ডাকপাড়ি পর্ব -৩৬+৩৭+৩৮

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩৬
#আফনান_লারা
________
আজিজ খান মস্ত বড় নাছোড়বান্দা লোক।ফারাজ আর পূর্ণতাকে কথা দিয়ে আটকে রেখেছেন।পারছেননা এখানে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়েটা পরিয়ে দিতে।বারবার তিনি বেলায়েত হোসেনকে স্মরণ করছিলেন।একবার যদি দেখা পাইতেন তাহলে হাতেনাতে দেখিয়ে দিতে পারতেন।কিন্তু এদের একা রেখে গেলেই এরা দুজন দুদিকে পালাবে, এমনও হতে পারে তাকে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করলো।

মনে মনে ভাবছিলেন কি করে সাপ ও মরবে,লাঠিও ভাঙ্গবেনা।
ফারাজ পূর্ণাকে ইশারা করে বলতে চাইছিল তাদের দৌড় দেয়া উচিত।

আজিজ খানের চোখে ধুলা দেয়া সহজ কথা না।কিন্তু এখন পালানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ওদের দুজনের কাছে।
এক দুই তিন বলে দুজনেই ঝড়ের গতিতে দৌড় দিয়ে দিছে।আজিজ খান সেসময় চশমা খুলে গায়ের শার্ট দিয়ে পরিষ্কার করছিলেন।চশমাটা পরে দেখলেন সামনে ফারাজ পূর্ণতা দুজনের একজনও নেই।কেমন বোকা বানিয়ে দিলো তাকে।রেগে মেগে তিনি চললেন বেলায়েত হোসেনের কাছে।কড়া করে বিচার বসাবেন।

ওদিকে ফারাজ আর পূর্ণতা ছুটতে ছুটতে ছাদে চলে এসেছে।সেখানে এসে চিলেকোঠার দরজা লাগিয়ে দুজনে ধপ করে নিচে বসে গেলো হাঁপাতে হাঁপাতে।

শেষে দুজনে একত্র হয়ে হেসে ফেললো।হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাওয়ার মতন অবস্থা। ফারাজ পূর্ণাকে হাসতে দেখে বললো,’জানেন হাসলে আপনাকে কেমন লাগে?’

‘জানি,অসম্ভব সুন্দরী। ক্লাস সেভেনে থাকতে একটা ছেলে কথাটি আমায় বলেছিল।সে কাদায় পিছলে পড়ে যাওয়ায় আমি খুব হেসেছিলাম।তখন সে কাদায় মেখে থেকে এই কথাটা বলেছে।ছেলেটির নাম ছিল ‘অজিত দাস’ আমার বাবার বন্ধুর ছেলে।আমার জন্য খুব পাগল ছিল।কতবার যে ফুলের মালা এনে দিতো।কিন্তু কি থেকে যে কি হয়ে গেলো!!তার বাবার অফিসের বদলি হয়ে যাওয়ায় সে অনেকদূর চলে গেলো এরপর আর খবর জানিনা’

‘ছেলেটি লাইন মারতে চেয়েছিল বলেই এত বড় মিথ্যা বলেছে।আসলে কিন্তু আপনার হাসি দেখতে ডাইনির মতন।যেন এক ডাইনি হাসছে’

‘আপনি যে আমায় সহ্য করতে পারেননা তা জানি আমি।তাই গায়ে মাখলাম না কথাটা’

‘সহ্য করবেন কি করে?সত্যি কথা তো টক হয়’

পূর্ণতা গেলো রেগে।উঠে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল তুলে বললো,’আমি কম সুন্দরী হতে পারি কিন্তু অতোটাও খারাপ দেখতে না।আমার পেছনে অনেক ছেলে পড়ে থাকতো’

‘মরে?’

‘আপনি এমন করে কথা বলছেন কেন?আপনার ভুটকি বিবাহিত গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে আমি কিছু বলতাম?তাহলে আপনার কোনো রাইট নাই আমাকে নিয়ে কিছু বলার।’
—-
আজিজ খান সব বেলায়েত হোসেনের কানে তুলেছেন।সব শুনে তিনি অর্ককে দিয়ে ফারাজকে ডেকে পাঠিয়ে নিজের পাশে বসিয়ে রাখলেন।কোনো কিছু বললেন না করলেন ও না।
———–
সজীব অতিরিক্ত করছিল।সারথিকে সে সাথে নিয়েই যাবে এটা তার শেষ কথা।এদিকে সারথি কথা বলার শক্তি টুকু পাচ্ছিল না,আস্তে আস্তে শুধু বলে যাচ্ছে সে সজীবের সাথে যাবেনা।একটা সময়ে সজীব রেগে বললো বাইরের মানুষের সামনে সারথি এরকম কেন করছে।

সারথি হাত ছাড়িয়ে যেদিকে পথ পেলো সেদিকে ছুটলো। আনাফ চুপ করে সব দেখছিল।সারথি অন্যদিকে চলে যাচ্ছে বলে সজীব রাগ দেখিয়ে ওর সামনে এসে পথ আটকে হাতটা খুব শক্ত করে ধরে বললো,’আমি এখন যেটা বলবো সেটাই হবে,এবং তোমাকে সেটা শুনতে হবে’

আনাফের সামনে দিয়ে সজীব সারথিকে নিয়ে গেছে।আনাফ না পারলো কিছু বলতে আর না পারলো কিছু করতে।চুপ করে দেখা ছাড়া তার আর কিছু করার ছিলনা।

বাড়ির গেইট অবধি এসেই সারথি নিজে নিজে মাটিতে বসে গেছে।কাঁদো স্বরে আরও একবার বললো সে যাবেনা,একা থাকতে চায়’

সজীব এবার ওর হাত ছেড়ে দিয়েছে।যেহেতু সারথি একেবারেই চায়না ফিরতে সেহেতু সে আর জোর করবেনা।ওর যেভাবে থাকতে চায় থাকুক ভেবে সজীব একাই গেট দিয়ে চলে গেলো। সারথি সেই আবার আগের জায়গায় ফিরছে।
ছুটতে ছুটতে এবার নিজের সব শক্তি দিয়ে আনাফের নাম ধরে ডাকে সারথি।
আনাফ সেসময় গাড়ীতে ঢুকছিল।সারথির ডাক শুনে থেমে মাথা তুলে চেয়ে দেখলো সারথি এদিকেই আসছে,এদিক সেদিক ফিরে বারবার আনাফের নাম নিচ্ছে।একেবারে এদিকটায় এসে আনাফের গায়ের গন্ধটা তীব্র মনে হলো ওর কাছে তখনই সে নাম ধরে ডাকা থামিয়ে দেয়।
আনাফ মুচকি হেসে বলে,’এতক্ষণে আনাফের কথা মনে হলো?’

‘আগেও ছিল।’

‘গিয়ে আবার ফিরে আসার কারণ কি?’

‘আমি চাইনা ওখানে থাকতে,তাই ফিরলাম’

‘আর আমাকে কেন ডাকছিলেন শুনি?’

‘কোলে নিতে হবেনা,এমনিতেই নিয়ে যান।যেখানে সজীব নামের পুরুষটার কোনো অস্তিত্ব থাকবেনা,আমার পরিবার তার পরিবারের কেউ থাকবেনা। যেখানে আমি স্বস্তিতে দম ফেলতে পারবো, সেই জায়গায় যেতে চাই।নিয়ে যাবেন?’

আনাফ সারথির হাত ধরতে গিয়েও ধরলো না।একবার জানতে চাইলো ধরবে কিনা।সারথি হাতটা বাড়িয়ে ধরে তখনই।আনাফ ওর হাত ধরে গাড়ীর কাছে এনে থামে।সারথি নিজে নিজে গাড়ীতে বসলো এবার।
আনাফ ও নিজের সিটে বসে একটু ঝুঁকে সারথিকে সিট বেল্টটা লাগিয়ে দিলো।

একটা গান প্লে করে সে গাড়ী ঘুরিয়ে অন্য পথে চলছে।গানটা ছিল তামিলের একটা গান।লিরিক্স বোঝা না গেলোও সুরে খুব ভাল লাগছিল শুনতে,যেনো আমাদেরই দেশের চেনাপরিচিত একটি গান। খুব সহজ কিছু বলছে কিন্তু ভাষা অজানা বলে বোঝা গেলোনা।
গানটা মূহুর্তটাকে খুব সুন্দর করে ফেলছিল।এটাই হয়ত সারথির বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।রাগ করে সে বলে দিলো গানটা বন্ধ করতে।
আনাফ কথাটা শুনেছে কিন্তু কাজটা করে নাই,বরং সাউন্ড বাড়িয়ে দিলো।

সারথি এবার প্রচণ্ড রকম ভাবে রেগে গেলো।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’কি বললাম শুনতে পারছেন না?গানটা বন্ধ করেন’

‘আপনার ইচ্ছা করেনা ভাল মূহুর্ত কাটাতে?’

‘আমার কাছে ভাল মূহুর্ত মানেই গান শোনা না।আরও অনেক কিছু আছে যেটা দিয়ে মূহুর্তটাকে সুন্দর করা যায়’

‘যেমন?’

‘যেমন নিজের গলায় গান গাইলে মূহুর্তটা একটু বেশি সুন্দর হয়ে যায়।এখন বলবেন না যে আমি গাইতাম।আমাকে দিয়ে গান হয়না।ফারাজ খুব ভাল গান করে কিন্তু আমি ওর মতন হইনি।আমার গানের গলা বাজে’

‘আমি গাই?’

‘নাহ।আপনার যে কন্ঠ,আমার মনে হয় গান গাইলে গাড়ীর পার্টস খুলে পড়ে যাবে’

আনাফ মুখ বাঁকিয়ে গাড়ীটা একটু স্লো করে গান ধরলো।
গানটা ছিল পুরোনো দিনের।তোমার খোলা হাওয়া গানটি।শুধু চার লাইন গেয়েছিল সে।সারথি কল্পনাও করতে পারেনি এত ভাল শুনাবে।

এতটাই বিভোর হয়ে গেছিলো সে যে আনাফের গান থেমে যেতেই সে বলে উঠলো বাকি লাইনগুলোও যেন সে গায়।আনাফ খুশি হয়ে তাই করলো।পুরো গানটাই শেষ করলো সে।
আনাফ ভাল গান গাইতে পারে অথচ সে কত অপমান করলো এটা নিয়ে ভেবে সারথি লজ্জায় পড়ে গেলো।নিজের মনের ভেতর ছোটখাটো একটা যুদ্ধ করে বলেই ফেললো সে দুঃখিত।আনাফ বিষয়টাকে এতটা সিরিয়াস নেয়নি কিন্তু সারথি সিরিয়াস নিয়েছে দেখে সে হাসলো,তার হাসিটা সারথি জানতেও পারলোনা,দেখতেও পারলোনা।গোপনের হাসি গোপনই রয়ে গেলো।আনাফ কিছু বলছেনা দেখে সারথি বললো,’আমার উচিত হয়নি আপনাকে নিয়ে মজা করা।’

‘হয়েছে!আর বলতে হবেনা।আমরা কোথায় যাচ্ছি বলতে পারেন?দেখি আমার সাথে মিশে আপনার কেমন উন্নতি হলো?’

সারথি অনেক ভেবে বললো,’কোনো রিসোর্ট? ‘

‘নাহ’

‘পার্ক?’

‘নাহ’

‘তবে কি?’

‘এমন একটা জায়গা যেখানে দূর দূরান্তে কেউ থাকবেনা।যেখানে সজীবের দন্ত স থাকবেনা।পরিবারের প থাকবেনা।থাকবে শুধু সারথি আর আনাফ।হতে পারে বিশাল আকারের সেই জায়গা।সাদা ধুসুর রঙে রাঙায়িত।উপর নীল আকাশ আর নিচে ধুসুর রঙের মেলা।বলুন সেটা কি?’

‘নদী’

‘বাহ!ভালই।তাও ক্লু দেয়ার পর বুঝতে পারলেন’

‘আপনার কি মনে হয়না আমি আরও একবার ঝাঁপ দিতে পারি?’

‘হয়।অনেকবার মনে হয় কিন্তু আমি তো আছি তাইনা?আমার সামনে আপনি মরতে পারবেন না।আমি ঠিক বাঁচিয়ে আনবো’

‘কতদিন পারবেন এটা?’

‘যতদিন আছি’
———
সজীবকে গাল ফুলিয়ে বাড়িতে ঢুকতে দেখে ওর মা এসে জানতে চাইলেন সারথি কোথায়।

‘আছে ওর রুমে হয়ত’

‘তাহলে তুই এখানে কি করছিস?যা ওর কাছে’

‘না আসলে!!থাকিনা তোমাদের সাথে।ও রেস্ট নিক’

মায়ের সন্দেহ হলো।সজীবের হাত ধরে সবার থেকে একটু দূরে নিয়ে এসে জানতে চাইলেন ব্যাপারটা কি আসলে।সজীব ধামাচাপা দিয়ে দিচ্ছে তাও মা আরও জোর করছেন জানার জন্য।কারণ তার মনে সন্দেহ জাগলো লেভেনকে নিয়ে।সজীব যে বিয়ের আগে একটা মেয়েকে ভালবাসতো এটা তিনি জানেন।
এবং তার সন্দেহ হয় ঐ মেয়ের সাথে সজীবের এখনও সম্পর্ক আছে কিনা।
সজীব কিছুতেই স্বীকার করে নাই লেভেনের কথা।এটাও বলে নাই সারথি যে বাসাতে নেই।সে ঝামেলা চাইছিল না।

ওদিকে পূর্ণতা দেখে এসেছে রুমে সারথি নেই।সবে সে বাগান থেকে এসেছিল তার মানে সারথি বাসাতেই নেই??এই কথা ফারাজকে জানাতেই হবে।কিন্তু দুই দাদুর চোখে ফাঁকি দিয়ে কি করে সে ফারাজের কাছে কথাটা পৌঁছাবে!!
ফারাজ গিয়ে সবার মাঝে বরাবর বসে আছে।পূর্ণতা অনেক ইশারা করলো কিন্তু সে দেখলোই না।পরে অর্কর রুম থেকে একটা খাতা নিয়ে কাগজ ছিঁড়ে সেটাকে গোল করে চেপে ধরে খোসা বানিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে মারে পূর্ণ।সেটা গিয়ে পড়েছে একেবারে ফারাজের কপাল বরাবর। এটা দেখে ফেলেছেন জনাব বেলায়েত হোসেন।ফারাজ কাগজ খুলে কিছু না দেখে সেটা ফেলে সামনে চেয়ে দেখলো পূর্ণতা হাত দিয়ে ওকে ডাকছে বাড়ির ভেতের আসার জন্য।

ফারাজ উঠে সেদিকেই গেলো ওমনি পিছু পিছু আসছেন বেলায়েত হোসেন,সাথে তিনি আজিজ খানকেও ইশারা ইঙ্গিতে নিজের সাথে আসতে বললেন।
ফারাজ বুঝেছে কিছু একটা হয়েছে।তা নাহলে পূর্ণতা ওকে ডাকার মেয়ে না।এর পেছনে যথাযথ কারণ আছে।
তাই সে দ্রুত গেলো ঐদিকে।

চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩৭
#আফনান_লারা
________
পূর্ণতা অনেক চিন্তিত ছিল।সারথির এভাবে হুটহাট বেরিয়ে যাওয়া ভাল কিছুর লক্ষণ না।তার উপর সে অসুস্থ। ফারাজ দোতলায় এসে পূর্ণতাকে করিডোরে পায়চারি করতে দেখে জানতে চাইলো কি হয়েছে।
পূর্ণতা সারথির কথা বলে দেয় তখনই।ফারাজের তো মাথায় হাত।সে ওকে খুঁজতে ছুটতে গেলো ওমনি সামনে এসে দাঁড়ালেন দাদুরা।দুজনেই রাগান্বিত হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছেন ফারাজ পূর্ণতাকে।

‘দাদাজান আমার কথা শুনেন!’

‘তোমার কথা আপাতত শুনবোনা,এমন কি পূর্ণতার কথাও শুনবোনা’

পূর্ণতা এগিয়ে এসে বললো,’সারথি আপু বাসা থেকে গায়েব।আমাদের আগে সেটা দেখা উচিত’

‘চুপ করো মাইয়া!বহুত বাহানা দিছো।আজ এর শেষ দেখে ছাড়বো। এত করে বললাম তোমাদের একসাথে দেখলে বিয়ে পরিয়ে দিবো তাও ভয় না পেয়ে একের পর এক দেখা করেই যাচ্ছো।সমস্যা কি!!তার মানে তোমরা বিয়ে ভয় পাওনা।তোমাদের বিয়ে করিয়ে দিলে কিছু যায় আসবেনা সেটা ভেবেই তোমরা দেখা করতে লজ্জা পাও না।কারণ তোমরা তো জানোই, ধরা পড়লে পরিণতি হবে বিয়ে!’

ফারাজ দাদাজানের সামনে এসে বোঝানোর চেষ্টা করে বলে,’এখন এসব বাদ দিয়ে আমাদের সবাইকে মিলে সারথিকে খোঁজা উচিত দাদু।আমি সিরিয়াসলি বলতেছি’

‘চুপ করো তুমি।সারথির জামাই আসছে বিদেশ থেকে।ও গায়েব হবে কোন দুঃখে??সজীবকেও তো দেখলাম ওখানে।বাহানা দেয়ার বিষয় খুঁজে পাওনা তোমরা?এক্ষুনি বিয়ে পরাবো তোমাদের।আমার সাথে চলো সামনের মসজিদে’

‘আরে দাদাজান বোঝার চেষ্টা করেন প্লিজ’

দুই দাদা তাদের একজনের ও কথা শুনছেন না।ওদের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন নিচ তলায়। সেখানে সবাই সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল।দাদাজান ওদের দুজনকে টেনে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে জোর গলায় বললেন,’আজ ওদের বিয়ে হবে,সকলে প্রস্তুতি নাও’

সকলে দাদার কথা শুনে হা করে চেয়ে আছে আর ফারাজ কপাল চাপড়াচ্ছে।পূর্ণতা ভাবছে পালাবে।নাহলে আজ বিয়েটা হয়েই ছাড়বে।

দাদাজান সকলকে স্তম্ভিত হতে দেখে আবার বললেন সত্যি সত্যি প্রস্তুতি নিতে।সত্যিই আজ বিয়ে হবে ওদের দুজনের।
সেখানে মানিক সাহেব ও ছিলেন।ফারাজ পূর্ণতার বিয়ের কথা নিয়ে তিনি জানতেন না।তাই এ কথা শুনে অবজেকশান পেশ করলেন।বললেন,’আমার ছেলের বিয়ের কথা আমি জানিনা??’

দাদাজান তখন শান্ত স্বরে বলে দিলেন,’এখন তো জানলে!!’

‘জানলে মানে!!আমি তো কিছুু বলি নাই এখনও।এই বিয়ে কেন হবে?কি কারণে হবে?পূর্ণতার বাবা মা উপস্থিত আছে এখানে?তাদের অবগত না করে কিসের বিয়ে?বাবা কি ঠাট্টা করছেন?’

‘তুমি আমার অবাধ্য হতে পারো কিন্তু অরিন্দম কখনওই আমার অবাধ্য হবেনা।বরং সে খুশি হবে আমার নাতির সাথে ওর একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে শুনে।তাছাড়া আমি ওকে এসব বৃত্তান্ত লিখে চিঠিও পাঠিয়েছি’

‘ওদের কথা বাদ দিলাম,আমার মত নিয়েছেন??আমার ছেলে আর আমারই মত নেই??বড় ছেলে তো আমার অবাধ্য হয়ে একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছিল কিন্তু তাই বলে কি ছোট ছেলের বেলাতেও আমি তা হতে দিবো?ফারাজ তো প্রেম ও করছেনা তার মানে এটা এরেঞ্জড্।আর যেহেতু এরেঞ্জড্ সেটাতে ওর বাবা হিসেবে আমি মত দিতেই পারি,এবং আমার মত হলো এই বিয়ে হবেনা’

বেলায়েত হোসেন রেগে বললেন,’পূর্ণতাকে কি তোমার পছন্দ হয় নাই?এই যে সকাল সকাল না বলতেই মুখের সামনে চা পাও সেই চা কে বানায়??পূর্ণতা বানায়।একবারও জানতে চেয়েছো??এই যে দুপুরে তোমার গোসলের গরম পানির ব্যবস্থা হয়।কে করে?পূর্ণতা করে।জীবনে তোমার বউ এইসব করছে?সে তো অন্য সবার খেয়াল রাখতে গিয়ে তোমার খেয়ালই রাখেনা’

‘পূর্ণতা অবশ্যই ভাল একটা মেয়ে।সব দিক দিয়ে ঠিক আছে কিন্তু আমার ওর বংশ পছন্দ নয়।অরিন্দমকে আমি শুরু থেকেই পছন্দ করতাম না আর সেখানে ওর মেয়ের সাথে আমার আদরের ছেলের বিয়ে?’

‘ফারাজ তোমার আদরের ছেলে কবে হলো?ওরে দেখলেই তো তোমার ঝাঁটা পেটা দিতে ইচ্ছা করে, সেখানে আদরের ছেলে হয়ে গেলো আজ??’

মানিক সাহেব গাল ফুলিয়ে ফারাজের মুখের দিকে চেয়ে বললেন,’তুই রাজি বিয়েতে?’

‘আমি পূর্ণতা কেউই রাজিনা’

‘তাহলে বিয়েটা কেন হচ্ছে?’

‘বিয়ে তো বাচ্চারা মিলে দেয়না।বিয়ে গুরুজনরা মিলে দেয়।আর এই বাড়িতে এখন গুরুজন বলতে আমি এবং আজিজ আছি।বুঝেছো সকলে?আমাদের যেটা ভাল মনে হলো সেটাই করবো’
————
নদীর পাড়ে যেখানে সবুজ মাঝারি আকারের ঘাস সেখানে সারথি দাঁড়িয়ে আছে।বাতাসে তার আঁচল একবারও নিচে নামছেনা।বাতাসে উড়ছে কেবল।আনাফ নিজের পরনে থাকা জিন্সটা হাঁটু অবধি উঠিয়ে সারথির পাশে দাঁড়িয়ে আছে।সারথির শাড়ীর অর্ধেক ভিজে গেছে পানিতে।আনাফ সেটা দেখে বললো,’আপনার ভয় করেনা?এই পানিতে নির্ঘাত জোঁক,সাপ থাকতে পারে’

‘ওরা থাকলে কামড় দেবে,মরে তো যাব না।আর যদি হয় বিষাক্ত সাপ তবে কামড়াক।আমি চাই আমাকে দংশন করে মেরে ফেলুক’

‘শুনেন!আপনাকে সাপে কামড়ালে ঘুরেফিরে সেই আমাকেই ক্ষত জায়গা চুষে বিষ বের করতে হবে।নিজের ক্ষতি করছেন নাকি একচুয়ালি আমাকে খাটাচ্ছেন, আল্লাহ মালুম’

‘আপনাকে তো বলিনি আমাকে বাঁচান’

‘তো চোখের সামনে একজনকে মরে যেতে দেবো?’

সারথি আর কিছু বললোনা।
আরও এগিয়ে গেলো।আনাফ ওকে আটকে বললো,’পানি সামনে।আর কেন যাচ্ছেন?আমরা কিন্তু শহর ছেড়ে অনেক দূরে।ভিজে গেলে পরার মতন কিছু নেই হাতের কাছে।পরে আমার শার্ট পরে থাকতে হবে আপনাকে’

‘সজীবকে মনে করে বৃষ্টিতে ভিজেছি বহুবার।উনি আমাকে ভেজা অবস্থায় দেখে তোয়ালে এগিয়ে চলে যেতেন।’

‘আমি কিন্তু মোটেও আনরোমান্টিক না সজীবের মতন।আমি বউকে বৃষ্টিভেজা হালে দেখলে ঝাঁপটে ধরে রুমের দরজা বন্ধ করে দেবো’

‘দিয়েন’

সারথি এখন এতটা পানিতে নেমেছে যে ওর কোমড় অবধি পানিতে থইথই করছে।পায়ে নরম কাদা মাটি লাগছে এখন।যেন পা তলিয়ে যাচ্ছে কাদামাটির গভীরতায়।সারথি সাপ জোঁক অনেক ভয় পায়।হঠাৎ করে মনে হলো কাদা মাটির ভেতর থেকে যদি কোনো পোকামাকড় বের হয়?তার ভয় লেগে গেলো।এতক্ষণ একটা ঘোরের মাঝে ছিল।ঘোর কেটে যাওয়ায় ভয় এসে চেপে ধরেছে তাকে।
পা পিছোতেই পানির দোলের সাথে লেগে পড়ে যাচ্ছিল সারথি।আনাফ ওর পিঠের পেছনে হাত দিয়ে ওকে ধরে ফেলে বললো,’এখন ভয় পাচ্ছেন?’

‘কিছুটা’

‘আমি তো দেখছি পুরোটাই’

‘চলুন যাই’

আনাফ সারথির কথামতন ওকে ধরে পানি থেকে নিয়ে আসলো
দুজনে এবার কারের সাথে হেলান দিয়ে নদীর জোয়ারের বাতাস খাচ্ছে।
আনাফ নিজের জিন্স ঠিক করে পরে বললো,’আমি ভাবলাম জিন্স ঠিক করতে গিয়ে দু একটা জোঁক পাবো। পাইনি তার মানে হয়ত ঋতুর কারণে।
বর্ষাকাল হলে দেখতেন এখানে সবজায়গায় জোঁক দেখতে পেতেন।গায়ে তো লেগে থাকতো দুইশটার মতন। আমি সেবার বন্ধুদের নিয়ে বর্ষাকালে এই জায়গায় এসেছিলাম।আমার হাতে পায়ে এমনকি গালেও জোঁক উঠে গেছিলো।তার অবশ্য কারণ আছে।সেটা হলো আমরা পানিতে সাঁতরেছিলাম প্রায় এক ঘন্টার মতন।এরপর ঘাসে এসে একজন আরেকজনের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম।জোঁক তো পেয়ে গেলো মামার বাড়ির আবদার।একেবারে সবার গায়ে উঠে তারা রাজ্য বিস্তার করে ফেললো।

সারথি হাসলো এই কথা শুনে।আনাফ ওকে হাসাতে পেরে বললো,’জানেন?আমি আগে ভাবতাম আপনাকে হাসানো অনেক কঠিন। এরপর দেখলাম আসলেই তা নয়।অনেক ছোট কারণেও আপনি হাসেন।তবে সেই ছোট কারণ গুলা ইউনিক হতে হয়।’

সারথিকে সেই আগের মতন চুপ হয়ে থাকতে দেখে আনাফ আবার বলে,’আচ্ছা ডিভোর্স যখন হয়ে গেছে তখন সজীব এত দরদ কেন দেখাচ্ছে?মানে সে আসলে কি চায়?’

‘তিনি এখনও সই করেননি।জানিনা কি চান।আমি ওনার মনের ভেতরের খবর তো জানিনা’

‘গাছের ও খাবে,তলার ও কুড়াবে।বুঝলাম।আচ্ছা সে যদি সই করে তবে কি করবেন সেসময়? ‘

‘এখব যেটা করছি।উনি সই করবেন এটা নিশ্চিত বলেই তো আমি তার সাথে ফিরিনি’
———–
অরিন্দম কর্মকার হাবিজাবি বাড়ির গেটে এসে দাঁড়িয়ে আছেন।বেলায়েত হোসেনের চিঠিটা পাওয়া মাত্রই তিনি রওনা হয়েছিলেন।
গেইটটা সেই আগের মতনই আছে।মরিচা পড়ায় রঙটা কেমন যেন দেখতে।
মতিন বাগানে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে থাকা প্লাস্টিকের চেয়ারগুলো গুছিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাবার পথে দেখতে পেলো অরিন্দমকে।
চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা,পরনে ছাই রঙের শার্ট।হাতে একটা ব্যাগ ঝুলছে।তাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখে মতিন এগিয়ে এসে জানতে চাইলো উনি কাকে চান।

‘এই বাড়িতে কি বেলায়েত হোসেন থাকেন?’

‘হুম থাকেন।আপনি কে?’

‘পূর্ণতা আছে?’

‘হুম আছে।আহা বলবেন তো আপনি কে!’

‘আমি পূর্ণতার বাবা’

মতিন চোখ বড় করে এক দৌড় দিলো বাড়ির ভেতরের দিকে।অরিন্দম এখনও গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।ঐদিকে বাড়ির ভেতর চলছিল ফারাজ পূর্ণতার বিয়ে হবে নাকি হবেনা সেটা নিয়ে তর্কাতর্কি।
মতিন সবার মাঝে গিয়ে বলে দিলো পূর্ণতার বাবা এসেছেন।এই কথা শুনে পূর্ণতা সব রেখে দিলো ছুট।
বেলায়েত হোসেন খুশি হয়ে বললেন,’তাহলে আর কি!কনের বাবাও এসে গেছে।এবার আর কোনো সমস্যা হবার কথা না’
———-
পূর্ণতা ছুটে এসে বাবাকে দেখে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারেনি।দ্রুত তার কাছে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
অরিন্দম নিরবে কাঁদছিলেন।কিছু বলতে পারছিলেন না।পূর্ণতা তখন তার মায়ের কথা জানতে চাইলো।সেই কথা শুনেও অরিন্দম চুপ হয়ে আছেন দেখে পূর্ণতা এবার মাথা তুলে বললো,’মাকে ওখানে রেখে এসেছো?আনোনি কেন?মায়ের কি শরীর বেশি খারাপ?’

অরিন্দম পূর্ণতার চোখে চোখ রাখতে পারছেন না।মনে হয় কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছেন।
পূর্ণতা এবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়।চোখ মুছে আবার বলে,’কি হলো বাবা?কিছু বলছো না যে?’

‘তোর মা আর নেই পূর্ণা।এক সপ্তাহ আগেই!!!
আমি তোকে অনেক চিঠি দিছিলাম তোর মায়ের শরীর বেশি খারাপ হবার পর থেকে।জানিনা পাসনি কেন!সেসময় তোর মায়ের মৃতদেহ রেখে আমার এখানে আসাও সহজ ছিলনা তাই আমাকে একাই তোর মাকে কবর দিতে হয়েছে।’

বাবার কথা শুনে পূর্ণতা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে।তার নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছেনা।বাবা এসব কি বলছে!সে কি স্বপ্ন দেখছে না এর সবই সত্যি!
এটা হতে পারেনা!এটা মিথ্যে!!’

পেছন থেকে কথাগুলো বাড়ির সবাই শুনেছে।পূর্ণতার মাথা ঘুরে উঠলো। কোনো রকমে নিজেকে সামলে সে গেইটের দেয়াল ঘেঁষে নিচে বসে পড়ে।অরিন্দম ওর পিঠে হাত রেখে বললেন,’মা রে নিজেকে সামলে নে।আমার পক্ষে অসম্ভব এখন তোকে কোনো প্রকার সান্ত্বনা দেয়া।কারণ যাই বলবো কম হবে।’

পূর্ণতাকে কাঁদতে দেখে বাড়ির সবার মাঝ থেকে বিয়ের প্রসঙ্গ গায়েব হয়ে গেলো।
সবার মাঝে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।বেলায়েত হোসেন এগিয়ে এসে অরিন্দমের ঘাঁড়ে হাত রেখে চুপ করে রইলেন।ফারাজ এক দৃষ্টিতে পূর্ণতাকে দেখছিল।মা হারানোর কি বেদনা!!!
পূর্ণতা মাটিতে লুটিয়ে দেয়াল ঘেঁষে হাউমাউ করে কাঁদছে।শেষে মিসেস সোনালী এসে ওকে কাঁদতে মানা করলেন,কিন্তু পূর্ণতার যে মা মারা গেছে, সে কি করে কান্না থামাবে??

চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩৮
#আফনান_লারা
________
সারথি আনাফকে বলেছিল তার বাসায় চলতে।যেটাতে অধরা থাকে।
আনাফ তাই করছে।পথে সারথি ঘুমিয়ে পড়ে সিটেই।আনাফ ওকে দেখতে দেখতে ড্রাইভ করছিল।ভাবছিল সে পারবে সারথিকে একটা সুন্দর জীবন দিতে।চোখ অপারেশনের মাধ্যমে ঠিক করা যেতে পারে।এই কথা আজ কয়েকদিন ধরে ঘুরছিল আনাফের মাথায়।সারথির সাথে ওর বিয়ে হবার পর সে এটা নিয়ে লেগে পড়বে কাজে।

আনাফ যে পথ দিয়ে ওর বাসার দিকে যাচ্ছে ঐ পথটা একেবারে নির্জন।শর্টকাট বলে এটাতেই মোড় ঘুরিয়ে ঢুুকেছে আনাফ।চারপাশে বড় বড় গাছ আর মাঝে ফাঁকা রোড।
রাত হয়ে যাওয়ায় আলাদা একটা শব্দ ভাসছিল বাতাসে।যেন এই বুঝি বৃষ্টি হবে,অথচ এখন বৃষ্টির সময়ই না।সারথি হঠাৎ চোখ মেলেই শুনতে পেলো আনাফের হাসি।
আনাফ সেসময় হালকা আওয়াজে হাসতে হাসতে ড্রাইভ করছিল।সারথির করা একটা কাজ মনে পড়ায় হাসিটা এসেছিল মূলত।
তার মনের ভেতর চলছিল সারথিকে নিয়ে জল্পনাকল্পনা। সারথি ওকে এমন হাসতে শুনে জানতে চাইলো কি ব্যাপার।

আনাফ আচমকা সারথির গলা শুনে গাড়ী থামিয়ে ফেলেছে।এরপর ওর দিকে ফিরে বললো,’কই না তো। ‘

‘আমি মাত্র শুনলাম আপনি হাসছেন’

‘আমি তো সবসময় হাসিমুখে থাকি।এই আর নতুন কি’

‘না সেটা নয়।আপনি হাসছিলেন।সবসময়কার হাসি আর কোনো কারণে হাসা তফাৎ আছে”!

আনাফ বলতে চাইছেনা সে সারথিকে নিয়ে ভাবছিল।সারথি এদিকে জোর দিয়েই চলেছে।শেষে বাধ্য হয়ে সে বলে সারথির কথা ভাবছিল।
এই কথা শুনে সারথি লজ্জা পেয়ে গেছে।

আনাফ দুষ্টু হাসি দিয়ে গাড়ী আবার স্টার্ট করলো।মাঝে মাঝে সারথিকে নিয়ে গোপনে যে হাসি সে হাসে সেটা নিয়ে সারথি কিছুই জানেনা।হয়ত কখনও জানবেওনা।চোখের চিকিৎসা হয়ে গেলে বুঝি জানবে।
সেই দিনটিরই অপেক্ষা।আনাফ চায় সারথি ওর হাসি দেখুক।এরপর নিজেও হাসুক।মেয়েটিকে সে সারাজীবন হাসিয়ে রাখতে চায়।অনেক দুঃখ পেয়েছে। আর না’
————
পূর্ণতার হুশ নেই।যে জায়গায় ছিল ঐ জায়গাতেই বসে শুধু কেঁদে যাচ্ছে।এক এক করে সবাই ওকে সান্ত্বনা দিয়ে যে যার কাজে চলে গেছে।পূর্ণতার বাবাকেও নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেছেন দাদাজান।
পূর্ণতা একাই বাগানে বসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কাঁদছিল।ফারাজ যেতে চেয়েও পারেনি।মন বললো একবার ওর পাশে বসা উচিত।মা হারা কি কষ্টের যার হারায় সেই বোঝে।ফারাজের মায়া হলো পূর্ণার প্রতি,তাই সে এগিয়ে এসে ওর পাশে বসে।অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে হঠাৎ পূর্ণতার হাতটা চেপে ধরলো।পূর্ণতা তখনও কাঁদছিল।সে আসলে বুঝতে পারেনি কে তার হাত ধরেছে।
ফারাজ আরেকটা হাত পূর্ণতার মাথায় রেখে বললো,’আপনি না স্ট্রং একটা মেয়ে?তাহলে এভাবে কাঁদছেন কেন?’

পূর্ণতার হুশ আসলো ফারাজের কথায়।চট করে হাত ছাড়িয়ে রেগে বললো,’আপনি কি বুঝবেন!

‘বুঝতে হলে মা মরা হতে হবে?’

পূর্ণতা মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকলো।ফারাহ আবার বললো,’আপনি আপনার বাবার সাথে চলে যান।মায়ের কবর দেখবেন আর বাবার কাছে থাকবেন।এখানে ভাল থাকবেন না আপনি’

‘আপনি যাবেন এখন?আমার ভাল লাগছেনা কিছু।প্লিজ যান’

ফারাজ পূর্ণতার পাশেই বসে থাকলো।গেলোনা।
বাড়ির ভেতরে বেলায়েত হোসেন অরিন্দমকে পাঠানো চিঠি নিয়ে কথা বলছিলেন।তিনি আসলে অরিন্দমের মতামত জানতে চান।

অরিন্দম এই বিষয়ে পরে কথা বলবে বলে ঠিক করে।তাই বেলায়েত হোসেন ও আর জোরাজুরি করলেন না।কিন্তু মনে মনে আক্ষেপ রয়ে গেলো।
তিনি খুব করে চান পূর্ণতাই এই বাড়ির বউ হোক।
————-
সজীব বাইরে বের হওয়ার কথা বলে সারথিকে তন্নতন্ন করে খুঁজছে।কোথাও পাচ্ছেনা।চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে আছে সেই তখন থেকে।মেয়েটা কোথায় গেলো!কেমন আছে!!
ওকে খুঁজতেই হবে।নাহলে মা ঠিক বুঝে যাবে ওর সাথে ঝামেলা হয়েছে কিছু।
কোথা থেকে খুঁজবে সেটাও তো সমস্যা!!
———-
বাড়িতে যে সারথি নেই এই কথা ফারাজ পূর্ণতাকে বাইরে রেখে এসেই জানিয়ে দিয়েছে সবাইকে।প্রথমবার দাদাজান ওদের দুজনের এই কথা তেমন সিরিয়াসলি না নিলেও এখন সিরিয়াসলি নিলেন।সকলে মিলে পুরো বাসায় একবার করে খুঁজেছে ওকে।পরে দেখা গেলো আসলেই সে বাড়িতে নাই।এদিকে সজীব ও বেরিয়ে গেছে।বোঝা গেলো তাদের মাঝে কিছু হয়েছে।কিন্তু যেহেতু সজীব বের হয়েছে তার মানে ও সাথে নিয়েই আসবে তাই সবাই কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো।তবে ফারাজের মনে চিন্তা থেকেই গেছে।কারণ সজীব সারথির প্রতি কেয়ারলেস এটা সে খুব ভাল করে জানে।ওর উপর একটুও ভরসা নেই তার
———-
আনাফ সারথিকে নিয়ে তার বাসায় এসেছে।অধরা ঘুমায়।আনাফের কাছে বাসার যে বারতি চাবি ছিল সেটা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছে তারা।সারথিকে ওর রুম অবধি এগিয়ে দিয়ে সে বললো রাতে আর ডিস্টার্ব করবেনা।এই বলে চলে গেছে আনাফ।সারথি একা মনে বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছিল নিরবে।
ওদিকে আনাফ ফ্রেশ হয়ে বের হতেই মায়ের কল আসে তার ফোনে।মা ভীষণ ক্ষেপে আছেন ওর উপর।শুরুতেই জানতে চাইলেন আনাফ আজ দুপুরে হাসপাতাল যায়নি কেন।

‘তুমি কি করে জানলে?’

‘আমি তোর নাম্বারে কল যাচ্ছেনা বলে হাসপাতালে কল করেছিলাম।সুরাইয়া জানালো তুই আসিসনি’

‘হ্যাঁ,বাইরে একটা কাজ ছিল।’

‘তো এখন রাত কটা বাজে?আসবিনা?’

‘না আমি অধরার কাছে এসেছি।আজ এখানেই থাকবো, তুমি খেয়ে নাও’

‘আগে বললেই হতো।অধরা কেমন আছে?’

‘ঘুমায়’

‘আচ্ছা যা রাখছি’

ফোন রাখার পর আনাফের মাথায় আসলো সারথি তো কিছু খায়নি।
তাই সে পা টিপে টিপে ওর রুমের কাছে এসে দেখলো সারথি বসে আছে চুপচাপ।এখনও ঘুমায়নি।ঘুমাবে কি করে সে তো না খেয়ে আছে।
কোমরে হাত দিয়ে আনাফ তাই রান্নাঘরে এসে হাজির।রান্না বলতে সে শুধু সেমাই বানাতে পারে এর বাইরে কিছুই পারেনা।কিন্তু এখন সারথির জন্য তো কিছু বানাতে হবে।
ফ্রিজে পানি দেওয়া ভাত পেলো।তরকারি নেই।এগুলো তো সারথিকে দেয়া যাবেনা।মাথা চুলকে পাউরুটির প্যাকেট আর দুটো ডিম বের করলো সে।ডিম দিয়ে পাউরুটি ভেজে সারথিকে দিবে খাওয়ার জন্য।এটা মা অনেকবার বানিয়ে খাওয়াতো ওকে।কিন্তু সমস্যা হলো সে রেসিপি জানেনা।সারথির কাছে জানতে চাইবে কিনা।চাইলে হয়ত সে মানা করবে না বানানোর জন্য।
অনেক ভেবেচিন্তে ফোন বের করে ইউটিউব দেখেই বানাতে নামলো আনাফ।
অনেক কষ্টে দীর্ঘ এক ঘন্টা যুদ্ধ করে সে বানাতে পেরেছে।এরপর প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে গেলো সারথির সামনে।দরজায় নক করে সারথির সামনে এনে রাখে আনাফ।
সারথি গন্ধ পেয়ে বললো,’আপনি বুঝি ডিম দিয়ে পাউরুটি ভেজে এনেছেন?’

‘হুম’

‘কেনো?’

‘রাতে কিছু খাওয়া হয়নি তো আপনার। খেয়ে নিন।আমি ঘুমাই’

‘আপনি খাবেননা?’

‘তেল জাতীয় খাবার কম খাই আমি।বডি ধরে রাখতে হবে তো।নাহলে বিয়ের আগেই মানুষ আঙ্কেল ডাকা শুরু করবে’

‘বয়স কত আপনার?’

‘জানার দরকার নাই।নতুন ডাক্তারদের বয়স কত আন্দাজ করেন।তবে এটা বলতে পারি আপনার থেকে অনেক বড় আমি’

সারথি কিছু না বলে প্লেটে হাত বাড়িয়ে একটা পাউরুটি নিয়ে মুখে দিয়ে বললো,’চিনি বেশি’

‘ভিডিওর আন্টিটা তো তিন চামচ দিছিলো।আমি দিছি হাফ চামচ।তাও মিষ্টি হইছে?’
——
সারথির ঠোঁটের কাছে ডিম লেগে ছিল।আনাফ অনেকক্ষণ ধরে দেখছিল সেটা সরে কিনা।কিন্তু কিছুতেই সেটা নড়ছিল না।এরপর সে নিজেই সারথিকে বললো ঠোঁটের কাছে খাবার আটকে আছে।
সারথি হাত দিয়ে মুছলো, তাও গেলোনা সেটা।আনাফ তাই নিজেই হাত দিয়ে মুছিয়ে দেয়।ওমনি সারথি একটু নড়েচড়ে বসেছে।
আনাফ তখন আবারও হাসলো।সেই গোপন হাসি।তার হাসির কারণ হলো সারথি ভেবেছে এখন আনাফ তার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলতে পারে।সেই ভয়ে সারথি পিছিয়েছে।

আনাফ চুপ করে আছে দেখে সারথি বললো,’ফারাজকে একবার কল করে বলে দিন আমি এখানে আছি।’

‘আচ্ছা।আর কিছু?’

‘নাহ’

আনাফ পানির বোতল এনে রেখে নিজের রুমে চলে এসেছে এবার।কাল থেকে একটা মেয়ে মেসেজ করে অনেক জ্বালাচ্ছে।মেয়েটার আইডি দেখে ফেক মনে হয় আনাফের,তাই ব্লক করে দিয়েছিল কিন্তু সে আবার একই নাম দিয়ে আইডি খুলে আনাফকে মেসেজ করেই যাচ্ছে।তার চাহিদা হলো সে আনাফের সাথে কথা বলতে চায়।আনাফ ফেসবুকে ঢুকতেই সেই মেয়ের হাজারটা মেসেজ,কমেন্টের ভীড় জমে গেলো।বিরক্ত হয়ে আনাফ এবার এই আইডিটাও ব্লক করে ফোনে গান চালু দিয়ে শুয়ে পড়েছে বিছানায়।
—–
সারথি বিছানায় শুয়ে ভাবছে সজীব ওকে খুঁজছে নাকি আনন্দে আছে ও নেই বলে।
কিছু কিছু মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়!!তারা কি করে মোহত্যাগ করতে পারে এত জলদি?অন্য নারীর কি এতই ক্ষমতা যে স্ত্রীর জায়গা দখলে নিতে পারে তারা!!

যতবার সজীবের কথা সারথি ভাবে ততবার তার মুখ ভিজে যায় অশ্রুতে।এর কি শেষ নেই?কবে সে এই ব্যাথা থেকে মুক্তি পাবে।আর কতদিন সজীবের জন্য তার বুক পুড়বে!!
———
‘তোমার বোন আমার কাছে আছে ফারাজ।চিন্তা করোনা’

আনাফকে সারথির খেয়াল রাখতে বলে ফারাজ ফোন রেখে সামনে তাকালো।সবাই ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে সারথির কোনো খবর আছে কিনা জানার জন্য। ফারাজ তখন কথা ঘুরিয়ে বলে দিলো সারথি তার একটা বান্ধুবীর বাসায় আছে।কেউ যেন চিন্তা না করে।
সবাই এবার বাকি নিশ্চিত হয়ে যে যার কাজে চলে গেছে। ফারাজ তখন বাইরে এসে দেখে পূর্ণতা এখনও আগের জায়গায় বসে চোখ মুছছে।

‘আপনি কি সারারাত এখানেই থাকবেন?’

‘আপনার কি?’

‘আমার প্রতি কথায় এত তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠার কারণ কি?’

‘আমি কান্না করার সময় চোখের সামনে কিছু সহ্য করতে পারিনা।আপনি সরবেন নাকি মার খাবেন?’

‘উরি বাবা!আপনি মারতেও পারেন?

কথাটা শেষ হতে না হতেই পূর্ণতা বাগানের ঝুলন্ত টব একটা খুলে ফারাজের কপাল বরাবর মেরে তারপর ক্ষান্ত হলো।
ফারাজ কপালে হাত দিয়ে বললো,’আপনি তো মহা সাংগাতিক একটা মেয়ে! কপাল ফাটিয়েই দিলেন আমার।ভালই ভালই আপনাকে নিয়ে যেতে এলাম’

‘এত দরদ কেন দেখাচ্ছেন?বাকিরা মিলে বিয়ে পরিয়ে দিবে সেটা জানেন?’

‘এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। আমি আপনি একসাথে ঘুরতে গেলেও কেউ বিষয়টা সিরিয়াসলি নিবেনা।বিয়ে আগামী এক মাসেও হবেনা মিলিয়ে নিয়েন’

ওমনি ভেতর থেকে আজিজ খানের ডাক শোনা গেলো। তিনি ফারাজ পূর্ণতাকে একসাথে ডাকছেন।

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here