#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন
|২৪|
ঝাড়বাতির মৃদু আলোয় রিমঝিমের রুমটা হালকা আলোকিত হয়ে আছে।পাশের সাইড বক্সের উপর রাখা কলমটা সহ ডায়েরি টা হাতে তোলে নিলো।মধ্যরাত টা যেনো অতীত স্মৃতিচারণ করার মোক্ষম সময়।দিনের ব্যস্ততম সময় পার করার পরও মধ্যরাতে ঠিকই পাকিস্তানি বাহিনীদের মতো হানা দিয়ে উঠে অতীতের এক একটি ঘটনা।রিমঝিমের কাছে মনে হয় অতীত হলো একটি বিষের মতো।বিষ খেলে যেমন শরীর আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যায় ঠিক তেমনি,অতীতের এক একটি ঘটনা মনকে একপলকেই দূর্বল করে দেয়।শুধু তাই নয়,চোখের পানিকেও অবাধ্যভাবে ঝড়তে দিতে হয়।রিমঝিম দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছাড়লো।আজও ব্যতিক্রম কিছু হয় নি।চোখ দিয়ে তার অজোরে পানি পড়ছে।কপাল ব্যথায় টনটন করায় অবহেলায় চোখের পানিটুকু মুছে নিলো।বিছানার পাশে বিদ্যমান সাইড বক্সের ড্রয়ার টা খোলে অয়েন্টমেন্ট টা লাগিয়ে নিলো।বিছানায় হেলান দিয়ে ঠিকঠাক করে বসে পড়লো।বারবার চোখের সামনে শুধু সেদিনের ঘটনা গুলো ভেসে উঠছে।রিমঝিম নিজেকে শক্ত রাখতে গিয়েও খুব হিমশিম খাচ্ছে।টপটপ শব্দ করে দু’ফোঁটা অশ্রুদানা ডায়েরির সাদা কাগজ টায় জায়গায় করে নিলো।কাঁপা কাঁপা হাতে কলম টা নিয়ে গুটিগুটি অক্ষরে লিখতে লাগলো,
🍁🍂
সবকিছু সহ্য করে নিলেও ভালোবাসার মানুষটির অবহেলা যেনো কিছুতেই সহ্য করা যায় না।এ যেনো এক মরণযান্রণা।চারপাশের সবকিছুই যেনো বিষাদ হয়ে যায়।চাইলেও কোনোকিছু স্বাভাবিক করা যায় না।ঠিক এমনটাই এখন হচ্ছে আমার সাথে।আমি চাইলেও নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছি না।চোখের সামনে প্রতিনিয়ত দেখছি রক্তিম ভাইয়ের অবহেলা।যে চোখ দিয়ে রক্তিম ভাই ভালোবাসার দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেন আজকে,সেই চোখে ফুটে উঠেছে একরাশ রাগ,ক্ষোভ আর সেই সাথে বিরক্তি।আমি নিশ্চিত রক্তিম ভাই ইচ্ছে করে আমার সাথে এমন করছেন।একদিন বিকেলে রক্তিম ভাই ছাঁদে দাঁড়িয়ে ফোনে কারোর সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলেন।আমি তখন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলাম রক্তিম ভাইয়ের হাবভাব।রক্তিম ভাইয়ের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে অনুমান করলাম,রক্তিম ভাই খুশি মুডে আছেন।এখন অত্যন্ত আমাকে অবহেলা করবেন না।উঁহুহু!আমার ধারণা ভুল ছিলো সেদিন।সেদিনও রক্তিম ভাই আমাকে ইগনোর করে চলে যেতে চেয়েছিলেন।রক্তিম ভাইয়ের এরূপ আচরণ যেনো আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারলাম না।বুকের ভিতরে অসহনীয় ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম।রক্তিম ভাই চলে যেতে নিলেই আমি হাতজোড়া আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠলাম।ক্রন্দনরত গলায় বললাম,
‘রক্তিম ভাই!কেনো আপনি এইরকম করছেন?আমি পারছি না এইসব সহ্য করতে।প্লিজ!আপনি আগের মতো হয়ে যান।আমাকে আগের মতো ভালোবাসায় আবদ্ধ করে নিন।’
রক্তিম ভাই গভীর ভাবে তাকালেন আমার মুখপানে।ভাবলাম,রক্তিম ভাইও উপলব্ধি করতে পারছেন আমার কষ্ট।এবারও আমি হতাশ হলাম।রক্তিম ভাই ছিটকে সরিয়ে দিলেন আমার হাতখানা।কিছুটা দূরে সরে গেলেন আমার থেকে।আঙুল তোলে শাসিয়ে বললেন,
‘তোকে বলেছি না আমার থেকে দূরে থাকতে।তাহলে,বারবার কেনো আমার কাছে আসছিস।তোকে আমার সহ্য হয় না তা কি তুই বুঝিস না,নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকিস।’
‘রক্তিম ভাই কি হয়েছে বলুন তো আপনার!!কয়েকদিন ধরেই আপনি আমার সাথে এমন আচরণ করছেন।একপ্রকার এঁড়িয়ে চলছেন।আমি তো আপনার বউ,আর আপনি তো আমাকে ভালোওবাসেন তাই না রক্তিম ভাই!!’
রক্তিম ভাই কঠোর গলায় বলে উঠলেন,
‘আগে যা যা হয়েছিলো তা ভুলে গেলে তোর জন্যই ভালো রিমঝিম।কারণ,আমি তোকে আমার বউ হিসেবে আর মানি না।’
রক্তিম ভাই আর দাঁড়ালেন না।হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন ছাঁদ থেকে।আমি স্তব্ধ হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছি।রক্তিম ভাইয়ের কথাগুলো কানের পাশে পোঁকার মতো ভনভন করছে।মনে মনে ভাবছি!কি অবলীলায় বলে দিলেন রক্তিম ভাই!এই বিয়েটা নাকি আর মানেন না।তাহলে,এতোদিন কেনো আমাকে কাছে টেনে নিলেন!স্বামীর অধিকার ফলালেন!বুকের ভিতর টা কেমন হাহাকার করছে।মাথার উপর কড়া সূর্য।তার তেজ সে কখন থেকেই দেখিয়ে যাচ্ছে।সূর্যের তেজের প্রকোপে আমার মাথা টা ঘুরে উঠলো।চোখ দুটো নিমিষেই ঝাঁপসা হয়ে আসলো।শরীর টা কেমন দুলছে!আমি উপলব্ধি করতে পারছি,আমার শরীর টা যেনো আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসছে।তারপর!তারপর আর কি হলো তা আমার জানা নেই।চোখ,খোলে নিজেকে রুমে আবিষ্কার করলাম।ঘরটা অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে।কপালে ব্যথা অনুভব করতেই চোখ,মুখ খিঁচিয়ে আসলো।পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি মা আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে।সাইড বক্সের উপর হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে ফোন টা নিয়ে সময় টা দেখে আমার চোখ দুটো চড়াকগাছ।চারটা বাজতে চললো।কিছুটা দ্বিধায় আছি,এখানে কীভাবে আসলাম।আমি তো ছাঁদে ছিলাম।ছাঁদের কথা মনে আসতেই রক্তিম ভাইয়ের কথাগুলোও নিমিষেই মনে পড়ে গেলো।সেই সাথে শুরু হলো বুকে তীব্র ব্যথা।নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছি।আমার মন কিছুতেই মানছে না রক্তিমি ভাইয়ের বলা কথা গুলো একটাও সত্যি।বারবার মনে হচ্ছে,রক্তিম ভাই কোনো এক কারণে ইচ্ছে করে আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন।নিজেই নিজের মনকে শান্ত করতে উঠে-পড়ে লেগে গেলাম।কিন্তু,মনও খুব অবাধ্য হয়ে আছে।কিছুতেই মানতে রাজি নয়।সেদিন কোনোমতে রাত টা পার করেছিলাম।এভাবেই মাঝখানে আরো কয়েকটা দিন কেটে গেলো।এই কয়েকটা দিনে রক্তিম ভাইয়ের সাথে আমার দূরত্ব কমার বদলে অনেকটা বেড়ে গিয়েছে।গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফটিয়ে দিনগুলো পার করেছি।সামনে থাকা অব্দি কিছুই বলতে পারছি না।এই কয়েকদিনের মধ্যেই বাসায় তনায়া আপু আর বাবু এসেছিলেন।বিয়ের পর এই প্রথম আসা তাদের।রক্তিম ভাইয়ের সাথে কথা বলার অনেক সুযোগ পেলাম কিন্তু,বরাবর মতোই রক্তিম ভাই আমাকে ইগনোর করে গেলেন।রাগে দুঃখে ওইদিন দৌড়ে রুমে চলে এলাম।দরজা বন্ধ করে পাগলের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।ভালোবাসার মানুষের থেকে প্রথমবারের মতো অবহেলিত হয়েছি।নিজেকে যেনো মানাতেই পারছি না।এইভাবে কেটে গেলো আরো কয়েকটা দিন।ভিতরে ভিতরে যেনো প্রতিনিয়ত আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।
—-
টেবিলে বসে অন্তরীকরণ অধ্যায় টা করছিলাম।বারবার সূত্রে গিয়ে তালগোল পাঁকিয়ে ফেলছি।একই ভুল করে সাইনের স্থলে কস!আর কসের স্থলে সাইন।সেই সাথে প্লাস,মাইনাসও ভুল যাচ্ছে।রাগে ম্যাথ বইটা বন্ধ করে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লাম।তখনি ফোন টা বেজে উঠলো।ফোনের স্ক্রিনে তারিন আপুর নাম্বার দেখে বেশ খানিকটা অবাক হলাম।অবাকের রেশ নিয়েই ফোন টা কানে চেপে ধরলাম।ফোনের অপাশে তারিন আপুর হাসির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।এমতাবস্থায় আমাকে কিছুটা ঠেস দিয়ে বললেন,
‘কি ছেড়ে দিয়েছো তো রক্তিম?আমি জানতাম এটাই হবে।রক্তিম তোমাকে কোনোদিনও ভালোবাসে নি।’
অবাকের রেশ যেনো আরেকটু এসে যোগ হলো।তারিন আপুর আবারও হাসলেন।ঝাঁঝালো হাসির আওয়াজ শুনে আমার মন-মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।কড়া গলায় বললাম,
‘সমস্যা কি আপনার তারিন আপু?আমাকে এখন ফোন দিয়ে কি এইসব বলতে চাচ্ছেন?’
‘বাহ্!রিমঝিম!তোমার তেজ তো দেখি একটুও কমলো না।অবশ্য,তাতে আমার কিছুই আসবে যাবে না।আসল কথা হলো,রক্তিম আমার।এতোদিন তোমার সাথে শুধুমাত্র ভালোবাসার অভিনয় করে গিয়েছে।আর,তুমিও রক্তিমকে বিশ্বাস করে একদম নিজেকে রক্তিমের কাছে বিলিয়ে দিয়েছো।রক্তিমের সাথে সঙ্গ দিয়েছো।এখন তো তোমাকে ভুগতে হচ্ছে।’
‘মিথ্যা বলছেন আপনি তারিন আপু!রক্তিম ভাই আমার।শুধু আমাকেই ভালোবাসেন।আর কাউকে না!’
‘এখনো এক কথাতেই আছো তুমি।শোনো রিমঝিম!রক্তিম তোমাকে ভালোবাসে না।ভালোবাসলে কি তোমাকে অবহেলা করতে পারতো?তুমি কষ্ট পাচ্ছো তা কি সহ্য করতে পারতো?উঁহুহু!রিমঝিম তা কখনোই পারতো না।তুমি ঠিকই ধরেছিলে,তোমাকে আমিই ম্যাসেজিং করতাম।তোমার কাছে সেগুলো ম্যাসেজ নাকি থ্রেট তা একমাত্র তোমার নিজস্ব ভাবনা।এতে আমার কোনো বক্তব্য নেই।তবে,বলেছিলাম তো!যে আমিই জিতবো।আর তুমি হারবে।দেখলে তো একদম সেটাই হলো।রক্তিম তোমাকে কোনোদিনও ভালোবাসে নি।শুধুমাত্র ভালোবাসার অভিনয় করে গিয়েছে।’
তারিন আপু কথাগুলো বলেই ফোনটা কেটে দিলেন।ফোনটা রেখে আমি দৌড়ে গেলাম রক্তিম ভাইয়ের রুমে।এইসব কিছুর প্রশ্নের উত্তর রক্তিম ভাইকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হবে।আমি শুধুমাত্র রক্তিম ভাইয়ের মুখ থেকেই শুনতে চাই।কিন্তু,আমার মন বলছে,তারিন আপুর কথাগুলো মিথ্যে ছিলো।রক্তিম ভাই আমার সাথে এইরকম করতেই পারেন না।রক্তিম ভাইয়ের রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমি যেনো আরেকদফা চমকে উঠলাম।রক্তিম ভাই চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলছেন,
‘আমি রিমঝিমকে ভালোবাসি না!এমনকি!কোনোদিনও ভালোবাসি নি।এতোদিন শুধু তার সাথে অভিনয় করে গিয়েছি।’
সেখানেই পা দুটো আঁটিকে গেলো।ভিতরে ঢোকার আর ইচ্ছে হয়নি।আমার যা যা প্রশ্ন ছিলো সবগুলোর উত্তর রক্তিম ভাইয়ের এক কয়েক লাইনেই দিয়ে দিয়েছেন।নিজেকে সামলে নিয়ে দৌড়ে রুমে চলে আসলাম।দরজা টা বন্ধ করে দিয়ে ফ্লোরে বসে বিছানার চাঁদর টা আঁকড়ে ধরে চিল্লিয়ে কেঁদে উঠলাম।আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না রক্তিম ভাই আমাকে ঠিকিয়েছেন।ভালোবাসার অভিনয় করে গিয়েছেন প্রতিনিয়ত।এরিমধ্যে ফোনের ম্যাসেজ টোন ভেসে আসলো।তারিন আপু রক্তিম ভাই আর উনার ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি পাঠিয়েছেন।তারিন আপুর নগ্ন বুকে রক্তিম ভাই মুখ গুঁজে আছেন।ছবিটা দেখেই আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো।আর কিছু ভাবতে পারলাম না।চুল গুলো খাঁমছে ধরে আছি।চারপাশের সবকিছু বিষাদ লাগছে।মরে যেতে ইচ্ছে করছে।সারাটা রাত আমি দু’চোখের পাতা এক করতে পারি নি।বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে কোনোমতে রাতটাকে পার করলাম।
—-
মনে মনে পণ করে নিয়েছি রক্তিম ভাইয়ের সামনে আর কোনোদিনও যাবো না।নিজেকে যতটা সম্ভব শক্ত রাখার চেষ্টা করবো।সেটাই করছি!রক্তিম ভাইকে দেখেও এখন না দেখার ভান করে থাকি।দু’জন যেনো সামনে থেকেও দু’প্রান্তে চলে যাচ্ছি।রক্তিম ভাইকে দেখলেই আমার খুব ঘৃণা হয়!চোখে ভেসে উঠে তারিন আপু আর রক্তিম ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সেই ছবিটা।এইভাবেই দিন গড়িয়ে যাচ্ছে।সবার সবকিছু আগের নিয়মে থাকলেও আমার সবকিছু ঝড়ের গতিতে উলোটপালোট হয়ে গিয়েছে।তাও!সময়ের সাথে সাথে নিজেকে মানিয়ে চলছি।একদিন কলেজ থেকে এসে দেখলাম বড়’বাবা আর বাবা কি নিয়ে যেনো ঝগড়া করছে।বাসার অবস্থা বেগতিক।মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।অদূরে বসে দাদি বিলাপ করছে।আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না।বড়’বাবা বাবাকে অনেক কথা শুনাচ্ছে!বাবাও কম না!দু’জনের মুখ যেনো সমান তালে চলছে।বাবা করুণ গলায় বড়’বাবাকে বললো,
‘বড় ভাই!এই কোম্পানিতে আমারও অনেক পরিশ্রম রয়েছে।তুমি আমাকে না জানিয়েই কোম্পানি টা নিজের নামে করে নিয়েছো।আর,এখন আমাকে কোম্পানি থেকে বেরও করে দিচ্ছো।এইটা অন্যায় করছো তুমি বড় ভাই।’
বড়’বাবা খেঁকিয়ে উঠে বললো,
‘তুইও তো কম না সাদিক!এই কোম্পানি থেকে টাকা চুরি করে তুই রাশিয়াতে আমার অজান্তে একটা কোম্পানি কিনেছিস।এইজন্য তো টাকার হিসেব সবসময় গোলমেলে হয়ে থাকতো।লোভী কোথাকার!টাকা চুরি করে নিয়ে নিজের নামে কোম্পানি করতে পারছিস আর আমি এইটা নিজের নামে করে নিলেই দোষ।’
‘মিথ্যে কথা বড় ভাই।রাশিয়ায় যে কোম্পানি টা আছে ওইটা আমি জমি বিক্রি করে কিনেছি।আব্বা আমাদের চারভাইয়ের নামে অনেক সম্পত্তিই লিখে দিয়েছিলেন।আমার ভাগের টা বিক্রি করে আমি ওই কোম্পানি টা কিনেছি।রাশিয়ায় তো প্রায়ই যাওয়া হতো মিটিং এর জন্য।আর,কোম্পানির টাকার হিসেব রাখতে তুমি আমি না।’
বড়’বাবা ধাক্কা মেরে বাবাকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিলো।আমার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসলো।দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম।ঝাঁপসা চোখে দেখছি,রক্তিম ভাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বললাম,মেরুদণ্ডহীন পুরুষ একটা।বড়’বাবা পুনরায় তেড়ে আসতে নিলেই আমি বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,
‘আমার বাবাকে আমি চিনি।টাকা চুরি করে এইসব করবে তা কখনোই বিশ্বাস করি না আমি।শুধু শুধু আমার বাবাকে মিথ্যা অপবাদ তুমি দিবে না বড়’বাবা।কোনো সন্তান এইটা সহ্য করতে পারবে না।’
সেখানে আর এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়ায় নি।বাবা,আর মা’র হাতে ধরে টেনে নিয়ে আসি রুমে।রুমে আসতেই বাবার অসহায় মুখটাকে দেখে কান্না চলে আসলো।আর,মা’তো সেই কখন থেকেই কেঁদে যাচ্ছে।
—-
দিনদিন যেনো সবকিছুই বিষিয়ে উঠছে।পরিবারের সব সদস্য রাও একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।তার মধ্যেই ধরা পড়ে গেলাম আমি মা’র কাছে।দিনটি ছিলো বুধবার।দুপুরের দিকে বারান্দার দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে কান্না করছিলাম।সবকিছুর সাথে যেনো হাঁপিয়ে উঠেছি।তার উপর রক্তিম ভাইয়ের দেওয়া কষ্ট গুলোর ঘা যেনো এখনো শুকোয় নি।একা থাকলেই সেগুলো মাথায় এসে কিলবিল করে।মা আমাকে কাঁদতে দেখেই কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলো।তারউপর,রক্তিম ভাইয়ের নাম ধরে হাজারো বুলি ফুটিয়ে কথাগুলো বলে নিজের মনকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করছিলাম।কিন্তু,সেদিন মা সব শুনে নিয়েছিলো।আমাকে কয়েকটা থাপ্পড় দিয়ে থামলেন।আচমকাই থাপ্পড় খেয়ে আমি একদম চুপ হয়ে গিয়েছিলাম।বলতে গেলে মা’কে দেখে আমি বাকরুদ্ধ।মা আমার চুলের মুঠি ধরে অনেক মেরেছিলো।মা’র পা দুটো ধরে আমি শুধু নিরবে অশ্রু ত্যাগ করেছিলাম।ওইদিন রাতেই,আরেকটা বিপত্তি বাজলো।গভীরে রাতে নিজের রুমে রক্তিম ভাইকে দেখে প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।পরমুহূর্তেই এতোদিনের করা সব কান্ড-কারখানা মনে পড়তেই রক্তিম ভাইয়ের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম।রক্তিম ভাই হুট করেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।গলায় মুখ গুঁজে বললেন,
‘রিমঝিম আমার কাছে ফিরে আয় প্লিজ।তোকে আমি আর কষ্ট দিবো না সত্যি বলছি।’
সেদিন কি হয়েছিলো জানা নেই আমার।মাথায় রাগ চেপে ধরেছে।রক্তিম ভাইকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিলাম।কঠোর হয়ে বললাম,
‘কাঁটা গা’য়ে নুনের ছিঁটা আর দিতে হবে না।আপনাকে আমার দেখতেও ইচ্ছে করছে না রক্তিম ভাই।ঘৃণা করি আপনাকে।’
রক্তিম ভাইকে বাহিরে বের করে দিয়ে দরজা টা লাগিয়ে দিলাম।রক্তিম ভাইয়ের ডাক শুনেও আমি কিছু বললাম না।নিজেকে শক্ত করে ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।তার কয়েকদিন পরেই মা একপ্রকার বায়না ধরে রাশিয়া তে শিফট হবে।মা কেনো রাশিয়াতে শিফট হতে চাচ্ছেন তা আমার অজানা নয়।কারণ টা আমি নিজেই।এমন কোনো দিন নেই আমি মা’র বুকে মুখ গুঁজে রক্তিম ভাইয়ের জন্য কাঁদি না।মা শুধু আমাকে জাপটে ধরে রাখে।রাশিয়ায় শিফট হওয়ার ব্যাপার টায় প্রথম সায় না দিলেও মা’র জোরাজুরিতে পরে ঠিকই রাজি হয়ে গেলাম।বাবা সবকিছু কয়েকদিনের মধ্যেই ঠিকঠাক করে ফেলে।তারপরেই,রাশিয়াতে চলে আসি আমরা।আসার আগ পর্যন্ত রক্তিম ভাইকে একবারও দেখি নি।এয়ারপোর্টে বড়’বাবা আর রক্তিম ভাই বাদে সবাই এসেছিলো।দাদির অসহায় মুখ টা আমার চোখে এখনো ভাসে।ছেলেকে দূরে যেতে দেখলে কোনো মা’ ঠিক থাকতে পারেন না।কিন্তু,এ ছাড়া তো আর কোনো উপায়ও ছিলো না।দেখতে দেখতে আজকে,দুটো বছরের উর্ধ্বে কেটে গেলো।অতীত ভুলতে গিয়েও যেনো ভুলতে পারি নি।অতীত জিনিস টাই এইরকম।দূরে ঠেলে দিলেও যেনো জোঁকের মতো আঁটকে ধরে রাখে।রিমঝিম কলম টা টেবিলের উপর ফেলে দিলো।চেয়ার টা টেনে উঠে দাঁড়ালো।বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই ঠান্ডা হাওয়া সারা শরীরে ছুঁয়ে দিয়ে গেলো।হাতের লোমগুলো যেনো দাঁড়িয়ে গিয়েছে।রিমঝিম কাঁপছে শীতে।পাতলা টি-শার্ট টা বুকের থেকে কিছুটা নেমে আছে।তবুও কি অবলীলায় এখানে দাঁড়িয়ে আছে!রিমঝিম মনে মনে আওড়াতে লাগলো,
আমি তো আর চাই নি অতীতের মুখোমুখি হতে।তাহলে,কেনোই আমার ভাগ্য আমাকে সেদিকে নিয়ে যাচ্ছে।বাংলাদেশে না যাওয়ার কি কোনো উপায় নেই!!
—
রিমঝিম মুখ ফুলিয়ে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে।একটু পরেই তাদের ফ্লাইট।অনেক জোরজবরদস্তি করেও মা,বাবাকে বাংলাদেশে না যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারলো না।সাদিক আহমেদ আর সেলিনা আহমেদ যেনো খুশিতে আত্নহারা।মাজহারুলও এসেছে এয়ারপোর্টে।তার মনটা খুব খারাপ।রিমঝিমকে কবে দেখতে পাবে তা ভেবেই অনেকটা পাগলপারা হয়ে গিয়েছে।তাই এককোনায় দাঁড়িয়ে রিমঝিমকে ভালো করে দেখে নিচ্ছে।ফ্লাইটের সময় হতেই সাদিক আহমেদ মাজহারুলের কাছে বিদায় নেওয়ার জন্য সামনে এগিয়ে গেলো।মাজহারুল সাদিক আহমেদ কে আস্বস্ত করে বললো,আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আংকেল!অফিসের সবকিছু আমি সামলে নিবো।তার প্রতিউত্তরে সাদিক আহমেদ মুচকি হাসলেন।মাজহারুল কিছুটা সাহস নিয়ে রিমঝিমের সামনে এগিয়ে গেলো।রিমঝিম তখন ফোন টিপতে ব্যস্ত।তার এদিকে কোনো খেয়াল নেই।ফোনে মগ্ন হয়ে গেমস খেলছে।মাজহারুল গলা কেশে বললো,
‘সাবধানে যাবে রিমঝিম!’
রিমঝিম একপলক তাকালো মাজহারুলের দিকে।পুনরায় মাথা নামিয়ে গেমস খেলায় মনোযোগ দিয়ে বললো,
‘জ্বি!আপনিও সাবধানে থাকবেন।’
মাজহারুলের মনের কোণে সুপ্ত অনুভূতি বয়ে গেলো।রিমঝিম এইটা তাকে বলবে,কখনো আশা করে নি।মনে হচ্ছে,অনাঙ্ক্ষিত কিছু শুনেছে।চুল গুলো টেনে টেনে বললো,
‘একদম।’
রিমঝিম মুচকি হেসে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো।তবে,মনের ভিতরে তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে।হৃদপিন্ড টা যেনো ধকধক করছে।অন্যদিকে মাজহারুল একমনে চেয়ে আছে রিমঝিমের যাওয়ার পানে।চোখ দুটো টলমলিয়ে উঠলো।মনে হচ্ছে,পানি গড়িয়ে পড়বে।
চলবে..
[গুছিয়ে লিখা হয় নি।😒😑]