#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২
আমি কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে উনি যা বলে উঠলেন তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। শান্ত শীতল মনে কথাগুলো শুনে ক্রমশেই আবেগের তুমুল বর্ষণ নেমে আসলো। সে বর্ষণে শিলা নুড়ির মতো কিছু একটা বুকের বা পাশটায় বারবার হানা দিচ্ছিল। হার্টবিট একটু দ্রূত গতিতে উঠানামা করছিল। শুনেছি মেডিকেল সায়েন্সে হুট করে দ্রূত গতিতে হার্টবিট বেড়ে যাওয়াকে পালপিটিশন বলে। আবার সিরিয়াল গুলোতে এ উঠানামার ব্যপারটা বেশ ফোকাস করে ভেঙে ভেঙে পর্যবেক্ষণ করে দেখানো হয়। আপাতত সেসব ভাবনায় মনোযোগ না দিয়ে উনার কথায় মনোযোগ দিলাম।
– আপনি কি সে মেয়েটা যে আজকে দুপুরে আমার চেম্বারে এসেছিলেন! নীল বর্ণী চোখের কাজল কালো রেখার টান দেওয়া। সে রেখার শেষ কোণে নদীর বাঁক নিয়েছে ঢেউয়ের বিস্তরণ ঘটিয়ে। চুল গুলো অবাধে বড় হয়ে হাঁটু পার করেছে। সামনের কিছু চুল যেন বাতাসের শিহরণে মুক্ত আকাশে ডানা মেলেছিল। ফর্সা রোগা পাতলা।কালো সাদা বর্ণের একটা জামা পরে ছিলেন। কপালের এক পাশে কাটা দাগ ছিল, হয়তো ছোট বেলায় পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছেন। কানের পাশে উঁচু হয়ে একটা ব্রণ হয়ে লাল হয়ে আছে। কথার পৃষ্ঠে কথা বলে যাচ্ছিলেন।
ব্রনের কথাটা বলতেই আমি হাত দিলাম কানের পাশে। সত্যিই তো একটা ব্রণ হয়ে উঁচু বিস্তার লাভ করেছে। অনেকটা নেতানো লাউয়ের ডগায় শাখা বিস্তার করে একটু উঁচু বাঁক নেওয়ার মতো। ডাক্তার মহাশয় আমাকে এত লক্ষ্য করেছেন সেটা সত্যিই ধারণার বাইরে ছিল আমার। মনে হচ্ছিল কল্পিত কোনো রাজ কুমার আমার রুপের বর্ণণা দিয়েছে। সৌন্দর্য না থাকা সত্ত্বেও যেন সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে বহুগুণে। তার উপর উনার কথাগুলো অনেকটা বাংলা সাহিত্যের কবির মতো মনে হচ্ছিল। ভেতরে ভতরে আনন্দের ফিনিক বেড়ে যাচ্ছিল। এত আবেগের বিস্ফোরণ কেন হচ্ছে! বুকটা কেন কথাগুলো শুনে ধুকধুক করছে। কেনই বা নিঃশ্বাস দীর্ঘ হচ্ছে অযথায়। নিজেকে সামলানো দরকার। সমস্ত চেষ্টা শক্তির উত্তাল সমাবেশে নিজেকে সামলে নিলাম। কিন্তু তাহাকে তো বুঝানো যাবে না এটা আমি। তাই কিছুটা তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠলাম
– আপনি থামুন! আমি সিঁথি না। আমি ওর বান্ধবী মিহু। আপনার সাথে আমার একটু গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল তাই সে নম্বরটা নিয়ে সাহায্য করেছিল। আপনি এতক্ষণ যার বর্ণনা দিয়েছেন সে তো সিঁথি।
নিজের পরিচয়টা মূলত গোপন করেছিলাম ডাক্তার মহাশয়ের নিকট থেকে আমার প্রতি জমে থাকা আবেগের বিস্ফোরণ জানতে। তিনি এবার গলাটা নরম করে ফেললেন। হয়তো তার মুখটা লজ্জা মাখা হয়ে লাল হয়ে আছে অথবা মুখ অবয়বে ইতস্ততা ফুটে উঠেছে। কন্ঠটা বেশ নম্র করে বললেন
– দুঃখিত আমি বুঝতে পারিনি৷ সে তো নম্বর নিয়েছিল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়েছিল আমাকে কল দিবে। আমিও মনে মনে অপেক্ষা করছিলাম সে যেন কল দেয়। আপনার কন্ঠটাও সিঁথির মতোই। তাই গুলিয়ে ফেলেছিলাম। বলুন কী বলবেন।
– আমার সাথে প্রেম করতে হবে একমাস।
তিনি বেশ জোরেসোরেই জবাব দিলেন
– মানে?
– মানে খুব সোজা। আমার সাথে একমাস প্রেম করবেন। শুধু আমার বান্ধুমহলের সামনে বুঝাবেন আমরা প্রেম করছি। আপনি আমাকে পছন্দ করেন।
– আপনার কি মাথার তার ছুটে গেছে। কল দিয়ে কী সব আজেবাজে কথা বলছেন।
– আরে শুনোন।
– আপনার কোনো কথায় আমি শুনব না। ফোন রাখুন, আর বিরক্ত করবেন না। আপনার ফ্রেন্ড সিঁথি যে বিনা অনুমতিতে আপনাকে আমার নম্বরটা দিবে বুঝতে পারিনি। ভারি বেয়াদবি করেছে সে।
আমার সামনেই আমাকে বেয়াদব বলা হচ্ছে! রেগে গেলাম বেশ। রাগটা চটে যেতেই বলে উঠলাম
– আমি বেয়াদবি করেছি ভালো করেছি। ঠিকেই তো আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আমার সব পর্যবেক্ষণ করেছেন। মেয়েদের দিকে এভাবে তাকাতে লজ্জা লাগে না!
অপর পাশ থেকে একটা হাসির শব্দ আসলো। মৃদু কন্ঠে উচ্চারিত হলো কয়েকটি শব্দ।
– সিঁথি একটু ঠান্ডা হন।
আমি এবার চুপ হয়ে বোকা বনে গেলাম। নিজের পরিচয়টা কত অবলীলায় দিয়ে দিলাম। হালকা গলায় বললাম
– আপনিই তো রাগালেন।
– আমি রাগায়নি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম এটা আপনি। তাই এমনটা বলেছি। বয়সে বেশ ছোট আপনি। কীভাবে কথা বললে আপনার মুখ থেকে সত্যি বের হবে সেটা আমি জানি। আর ড্যাব ড্যাব করে তাকায়নি আঁড়চোখে তাকিয়েছি। কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া ঠিক না। রেগীকে দেখতে হলে তার সবকিছু ভালো করে দেখতে হয়।
আমার বুকের ভেতরে উত্তাল সাগরের ঝড় বইতে লাগল। মনে হচ্ছে ঢেউগুলো জলোচ্ছ্বাসের ন্যায় আঁচড়ে পড়ছে। এমন তো কখনও হয়নি। আমি উনার কথায় বিরক্ত কেন হচ্ছি না। নীরব থেকে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। মনের অজান্তেই বলে ফেললাম
– প্রেম করবেন এক মাস? বাজি ধরেছি। বলেছিলাম হাসপাতালের যেকোনো ডাক্তারকে পটিয়ে এক মাস প্রেম করব। বিনিময়ে আমার হাতে এক হাজার টাকা আসবে। টাকাটা মূখ্য বিষয় না। আমি কখনও বাজিতে হারিনি। আমাকে জিততে হবে। ফেক প্রেম করলেও হবে। জি এফ থাকলে করার দরকার নেই। বউ থাকলেও দরকার নাই। সিনগেল থাকলে একটু সাহায্য করুন। অভিনয় করলেই হবে। আচ্ছা আপনি সিনগেল তো!
জড়তা কন্ঠে বলে উঠল
– হুম সিনগেল। প্রেম করব সমস্যা নেই তবে ফেক প্রেম করতে গিয়ে যদি সত্যি সত্যি প্রেমে পড়ে যাই তাহলে কী করবেন?
– পরে সেসব ভাবা যাবে। কালকে থেকে প্রেম স্টার্ট।
তিনি সশব্দে উচ্চ হাসি দিলেন। আমিও হালকা হেসে বললাম
– সকাল ছয়টায় হাঁটতে বের হব। রাস্তার দিকে আসবেন। একসাথে হাঁটব। আগে পিছে হাঁটব কারণ মানুষ দেখলে দূর্নাম রটাবে।
– ওকে ঠিক আছে। আপনি যা বলেন।
– আপনি আমাকে এখন থেকে তুমি বলবেন। আর আমিও তুমি বলব। তুমি হচ্ছে প্রেমের প্রথম স্টেপ।
সশব্দে আরেকটা হাসি ভেসে আসলো ওপাশ থেকে। বেশ কিছুক্ষণ হেসে জবাব দিল
– তুমি বড্ড পাগলাটে স্বভাবের।
– হুহ! বললেই হলো। আচ্ছা তোমায় আমি কী বলে ডাকব? তোমার নমাটায় আমি জানি না। প্রেসক্রিপশনে তোমার সিগনেচার এত হজবরল যে বুঝতেই পারিনি নামটা কী। ডাক্তারদের লেখা সত্যিই অনেক খারাপ।
বিপরীত পাশ থেকে আরও উচ্চ সুরে হাসির শব্দ কানে আসলো। কারও কর্কশ হাসির শব্দও যে কোনো কোনো সময় মধুর মনে হয় সেটা এখন বুঝতে পারছি। হাসির শব্দটার প্রখরতা বেশিক্ষণ বিস্তার লাভ করেনি৷ মনে হচ্ছিল বিস্তার লাভের মাঝপথে এসে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থেমে গেছে৷ চুপসানো মসৃন গলায় উত্তর আসলো ওপাশ থেকে।
– আমার নাম অনিল। তুমি আমাকে অনি বা নীল বলেও ডাকতে পারো। অথবা পুরো নাম ধরেও ডাকতে পারো। তোমার যা ইচ্ছা।
চোখ মুখে আমার লজ্জার ছাপ প্রকাশিত হলো। শুনেছি লজ্জা পেলে নাকি মেয়েদের চোখ মুখ লাল হয়ে যায় আমারও কী তাই হয়েছে! আয়নাতে নিজের মুখটা দেখার ভীষণ ইচ্ছা হওয়া সত্ত্বেও দমিয়ে নিলাম। হালকা লজ্জা কন্ঠে বলে উঠলাম
– নীল বলেই ডাকব। তবে বয়সে তো আপনি বেশ বড়। গুণে গুণে ১২ বছরের বড়। এত বড় ছেলেকে নাম ধরে ডাকাটা দুঃসাহস হয়ে যায়।
ওপাশ থেকে আবারও চাপা হাসির লিরিক কানে আসলো। ক্ষণে ক্ষণে এ হাসি আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। এ হাসিটা বড্ড মধুর। খনিকের পরিচয়টা কেন জানি না মনে হচ্ছে সহস্র বছরের পরিচয়। মনেই হচ্ছে না আমি উনাকে আজকে চিনেছি। মনে হচ্ছে যুগ যুগান্তর আর সহস্র বছরের অভিস্রোতে দুজন ভাসছি। নিয়ম করে যেন তার সাথে আমার এর আগেও কথা হয়েছে, এমনটায় অনুভূত হচ্ছে। ভাবনায় ছেদ পড়ে তার মোহনীয় কন্ঠ সুরের দাবানলে।
– একটা ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে মাস্তানি করে চলে আসো। প্রেম করার জন্য রোগী সেজে নম্বর আনতে পারো। তখন কিছু মনে হলো না আর নাম ধরে ডাকাতে দুঃসাহস মনে হচ্ছে! কী যে বলো তুমি। মশকরা করতেছো মনে হয়।
– হুহ! নেহাত বাজি ধরেছিলাম তাই। নাহয় কী আর এমন করতাম? তবে ভালোই হলো তোমার সাথে পরিচয় হয়ে। মাঝে মাঝে কথা বলে তো সময় পার করতে পারব। তুমি ব্যস্ত থাকো নাকি?
– আপাতত বেশ ফ্রি। চেম্বার নাই। এখানে নতুন এসেছি একমাস হয়েছে। আগামি মাস থেকে চেম্বারে বসা শুরু করব।
– তাহলে তো ফ্রি। আড্ডা দেওয়া যাবে। যাইহোক ঘুম পাচ্ছে সকাল ছয়টায় চলে আসবে বাসার সামনে।
– বাসা তো চিনি না সিঁথি রাণী।
– হাসপাতালের মোরেই দাঁড়িয়ে থাকবে আমি এসে নিয়ে যাব। আগেই বলে রাখছি আমি সামনে হাঁটব আর তুমি পেছনে।
– ঠিক আছে ঘুমাও। আমার আজকে ইমারজেন্সি আছে। একটু ওয়ার্ডে রাউন্ড দিয়ে আসি। ভালো থেকো।
– হুম তুমিও।
বলেই কলটা কাটলাম। এমন সময় মেসেজ আসলো। মেসেজটা ওপেন করে দেখলাম আগের মেসেজের রিপ্লাই মাত্র করেছে।
“মেসেজটা মাত্র খেয়াল করলাম। হ্যাঁ ভুল বলেছো কারণ আমি কিউট না। এজন্য তোমাকে পানিশমেন্ট দিতে হবে। মিসবিহেব হলে সরি।”
মেসেজটা পাওয়ার পর বিভোর ঝড়ের উত্তাল হাওয়া মনে বইতে লাগল। ভালোলাগার প্রবল ঢেউ গুলো বুকের পৃষ্ঠে যেন বিরতি নিয়ে নিয়ে আঁচড়ে পড়ছিল।
কানে যেন তার মধুর সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। বারবার তাকে সামনে দেখার প্রয়াস জাগতে শুরু করছিল। ভেতরে যেন তার প্রতি অনুভূতির আওয়াজ গুলো মুহুমুহু সুরে গুন্জণ তুলছিল। বারবার মনে হচ্ছিল আরেকবার কল দিই। আরেকবার নাহয় কথা বলি। বয়সে বড় একজন মানুষের প্রতি এত অনুভূতি কাজ করছে কেন! কেনই বা তার কন্ঠ শোনার জন্য মন এত উতলা হয়ে যাচ্ছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময় দেখলাম, বেশি না ১০ মিনিট পার হয়েছে সবে। কিন্তু মনে হচ্ছে কত যুগ আগে কলটা কেটেছি। এত ছটফটেই বা কেন করছি! কেনই বা এত মায়া জমে উঠছে বুকের কোণে,মনের অন্তরালে। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। পুনরায় কল দিলাম। কল দিয়েও কেটে দিলাম। সাহস হচ্ছিল না। আমার মতো মাফিয়া মেয়ের সাহস কী না এ বয়স্ক বুড়োর কাছে হার মানছে। নিজেকে নতুন ভাবে চিনতে পারছিলাম। ঠিক এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। ভেবেছিলাম সে কিন্তু..
(কপি করা নিষেধ)