#জঠর
#পর্বঃ২৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
একটা ছোট্ট গাড়ি নিয়ে খেলছে পিউলী। নিজের হাত দিয়েই সেটাকে মেঝের বুকে ভ্রমন করাচ্ছে। অর্হিতার হাতে পিউলীর শ্রেণি পরীক্ষার পেপার। সেগুলো মনোযোগ সহকারে দেখছে সে। পিউলী হঠাৎ থমকে গিয়ে থমথমে গলায় বলল—
“মামুনি, আমি সুহাস আঙ্কলের কাছে যাই?”
ব্যস্ত থাকায় পিউলীর কথায় ততটা অভিনিবেশ ছিল না অর্হিতার। সে আনমনেই বলল—
“যাও।”
পিউলী হাতে চাঁদ পেল। ব্যস্তসমস্ত হয়ে দরজা খুলেই ছুট লাগালো।
প্রভাতের একনিষ্ঠ বেলা। পূর্বাকাশে উদিত সূর্যের ঝলমলে মিঠে রোদে তপ্ত হচ্ছে ধরণী। সোনাঝরা রোদ নীলাভ আকাশ ছাড়িয়ে মৃত্তিকার বুকে দোল খেলছে। কোলাহল শুরু হয়েছে পরিবেশে। পাশের নারকেল গাছটায় দুটো কাক বসে আছে। তাদের কর্কশ স্বর ভেসে আসছে জানালা ভেদ করে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে চোখের কোণ সংকুচন করে নায়েল। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে কিছু একটা দেখছে অর্হিতা। ঘড়ির কাটা ছুঁইছে আটটার ঘর। নায়েল তৈরি হচ্ছে অফিসের জন্য। জলপাই রঙা শার্টটা পরে ভ্রূ নাচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে নায়েল—
” এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছেন?”
অর্হিতা চমকে তাকায়। অধর বিস্তৃত হয়। তপ্ত মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টির হাসি। বিছানা থেকে ওঠে আসে। নায়েলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল—
“দেখুন, পিউর ক্লাস টেস্টের খাতা দিয়েছে।”
নায়েল পেপারগুলো হাতে নিল। পেপারের কোণায় মার্কের জায়গাটা চক্ষুগোচর হতেই ফিক করে হেসে ফেলে। অর্হিতা রাগ হয়। নাক ফুলিয়ে বলল—
“হাসছেন কেন?”
নায়েল অতি কষ্টে হাসি রোধ করে। তবুও পুরু অধর ভেদ করে হাসির ফোয়ারা যেন সবকিছু বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসবে!
অধরের কোণ চেপে ধরে অর্হিতা। পেপারগুলো খপ করে নিয়ে বলল—
“হাসছেন কেন আপনি?”
“পনেরো নম্বরে পরীক্ষা। একটাতে সাত, একটাতে ছয় আর বাংলাতে পাঁচ! এইগুলো কোনো নাম্বার হলো?”
অর্হিতা প্রতিবাদ করে বলল—
“হবে না কেন? ভালোই করেছে আমার মেয়ে।”
“তাই বলে বাংলায় পাঁচ?”
“তো! ইংলিশ মিডিমায়ে ‘ও’ লেবেলের বাচ্চারাও বাংলা বারো মাসের নাম পারে না। সেখানে আমার মেয়ে ভালোই পেয়েছে।”
নায়েল চোরা হাসে। অর্হিতাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল—
“তাই বলেন। নিহিতা অঙ্কে হান্ড্রেডে এইটি নিয়ে আসত।”
স্বামীর দিকে হেয়ালি দৃষ্টিতে তাকিয়ে অর্হিতার স্বত:স্ফূর্ত উত্তর—
“নির্ঘাত আপনি লাড্ডু নিয়ে আসতেন। বাবার ধারা পেয়েছে মেয়ে।”
নায়েল হাতের বাঁধন শক্ত করে। গেথে যায় তার বক্ষ:স্থলে অর্হিতা। অর্হিতার কপালে নায়েলের উষ্ণ শ্বাসের পতন হচ্ছে। নায়েল হেসে হেসে বলল—
“মোটেও না। ম্যাথে অলওয়েজ টপ করেছি আমি। মাধ্যমিকে পুরো স্কুলে হায়ার ম্যাথে পাঁচ বছরের রেকর্ড ভেঙেছিলাম। পিউর কপাল ভালো না। সম্ভবত তার অরি মামুনির রেকর্ড ভালো না।”
“জি না মি. গিরগিরি। রেকর্ড না করি। তবে পাশ করেছি সবসময়।”
“তাই বলুন। টিটিপি টিচার হলে স্টুডেন্টকে তো ভুগতেই হবে।”
অর্হিতা জিজ্ঞাসু গলায় বলল—
“টিটিপি কী?”
“টেনেটুনে পাশ!
“দুর! ছাড়েন তো।”
অর্হিতার গলদেশে ডুবে যায় নায়েল। ভুলে যাচ্ছে তার অফিসের কথা। দরজায় কড়াঘাত পড়তেই সরব হয় দুজন। নায়েল ধাতস্থ হয়ে ভেজানো দরজা ফাঁক করে চাইতেই কলরবকে দেখল। কলরব কপাল কুঞ্চি করে বলল—
“স্যার, দুইজন লোক এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে।”
নায়েলের মসৃণ চেহারায় চিন্তার ভাবাবেশ ঘটে। কুঞ্চিত ভ্রূজোড়া টানটান করে বলল—
“তুমি তাদের বসতে বলো আমি আসছি।”
“জি, স্যার।”
বসার ঘরের কাউচে বসে আছে সুহাস। তার এক উরুর উপর পা ঝুলিয়ে বসেছে পিউলী। মোবাইলের গেমে নিমগ্ন দৃষ্টি পিউলীর। চাপা উচ্ছ্বাসের সাথে বলল—
” এটাকে মারো আঙ্কল, এটাকে মারো।”
গেমের সাউন্ডের সাথে পিউলীর হাতের তালির সংমিশ্রণ চলছে। দুজন ভদ্রলোক একে অপরের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে আছে। সেদিকে পাত্তা নেই সুহাসের। নায়েল নিচে নেমে আসে। লোকদুটোকে সে আগে কখনো দেখেনি। গোল গোল আঁখিতে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ চলছে আগন্তুক দুজনের। নায়েল সরব গলায় বলল—
“আপনারা কারা?”
তাদের মধ্যে একজন উষ্ণ আলিঙ্গন করল নায়েলকে। ভদ্রলোক অমায়িক হেসে বললেন—
“আমি অ্যাডভোকেট জামিল। আমাকে বিশিষ্ট সমাজসেবী মাহিম হাওলাদার পাঠিয়েছেন।”
পাশের লোকটি মুচকি হেসে বললেন—
“আসসালামু আলাইকুম! আমি মাহিম স্যারের পি.এ।”
অনুপলেই চোয়াল ভারী হলো নায়েলের। বিক্ষিপ্ত গলায় বলল—
” এখানে কেন এসেছেন? মাহিম হাওলাদারকে আমি অফিসে আসতে বলেছি।”
পি.এ সজীব স্মিত হেসে বললেন—
“এইটা তো পারিবারিক ম্যাটার। অফিসে হবে না। উকিল সাহেব, পেপারটা মি. নায়েলকে দেখান।”
নায়েল উদ্বিগ্নতা আর ভয় মিশ্রিত গলায় বলল—
“কীসের পেপার?”
জামিল একটা রিপোর্ট এগিয়ে দিলেন। চট করে ভাবাবেশ ছাড়া তা হাতে নেয় নায়েল। ক্ষণপলেই তড়াক করে ওঠে তার মস্তিষ্ক। শিড়দাঁড়া বেয়ে নেমে যায় এক শীতল স্রোত। গর্জে ওঠে নায়েল।
“এসবের মানে কী? পিউ আমার মেয়ে।”
কথা শেষ করেই ডি.এন. এ. রিপোর্টটা ছিড়ে ছুড়ে ফেলে নায়েল। সুহাসের উরুর উপর থেকে নেমে দাঁড়ায় পিউলী। বাবার উচ্চ কণ্ঠে ভেতর কেঁপে ওঠে তার। ছুটে আসেন নওশাদ সাহেব আর সায়েরা। অর্হিতার কানেও পৌঁছাল সেই রুক্ষ স্বর। তড়িঘড়ি নেমে আসে সে।
সজীব মুক্ত গলায় বলল—
“দেখুন মি. নায়েল, স্যার এমনিতেও প্রচুর ক্ষেপে আছেন আপনার ওপর। তিনি কোনো ঝামেলা করতে চাচ্ছেন না। আপনি রিপোর্ট দেখেছেন, যদিও তার প্রয়োজন নেই। আপনি সত্য জানেন। তাই…।”
নায়েল খপ করে গলা চেপে ধরে সজীবের। দগদগে গলায় বলল—
“তাই কী? তাই কী? পিউ আমার মেয়ে। ওর দিকে হাত বাড়াতে নিষেধ করবি তোর স্যারকে। আমার বোনের মৃত্যুর সাথে ওর সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ। বের হ আমার বাড়ি থেকে। ”
“দেখুন মি. আপনি কিন্তু ভুভভভল করছেন। আমার গায়ে হাত দিয়ে একদম ঠিক করছেন না।”
নায়েল সদর্পে এক চড় বসায় সজীবের গালে। আঁতকে ওঠে উপস্থিত সকলে। পিউলী ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে অর্হিতাকে। সুহাস এগিয়ে এসে ছাড়িয়ে নেয় নায়েলকে। শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলল—
“আরে মিয়া যান তো এখান থেকে। কী না কী নিয়ে এসে বলছে পিউ তার মেয়ে! যা হবে আদালতে হবে। যান এখন এখান থেকে। ও মি. অ্যাডভোকেট, আপনাকে কী আলাদা করে বলতে হবে? না কি বড়ো ভাইয়ের দাবাং চড় একটা আপনার গালও খাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করছে!”
জামিল থতমত গলায় বলল—
“কাজটা একদম ঠিক করেননি আপনারা। মাহিম হাওলাদার কোনো ঝামেলা করতে চাননি। তাই শুধু আমাকে পাঠিয়েছেন সমঝোতার জন্য। কিন্তু আপনারা যে ব্যবহার করেছেন এইবার কেস কোর্টে উঠবে। মনে রাখবেন।”
“আরে ভাই যান তো। এইরকম কোর্ট অনেক দেখেছি।”
নায়েল কোনো কথা বলল না। দপদপিয়ে যাচ্ছে তার মস্তিষ্ক।
,
,
,
নায়েলের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় রক্তের বদলে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুটছে রকেট বেগে। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষন করে ভেবে চলছে, কী হয়েছে আর কী হতে চলেছে। নায়েল ঝাঁঝিয়ে উঠে—
“ওর সাহস কী করে হলো? উকিল পাঠিয়েছে! আমার পিউকে কেড়ে নিতে এসেছে! আমি আমার মেয়েকে কোথাও যেতে দেবো না।”
নায়েলের ঘাড়ের রগ বারংবার ফুলে উঠছে তার কণ্ঠস্বর হতে নির্গত উচ্চ বাক্যে। নওশাদ সাহেব ম্লান চোখে চেয়ে আছেন। এ বয়সে এর বেশি তিনি কিছু করতে পারবেন না। সায়েরা স্বামীর পাশে বসে পাংশুটে চেহারায় নায়েলকে দেখছে। অর্হিতা বিচলিত, উদ্বেলিত। দরজার সাথে ঠেস দিয়ে ভাবনাহীন চোখে চেয়ে আছে সুহাস। পকেটে দু’হাত গুঁজে রেখেছে। তার চিত্তে শীতল হাওয়া বইছে। এটাই তো সে চেয়েছে। নায়েলের ঘুম উবে যাবে এবার মাহিমের ভয়ে। মাহিম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত রাজনীতির সাথে। নায়েলকে টক্কর দেওয়া তার চুটকির ব্যাপার।
অর্হিতার ভাবুক মনে এক প্রশ্নের উদয় হয়। পরিস্থিতির কাষ্ঠ অবস্থায় বেখেয়ালি মনেই বলে ফেলে—
“ডি.এন. এ. টেস্টের জন্য তো স্যাম্পলের প্রয়োজন হয়। পিউ তো বাইরে কোথাও যায় না। তাহলে মাহিম হাওলাদার পিউর স্যাম্পল পেল কোথায়?”
চকিতে সকলের বিস্ফোরিত নেত্র নিবদ্ধ হয় অর্হিতার দিকে। সুহাস শঠ হাসে। সে নিরুদ্বেগ। নায়েল হুট করেই বলে উঠে—
“জানি না। আর জানতেও চাই না। আমার মেয়ে কোথাও যাবে না। ও যা করেছে আমার বোনের সাথে তারপরে ও ভাবে কী করে আমি পিউকে ওকে দেবো!
পিউ কোথায়?”
অর্হিতা শান্ত সুরে বলল—
“ও হৃতির ঘরে। ঘুমিয়ে পড়েছে। আপনাকে চিৎকার করতে দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছে।”
নায়েল কোনো কথা ছাড়াই ওঠে দাঁড়ায়। সুহাস দরজা থেকে আলগা হয়ে বলল—
“আপনি বসুন বড়ো ভাই। আমি পিউকে নিয়ে আসছি। আমার ঘরের অবস্থা দেখে আবার আপনার মাথা না বিগড়ে যায়!”
এই মুহুর্তে এই ধরনের রসিকতা মোটেও পছন্দ হলো না কারো। সুহাস সিঁড়ি বেয়ে নামছে। অসীম খুশি নিয়ে পা ফেলছে মেপে মেপে। সচেতন মনে বিড়বিড় করে বলল—
“তোর কারণে আমি আমার অনাগত সন্তানকে হারিয়েছি। এইবার তুই বুঝবি সন্তান হারানোর দগ্ধ হৃদয়ের জ্বালা। ”
তাচ্ছিল্য হাসে সুহাস। স্বগতোক্তি করে বলল—
“মাহিম হাওলাদার কোনো চুনোপুঁটি নয় আমার মতো যে টাকায় তাকে হারিয়ে দিবি। তোর কলিজায় টান পড়েছে নায়েল আনসারী। এইবার দেখ আসল খেল।”
পিউলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে হৃতি। সুহাস এসেই ব্যস্ত হাতে পিউলীকে উঠিয়ে কাঁধের দিকে মাথা দিয়ে বুকের সাথে ধরে। হৃতি ত্রস্ত গলায় বলল—
“ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”
“পালিয়ে যাচ্ছি না। নায়েল নিতে বলেছে।”
হৃতি শান্ত হয়। অসহায় মুখ করে বলল—
“এ কেমন অশান্তি বলো তো! আজ এত বছর নিজের সন্তানের খোঁজ নিল না। আর এখন এসেই ঝামেলা শুরু করে দিলো? পিউ নায়েলের হৃৎপিন্ড। ওর কিছু হলে নায়েল মরেই যাবে।”
“আমিও তাই চাই।”
চকিতে প্রশস্ত হয় হৃতির চোখ। জোর গলায় বলল—
“কী বললে তুমি?”
“কিছু না।”
হৃতির মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। বেশ কয়েকদিন ধরে সুহাসের ব্যবহার তাকে ভাবাচ্ছে। দিনের বেশিরভাগ সময় বাইরে কাটায়। চলছে কী ওর মাথায়?
#জঠর
#পর্বঃ২৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
নায়েলের সামনেই বসে আছে মাহিম। টেবিলের নিচে থাকা তার পা যুগলে কম্পন শুরু হয়েছে। মুষ্টিবদ্ধ হাতের শিরা বেয়ে দপদপিয়ে চলছে রক্ত প্রবাহ। মস্তিষ্কের স্নায়ুতে লেগেছে দ্বন্ধ। নিজেকে তবুও শান্ত রেখেছে নায়েল। মাহিম সহজ গলায় বলল—
“ব্যাপারটা কী ঠিক হচ্ছে নায়েল?”
নায়েল তিরিক্ষি মেজাজে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল—
“আপনি নিহিতার সাথে যা করেছেন তা ঠিক করেছেন?”
মাহিম তাচ্ছল্য চোখে চেয়ে বলল—
“তোমার কী মনে হয়, একজন স্ত্রী ঘরে স্বামী রেখে বাইরে নষ্টামি করে বেড়াবে আর তার স্বামী তা চুপচাপ সহ্য করে যাবে?”
তড়িৎ বেগে ওঠে দাঁড়ায় নায়েল। তার প্রশস্ত আঁখিপক্ষ্ম কম্পিত হচ্ছে। নায়েল চিবিয়ে চিবিয়ে বলল—-
“আরেকটা বাজে কথা বলবেন না আমার বোনের নামে। ওর অস্থিমজ্জাকেও চিনি আমি। ও কী করতে পারে আর না পারে তার সবটা আমি জানি। আমার বোনের দুর্বলতা কোথায় জানেন? ধোঁকা পাওয়ার পরও আপনার কোনো ক্ষতি চাইনি ও। নিজের আর নিজের সন্তানের কথা ভেবে সব মেনে নিয়েছে।”
মাহিম অগম চোখে তাকাল। সংকোচমুক্ত গলায় বলল—
“আই সি! এতটা সতী ছিল তোমার বোন আমার জানাই ছিল না! তুমি তো তার চেয়ে চার কদম এগিয়ে। আমার সন্তানকে আটকে রেখেছ।”
নায়েল অট্টহাস্য বদনে বলল—
“হাসালেন আপনি! বউ দরকার নেই, এখন মেয়ে চাই আপনার। পিউর সাথে আপনার সব সম্পর্ক নিহিতার মৃত্যুর সাথে সমাপ্ত।”
মাহিম মৃদু হাসল। তার হাসিতে সজীবতা। অচক্রী গলায় বলল—
“দেখো নায়েল, তুমি নিজেও বিয়ে করেছ। তোমার স্ত্রীর কী যেন নাম! অর্হিতা, মিসেস অর্হিতা। আজ বাদে কাল তিনিও মা হবেন, তুমি বাবা হবে। যতই তিনি পিউকে ভালোবাসেন না কেন নিজের সন্তানের থেকে তো আর বেশি ভালোবাসবেন না! তো কী দাঁড়াল বলো তো, আজ বাদে কাল আমার মেয়েটাকে সৎ মায়ের চোখের বালি হতে হবে।”
নায়েল টেবিলের উপর ঝুঁকে দম্ভোক্তি করে বলল—
“পিউ আমার মেয়ে। ভুলেও ওকে নিজের মেয়ে বলবেন না। আপনি আসতে পারেন এখন। আর অর্হিতাকে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে। পৃথিবীতে সব নারী এক না হলেও সত্যিকারের মায়েরা হয়। ”
মাহিম বসেই রইল চেয়ারে। অনুদ্বেগ চাহনিতে চেয়ে বলল—
“আমি মিউচুয়াল সেটেলমেন্ট চাই। কেস কোর্টে উঠলে নিহিতার সম্মান বাঁচবে না। আর ওর সাথে আমার ডিভোর্স এপ্রুভ হবে না। কারণ ও তখন প্রেগন্যান্ট ছিল। তোমরা আমাকে ধোঁকায় রেখছ। কথাটা মাথায় রেখো নায়েল।”
নায়েল বাঁকা হাসল। তীর্যক গলায় বলল—
“যে মরে গেছে অন্তত তাকে তো রেহাই দিন। আপনার যা ইচ্ছে করুন। পিউ কোথাও যাবে না। আমি যেতে দেবো না। ছয় বছর, অর্ধ যুগ ওকে আমি আমার এই বুকে রেখেছি। বাবা না হয়েও বাবা হয়েছি। মাস্টার্স পরীক্ষা দিতেও গিয়েও আমার পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে ছিল আমার পিউ। আমার শ্বাস ও। আপনি ভাবলেন কী করে আমি ওকে আপনাকে দেবো? আমার নীরবতাকে আমার দুর্বলতা ভাববেন না মাহিম হাওলাদার। জাস্ট আউট নাউ।”
“বাড়াবাড়ি হচ্ছে নায়েল।”
নায়েল ক্ষুব্ধ হয়ে বলল—
“বাড়াবাড়ি তো হবেই। এখনই আমার কেবিন থেকে বের হোন। নাহলে গায়ে হাত তুলতে বাধ্য হবো আমি।”
“নায়েল!”
দাপিয়ে ওঠে মাহিম। তার দীর্ঘ শরীরে কাঁপন শুরু হয়েছে। থরথরে গলায় ফের বলল—
“ওকে, আমি দেখব তুমি কী করতে পারো।”
নায়েলের কেবিন থেকে বিগড়ানো মস্তিষ্কে বের হয় মাহিম। মুক্ত শ্বাস ফেলল নায়েল। শান্ত হয়ে মাথা চেপে ধরে চেয়ারে বসে সে।
,
,
,
শ্রান্ত বিকালের ধূসর আকাশ আবেগে টলমল। একটু পরেই দুপুরের তেজস্বি প্রভাকরের মিইয়ে যাওয়া আলোর পরের বাকি অংশটুকু, যা চেয়ে রয়েছে ম্লান চোখে, পূর্বাকাশে তা প্রলীন হবে। সন্ধ্যারাগে রঞ্জিত হবে কালচে নীলাভ দ্যুলোক। গোধূলির আবির রঙ সরে গিয়ে জায়গা করে নেবে তমসার চাঁদোয়া। অাচানক দিনের রোশনাই তার খেঁই হারিয়ে মিলেমিশে একাকার হবে রাতের জ্যোৎস্নায়।
শহরের নামকরা পাঁচ তারকা আবাসিক হোটেলে পদার্পন হলো সুহাসের। থাই পুশ করে ভেতরে ঢুকেই সুডোল নেত্রযুগলে চারপাশে চোখ বোলালো সে। রিসিপশনিস্ট থেকে নির্ধারিত ঠিকানা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে হোটেলটির তিন তলায় আসে। করিডর দিয়ে হেঁটে তিনশত দশ নাম্বার কক্ষের দরজার সামনে এসে রুখে দেয় পদযুগলের চঞ্চলতা। দরজায় নক করতেই কেউ একজন আসে। সুহাসকে দেখেই সজীবের চকচকে চোখ ঝিলিক মেরে ওঠে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হোটেল কক্ষে প্রবিষ্ট হতেই সুহাসের শরীরে আলাদা শিহরণ বয়ে যায়। ছোটো ছোটো কদমে এগিয়ে যায় সে। জানালার পাশ ঘেঁষে কাউচ। মৃদু আলোতে মাহিমকে দেখতে পায় সুহাস। স্কচের পেগ নিয়ে মত্ত সে। সজীব কৃত্রিম বাতি অন করে। রোশনাইতে ভরে যায় বদ্ধ ঘর। সুহাসকে ইশারায় ডাকল মাহিম। পাশের কাউচে নিরুত্তাপ হয়ে বসল সুহাস। নেশায় বুঁদ মাহিম। তার নিভুনিভু চোখ। সুহাসের দিকে একটা খাম এগিয়ে দিতেই বিতৃষ্ণ হাসে সে। প্রসন্ন গলায় বলল—
“টাকার জন্য তো আমি কিছু করিনি ভাই।”
মাহিম নেশার্ত গলায় বলল—
“আজকাল স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু করে না। তোমার কী চাই বলো?”
সুহাস ক্রুর কণ্ঠে বলল—
“আমি শুধু চাই আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে চলে যান। আপনারও তো একটা হক আছে তাই না!”
মাহিমের অধরের কোণে চিলতে হাসি দেখা গেল। প্রসন্ন চোখে চেয়ে বলল—
“ওকে তো আমি নিয়ে যাবই।”
সুহাস পৈচাশিক হাসে। দাঁত কেলিয়ে বলল—
“ভাই একটা কথা বলব?”
“অবশ্যই।”
সুহাস হেসে হেসে বলল—
“আসলে মাই কিউরিয়াস মাইন্ড ওয়ান্ট টু নো, শুনেছি আপনার আর নিহিতার বিয়ে না কি লাভ ম্যারেজ ছিল! তাহলে বিয়ের চার, পাঁচ মাসেই সব লাভ উবে গেল?”
মাহিম অধর চওড়া করে হাসল। স্কচের এক চুমুক গালভর্তি করে গিলে নিয়ে প্রশান্তির চোখে চেয়ে বলল—
“নিহিতাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লাগে আমার। বাট চেষ্টা করেও ওর কাছে যেতে পাচ্ছিলাম না। বিয়ে ছাড়া হাত লাগানো যাচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছিলাম।”
সুহাস অবাক না হওয়ার ভান করে বলল—-
“ও আচ্ছা। তাহলে পরকীয়ার ব্যাপারটা! ওটা নিশ্চয়ই সাজানো ছিল?”
মাহিম গাঢ় চোখে তাকাল। সুহাস ফিক করে হেসে নিষ্পাপ মুখ করে বলল—
“না, মানে আমার নিষ্পাপ মন জানতে চাচ্ছিল আর কি!”
মাহিম গ্লাসের সবটকু স্কচ গিলে নিয়ে মুক্ত শ্বাস ছেড়ে বলল—
“আমার কাজে বাঁধা হচ্ছিল। তাই সরাতে বাধ্য হয়েছি।”
দাঁত কেলিয়ে খলখল করে হাসল সুহাস। যেন মজার কিছু ঘটেছে। মিনমিনে সুরে বলল—
“ভাই, এখন বলবেন না যে ওকে রাস্তা থেকে সরাতে আপনিই অ্যাকসিডেন্ট করিয়েছেন?”
বাঁকা চোখে তাকাল মাহিম। সদর্পে বলল—
“ডিভোর্সের পর আর কোনো যোগাযোগ রাখিনি আমি। তাই বলতে পারছি না।”
“তাহলে হয়তো ক্যাজুয়াল অ্যাকসিডেন্ট ছিল। বেচারি!
ভাই না কি বিয়েও করেছেন? এখন কেমন চলছে আপনার সংসার?”
মাহিম স্থির চোখে তাকিয়ে বলল—
“ভালো।”
“ও আচ্ছা। আজ তাহলে আমি আসি। শুভ কামনা।”
নেশায় বুঁদ মাহিম শুধু হাত দিয়ে বিদায় জানালো। মুখে কিছু বলতে পারল না।”
হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল সুহাস। আপাতত তাকে আর কিছুই করতে হবে না। সুহাস নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে হেঁটে চলছে। অদূরে একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসল। তাকে দেখেই সামনের বেঞ্চিতে বসা ছেলেটি বিগলিত হাসল। উঠে এসে সুহাসের পাশে বসল। ঝরা গলায় বলল—
“কী খবর তোর?”
সুহাস দৃঢ়চিত্তে বলল—
“ভালো।”
সুহাসের বন্ধু নায়িম। কুসুমপুরে থাকে। মাহিমের ভাই মনিরের সাথে ভাগ্যক্রমে সখ্যখা ছিল। সুহাস তাকেই টোপ হিসেবে ব্যবহার করে। নায়িমের মাধ্যমে সব খবর টেনে বের করে মনিরের পেট থেকে। আর শিওর হয় মাহিম-ই পিউলীর জন্মদাতা পিতা কি না। নিহিতার সাথে সুসম্পর্ক কখনোই ছিল না মাহিমের। শুধু নিজের আত্মসিদ্ধির জন্য বিয়ে করেছিল নিহিতাকে। তারপর নিহিতার ওপর পরকীয়ার আরোপ লাগিয়ে ডিভোর্স।
সুহাস কণ্ঠে বিষাদ নিয়ে বলল—
“শালা, কামিনা! শুধু নিজের খায়েস পূরণ করার জন্য নিহিতাকে বিয়ে করেছিল।”
নায়িম ঝকঝকে গলায় বলল—
” ওরা এমনই দোস্ত। মানুষের মূল্য নেই ওদের কাছে।”
“ব্যাপারটা হাস্যকর তাই না বল! যে মেয়ের জন্মের খোঁজও রাখেনি তাকে পাওয়ার জন্য এখন উঠে পড়ে লেগেছে।”
নায়িম সংকীর্ণ হেসে বলল—-
“এসব টাকার খেল বুঝলি। বছর কয়েক আগে একটা দুর্ঘটনার স্বীকার হয় মাহিম হাওলাদার। ইন্টারনাল ইঞ্জুরির কারণে বাবা হওয়ার ক্ষমতা হারায়। তার ভাই মনিরের স্ত্রী মা হবে। উত্তরাধিকারী প্রয়োজন তাদের। সন্তান জন্মদানে অক্ষম মাহিম এখন তটস্থ। তাই এতো আলগা পিরিত।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুহাস। নায়িম শ্রান্ত চোখে চেয়ে মোলায়েম গলায় বলল—
“একটা কথা বলি সুহাস। আমার মনে হচ্ছে তুই যা করছিস ঠিক হচ্ছে না দোস্ত। পিউ ওদের কাছে একদম ভালো থাকবে না। মাহিম শুধু নিজের আধিপত্য বিস্তারের জন্য পিউকে নেবে। মেয়েটার শৈশব নষ্ট হয়ে যাবে।”
শান্ত সুহাস মুহুর্তেই ফুঁসে উঠে বলল—
“তাতে আমার কী?”
“দেখ সুহাস, এসব করে কী হবে বল? আদৌ কী তুই তোর সন্তানকে ফিরে পাবি? আর কাকে কষ্ট দিতে চাইছিস তুই? যে সন্তান জন্মই নেয়নি তার জন্য তোর এত কষ্ট হচ্ছে, আর পিউর বয়স তো ছয়! ছয় বছরে কতগুলো দিন হয় তুই ভাবতে পারছিস? নিজের জীবনকে দেখ, তুই কী চাস পিউও এমন একটা জীবন লিড করুক? ”
সুহাস কোনো কথা বলল না। তার আঁখিতে ছলছল করছে নোনা জল। নায়িম ফের বলল—
“বিবেকহীন মানুষ পশুর সমতুল্য দোস্ত। তুই পশুর খাতায় নাম লেখাস না। বন্ধু হয়ে তোর কষ্ট লাগবে আমি যা পেরেছি করেছি। এখন একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে ফের বলছি, বন্ধ কর এই বদলার খেল। পিউকে ওর বাবা -মায়ের কাছে থাকতে দে। না হলে আরেকটা সুহাস তৈরি হয়ে যাবে। নিজের সন্তানের জায়গায় একবার পিউকে আর নিজের জায়গায় নায়েলকে বসিয়ে ভাব। একটা ভ্রুণ আর একটা মাংসের শরীরের অনেক পার্থক্য দোস্ত। তোকে আমি চিনি। আমি আশা করব তুই সঠিক সিদ্ধান্ত নিবি। জানি না আদৌ এই কেস ঘোরানো সম্ভব কি না! কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। তুই মন থেকে চাইলেই পারবি। ভালো থাকিস।”
নায়িমের কথায় ছিন্নভিন্ন হয় সুহাসের অন্তঃকরণ।
চলবে,,,
চলবে,,,