###__ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল__###
পর্ব_১৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
রুবির ব্যবহার গুলো অনেকটা চাড়ালের মত । মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের সাথে তার এমন ব্যবহার গুলো মেনে নেয়ার মত না । বেলী এখানে নিতান্তই অসহায় । তাই ছাড়তেও পারে না থাকতেও পারে না । ইরফানের মুখের দিকে তাকিয়ে পড়ে আছে সে । শত হোক সে তার স্বামী । বিয়ে তো তাকেও করেছে । থাকুক না সতীন ক্ষতি কি তাতে ? স্বামী সংসার কিছুই ছাড়তে পারবে না সে । এখানে দুটো জিনিস বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় , এক গ্রামে তার শ্বশুরের সম্মান দুই তার নিজের মায়ের সম্মান । বেলী কাউকে বলতেও পারে নাই যে তার স্বামী বিয়ে আরেকটা করেছে এতে তার শ্বশুরের মান সম্মান সব যাবে আর তার মা হয়তো শোকটাই নিতে পারবে না । আর যাই হোক কোন মা নিশ্চয়ই চাইবে না তার মেয়ে আর যাই হোক সতীন নিয়ে যাতে সংসার না করে সেখানে তার মেয়ে নিজেই সতীনের সাথে থাকছে তাও এক বাড়িতে । এই শোকটা সে মানতে পারবে না । আবার ছেড়ে চলে গেলে আরও বদনাম । গ্রামের সবাই তার মায়ের মুখে চুনকালি মারবে । সব দিক দিয়েই বেলী আটকে পড়ে গেছে । পরিস্থিতি এত খারাপ যে এর বিকল্প কোন পন্থা নেই । যেই পন্থাতে যাবে তাতেই কোন না কোন বাঁধা ।
আর এদিকে মিনুর রুবিকে একদম সহ্য হয় না । মিনু ভেবে রেখেছে আজ ইরফান বাসাতে এলেই রুবির নামে সব বলবে । যা সত্যি তাই বলবে পারলে আরও বানিয়ে বানিয়ে বলবে । মিনু কথা দারুণ বানায় । বেলীকে নিজের রুমে ডেকে পাঠায় রুবি । বেলীও যায় সেই রুমে । বেলীকে রীতিমত চোখের বিষ ভাবে রুবি । কেন জানি তার সহ্য হয় না বেলীকে । তাই সেও চাইছে যে কোন একজন এই বাড়িতে থাকবে । আর সেই একজনটা সে-ই হবে । এর জন্যে যতটা করা লাগবে সে করবে যতটা নিচে নামার সে নামবে । বেলীকে দেখে তার মেজাজ আরও গরম হয়ে যায় তার । বেলীকে টর্চার করে রুবি এক রকম পৈশাচিক আনন্দ পায় তার কারণ , শত কিছু হয়ে গেলেও বেলী টু শব্দ করে না আর ইরফানের কাছে তো ভুলেও বলে না । আর এটারই সুযোগ নেয় রুবি ।
– তোকে যে আমি এতক্ষন ডাকলাম , কানের মধ্যে কি দিয়ে রাখছিস , শুনিস নাই ?
– আমি তো ডাকার সাথে সাথেই আসলাম ।
– বাপরে বাপ, ভালো চোপা লাড়াস তো তুই ? এত সাহস পেলি কোথা থেকে ?
– কিছু বলবেন ?
– কেন কষ্ট লাগে নাকি দাঁড়িয়ে থাকতে ?
– নাহ ,
– তা তোর বাড়িতে ইরফান ছিল ?
– হু ,
– ঘুমিয়েছে কই রাতে ?
– ঘরেই ।
– আর তুই ?
– আমিও ঘরেই ঘুমাইছি ।
– ওহ আচ্ছা এইজন্যই বলি ইরফান রাতারাতি মাগুর মাছ কোথায় পেলো ?
রুবির নোংরা মানসিকতার নোংরা ইংগিত টা বেলীর বুঝতে সময় লাগে নি । খুব বিশ্রী লাগছিল কথা গুলো শুনতে । তাই নিজেই সাহস করে দুইটা কথা বলে ,
– আপনি যা ভাবছেন তা নয় , এইসব কিছুই হয় নাই ।
– সব জান্তা হয়ে গেছিস দেখতেছি ।
– নাহ , শুধু যতটুকু বুঝার তাই বুঝছি , আর কিছু না ।
রুবির মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায় । বিশ্রী ভাষায় বেলীকে গালি দেয় সে । তারপর খাট থেকে এসে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় বেলীকে । চড়টা খেয়েও বেলী সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে । একটা আওয়াজও করে নাই ।
– টিভির মধ্যে যেই রাক্ষুসি গুলা থাকে তেমন হলি তুই । ১০০ রঙ তোর , অভিনয় করস তুই । গ্রামে গিয়ে কি তাবিজ করছিস ইরফানকে , কি তাবিজ করছিস বল ।
রুবির কথা শুনে বেলী অবাক হয়ে যায় । এত শিক্ষিত হয়ে এত বাজে চিন্তা ভাবনা তার মাথায় আসে কিভাবে । তখন বেলী আবারও বলে ,
– যদি তাবিজ করার হতো আমি তার জীবনে আপনার আসার অপেক্ষায় বসে থাকতাম না । তার আগেই তাবিজ-তুমার করে নিজের বশে রাখতাম তাকে । আর আপনি তো তার স্ত্রী যাকে সে আব থেকে বেশি ভালোবাসে অথচ এই আপনি তাকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না । এখানে আপনার বিশ্বাস ডগমগিয়ে যাচ্ছে
বেলীর কথা শুনে রুবি চুপ হয়ে যায় । ভাবতে থাকে ওর এত সাহস হয় কিভাবে , যে ও রুবির সামনে মানে তার সামনে দাঁড়িয়ে এত স্ট্রংলি কথা বলে যাচ্ছে । কিভাবে সম্ভব এটা ? সে চায় শুধু সে বলবে আর বেলীকে সব শুনতে হবে এবং মানতে হবে । বেলীকে চুপ করানোর জন্যে আরও বাজে ভাবে বেলীকে একিউজ করে রুবি ।
– অশিক্ষিত থার্ড ক্লাস মানুষ , কি যোগ্যতা আছে তোর যে তুই ইরফানের সাথে দাঁড়াবি । নিজের চেহারা আয়নায় দেখছিস , এই চেহারায় আসছে ইরফানের বউ হতে । ওর সাথে কেবল আমাকেই যায় তোকে নয় ।
এইবার বেলী আরেকটু বলে ,
– আলহামদুলিল্লাহ , আমি অনেক খুশি যে ওনার সাথে কেবল আপনাকেই যায় । আপনি শিক্ষিত দেখতেও সুন্দর । সব গুন আছে আপনার মাঝে তাহলে দাঁড়াতে কেন পারছেন না ওনার সাথে । বিশ্বাস কেন রাখতে পারছেন না ওনার উপর ।
– সেটা তোকে নিশ্চয়ই বলবো না আমি ।
– আইন অনুযায়ী আমি এখনও ওনার স্ত্রী , আমি থাকা অবস্থাতে উনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন এটা দিয়ে থানায় মামলা করলে কেইসটা আমার পক্ষেই আসবে । আর আমি পড়াশোনা কম করছি তাই বলে অশিক্ষিত নই । আর অহেতুক আমাকে জ্বালিয়ে কি লাভ বলেন তো ? আমি না আগেও আপনাদের মাঝে ছিলাম না এখনও আছি আর না ভবিষ্যতেও থাকবো । কোন কাজ থাকলে বলবেন আমি সব করে দিবো তবে এইসব বাজে কথা আর বলবেন না ।
এইসব বলে বেলী রুম থেকে বের হয়ে যায় । রুবি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে এখনও অবদি । বেলীর কথা গুলো তার পুরো শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে । রুবি ভেবেছিল কি আর হয়েগেছে কি । বেলীর মুখে বুলি ফুটেছে । এইবার রুবির আরও সচেতনতার সাথে খেলতে হবে । এইসবই ভেবে যাচ্ছে রুবি ।
রুমের পাশে দাঁড়িয়ে সব কথা গুলো শুনছিল মিনু । রুবিকে বলা বেলীর কথাগুলো শুনে অনেক খুশি মিনু । এতদিন পর বেলী কিছু তো বলেছে রুবিকে । এটাই বা কম কিসের ? তাই সে আজ একটু হলেও অনেক খুশি । যতটা খুশি সে বেলীর উপর ততটাই ক্ষিপ্ত সে রুবির উপর । কারণ , রুবি আজকে একদম অতিরিক্ত করে ফেলছে । মিনু হাসি মুখে বেলীর রুমে যায় ।
– ভাবী ,,,,,,,,?
– হুম ,
– আইজ্জা তো ফাটাইয়া দিছেন আপনে ।
– কি ?
– ডাইনীটারে ইচ্ছামত কথা শুনাইছেন ,
– ডাইনী কেন বলো , সেও তো মানুষ ।
– মানুষ , কিন্তু কাজ কাম ডাইনীগো মত , তবে আপনে ভালা কাম করছেন শয়তান এইডারে ইচ্ছামত বলছেন ।
– একটা কথা কি জানো তো মিনু , দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন পিঠও কথা বলে । আমার অবস্থাটাও ঠিক ওই রকম । আমি চাই না সে বার বার তার আর ওনার মাঝে আমায় টানুক । আর দেখতে গেলে রুবি আপু তো বেশি হকদার এই সংসারের । আমি কে ?
– আপনে কে মানে ? আপনে তো ভাইয়ের বউ ।
– আমি বউ হলে কি আরেক বউয়ের দরকার পড়তো ওনার মিনু ? আমি তো আমার সবটা উজাড় করে দিয়েছিলাম কিন্তু লাভ কি হলো , বলতে পারো ?
– সবই কপালের দোষ ,
– কপালের দোষ বলেই তো টিকে আছি , একদিন দেখবে আমি আর থাকবো না ।
– এইডা কি কন ভাবী ?
– আমি এখনও থাকতে চাই না , কিন্তু যেতেও পারি না ।
– এডি কইয়েন না ভাবী ।
– যাও কাজ করতে যাও , শরীর টা ভালো লাগছে না আমার একটু ঘুমাবো ।
– আইচ্ছা ,
– আর শুনো , তোমার ভাই আসলে তাকে কফি করে দিও আমি আজ আর বের হবো না কেমন ?
– আইচ্ছা ভাবী ।
[ বিঃদ্রঃ বাস্তব জীবনে আমরা এমন অনেক পরিস্থিতিতে পড়ি যেখান থেকে ওভারকাম করা খুব কঠিন । কথা শুনতে শুনতে মস্তিষ্ক এমন অবস্থায় চলে যায় যেখানে না চাইতেও কথা বেরিয়ে আসে মুখ থেকে । আসলেই যেতে যেতে যখন পিঠটা দেয়ালে আটকে যায় তখন দিক বিক না দেখে না ভেবে পিঠাটাই কথা বলা শুরু করে দেয় । তেমন সাধু ব্যাক্তিও একবার না একবার বলবেই । যে হাজারো হাদিস জানে সেও একবার না একবার একটা হলেও গালি দিবে । আজ বেলীও তেমন , শুনতে শুনতে বড্ড বেশি তিক্ত সে । তাই আজ কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে সেও বাধ্য হয় । বাঁচতে হলে এভাবেই হয়তো বাঁচতে হবে । যুদ্ধ করে নিজের জন্য হলেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে । এটাই নিয়ম , সব কিছু নিয়তির উপর ছেড়ে দেয়া যায় কিন্তু নিজের আত্নমর্যাদা আত্নসম্মান নিয়তির উপর ছেড়ে দেয়া যায় না নতুবা নিয়তি বার বার ধোঁকা দিতে থাকে ]
বেলী বিছানায় শুয়ে আছে । শরীরটা আসলেই ভালো লাগছে না তার । পুরো শরীর কাঁপছে তার । শরীরটাও গরম হয়ে আছে । মনে হয় জ্বর আসবে । জ্বরের কথা ভাবতেই একটা কথা মনে পড়ে যায় বেলীর ।
সেদিনও বেলীর জ্বর ছিল , কিন্তু তবুও সেদিন সে কলেজে গিয়েছিল । মোড়ের মাথার সামনে সেদিন রাজু তার জন্যে অপেক্ষা করতেছিল । বেলী সেদিন আস্তে আস্তে হেটে যাচ্ছিলো আর তখনই ,
– কালচে ফুল,,,,,,,,,,,,,?
– কেহহহহহ ,
– কিরে কলিজা এত ছোট কেন তোর ?
– আপনারে না বলছি এমনে হুটহাট ডাক দিবেন না ।
– তোর কলিজা ছোট হইলে আমি কি করবো ,
– কি করবো মানে , আমার এগুলা ভালো লাগে না ।
– তোরে এমন দেখা যায় কি জন্যে , শরীর কি ভালো না ?
– উহু , জ্বর আইসা গেছে
– আহারে , কালির আবার অসুখও করে ।
– এমনে বলেন কেন ?
– তোরে রাগাইতে ভালোই লাগে আমার ।
– ধুর , বাইত যাই গা ।
সেদিন অনেকটা রাগ করেই বেলী চলে আসছিল রাজুর সামনে থেকে । সেদিন রাজুও হেসেছিল বেলীর রাগ দেখে তাই তো জোরে জোরেই বলেছিল ,
– ওই কালিইইইই , দাঁড়া যাস কই , আয় আমি ওষুধ কিনে দিবো
– আপনের ওষুধ আপনিই গিলেন ।
কথাটা শুনে রাজু অনেক হেসেছিল । রাজুর হাসিমাখা মুখটা আজও বেলীর চোখে ভাসে । এইসব ভাবতে ভাবতে বেলীর চোখে ঘুম নেমে আসে ।
রাত ৮ টার পর ইরফান বাসায় আসে । ক্লান্ত শরীরে কলিংবেল বাজানোর পর ভেবেছিল দরজায় বেলীর মায়াবী চেহারাটা দেখবে । কিন্তু দুর্ভাগ্য দরজা খুলে মিনু । মিনুকে দেখে বেশ খানিকটা অবাক হয় ইরফান ।
– কিরে তুই কখন এলি ?
– ১১ টার দিকে , খালি আমি একলা আই নাই আরও একজনও আইছে ।
– কে ?
– নিজে যাইয়াই দেখেন ,
– এক কাপ কফি করে দে ,
– আইচ্ছা ,
– বেলী কোথায় ?
– ঘুমায় ,
– এখন ?
– জানি না আমি
দরজা থেকে ভেতরে গিয়ে নিজের রুমে যায় ইরফান । রুমের ভেতরে গিয়ে খাটের উপর রুবিকে শুইয়ে থাকা অবস্থায় দেখে মেজাজ বিগড়ে যায় ইরফানের । হাতে থাকা মোবাইল টা রেখে রুবির সাথে কথা না বলেই বেলীর রুমে যায় ইরফান । বেলীর রুমে গিয়ে বেলীকে শোয়া অবস্থায় দেখতে পেয়ে কাছে গিয়ে বসে ইরফান । হাত ধরতেই দেখে বেলীর পুরো শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে । মুহুর্তের মাঝেই ইরফানের সাড়া মুখে চিন্তার রেখা ভেসে ওঠে । উদ্বিগ্ন হয়ে চিন্তিত গলায় বেলীকে কয়েকবার ডাকে ইরফান ।
– বেলী,,,,,,,,?
-………
– এই বেলী , বেলী
– হু,,,,,,,,,
হালকা স্বরে হু করে উঠে বেলী ।
.
.
চলবে…………………..