#জঠর
#পর্বঃ২৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
মুক্ত নীলাভ নভোলোকে সফেদ মেঘের ঘনঘটা। নীলাভ নভোলোকের ভাঁজে ভাঁজে উড়ছে জলদ। বইয়ে চলা সমীরণে অদ্ভুত স্থবিরতা ! শান্ত চোখে চেয়ে সেই নিস্তব্ধতাকে অনুভব করছে নায়েল। তার বদ্ধদৃষ্টিতে নেই কোনো কম্পন।
অর্হিতা নরমপায়ে স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ায়। নায়েলের কাঁধে হাত রাখতেই ধ্যান ছুটে তার। সচেতন চোখে তাকাল নায়েল। জিজ্ঞাসু গলায় বলল—
“কিছু বলবেন?”
অর্হিতা মখমলে গলায় বলল—
“আপনার মনে হয় না আপনি একটু বেশিই ভাবছেন?”
কপাল কুঁচকায় নায়েল। সুদূর আকাশে অপলক চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মলিন কণ্ঠে বলল–
“পিউকে আমি ছাড়তে পারব না।”
অর্হিতা নায়েলের বাজুতে মাথা রেখে বলল—
“আপনার কেন মনে হলো পিউকে আমাদের ছাড়তে হবে? পিউ আমাদের মেয়ে। ওকে আমাদের কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।”
নায়েল কোনো শব্দ করল না। নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল। তার অন্তঃকরণে তান্ডব চলছে। কুটিলতা থেকে বহুক্রোশ দূরে নায়েল। পড়ালেখা শেষ করে বাবার ব্যবসায়ের হাল ধরেছে সে। অত্যন্ত শান্ত এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ নায়েল। এতটা বিচলিত সে কখনো হয়নি। বোনের মৃত্যুতে সে ছিল অবশ। কিন্তু আজ আর পারছে না। একটা মাংসের দলাকে একটা পূর্ণ শরীরে পরিণত করেছে সে। তাতে শুধু তার অধিকার। তার ঔরসে জন্ম না হলে পিউলী তারই মেয়ে। কোনোভাবেই নিজের মেয়েকে কাছ ছাড়া করবে না নায়েল।
,
,
,
সুহাসের কোল ভরে বসে আছে পিউলী। তার সামনে একটা ইংরেজী ছড়ার বই। বইয়ের ছড়ার সাথে অঙ্কিত ছবিগুলোই এখন পিউলীর পছন্দনীয় বিষয়। সুহাসের গালে ছোটো ছোটো হাতে আঘাত করে তাকে মনোযোগী করে নিজের দিকে। আধো আধো মুখে বলল—
“দেখো আঙ্কল, লম্বা চুল! সুন্দর! হৃতি আনটির মতো।”
সামনে দাঁড়ানো হৃতির দিকে চাইল সুহাস। হৃতি চোখে হাসল। তার লম্বা চুলে এখন বেনুনী করা। সুহাস চোখ নামায়। বইয়ে রাখে চাহনি। পিউলী ডান হাতের তর্জনী দিয়ে টুকটুক করে ছবিগুলো দেখাচ্ছে সুহাসকে।
“আঙ্কল দেখো, কো।”
সুহাস পিউলীর ফুলকো গাল টেনে দিয়ে বলল—
“কো নয় ক্রো। মানে কাক।”
পিউলী খিলখিলিয়ে হাসে। তার চোখের কোণে তারার খাঁজ ফুটে ওঠে। সুহাস লোভ সামলাতে পারল না। এক আদুরে চুমু বসাল পিউলীর গালে। পিউলী তার ইঁদুর দাঁত উন্মুক্ত করে হাসল। মায়া ঝরে পড়ল সেই হাসিতে। সুহাস নির্নিমিখ তাকিয়ে রইল। এই হাসিতে সে প্রাণ পায়, তার দগ্ধ হৃদয়ে প্রশান্তির বর্ষণ হয়, প্রলেপ পড়ে পোড়া কলিজায়।
সুহাস আর পিউলীর এই সখ্যতায় উৎফুল্ল হৃতি। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবছে সে। মনের কোণে খসখসে অনুভূতিরা সুড়সুড়ি দিচ্ছে। সে কিছু বলতে চায়। এক হাত দিয়ে আরেক হাত কচলাচ্ছে হৃতি। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে তার কপাল আর নাকের ডগায়। কণ্ঠনালীতে ঊষরতা। আচানক বাইরে চিৎকার চেঁচামেচিতে সয়লাব হয় পুরো বাড়ি। সুহাস নায়েলের উচ্চ কণ্ঠ শুনেই বিছানা থেকে ওঠে আসে। হৃতি পা বাড়াতেই ধমকে ওঠে সুহাস।
“বাইরে আসবে না। এখানেই থাকো। পিউকে রাখো তোমার কাছে।”
হৃতি বাধ্য সহচারীর মতো নিভে গেল। পিউকে রেখেই বাইরে বেরিয়ে যায় সুহাস। তার মোবাইল বিছানাতেই গড়াগড়ি খাচ্ছে। চকিতে তা বেজে ওঠে। হৃতি এমনিতে কখনো সুহাসের মোবাইলে হাত দেয় না। সুহাস বাইরে থাকায় মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল হৃতি। অকস্মাৎ তার শ্বাষ রোধ হয়ে এলো। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম্বারটা দেখে থরথরিয়ে গেল হৃতির শরীর।
,
,
,
পিউলীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে নায়েল। বিমর্ষ, বিধ্বস্ত সে। মাহিম লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে। ত্রস্ত নায়েল। টাকার বিনিময়ে কিছু করতে পারলেও ক্ষমতার কাছে হেরে যাবে সে। মাহিম হাওলাদার রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তার বাবা একজন প্রভাবশালী এম.পি। বাবার পরে সে জায়গা তারই হবে। এমনটাই আশা রাখে মাহিম। বাবার নামের সাথে এম.পি পদবী থাকলেও ক্ষমতার ব্যবহার মাহিম করে।
টলটল করছে নায়েলের নেত্রদ্বয়। পিউলী বাবার বুকে গুঁজে রয়েছে। আহত গলায় বলল—
“পাপা, ওই আঙ্কল কেন বলল আমাকে নিয়ে যাবে? আমি যাব না।”
নায়েল চেপে ধরে বুকের পাটাতনে পিউলীকে। পিউলী দলিত হচ্ছে। নায়েল ভেজা গলায় আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল—
“পাপা কোথাও যেতে দেবে না তোমাকে। কোথাও না।”
“আমি যাব না।”
অর্হিতার চোখ ভরে আসে। সে কখনো ভাবতে পারেনি কোনো পুরুষকে সে এভাবে দেখবে। সকল পুরুষের ভেতর-ই এক সুপ্ত পিতৃত্ববোধ লুকিয়ে থাকে। তা বিকশিত হয় একজন সন্তানের ভুমিষ্ঠ হওয়াতে। পুরুষ মানুষকে পাথরের সাথে তুলনা করলে ভুল হবে না। তাদের হৃৎপ্রকোষ্ঠে রক্তক্ষরণ হলেও ঠোঁটে থাকে সাবলীল হাসি। হাসির ফোয়ারায় স্বচ্ছ জলের স্রোত বয়ে বাঁধাহীন গতিতে। কিন্তু সেই পুরুষের চোখ ছাপিয়ে যখন জল নামে, বুঝতে হবে তার অন্তরিন্দ্রিয় তার সহ্য ক্ষমতা হারিয়েছে। তরল মোমে পরিণত হয়েছে সে। পিউলী হেঁচকি তুলতে তুলতে নিদ্রামগ্ন হয়।
লিগ্যাল নোটিশ নিয়ে আসা লোকগুলোর সাথে উচ্চবাচ্য করে নায়েল। তা দেখেই ভয়ে আঁতকে ওঠে পিউলী। নিজের বাবাকে তার হিরো মনে হয়, কিন্তু তা কোনো অ্যাকশন মুভির হিরো নয়। তার আদুরে হিরো, যে তাকে আগলে রাখে, ঘুমন্ত মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, খিদে পেলে খাইয়ে দেয়। আকাশের চাঁদ চাইলে বলে, উড়োজাহাজে করে গিয়ে সেই চাঁদ এনে দেবে।
অর্হিতা নায়েলের এক হাত বুকের সাথে চেপে ধরে তার কাঁধে মাথা রাখে। নায়েল তার মাথাটা হেলিয়ে দেয়। এক বিষণ্ন প্রভঞ্জনে আবদ্ধ ঘর। ভাটা পড়ে গেছে খুশির জোয়ারে। চাঁদহীন আকাশের অমানিশা লেগেছে আজ। শ্রান্ত সুরে বলে উঠে অর্হিতা—
“আপনি এত চিন্তা করবেন না নায়েল। এতে আপনার শরীর খারাপ করবে। গত দু’দিন ধরে ঠিক মতো খাচ্ছেন না আপনি।”
“আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে অর্হিতা! আর আপনি খাওয়ার কথা বলছেন? মাহিমের সাথে কী করে লড়বো আমি?”
অর্হিতা নরম সুরে বলল—
“একটা জিনিস ভেবে দেখেছেন, মাহিম হাওলাদার মিউচুয়ালে যেতে চাচ্ছেন। কেন বলতে পারেন?”
নায়েল মাথা আলগা করে। ঘাড় ঘুরিয়ে সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল। অর্হিতা নিম্ন স্বরে বলল—
“মাহিম হাওলাদার জানেন কেস কোর্টে উঠলে তিনি ঝামেলায় পড়বেন। তিনি তার ক্ষমতা ব্যবহার করছেন না, কারণ এসব করলে এই খবর আরো বিস্তৃত হবে। মাহিম হাওলাদারের বর্তমান স্ত্রী কিংবা তার শশুর
পক্ষের লোক জেনে যাবেন। তাই তিনি মিউচুয়াল সেটেলমেন্ট চাচ্ছেন।”
“তো?”
“তো আর কী! যেই ক্ষমতা তার সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার, সেই ক্ষমতাই তার সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা। কিন্তু আমাদের কাছে আছে ভালোবাসার শক্তি। মহামান্য বিচারপতিও মানুষ। তিঁনিও কারো বাবা/মা, তিনি অবশ্যই বুঝবেন। পিউ আপনার কাছে ভালো থাকবে নায়েল। আপনি এতদিন বাবার দায়িত্ব নিভিয়েছেন। এবার মেয়ে হিসেবে পিউকে ওর দায়িত্ব নেভাতে দিন। পিউ বাধ্য করবে তাদের। শিশুরা শুধু ভালোবাসা চায়। আর আপনি পিউর ভালোবাসার আধার। আপনাকে ছেড়ে ও কোথায় যাবে?”
নায়েলের বিক্ষিপ্ত মন শান্ত হতে নারাজ। পিউলীর ঘুমন্ত, নিষ্পাপ মুখে অবিশ্রান্ত চুমু খেতে থাকে। অর্হিতার মনে হলো তার স্বামীর চোখের কোণ ঘেঁষে জলকণা খসে পড়ল!
,
,
,
একটা রেস্তোরাঁয় মুখোমুখি বসে আছে সুহাস আর মাহিম। সুহাস হেসে হেসে বলল—
“লিগ্যাল নোটিশ কী ওদের ভয় দেখানোর জন্য না কী?”
মাহিম সরস হেসে বলল—
“উঁহু। পিউকে আমার চাই।”
“দ্যাটস গ্রেট। তো আমায় কী করতে হবে?”
“কিছুই না। থ্যাংকস জানাতে ডাকলাম। তুমি না জানালে তো আমি জানতেই পারতাম না পিউর কথা। সেদিন অবশ্য আমার খটকা লেগেছিল। নায়েল ওমন ছেলেই নয়, যে বিয়ের আগেই…।”
চোরা হাসল সুহাস। কোল্ড ড্রিংসে চুমুক দিয়ে বলল—
“অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। কে কী তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে চলে যান।”
মাহিম ভ্রু কুঞ্চন করে। ভরা রেস্তোরাঁয় চোখ বুলিয়ে সন্ধানী চোখে তাকিয়ে বেখেয়ালি সুরে বলল—
“এতে তোমার কী লাভ?”
সুহাস প্রসন্ন হাসে। আমোদিত গলায় বলল—
“এক বাবা তার সন্তানকে ফিরে পাবে এটাই আমার লাভ। আসি ভাই।”
সুহাস বের হতেই কর্কশ স্বরে বেজে ওঠে মাহিমের মোবাইল।
,
,
,
বাসার ভেতর পা রাখতেই সুনসান নীরবতায় গা ছমছম করে ওঠে সুহাসের। বসার ঘরের কাউচে বসে আছে সবাই। সুহাসকে দেখেই তেড়ে আসে নায়েল। সহসা সুহাসের চোয়ালে এক ভয়ংকর ঘুষি বসাতেই মেঝেতে পড়ে যায় সুহাস। ধাতস্থ হয়ে সকলের দিকে শান্ত চোখে তাকায়। রাগে থরথর করে কাঁপছে নায়েল। তার ফর্সা মুখটাতে আগুন ঝরছে। বদ্ধ ঠোঁটে চলছে নির্লিপ্ত অনুরণন। সুহাস বিগলিতে হাসে। ঠোঁটের কোণের রক্ত হাত দিয়ে ঘষে মুখে পুরে। ঠোঁট কামড়ে তীর্যক হাসে। সেই হাসিতে গা জ্বালা দিয়ে ওঠে নায়েলের। নিজেকে দমাতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে সুহাসের কলার চেপে ধরে আরও কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে শাসিয়ে উঠে বলল—
“কেন করলি এসব? আমার খেয়ে আমারই থালায় ফুটো করেছিস! টাকার দরকার থাকলে আমাকে বলতি। কেন খেললি এই নোংরা খেলা?”
সুহাস নিরুত্তাপ চিত্তে হাসে। তার কোমল আনন রঞ্জিত। অর্হিতা তটস্থ হয়ে এসে নায়েলকে সরিয়ে নিয়ে বলল—
“নায়েল, কী করছেন কী! থামুন। ”
অধরের কোণ উন্মুক্ত করে হাসে সুহাস। ভারী গলায় বলল—
“মারতে দিন ভাবীজান। সন্তানের জন্য কষ্ট সব বাবার-ই হয়। বড়ো ভাই কতটা কষ্ট পাচ্ছে তাই দেখতে চাই আমি।”
নায়েল ফুঁসে ওঠে। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে মেঝতে ফেলেই সুহাসকে লাথি, ঘুষি বসাতে থাকে। অর্হিতা অনেক কষ্টে নায়েলকে টেনে আনে। সায়েরা মুখে আঁচল গুঁজে কেঁদেই যাচ্ছে। নায়েল সরে আসতেই ব্যাথায় জর্জরিত দেহ নিয়ে শান্ত হয়ে আসন পেতে বসে সুহাস। হৃতির দিকে শীতল চোখে চেয়ে দেখল। মেয়েটা সমানতালে কাঁদছে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নড়ে যাচ্ছে সাথে। নওশাদ সাহেব পিউলীকে নিয়ে নিজের কক্ষে বসে আছেন। যেন বাইরের কোনো কিছু পিউলীর কানে না পৌঁছায়।
সুহাস ক্রুর হেসে বলল—
“এখন কেন কাঁদছিস? আমি মরে গেলেও তোর কী? তুই কী ভেবেছিস আমি তোকে দেখিনি! তোকে তো আমি রেস্টুরেন্টের ফ্রন্ট মিররেই দেখেছি।”
সকলের বিস্ময় আকাশ ছুঁল। কৌতূহলী নজরগুলো বিদ্ধ হলো সুহাসের দিকে। অর্হিতা ধরা গলায় বলল—
“এসব কেন করলে তুমি? কেন মাহিম হাওলাদারের সাথে হাত মিলালে?”
সুহাস মুচকি হাসে। তার চোখে কোনো অনুশোচনা নেই। সায়েরা চিৎকার করে বলে উঠে—
“আমি ভাবতেও পারিনি তুই…..।”
“আর একটা কথাও বলবেন না আপনি।”
ভ্রূকুটি করে নায়েল। অর্হিতা গোল গোল চোখে চেয়ে বলল—
“এভাবে কথা বলছ কেন তুমি?”
সুহাস সহাস্য অধরে বলল—
“এদের মতো মানুষের সাথে এভাবেই কথা বলতে হয়। মা হয়ে যে মানুষ নিজের সন্তানকে ফেলে আসতে পারে তাদের সাথে এর চেয়ে ভালো করে কথা বলতে পারব না আমি।”
হৃতির শ্বাস ভারী হয়ে এলো। অর্হিতার চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। নায়েল হতচকিত। সায়েরার দিকে তাকিয়ে শীতল বাণ ছোড়ে সুহাস।
অর্হিতা আওড়াতে থাকে। তার মানে এসব সুহাস তার মায়ের ওপর বদলা নিতে করেছে। অর্হিতা অসহনীয় গলায় বলে উঠে—-
“যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সেখানে নায়েলের কী দোষ? তুমি তার সাথে এমন কেন করলে?”
বিক্ষিপ্ত হাসে সুহাস। ওঠে দাঁড়ায় সে। রোষিত গলায় বলল—
“কেন করেছি শুনবেন? তাহলে শুনুন, আমার সন্তানের জন্য। যে পৃথিবীর আলো দেখিনি নায়েলের জন্য।”
পুরো ঘরে নীরবতা নেমে এলো। উদ্ভাসিত চাহনি একে অপরের পানে। হৃতির হঠাৎ কী যেন হলো। বুক ফেটে যাচ্ছে তার। সুহাসের সন্তান!
অর্হিতা চমকিত গলায় বলল—
“মানে? তোমার সন্তান!”
“হ্যাঁ, আমার সন্তান। যে পৃথিবীতে আসার আগেই তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আর এসব হয়েছে নায়েলের জন্য।”
সুহাস হৃতির দিকে তাকাল। মেয়েটার মুখটা রক্তশূন্য দেখাচ্ছে। সেদিকে অপলক দৃষ্টি রেখেই বলল—
“লুবানাকে আমি ভালোবাসতাম। বিয়েও করতাম ওকে আমি। কিন্তু ও আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। নায়েলের সাথে বিয়ে ঠিক হতেই ও আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। অনেক বুঝিয়েছি ওকে আমি। টাকার কাছে হেরে যায় আমার ভালোবাসা। কিন্তু ও আমাকে তার চেয়েও বড়ো ধোঁকা দিয়েছে। নিজের এবোর্শন করিয়েছে আমাকে না জানিয়েই। সত্য কখনো চাপা থাকে না। ফিটার্সের গ্রোথ বেশি থাকার কারণে এবোর্শনে ওর প্রবলেম দেখা দেয়। তার ট্রিটমেন্ট করাচ্ছিল ও।
সেদিন ও আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল শেষ বারের মতো। পিউও ছিল ওর সাথে। এতকিছুর পর ওকে ছেড়ে কীভাবে দেই আমি! পিউর কোনো ক্ষতি আমি করতে চাইনি। কিন্তু লুবানাকে আমি ছাড়তে পারিনি।”
ক্রোধে বিহ্বল নায়েল তেড়ে এসে চেপে ধরে সুহাসকে। গরগরিয়ে বলল—
“তাহলে তুই সেদিন অ্যাকসিডেন্ট করিয়েছিলি? এই, তোদের এই নোংরামিতে আমার মেয়েকে কেন জড়িয়েছিস? যদি ওর কিছু হয়ে যেতো!”
এতক্ষণ পালটা আঘাত না করলে এবার দাপিয়ে ওঠে সুহাস। একে অপরকে ছাড়ার পাত্র কেউ নয়। ভয়ে সিটিয়ে আছে কলরব। অর্হিতা এক হাতে কিছুই করতে পারছে না। আচানক ভয়ানক কান্ড ঘটল। সেন্টার টেবিলে থাকা ফ্লাওয়ার ভাস তুলে নিয়ে তা দিয়ে আঘাত করে সুহাসকে সায়েরা। অনুপলেই হাত শিথিল হয় সুহাসের। সে মৃদু কম্পনে সরে আসে। মাথার পেছন থেকে হাত আনতেই রক্তের ছড়াছড়ি। গূঢ় হাসল সুহাস। ফ্লাওয়ার ভাস অর্ধেক এখনো সায়েরার হাতে। হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে তার বুক। সুহাস সাবলীল গলায়—
“আমার কোনো আফসোস নেই। আমি মরে গেলেও নয়। কারো কাছে ক্ষমা চাইব না আমি। যদি চাইতে হয় তাহলে হৃতির কাছে চাইব।”
সুহাস তার নিভুনিভু চোখে হৃতির দিকে তাকাল। শেষ হওয়া শ্বাস টেনে বলল—
“আই এম সরি হৃতি। না চাইতেও তোমাকে ভালোবেসেছি আমি। এতবার ধোঁকা খেয়েও তোমাকে ভালোবাসা সহজ ছিল আমার জন্য। পারলে ক্ষমা করে দিয়ো আমায়।”
ধপাস করে একটা শব্দ হলো। সুহাসের ভারী শরীর পতিত হলো মেঝের বুকে। সায়েরা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়ে বলল—
“সুহাস, বাবা আমার ওঠ!”
সুহাস নিশ্চেতন। পাথর মুর্তি হৃতি সম্বিৎ ফিরে পেল সুহাসের পড়ে যাওয়ার আওয়াজে। দৌড়ে এসে সুহাসের শার্ট খামছে ধরল। নম্র সুরে বলল—
“সুহাস! এই সুহাস! ওঠো।”
সুহাসের সাড়া না পেয়ে ডুকরে ওঠল হৃতি। জমাট গলায় বলল—
“এইটা কী করলে খালামনি? এইটা তুমি কী করলে? এখন আমার সন্তানের কী হবে? ও কাকে বাবা বলে ডাকবে?”
সায়েরা আর হৃতির বিলাপে বাতাস ভারী হয়ে ওঠল। অর্হিতা চঞ্চল পায়ে এসে সুহাসের নাকের কাছে হাত নিয়ে তাড়া দিয়ে বলল—
“নায়েল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন। সুহাসের শ্বাস চলছে।”
ঘটে যাওয়া তড়িৎ বেগের ঘটনায় বিবশ হয়ে আছে নায়েল।
#জঠর
#পর্বঃ২৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
হাসপাতালের সফেদ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে সুহাস। এক সপ্তাহ ধরে এই বিছানাই তার সঙ্গী। ফিনাইলের তীক্ষ্ম গন্ধ আর বদ্ধ পরিবেশে থমকে আছে সুহাসের মস্তিষ্ক। তার পায়ের কাছে বসে আছে হৃতি। সফেদ পর্দাটা একপাশে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে অর্হিতা। তার নরম পায়ে কোনোরূপ ছন্দপতন হলো না। সুহাসের নিকটে এসে থামে সে। সুহাস নতজানু হয়ে আছে। অর্হিতা শান্ত গলায় বলল—
“কেমন আছ সুহাস?”
সুহাস তাচ্ছল্য হাসল। কটাক্ষ করে বলল—
“যেমনটা রেখেছেন। পিউ কোথায়?”
অর্হিতা গূঢ় হাসল। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল—
“আজ কোর্টে হিয়ারিং আছে।”
সুহাস নড়ে বসল। ঝকঝকে গলায় হৃতিকে বলল—
“আমার মোবাইল এনেছ?”
হৃতি নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকায়। পার্স থেকে বের করে সুহাসের মোবাইলটা এগিয়ে দেয়। সুহাস মোবাইলটা নিজের হাতে নিয়ে একটা চাপা শ্বাস ফেলে বলল—
“লুবানার অ্যাকসিডেন্টে আমার কোনো হাত নেই। নিজের ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ও ঠিকভাবে ড্রাইভ করতে পারেনি। পাপ কাউকে ছাড়ে না। ওর পাপের শাস্তি ও পেয়েছে। আমাকে ধোঁকা দিয়েছে, জীবন ওকে ধোঁকা দিয়েছে। না হলে ভাবুন, এত বড়ো অ্যাকসিডেন্টে পিউ কী করে বেঁচে গেল!”
অর্হিতা ব্যস্ত গলায় বলল—
“তাহলে মিথ্যে বললে কেন? আর পিউ তোমাকে চিনতে কেন পারেনি?”
সুহাস বেখেয়ালি গলায় বলল—
“ওইটুকুন মস্তিষ্কে কত মনে রাখবে! আমি তখন ক্লিনশেভে ছিলাম না।”
অর্হিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সুহাস হাতের মোবাইলটা অর্হিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল—
“এইটা নিন। আশা করি আপনাদের কাজে লাগবে। পিউর কাস্টেডি পেতে এইটা আপনাদের সাহায্য করবে।”
অর্হিতা কপাল কুঞ্চন করে। ভ্রুযুগলে ভাঁজ তোলে। কৌতূহলী চোখে চেয়ে থাকে মোবাইলটার দিকে। একটা মোবাইল কী করে তাদের পক্ষে লড়তে পারে, যেখানে তাদের এত চেষ্টাও কিছু করতে পারছে না! মাহিম তার রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়েছে। আদালতে উপস্থাপন করেছে, নায়েল ইচ্ছে করে তার সন্তানকে নিজের কাছে রেখেছে যাতে করে সঠিক সময়ে কাজে লাগিয়ে তার সম্পত্তি হাতাতে পারে!
অর্হিতার দিকে তাকিয়ে সাবলীল সুরে বলতে থাকে সুহাস—
“মাহিম হাওলাদার ইচ্ছে করে পরকীয়ার নাটক সাজিয়ে নিহিতাকে সরিয়েছে। তার কনফেশনের ভিডিয়ো রেকর্ড আছে এখানে। মাহিমের ভাই মনিরের নজর ছিল নিহিতার ওপর। ও চেয়েছিল ডিভোর্সের পর নিহিতাকে বিয়ে করবে। কিন্তু নিহিতা কোনোভাবেই রাজি হয়নি। মনির পিউর কথা জানতে পারে। আর ওই-ই লোক দিয়ে নিহিতাকে সরিয়েছে যেন মাহিম ওকে পিউর কারণে ফিরিয়ে নিতে না পারে। ওর অডিয়ো কনফেশন আছে এতে। তবে মনির নেশায় বুঁদ। আদালত সরাসরি গ্রহণ না করলে ভয়েজ টেস্টে বুঝতে পারবে এইটা মনিরের-ই কণ্ঠ। পিউর কোনো ক্ষতি আমি কখনো করতে চাইনি। শুধু চেয়েছি যে যন্ত্রণা আমি পেয়েছি তা নায়েলও অনুধাবন করুক।”
সুহাসের গলা কম্পিত হচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। অর্হিতা ভিডিয়ো দেখল আর অডিয়োটাও শুনল। এইবার অর্হিতা নিশ্চিত কেস তারাই জিতবে। ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বলল—
“যাকে কষ্ট দিতে চেয়েছ আদৌ কী তারচেয়ে বিন্দু পরিমাণ কষ্ট তোমার কম হয়েছে?”
সুহাস দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। তার ক্রন্দনরত অশ্রুসিক্ত আনন সে কাউকে দেখাতে চায় না। হৃতি শশব্যস্ত হয়ে উঠে আসে। সুহাসের দুই হাতে নিজের হাত ছুঁইয়ে ধরে। অর্হিতা মিষ্টি হাসে। বেরিয়ে আসে সেখান থেকে।
মুখের উপর থেকে সুহাসের হাত সরিয়ে তার বুকের কাছে খামছে ধরে হৃতি। মুখ গুঁজে দেয় তার বুকে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। সুহাসের টিশার্ট ভিজে যাচ্ছে হৃতির চোখের নোনা জলে। সুহাস কপট রাগ দেখিয়ে বলল—
“এখন কাঁদছিস কেন? আমি তো খারাপ! আমি মরে গেলেই ভালো।”
ভেজা গলায় হেঁচকি তুলে তুলে হৃতি বলল—
“আমি তোমার জীবনে প্রথম নারী নই, এই আপসোস আমার কোনোদিনও যাবে না সুহাস!”
দুই হাতে বুকের পাটাতনে পিষে ধরে হৃতিকে সুহাস। জমাট গলায় বলল—
“আমার পবিত্র ভালোবাসাকে আমি চিনতে পারিনি, এই আক্ষেপ আমার কখনো কমবে না।”
,
,
,
টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে পিউলী। তার খুশিতে জোয়ার এসেছে। টেবিলে রাখা কেকের ক্রিমে আঙুল ঢুকাতেই অর্হিতা চেঁচিয়ে উঠে—-
“পিউসোনা কী করছ! নষ্ট হয়ে যাবে কেক।”
পিউলী অসহায় মুখ করে বলল—
“আমি কেক খাবো।”
“খাবে তো। সুহাস আঙ্কল আসুক।”
“কখন আসবে?”
“এই তো এক্ষুনি।”
পেছন থেকে অকস্মাৎ জবাব ভেসে আসে। চোখের পলকে বাবাকে দেখে পিউলীর খুশি দ্বিগুন হয়ে এলো। নায়েলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল—
“পাপা, আঙ্কল এখন আসবে?”
“এসে পড়েছে। ওই যে দেখো।”
হৃতি আর সুহাসকে ছাদ থেকে বাড়ির গেইটে দেখেই নেমে আসে নায়েল। বাড়ির ভেতরে পদার্পন করে তারা। পিউলী নায়েলের কোল থেকে নেমে অগোছালো পায়ে দৌড়ে সুহাস কাছে যায়। ঝপ করে তার পায়ের দিকটা জড়িয়ে ধরে পিউলী। সুহাস হাঁটু ভেঙে বসে। পিউলীর ঝকঝকে দাঁতের হাসি, চোখের তারায় প্রাণের উচ্ছ্বাস দেখে নিজেকে রুখতে পারল না সে। নিবিড় মায়ায় জড়িয়ে ধরল পিউলীকে। কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে থাকে। পিউলীকে নিজের থেকে আলাদা করে এলোপাথাড়ি চুমু খায়। পিউলী মর্মভেদী গলায় বলল—
“তুমি ডাক্তারের কাছে গেছিলে আঙ্কল? তোমায় মাথায় ব্যাথা! ডাক্তার তোমাকে মেরেছে?”
“না, সোনা। কেউ মারেনি আমায়। কেউ না।”
একপাশে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সায়েরার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সুহাস। দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে ওঠে দাঁড়ায়। পিউলী প্রাণোচ্ছল হাসে। সুহাসের আঙুল চেপে ধরে বলল—
“এসো আঙ্কল, এসো। মামুনির তোমার জন্য কেক বানিয়েছে। খাবে এসো।”
ডাইনিং টেবিলের কাছে টেনে নিয়ে আসে সুহাসকে পিউলী। চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের অবস্থান পাকা করে। ঝলমলে গলায় বলল—-
“মামুনি কেক খাবো।”
অর্হিতা আদুরে গলায় বলল—
“আচ্ছা, আচ্ছা।”
অর্হিতার ঠোঁটের কোণে রাঙা হাসি। কৃতজ্ঞতার সুরে বলল—
“ধন্যবাদ দেবো না তোমাকে। আপন মানুষদের ধন্যবাদ দিতে নেই। তারা হৃদয়ের কাছাকাছি থাকে। তোমার প্রতিহিংসা যতটা আমাদের পুড়িয়েছে তার চেয়ে অধিক তোমাকে। তাই আজ তুমি আবারও খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছে। পিউকে নিয়ে নায়েলের যে ভয় তা আর নেই। এখন থেকে পিউ সম্পূর্ণ আমাদের। নিহিতা তার ন্যায়-বিচার পেয়েছে। মাহিম হাওলাদার তার পাপের শাস্তি। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ, মনিরের জেল হয়েছে। সত্যের জয় সর্বত্র, তা আরেকবার প্রমাণিত। আমরা সবাই তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ সুহাস।”
সুহাস হাসল না। তার অন্তঃকরণ ব্যাথিত। মোমের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। নায়েল এগিয়ে গিয়ে কোনো কথা ছাড়াই সুহাসকে আলিঙ্গন করে। সুহাস মুক্ত শ্বাস ফেলে। নায়েল ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলল—
“আই এম সরি সুহাস। রাগের বশে তোমার গায়ে হাত তুলে ফেলেছি।”
“না, আপনার জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম। নিজের সন্তান হারানোর কষ্টে ভুলেই গেছিলাম আমি যা করছি তা ঠিক নয়। সেখানে আপনার কোনো দোষ নেই।”
“আই এম সরি।”
নায়েল তার হাত আলতো করে বুলাতে থাকে সুহাসের পিঠে। পিউলী চট করে চিৎকার করে উঠে—
“আমি কেক খাবো। সুহাস আঙ্কল কেক কাটো।”
পিউলীর এই কেক খাওয়ার তাড়নায় উপস্থিত সকলে সশব্দে হেসে ওঠে।
,
,
,
ব্যাগভর্তি করছে কাপড়। সেই দিকে বিবশ চাহনি হৃতির। আড়ষ্ট গলায় বলল—
“আমরা কী সত্যিই চলে যাব?”
সুহাস ব্যাগের চেইন লক করে বলল—-
“হুম। আজ-ই।”
হৃতি কৌতূহলী চোখে চেয়ে বলল—
“কোথায় থাকব আমরা?
“আপাতত কোনো হোটেলে। দুদিনের মধ্যে আমি কোনো বাসা খুঁজে নেবো। এসো আমার সাথে।”
হৃতি দ্বিরূক্তি করল। অজানা উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সুহাসের সাথে। বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পিউলী। কেঁদে কেটে একাকার। সে কিছুতেই সুহাসকে যেতে দেবে না। সুহাস মানতে নারাজ। তার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়। পিউলী নায়েলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই নীরব নিস্তব্ধ। নওশাদ সাহেব সুহাসের সামনে এসে দাঁড়ান। একটা অজ্ঞাত সংকোচে লোকটার দিকে তাকাতে ইচ্ছে হলো না সুহাসের। নওশাদ সাহেব ছোট্ট করে বললেন—
“ধন্যবাদ।”
সুহাস ঝট করেই বিস্মিত চোখে তাকাল। তিনি ফের বললেন—-
“আমাকে তৃতীয়বারের মতো বাবার স্বাদ আস্বাদন করানোর জন্য।”
সুহাস কল্পনাতীত অবাক হলো। নওশাদ সাহেব নিজের গরজে বললেন—
“আজ থেকে আমার দুটো ছেলে। তুমি নাহয় আমাকে খালুজান বলেই ডেকো।”
সুহাসের আঁখিপল্লব সিক্ত হয়। নিজের রোদন দমিয়ে রাখে সে।
সায়েরা দুই হাত জোড় করে ছেলের সামনে দাঁড়ালেন। সুহাসের তাকাতে ইচ্ছে হলো না। কেন তাকাবে সে?
যখন মায়ের উমে তার ঘুমানোর কথা ছিল, তখন কোথায় ছিল সে মা? বজ্ররাতে ভয় থেকে বাঁচতে যখন মায়ের বুকে লুকানোর কথা ছিল, তখন কোথায় ছিল সে মা?
তবে আজ কেন স্নেহের রিক্তথালা নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! সায়েরার কপোল বেয়ে নামছে প্রস্রবণ।অর্হিতা স্বমহিমায় বলল—
“খালামনি যা করেছে তা ভুল ছিল না। নারী বলে যে তাকে স্বামীর অত্যাচার সহ্য করে পড়ে থাকতে হবে তার কোনো মানে নেই। যদি সেদিন ওই পরিবার থেকে খালামনি বেরিয়ে না আসত তাহলে আদৌ তাকে তারা বাঁচতে দিতো? আমাদের সমাজে এমন অনেক নারী আছে যারা স্বামী এবং তার পরিবারের অত্যাচার, বঞ্চনা সহ্য করে পড়ে থাকে। তাদের শেষ পরিণতি হয় আগুনে ঝলসে যাওয়া না হয় স্বামীর হাতে খুন। তোমার মা এখনো বেঁচে আছে সুহাস!
মাতৃত্ব এক সুপ্ত অনুভূতি। তার পরিস্ফুটন ঘটে সন্তানের উপস্থিতিতে। নায়েল আর নিহিতাকে খালামনি জন্ম দেননি। তার জঠরে জন্ম না হওয়া সত্ত্বেও তাদের তিনি মায়ের স্নেহ দিয়েছেন। সেখানে তুমি তার রক্তে জন্ম নিয়েছ। তোমায় কতটা ভালোবাসে তা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।”
সুহাসের শ্বাস ভারী হয়। রাগের চিতায় আগুন ধরিয়ে তার বিসর্জন করে সে। হুমড়ি খেয়ে মায়ের বুকে পড়ে সুহাস।
মা- ছেলের মিলবন্ধনে সকলের নেত্র সিক্ত হয়। অর্হিতা সুডোল গলায় বলল—
“শেষ ভালো যার, সব ভালো তার!”
চলবে,,,
চলবে,,,