জলচক্ষু পর্ব ৫এবং শেষ

গল্প :- #জলচক্ষু
পর্ব :- ০৫ এবং শেষ
লেখক :- অনন্য শফিক
.
.
.
-: “মিতু আমায় নিয়ে পরদিনও দেখা করতে গেলো না। কিন্তু ওকে হঠাৎ দেখলাম মোবাইল নিয়ে কেমন মনোযোগী হয়ে যেতে। সারাক্ষণ অনলাইনে থাকে সে।এর আগে তো এমন ছিল না মিতু!
আমি বললাম,’এই মিতু,তুই আমার সাথে কথা বলছিস না কেন?আর ফোনে তো এর আগে তুই অত মনোযোগী ছিলি না। এখন কীভাবে এতো মনোযোগী হয়ে পড়লি?’
মিতু অদ্ভুত করে হাসলো।আর বললো,’মাথা মোটা তুই কিছুই বুঝবি না!’
আমি ওর চোখের দিকে শুধু তাকালাম। এমন মায়াবী চোখের একটা মেয়ে কী করে আমার সাথে এমন প্রতারণা করতে পারলো!

সারাদিন আমি কিছু খাইনি।মিতুও আমায় খাবারের জন্য যত্ন আত্মাদি করেনি।ও হঠাৎ করে যেন কেমন হয়ে গেছে! এইসব কিছু আমি আর নিতে পারছি না।
তাই আমি শিমুলকে ফোন দিলাম। কিন্তু শিমুলের ফোন বন্ধ।
অথচ মিতু হেসে খেলে কার সাথে একটু পর পর কথা বলছে। আমার মনে হয় শিমুল নতুন নম্বর নিয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কিছুতেই মুখ খুলছে না মিতু।
আমি সহ্য করতে পারছি না মিতুর এমন আচরণ।তাই মিতুর একটা হাত খপ করে ধরে ফেললাম আমি। তারপর সেই হাত আমার পেটের কাছে টেনে এনে চেপে ধরলাম আর বললাম,’এই দ্যাখ মিতু,দ্যাখ। এইখানে শিমুলের রক্ত।চার মাস বয়সী শিমুলের অস্তিত্ব আমার পেটের ভেতর। তুই কী করে এই নিস্পাপ প্রাণটার সাথে বেঈমানি করলি মিতু?’
কথাগুলো বলে আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।
মিতু বললো,’তুই শান্ত হ এনা।তোর চটপটে ভাবটার জন্যই তোর কপালে এতো দুঃখ!’
‘দুঃখ তো তুই ই দিচ্ছিস।আমি কী দোষ করেছিলাম যে আমার শিমুলকে তুই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছিস?’
মিতু অদ্ভুত করে হাসলো।এই হাসিটা বেশ রহস্যজনক। হেসে সে বললো,’আসলে কেউ কাউকে কেড়ে নিতে পারে না। শরীর কেড়ে নেয়া যায় কিন্তু মন না।’
‘তুই ওর মন কেড়ে নিয়েছিস। এখন ওর শরীরও কেড়ে নিতে চাইছিস!’
মিতু আবার হাসলো।সেই রহস্যময় হাসি।
তারপর বললো,’আমি তোর মতো মাথা মোটা না যে কাউকে শরীর দিয়ে বসবো!’
‘তাহলে কী চাস তুই শিমুলের কাছ থেকে।তোর জন্য শিমুল আমায় ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছে কেন? তুই ওকে কী বুঝিয়েছিস?’
মিতুর ফোন এসেছে আবার। আমার কথার উত্তর সে দিলো না। শিমুল ফোন করেছে।
ও পাশ থেকে শিমুল বললো,’তুমি আজ আসলে না কেন?’
মিতু বললো,’আমার মন চাইনি তাই।’
‘আমার না খুব মন খারাপ হয়েছে জানো!’
‘আচ্ছা।’
‘কাল একেবারে সকাল সকাল আসবা কিন্তু!’
‘যদি না আসি?’
‘মরে যাবো আমি!’
‘মরে যাবে?’
‘হুম মরে যাবো।’
‘কেন?মরে যাবে কেন?’
‘তুমি জানো না কেন মরে যাবো?তোমায় না দেখতে পাওয়ার বিরহ আমায় পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে।’
‘আই সি!’

আমার আর সহ্য হলো না।আমি খপ করে মিতুর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলাম। কিন্তু ততক্ষণে লাইন কেটে গেছে ফোনের।আর হাতের চাপ পড়ে ওর ফোন লক হয়ে গেছে।
আমি রাগ সামলাতে না পেরে মিতুর গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম।আর বললাম,’তুই আমার সবচেয়ে বড় শত্রু।’
মিতু তার গালে হাত চেপে ধরে চোখের জল ফেলে দিলো। তারপর চুপচাপ চলে গেল ওয়াশরুমের দিকে।

পরদিন মিতু আমায় নিয়ে জয়নুল আবেদীন পার্কে শিমুলের সাথে দেখা করতে গেলো।
আমি কোনদিন বোরখা পরিনি। কিন্তু মিতুর কথায় বোরখা পরতে হলো। আমার যাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু একবার কেন যেন মনে হলো দেখে আসি ওদের সম্পর্কটা কতদূর এগুলো!

পার্কে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শিমুল অনেকবার ফোন করলো মিতুকে। ফোন করে বারবার বলছে,’এখনও আসছো না কেন?সেই কখন থেকে আমি পার্কে এসে বসে আছি।’
মিতু বললো,’আরেকটু ওয়েট করো।আমরা এসে গেছি প্রায়।’

পার্কে পৌঁছে মিতু শিমুলকে ফোন করে বললো,’আমরা ব্রক্ষ্মপুত্রের পাড় ঘেঁষা হলুদ রঙা বাদামি ওয়ালা নৌকৌটায় বসে আছি। আমাদের দুজনের বোরখাই কালো।দেখা যায় আমাদেরকে?’
শিমুলকে প্রথমে আমি দেখিনি। কিন্তু একটু পর দেখলাম এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।তার চোখে উৎপুল্লতা। হঠাৎ সে হাত উপরে তুলে বললো,’দেখেছি দেখেছি।’
মিতু বললো,’আসো।নীচে নেমে এসো।’
শিমুল ফোন কেটে দিয়ে নীচে নেমে এলো। তারপর এসে বসলো মিতুর পাশে।
আমি ওদের থেকে খানিক সড়ে গেলাম।আর দেখতে লাগলাম ওরা কী করে।
শিমুল খানিক সময় চুপচাপ থেকে মিতুকে বললো,’মিতু, তোমার মুখটা তো খুলো।’
মিতু বললো,’আমার লজ্জা করে।আমি মুখ খুলতে পারবো না।’
শিমুল তখন ফিসফিস করে ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে বললো,’লজ্জা করে তো বউ হবে কী করে?’
এটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই মিতু তার হাত উঠিয়ে এমন চড় বসালো শিমুলের গালে যে শিমুল খানিক দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লো।
শিমুল কিছু বুঝতে না পেরে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো।
মিতু এবার বললো,’এই লম্পট।কয়টা মেয়েকে তুই বিয়ে করবি আর কয়টা মেয়েকে তুই ভালোবাসবি?’
কথাটা বলে আমার মুখের নেকাব এক টানে খুলে দিলো মিতু। আমার চোখ তখন টকটকে লাল।
আমায় দেখে শিমুলের অবস্থা মরণাপন্ন রোগীর মতো হলো।
সে এবার থতমত করে বললো,’এনা তুমি এখানে?’
আমি চুপ করে রইলাম। কোন কথা বললাম না।
মিতু এবার তার নিজের পা থেকে জুতো খুলে নিলো।আর সেই জুতো আমার হাতে দিয়ে বললো,’ওকে যতোক্ষণ তোর শরীরে শক্তি আছে ততোক্ষণ পেটা।’
আমি ওর কাছ থেকে জুতো নিয়ে রেখে দিলাম নৌকোর পাটাতনে।আর হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম তখন। কাঁদতে কাঁদতে বললাম,’শিমুল, তুমি এতো নীচ! মাত্র দু দিনেই কারোর প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করে ফেলতে চাও!অথচ তাকে চেনো না। জানো না?’
শিমুল হাত জোড় করে বললো,’সরি এনা। আমার ভুল হয়ে গেছে।আর এমন হবে না।’
মিতু তখন ওকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলো। তারপর সে আমার দিকে তাকালো। তাকিয়ে বললো,’শিমুলকে ক্ষমা করে দেয়া হবে তোর দ্বিতীয় ভুল।যে ভুলের মাশুল তোকে দিতে হবে সারা জীবন।আমি চাই না তুই এই ভুল কর!’
আমি অনেকক্ষন ধরে ভাবলাম। এতো দিন যে সহজ আবেগ আর ভালোবাসার জন্য আমি যে কষ্ট পেয়েছি আমি তা আর পেতে চাই না। শিমুলেরা বিষধর জাতের সাপ।এদের সহজে বিশ্বাস করা যায় না!

শিমুলকে ছেড়ে চলে এসেছি আমরা। হোস্টেলে ফিরে মিতুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছি,’বোন, তোকে আমি অনেক ভুল বুঝেছি।আমায় ক্ষমা করে দে!’
মিতু হেসে বললো,’ধুর বোকা মেয়ে। তুই আসলেই মাথামোটা। তোর প্রতি আমি রাগলে তো আমি তোকে ক্ষমা করবো!’
————–
শিমুলের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার সপ্তাহ খানেক পর হঠাৎ করে মিতু বললো,’একটা সুখবর আছে তোর জন্য এনা।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’কী সুখবর?’
মিতু বললো,’আমার ভাইয়ের জন্য তোকে বউ করে নিবো। সন্তান সহ বউ।হি হি হি।’
আমি মিতুর চোখের দিকে তাকালাম।এতো মায়াবী তার চোখ।এতো মায়া তার মনে!
মিতু আমার জন্য মিতু হওয়ার উপায় বের করে দিলো।আমি সত্যিই মিতু হতে চাই। সহজ সরল অথচ চৌকস মিতু।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here