###__ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল__###
পর্ব_৬
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
আজ দুইদিন হলো রুবির খবর নেই । ইরফানও রেগে ফোন করেনি তাকে । মাঝে জাফর সাহেব (রুবির বাবা) ফোন করে বাসায় যেতে বলেছেন ইরফানকে । কিন্তু ইরফানই যায় নি । রুবির বলা মিথ্যা কথা গুলো মেনে নিতে পারেনি ইরফান । সে এমনিতেও মিথ্যা পছন্দ করে না তার উপর না বলে টাকা খরচ করে আরেকজনের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে । এর জন্যে আরও বেশি রাগ ইরফানের । তাই ইচ্ছা করেই যায় নি সে ।
অফিস থেকে এক গাদা কাজ নিয়ে বাসায় ফিরেছে ইরফান । বেলীর শরীরটা দুদিন পর ভালোই আছে এখন । তাই দৌড়ে দৌড়ে সব কাজই করতে পারে সে ।
আর বেলীকে দেখে ইদানীং বড্ড বেশি মায়া হয় ইরফানের । মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা ভালো লাগাটা বের হয়ে আসতে বেশি সময় নেয় না ।
ইরফান নিজের রুমে ফ্রেশ হয়ে নেয় । বেলী সেই সময়েই কফি হাতে রুমে যায় । ইরফান তখন খালি গায়ে শরীরের পানি মুছতেছে । ইরফানকে ওই অবস্থাতে দেখে অনেকটাই ইতস্তত বোধ করে বেলী । বেলীর ইতস্তত বোধ করা দেখে ইরফান টি-শার্ট টা পরে নেয় ।
– আপনার কফি ,
– রেখে দে ,
– হু ,
বেলী চলে যেতে নিলে ইরফান ডাক দেয় তাকে ।
– বেলী শুন ,
– জ্বি
– তোর একটা জিনিস আমার কাছে আছে ,
– জিনিস ! কি জিনিস ?
এরপর ড্রয়ার থেকে কানের দুলটা নিয়ে আসে ইরফান ।
– হাত পাত ,
– কি জিনিস আছে ,
– হাত পাত আগে ,
বেলী হাত পাতলে ইরফান বেলীর এক কানের দুলটা বেলীর হাতে দেয় ।
– এই জিনিসটা ,
– হায় আল্লাহ এইটা আপনার কাছে ছিল ।
– হ্যাঁ
– আমি কত খুজছি এইটা , আমার বাবার শেষ স্মৃতি এইটা । অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে বানিয়ে দিছিলো ।
– ওহ ,
– আচ্ছা , কি খাবেন রাতে ?
– দুপুরে রান্না করস নাই ?
– ভাত রান্না করছিলাম , আর কালকের রান্না করা তারকারি ছিল , তাই খেয়ে নিছি আমি আর মিনু ।
– ফ্রিজে তো মোটামুটি সবই রাখা আছে বেলী তাহলে কালকের রান্না করা জিনিস কেন খাস তুই ।
– ফেলে দেয়ার থেকে খেয়ে নেয়া টা ভালো । আপনি কি খাবেন , বলেন আমি রান্না বসাবো ।
– মাছ ভুনা করিস ,
– আচ্ছা ।
বেলী রুবির থেকে অনেকটা আলাদা । অপচয় করতে একদম চায় না । ল্যাপটপ নিয়ে বসে যায় ইরফান । এক মনে কাজ করতেই আছে তো করতেই আছে । ল্যাপটপ থেকে কাজ শেষ করে আড়মোড়া দেয় ইরফান । ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখে রাত ১১ টা বেজে ৫৫ মিনিট । তার মানে ১২ টা বাজতে আর মাত্র ৫ মিনিট । বেলী কি এখনও রান্না করে নাকি৷। একবার এসে ডেকেও গেলো না । কান থেকে হেডফোন খুলে ডাইনিং টেবিলে যায় ইরফান । বেলী সেখানেই সোফায় বসে কাত হয়ে আছে । ইরফান গিয়ে আস্তে করে নাড়া দেয় বেলীকে । ইরফানের ছোয়া পেয়ে বেলী উঠে যায় ।
– কিরে , রাত ১২ টা বেজে গেছে আমাকে ডাকলিও না , আর এখানে বসে ঘুমিয়ে গেছিস ।
– কয়েকবার গেছিলাম রুমে , ডাকছিলামও , আপনি কানের মধ্যে হেডফোন লাগিয়ে কাজ করতেছিলেন । ভাবলাম কাজ শেষ হলে আবার ডাক দিবো , আর আমিই ঘুমিয়ে গেছি ।
– হায়রে , চল
– আসেন
– মিনু কোথায় ?
– সে খেয়ে দেয়ে ঘুম ।
– ওহ ,
বেলী ইরফানকে ভাত বেড়ে দেয় । প্রয়োজনীয় সব কাছে এনে দেয় । ইরফান খাওয়ার দিকে তাকিয়ে আবার বেলীর দিকে তাকায় ।
– তুই খাইছিস ?
– হু
– সত্যিই খেয়েছিস ?
– হু
– ইদানীং মিথ্যা বলস তুই , রুবিকে চড় মেরেছিলাম কিন্তু মিথ্যা বলার কারণে ।
– আর আমি সত্য বলার পরেও লাথি খাই ,
আপনি খেয়ে নেন ।
বলে বেলী রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল । ওমনি ইরফান বেলীর হাতটা ধরে নেয় ।
– কিছু বলবেন ?
– তোর সাথে একদিন বসেও ভাত খাওয়া হয় নাই , রুবির সাথে সময় মিলে না । আমি বরাবর খাবার একাই খাই । আজ না হয় তুই আমার খাওয়ার সাথী হলি ।
– মানে ,
– আমার সাথে বসে খেতে হবে আজকে তোকে ।
কথাটা শুনে কলিজায় একটা মোচড় দিয়ে উঠে বেলীর । বিয়ের প্রায় ১০ মাস পর ইরফান নিজ থেকে বেলীকে তার সাথে ভাত খেতে বলেছে । অনুভূতি টা ঠিক কি রকম বলে তা বুঝতে পারছে না বেলী । কিছুক্ষণ ইরফানের দিকে তাকিয়ে আবারও নজর নিচে নামিয়ে ফেলে সে ।
– কিরে , বসবি না ?
– আপনি খান , আমি এখন আর খাবো না ।
– আমি কি এতই খারাপ নাকি যে আমার সাথে বসে ভাত খাওয়া যায় না ।
– নাহ নাহ তা কেন হতে যাবে ?
– তাহলে খেতে বস ।
– হু ,
কথা না বাড়িয়ে খেতে বসে যায় বেলী । ইরফান আড় চোখে বেলীর খাওয়ার ধরণ দেখে । এর আগে কখনো ইরফান বেলীকে খেতে দেখে নি । যতক্ষন ছিলো শুধু মারধর আর বকাবাধ্য করে গেছে মেয়েটাকে । মেয়েটাও যেমন , চুপচাপ মানিয়ে নিয়েছে সবটা । এমনকি সতীনের সাথে সংসার করতে হবে সেইটাও মানিয়ে নিয়েছে সে । একবারের জন্যেও প্রতিবাদ করেনি বা না জানিয়েছে নিজের আপত্তির কথা । গত সাতটা মাস যাবত চোখের সামনে নিজের স্বামীকে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে এক রুমে থাকতে দেখেছে । প্রাত্যহিক সতীনের ভেজা চুল দেখতে হয়েছে তাকে । তবুও নিজের অধিকারের দাবি নিয়ে একবারের জন্যেও দাঁড়ায় নি সামনে এসে । ওর মত মেয়ে খুব কমই আছে , বা পাওয়া যায় । ইরফান কথা গুলো মনে মনে ভাবছে । ঠিক এক চামচের মত ভাত নিয়েছে আর একটু ডাল ।
– মাছ নিবি না ?
– উহু ,
– কেন ?
– ডালটা দিয়েই খাই ।
– মাছে কি সমস্যা ?
– কিছু না , আপনি খান । আরেক টুকরা দিবো ?
– নাহ থাক ।
কোন রকম খেয়ে উঠে যায় বেলী । ইরফান বেশ বুঝতে পারছে বেলী তার সামনে থাকতে চায় না । অবশ্য এইসবের একমাত্র কারণ ইরফানের করা খারাপ ব্যবহার গুলো । তাই সেও আর কিছু বলে নাই ।
আব কিছু গুছিয়ে পরিষ্কার করে বেলী শুতে যাবে এমন সময় দেখে ইরফান ড্রইং রুমে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে বসেছে । ঘড়িতে প্রায় ১ টা বাজে । এই সময়ে কি কাজ করবে আবার । কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ইরফানকে দেখছে বেলী । এরই মাঝে ইরফান আবারও ডাক দেয় বেলীকে ।
– বেলী শুন তো ?
– হু ,
– আমার রুমে যা , সেলফের উপরে দেখবি একটা সাদা কৌটা রাখা আছে নিয়ে আয় ।
– হু ,
কৌটা এনে ইরফানের কাছে রাখে বেলী । অনেকগুলা জিনিসই রাখা আছে টি-টেবিলের উপরে । বেলী তাকিয়ে আছে সেইগুলার দিকে । বেলীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইরফান নিজ থেকেই বেলীকে বসতে বলে ।
– কিরে দাঁড়িয়ে আছিস যে , বস এইখানে ।
– এইগুলা দিয়ে কি করবেন ?
– হাউজ বিল্ডিংয়ের প্রজেক্ট এর জন্যে । কাল অফিসে প্রেজেন্টেশন ।
– ওহ , বাড়ি বানাবেন ?
– হা হা , নাহ রে পাগলী । এটা যাস্ট একটা সেম্পল হবে ।
– ওহ ,
ইরফানের মুখ থেকে পাগলী শব্দটা বেলীর বুকে গিয়ে লাগে । তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে বেলী ।
– মানুষটাকে কত শান্ত লাগে দেখতে । কিন্তু কে বলবে এই মানুষটার হাতে কারণে অকারণে মা’র খেতে হয় আমার । আমার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসাটা সে কখনো দেখবে না । নাহ কখনো জানতে চাইবে আমি কি চাই ? রুবিকে আপুকে মানুষটা খুব ভালোবাসে , তাহলে আমাকে কি একটু ভালোবাসতে পারে না সে ? বিয়ের পর থেকে অপমান , অবহেলা আর মারধর জুটে এসেছে এই পোড়া কপালটায় আমার । আমার জনম দুঃখি মা’টা ভাবে আমি স্বামীর ঘরে রানী হয়ে আছি । অথচ আমার মা তো আর জানে না আমার জীবনের এই ৭ টা মাস কিভাবে কাটছে ।
এইসব ভাবতে ভাবতে অজান্তেই চোখের পানি এসে যায় । মুখ মুছার ছলে চোখের পানি গুলো মুছে নেয় বেলী ।
– সেম্পল হলে তো বানাইতে হবে ।
– হ্যাঁ ,
– তাহলে নিবেন কিভাবে ?
– কাল অফিসের গাড়ি আসবে ,
– ওহ ,
– কাল যদি প্রেজেন্টেশন টা ভালো হয় , তাহলে প্রমোশন টা পাক্কা ।
– আলহামদুলিল্লাহ হয়ে যাবে ।
– কিভাবে সিউর হলি ?
– মন বললো , হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ ।
ইরফান একবার বেলীর মুখের দিকে চেয়ে আছে । বেলীর মুখটা আসলেই মায়ায় ভরা । উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের হলেও দেখতে মাশা-আল্লাহ । মনে মনে এখন আফসোস হয় ইরফানের । যদি তখন সে একটু বাস্তবিকতার সাথে ভাবতো তাহলে আজ হয়তো বেলী একাই তার ঘরে থাকতো । কিন্তু ভালোবাসা নামক পোকার কামড়ে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে । বেলী ফোম গুলো হাত দিয়ে ধরতে চাচ্ছে , কিন্তু ইরফানের ভয়ে ধরতে পারছে না । তাই অনুমতি নিতেই ইরফানের দিকে তাকায় সে ।
– এইগুলা একটু ধরি ?
– ধর ,
ফোম গুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে নেয় ।
– আমি না ক্লাস টেনে থাকতে একটা বাড়ি বানাইছিলাম । ওই যে গার্হস্থ্য অর্থনীতির ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় ।
– ওহ ,
– আমি সাহায্য করি ?
– তুই পারবি না তো , এটা অন্য রকম ।
– কি রকম ,
ইরফান ল্যাপটপ থেকে একটা ঘরের ছবি দেখিয়ে বলে ,
– এই রকম বানাতে হবে ।
– আপনি পারবেন ?
– হ্যাঁ , পারবো তো ।
– আমিও পারবো , বানাই ?
বেলীর কন্ঠস্বরটা ছোট । চিকন স্বরে কথা বলে সে । আবদার গুলো দেখলে যে কারো চোখে পানি আসার মত । ইরফান কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে বেলীর দিকে । তারপর হ্যাঁ বলে দেয় । রাজ্য জয় করা হাসি দিয়ে ফোম গুলোতে গ্লু লাগাতে থাকে বেলী । ইরফানও সাহায্য করছিল বেলীকে ।
প্রায় দেড় ঘন্টা বেলী বাড়ি টা বানিয়ে ফেলে । একদম হুবুহু ল্যাপটপে থাকা ছবিটার মত । হস্তশিল্পে বেলীর হাত পাকা , কারণ বেলীর বাবা একজন কাঠমিস্ত্রি ছিলেন ।
– বাড়ি তো হয়ে গেলো , নাম কি দিবি এই বাড়ির ?
– ‘ স্বপ্ননীড় ‘
অজান্তেই কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে যায় বেলীর । ইরফান চুপ করেই তাকিয়ে থাকে বেলীর দিকে । পরে বেলী কথা কাটিয়ে নেয় ।
– মা,,,,মা,,, মানে , নাম যে কোন একটা দিয়ে দিয়েন ।
– ‘ স্বপ্ননীড় ‘ নাম টাই থাকবে ।
– ঘুমিয়ে যাইয়েন , আসছি
এই বলে বেলী উঠে যেতে নেয় ,
– বেলী শুন ,
– জ্বি ,
– কাল যদি প্রজেক্টটা হয়ে যায় , তাহলে কি চাই তোর ?
– কিছুই না ।
– বল , কি চাই তোর ?
– যদি চাই , দিবেন ?
– হ্যাঁ ,
ইরফান জানে বেলী বেশি দামি কিছু চাইবে না তাই নির্দ্বিধায় বলে ফেলছে হ্যাঁ ।
বেলীও তার ইচ্ছামত তার চাওয়া গুলো ব্যক্ত করে ।
– আপনি যখন আমাকে মারবেন আমি কাঁদবো না , একদম কাঁদবো না , শুধু ছাড়তে বলবেন না , সহ্য করতে পারবো না । আসছি , ঘুমিয়ে যাইয়েন ।
এই কথা বলে সেইখান থেকে চলে যায় বেলী । ইরফান একদম স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে বেলীর চলে যাওয়ার দিকে ।
[ বিঃদ্রঃ হয়তো এই হয় কিছু নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে । যারা বিয়েকে অনেক সম্মান এবং স্বামীকে অনেক শ্রদ্ধা করে । তারা মা’র খেতে প্রস্তুত থাকে তবে সংসার ছাড়তে রাজি নয় । বর্তমান যুগের মেয়েরা আমরা ভাবি করলাম না স্বামীর ঘর খেলাম না স্বামীর ভাত , নিজে কামাই করে খাবো । আসলে বলা যতটা সহজ একজন মেয়ের পক্ষে করা ততটাই কঠিন । তবুও আজকের যুগে মেয়েরা পিছিয়ে নেই । কারণ আমাদের ঘুরে দাড়াতেই হয় এবং হবে । সব কথার শেষ কথা , আমরা নারী……… দিনশেষে আমরাই বিজয়ী ]
.
.
চলবে……………….