জনৈক প্রেমিক পর্ব -১২ ও শেষ পর্ব

#জনৈক_প্রেমিক
পর্ব- ১২ (শেষ)
লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা

প্রত্ন চলে যাবার সময় পুনরায় বলল, ‘তুই কিন্তু কিছুতেই যাবি না শ্রাবণ ভাইয়ের সঙ্গে। বুঝেছিস?’

আমি জবাব দিলাম না। প্রত্ন আবার বলল, ‘ আগামী পরশু দিন কী মনে আছে?’

আমি মাথা নাড়ালাম। প্রত্ন ভ্রু কুঁচকালো, ‘এভাবে ভুলে যেতে পারলি? ‘

আমি ভাবতে লাগলাম আটাশ অক্টোবর কী এমন বিশেষ দিন! আমাকে ভাবতে দেখে প্রত্ন বলল, ‘থাক! আর ভাবতে হবে না। ‘ এরপর নিজেই কোনো এক ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে গেল। তারপর প্রশ্ন করল, ‘একটা কাজ করতে পারবি হৃদি?’

‘কী?’

‘পরশু আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে পারবি? তোকে একটা সারপ্রাইজ দেবার আছে!’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী সারপ্রাইজ? ‘

প্রত্ন হেসে বলল, ‘সেদিনই দেখবি!’

‘আমি দেখা করতে পারব না।’

প্রত্ন অনুনয় করল, ‘প্লিজ হৃদি! ইটস ইমপর্টেন্ট! তোকে আমার অনেক কিছু বলার আছে।’

আমি বললাম, ‘এখনি বল!’

‘সেসব কথা এখন বলা সম্ভব নয়। শোনার পর তুই কেমন রিয়েক্ট করবি সেটাও বুঝতে পারছি না। এখনি আমার টেনশন হচ্ছে। আবার একটুপরে আঙ্কেলও এসে পড়বে। ‘

‘কী এমন কথা, প্রত্ন? এবার কিন্তু আমারও টেনশন হচ্ছে!’

প্রত্ন হাসল, ‘আরে তোর টেনশন নেবার কিছু নয়! তুই নিশ্চিন্ত মনে থাক। ‘ এরপর আবার বলল, ‘পরশু দেখা করবি তো?’

‘কথা দিতে পারছি না।’

‘তোকে কথা দিতে হবেই! নয়তো আমি এখান থেকে কিছুতেই যাব না। ‘

‘প্রত্ন! পাগলামো করিস না!’

‘কথা দে! আমি চলে যাব।’

বাধ্য হয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, দেখা করব। এবার প্লিজ দয়া করে বিদেয় হন আপনি।’

প্রত্ন দাত বের করে হাসল। যেতে যেতে বলল, ‘পরশু দিন ঠিক বিকেল চারটায় তোদের কলেজের পাশের কফিশপটায়!’

.
প্রত্ন চলে যেতেই মা আমার উদ্দেশ্যে এক গাদা প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে বসল। ‘ছেলেটা কে রে?’

‘আমার ফ্রেন্ড মা!’

মা বলল, ‘কেন আসছিল?’

‘আবার কেন! দেখা করতে।’

‘এমন ভাঙা হাত-পা নিয়া?’

আমি বললাম, ‘মা ও একটু পাগলাটে ধরনের। যখন যেটা মন চায় সেটাই করে। এজন্য।’

মা কেমন বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, ‘আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি মা।’

মা জিজ্ঞাসু হয়ে বলল, ‘কী? ‘

‘শ্রাবণের সাথে ফিরে যাব।’

মুহূর্তেই মা’র মুখের বিরক্তি ভাবটা কেটে গেল। এক গাল হেসে বলল, ‘সত্যি?’

‘হ্যা মা! ‘

মা আমার মাথায় হাত রাখল, ‘ছেলেটা ভালো। কতবার বলসি একবার ক্ষমা করে দেখ! একবার ক্ষমা করে দেখ! তুই আর তোর বাবা তো কানেই তুলোস না আমার কথা। অনেক ভালো থাকবি মা, দেখিস!’

আমি মা’কে জড়িয়ে ধরলাম, ‘হুম।’

মা বলল, ‘তোর বাবারে বলছিস?’

‘না মা। বাবা দোকান থেকে এলে জানাবো। তুমিও একটু জানিয়ো!’

‘অসম্ভব! আমার কলিজায় ডর-ভয় নাই না-কি? আমি বললেই ভাববো, তার মেয়েরে আমি জোর করে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইতাসি।’

আমি শব্দ করে হাসলাম। ‘ মা তুমি শুধু শুধুই বাবাকে এত ভয় পাও। আচ্ছা যাও তোমার বলতে হবে না। আমি নিজেই বলব!’

.
শ্রাবণকে কিছু বিষয় পরিষ্কার করে বলার দরকার। উনি ভাবছেন আমি ওনাকে ধোঁকা দিয়ে প্রত্নর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছি। আপাত দৃষ্টিতে সত্যি মনে হলেও সেগুলো সত্যি নয়।
শ্রাবণের সঙ্গে যখন আমার প্রেমের শুরু তখন আমি কেবল ক্লাস নাইনে পড়ি। ক্লাস টেইনে ওঠার পর একবার শ্রাবণের একটা চিঠি কেমন করে যেন বাবার হাতে পড়ে যায়। তখন আমার বয়স কেবল পনেরো। বাবা চাইছিলেন না এমন সংবেদনশীল একটা বয়সে মোহে পড়ে কোনো ভুল করে বসি। বাবা একদিন ডেকে আমাকে সাবধান করেন। জিজ্ঞেস করেন চিঠি পাঠানো ব্যাক্তিটা কে? তার নাম কী? কোথায় থাকে।
কিন্তু আমি তার নামধাম কিছুই বলতে পারি না। ফলে বাবা ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, আমি কেন বোকার মতো এই চিঠির উত্তর দিয়ে এসেছি এতকাল। বারবার করে নিষেধ করেন আর যেন কখনো ভুলেও এ চিঠির উত্তর না দেই। ছোটোবেলা থেকে কোনোদিন বাবার কোনো কথার অবাধ্য হইনি। ভয়, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা সবগুলোর জন্যই। বাবার নিষেধ করা বস্তুকে আমরা দু’বোন নিজেদের জন্য হারাম ভাবতাম। কাজেই বাবার নিষেধ করা স্বত্তেও শ্রাবণের চিঠির জবাব দেয়া অসম্ভব ছিল আমার পক্ষে। কখনো না দেখলেও ওনাকে আমি মন থেকেই ভালোবাসতাম। উনি ছিলেন আমার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা। যাকে কখনোই ভোলা সম্ভব নয়। ওনার শত শত চিঠি পাবার পরও উত্তর দিতে পারার অপারগতা আমাকে কুরেকুরে খেত। একপ্রকার মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল আমার কিশোর মন। তখনি আচমকা আমার জীবনে প্রত্নর প্রবেশ।
আমরা দুজনে একই ক্লাসে পড়তাম ভিন্ন কলেজে। আমাদের দেখা হয়েছিল একটা পিকনিক স্পটে। সেদিন ওদেরও পিকনিকে নিয়ে আসা হয়েছিল ওদের কলেজ থেকে। ও-ই প্রথম আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়। ভালো ছেলে মনে হওয়ায় আমিও আপত্তি জানাই না বন্ধু হতে। আমাদের নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হতো। ধীরে ধীরে ও আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায়। একদিন হুট করেই ও আমাকে প্রপোজ করে বসে। আমাকে জানায়, ও প্রথম থেকেই আমাকে পছন্দ করতো, ভালোবাসতো। আমি তখনো আমার প্রথম প্রেমকে ভুলতে পারিনি। ওকে তার ব্যাপারে সবই জানাই। প্রত্ন জানায়, যেহেতু বাবা আমার পত্রপ্রেমিককে পছন্দ করছে না, আবার সে কে তাও আমরা জানি না সেহেতু তার সাথে ভবিষ্যতে কোনো রকম সম্পর্ক হবারও সম্ভাবনা নেই। তাকে ভুলে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। একপ্রকার তাকে ভোলার উদ্দেশ্য নিয়েই আমি প্রত্নর সাথে নামমাত্র প্রেমের সম্পর্কে জড়াই। তাকে ভুলতে পেরেছি কি-না জানিনা। তবে প্রত্নকে কখনো সেভাবে ভালোবেসে উঠতে পারিনি। প্রত্নও জানতো সেটা। ওর নিজেরও এ নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না। প্রত্ন সবসময়ই বলত, ওর একার ভালোবাসাই আমাদের দুজনের জন্য যথেষ্ট। প্রত্নর দিক থেকে ভালোবাসার কোনো কমতি না থাকলেও আমার দিক থেকে কেবল বন্ধুত্বই ছিল। তবুও প্রত্ন কখনো চাইতো না সম্পর্কটা ভাঙ্গুক। এভাবেই এতদিন যাবৎ আমাদের প্রেম নামক সম্পর্কটা চলেছে।
শ্রাবণকে সব বুঝিয়ে বলতে হবে। তিনি নিশ্চয়ই এতদিন যাবৎ আমাকে ভুল বুঝে বসে আছেন!

শ্রাবণের নম্বরটায় ডায়াল করতেই রিসিভ করে কেউ ‘হ্যালো’ বলল। সঙ্গে সঙ্গে আমি গরগর করে বলতে আরম্ভ করলাম, ‘আমি আপনার সাথে ফিরতেই চাই শ্রাবণ! ‘

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এল না। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার পর উত্তর এল, ‘সত্যি বলছো হৃদি!’

‘হ্যা!’

‘আমি এখনি আসছি!’

এতক্ষণে গাড়ির আওয়াজ আমার কানে এল। ‘আপনি কী চলে যাচ্ছিলেন? ‘

শ্রাবণ উত্তর দিলেন, ‘হ্যা।’

‘কেন?’

শ্রাবণ হঠাৎ গলার স্বর নামিয়ে নিলেন, ‘তুমি আমাকে ঘৃণা করো তাই।’

আমি কী জবাব দেবো খুঁজে পেলাম না। শ্রাবণ আবার বললেন, ‘হৃদি?’

‘হুম?’

‘আমি আর কখনো তোমাকে হারাতে চাই না।’

_______________

গতকাল আমাদের অ্যানিভার্সারি ছিল। দু’বছর হয়ে গেছে শ্রাবণের সঙ্গে আমার বিয়ের। বেশ বড় করেই উদযাপন করা হয়েছিল গতকালের দিনটা। আমি ক্লান্ত ভঙ্গিতে শোবার ঘরে বারান্দায় রাখা চেয়ারটায় বসে আছি। প্রত্যেক বছর এ দিনটায় এক অদ্ভুত কারণে আমার প্রত্নর কথা মনে পড়ে। এখনো পড়ছে। সেদিন রাতে শ্রাবণের সাথে ফেরার পরপরই আমি প্রত্নর মৃত্যুর কথা জানতে পারি। আমাদের বাসা থেকে ফেরার সময়ই সম্ভবত ওর এক্সিডেন্টটা ঘটে। কার এক্সিডেন্ট। এরপর আটাশ অক্টোবর আমার আর ওর সঙ্গে দেখা করা হয়ে উঠেনি। ওর না বলা কথাগুলো শোনা হয়ে উঠেনি। সারপ্রাইজ পাওয়াটাও বাকি রয়ে গেছে। প্রত্ন আমার জীবনের কিছুই ছিল না। আবার অনেক কিছুই ছিল। জীবনে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে যাকে পাওয়া যেত সে ছিল প্রত্ন। ভালোবাসার পরিবর্তে ভালোবাসা না পেয়েও যে আমাকে ভালোবাসতো সে ছিল প্রত্ন। নিজের মন খারাপ নিয়েও যে আমার মন ভালো করতে উঠে পড়ে লাগত সে ছিল প্রত্ন। প্রত্ন ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। বেঁচে থাকতে কতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছি, অবহেলা করেছি! এখন আফসোস হয় ভীষণ! ওর দিক দিয়ে তো ও কখনো ভুল ছিল না! আমিই তো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে আজীবন সবাইকে কষ্ট দেই। নিজের ওপর রাগ হয়। এত ইমম্যাচিউর এত বোকা কেন আমি!
মাঝে মাঝেই ওর শূন্যতা আমি ভীষণভাবে অনুভব করি। কিছু বলার থাকে না। কিছু করারও থাকে না। আমার কান্না পায়। কিন্তু জানিনা কেন কাঁদতেও পারিনা। দম বন্ধ হয়ে আসে শুধু। তখন শ্রাবণ এসে সামলে নেন আমাকে। উনি ভালো করেই জানেন প্রত্নর প্রতি আমার এই ভালোবাসা শুধুই বন্ধুত্বের। তাই রাগ না দেখিয়ে উলটো স্বান্তনার হাত বাড়িয়ে দেন। আগের মতো বদমেজাজী থাকলে হয়তো উনি আমার এই কান্নাকাটি দেখলে রেগে যেতেন। কিন্তু এখন আর উনি তেমনটা নেই। ওনার অনুদ্ধত স্বভাব মাঝে মাঝেই আমাকে ভীষণ অবাক করে।আমার জন্য এতটা বদলে নিয়েছেন নিজেকে!

ভাবনায় এতটাই ডুবে ছিলাম যে বুঝতেই পারিনি কখন শ্রাবণ এসে পেছনে দাঁড়িয়েছেন! কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে পেছন ফিরে দেখি উনি দাঁড়িয়ে। আমাকে কাঁদতে দেখে হঠাৎ আমার হাত ধরে দাড় করিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ‘কাঁদে না বউ! ‘ এরপর আমার পেটে হাত রেখে বললেন, ‘তুমি কাঁদলে তোমার সাথে সাথে আমার আর আমাদের সন্তানেরও যে মন খারাপ হয়!’

আমি শ্রাবণের বুকে মাথা রাখলাম। আমার বাবার পরে একমাত্র এই মানুষটার বুকেই যেন সমস্ত প্রশান্তি।
আমি মুখ উঁচু করে শ্রাবণের দিকে তাকালাম। ‘আমি খুব ভাগ্যবতী আপনাকে পেয়ে!’

শ্রাবণ আমার কপালে চুমু খেলেন। ‘আমি আরো বেশি ভাগ্যবান তোমাকে পেয়ে!’

আমি আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আমার পাগল মানুষটাকে।

“সমাপ্ত”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here