জঠর পর্ব ১৯+২০

#জঠর
#পর্বঃ১৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

“মামুনি জানো ওই আঙ্কল না পঁচা জিনিস খায়। ছিঃ গন্ধ! ধোঁয়া, ধোঁয়া।”

অর্হিতা ভাবুক নয়নে তাকায়। তার বুঝতে বাকি নেই পিউলী কীসের কথা বলছে। আজকাল হৃতির ঘরে গেলে সিগারেটের উৎকট গন্ধ লাগে! পিউলী নিশ্চয়ই সুহাসকে সিগারেট খেতে দেখেছে।

“জানো মামুনি, তমাল ভাইয়াও খায়। কী পঁচা!”

“এসব বলে না। থাক, আর তুমি পাপাকে বলিয়ো না আঙ্কলের কথা। ঠিক আছে?”

“ওকে মামুনি।”

পিউলীকে কোলে তুলে নেয় অর্হিতা। নিচে এসে ডাইনিং চেয়ারে বসায়।

“তুমি বসো, মামুনি দুধ নিয়ে আসি।”

“হুম, হুম।”

অর্হিতা রান্নাঘরে গেলে পিউলী ডাইনিং চেয়ারে চিবুক লাগিয়ে বসে থাকে। সুহাসকে দেখে সরব হয় পিউলী। চিবুক উঠিয়ে গোল গোল চোখে চেয়ে থাকে। সুহাস একটা চেয়ার টান দিয়ে পিউলীর পাশেই বসে। সকালে খাওয়া হয়নি তার। নায়েলকে দেখলেই মাথার শিরা কম্পিত হয় সুহাসের। তাই তাকে এড়িয়ে চলার যথাসাধ্য চেষ্টা করে সুহাস।

পিউলী আধো আধো গলায় বলল—

“তুমি হৃতি আনটিকে বিয়ে করেছ?”

ছোট্ট করে হাসে সুহাস। মাথাটা ঝাঁকিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজ করে বলল—

“হু।”

“তোমার নাম কী?”

“সুহাস। আর তোমার?”

“আমি পিউলী। তুমি দুধ খাবে?”

সুহাস গালভর্তি হেসে বলল—

“না।”

পিউলীর মুখটা চুপসে যায়। দুঃখী দুঃখী গলায় বলল—

“কেন?”

সুহাস হেসে হেসে বলল—

“আমি তো আর তোমার মতো বাবু নই।”

“দুধ খেলে শত্তি হয়। মামুনি বলেছে।”

পিউলীর কথায় প্রসন্ন হাসে সুহাস। মেয়েটা কী মিষ্টি!

“তুমি কিকেট খেলতে পারো?”

“হুম।”

“ইয়েহ! তুমি দাঁড়াও, আমি আসছি।”

পিউলী চেয়ার থেকে নেমে তার ছোট্ট ছোট্ট পায়ে এলোমেলো দৌড়াতে থাকে। টেবিলে রাখা বাদামের বাটি থেকে দুটো বাদাম মুখে পুরে নেয় সুহাস। অর্হিতা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে সন্ধানী গলায় বলল—

“পিউ কোথায়?”

মুহূর্তেই সিঁড়ির দিক থেকে ঠকঠক আওয়াজ আসছে। ছোট্ট পিউলীর ক্রিকেট ব্যাট দ্বন্ধ লাগিয়েছে সিঁড়ির সাথে। সুহাসের কাছে এসে দাঁড়ায় পিউলী। চোখভরা আশা নিয়ে বলল—

“বল নাও।”

সুহাস টেনিস বলটা হাতে নেয়। পিউলী সুহাসের আঙুল আঁকড়ে ধরে। টুকটুক করে বলল—

“চলো, চলো আঙ্কল। আমরা খেলব।”

অর্হিতা বাঁধা দিয়ে বলল—

“পিউ দুধটা খেয়ে যাও সোনা।”

“না। খাবো না এখন। আমি খেলব। চলো আঙ্কল।”

সুহাস মৃদুহাস্য অধরে বলল—

“চলো।”

সুহাসকে টেনে টেনে ব্যাক ইয়ার্ডে নিয়ে যায় পিউলী। গাছগাছালির মায়ার ঘেরা শান্ত পরিবেশ। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া। পত্র-পল্লবে নিবিড় ছায়ায় রোদ্দুর ঝলসানো তাপ নেই বললেই চলে। পিউলীর খুশি তার চোখে -মুখে উপচে পড়ছে। অতি সাবধানে বল ছুড়ে দেয় সুহাস। পাছে পিউলীর লেগে না যায়!
অকস্মাৎ ব্যাট হাতে দৌড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে পিউলী। মাখনের শরীরে আঘাত লেগেছে। থামায় কার সাধ্যি! একটুখানি ব্যাথাতেই পুরো বাড়ির আঙিনা কাঁপিয়ে ফেলল পিউলী। অর্হিতা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসে। তার কান মিথ্যে শুনেনি। অস্পষ্ট আওয়াজ শুনে দৌড়ে আসে সে। পিউলী তখন সুহাসের ক্রোড়ে।

“কী হয়েছে?”

“তেমন কিছু নয়। খেলতে গিয়ে পড়ে গেছে।”

“এই জন্যই আমি বারণ করেছি।”

“বাচ্চা মানুষ! খেলতে গিয়ে একটু পড়বেই। এত চিন্তার কিছু নেই ভাবীজান।”

“দিন ওকে আমার কাছে।”

“একটা বাচ্চাকে সামলানোর ক্ষমতা আছে আমার। চলুন।”

পিউলী সমানতালে কেঁদেই যাচ্ছে। ক্রন্দনরত গলায় তার একটাই আবদার,” পাপাকে ডাকো, পাপাকে ডাকো।” প্রথমে বাঁধ সাধলেও পরে নায়েলকে কল করে অর্হিতা। কারো কথায় কান্না থামছে না পিউলীর। যতক্ষন না নায়েল এসে পিউলীকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে।

বাবার কোলে শান্ত হয়ে লেপ্টে আছে পিউলী। কাঁদতে কাঁদতে ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে। চোখ ফুলে টমেটো! ঘুমিয়ে পড়েছে কিছুক্ষণ আগেই। নায়েল নম্র স্বরে বলল—

“আপনার খেয়াল রাখা উচিত ছিল অর্হিতা।”

অর্হিতা ফ্যাকাশে গলায় বলল—

“আসলে আমি….।”

“ভাবীজানের কোনো দোষ নেই বড়ো ভাই। আর বাচ্চা মানুষ, একটু আকটু পড়বেই। নাহলে বুঝবে কী করে ব্যাথায় যন্ত্রণা কত হয়!”

শেষের লাইটা কেমন অদ্ভুত শোনালো অর্হিতার কাছে। তাতে রোষ ছিল।
নায়েল তীর্যক গলায় বলল—

“কী বলতে চাও তুমি?”

“তেমন কিছু না। খেলতে গিয়ে পড়েছে। মলম লাগিয়ে দিন ঠিক হয়ে যাবে। এইটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার প্রয়োজন নেই।”

“জাস্ট শাট আপ। দায়িত্ব নিলে তা পালন করতে হয়। ও তোমার সাথে খেলতে গেছে, সেক্ষেত্রে তোমার ওর খেয়াল রাখা উচিত ছিল।”

নায়েলের জোর গলায় নড়ে ওঠে পিউলী। সুহাস ঝরা হাসে। রসালো গলায় বলল—

“বড়ো ভাই, ব্যাটসম্যান ব্যাট নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেছে, সেখানে বোলার কী করতে পারে বলুন? সেইটা তো বোলারের জন্য সুযোগ!”

দাঁত কিড়মিড় করে নায়েল। অগত্যা সে চুপ করে রইল। স্বগতোক্তি( মনে মনে বিড়বিড় করা) করে সুহাস,” নিজের সন্তান না হওয়া সত্ত্বেও একটুখানিতে এত কষ্ট লাগছে তোর! আর তোর কারণে যে আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি তার হিসেব কে দেবে? তোকে যদি আমি পাগলা কুকুরের মতো দৌড় না করিয়েছি, তো আমিও সুহাস নই মনে রাখিস।”
,
,
,
মুখ নিঃসৃত ধোঁয়ায় অবগাহন( গোসল,সিক্ত) করছে সুহাস। বিছানায় আরাম করে বসে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। পড়ার টেবিলে বসে আছে হৃতি। সিগারেটের গন্ধে পড়ায় মন বসাতে পারছে না। গা গুলিয়ে উঠছে তার। তবুও বইয়ের দিকে তাকিয়ে ঠাঁয় বসে আছে। সুহাস কোমল গলায় ডেকে উঠে—

“হৃতি, তোমার পরীক্ষা কবে?”

হৃতি সহজ গলায় প্রত্যুক্তি করে—

“আগামী মাসে।”

“এদিকে এসো।”

সুহাসের সামনে এসে বসে হৃতি। তার মুখভর্তি ধোঁয়ার পাক ছুড়ে দেয় হৃতির স্বচ্ছ মুখে। কেঁশে ওঠে হৃতি। অনুরক্তির সুরে বলল—

“এসব কেন খাও তুমি?”

সুহাস লম্বা টান মারে সিগারেটের ফিল্টারে। শূন্যে ধোঁয়া ছুড়ে বলল—

“পৃথিবী ভুলতে।”

হৃতির করুন দৃষ্টি। সিগারেটের বাকি অংশ অ্যাশ ট্রেতে রেখে হৃতির হাত নিজের হাতে নেয় সুহাস। হাতের উলটো পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল—

“নায়েল পিউলীর বায়োলজিক্যাল ফাদার নয় তাই না?”

হৃতি নির্বিকার গলায় বলল—

“হুম।”

“পিউলীর বাবা কোথায় জানো?”

“না। আমি কখনো তাকে দেখিনি।”

সুহাস রহস্য হাসে। হৃতি সংকীর্ণ গলায় বলল—

“তুমি এমন কেন করছ সুহাস? এসব নেশা কেন ছেড়ে দিচ্ছ না?”

“তোর কথায় ছেড়ে দেবো? কে তুই আমার? যা এখান থেকে।”

টলটল করে ওঠে হৃতির চোখ। হৃতি ভেজা গলায় প্রশ্ন করে—

“কেন এমন করছ তুমি? কী করেছি আমি?”

সুহাস তেড়ে যায়। ক্ষুব্ধ গলায় বলল—

“কী করিস না তোরা? তোরা মেয়েরা সব পারিস। টাকার জন্য নিজের সন্তানকে ফেলে আসতে পারিস, টাকার জন্য নিজের অনাগত সন্তানকে মেরে ফেলতে পারিস, টাকার জন্য ভালোবাসার মানুষকে রাস্তায় ফেলে আসতে পারিস। টাকাই সব তোদের কাছে সব। মানি ইজ লাইফ, মানি ইজ লাভ। এখন আমার কাছেও তা। কেউ যদি আমাকে দশ লাখ টাকা দিয়ে বলে তোকে দিয়ে দিতে, আমি দিয়ে দেবো। টাকা চাই আমার।”

ঝমঝম করে কেঁদে ফেলে হৃতি। সন্তর্পনে সুহাসের হাত তার নিজের বক্ষস্থলে চেপে ধরে বলল—

“তোমার হৃৎপিন্ডে হাত রেখে বলো, তুমি পারবে টাকার জন্য আমাকে অন্য কারো কাছে দিয়ে দিতে? সহ্য করতে পারবে তোমার সামনে অন্য কেউ আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলে? ভাবতে পারবে তোমার জায়গায় অন্য কেউ আমাকে ভালোবেসে আদর করছে?”

সুহাসের মেজাজ চওড়া হয়। খটমটিয়ে উঠে বলল—

“একদম ন্যাকামি করবি না আমার সামনে। যা এখান থেকে। যা আমার চোখের সামনে থেকে।”

হৃতির চোখের শ্রাবণে প্লাবিত হচ্ছে তার কপোল(গাল)। সে জানে, সুহাস তাকে ভালোবাসে। একদিন কলেজের সামনে একটা ছেলে হৃতিকে টিজ করেছিল বলে ছেলেটিকে ইচ্ছেমতো রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে ছিল সুহাস। কলেজের প্রায় ডজনখানেক শিক্ষার্থীর সামনে তাকে প্রপোজ করেছে। কিন্তু সেই মানুষটাই হঠাৎ বদলে গেল। কেন?
তার উত্তর হৃতি জানে না।
#জঠর
#পর্বঃ২০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ছোটো ছোটো চোখের পক্ষ্মচ্ছায়া( চোখের পল্লব) মেলে তাকিয়ে আছে পিউলী। নিমগ্ন দৃষ্টি তার। তন্দ্রায় বিভোর সুহাস। বিছানার সাথে বুক চেপে রেখেছে। পিউলী তার ছোটো ছোটো বাহুর নরম স্পর্শ আঁকে সুহাসের অনাবৃত প্রশস্ত পিঠে। নড়বড়ে ঘুমের মধ্যে মৃদু কুঞ্চন ওঠে সুহাসের পুরু ভ্রুযুগলে। অতি কষ্টে চোখের পল্লব মেলে ধরে সে। পাশ ফিরে চাইল। পিউলীর ইঁদুর দাঁতে প্রাণবন্ত হাসি। শ্রান্ত মুখে তাকায় সুহাস। চোখভর্তি ক্লান্ত হাসি। নম্র সুরে বলল—

“তুমি এখানে?”

পিউলী হি হি করে হাসে। খুশি খুশি গলায় বলল—

“তুমি এই পঁচা জিনিস কেন খাও আঙ্কল?”

বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলটার উপর সিগারেটের ছাঁইয়ের ছড়াছড়ি। কার্পেটের উপর ফিল্টার। সুহাস স্মিত হাসে। তার আড়ষ্ট শরীরকে সচল করে বা’হাতটা পিউলীর গালে স্পর্শ করে বলল—

“তুমি এখানে আর এসো না পিউ।”

“কেন?”

“এই যে আঙ্কল পঁচা জিনিস খাই।”

“তুমি আর খেয়ো না। ”

হেয়ালি হাসে সুহাস। তার উদ্দেশ্যহীন জীবন চলছেই নিকোটিনের ধোঁয়ায়। কলকলিয়ে হেসে ওঠে পিউলী। অকস্মাৎ সেই হাসিতে ভ্রু নাচায় সুহাস। চোখ পিটপিট করে বলল—

“হাসছ কেন পিউ?”

পিউলী মুখে হাত দেয়। তার চিকন দাঁতের হাসিতে প্রফুল্ল হয় সুহাসের অন্তঃকরণ(মন)। সুহাস চোখের চাহনি দৃঢ় করে। পিউলী সন্দিহান গলায় বলল—

“তুমি খালি গায়ে ঘুমাও কেন? তোমার জামা নেই?”

অধর জোড়া মুদিত অবস্থায় চওড়া করে সুহাস। বলল—

“আমার গরম লাগে।”

“ওই যে ফ্যান চলছে!”

সুহাস সিলিং ফ্যানের দিকে তাকায়। গাঢ় গলায় বলল—

“তবুও গরম লাগে।”

পিউলী একগাল হেসে বলল—

“তাহলে পাপাকে বলব তোমার ঘরে এসি লাগিয়ে দিতে। তারপর ঠান্ডা, ঠান্ডা।”

মুক্ত হাসে সুহাস। পিউলীর চোখের তারায় প্রাণাবেগ। সুহাস বিমোহিত হয়।

“তুমি এসি চিনো?”

“হুম। পাপার ঘরে আছে। ঠান্ডা, ঠান্ডা। ”

“তোমার ঘরে নেই?”

“না। আমি বড়ো হলে আমার ঘরে দেবে। তুমি আমার ঘরে যাওনি কেন? চলো, চলো, যাবে আমার ঘরে।”

পিউলী শায়িত সুহাসের হাত ধরে টানতে থাকে। সুহাস আপত্তি করে বলল—

“এখন না পিউ। পরে যাব।”

পিউলীকে চুমু খাওয়ার জন্য মুখ বাড়ায় সুহাস। পিউলী সরে আসে। চট করে বলল—

“না,না। তুমি ব্রাশ করোনি। যাও ব্রাশ করে আসো।”

সুহাস দিলখোলা হাসে। দুই হাতের ভর দিয়ে ওঠে বসে। ওয়াশরুমে যায়। হৃতি এসে সুহাসকে খুঁজতে থাকে। পেল না সে। টিমটিমে চোখে চেয়ে আছে পিউলী। তাকে জিজ্ঞেস করতেই হৃতি অবগত হয় সুহাসের ব্যাপারে। বিদ্যুৎ বেগে এক বুদ্ধি খেলে গেল হৃতির মস্তিষ্কের স্নায়ুতে। সে পিউলীকে কানে কানে কিছু একটা বলতেই উৎফুল্ল হয় পিউলী।

সুহাস ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে পিউলী এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সুহাসের পায়ের কাছে এসে দাঁড়ায় পিউলী। একটা আঙুল দিয়ে সুহাসের পায়ে বেল বাজানোর মতো করে নক করে। সুহাস হাতের তোয়ালেটা রেখে নিচু হয়ে বসে। পিউলীর দুই হাতের বাজু ধরে স্থবির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। চকিতে নিজের অনাগত সন্তানকে দেখতে পেল সুহাস। যাকে সে আর কোনোদিনও দেখতে পাবে না। ছলছল করে ওঠে সুহাসের চোখ। পিউলী আদুরে গলায় বলল—

“আঙ্কল খাবে না? চলো।”

নিজের ধাতস্থ করে সুহাস। অধর বিস্তৃত করে বলল—

“না, পিউ। তুমি যাও।”

“না। সকালে খেতে হয়।”

পিউলী বাঁধা মানলো না। অবাধ্য শিশুকে যেমন মা জোর করে, ঠিক তেমনটাই করল পিউলী।
,
,
,
“পিউ কোথায়?”

নায়েলের করা প্রশ্নে হৃতি রয়ে সয়ে প্রত্যুত্তর করে—

“ও আমার ঘরে।”

“তুমি এখানে তো পিউ তোমার ঘরে কেন?”

“সুহাস আছে।”

চোয়াল শক্ত করে নায়েল। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষন করতেই পিউলী গলার আওয়াজ ভেসে আসে।

” এসো আঙ্কল, এসো।”

নায়েলের বিক্ষুব্ধ দৃষ্টি। সুহাস তরল চোখে চাইল সবার দিকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সায়েরা। ছেলেটাকে আজ নিজ চোখে খেতে দেখতে পাবে সে!

“হৃতি আনটি ওঠো। এখানে আঙ্কল বসবে।”

হৃতিকে উঠিয়ে সেখানে সুহাসের বসার ব্যবস্থা করে পিউলী। একপাশে নায়েল আরেকপাশে সুহাস বসেছে পিউলীর। হৃতির দৃষ্টিতে চঞ্চলতা। দুই পা দোলাতে থাকে পিউলী। উচ্ছ্বসিত সে। সুহাসের সরল কাঠখোট্টা চাহনি। পিউলী আবদার করে—

“মামুনি, আঙ্কলকে খেতে দাও।”

অর্হিতা হেসে বলল—

“দিচ্ছি পিউ। তুমি তোমার ব্রেড খাও।”

“না, আগে আঙ্কলকে দাও।”

অর্হিতা গরম দুধ নিয়ে পিউলীর পাশে এসে দাঁড়ায়। টেবিলে রাখতে যাবে তৎক্ষণাৎ পিউলী সামনের দিকে হাত বাড়াতেই গরম দুধের গ্লাসে ধাক্কা লেগে অর্হিতার হাত থেকে গ্লাস পড়ে যায় টেবিলে। গলগলিয়ে দুধের গ্লাস খালি হলো। তা টেবিল ক্লথ বেয়ে পড়ল নিচে, যেখানে ছিল পিউলীর পা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে পিউলীর চেয়ারকে হাত দিয়ে ধাক্কা মারে সুহাস। তাতে পিউলীর চেয়ার খানিকটা পিছিয়ে যায় আর গরম দুধের বেশিরভাগ অংশ পড়ে সুহাসের হাতে। হঠাৎ ঘটা এই ঘটনায় চকিত সবাই। লাফিয়ে ওঠে সকলে। সায়েরা দ্রুত এসে সুহাসের হাত চেপে ধরে। সকলের উৎসুক দৃষ্টি।

“তুই ঠিক আছিস? জ্বলছে তোর হাত? দেখি কোথায় লেগেছে?”

সুহাস সকলের দিকে চোখ বোলাল। রোষিত গলায় বলল—

“হাতটা ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি।”

পিউলী ঝমঝমিয়ে কেঁদে ফেলে। তাকে কোলে নিয়ে নেয় নায়েল। ভয় পেয়েছে মেয়েটা। বুকের ভেতরের হৃৎপিন্ড লাফিয়ে যাচ্ছে। সুহাস গজগজ করে চলে যায় সেখান থেকে। খাওয়া হলো না তার। দেখা হলো না এক পিপাসার্ত মায়ের নিজের ছেলের খাওয়ার দৃশ্য।
,
,
,
ঘরময় পায়চারী করছে নায়েল। তার তাপিত মস্তিষ্কের কোণায় কোণায় অচ্ছুত( ছোঁয়া যায় না এমন) ত্রাসেরা আলোড়ন শুরু করেছে। জেঁকে ধরেছে তাকে এক কল্পনাতীত দুর্নিবার প্রলয়। সুহাস আশেপাশে থাকলেই কেন পিউলীর সাথে দুর্ঘটনা ঘটে! নায়েলের মনে হচ্ছে সে অদৃশ্য ঘাতক হয়তো পিউলীর আশেপাশেই আছে। চর্মচক্ষুতে তা দৃশ্যত নয়। বুকে কম্পন হয় নায়েলের। বোনের শেষ চিহ্নকে সে কোনোভাবেই আঘাতপ্রাপ্ত হতে দেবে না।
অর্হিতা দাঁড়িয়ে আছে বহুসময়। নিজের মাত্রাতিরিক্ত চিন্তায় বিভোর নায়েলের দৃষ্টিগোচর হলো না সে। অর্হিতা ধীর গলায় ডেকে উঠে—

“নায়েল!”

চকিত ধ্যাণ ছুটে নায়েলের। সামনে চোখ তুলে তাকায় সে। অর্হিতাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল—-

“পিউ কোথায়?”

অর্হিতা সহজ গলায় বলল—

“ও হৃতির ঘরে।”

“হৃতির ঘরে কেন?”

“জেদ ধরেছে সুহাসের কাছে যাবে।”

“ও বললেই যেতে দিতে হবে?”

নায়েল ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে দমদম করে পা ফেলে নিচে আসে। অর্হিতা কিছু বলার সুযোগ পেল না।
,
,
,
বিছানায় আসন পেতে বসে আছে সুহাস। তার উরুর উপর বসে আছে পিউলী। গরম দুধ পড়ায় সুহাসের রোমশ হাত লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। কুটকুট করে জ্বালা হচ্ছে হাতে। হৃতি বার্নল লাগিয়ে দিয়েছে। ফ্যানের নিচে হাত দিয়ে রেখেছে সুহাস। ছোট্ট লাল ঠোঁট দুটো বলয় করে সুহাসের হাতে মাতৃস্নেহের সাথে ফুঁ দিচ্ছে পিউলী।

“ব্যাথা করছে আঙ্কল?”

সুহাস ঘাড় বাকিয়ে পিউলীর নরম তুলতুলে গালে চুমু বসায়। আলতো গলায় বলল—

“না।”

“তুমি কেঁদো না। ভালো হয়ে যাবে।”

“জানি। সময়ের সাথে ক্ষত শুকিয়ে যায়, শুধু স্মৃতির পাতায় রয়ে যায় তার যন্ত্রণা!”

হৃতি ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুহাসের কথার অর্থোদ্বারের চেষ্টা করল। কিন্ত পারল না।
নায়েল তটস্থ হয়ে হৃতির কক্ষে ঢোকে। পিউলী চট করে ওঠে দাঁড়ায়। গলা চড়িয়ে বলল—

“পাপা!”

নায়েল অস্থির হয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে নেয়। ঘরের দিকে ভালো করে তাকিয়ে সুশ্রী আনন গম্ভীর করে। কাষ্ঠ গলায় বলল—

“ঘরের একি অবস্থা হৃতি? বাসায় একটা বাচ্চা আছে, সেইটা নিশ্চয়ই তুমি জানো?”

সুহাস গূঢ় হাসে। খেয়ালিপনায় বলল—

“বড়ো ভাই, আপনার মেয়েকে আমি এখানে আসতে বলিনি। আর ঘরটা যেহেতু হৃতির ওকে ওর মতো থাকতে দিন।”

“ঘরটা হৃতির হলেও বাড়িটা আমার।”

সুহাস চাপা হাসে। শ্লেষাত্মক গলায় বলল—

“ব্যাগ গুছা হৃতি। তোর বড়ো লোক নায়েল ভাই…উফ! সরি। ভাই তো ডাকিস না। কে জানে, কী সম্পর্ক তোদের! চল, তোকে নিয়ে না হয় হোটেলেই থাকব।”

নায়েলের থিতিয়ে থাকা রাগ তরতর করে ছড়িয়ে পড়ল পুরো দেহপিঞ্জরে। রাগ গলার মধ্যে চেপে রেখে বলল—

“পিউ, মামুনির কাছে যাও। ”

পিউলীকে কোল থেকে নামাতেই সে ছুট লাগায়। নায়েল ধীরপায়ে এগিয়ে আসে সুহাসের কাছে। সুহাস বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়।

“কী বললে তুমি ওকে?”

সুহাস বাঁকা হেসে বলল—

“চাইনিজ ভাষায় তো বলিনি। বাংলায় বলেছি। বুঝতে পারেননি বড়ো ভাই? আরেকবার বলব?”

“ওকে তুই কেন বললে?”

“আমার বউ, আমার যা ইচ্ছে বলব। তাতে কার বাঁড়া ভাতে পানি ঢাললাম!”

নায়েল ফুঁসে উঠে বলল—

“মানে কী এসবের? বউ হয় তোমার, কাজের লোক নয়। আর এই বাড়িতে কাজের লোকদেরও তাদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয়। ”

সুহাস ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে কটাক্ষ গলায় বলল—

“টাকার যারায় মানুষ বেচাকেনা করে তাদের মুখে এই কথা মানায় না বড়ো ভাই। নিজের চরকায় তেল দিন। আমারটা আমি বুঝব।
ভাবীজানকে তো টাকা দিয়েই কিনে এনেছেন। টাকায় কি না করে!”

নায়েল রাগে বিহ্বল হয়ে এক চড় বসায় সুহাসের গালে। সুহাস বিক্ষুব্ধ হয়ে নায়েলের কলার চেপে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় পাথর বনে যায় হৃতি। একে অপরকে শাসানোর এক পর্যায়ে সায়েরা এসে ধাক্কা লাগায় নায়েলকে। দেয়ালে ছিটকে পড়ে নায়েল।

চলবে,,,
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here