###__ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল__###
পর্ব_২২
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
সকাল থেকে বিকেল অবদি বেলী আর মিনু একা বাসায় । আজ ইরফান একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে গেছে । বেলী ঘুম থেকে উঠে ইরফানকে দেখতে পারে নাই । শরীর দুর্বল হওয়ার কারণে ঘুম আসলে আর সজাগ হতে পারে না সে । আজ দুই দিন ধরে নামাজ বাদ পড়ছে বলে আক্ষেপের শেষ নেই তার । আজ শরীরটা ভালো লাগায় নিজেই আস্তে আস্তে মিনুর সাথে মিলে সব কাজ করেছে । বিকেলের দিকে আসর নামাজ পড়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে গতকাল রাতের কথা মনে করে বেলী ।
– গতকাল রাতে কি একটু বেশিই বলছিলান তাকে ? জানি না কেন জানি নিজের কাছেই লজ্জা লাগতেছে এখন । মানুষটা যেমনই করুক এখন তো আর খারাপ আচরণ করে না আমার সাথে । আমার যথেষ্ট খেয়াল রাখে সে , তাহলে কিভাবে এত কিছু বললাম আমি । আজ দেখাও করে গেলো না আমার সাথে ।
নিজেই একা একা এইসব বলছে আ আফসোস করছে । এমন সময় ,
– দেখা কইরা যায় নাই তো কি হইছে ? কইয়া তো গেছে ।
মিনুর কথায় বেলী পিছনে ফিরে তাকায় । দেখে মিনু দাঁড়িয়ে আছে মাজায় হাত দিয়ে । মিনু মেয়েটা অতি ভালো , তবে চঞ্চল । মুখে সারাদিন হাসিই থাকে , মানুষের বাসায় কাজ করে খায় তবুও নিজের উপর পুরো আস্থা আর বিশ্বাস আছে তার । মিনুকে দেখে বেলীর মনে একটা কথা-ই আসে , ” মিনু না থাকলে আমি হয়তো কবেই শেষ হয়ে যেতাম ”
মিনু লাফিয়ে লাফিয়ে বেলীর কাছে আসে ,
– আহহহ মিনু !
– কিচ্ছে ?
– এইভাবে লাফাও কেন , নিচের ভাড়াটিয়াদের সমস্যা হবে তো ?
– হেতেগো সমিস্যা হইলে আমার কি আসে যায় । বাদ দে তো হেগো কতা । কার কতা আপনে এইহানে খাড়াইয়া খাড়াইয়া ?
– কই ?
– উহু , আমি তো হুনছি ।
– আমি যে কেন আজ দেরি করে উঠলাম ?
– তয় কি অইছে ?
– উনি কি নাস্তা করে গেছে ?
– হ এক পিচ বেরেড আর এক গেলাস পানি খাইছে ।
– ব্যাস এইটুকুই ?
– হ
– ইদানীং সে তেমন কিছুই খায় না ?
– আপনে মনে হয় কত খান ?
– কিছু বলে গেছিলো ?
– কইছিল বেলীর দিকে খেয়াল রাখিস । ভাইয়ে ভালাবাসে আপনারে ।
– জানি নাগো ।
– দেইখেন , তার মন আপনারেই চায় ।
– কিন্তু রুবি আপু ?
– হেই অসিভ্য মাতারি গুল্লি মারা খাউক ।
– ছিহ কি সব বলো মানুষ সম্পর্কে ?
– কম তো জ্বালায় নাই আপনারে ।
– সে করছে বলে তো আর আমি করতে পারবো না তাই না ।
– তয় যান , গিয়া আদর কইরা সতীন লইয়া আসেন । হুনেন ভাবী , আপনে বাঁচলে বাপের নাম বুজ্জেন । আমি যদি না বাঁচি বাপরে লইয়া ভাবুম কোন সময় ।
বহুত অইছে , এহন নিজের কতা ভাবেন ।
– ভাবতেই চাই কিন্তু পারি না যে ?
– অন্তরডার মইধ্যে অনেক কষ্ট , কেন ?
– যন্ত্রণায় বুকটা ব্যাথা করে , কলিজাটা ফেটে যায় । একবার যদি তাকে আপন করে পেতাম ।
– পাইবেন ভাবী , পাইবেন ৷ আল্লাহ পাক আপনের জন্যে অনেক ভালা কিছু রাখছে , পাইবেন আপনে ।
মিনুর কথায় একটু হলেও সাহস পায় বেলী । জীবনের গল্পটা হয়তো এক এক সময় এক এক রকম মোড় নেয় । নতুন মোড়ে গিয়ে জীবন নতুন কিছু শিখতে পারে ।
অন্যদিকে অফিসে কাজের ফাঁকে ইরফান একবার রুবিকে ফোন করে । ভেবেছিল রুবির সাথে কথা বলা প্রয়োজন । তাই ফোন দিয়েছি রুবিকে । দুই থেকে তিনবার ফোন যাওয়ার পর রুবি ফোন রিসিভ করে ।
– কি হয়েছে ?
– ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিতে হয় রুবি ?
– ধুর , এত সালাম দেয়ার সময় নাই আমার , হয়েছে কি তাই বলো ।
– বাড়ি ফিরবে না ?
– কেন , তোমার সো কলড বড় বউয়ের সেবা যত্ন করতে হবে নাকি ?
– এইভাবে কেন কথা বলো রুবি ?
– এই শুনো শুনো আমার সাথে একদম নাটক করবা না , ওকে ? হয় ওই মেয়েকে তাড়াও নয়তো আমি এখানেই থাকবো ।
– আমরা স্বামী স্ত্রী রুবি ।
– তো কি হয়েছে এখন ? স্বামী স্ত্রী বলে কি আমি তোমার ওই বউয়ের সাথে থাকবো নাকি ? এটা তো একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার ।
– আগে কিভাবে ছিলা ?
– আগের সিচুয়েশান অন্য ছিল আর এখনকারটা অন্য ।
– উহু , সিচুয়েশান একই আছে । তুমি পালটে গেছো । আগে বেলীকে মারধর করতাম বলে আমি ভালো ছিলাম । রোজ আমায় নিয়ে ও-কে দেখিয়ে দেখিয়ে অনেক কথা বলতে পারছো তাই ভালো লাগছে এখন আমি তাকে মারধর করি না আর তার কাছে আমায় নিয়ে বাড়তি কিছু বলতেও পারো না তাই এখন আমি খারাপ সিচুয়েশানটাও অন্য রকম হয়ে গেছে । তাই না রুবি ?
– অনেকটা সেই রকমই , হয় বেলী নয় রুবি । বাকিটা তোমার ডিসিশন ।
– আমি যদি বলি বেলীকে ছাড়া সম্ভব না তখন কি করবা তুমি ?
– হা হা আমি তোমায় ছেড়ে দিবো ।
– রুবি,,,,,,,,,?
– কি হলো , অবাক হলা নাকি ?
– অবাক না , শিহরিত হলাম সাথে উল্লাসিতও ।
– হওয়া ভালো ।
– এই ভালোবাসলা আমায় , জানো তো রুবি , বেলী কিন্তু তুমি থাকার পরেও আমায় ছেড়ে যায় নি ।
– ওইটা দেখে অশিক্ষিত বর্বর গাইয়া ভূত , আমি কি ওর মত নাকি , আজ রাস্তায় দাড়ালে হাজার ছেলের লাইন লাগবে , আমার বাবার অঢেল আছে । তখন কেউ দেখবে না আমার বিয়ে একটা হয়েছিল নাকি দশটা হয়েছিল ।
– ছিহ রুবি ? এইভাবে বলতে পারলা তুমি ?
– পারলামই তো , আগেই তো বললাম হয় আমি নয় ওই মেয়েটা ।
– আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম অন্যকিছু ভেবে , কিন্তু তুমি যা বললা তাতে আমি খুব খুশি হলাম ।
– বেশ , ডিসিশন জানিয়ে দিও । আমি ওইভাবেই আগাবো ,
– কিভাবে ?
– আইনিভাবে , রাখছি ।
রুবি লাইনটা কেটে দেয় । আইনিভাবে এগুবে তার মানে ও ডির্ভোসের দিকে যাবে । ভাবতেই হালকা হাসি দেয় ইরফান । আজ নিজেকে পৃথিবীর সেরা গর্দভ মনে হচ্ছে তার । এ কাকে বিয়ে করেছিল সে , যে নিজের স্বার্থ ছাড়া এক পা নড়ে না ।
– জীবনে মাকে দেখি নি । তবে নারী দেখলান , দু’রকমের নারী । এক রকম নারী হয় যারা নিজেকে উজাড় করে দেয় অন্যের ভালোবাসার কাছে । অন্যকে ভালোবেসে নিজের সব দিয়ে দেয় । অন্যের কাছ থেকে কিছু না আশা করেই বিলীন করে দেয় নিজেকে । আর আরেক নারী দেখলাম , যে শুধু নিজেরটাই বুঝে । নিজের ভালো থাকা নিজের মন্দ থাকা নিজের সৌখিনতা সবটাই বুঝবে । যে নিজের ইগো’র জন্য আমায় ছাড়তে রাজি , সে কি আদৌ আমার স্ত্রী ? আজ মুক্ত কন্ঠে বলতে ইচ্ছে করে হ্যাঁ , আসলেই আমি একজন খারাপ মানুষ । যে কিনা এক মহীয়সী নারীকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়েছি । আল্লাহ পাক হয়তো এর শাস্তি আমায় রুবিকে দিয়ে দেখালেন । আর বেলীর নিরবতা আমার বন্ধ চোখকে খুলে দিয়েছে ।
নিজের কেবিনে বসে ভুল গুলো স্মৃতিচারণ করে নেয় ইরফান । আসলেই তার হয়তো এইবার চোখ খুলে গেছে । ডেস্ক থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে গ্যালারিতে যায় সে । সেখানে গ্রামের বাড়িতে বেলীর কিছু ছবি ছিল । ছবিতে নিজের নজর রাখে সে ।
– তুই বেলী একটাই রে । আমি ধন্য তোকে পেয়ে । তুই-ই সেই নারী যে কিনা আমায় নিয়ে বেহেস্ত পর্যন্ত যেতে পারবি । তুই বেলী হাজারে একটাই হোস । ভালোবাসিরে অনেক ভালোবাসি । তোকে যতটা না ভালোবাসি ততটাই নিজেকে ঘেন্না করি না । ছোট হয়ে গেলাম নিজের কাছে নিজে ।
চোখ জোড়া মুছে নেয় ইরফান । আজ কেন যেন নিজের চোখ দিয়ে ক্রমশ পানি বের হচ্ছে তার । কিসের জন্যে বুঝতে পারছে না । তবে এই পানি হয়তো দুঃখের নয়তো সুখের । হয়তো রুবির করা স্বার্থপরতা অথবা বেইমানির জন্যে নয়তো বেলীর উজাড় করা ভালোবাসার জন্যে ।
সময় এসে গেছে সব ঠিক করার । এরপর হয়তো আর সময় নাও থাকতে পারে । ভুল গুলো শুধরে নিতে হবে । না হয় যে
” সময় গেলে আর সাধন হবে না ”
.
.
চলবে…………………
[ বিঃদ্রঃ রুবির বলা কথা গুলো সেইসব পর্যায়ের যে পর্যায়ে মানুষ একদম স্বার্থপর হয়ে যায় । হ্যাঁ , একজন নারীর একাধিক রুপ হয় । যখন সে ভালো তো ভালো , যখন সে খারাপ তো খুব খারাপ । তবে রুবির মত এমন অনেকেই আছেন আমাদের সমাজে আর আমার চোখের দেখাতেও যে কিনা অন্য মেয়ের সুখ সহ্য করতে পারে না । নিজের নিজের নিজের সব সময় নিজের জন্যই ভাবা । হ্যাঁ , নিজের জন্য ভাবা ভালো তবে সব কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে নয় । কখনো কখনো সেক্রিফাইজ জিনিসটাও প্রয়োজন । সেক্রিফাইজ করতে পারে হয়তো বেলীর মত মেয়েরা । একটা পয়সার দুটো দিক তেমনি সমাজের সব নারী আবার সব পুরুষ এক নয় । ভালো খারাপ মিলিয়েই মানুষ হয় । রুবিকে দেখেই বোঝা যায় নারীজাত কেমন হয় আবার অন্যদিকে বেলীকে দেখেও বোঝা যায় নারীজাত কতটা নরম হয় । যে কিনা সারাজীবন মুক্ত হস্তে নিজের সুখ শান্তি বিলীন করে দিয়ে সবাইকে ভালোই রেখে যায় । হয়তো কোন এক সময় পারি দেয় পরপারে ]