জঠর পর্ব ৬+৭

#জঠর
#পর্বঃ৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

বুকের খাঁচায় দীর্ঘশ্বাস জমিয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসে অর্হিতা। খিদেয় পেটের নাড়িভুঁড়ি পেঁচিয়ে যাচ্ছে। যুবা সার্ভেন্ট কলরব এসে অর্হিতাকে খাবার সার্ভ করে। অর্হিতা নাক কুঁচকায়। এত দামী খাবার খাওয়ার অভ্যাস তার নেই। মৃদু গলায় কলরবকে উদ্দেশ্য করে বলল—

“আমাকে এই জুস, টুস দিতে হবে না। দুটো পরোটা আর একটা ডিম ভেজে দিলেই হবে। তারা বুঝি এসব খায় না? ও বড়োলোক তো তাই হয়তো। আমার আবার এসবেই পেটভর্তি হয়। আপনি আমার জন্য এসব-ই নিয়ে আসুন।”

কলরব অপ্রস্তুত চোখে তাকাল। টেবিল ভর্তি খাবার থাকার পরও আবার বায়না! তবে সে তা পালন করতে বাধ্য। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো সায়েরা। জোরালো গলায় বলে ওঠেন তিনি—

“অর্ডার তো এমনভাবে করছ যেন রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছ? ”

অর্হিতা অগাহ্য চোখে তাকাল। স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে গাঢ় কমলা রঙের মিহি জর্জেটের শাড়ি পরেছে সায়েরা। অর্হিতা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। মহিলা যথেষ্ট সুন্দরী বলা চলে! এই বয়সেও চামড়া কুজ নেই। কেমন টানটান ভাব! চোখগুলোও মাশা আল্লাহ! বয়স অনুসারে শরীরের মেদ বাড়েনি। কিন্তু এখন তার কাছে সায়েরাকে বাংলা ছবির ভিলেন রাণি রিনা খান মনে হচ্ছে।

অর্হিতা সম্মানের সাথে বলল—

“আপনি কি আমাকে কিছু বললেন?”

সায়েরা রোষভরা গলায় বলল—

“তোমাকেই বলছি। অর্ডার তো এমনভাবে করছ যেন এই বাড়ি মালকিন তুমি?”

অর্হিতা ভ্রূকুটি করে। চোখের কোণ ক্ষীণ করে বলল—

“কেন? আপনাদের বাড়ির মালকিন বুঝি দুটো পরোটা আর ডিম ভাজি খায়? আমার মামার অবশ্য এত টাকা পয়সা নেই। তবুও রোজ সকালে মামি দুটো সেদ্ধ ডিম, চারটে পরোটা আর একগ্লাস দুধ খায়। ”

যারপরনাই অপমানবোধ করল সায়েরা। খনখনে গলায় বললেন—

“কী বলতে চাও তুমি?”

“কিছু না। তবে আমি যতটুকু শুনেছি আপনি মি.টাকার কুমিরের সৎ মা! তবে আমার কেন জানি আপনাকে তার বায়োলজিক্যাল মাদার মনে হচ্ছে। স্বভাবে কী মিল! তবে কথায় আছে না-” সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”

সায়েরা রাগে গজগজ করছে। তীক্ষ্ম,জ্বলন্ত চোখে চেয়ে শ্বাসভারী করে বললেন—

“বেয়াদব মেয়ে! বড়দের মুখে মুখে তর্ক! এই শিক্ষা দিয়েছে তোমার পরিবার তোমাকে?”

অর্হিতা হেয়ালি হাসল। কটাক্ষপূর্ণ গলায় বলল—

“আমার তো বাবা-মা ই নেই। শিক্ষা পাবো কোথা থেকে? কিন্তু আপনাদের ছেলের তো বাবা, মা সবই আছে। তবুও আদিম মানুষের মতো আচরণ।”

রাগে উৎকন্ঠিত হয়ে অর্হিতার গালে চড় মারতে গেলেই সায়েরার হাত আটকে ধরে নওশাদ সাহেব। ক্ষুব্ধ চোখে চেয়ে শক্ত গলায় বললেন—

“ঘরে যাও সায়েরা। দ্বিতীয়বার যেন এই ভুল না হয়।”

ফুঁসতে থাকে সায়েরা। গনগনে রাগে জলের ধারা বইয়ে নিজ কক্ষের পানে হাঁটা ধরলেন।

নওশাদ সাহেবের ব্রীড়াময় চাহনি। অস্বস্তি ঘিরে ধরল তাকে। প্রথমে নায়েল, এখন আবার সায়েরা! ভাবতে পারছেন না তিনি। লজ্জিত গলায় বললেন—

“তুমি কিছু মনে করো না মা। তোমার যা খেতে ইচ্ছে করবে ওদেরকে বলে দিয়ো। কোনো সংকোচ করো না।”

অর্হিতা মুক্ত শ্বাস ফেলল। সশব্দে বলে উঠে—

“ধন্যবাদ। তবে আদৌ কী আমার সে অধিকার আছে?”

নওশাদ সাহেব বিমূঢ় চোখে চাইলেন। পরক্ষনেই চাহনিতে টেনে আনলেন সরলতা। বললেন—

” আমার ছেলেটা ততটা খারাপ নয়। একটা ভুল করে ফেলেছে। তোমার সাথে ও যা করেছে এর শাস্তি তুমি ওকে দিতে পারো। তাতে আমার আপত্তি নেই। নায়েল নিজেও তোমার কাছে তা স্বীকার করেছে। কিন্তু,,, কিন্তু পিউলীর কোনো দোষ নেই এতে। ও তোমাকে মা মেনে নিয়েছে। একজন বাবা হয়ে আমি কখনো আমার মেয়ের সাথে একটা বিবাহিত ছেলের বিয়ে দেবো না। তোমার মতামতকে আমি পূর্ণ সাপোর্ট করি। কিন্তু জীবন তো সহজ -সরল নয় মা। ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর মতো আমাদের এই ক্ষণস্থায়ী জীবনটাও গোলকধাঁধা। তার এপিঠ -ওপিঠ, দুপিঠ-ই আমাদের ভাবনার বাইরে। যা চাই তা ঘটে না। কিন্তু যা চাই না তাই ঘটে যায় অবিলম্বে। ঘটে যাওয়া দারুন ঘটনা বা দূর্ঘটনা দুটোই আমাদের ওপর ন্যাস্ত। আমরা তাকে কোনভাবে গ্রহন করব। কারো কাছে যা সুখকর, আবার কারো কাছে তা দুঃখজনক। এই যে বর্ষা এলেই প্রকৃতি সাজে নতুন সাজে। চারদিকে অথৈ জলে ক্লান্ত, শ্রান্ত ধরণীতে নেমে আসে নব যৌবনা প্রাণের জোয়ার! কিন্তু এই বর্ষাই আবার দিন আনে দিন খায় মানুষের জন্য প্রাণনাশক। আমরা চেয়েও অনেক কিছু বদলাতে পারি না। মানিয়ে নিতে হয়। কিন্তু তা সহ্যের সীমার বাইরে নয়। তোমাকে জোর করার কেউ নেই। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। তোমার যা ঠিক মনে হবে তাই করবে।”

অর্হিতা মনোযোগ সহকারে সব শুনল। কিন্তু কোনো রা করল না। নওশাদ সাহেব বাড়ির বাইরে চলে গেলেন। অর্হিতার খিদে মরে গেল। চপল পদযুগল বাড়াতে লাগল নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে।
,
,
,
ডিভানের উপর বুক লাগিয়ে শুয়ে আছে পিউলী। দুই হাতের কনুই ভেঙে ডিভানের সাথে ঠেকিয়ে চিবুকের নিচে দিয়ে রেখেছে। গোল গোলে চোখে চেয়ে আছে সামনে রাখা ল্যাপটপের স্ক্রিনে। ছোটো ছোটো দাঁত বের করে খিলখিলিয়ে হেসে যাচ্ছে পিউলী। স্ক্রিনে তখন মটু-পাতলু কার্টুন দৃশ্যমান।

নিজের চেয়ার থেকে পিউলীর দিকে তাকিয়েই মুচকি হাসে নায়েল। নায়েল আর নিহিতা জমজ ভাইবোন। ভার্সিটিতে পড়াকালীন সেখানকার এক ছাত্রলীগের নেতার সাথে সখ্য গড়ে ওঠে নিহিতার। পরিচয় থেকে পরিণয় ঘটতে বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন শশুড়বাড়ি থেকে ফিরে আসে নিহিতা। তখন সে সন্তানসম্ভবা। মাস দুয়েক যাওআর পরও যখন ও বাড়ির কেউ খোঁজ নিল না তখন নওশাদ সাহেব শঙ্কিত হলেন। তিনি খবর পাঠালেন। কিন্তু ও বাড়ির মানুষ নিহিতার উপর আরোপ লাগাল। নিহিতার স্বামী মাহিম জানায় নিহিতার অন্য কারো সাথে সম্পর্ক আছে যা সে নিজের চোখে দেখেছে। তার কাছে উপযুক্ত প্রমাণও আছে। সব প্রমাণ- ই নিহিতার বিপরীত। যে ছেলেটাকে নিয়ে নিহিতাকে সন্দেহ করা হয় তাকে অনেক খুঁজেছে নায়েল। কিন্তু পায়নি। কারণ, তাকে শুধু নিহিতাই দেখেছে। কোনো ছবিতেই ছেলেটির চেহারা দৃশ্যমান নয়। নিহিতা বলেছে ছেলেটার সাথে তার এমনিতে জানাশোনা ছিল। এর চেয়ে বেশি কিছু না। অনেক ঝামেলার পর ডিবোর্স হয়ে যায় তাদের। কিন্তু নিহিতা তখন প্রেগন্যান্ট। সে হিসেবে আইনত ভিবোর্স গ্রান্টেড নয়। কিন্তু সন্তানের কথা ও বাড়ির কাউকে জানানো হয়নি। মাস চারেক পর মাহিম আবার বিয়ে করে। পিউলীর জন্মের ছয় মাস পর অ্যাকসিডেন্টে মারা যায় নিহিতা। ভড়কে যায় নায়েল। তার মায়ের মৃত্যুও হয়েছিল। কার অ্যাকসিডেন্টে। নিহিতারও। একবার নায়েলের মনে হয়েছিল হয়তো কাজটা মাহিম করছে। ঝামেলা শেষ করতে। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভেবেছে, মাহিম তো জানেই না এই সন্তানের কথা! পিউলীকে বাবার স্নেহেই প্রতিপালন করে নায়েল। তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে নওশাদ সাহেব। আপত্তি করল না সে। লুবানার সাথে বিয়ে ঠিক হতেই তাদেরকে সবটা জানানো হয়। শুধু অনুরোধ করে, পিউলীকে যেন কখনো এইটা না বলা হয় যে নায়েল পিউলীর বায়োলজিক্যাল ফাদার নয়। বিয়ে ঠিক হওয়ার কিছুদিন পরেই সেই মর্মান্তিক অ্যাকসিডেন্ট। নায়েল ড্যাম শিউর কেউ ইচ্ছে করে এসব করছে। পিউলী হয়তো তাদের টার্গেট। কিন্তু কেন?

নায়েলের ভাবনা কাটে তার মুঠোফোনের ভাইব্রেশনে। ওপাশ থেকে কী বলল কে জানে! নায়েল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। পিউলীর কাছে গিয়ে মৃদু গলায় বলল—

“পিউ, পাপা বাইরে যাচ্ছি। তুমি এখানেই থাকো। আমি শ্যামল আঙ্কলকে বলে যাচ্ছি। কিছু লাগলে তাকে বলো।”

“ওকে পাপা।”

“আর এখান থেকে বের হবে না। পাপা একটু পরেই ফিরে আসছি।”

“ওকে।”
,
,
,
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের ডাক্তাররা ব্যস্ত। আচমকা লুবানার অবস্থার অবনতি ঘটেছে। তাকে লাইফসাপোর্টে রাখা হয়েছে। ডাক্তার আজমল সেখান থেকে বের হতেই তাড়া দিয়ে জিজ্ঞেস করল নায়েল—

“এখন কী অবস্থা?”

ডাক্তার আজমল জ্যোতিহীন গলায় বলল—

“দেখুন, প্রেশেন্টের অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। আমরা আপাতত আপনাকে কোনো আশা দিতে পারছি না। বাকিটা ভাগ্য!”

করুণ শ্বাস ফেললেন তিনি। নায়েল বাইরে থেকে গ্লাস গলিয়ে একবার ভেতরে তাকাল। মেয়েটার অবস্থার জন্য হয়তো সে ই দায়ী!
#জঠর
#পর্বঃ৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

তপ্ত মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টি নেমেছে দুপুর লগ্নে। সেই বৃষ্টি মাথায় করে বাড়ি ফিরেছে নায়েল। লুবানার অবস্থা দেখে আর কাজে মন বসাতে পারেনি নায়েল। লুবানার বেঁচে থাকা জরুরি। কারণ, সেই ই বলতে পারবে এই অ্যাকসিডেন্ট কে ঘটিয়েছে।

পিউলীর ভেজা চুলে তোয়ালে ঘষছে নায়েল। পিউলীকে গোসল করিয়ে এনেছে। বিছানায় বসিয়ে তার চুল মুছে দিচ্ছে। পিউলী টুকটুক করে হাসছে। নায়েল শান্ত গলায় প্রশ্ন করে—

“পিউ, সেদিন লুবানা আনটি কার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল?”

পিউলী চোখ পিটপিট করে। চোখের উপর পড়ে থাকা অগোছালো চুলগুলো হাতের তালুর সাহায্যে ঘষে সরিয়ে নেয়। আদুরে গলায় বলল—

“আঙ্কলের সাথে।”

নায়েল আগ্রহদীপ্ত হয়ে বলল—

“কোন আঙ্কল? তুমি চেনো তাকে? আর কখনো দেখেছিলে?”

পিউলী চুপ মেরে যায়। তার ছোট্ট মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে মনে করার চেষ্টা করে আদৌও সে ওই আগন্তুককে আগে কখনো দেখেছে কি না।
লুবানা সেদিন পিউলীকে শপিংমল নিয়ে যায়। আসার পথেই কার অ্যাকসিডেন্ট হয়।

পিউলী মাথা ঝাঁকায়। যার মানে সে মনে করতে পারছে না। হতাশ শ্বাস ফেলল নায়েল। দৈবাৎ কর্কশ স্বরে ফিরে তাকায় সে।

“এই যে মি. টাকার কুমির! শুনতে পাচ্ছেন?”

নায়েল ভ্রু-বিলাস করে। সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে বলল—

“কিছু বলবেন?”

অর্হিতা পিউলীর দিকে তাকায়। একটা জিন্সের হাফ প্যান্ট আর গোলাপী,সাদার মিশেলে ফ্রক পরেছে পিউলী। অর্হিতাকে দেখে অধর ছড়িয়ে হাসে। অর্হিতা চোখ ফেরায়। মেয়েটার হাসি দেখলেই গলে যেতে ইচ্ছে করে!
চোয়াল শক্ত করে অর্হিতা। ঠান্ডা গলায় বলল—

“আমার ওয়াশরুমের ট্যাপ দিয়ে পানি আসছে না। একটু দেখবেন?”

নায়েল ঘুরে তাকায়। টেবিল থেকে চিরুনি নিয়ে পিউলীর চুল আচড়াতে থাকে। নিরুদ্বেগ গলায় বলল—

“কলরবকে বলুন। লোক এনে ঠিক করিয়ে দেবে।”

“কেন? আপনি ঠিক করতে পারেন না?”

অর্হিতার ঠেস মারা কন্ঠে নায়েল অপ্রস্তুত হয়। পিউলীকে বিছানার উপর থেকে কোলে নিয়ে বলল—

“চলুন। দেখছি।”

নায়েলের কক্ষের পাশেই পিউলীর কক্ষ। তার ডানদিকে অর্হিতার। অর্হিতার কক্ষের বারান্দা আর পিউলীর কক্ষের বারান্দা একই।
,
,
,
ট্যাপ খুলে ফেলেছে নায়েল। কিন্তু তার আগে ছাদে গিয়ে পানির লাইন বন্ধ করে দিয়ে এসেছে। পিউ দাঁড়িয়ে আছে অর্হিতার বিছানার উপর। উৎসুক নজরে চেয়ে আছে সে। ট্যাপের মুখে ময়লা জমে পানি আসতে বাঁধা দিচ্ছিল। অর্হিতা নায়েলের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। নায়েল কী করছে তাই-ই দেখছে মনোযোগ দিয়ে। চকিতে ট্যাপের পাইপ দিয়ে দুর্দমনীয় জলস্রোত শুরু হয়। তা গিয়ে হানা দেয় নায়েলের চোখে। ছিটকে সরে আসে নায়েল। তড়িঘড়ি করে নায়েলকে সামলাতে গিয়ে তার উপর পড়ে যায় অর্হিতা। জলস্রোত সমান্তরালে গিয়ে দেয়ালে আছড়ে পড়ছে। সেখান থেকে তাদের দুজনের শায়িত শরীরে। সেকেন্ডের ব্যবধানে এমন বিব্রতকর ঘটনা সম্মুখীন হবে তারা বুঝতেই পারেনি। অর্হিতার সম্পূর্ণ ভর নায়েলের বক্ষপুটে। বরফের মতো জমে গেছে অর্হিতা। হুটোপুটি করে উঠে দাড়ায়। ভিজে চুপচুপ দুই কপোত-কপোতী একে অন্যের দিকে তাকাতে পারছে না। নায়েলের স্যান্ডো গেঞ্জি ভিজে তার কায়া দৃশ্যমান। অর্হিতার অধর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। অপ্রস্তুত গলায় বলল—

“সসসসরি।”

নায়েল চোখ উঠাল না। তার মাথায় রাগ চেপেছে। পানির লাইন সে বন্ধ করে দিয়ে এসেছে। তাহলে পানি এলো কোথা থেকে। নির্ঘাত কেউ ছেড়েছে!
নায়েল অনুতপ্তের সুরে বলল—

“সরি। আসলে আমি..।”

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে অর্হিতা। তাকে দেখে জ্যোতিহীন চোখে চাইল পিউলী। ওয়াশরুমের দরজার কাছে এসে জোর গলায় বলে উঠে নায়েল—

“পিউ, কলরব ভাইয়াকে ডেকে আনো। বলো পাপা ডাকছে।”

পিউলী ঝলমলে গলায় বলল—

“ওকে পাপা।”

বিছানা থেকে নেমেই ছুট লাগায় পিউলী। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে অর্হিতা। ভেজা শরীর দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। নায়েলের অবাধ্য চোখ গিয়ে আবদ্ধ হচ্ছে অর্হিতার ভেজা আঁখিপল্লবে। দীর্ঘ পল্লব ভিজে একে অপরকে জড়িয়ে আছে। মুখে জমে আছে পানি। তা চেপে চেপে মুছে নিচ্ছে অর্হিতা। তার ভেজা ওষ্ঠাধর ক্রমশ কম্পিত হচ্ছে। পরিস্থিতির অস্থিরতা কমাতে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢোকে নায়েল। হুড়োহুড়ি করে কক্ষে প্রবেশ করে কলরব। ওয়াশরুমের ভেতর দিকে উঁকি মারতেই নায়েল তর্জন গর্জন করে বলল—

“পানি ছেড়েছে কে?”

কলরব থতমত খেয়ে বলল—

“হৃতি ম্যাম বলল পানি আসছে না কল দিয়ে তাই ছাদে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি…।”

“লাই যখন বন্ধ তখন তোমার দুর্বল মস্তিষ্কে ঢুকেনি যে কেউ হয়তো বন্ধ করেছে। যাও,এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? বন্ধ করে দিয়ে আসো। প্লাম্বারকে খবর দাও। গো ফাস্ট।”

“জি, জি স্যার।”

কলরব মুহূর্ত ব্যয় করল না।
,
,
,
নীলাভ্রের দিকে উদাসচিত্তে চেয়ে আছে অর্হিতা। শুভ্র, সতেজ জলদের লুকোচুরি খেলা। প্রভঞ্জনে মৃদু দোল। ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে আছে সে। এক পশলা বৃষ্টি হতেই ঝলমলে নীলাভ্রের বুক চিরে উড়ছে থোকা থোকা জলদ।

চকিতে বাড়ির সামনে কাউকে দেখে ভ্রু কুঁচকায় অর্হিতা। টানটান চোখে চেয়ে বুঝতে পারল উক্ত ব্যক্তি আর অন্য কেউ নয় তার-ই ভাই অর্নিশ। অর্হিতা কাল বিলম্ব করে না। দ্রুত পা চালিয়ে নিচে নেমে আসে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে সেখানেই। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে এসে হাঁটু মুড়ে পড়ে যায় অর্হিতা। তার আঙুলের ডগা ফেটে গিয়ে লহুর স্ফীত ধারা বইতে থাকে। অর্হিতার আর্ত চিৎকারে রান্নাঘর থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসে কলরব। থমকে যায় সে। নায়েল তার বাবার ঘরেই ছিল। তারাও একে একে জড়ো হয়। ব্যথায় কাতরাতে থাকে অর্হিতা। দরজা দিয়ে হৃতির সাথে প্রবেশ করে পিউলী। অর্হিতাকে দেখেই জল ছলছল আঁখি তার। ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে অস্থির। পিউলীর এই অবস্থায় নিজেকে ভুলে যায় অর্হিতা। হৃতি গম্ভীর গলায় বলে উঠে—

“বাইরে একটা লোক এসেছে। নায়েলের সাথে দেখা করতে চায়।”

নায়েল জানে কে এসেছে। তাই সে প্রতিক্রিয়াহীন। নায়েল অর্হিতার দিকে তাকিয়ে গাঢ় গলায় প্রশ্ন করে—

“এভাবে ছুটছিলেন কেন? ট্রেন মিস হয়ে যাচ্ছে আপনার?”

অর্হিতা তার ব্যথা ভুলে গেল। টগবগে গলায় বলল—

“ভাইয়া কেন এসেছে আপনার কাছে?”

নিরুত্তর নায়েল। সকলের সামনে এক অদ্ভুত কাজ করে বসল সে। অর্হিতাকে পাঁজাকোলে করে নিয়ে বলল—

“হৃতি, বাবার ঘর থেকে ফাস্টএইড বক্সটা নিয়ে এসো। পিউলী আমার সাথে এসো। কলরব গিয়ে বাইরে লোকটাকে ড্রয়িংরুমে বসতে বলো। আমি আসছি।”

অর্হিতা বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল। আঁতকে ওঠে নায়েলের কলার খাঁমচে ধরেছে সে। নায়েলের সোজা দৃষ্টি। অর্হিতার ঘোর লাগা চাহনি নায়েলের গম্ভীর মুখে।
কক্ষে নিয়ে বিছানায় আধশোয়া করে বসায় অর্হিতাকে। হৃতি ফাস্টএইড বক্স নিয়ে এসেছে। তাকে চলে যেতে বলে নায়েল। হৃতি একবার কঠিন চোখে তাকায় অর্হিতার দিকে। বিছানায় ওঠে বসে পিউলী। একদম অর্হিতার পায়ের কাছে। নায়েল তুলো দিয়ে প্রথমে রক্ত মুছে নেয়। পিউলী থেমে থেমে ফুঁ দিচ্ছে আর বলছে—

“মামুনি ব্যথা করছে?”

অর্হিতা জবাব দিলো না। সে অনিমেষ চেয়ে রইল নায়েলের দিকে। লোকটার মধ্যে কোনো উত্তেজনা নেই। স্বাভাবিক সে। ব্যান্ডেজ করে ক্ষান্ত হয় নায়েল। আর কোনো কথা না বলে পিউলীকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। অর্হিতা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।

ড্রয়িংরুমে বসে আছে অর্নিশ। নায়েল পিউলীকে নওশাদ সাহেবের কাছে যেতে বলল। কাউচের একপাশে বসেই প্রশ্ন ছুড়ে—-

“কেন এসেছেন?”

অর্নিশ মৃদু হাসল। মিইয়ে গলায় বলল—

“মানে, আসলে আমার কিছু টাকার প্রয়োজন ছিল।”

নায়েল ক্ষুব্ধ চোখে চাইতেই অর্নিশ অধৈর্য গলায় বলল—-

“আরে রাগ করবেন না। এইগুলো ধার হিসেবে নেবো। শোধ করে দেবো পরে। মাত্র তিনলাখ হলেই চলবে।”

সটান করে উঠে দাঁড়ায় নায়েল। ক্রোধিত গলায় বলল—

“গেট আইউ। আই সে গেট আউট।”

অপমানবোধ করল অর্নিশ। রুষ্ট গলায় বলল—

“দেখুন নায়েল….।”

“আমি আপনাকে যেতে বলেছি। পনেরো লাখ টাকা দিয়েছি আপনাকে। আবার কোন সাহসে এসেছেন? কেমন ভাই আপনি? শুধু অর্হিতা আমার কাছে সময় চেয়েছিল বলে। নাহলে একটা টাকাও পেতেন না আপনি। বের হোন এই বাড়ি থেকে। আর কখনো এখানে আসবেন না। জাস্ট লিভ…।”

ঢোক গিলল অর্নিশ। কন্ঠে চাপা রাগ। চোখ ভরা রোষ।

চলবে,,,

(বি.দ্র:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here