জঠর পর্ব ১৫+১৬

#জঠর
#পর্বঃ১৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

সময় চলে ধাবমান স্রোতোস্বিনীর মতো। দু’কুল ছাপিয়ে নিয়ে যায় সমস্ত বাঁধা, বিপত্তি। সময়ের সাথে বদলায় সম্পর্ক, মিলিয়ে যায় ক্ষত, পরিবর্তন হয় মনের।

অর্হিতা নায়েলের সম্পর্কটাও তেমন। দাঁ-কুমড়ার সম্পর্ক এখন মিহি কুয়াশার চাদর ঘেরা নব্য পল্লবের মতো। মেয়ে আর বাবাকে সামলে নিচ্ছে আপন ভঙ্গিমায়।

বিছানার সাথে বুক লেপ্টে উপুর হয়ে আছে পিউলী। মাথার একপাশে ঠেকিয়ে রেখেছে হাত। একটু কাত করা ঘাড়। সাদা কাগজে চলছে আঁকিবুঁকি। দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের মতো সামনে বসে আছে অর্হিতা। দরজায় শব্দ করে নায়েল। ছোট্ট করে বলল—

“আসতে পারি?”

অর্হিতা ভেঙচি কেটে বলল—

“নিষেধ করলে কী চলে যাবেন?”

মাথা আধটুকু ভেতরে গলিয়ে দিয়েছে নায়েল। পিউলী টসটসে চোখে বাবার দিকে তাকায়। অধরে খেলে যায় প্রফুল্ল হাসি। নায়েল দরজার পাল্লায় ধরে বলল—

“এতটাও ম্যানারলেস নই।”

“হ্যাঁ। কতটা ম্যানারফুল তা আমার জানা আছে।”

ফিচেল হাসে নায়েল। ভেতরে এসে দৃঢ় হয়ে দাঁড়ায়। পিউলী একাগ্রচিত্তে কিছু একটা রঙ করছে। নায়েল মোলায়েম স্বরে প্রশ্ন করে—

” এটা কী এঁকেছ পিউ?”

পিউলী গালভর্তি হাসে। বলল—

“নিহি মামুনি আর অরি মামুনি।”

নায়েল ভালো করে লক্ষ্য করল। পিউলী একটা স্টার এঁকেছে যার মোটা বর্ডার করা। গাঢ় হলুদ রঙে রাঙানো তা। নিচে এলোমেলো অক্ষরে লেখা “নিহি মামুনি”। তারপাশেই একটা গোলাকার বৃত্ত। বৃত্তের নিচের দিকে একটা সোজা রেখা। দু’পাশে দুটো ঢালু রেখা। যা হাত নির্দেশ করে। তার নিচে” অর্হিতা মামুনি ” লেখা। নায়েল সেটা দেখেই সশব্দে হেসে ওঠে। চোখ রাঙিয়ে চাইল অর্হিতা। কাষ্ঠ গলায় বলল—

“হাসছেন কেন?”

নায়েল ঠোঁট চেপে ধরে বলল—

“আপনাকে এখানের চেয়ে ছবিতে বেশি সুন্দর লাগছে।”

অর্হিতা ছবিটার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকায়। নায়েল নিচু হয়। হাতের ভর দিয়ে ঝুঁকে অর্হিতার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল—

“আপনি কিন্তু আসলেই সুন্দর।”

টুপ করে অর্হিতার গালে চুমু খায় নায়েল। অর্হিতা তপ্ত চোখে তাকায়। সোজা হয় নায়েল। গা দুলিয়ে হেসে ওঠে সরব চোখে তাকায়। অর্হিতা শ্লেষাত্মক গলায় বলল—

“মেয়ের সামনে সাধু বিড়াল। আমি মাছ খাই না। আড়াল হতেই জেলে ভাই, তিনদিনও পাই না।”

নায়েল ঠোঁট কামড়ে হাসে। পালটা জবাবে বলল—

“মেয়ের সামনে সব বাবারাই সাধু বিড়াল। মেয়ের উপযুক্ত বয়স হলে সে বুঝে যাবে, বাবা সাধু বিড়াল হলে তার আসা মুশকিল।”

অর্হিতা অপ্রতিভ হাসে। পিউলী চিবুকের নিচে দুই হাত দিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল—

“সাধু বিড়াল কী পাপা?”

অর্হিতা চট করেই বলল—

“যে বিড়াল মাছ খায় না।”

“পাপা তো মাছ খায়।”

ফিক করে হেসে ফেলে অর্হিতা। অপ্রস্তুত হয় নায়েল। মেয়ের সামনে ইজ্জতের ফালুদা করে ছাড়বে মেয়ের মা। নায়েল প্রসঙ্গ পালটাতে বলে উঠে—

” রাতে ফ্রি হবেন কখন?”

অর্হিতা শক্ত গলায় বলল—

“হবো না।”

অধৈর্য গলায় বলে উঠে নায়েল—

“হবেন না মানে?”

নায়েলের দ্রুতগতির স্বরে পিউলী মাথা উঁচু করে তাকায়। বিব্রত হয় নায়েল। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রয়ে সয়ে বলল—

“না মানে, পাপা বলছিলাম পড়া শেষ হলে মামুনি কখন ফ্রি হবে তাই জানতে চাচ্ছি।”

পিউলী শুকনো গলায় বলল—

“পড়া শেষ হলে আমরা টোরি বুক পড়ব। তুমি যাও পাপা।”

অর্হিতার দিকে মৃদু চোখে তাকায় নায়েল। অর্হিতা ফিচেল হেসে বলল—

“যেতে পারেন মি. গিরগিটি। আজ আমরা স্টোরি বুক পড়ব। সময় নেই আজ।”

নায়েল নমনীয় গলায় বলল—

“এটা কিন্তু অন্যায় মিসেস অর্হিতা।”

“যা খেয়েছেন ওটা দিয়ে আজ পেট ভরুন। আর কিছু হবে না।”

“ওকে। আমিও দেখে নেবো। বিরিয়ানি উইথ বোরহানি।”

অর্হিতা স্বগতোক্তি করে বলল—

“বেয়াদব গিরগিটি!”
,
,
,
নায়েল মুচকি হাসে। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই দেখে হৃতি উঠে আসছে।

“খালুজান তোমাকে ডাকছে নায়েল।”

“যাচ্ছি।
তুমি যাবে?”

“না। আমি অর্হিতার ঘরে যাচ্ছি।”

“আচ্ছা।”

মৃদু পায়ে অর্হিতার কক্ষে প্রবেশ করে হৃতি। মিষ্টি গলায় বলল—

“কী করছ পিউলী?”

“দেখছ না কালার করছি।”

হৃতির উৎসুক নজর অর্হিতার দিকে। আগ্রহী গলায় বলল—

“পিউলী কী স্কুলে যাবে না কি?”

“হুম।”

“কিন্তু নায়েল তো ওকে স্কুলে যেতে দেয় না।”

“আমি নায়েলের সাথে কথা বলেছি। সে রাজি।”

“ও। একটা কথা বলব তোমাকে?”

অর্হিতা ভনিতা না করেই বলল—

“বলো।”

“তুমি আমার ওপর রেগে আছ? নায়েল আর সম্পর্কের জন্য?”

অর্হিতা চাপা হাসল। সতেজ গলায় বলল—

“না তো। রাগ করব কেন? তোমার ওপর বিশ্বাস না থাকলেও আমার স্বামীর ওপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। এই দুই মাসে অন্তত এতটা ভালো সম্পর্ক আমাদের হয়েছে। তবে তার চেয়ে বেশি আমি নিজেকে বিশ্বাস করি। আমি কোনো ফেলে দেওয়া আসবাবপত্র নই যে, নায়েলের ইচ্ছে হলো সে কুড়িয়ে এনে তার স্টোর রুমে রাখল। আমি তার স্ত্রী। নূন্যতম সম্মান আর কর্তৃত্ব দুটোই পাওয়ার অধিকার আমার আছে। তাই এই নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন রেখো না মনে। সব সম্পর্কেই যে প্রেম থাকতে হবে তা নয়। আর সব ভালোবাসার ধরনও এক নয়। আশা করি বুঝতে পেরেছ আমার কথা। এখন যাও। পিউ পড়ছে। এমনিতেও নায়েল এসে সময় নষ্ট করেছে। পড়ার সময় ডোন্ট ডিস্টার্ব, তাই না পিউ?”

“হুম।”
,
,
,
গাঢ় খয়েরী রঙের জর্জেট শাড়ি পরেছে অর্হিতা। চুলগুলো টেনে উঁচু করে পনিটেল করছে। তার হলুদাভ গায়ের রঙে কেটে ধরেছে খয়েরী রঙ। ঠোঁটে গাঢ় খয়েরী রঙের ম্যাট লিপস্টিক। আয়নায় নিজেকে একবার ভালো করে দেখে নিল অর্হিতা। বিছানার উপর দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে আছে পিউলী। অর্হিতার ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি। বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায় সে। মেয়ের দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বলল—

“মামুনিকে কেমন লাগছে?”

পিউলী প্রাণখোলা হেসে বলল—

“সুন্দর।”

অর্হিতা ঝকঝকে হাসে। পিউলীর গালে শক্ত চুমু খেয়ে তাকে কোলে তুলে নেয়। মাথার মধ্যভাগে সিঁথি করে দুটো ঝুঁটি করে দিয়েছে। উপরে শর্ট হাতার শার্ট আর নিচে হাঁটু অব্দি স্কার্ট। স্কুলের জন্য তৈরি পিউলী। তাকে কোলে নিয়ে নিচে আসে অর্হিতা। কোল থেকে নামাতেই সামনে দাঁড়ানো বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে পিউলী। নায়েল পরম মমতায় জড়িয়ে নেয় মেয়েকে। চোখ, মুখ প্লাবিত করে চুমুর বর্ষণে। মিষ্টি গলায় বলল—

“আজ পিউ স্কুলে যাবে?”

“হুম, পাপা।”

“গড ব্লেস ইউ মাই প্রিন্সেস। একদম দুষ্টমি করবে না। গুড গার্ল হয়ে থাকবে।”

“ওকে পাপা।”

নায়েল উঠে দাঁড়ায়। অমিমাংসিত এক ভয় তার মনে। তা নাড়া দিয়ে উঠল। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে বলল—

“খেয়াল রাখবেন মিসেস অর্হিতা।”

অর্হিতা দায়িত্বের সুরে বলল—

“চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়েকে আমি আগলে রাখব।”

“আমাদের মেয়ে অর্হিতা।”

চট করেই জিব কাটে অর্হিতা। অনুরক্তির সুরে বলল—

“সরিইইই।”

নায়েল তেজহীন হাসে। নওশাদ সাহেবের সাথে টুকটুক করে কথা বলছে পিউলী। তাকে কোলে তুলে নিল অর্হিতা। সরল গলায় বলল—

“দাদুকে বাই বলো।”

পিউলী হাত নাড়ে। পাশেই সায়েরা আর হৃতি দাঁড়ানো। তারাও আদর মাখিয়ে দেয় পিউলীকে। যেন যুদ্ধে জয়ে যাচ্ছে কেউ!

গাড়িতে বসতেই নায়েলের বুকটা কেমন করে ওঠে। পিউলী জানালার ফাঁক দিয়ে নায়েলের দিকে চেয়ে আছে। নিজের বোনকে খুব মনে পড়ল নায়েলের। তমাল গাড়ি স্টার্ট করল। নায়েলের মোবাইলে একটা ছোট্ট মেসেজ আসে

” মি. গিরগিটি, প্রতি ঘণ্টায় যদি একবার কল না করেছেন তাহলে খবর আছে।”

নায়েল অধর ছড়িয়ে হাসে। মেয়েটা তাকে কোন মায়ায় ফেলেছে!
,
,
,
পিউলীকে স্কুলে ভেতর যেতে বলে গাড়ির কাছে ফিরে আসে অর্হিতা। তমালকে ডেকে বলল—

“তুমি ইচ্ছে করলে ঘুরে আসতে পারো। পিউর ছুটি হলে ওকে নিয়েই ফিরব।”

তমাল বিনীত সুরে বলল—

“সমস্যা নেই ম্যাম। আপনি গাড়িতেই বসুন।”

“না। এত সময় গাড়িতে বসলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। অভ্যাস নেই আমার। তুমি ইচ্ছে করলে কিছু খেয়েও আসতে পারো।”

“দরকার নেই। আমি ঠিক আছি।”

অর্হিতা স্কুলের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে একটা বেঞ্চে বসে। হঠাৎ তার মোবাইল বেজে ওঠে। মি. গিরগিটি ইজ কলিং। অর্হিতার অধরে এক অপ্রত্যাশিত হাসি। চট করে রিসিভ করেই বলল—

” মাত্র দুই মিনিটই বাকি ছিল। কল না করলে তো খবরই ছিল।”

গা দুলিয়ে হাসে নায়েল। হেসে হেসে বলল—

“কী করতেন?”

“উপোস রাখতাম আপনাকে।”

“এ বড়ো অন্যায়! একদিন বিরিয়ানি খাইয়ে তিনদিন উপোস রাখলে বাঁচব কী করে?”

“এতদিন যেভাবে বেঁচেছেন?”

“তখন তো বিরিয়ানির স্বাদ নেইনি। এখন যে রোজ না হলে চলবে না।”

“হয়েছে, হয়েছে আর ন্যাকামো করতে হবে না। অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।”

“হলাম না হয় চোর। সিঁদ কেটে নিজের ঘরে কতজন চুরি করতে পারে!”

অর্হিতা লাজুক হাসে। নখ কাটে দাঁত দিয়ে। তার কুঞ্চিত শাড়ির আঁচল নিচে পড়ে। আচমকা নায়েল বলে উঠে—

“আঁচলটা ঠিক করুন অর্হিতা। আর বাচ্চাদের মতো নখ কাঁটছেন কেন?”

অর্হিতা চমকে ওঠে দাঁড়ায়। চড়ুই পাখির মতো ছোট্ট মাথাটা হেলিকপ্টারের মতো ঘুরিয়ে চারদিকে তাকায়। চোখের পল্লব প্রশস্ত করে বলল—

“এই আপনি কী করে বুঝলেন আমি নখ কাঁটছি? কোথায় আপনি?”

“আপনার সামনের দিকে তাকান।”

অর্হিতা তার সামনে দিকে অদূরে তাকায়। দুটো গাড়ির মাঝের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে নায়েল। অর্হিতার অধর বিস্তৃত হয়। শিহরিত হয় মন। ছুটে আসে নায়েলের কাছে। বিস্ময় নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে নায়েল বাঁধা প্রদান করে।

“অর্হিতা এইটা রাস্তা।”

“ও সরি, সরি। বেশি এক্সাইটেড হয়ে গেছিলাম কি না। আপনি এখানে কেন?”

অর্হিতার চোখে, মুখে ঝলমলে পড়ন্ত সূর্যের রোশনাই দুলে যাচ্ছে। কেঁপে যাচ্ছে আঁখিপুট। অনুরণন হচ্ছে ওষ্ঠাধরে। মেয়েটার এই সরলতায় বারবার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হয় নায়েলের। প্রেমে তো সে পড়েছে। তার হাজার যামিনীর ঘুম কেড়ে নিতে এই মেয়ের এক ছোঁয়াই যথেষ্ট, তার দীর্ঘ দিবসের নিস্পলক চাহনীর জন্য এই মেয়ের এক হাসিই যথেষ্ট।

“প্রথম দিন। তাই ভাবলাম আপনাকে সঙ্গ দেই।”

“ভালো করেছেন। বোর হচ্ছিলাম। পিউর ছুটি হতে এখনো দুই ঘণ্টা বাকি।”

নায়েল নরম গলায় বলল—

“চলুন,পাশের রেস্টুরেন্টে বসা যাক। ”

“চলুন।”

কফিতে চুমুক বসায় অর্হিতা। তার দিকে নিমেষহীন চেয়ে আছে নায়েল। চাহনিতে স্থিরতার সাথে ঘোর। নেশা না করেও যে কেউ এতটা নেশার্ত হয় তা এখন নায়েলকে দেখলে অনুমেয় করা যাবে। অর্হিতা তার রাঙা অধর অদ্ভুত ভঙিতে উঠানামা করে। তাতেই ধ্যানমগ্ন নায়েল। কী বিষন্ন দুপুরের শোভিত স্বপ্ন! যেন ধরতে গেলে সব অস্পষ্ট!

অর্হিতা চট করে বলল—

“নায়েল!”

নায়েলের ঘোর কাটে। মৃদু ছন্দে বলল—

“হু।”

“আপনার খালামনিকে কখনো সন্দেহ হয়নি?”

নায়েল বেখেয়ালি হাসল। টানটান ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে বলল—

“প্রশ্নই উঠে না।”

“অর্হিতা সন্দিগ্ধ গলায় বলল—

“কেন?”

“কেন করবেন সে এসব? আমরা ছাড়া তার কে আছে? বাবার সাথে যখন খালামনির বিয়ে হয় তখন সে ডিবোর্সী। আমি খালামনি ডাকলেও নিহিতা তাকে আম্মু বলেই ডাকত। খালামনি কখনো আমাদের অনাদর করেননি। একটু কঠিন স্বভাবের। কিন্তু মনটা নরম। খালামনি না থাকলে পিউকে একা সামলাতাম কী করে?”

অর্হিতা চেপে যায়। কোথাও না কোথাও তার সায়েরাকে সন্দেহ হয়। পরক্ষণে মনে হয়, সেও তো সৎ মা। সেও তো পিউলীকে জন্ম দেয়নি। তো?
নায়েল নিষ্কম্প গলায় বলল—

“জন্ম না দিলেও নিজ সন্তানের মতোই আমাদের ভালোবেসেছেন খালামনি। তার ওপর দয়া করে আঙুল উঠাবেন না।”

বিক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠে অর্হিতা—

“রাগ করছেন কেন? আমি কী কিছু বলেছি? শুধু জানতে ইচ্ছে হলো তাই বললাম।”

“ইটস ওকে। আই আন্ডারস্ট্যান্ড।”

বেশ কিছু সময় দুজন রেস্তোরাঁতে কাটায়। পিউলীর ছুটির সময় হতেই বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। হেলে পড়া সূর্যের তীর্যক রশ্মি কপাল বেয়ে নামছে। তাদের পাশ দিয়েই দুটো মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একজন পরেছে জিন্সের সাথে কুর্তি। অন্যজন ফুলস্লিভ শার্ট। মেয়ে দুটো একবার তাদের দিকে তাকাল। সন্দেহবাতিক অর্হিতার মনে হলো তারা নায়েলের দিকে তাকিয়েছে। ডেনিম প্যান্টের সাথে সাদা শার্ট পরেছে নায়েল। তার শার্টের উপরের দিকে দুটো বোতাম খোলা। তার বাদামি বর্ণের বক্ষস্থল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ফট করে দাঁড়িয়ে যায় অর্হিতা। নায়েলের সামনে এসে দাঁড়ায়। অর্হিতার এহেন কান্ডে ভ্রূকুটি করে নায়েল। শার্টের বোতামে হাত লাগিয়ে বলল—

“আমার জিনিস শুধু আমিই দেখব। অন্য কাউকে দেখাবেন না। মাইন্ড ইট মি. গিরগিটি।”

সোনা গলা রোদ টুক করে ছুঁয়ে যায় নায়েলের চোখ। বুজে নিল সে। চোখ খুলে হাসল চোরা হাসি। আনমনেই বলল—

“ভালোবাসি।”
#জঠর
#পর্বঃ১৬
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি

কয়েকদিন ধরেই হৃতির অস্বাভাবিক আচরণ খেয়াল করছে অর্হিতা। মেয়েটা কলেজ থেকে বেশ সময় করে বাড়ি ফিরে। কারো সাথে তেমন একটা কথাও বলে না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকে। আগে নায়েলের সাথে ভালো একটি বন্ডিং ছিল। ক্রমশ তা ফিকে হতে লাগল। অর্হিতা ভেবেছে হয়তো তার জন্য হৃতি নিজেকে নায়েলের কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু অর্হিতার ভুল ভাঙল যখন সে হৃতির ব্যবহারের প্রতি অভিনিবেশ করে।

তিমির আচ্ছন্ন নভোলোকে চন্দ্রিকার উদ্ভাসিত চন্দ্রাতপে মুখর মেদিনী। মৃদুশীতল বহ্নিসখে গুঞ্জন উঠেছে শান্ত তিমির পরিবেশে। ছাদের বাউন্ডারি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে নায়েল। তার বুকের বা’পাশে হৃদপিন্ডের উপর মাথা রেখে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে অর্হিতা।

চাঁদের মিহি আলো চুকচুক করে ছুঁইছে অর্হিতার সুশ্রী আনন। নায়েলের ঘ্রাণেন্দ্রিয় তখন মত্ত অর্হিতার ঘন কেশে। সৌরভের ছড়াছড়ি রেশম কালো অরন্যে। নায়েল প্রাণভরে শ্বাস নেয়। অর্হিতা ধীর গলায় বলল—

“হৃতির সাথে কথা বলেছেন আপনি?”

নায়েলের অস্পষ্ট উত্তর—

“উঁহু।”

“আপনি কালই ওর সাথে কথা বলবেন। আজকাল অদ্ভুত আচরণ করছে। কথা বলছে নি ঠিক মতো, খাচ্ছে না ঠিক মতো। সারাদিন ধুম ধরে ঘরে বসে থাকে। আর কলেজ থেকে ফেরেও দেরি করে।”

নায়েলের শ্রুতিগোচর হলো না কিছুই। সে ব্যস্ত অর্হিতার ঘাড়ে। ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের ঘর্ষণের সাথে উষ্ণ অধরের ছোঁয়া। নায়েলের দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে অসহনীয় গলায় বলে উঠে অর্হিতা—

“নায়েল! কী বলেছি শুনতে পেরেছেন আপনি?”

“হু।”

মেজাজ তিরিক্ষি হলো অর্হিতার। নায়েলের বুকের পাটাতন থেকে পিঠ সরিয়ে সরব কণ্ঠে বলল—

“ধুর! কিছু বলছেন না কেন?”

নায়েল নিরীহ গলায় বলল—

“কী বলব?”

“আপনি কি কিছুই শুনতে পাননি।”

“না তো। শুধু দেখতে পেয়েছি। আপনার ওই চন্দ্রানন! চাঁদের জোছনা ঠিকরে পড়ছে আপনার অঙ্গে। প্রভঞ্জনে উঠেছে ঝড়, উত্তাল করেছে আমার মন।”

অর্হিতা বিষিয়ে উঠা গলায় বলল—

“আপনার এই আবর্জনা মার্কা কবিতাগিরি বন্ধ করবেন? মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার।”

“কুল, কুল মিসেস অর্হিতা। বলুন, আমি শুনছি।”

অর্হিতা সচেতন গলায় ফের বলল—

“হৃতির সাথে কালই কথা বলবেন আপনি।”

নায়েল ফিচেল হাসে। বক্রোক্তি করে বলল—

“যেন আপনি আমার চুল ছিঁড়ে বাতাসে ফুঁ দিয়ে ওড়াতে পারেন। নো চান্স!”

অর্হিতা চোয়াল শক্ত করে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল—

“আপনি কী আমার কথা শুনবেন, না আমি চলে যাব?”

নায়েল হুট করে অর্হিতাকে নিজের বুকে টেনে নেয়। টপটপ করে কয়েকটা চুমু খেয়ে বলল—

“আই এম সিরিয়াস নাউ, বলুন।”

অর্হিতা ফোঁস করে দম ফেলে। সোজা হয়ে বসে। মৃদু বাতাসে তার চুলে উড়াভাব এসেছে। নায়েল সেই চুল নিয়ে উঁচু করে ধরে। তারপর একটু একটু করে হাত থেকে ছাড়ে। চুলগুলো কচ্ছপ গতিতে খসে পড়ে বাতাসে দোল খায়। নায়েল সেই চুলের ফাঁক গলিয়ে চাঁদ দেখে। অর্হিতা নাক, মুখ কুঁচকে নায়েলের আচরণ দেখছে। ইচ্ছে করছে এখন নিজের চুলগুলোই টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। নায়েলের হাত থেকে চুল সরিয়ে দগদগে চোখে তাকাতেই নায়েল কপট ভয়ের ভঙ্গি ধরে। বুকে থু থু ছিটিয়ে বলল—

“এভাবে তাকান কেন? ভয় লাগে আমার।আচ্ছা বলুন। কী বলছিলেন যেন!”

অর্হিতা রাগ সংবরণ করে। সে বেশ বুঝতে পারছে নায়েল তাকে রাগানোর জন্য এমন করছে। অর্হিতা একটু শান্ত হয়ে বলল—

“আপনি কাল সকালেই হৃতির সাথে কথা বলবেন। হৃতি আপনার সাথে অনেক ফ্রি। আই থিংক ও আপনাকে নিজের সমস্যাটা খুলে বলবে।”

“আপনি শুধু শুধু ভাবছেন। ওর পরীক্ষা সামনে। তাই হয়তো ব্যস্ত।”

“তা নয়। হৃতি ঠিক সময়ে বাসায় ফেরে না। রাতে প্রায়ই না খেয়ে ঘুমিয়ে থাকে। সেদিন দেখলাম মেঝেতে শুইয়ে আছে। মেয়েটার চোখ গুলো কেমন প্রাণহীন! শরীরেও জোর নেই।”

নায়েলের মসৃণ কপাল কুঞ্চিত হয়। গাঢ় শ্বাস ফেলে। চোয়ালে আসে দৃঢ়তা। স্থির গলায় বলল—

” ওকে। আমি দেখছি।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অর্হিতা। মেয়েটার জন্য বড্ড মন পোড়ে তার। নিজেকে কল্পনা করে ওর জায়গায়। তার কেউ নেই, কিন্তু মেয়েটির বাবা থেকেও নেই। অর্হিতার ধ্যান কাটে নায়েলের কণ্ঠে—

“এখন বলুন তার বিনিময়ে আমি কী পাবো?”

অর্হিতা চোখের আয়তণ সংকুচন করে বলল—

“আপনি কী পাবেন মানে? আপনাকে আমি কী দেবো?”

“যা আমার চাই।”

অর্হিতা বিরক্তি নিয়ে উঠে বলল—

“ধুর! বসে থাকুন এখানে। আমার ঘুম পাচ্ছে।”

“আরে, এই, মিসেস অর্হিতা শুনুন।”

খলখল করে হাসে নায়েল। মেয়েটা অদ্ভুত ! দূরে গেলে বাড়ায় জ্বালা, কাছে এলে দিশেহারা!
,
,
,
সকালে জরুরি কাজ থাকায় হৃতির সাথে দেখা হয়নি নায়েলের। বিকেলে বাসায় ফিরে সে অপেক্ষমাণ হৃতির জন্য। হৃতি এলো। কিন্তু সায়াহ্নের শেষ লগ্নে। নায়েল তখনও বসার ঘরে বসে আছে। নায়েলকে দেখে একরকম লুকোচুরি করে নিজের কক্ষে পা বাড়ায় হৃতি। বাসায় এসেই যে নায়েলের সম্মুখিন হবে তা সে ভাবতে পারেনি। প্রায় আধঘণ্টা পরও যখন হৃতি এলো না তখন নায়েল নিজেই তার কক্ষে গেল। বাইরে থেকে নক করতেই থিতিয়ে থাকা হৃতি সরব হলো। নায়েলকে দেখেই অপ্রস্তুত ভঙিতে নিজেকে গোটাতে থাকল। নায়েল চোখের সাহায্যে হৃতিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে। হৃতি অস্বাভাবিক আচরণ করছে। নায়েল কাঠ গলায় বলল—

“এতক্ষণ কোথায় ছিলে?”

ঢোক গিলল হৃতি। মৃদু গলায় বলল—

“কলেজে।”

নায়েল হাত ঘড়িতে তাকায়। বলল—

“সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। বিকেল চারটায় ছুটি। এত সময় কোথায় ছিলে?”

হৃতি থতমত খেয়ে বলল—

“বান্ধবীদের সাথে গেছিলাম। তাই…।”

“মিথ্যে বলছ। কোথায় ছিলে হৃতি? এনি থিংক রং?”

“না, না। আমি ঠিক আছি। তুমি যাও।”

নায়েলের চোখ পড়ে হৃতির হাতে। খপ করে তা ধরে তীক্ষ্ম স্বরে বলল—

“তোমার হাতে কী হয়েছে? পুড়লো কী করে?”

হৃতি নিজের হাতের দিকে তাকায়। জলন্ত সিগারেটের পোড়া দাগ। হৃতির মোমের মতো শরীরে কৃষ্ণ গহ্বর তৈরি করেছে। সিক্ত হয় তার আঁখিজোড়া। নায়েলকে জোর করে কক্ষ থেকে বের করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—

“তুমি যাও, যাও এখান থেকে। কিছু হয়নি আমার। যাও এখান থেকে।”

নায়েল ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। ঠিক পিউলী যেন অভিমান করে কাঁদছে। নায়েল দরজায় চাপড় বসাতে থাকে।

“হৃতি দরজা খোলো। কী হয়েছে তোমার?হৃতি!”

অর্হিতা এসে দাঁড়িয়েছে পাশেই। সন্দিহান গলায় বলল—

“কী হয়েছে?”

নায়েল নাকের ডগা ফুলিয়ে বলল—

“হয়েছে তো কিছু একটা।”

গজগজ করতে থাকে নায়েল। বিছানায় শুয়ে ঝমঝমিয়ে কাঁদছে হৃতি। এত বড়ো ভুল সে কী করে করল? এর মাসুল তাকেই দিতে হবে।
,
,
,
নওশাদ সাহেবের কোলে বসে কার্টুন দেখছে পিউলী। ডিভানের কোণে বসে আছেন সায়েরা। নায়েল কোনো সাড়া না দিয়েই ভেতরে ঢুকে পড়ে। বিব্রত চোখে তাকাল সায়েরা। নায়েল কখনো এমন করে না। তার বাদামী রঙটায় আগুন ধরেছে যেন! গটগট করে বলল—

“হৃতির কী হয়েছে বলোতো? ও কী কারো সাথে রিলেশনে জড়িয়েছে?”

সায়েরা ফাঁকা ঢোক গিললেন। ঊষর গলায় বিস্ময় নিয়ে বললেন—

“এসব কী বলছ তুমি?”

“ঠিক ই বলছি। ওর হাত দেখেছ? যেন কেউ জ্বলন্ত সিগারেটের ফিল্টার লাগিয়ে দিয়েছে। আই সয়ের, যদি কোনো এড়েগেড়ে ছেলের পাল্লায় ও পড়েছে তাহলে কিন্তু ভালো হবে না। সাবধান করে দিয়ো ওকে।”

পিউলীর কৌতূহল দমাতে নওশাদ সাহেব তাকে টিভিতে ব্যস্ত করলেন। বিভিন্ন কথা বলে ভোলাতে চেষ্টা করছেন। সায়েরা দ্বিধান্বিত ! ভয়ে জবুথবু সায়েরা নিজের প্রশান্তিময়ী জায়গা খুঁজে নিয়ে কাউকে কল করে। ওপাশের ব্যক্তি যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। কল রিসিভ করেই বিশ্রি রকম হাসল। সায়েরা খনখনে গলায় বললেন—

” এসব কী শুরু করেছিস তুই? কী করেছিস মেয়েটার সাথে?”

ওপাশের ব্যক্তিটি বাঁকা হাসল। তার ঠোঁটের ভাজে জ্বলন্ত সিগারেট। দুই আঙুলের ভাঁজে নিয়ে মুখ ভর্তি ধোঁয়ার কুন্ডলি বিক্ষিপ্ত করল। প্রকীর্ণ হলো ছোট্ট খুপড়ি কক্ষে। চেয়ারে হেলান দিয়ে আরেক চেয়ারে অদ্ভুত ভঙিতে পা তুলে রেখেছে। রঞ্জিত চোখে দীর্ঘ পল্লব। মেঘবর্ণ মুখে সিগারেট পোড়া ওষ্ঠাধর। কণ্ঠে জীর্ণতা।

“টাকা কোথায় আমার?”

সায়েরা চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন—

“পনেরো দিন আগেই তোকে টাকা দিয়েছি। শেষ করে ফেললি! এত টাকা দিয়ে করিস কী তুই? এই মাসে তুই দুই বার টাকা নিয়েছিস।”

ব্যক্তিটি আঙুলের ভাঁজের সিগারেটটি মুখে পুড়ল। একটা দীর্ঘ টান মেরে মুখ থেকে সরিয়ে নিল। আয়েশি ভঙ্গিতে ধোঁয়া ছেড়ে বলল—

“কী করেছি জানি না। টাকা লাগবে আমার। ব্যবস্থা কোরো। না হলে তোমার ওই নায়েল আনসারীর মান সম্মান নিলামে ওঠাব আমি। জাস্ট এক মিনিট লাগবে আমার। ওই হৃতির অ্যাডাল্ট ভিডিয়ো ভাইরাল করতে। তখন তোমার নায়েল মুখ লুকাতে পারবে না।”

সায়েরা তেঁতে উঠলেন। গরগর করে বললেন—

“আমি তোকে হৃতিকে ভালোবাসতে বলেছি। আর তুই মেয়েটার সাথে এই জঘন্য কাজ করলি!”

বিশ্রি রকম চাপা হাসে ব্যক্তিটি। ভরাট গলায় বলল—

“ভালো বিয়ের পর বাসব। এখন এনজয়! টাকার ব্যবস্থা কোরো আমার আর না হলে ওই বাড়িতে আমার এন্ট্রির। নাহলে ওই হৃতিকে আমি বাজারে উঠিয়ে ছাড়ব।”

“সুহাস!”

ব্যক্তিটি খিঁচতি মেরে হাসে। কল কেটে অ্যাশ ট্রেতে সিগারেটের ফিল্টার ফেলে একটা সিরিঞ্জ নেয়। নিজের হাতে পুশ করে তৃপ্তিকর হাসে। শরীরটা এলিয়ে দেয় পুরোদস্তুর চেয়ারে।

চলবে,,,
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here