহেতুক একজন মানুষ কে খু*নি বানিয়ে দিচ্ছ! আচ্ছা বাদ দাও।
তারপর ভাইয়া ফোন হাতে নিয়ে কাউকে কল করলো।কল রিসিভ হতেই ভাইয়া সালাম দিল। এরমধ্যে লাউড স্পিকার অন করে দিয়েছে ভাইয়া,তাই কন্ঠস্বর শুনতেই বুঝতে পারলাম অপরপাশের ব্যক্তিটি আব্বু! আমি আর আপু পূর্ন মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনছি। ভাইয়া সালাম দিয়ে বললো,
– আব্বা আপনার শরীরের কি অবস্থা এখন?
– আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ ভালো রাখছে। আপনারা সবাই কেমন আছেন? আমার নানু মনিরা কেমন আছে?
– আলহামদুলিল্লাহ আমরা সবাই ভালো আছি।
– জামাই একদিন সময় নিয়া,নানু মনিদের নিয়া আসেন নারায়ণগঞ্জ। কতোদিন ওদের দেখি না।
– ইনশা আল্লাহ,আমরা আসবো আব্বা। আপনি ও তো এসে ওদের দেখে যেতে পারেন। তাছাড়া গ্রামের হাওয়া, বাতাস লাগবে ভালো লাগবে।
– সেকি মন চায় না আমার? কিন্তু শরীরের অবস্থা তো জানেন, এতো জার্নি করে শরীর কুলাবে না।তো আয়রার ব্যাপারটা নিয়ে সারারাত ভাবলাম বুঝলেন জামাই।
– আমি আপনার মতামতের অপেক্ষা করছি আব্বা, এবার বলুন কি সিদ্ধান্ত নিলেন আপনি?
আব্বু আর ভাইয়ার ফোন আলাপ,আলোচনা শুনে এটুকু বুঝে গেছি যে বিয়ের ব্যাপারে তারা আগেই আলোচনা করেছেন। এখন শুধু আব্বুর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বাকি আছে,আর সেটাই আব্বু বলতে শুরু করলো,
– জামাই এটা নিয়ে আমার বড় ছেলের সাথে কথা বললাম আমি,সে বললো আমরা যেটা ভালো মনে করি সেটাই যেন করি।তো আপনি আমার কাছে প্রস্তাব রাখার পর থেকে আমি অনেক ভেবে দেখলাম, সেদিন আমার ও ভুল ত্রুটি ছিল। তবে পাত্র পক্ষের বেশি ছিল কারণ তারা এতো দিন,ব্যাপারটা না তুলে বিয়ের আগের দিন তুললো।যেখানে আমার মেয়ের সারাজীবনের স্বপ্ন এবং আমার মান সম্মান ক্ষুন্ন হওয়ার আশংকা ছিল বা ক্ষুন্ন হয়েছে। আচ্ছা যাই হোক আমি আমার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, কাবিনটা একটু পাকা পোক্ত ভাবে করতে চেয়েছিলাম। সেখানে আপনার আর অনামিকার কাবিন পাঁচ লাখ টাকাই করা হয়েছিল।আর যদি স্ত্রী কে পরিশোধ করার কথা বলেন সেখানে তো আমার মেয়ে তাকে মাফ করে দিয়েছিল।
কোরআনে আছে,
বিয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে মোহর।
আল্লাহ তা’লা ইরশাদ করেছেন,’মুহরিম মহিলা ব্যতীত যত মহিলা আছে তাদেরকে মালের বিনিময়ে হাসিল করা তোমাদের জন্য এ শর্তে হালাল করে দেওয়া হয়েছে যে,তাদের কে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করবে,তাদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক করবে না। তারপর বিবাহিত জীবনে যে মজা তোমরা হাসিল কর তার বদলে তাদের মনোহরা ফরয হিসেবে আদায় করো’।
[সূরা নিসাঃ২৪]
সুতরাং বলা যায় দেনমোহর স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দান কিংবা অনুগ্রহ নয়; এটি স্ত্রীর অধিকার। তাই এটি আদায় করার প্রতি গাফিলতি করার প্রশ্নই আসেনা।
‘বিবিদের মোহর খুশি মনে(ফরজ মনে করে) আদায় করো।
[-সূরা নিসাঃ ৪]
অনেক স্বামীই তার সদ্য বিবাহ করা স্ত্রী কে অসহায় মনে করে ভুলিয়ে-ফুসলে কিংবা নানান ভাবে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে মোহর মাফ করিয়ে নেয়। কিন্তু এতে প্রকৃতপক্ষে মাফ হয় না, এটা স্ত্রীর হক। কিন্তু তারা মনে করে মৌখিক ভাবে স্বীকার করিয়ে নিলেই তার ঋণ মাফ হয়ে গেছে।
‘যদি স্ত্রী নিজে পক্ষ থেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মোহরের কোন অংশ ক্ষমা করে দেয়,তবেই তোমরা হৃষ্টমনে ভোগ করতে পারো।’
[সূরা নিসাঃ৪]
অর্থাৎ পূর্ণভাবে স্ত্রীর মোহর বুঝে নেওয়ার পর যদি স্ত্রী তার কিছু অংশ ফিরিয়ে দেয়, তবে তা তোমাদের পক্ষে ভোগ করা জায়েয হবে, অন্যথায় নয়।
আচ্ছা যাই হোক যা হওয়া তা তো হয়েই গেছে। এখন আপনি যদি ভালো মনে করেন এবং আয়রা যদি বিয়েতে মত দেয় তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই। তাছাড়া আয়রার আম্মু শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চাইতো রাহাতের সাথে যেন আয়রার বিয়ে হয়!এর জন্য আয়রা কে বলতো আয়রা যেন একটা বার রাহাত কে কল করে! তাই আমার স্ত্রীর শেষ ইচ্ছাটা পূরণ হোক আমি চাই, বাকিটা আয়রা এবং আপনারা জানেন।
– আচ্ছা আব্বা আয়রা মতামত দিলে আজকেই শুভ কাজটা সেরে ফেলবো, আপনি ওদের জন্য দো’আ কইরেন।
– আমার দো’আ সবসময় ওদের আছে।
তাহলে রাখছি জামাই, আপনি সব কিছু সেরে সাফা আর মারওয়া নানু মনিদের নিয়া আইসেন।
– ইনশা আল্লাহ,
আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুমুস সালাম।
________
– এবার আয়রা আর অনামিকা শুনলে তো আব্বার কথা? আমার শ্বাশুড়ি আম্মার ও ইচ্ছা ছিল বিয়েটা যেন হয়। তাছাড়া তোমরা হয়তো জানো না,যে দিন বিয়ে হওয়ার কথা ছিল সেদিন কিন্তু রাহাত পাগলের মতো দৌড়ে ঠিকই তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিল! কিন্তু তোমরা ভুল শুধরানোর সময় টুকু ও রাহাতের হাতে রাখ নাই।এর পর ছেলেটা কি করতে পারে বলো? তোমরাই বলো আমাকে? আমি তো শুধু বন্ধু বলে ওর হয়ে কথা বলছি না।যেটা ঠিক সেটাই বলছি। এবার তোমাদের সিদ্ধান্ত ই সিদ্ধান্ত?
ভাইয়া,আব্বুর কথা শুনে আমি আপু দু’জনেই চুপচাপ বসে আছি।
তারপর নিরবতা ভেঙ্গে বললাম,
– ভাইয়া আপনার যা ইচ্ছা করেন, তবে একটা কথা বলছি আমি,বিয়ে করলেও কারো সাথে কোথাও যাচ্ছি না। আমি এখন যেমন এখানে আছি, তারপর আপনি আপু বিদেশে চলে যেমন নারায়ণগঞ্জ আব্বুর কাছে চলে যাবো, ঠিক তেমনি বিয়ে করলেও আমি তাই করবো! এখন আপনারা ঠিক করুন, এই শর্তে রাজি কিনা?
ভাইয়া কে এটুকু বলে নিজের রুমে চলে আসলাম। পরে লতার কাছ থেকে শুনলাম, ভাইয়া রাহাত আর তার বন্ধুরা মিলে বিয়ের শপিং করতে গিয়েছে! তারমানে আমার শর্ত মেনে নিয়েছে রাহাত।
_______
মনি সাফা সাজবে!
জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে সকালের ঘটনাটা ভাবছি তখন সাফা পিছন থেকে বললো কথাটা। পেছনে ফিরে দেখি,সে লিপস্টিক হাতে নিয়ে আমাকে এগিয়ে দিল। আমি মুচকি হাসলাম ওর কান্ডে।সে সব কিছুতেই তার নাম নিয়ে বলে,যেমন সাফা খাবে,সাফা যাবে,সাফা করবে।ওর ছোট্ট মাথায় নিজের নাম নামটা পাকা পোক্ত হয়ে সেট হয়ে গেছে।সে এটা বুঝতে শিখে নাই এভাবে বলার, আমি খাবো, আমি যাবো, আমি করবো।যাই হোক, তার হাত থেকে লিপস্টিক নিয়ে সুন্দর করে ছোট চিকন ঠোঁট দুটো গোলাপী রঙে রাঙিয়ে দিলাম।গুলুমুলু ফর্সা মুখশ্রীটা ফুটে উঠেছে।মা শা আল্লাহ খুব মিষ্টি লাগছে সাফা কে।ওকে সাজিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
– মারওয়া কোথায়?
সে একটু ভাবুক ভঙ্গিতে বললো,
– মারও মাম ধচ্চে!
বুঝলাম ছোট পাকনি সবাই কে ফাঁকি দিয়ে, বাথরুমে গিয়ে পানি নিয়ে খেলছে। ওদের নিয়ে আমি আর পারি না,একটু সুযোগ পেলেই পানি দিয়ে গোসল করে কাপড় চোপড় ভিজিয়ে একাকার অবস্থা করে ফেলে। বাচ্চারা পানি নিয়ে খেলতে কি মজা পায় আল্লাহ জানেন। তারাতাড়ি বাথরুমের কাছে গেলাম ওকে কান ধরে টেনে আনতে, গিয়ে দেখি দরজা বন্ধ করে আছে। তবে লক করে নাই, পারে না সে জন্যই। দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে যা দেখলাম, তাঁতে হতভম্ব আমি!
রাহাত হাঁটু গেড়ে বসে,মারওয়ার শরীরে লেগে থাকা লিপস্টিক পরিষ্কার করে দিচ্ছে! তারপর আমার ওখান থেকে লিপস্টিক এনে এই কান্ড ঘটিয়েছে মারওয়া,হায় আল্লাহ এই দু’টো দুষ্টু কে আপু কি করে সামলায় আমার মাথায় আসছে না।
একটু ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, রাহাতের হাতে আমার ফেইস ওয়াশ! তারমানে সে আমার ফেইস ওয়াশ দিয়ে লিপস্টিক ধুয়ে দিচ্ছে!হায় আল্লাহ!এই লোক কে ইচ্ছে করছে বার্থটবে রেখে চুবানি দেই। বাথরুমে এতো সাবান থাকতে আমার ফেইস ওয়াশ টাই চোখে পরলো তার? এখন তো কিছু বলতেও পারবো না।বললে সে বলবে, তোমার জন্য তো নতুন আনা হয়েছে আয়রা।তাই পুরাতন টা ইউজ না করলেও চলবে।
__________
বিয়েটা দুপুর বেলতেই সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। এখন বেলা সাড়ে পাঁচটা বাজে।আপু বিয়ের বেনারসী খুলতে নিষেধ করেছে সে জন্যই এখনো এই ভারি বেনারসী গায়ে জড়িয়ে আছি। খুব বিরক্ত লাগছে আমার। খাটের এক কোণে গুটিয়ে বসে আছি আমি তখন,লম্বা তবে পাতলা ও না আবার মোটা ও না। মাঝামাঝি গরন, দেহের অধিকারী ব্যক্তিটি রুমে প্রবেশ করলো! হাল্কা সোনালী রঙের পাঞ্জাবি গায়ে তার। চুল গুলো নিয়ম অনুযায়ী ছোট,যেমনটা আর্মিদের নিয়ম।
শ্যাম বর্ণের ব্যাক্তিটা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, আমি খাট থেকে নেমে সৌজন্য মূলক সালাম দিলাম।তার সালামের জবাব শুনে বললাম,
– তাহলে শেষ পর্যন্ত নিজের অধিকার করে নিলেন। আপনি খুব ভালো করে জানেন যে আমি আল্লাহ ভিরু মেয়ে! বিয়েটা হয়ে গেলে, স্বামী হিসেবে আপনার সব কথা শুনতে বাধ্য আমি।তো শুরু করুন অধিকার খাটানো!
আমার কথা শেষ হতে, রাহাত মলিন মুখে বললো,
– কি করলে আমাকে মাফ করবে?যাই বলো চেষ্টা করবো তোমার অভিমান ভাঙার।
– আমার চোখের পানি কেরে নিয়েছেন আপনি! তাই এই পাথর আমাকে কাঁদিয়ে দেখান! তারপর সব কিছু ভুলে যাবো আমি, কথা দিলাম,,,,,
#চলবে,, ইনশা আল্লাহ।
(