###__ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল__###
#পর্ব_২৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
সন্ধ্যার পর রাত প্রায় ৮ টা নাগাদ ইরফান আর বেলী বাসায় ফিরে । মিনু তখন স্টার জলসা নিয়ে বসে আছে । মিনু তাদের দেখে কথা বলা শুরু করে দেয় ।
– আইয়া ফরছেন ?
– হু ,
– এত তাড়াতাড়ি ?
– কি করবো তাহলে , ঘুরাঘুরি শেষ আর থেকে কি করবো ?
– খাইয়া আইতেন ?
– তোমার ভাই খাবার নিয়ে আসছে , আমরা এক সাথেই খাবো ।
– ওহ আইচ্ছা ,
ইরফান আগেই রুমে চলে গেছে । বেলী মিনুর সাথে কথা বলার পরেই রুমে যায় । বেলী রুমে গিয়ে দেখে ইরফান শার্টের বোতাম খুলছে । এটা দেখে বেলী বের হয়ে যেতে নেয় ওমনি ইরফান ডেকে দাড় করায় বেলীকে ,
– বেলী দাড়াও ,
– হু ,
– কি হয়েছে চলে যাচ্ছো যে ,
– নাহ আসলে এসেছিলাম কাপড় বদলাতে এখন দেখলাম আপনি বদলাচ্ছেন ।
– তাতে কি হয়েছে , আমি কাপড় বদলাবো বলে তুমি চলে যাবা ?
– নাহ ঠিক আছে , সমস্যা নাই ।
– আচ্ছা শুনো একটু ,
– হু ,
– শাড়িটা পরে থাকো ,
– রাতের বেলাতেও ?
– হ্যাঁ , আজ তোমার গলায় গান শুনবো ।
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– কিছু বললে না যে ,
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– আচ্ছা বাদ দেও , তা বলো কেমন লাগলো আজকে ঘুরতে বেরিয়ে ।
– ভালো ,
– তুমি যে এত ঝাল দিয়ে ফুচকা খাও , আগে তো বলো নাই ।
– আমি ফুচকায় ঝাল একটু বেশিই খাই ?
– তাই ?
– হু ,
– আমার তো নাকে পানি চলে আসছে ।
– ওহ , আচ্ছা আমি একটু রান্না ঘরে যাই , কেমন ?
– হু ,
বেলী চলে যাওয়ার পর আয়নায় নিজেকে দেখতে থাকে ইরফান । কিছুক্ষণ ভালো করে তাকায় নিজের দিকে সে । তারপর ভাবতে থাকে কিছু কথা ।
– কতটা পরিবর্তিত আমি , এই আমি নিজেকে এখন অনেকটাই অচেনা লাগে । কি আমি কি হয়ে গেলাম আর আগেই বা কি ছিলাম । বেলী যে কিনা অসহায় অবস্থায় আমার জীবনে এসেছিল আর আমি তাকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিয়েছি । মুখ ফুটে কখনো কিছুই বলেনি মেয়েটা । শুধু সহ্য করে গেছে আমার অত্যাচার গুলো । আজ নিজের কাছে নিজেকে অনেকটা নড়পশুর মত মনে হয় । জীবনটাকে নিজের হাতে ধরে দু’মুখো করে দিলাম । আজ বেলী আমার সাথে ঠিকমত কথা বলে না হয়তো আমায় দেখলে তার সেই অসহ্য মুহুর্ত গুলোর স্মৃতি মনে পড়ে যায় । একটা মানুষের পক্ষে কতটা সম্ভব এইভাবে সব কিছু সহ্য করে পড়ে থাকাটা । কেন জানি মনে হয় বেলী একটাই হয় যে ফুল হয়ে ফোঁটে অন্যকে সুবাস ছড়িয়ে দিতে ।
কথা গুলো অনুধাবন করতে থাকা ইরফানের চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে যায় । জীবনটা আসলেই বৈচিত্র্যময় , এখানে জীবন ক্ষনে ক্ষনে রূপ বদলায় । এরই মাঝে বেলীর ডাকে ধ্যান ভেঙে যায় ইরফানের ।
– হু , কিছু বলবে ?
– ৫ বার ডাক দিলাম , যেইভাবে দেখে গেছিলাম এখন ২৫ মিনিট পর সেইভাবেই দেখছি আপনাকে । কি করছেন এখানে দাঁড়িয়ে ?
বাহ বাহ ২৫ মিনিট হয়ে গেছে , অথচ ইরফানের খেয়ালই ছিল না । বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে ইরফান । বেলীর শান্ত চোখের দৃষ্টি ইরফানের মনে ঝড় তুলে দেয় । মুচকি হেসে দিয়ে হাতের ইশারায় বেলীকে নিজের কাছে ডাকে ইরফান । বেলীও ধীর পায়ে ইরফানের দিকে এগিয়ে যায় । আলতো করে বেলীর হাতটা ধরে ইরফান । নিজের একদম কাছে নিয়ে যায় সে বেলীকে । জানালার পাশে নিয়ে গিয়ে দাড় করায় ।
বেলীকে জানালার সামনে দাড় করিয়ে নিজের বুকে বেলীর পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায় ইরফান । ইরফানের স্পর্শে ভেতরটা ভেঙে চূড়ে যাচ্ছিল বেলীর । এ যেনো এক স্বর্গীয় সুখ । যেখানে প্রিয় মানুষটার স্পর্শ পাওয়া যায় । ভালোলাগা হয়তো এটাই , আর এটাকেই হয়তো ভালোবাসা বলে ।
বেলীর কোমড়ের দু’পাশ দিয়ে নিজের হাত রাখে ইরফান । ছোয়া গুলো মায়াবী হলেও নোংরামি ছিল না কিছুতেই । এ যেনো এক প্রকার স্পর্শকাতর ভালোবাসা । বেলীর ঘাড়ে নিজের থুতনি লাগিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ইরফান ।
– বেলী ,
– হু ,
– এত চুপ থাকিস কেন ?
প্রায় বেশ কিছুদিন পর ইরফানের মুখ থেকে তুই শব্দটা শুনে বুকের মাঝে ঝট করেই কামড় দিয়ে উঠে বেলীর । সাথে এক রকম শান্তিও আসে মনে । আত্মাটা তার শুকিয়ে ছিল সেই তৃষ্ণার্ত আত্মায় কে যেন পানি ঢেলে দিয়েছে মনে হলো । পরম অনুভবে চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয় বেলী ।
– আমায় একটা কথার উত্তর দিবি ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,
– কিরে বল না , দিবি ?
– হু ,
– তুই এমন কেন বেলী ? কেন তুই পাল্টাতে পারিস না ? ঘেন্না লাগে না আমার প্রতি ।
– বেলী কখনো পালটায় না । আর ঘেন্না করবো কাকে ? আপনাকে ? তাহলে তো আমি নিজেকেই ঘেন্না করতে পারি ।
– তোকে কেন জানি বুঝতে পারি না আমি ?
– কেন জানি আপনাকে চিনতে পারি না আমি ?
– কেন জানি তুই আমার হৃদয়ে মিশে গেছিস ?
– কেন জানি আপনি আমার অন্তরে আটকে গেছেন ?
– অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে তাই না রে ?
– হয়তো ভাগ্যে ছিল ,
– আমায় ছেড়ে কোথাও যাবি না তো ?
– জানা নেই , তবে মৃত্যু এলে আটকাতে পারবো না ।
– রাগটা দেখাস না ঠিকই কিন্তু অভিমানটা ঠিকই রয়ে গেছে ।
– না আছে রাগ , না আছে অভিমান , যদি কিছু থাকে তাহলে তা হচ্ছে নিরবতা ,
– আর সেই নিরবতায় কে বিরাজমান ?
– যে আমার সব চেয়ে কাছে , যার মাঝে আমার অস্তিত্বের জানান হয় ।
বেলীর কথায় ইরফানের অশান্ত মনটা শান্ত হয় নিমিষেই । বেলীর কোমড়ে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ইরফান ।
– চলেন , খাবেন না ?
– পালিয়ে যেতে চাইছিস ?
– পালাবো কেন , আমি তো এখানেই আছি , আসুন খাবেন আসুন ।
বেলী একটু নড়েচড়ে উঠে , ইরফান বেশ বুঝতে পারে যে তার কাছে থাকতে বেলী আন-কমফোর্ট ফিল করছে । তাই ইরফানও বেলীকে ছেড়ে দেয় ইরফান ।
খাওয়া দাওয়ার পর ইরফান রুমে এসে বসে বসে মোবাইল টিপছে । রুবিকে অনলাইনে দেখে মনটা কড়া নেড়ে ওঠে ইরফানের । একবার নক করবে কি করবে না ভাবছে সে । রুবিও হয়তো ইরফানকে অনলাইনে দেখেছে কিন্তু কোন ম্যাসেজ করে নি ।
– আফসোস লাগে নিজের প্রতি , কেন যেনো এলোমেলো হয়ে গেছে আমার জীবনটা । এখনও জানা নেই রুবির ডিসিশন কি হবে । তবে যাই হোক বেলীকে আমি ছাড়তে পারবো না । বেলীতে মত্ত্ব আমি , সে আমার হৃদয় মন্দিরে আটকে আছে । ভালোবাসি তাকে ভিষণ ।
এরই মাঝে বেলীর প্রবেশ ঘটে রুমে । বেলী ইরফানকে খাটে আধো শোয়া অবস্থায় থাকতে দেখে দরজা লাগিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় । কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে আকাশে ওঠা চাঁদের পাণে নজর রাখে বেলী ।
ইরফান মোবাইল টিপতে টিপতে হঠাৎ করেই তার কানে আসে ,
তুই ফেলে এসেছিস কারে মন ,
মন মন রে আমার ,
তাই জনম গেলো শান্তি পেলি না রে
মন মন রে আমার ,
ইরফান শোয়া থেকে উঠে বসে যায় । বেলীর কন্ঠে এই প্রথম ইরফান গান শুনছে । অসাধারণ কন্ঠে গান গাইছে বেলী । ইরফান হেটে গিয়ে বেলীর পাশে দাঁড়ায় । বেলী তখনও জানালার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে গান গাইছে ।
যে পথ ধরে এসেছিলি ,
সে পথ এখন গেলি ভুলে ,
কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে মন ,
মন মন রে আমার
ইরফান মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে বেলীর মুখের দিকে । বেলীর কন্ঠে তখন গান আর চোখের কোণে তখন অশ্রুর ঢল । গাইতে গাইতেচেক সময় শেষ হয়ে যায় গানটা । ইরফানের তখন হুশ হয় যে গান শেষ ।
– অনেক সুন্দর গাইলি ,
– মন বড়ই অবুঝ , বুঝেও বুঝে না । ফেলে আসা মানুষটা আজও বুঝলো না , মন তো মন-ই । এক অস্পর্শনীয় অনুভূতি।।
.
.
চলবে…………….
[