জলপদ্ম পর্ব -২৬

#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন

|২৬|
বারান্দার রকিং চেয়ার টায় নিস্তব্ধে বসে আছে রক্তিম।এক হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।অন্যহাতে রিমঝিমের সেই নীল ওড়নাটা।মুঠো করে রেখেছে নিজের হাতের বন্ধনে।ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে।মনে হচ্ছে শ্বাসকষ্টের রোগী।রক্তিম রিমঝিমের নীল ওড়না টা নাকের কাছে এনে মন খোলে ঘ্রাণ নিলো।পরক্ষণেই বিরবির করে বললো,’এই ঘ্রাণ পুরনো হয়ে গিয়েছে।আমার আস্ত রিমঝিমের ঘ্রাণ লাগবে।’কপাল ঠেকিয়ে দিলো চেয়ার টায়।হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেট টা ছুঁড়ে মারলো বারান্দার বাহিরে।চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো।সাইড বক্সের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে আবির কে ফোন করলো।আবির ফোন ধরতেই একপ্রকার দ্রুত গতিতে বললো,’আমার রিমঝিম কে লাগবে আবির।’ফোনের অপাশে আবির যেনো রক্তিমের কথায় থতমত খেয়ে গিয়েছে।আচমকাই এমন কথা শুনলে থতমত খাওয়া তো বড় কোনো ব্যাপার না।রক্তিম আবারও বললো,’আবির আমার কথা শুনছিস তো।’আবির দাঁত খেঁচিয়ে তাকালো দেয়াল ঘড়ির দিকে।দুটো বাজতে আরো কয়েক মিনিট বাকি।চোখ,মুখ বিতৃষ্ণা করে বললো,’না শুনি নি।আবার বল তো কি বলেছিস।’রক্তিমও বাধ্য ছেলের মতো বললো,
‘আমার রিমঝিমকে লাগবে।ওকে একটু এনে দিবি।’রক্তিমের কথার পিঠে আবির এবার জোরালো গলায় বললো,’যেভাবে বলছিস মনে হচ্ছে,রিমঝিম একটা খাওয়ার জিনিস।আমি এনে দিবো আর তুই টুপ করে খেয়ে নিবি।’আবিরের কথা মোটেও পছন্দ হলো না রক্তিমের।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’তুই মজা না নিয়ে একটা ব্যবস্থা কর।আমি ইমিডিয়েটলি রিমঝিমের কাছে যেতে চাই।বুকের ভেতর টা হাঁসফাঁস করছে তুই কি বুঝতে পারছিস না।কাছে থেকেও মন খোলে দেখতে পারছি না।’

‘ঢং!বুকের ভিতর টা হাঁসফাঁস করলে রিমঝিমের সাথে এমন করতে পারতিস না।বেচারি কে কম কষ্ট দিস নি।সবসময় অবহেলা,কষ্ট দিয়ে গিয়েছিস।আর,এখন প্রেম উতলা হয়ে উঠেছে।রিমঝিম ঠিকই বলতো,তুই একটা খারাপ দূষিত পুরুষ।’

রক্তিম এক চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
‘ফোন রাখ হারামজাদা!সময় আমারও আসবে।তখন আমিও দেখে নিবো।আল্লাহ আমার দুটো পা দিয়েছেন।সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে আমি রিমঝিমের কাছে চলে যেতে পারবো।’
কথাগুলো বলেই রক্তিম ফোনটা কেটে দিলো।আবিরকে একগাদা বকে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।গন্তব্য!রিমঝিমের রুম।অন্যদিকে,আবির কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।ঘুমোতে পারলেই বাঁচে।কাল সকালে উঠে সেলুনে যাবে।দাড়ি,চুলগুলোকে একটু সাইজে আনতে হবে।মেয়েদের মুখ থেকে আবছা শুনেছিলো,সময় করে তারা সবাই ঘুরতে বের হবে।আর,সেখানে শিলাও থাকবে।আবির মনে মনে প্ল্যান করে নিয়েছে পরের বার যখন শিলার সাথে দেখা হবে তখন শিলার হাতটা ধরবেই ধরবে।যতকিছুই হয়ে যাক না কেনো!হাত সে ধরবেই।না হলে,বাসায়ই আসবে না।

রক্তিম গুটিগুটি পায়ে রিমঝিমের রুমের সামনে এসে থামলো।কিন্তু,রিমঝিমের রুমের দরজা লাগানো দেখেই মুখটা চুপসে গিয়েছে।সে তো ভেবেছিলো,দরজা টা খোলা থাকবে।দরজার অপাশে রিমঝিমের হাসি শুনতে পেয়ে রক্তিম ভাবনায় পড়ে গেলো।কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে রাগে হাত দুটো মুঠো করে নিলো।চোয়াল শক্ত করে বললো,’হেসে হেসে ওই ছেলের সাথে কথা বলা হচ্ছে।বলুক!তাতে আমার কিছুই না।’
রক্তিম আর দাঁড়ালো না।ধপাধপ্ পা’য়ে নিজের রুমের দিকে চলে আসলো।রাগে তার শরীর শিরশির করছে।

টেবিলে সবাই গোল হয়ে বসে আছে।সাদিক আহমেদ আর সিদ্দিক আহমেদ দু’জন দু’কোণায় বসে আছেন।চোখাচোখি হয়েছে অনেকবার।সিদ্দিক আহমেদ কোনোমতে রাগটাকে সংবরণ করে রেখেছেন।কোনোমতে খেয়ে উঠলেই বাঁচেন।তাই,নিশ্চুপে খেতে লাগলেন।আশেপাশের কোনো কথাই কানে নিচ্ছেন না।
রিমঝিম বরাবরের মতো সকালে দৌড়তে বেরিয়েছিলো,শরীর ঘর্মাক্ত হওয়ায় রুমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।সিঁড়ির কাছে আসতেই চোখ পড়লো রক্তিমের উপর।ফরমাল ড্রেস পড়ে আছে।অফিস যাবে।রিমিঝিম রক্তিমকে দেখে সাথেসাথেই চোখ নামিয়ে নিলো।বুকের ভিতর টা কেমন ঢিপঢিপ আওয়াজ করছে।সেই সাথে ঢোকও গিলছে।অন্যদিকে,রক্তিম আঁড়চোখে রিমঝিমকে কয়েকবার পরোক্ষ করে নিলো।পরমুহূর্তেই অভিমানে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের মতো করে নামতে লাগলো।মনে হচ্ছে,দু’জন দু’জনের অনেক অপরিচিত।কয়েক সিঁড়ি পার হতেই বাজলো এক বিপত্তি।আচমকাই দু’জনের হাত লেগে গেলো।এমন হওয়ায় রিমঝিম কিছুটা দূরে ছিটকে সরে আসলো।রক্তিমের বেশ রাগ হলো।নাক,মুখ ফুলিয়ে বিরবির করে বলতে লাগলো,আমার সংস্পর্শে আসলেও তার সমস্যা।ভুলে গেছে নাকি আমি তার স্বামী।তাকে স্পর্শ করার অধিকার তো একমাত্র আমারই।রিমঝিম একরাশ বিরক্তি নিয়ে হাত টা টি-শার্টে মুছে নিলো।রক্তিম যেনো রাগে ফেটে যাচ্ছে।পারছে না রাগ টা দেখাতে।সিদ্দিক আহমেদ কড়া চোখে চেয়ে আছেন রক্তিমের দিকে।এই ভয় টাই পাচ্ছিলেন তিনি।হাত মুঠো করে মনে মনে বুদ্ধি করে নিলেন,খুব তাড়াতাড়িই তারিনের সাথে বিয়ের সবকিছু পাকাপোক্ত করে নিবেন।জোর গলায় হাঁক মেরে রক্তিমের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘রক্তিম!আজকে একটু তাড়াতাড়িই বের হও।গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে।সবকিছু আমি ঠিকঠাক চাই।’

রক্তিমের রাগের মাত্রা ক্রমশই বেড়েই চলেছে।থমথমে ভাব নিয়ে মেইন দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।জাহানারা আহমেদ ডাকতেই রক্তিম বেজায় কণ্ঠে বলে উঠলো,
‘অফিসের ক্যান্টিনে খেয়ে নিবো।চিন্তা করতে হবে না।’

রিমঝিম উপর থেকে রক্তিমের যাওয়া দেখলো।রক্তিম যেতে নিজেও চলে গেলো রুমে।সিদ্দিক আহমেদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।রক্তিম আর রিমঝিমকে একসাথে দেখলেই মাথায় হাজারো চিন্তা এসে যুক্ত হয়।কিছু খাবার রেখেই উঠে পড়লেন চেয়ার ছেড়ে।আজকে,তারিনদের বাসায় যাবেন।তারিনের বাবা তোফায়েল খন্দকারের সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে।সেই সাথে রক্তিম আর তারিনের বিয়ে নিয়েও কথা বলবেন।

ভার্সিটি থেকে বেরোতেই সিফাতের মুখোমুখি পড়তে হলো রিমিকে।রিমি সাথে সাথেই মুখ টা ভেঙচি মারলো।সিফাত একপ্রকার দ্রুত গতিতে বাইক থেকে নামলো।সানগ্লাস টা শার্টের পকেটে রেখে রিমির দিকে এগিয়ে গেলো।রিমি এঁড়িয়ে যেতেই সিফাত রিমির হাতজোড় আগলে ধরে বললো,
‘আর কতো ঘুরাঘুরি করবো আমি।ঘুরতে ঘুরতে আমার বেহাল অবস্থা যে।’
রিমি চোখ পাঁকিয়ে তাকালো সিফাতের দিকে।কটমটে গলায় বললো,
‘যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনার প্যান্টের তলা ছিঁড়ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে আমার পিছনে ঘুরঘুর করতে হবে।রাজি থাকলে ভালো আর রাজি না থাকলে এখান থেকে কেল্লাফতে!’
‘আমি আমার প্যান্টের তলাও ছিঁড়তে রাজি আছি তোমার জন্য…কথাটা বলেই জিহবায় কাঁমড় বসালো সিফাত।তাড়াহুড়োর মধ্যে কি বলেছে এখন তার বোধগম্য হয়েছে।মনে মনে বিরবির করে বললো,অবশ্য,যে পরিমাণে ঘুরছি আমি প্যান্টের তলা না ছিঁড়লেও ফেঁসে তো যাবেই।ছি!কি অশ্লীল কথাবার্তা।’
রিমির খুব হাসি পাচ্ছে।কিন্তু,বাহিরে প্রকাশ করছে না।কথাটা মজার ছলে বললেও সিফাত যে আবার রিপিট করবে তা ভাবে নি।কোনোমতে হাসিটা আঁটকে রেখে বললো,
‘সত্যি বলছেন তো।কথাটা আমি কাউন্ট করে নিবো তাহলে!!’
সিফাত এবার মুখের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন করে বললো,
‘প্যান্টের তলা না ছিঁড়লেও ফাঁসবে এটা নিশ্চিত করে বলে দিচ্ছি রিমি।’
‘আমার বুঝা হয়ে গেছে আপনার দম কতটুকু।সরুন তো!সাইড দিন আমাকে।’
রিমি রিকশায় উঠে হুড টা তোলে নিলো।সিফাত অসহায় মুখ করে তাকিয়ে আছে রিমির দিকে।রিকশা টা কিছুদূর আগাতেই রিমি মুখ চেপে হেসে উঠলো।রিকশাচালক পিছনে ঘুরে রিমির দিকে তাকিয়ে বললো,’কি হইলো আপা হাসেন কা!’
‘সে অনেক কাহিনী মামা।’
‘কিছু আন্দাজ করতাম পারছি আপা।ওই ভাইজানও আছে এইহানে তাই না আপা।’
‘সেইরকমই অনেকটা।’
‘অনেকটা না কন সবটাই।’
রিমি মাথা নিচু করে ঠোঁট চেপে হাসছে।সিফাতের সাথে আজকে একটু বেশিই করে ফেলেছে।
🍁🍂
ফাঁকা একটা জায়গায় রক্তিম গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে।পকেটে হাত গুঁজা।পাশে রঞ্জনও আছে।হাতে সিগারেট।রঞ্জন রক্তিমকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘সামনের সপ্তাহ আমার বিয়েতে আসছিস তো।দেখ!রক্তিম আমার আর সুস্মিতার বিয়েতে তোদের সবাইকে আমি দু’সপ্তাহের আগে বাসায় চাই।এর যেনো কোনো উলোটপালোট না হয়।আর,কালকে তোদের বাসায় যাওয়ার সময় রিমঝিমকেও বলে আসবো।’
রক্তিম আঁড়চোখে তাকালো রঞ্জনের দিকে।এমতাবস্থায় বললো,
‘আরো একসপ্তাহ আগে আমাদের দাওয়াত দিবি ভাই।না মানে!রিমঝিমকে তাহলে,এক্সট্রা একসপ্তাহের জন্য একা পেতাম।’
রঞ্জন মুচকি হেসে সিগারেট টা ঘাসের উপর ফেলে দিলো।পা দিয়ে পিঁষে বললো,
‘জানতাম!একদিন পস্তাবি তুই।আজকে,সেই দিনটা এসেও গেলো।কেনো,দিতে গেলি কষ্ট!রিমঝিমের কষ্ট গুলো কি একবারও উপলব্ধি করতে পেরেছিস।’
রক্তিম ঠোঁট গুলো হালকা নেড়ে বললো,
‘আমি নিরুপায় ছিলাম রঞ্জন।’কিন্তু তা রঞ্জনের কান অব্দি পৌঁছায় নি।
রঞ্জন সামনের দিকে তাকিয়ে জোরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।কিছুক্ষণ থেমে গিয়ে বললো,
‘ভালোবাসার অনুভূতি টা যেনো খুবই অদ্ভুত।আকর্ষণ,রাগ,দুঃখ সবই হয়।শুধু তাই নয় গভীর এক টানও কাজ করে।আমাকে দেখ!সুস্মিতা আমার বাল্যকালের বন্ধু।একসাথে থাকতে থাকতে কখন যে তার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছি তা নিতান্তই আমার কাছে অজানা ছিলো।প্রথমে ব্যাপার টাকে ভালো লাগা ভাবলেও ঠিকই তার কয়েকদিন পরেই বুঝতে পেরেছি সেই অনুভূতি টা আমার ভালোলাগা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলো না।সেটা ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে।তারপর থেকেই সুস্মিতা কে আগলে রাখতে শিখেছি।নিজের অজান্তেও কষ্ট দিতে গেলে বুকটা হাহাকার করে উঠতো।তাই,বলছি!সময় থাকতে সবকিছুর যেমন মূল্য দিতে হয় একই ভাবে ভালোবাসার মানুষ টিকেও আগলে রাখতে হয়।এর যদি একটু হেরফের হয় তাহলে,সবকিছুই শেষ।’
রক্তিম মনোযোগ দিয়ে রঞ্জনের কথাগুলো শুনলো।রিমঝিমকে কষ্ট দিতে গিয়ে নিজেও তো কম কষ্ট পায় নি।চোখের সামনে রিমঝিমের কান্নামাখা মুখশ্রী টা ভেসে উঠতেই বুকটা কেঁপে উঠলো।

‘রিমঝিম!চলে যাওয়ার সময় প্লিজ কান্না করবি না।তুই কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হবে।’
‘আপনার জন্য তো আমি কাঁদবো না রক্তিম ভাই।আমি কাঁদবো বাসার বাদবাকি সবার জন্য।’
‘তাও!তুই কাঁদবি না।তুই কাঁদলেই আমার কষ্ট হবে।’
‘ঢং!দু’বছরের আগের কথা মনে আছে তো আপনার রক্তিম ভাই!!আমাকে কি পরিমাণে কাঁদিয়েছিলেন!অবহেলা করেছিলেন!মাঝরাতে যখন ডুকরে কেঁদে উঠতাম তখন কি একবারও আমাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন?মাথায় কি একটু হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,রিমঝিমি তুই কাঁদিস না প্লিজ।আমার খুব কষ্ট হয় তুই কাঁদলে।উঁহুহু!তখন তো এইসব কিছুই বলেন নি,বরং আমাকে আরো কষ্ট দিয়েছেন।তাহলে এখন,কেনো আমাকে কাঁদতে নিষেধ করছেন।চলেই তো গিয়েছি আপনার জীবন থেকে।এখন তো আপনি মুক্ত।তাহলে!আমার জন্য কাঁদবেন কেনো রক্তিম ভাই!বরং,আমি চলে গেলে তো আপনার খুশি হওয়ার কথা।দেখুন!রক্তিম ভাই আমি চলে যাচ্ছি।আর আসবো না আপনার হাতের নাগালে!!’

রক্তিম ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়লো।ঘাড়ে তীব্র ব্যাথা অনুভব করতেই চোখ,মুখ খিঁচিয়ে নিলো।আশপাশে তাকিয়ে দেখলো সে অফিসে বসে আছে।বসে বসে একদফা ঘুমও হয়ে গিয়েছে।ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই চোখ তার চড়াকগাছ।রাত একটা বাজে।কিন্তু,স্বপ্নের ব্যাপার টা এখনো তার মাথায় ঘুরছে।এতোক্ষণ সে কিসব দেখলো তাই ভাবছে।স্বপ্নের কথা যতই ভাবছে ততই তার মন অস্থিরতায় ভরে উঠছে।হাত,পা কাঁপছে।টেবিলের সামনে রাখা পানির গ্লাস টা এক চুমুকেই শেষ করে দিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লো।গাড়িতে বসে স্টার্ট দিয়ে একপ্রকার ঝড়ের গতিতে বাসার সামনে এসে থামলো।হন্তদন্ত হয়ে কলিং বেল টা বাজাতেই লাগলো।

রিমঝিম ডাইনিং টেবিলে এসেছিলো পানি খেতে।এতোক্ষণ পর্যন্ত রিমি আর সে ইংলিশ মুভি দেখছিলো।রিমি শুয়ে পড়েছে সেও পানিটা খেয়ে শুয়ে পড়বে।কিন্তু,ঝড়ের গতিতে কলিং বেল বাজাতে দেখে রিমঝিমের খুব রাগ হলো।রিমঝিম ভেবে নিয়েছে এইটা আবির।কারণ,আবির এখনো বাসায় আসে নি।একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে নিয়ে দরজাটা খোলে সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো।সাথেসাথেই কয়েক’পা পিছিয়ে গেলো।রক্তিমকে মোটেও আশা করে নি।আর,রক্তিম রিমঝিমকে দেখেই কষ্টের রেশ যেনো দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।সেই সাথে অস্থিরতা।বুকের হৃদপিন্ডটা যেনো দ্রুত গতিতে চলছে।সেই সাথে পেটেও যেনো ডাক দিয়ে উঠছে।খালি পেটে থাকলে তো সিগনাল দিবেই।বেশ কিছুক্ষণ সময় এইভাবে অতিবাহিত করার পর রিমঝিম চলে আসার জন্য উল্টো ঘুরে দাঁড়াতেই রক্তিম চট করে রিমঝিমকে জাপটে ধরলো।আচমকাই এমন হওয়ায় রিমঝিম কিছুটা কেঁপে উঠলো।সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছে।নড়তেও পারছে না।রক্তিম রিমঝিমের ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো।জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।চোখের কোণা থেকে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো রিমঝিমের উন্মুক্ত ঘাড়ে।রিমঝিম ঠোঁট কাঁমড়ে নিজেকে শক্ত করে রেখেছে।বুঝতে পারছে রক্তিম কান্না করছে।কিন্তু,তার কিছুই বলার নেই,অস্বস্তি হচ্ছে খুব।বরং,এখান থেকে যেতে পারলেই বাঁচে।রিমিঝিমের মুখটা নিজের মুখের দিকে ফিরিয়ে নিতেই রিমঝিম চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।রক্তিম অপলক তাকিয়ে আছে রিমঝিমের দিকে।কতদিন বাদে এই মুখটাকে ভালো করে দেখছে।মাথাটা নুইয়ে রিমঝিমের গলায়,বুকে ঠোঁট বুলাতে লাগলো।সেই সাথে ছোট ছোট চুমুও রয়েছে বটে।বাহির থেকে শীতল বাতাস এসে রক্তিম আর রিমঝিমকে যেনো আরেকটু কাছে টেনে আনলো।রিমঝিম নিজের অজান্তেই রক্তিমের ব্লেজার টা খাঁমচে ধরে রেখেছে।রক্তিমের অবাধ্যতা যেনো ক্রমশই বেড়েই চলছে।বেড়েই চলেছে তাদের মধ্যে দুষ্টু,মিষ্টি কিছু কাজ।এতোদিন পর দু’জন দু’জনকে কাছে পেয়ে অনেকটাই দিশেহারা।কিন্তু,রিমঝিমের মস্তিষ্কে অতীতের স্মৃতি গুলো জাগান দিতেই রিমঝিম চট করে রক্তিমকে দূরে ঢেলে সরিয়ে দিলো।নিজেও কয়েককদম পা পিছিয়ে আসলো।রিমঝিমের এরূপ আচরণে রক্তিম কিছুই মনে করে নি।এটাই তো করা উচিত তার সাথে।করিডোরের মৃদু আলোয় রক্তিম ঝাঁপসা চোখে তাকিয়ে দেখলো রিমঝিমের গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রুদানা গড়িয়ে পড়ছে।রিমঝিম আর একমুহূর্তের জন্যও দাঁড়ায় নি।দৌড়ে চলে গেলো।একবার যদি রিমঝিম পিছন ফিরে রক্তিমের পানে তাকাতো তাহলে,সেও দেখতে পারতো রক্তিমের চোখের অশ্রু।আফসোস!রিমঝিম একটিবারও পিছনে ঘুরে তাকালো না।আর না পড়লো চোখে অনাঙ্ক্ষিত এই দৃশ্যটি।

শুক্রবার হওয়ায় সবাই লিভিং রুমে বসে আড্ডায় মেতে আছে।সিদ্দিক আহমেদ দু’দিনের জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছেন।সেখানে আরেকটি কোম্পানির কাজ চলছে।তার জন্যই তাড়াহুড়ো করে যাওয়া।সোফার এককোনায় রক্তিমও বসে আছে।আজকে তার মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।রাতে ঘুম না হলেও সকালে বেশ মজার একটা ঘুম হয়েছে।তার কারণ একটাই!গতকাল রাতে রিমঝিমকে একটুর জন্য হলেও কাছে পেয়েছে।রাতের কথাগুলো ভেবেই রক্তিম মিটিমিটি হাসলো।রিমঝিম একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে সবার সামনে দাঁড়িয়ে সাদিক আহমেদ কে উদ্দেশ্য করে জোর গলায় বললো,
‘বাবা!আমি কয়েক দিনের মধ্যেই রাশিয়ায় যেতে চাই।প্লিজ তুমি একটু ব্যবস্থা করো।’
রিমঝিমের কথার শেষ হতে না হতেই রক্তিম চট করে মাথা তোলে তাকালো।অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রিমঝিমের দিকে।স্বপ্নের কথাটা তার মনে পড়ে গেলো।কানে এসে ঠেকছে!স্বপ্নে বলা রিমঝিমের এক একটা অভিমানী কথার বুলি।বুকে অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে।
রিমঝিম একপলক তাকালো রক্তিমের দিকে।কাল রাতের ঘটনার পর আর তার একমুহূর্তেও বাংলাদেশে থাকার ইচ্ছে নেই।তাই তো জরুরী তলবে সবার সামনেই বলতে হয়েছে।রিমঝিমের দাদি বিলাপ করে কেঁদে উঠলেন।রিমঝিম ভয়ে তাকালো দাদির দিকে।কতক্ষণ এইভাবে সঙের মতো দাঁড়িয়ে থেকে দাদির কান্না দেখে বাধ্য হয়ে বললো,
‘ঠিক আছে!যাচ্ছি না দাদি।তুমি কান্না করো না প্লিজ।’
ব্যাস!রিমঝিমের এই একটা কথাতেই রক্তিম প্রাণ ফিরে পেলো।মুখের গম্ভীর ভাব সরিয়ে দিয়ে হাসি ফুটে উঠলো।

চলবে..
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here