#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৪৯ (১ম অংশ)
(নোট- সবাই কমেন্ট করবেন প্লিজ। কারণ পেইজের রিচ ডাউন হয়ে গেছে হুট করে।)
সিঁথি দুটানা ভেঙে জমে থাকা পাথরটাকে একটু হালকা করতে রুবাইয়াকে বলা শুরু করল।
– আমি রেইপ কেইসের মামলায় ফেঁসে গেছি। কোনোভাবেই প্রমাণ করতে পারছি না যে এ কাজ আমি করিনি। আর আমি নিজেও সে সময় নিজের সেন্সে ছিলাম না। কী থেকে কী হয়েছে আমি জানি না।
নীলের মুখে কথাটা শোনার পর পরই আমার মনে হচ্ছিল আমি বেঁচে নেই। এত কষ্ট হচ্ছিল যে নিজেকে সামলানোর মতো প্রয়াস খুঁজে পাচ্ছিলাম না। খুনের মামলা হলেও হয়তো মেনে নিতে পারতাম তবে রেইপের মামলা কেন জানি না মেনে নিতে পারতেছিলাম না। তার উপর নীলের কনফিউশান দেখে মনে হচ্ছে সে রেইপ করেছে কী না সঠিক বলতে পারছে না। করতেও পারে আবার না। আমার চোখ দিয়ে তখন গড়গড়িয়ে পানি পড়ছিল। শরীরটা ক্রমশেই কাঁপছে। আমি কোনো উত্তর দিলাম না। চুপ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। নীল পরপরই বলল
– তোমার জন্য ব্লাড আনতে গিয়েছিলাম এক ডোনারের কাছে। ব্লাড আনার পর অফিস থেকে একটা জরুরি কল আসে ডিউটিতে জয়েন করার জন্য। আমি রুবুকে এক নজর দেখে ব্লাডটা দিয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে রওনা দিই। অফিসে যাওয়ার পর অনেকগুলো কাজ হাতে ধরিয়ে দিল। অন্যের অধীনে চাকুরি সেগুলো তো না করে ফেলে আসা যায় না। এদিকে তোমার অবস্থাও খারাপ। তোমার জ্ঞান ফিরছিল আবার চলে যাচ্ছিল। সব মিলিয়ে চিন্তা আমাকে ক্রমশ গ্রাস করতে লাগল। তবুও পেটের জন্য চাকুরি বাঁচাতে হবে। সে জন্য তোমার চিন্তা বাদ দিয়ে কাজে মনোযোগ দিলাম। এমন সময় রবিন আসলো আমার চেম্বারে। আমার দিকে তাকিয়ে বেশ মোলায়েম গলায় বলল
– অনীল সাহেব এত কাজের প্রেসার এ সময় নিচ্ছেন।
– বইলেন না ভাই কয়েকদিন অফিস কামাই করেছি তো সব কাজ একসাথে পড়েছে। আমার স্ত্রী এর অবস্থাও এত ভালো না তবে চাকুরির জন্য হলেও কাজ করতে হবে। ডাক্তারদের জীবনেই তো এটা।
– তা যা বলেছেন ভাই। তা আপনার মেয়ে হয়েছে নাকি ছেলে?
– মেয়ে হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। মেয়েটা একদম তার মায়ের মতো হয়েছে। আমিও চেয়েছিলাম মেয়েটা মায়ের মতো সুন্দরী হোক।
– যাক মশআল্লাহ। তবে এত প্রেসার নিতে হবে না আপনার। আমি নাহয় আপনার কিছু কাজ করে সাহায্য করলাম। বিপদে পাশে থাকতে সমস্যা নেই। আপনার বাসার সবাই কী চলে এসেছে?
– সবাই ঢাকায় আছে আপনার ভাবির কাছে। ওদের আসতে সময় লাগবে৷
– তাহলে একটা কাজ করুন আমার বাসায় চলে আইসেন, একসাথে আড্ডাও দেওয়া হবে কাজও করা হবে। আপনারও খাওয়া দাওয়া নিয়ে টেনশন করতে হবে না। আমি তো ব্যাচেলর মানুষ পুরো বাসায় একা থাকি। থাকার সমস্যা হবে না আশাকরি।
আমি মুচকি হেসে থাকার জন্য সম্মতি জানালাম। কারণ এদিকে যতদ্রুত কাজটা আমি সেড়ে ফেলতে পারব ঐদিকে তত দ্রূত তোমার কাছে যেতে পারব। সারাদিন হাসপাতালে বেশ ভালোই রোগীর চাপ সামলিয়েছি। তোমার অবস্থা তখন তেমন ভালো না। মিহুর কাছ থেকে বারকয়েক তোমার খোঁজ নিলাম। কাজের চাপে খোঁজ নেওয়ার পরিমাণ কম থাকলেও মন পড়ে ছিল তোমার কাছেই।
সারাদিনের কাজ শেষ করে রাতে রবিনের বাসায় যাই। সেখানে গিয়ে লক্ষ্য করলাম শোভন ও আছে। আমি শোভনের সাথে মোটেও এত ফ্রি না। শোভনের কিছু বিষয় আমার ভালো লাগত না বিধায় ওকে একটু এড়িয়ে চলতাম। তবুও ওর সাথে কুশল বিনিময় করে একসাথে বসলাম আড্ডা দিতে। আড্ডা দেওয়ার এক পর্যায়ে শোভন মদের বোতল বের করল। রাত তখন রাত ১২ টা ছুঁইছুঁই। আমি কিছুটা ইতস্তত হয়ে বললাম
– আমি তাহলে উঠি। আপনারা খান। আমার এসব সহ্য হবে না। আমার দৌঁড় সিগারেট পর্যন্ত । এটা হজম করা সম্ভব না। তার উপর বউ বাচ্চা দুজনেই অসুস্থ। এর মধ্যে এটা খেলে আমার আরও সইবে না। আমি উঠলাম তাহলে।
রবিন আমার হাতটা ধরে বলল
– আরে বসেন তো। একটু খেলে কিছুই হবে না। বাচ্চার বাবা হয়েছেন সে খুশিতেও তো একটু খেতে পারেন। বেশি খাওয়ার জন্য জোর করব না নিশ্চিত থাকুন। আর না খেলে না খাবেন। বসে বসে আড্ডা দিতে তো সমস্যা নাই। আপনি সিগারেট খেলেন আর আমরা মদ।
এমন ভাবে ধরল সেখান থেকে উঠে আসার সুযোগ হলো না। অবশেষে বসে মুড়ি মাখা খাচ্ছিলাম আর সিগারেট আর তারা মদ। এক পর্যায়ে আমার কী যে হলো জানি না মনের মধ্যে অদ্ভুত চাওয়ার মতো মদ খাওয়ার চাওয়াটা উদয় হলো। আমি নিজেকে তেমন সামলাতে পারলাম না। মনে হলো একটু টেস্ট করে দেখি। আমি গ্লাসে একটু মদ নিয়ে নাক চেপে খেয়ে ফেললাম। সাথে সাথে আমাকে নেশায় পেয়ে বসলো। অল্পতে আর তুষ্টি মিলল না আরও খেলাম। এবার আমার নেশা ভালোই হলো। নেশায় গুঙরাতে লাগলাম।
রাত তখন আড়াইটা। দরজায় জোরে ডাক পড়ছে। বুঝতে পারছিলাম না এত রাতে কে ডাকছে। ইমারজেন্সি থেকে আমাদের কারও কল আসার কথা না কারণ রাতের ইমারজেন্সি ডিউটিতে আজকে মুক্তা আছে। শোভন নিজেকে গুছিয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই এক রমণী ঘরে প্রবেশ করল। প্রচন্ড পেট ব্যথায় কাঁতরাতে লাগল। আমি নেশায় তলিয়ে পড়লেও শোভন আর রবিনের নেশা তেমন ধরেনি। তারা নিজের মধ্যেই ছিল। সুতরাং শোভন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল
– কী সমস্যা?
এর মধ্যেই মেয়েটার সাথে ১৪ বছরের এক বাচ্চা প্রবেশ করল। বাচ্চাটা মেয়েটার ভাই। বাচ্চাটা কান্না গলায় বলল
– আপুর পেটে অনেক ব্যথা। হাসপাতালে কেউ নেই তাই এখানে আসলাম দেখানোর জন্য।
রবিন ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল
– তোমার নাম কী?
– অপু।
– শোনো অপু তোমার বোনের কিছু হবে না। বাসায় কে কে আছে তোমার?
– মা আছে শুধু। বাবা মারা গেছে অনেক আগে।
– আচ্ছা তুমি বসো আমরা তোমার বোনকে দেখছি কী হয়েছে।
তখনও আমি বুঝতেছিলাম না তাদের মধ্যে কী চলছে। ঘর থেকে শুধু কথোপকথন শুনছিলাম। অপুকে বাইরে রেখে মেয়েটাকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করল চিকিৎসার জন্য। এর কিছুক্ষণ পর মেয়েটার একটা হালকা চিৎকার পেলাম। সাথে সাথে আমার মনে অজানা ভয়ের আশঙ্কা তৈরী হলো। আমি ভয়ে চুপসে গেলাম। নেশার ঘোর ততক্ষণে অর্ধেক কেটে গেছে। আমি রুম থেকে বের হয়ে পাশের রুমে গেলাম। সেখানে গিয়ে আমার চোখ কপালে উঠল। গায়ের লোম শিউরে উঠল। মেয়েটা নগ্ন অবস্থায় কাঁতরাচ্ছে আর রবিন শোভন দুজনও নগ্ন। বুঝতে আর বাকি রইল না তারা মেয়েটাকে নেশার ঘোরে পরে রেইপ করেছে। আমি তাদের ছুটানোর জন্য গেলে তারা আমায় জোরে ধাক্কা দেয়। যেহেতু আমি নেশার ঘোরে ছিলাম ধাক্কা সামলাতে না পেরে আমি দূরে ছিটকে পড়ে জ্ঞান হারাই। পরদিন মেয়েটার ভাই মেয়েটাকে নিয়ে অন্য হাসপাতালে ভর্তি করায় আর আমাদের তিনজনের নামে রেইপ কেসের মামলা ঠুকে। আমি কোনো দোষ করিনি কিন্তু আমি চিন্তায় ছিলাম কী করব। মেয়েটার অবস্থা খারাপ হওয়ায় রবিন আর শোভন পালিয়ে যায়। আমি পড়ি বিপাকে। তাই বুঝতে না পেরে আমিও পালালাম। শুধু অপেক্ষা করছিলাম মেয়েটা একটু সুস্থ হোক। কারণ অন্তত মেয়েটা জানে আমি কিছু করিনি। মেয়েটা সাক্ষী দিলে আমি নির্দোষ প্রমাণ হব। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েটার সুস্থতায় কামনা করছিলাম। তবে সে আশার আলোটাও দুদিন আগে নিভে গেছে।
বলেই নীল হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আমি তো পুরো বরফ হয়ে গিয়েছিলাম। নীলের কান্না শুনে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও আমি পাচ্ছিলাম না। শুধু জিজ্ঞেস করলাম
– মেয়েটার কী হয়েছে?
নীল কাঁদতে কাঁদতে বলল
– মেয়েটা আর কোনোদিন সাক্ষী দিতে পারবে না।
বুঝতে আর বাকি রইল না কী হতে চলেছে আমার জীবনে। কান্নাও যেন বুকে আটকে গেছে আমার। নীলকে আমি বিশ্বাস করি। আমি জানি নীল কিছু করে নি। তবে পুরো দুনিয়া কী করে আমি বিশ্বাস করাব। এর মধ্যেই নীল আরেকটা কথার সংযোজন করল যা শুনে আমার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল।
বলেই সিঁথি চুপ হয়ে গেল। মনের ভেতর তার ঝড় চলছে। রুবাইয়া মায়ের কষ্টটা একটু হলেও বুঝতে পারছে। তাই তেমন কিছু বলল না। মায়ের পাশ থেকে আস্তে করে উঠে পাশের রুমে গেল।
সিঁথি চুপ চাপ বসে আছে। ডায়রিটা নিয়ে পুনরায় লেখা শুরু করল।
#প্রিয়_ডাক্তার_সাহেব
মনের অন্তরালে আপনি বরাবরেই রয়ে গেছেন। কেউ বিশ্বাস না করুক আমি আপনাকে সম্পূর্ণ সত্তা দিয়ে বিশ্বাস করি। আমি জানি আপনি আমায় কখনও ঠকাতে পারেন না৷ আপনার শেষ কথাটা প্রবলভাবে আমি বিশ্বাস করি। সেদিন আপনি বলেছিলেন আমি আপনার সম্পূর্ণ অস্তিত্বজুড়ে অভিচল থাকব। আমি আপনার কথা রেখেছি আমি আপনার মেয়ের আদর্শ মা হতে পেরেছি। আপনার মেয়ে কী ভাবছে জানি না। তবে আমি জানি আপনি আমায় মিথ্যা বলেননি। সত্য প্রমাণের সুযোগ যথেষ্ঠ ক্ষীণ তবে আমি চেষ্টা করছি। আমি এখনও আশা রাখি আপনি আসবেন আমার কানের কাছে এসে বলবেন আই লাভ ইউ পাগলি বুড়ি। আমি হালকা হেসে বলব এভাবে না বাংলায় বলুন আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আজ কেন জানি অভিমানী গলায় তোমাকে আপনি বললাম। যখন আমার কাছে ফিরে আসবে তখন মনভরে তুমি বলে ডাকব আর হজারবার বলব আমি তোমায় ভালোবাসি। তুমি শুধু শুনবে আর আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকাবে। আমি তোমার সংস্পর্শে এসে পুনরায় যৌবনে ডুব দিব৷ হারিয়ে যাওয়া যৌবনটাকে উপভোগ করব। আমি শুকিয়ে যাওয়া ফুল। তাজা হতে তোমার একটু সংস্পর্শের প্রয়োজন। প্রিয় আমি তোমার অপেক্ষায় এক যুগ কেন এক জনম কাটিয়ে দিতে পারব। বড্ড ভালোবাসি তোমায়।
তোমার পাগলি বুড়ি।
এদিকে রুবাইয়ার মন ছটফট করতে লাগল তার বাবার পরের কথা শোনার জন্য। এত কঠিন কিছু শুনবে সেটা সে আশাও করেনি। রুবাইয়া পুনরায় সিঁথির ঘরে গেল। সিঁথির পাশে বসে বলল
– তারপর কী হয়েছিল মা?
সিঁথি লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে পরের কাহিনি বলা শুরু করল।
#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৪৯ ( ২য় অংশ)
সিঁথি লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে পরের কাহিনি বলা শুরু করল।
– তোমার বাবার পরের কথাটা শুনে আমি পুরো জীবিত লাশ হয়ে গিয়েছিলাম।
নীল নীচু গলায় বলল
– সিঁথি মেয়েটাকে মেডিকেল টেস্ট করে জানা যায় যে মেয়েটাকে তিনজন ধর্ষণ করেছে। ঐ রুমে আমি শোভন আর রবিন ছিলাম। এছাড়া কেউ ছিল না। তৃতীয় কে এসে ধর্ষণ করেছে সেটা আমি জানি না। আমি তো অচেতন হয়ে পড়ে ছিলাম। একবার মনে হয় আমি কী অচেতন হয়ে নেশার ঘোরে কিছু করে বসলাম না তো? পরক্ষণেই মনে হয় এমন কিছু করলে একটু চিন্হ তো আমার শরীরে থাকত। মানে খামচির দাগ বা কোনো দাগ। কারণ মেয়েটা তো নিজেকে বাঁচাবার জন্য হলেও আমাকে ছুটাতে চাইত। আর আমিও এমন করার পর স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতাম না। আমার জ্ঞান ফেরার পর আমি একদম স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলাম। তবে বিশ্বাস করো আমি এমন কিছুই করিনি। রবিন শোভন ছাড়া আর কে এ কাজ করেছে আমার জানা নেই। রবিন আর শোভনের সাথেও আমার যোগাযোগ নেই। নাহয় তাদের জিজ্ঞেস করলে একটা হদিস মিলত। আমার কাছে আর উপায় নেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার। আমি আজকে পুলিশের কাছে নিজেকে সমর্পণ করব। সিঁথি আমাকে মাফ করে দাও। আমি চাইনি কখনও তোমাকে ঠকাতে। আমি কিছুই করিনি। তবুও আমাকে সাজা ভোগ করতে হচ্ছে। এ নিষ্ঠুর পরিণতির সম্মুখীন হব কল্পনাও করতে পারিনি৷ নেশা মানুষকে পশু বানিয়ে দেয়। বানিয়ে দেয় উন্মাদ মাতাল।
নীল পুনরায় বলল
– সিঁথি আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনি। আমাকে ক্ষমা করে দাও৷
বলেই তোমার কপালে দুটো চুমু দিয়ে চলে গেল। আমি শুধু তোমার বাবার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। পিছু ডাকবার কোনো উপায় আমার ছিল না। পিছু হটারও কোনো উপায় ছিল না। কলিজায় মনে হলো কেউ ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে আমায়। আমার কষ্টটা সেদিন চাপা দিয়েছিলাম তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে। নাহয় হয়তো এ জীবন আমি রাখতে পারতাম না। আমি শেষ হয়ে যেতাম। সেদিন বাসায় ফিরি অনেক রাত করে। বাসায় আসার পর থেকেই তোমার বাবার কথাগুলোই যেন মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি। শুধু ভাবছিলাম এ দুঃস্বপ্নের ঘোর কবে কাটবে। তবে তিতা হলেও এটাই সত্য যে দীর্ঘ ১৬ বছরেও এ দুঃস্বপ্নের বেড়াজাল থেকে আমি বের হতে পারছি না। সব যেন আরও ঘিরে ধরেছে।
রুবু চুপ হয়ে আছে। বাবাকে কত কিছুই না সে ভেবেছিল। মায়ের কষ্টটা যেন রুবুকে আরও ঘিরে ধরেছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে তার। নিজেকে সামলাবে নাকি মাকে সামলাবে বুঝতে পারছে না। অতি কষ্টে মানুষ নীরব হয়ে যায়। সিঁথি আর রুবুর মধ্যেও একই বিষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। নীরবতা বিরাজ করল অনেকক্ষণ। নীরবতা কাটিয়ে রুবু তার মাকে প্রশ্ন করল
– মা দাদু কেন মারা গিয়েছিল?
সিঁথি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
– পরদিন সকালে নীল আত্মসমর্পণ করে। আর সেটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তোমার দাদু নিজের ছেলের এমন করুণ পরিণতি মানতে পারেনি। তাই খবরটা শোনার সাথে সাথেই স্ট্রোক করে মারা যান। সুখের সময় যেন খুব দ্রূতই বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। এখনও সে বিষের প্রভাব বিরাজ করছে। সবকিছু ঠিক চললেও মনের গহীনের শূন্য জায়গাটা যেন আজও তোমার বাবাকে ছাড়া শূন্যই রয়ে গেছে৷ তোমার নানা নানু নীলকে বিশ্বাস করতে পারেনি। তারা ভেবেই নিয়েছে নীল এমন করেছে। তাই বহুবার বলেছিল আরেকটা বিয়ে করে নিতে। কিন্তু আমি নীলকে ছাড়া অন্য কাউকে কীভাবে ভালোবাসব বলো! আমার ভেতরে বাহিরে প্রতিটা শিরায় উপশিরায় যে শুধু নীলের অস্তিত্ব বিদ্যমান। আমি অন্য জায়গায় বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় তেমার নানা নানুও আমার সাথে তেমন কথা বলে না। তুমি তোমার রুমে যাও এবার। আমাকে একটু একা থাকতে দাও। রাত তিনটে বেজে গেছে।
রুবাইয়ার মনে অনেক প্রশ্ন এখনও আছে যেমন রবিন আর শোভন ধরা পড়েছিল কী না? তাদের কী পরিণতি হয়েছে? তৃতীয় কোন ব্যাক্তি মেয়েটাকে আবার ধর্ষণ করেছিল? এত প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও সে আর কোনো কথা বাড়াল না সোজা উঠে তার রুমে চলে গেল। সিঁথি চুপ হয়ে বসে আছে। এর শেষ কোথায় সিঁথি জানে না। সিঁথির বুকে কেমন জানি ব্যথা হতে লাগল। ডায়রি বের করে পুনরায় লিখতে শুরু করল। দীর্ঘ ১৬ টা বছর এ ডায়রিটায় তার সঙ্গী ছিল। নীল বলেছিল সিঁথিকে ডাক্তার হতে সিঁথি নীলের কথা রেখেছে। তার শ্বশুর বাবা যদি পাশে না থাকত তাহলে হয়তো এ কঠিন পথ পারি দেওয়া আরও কঠিনতর হয়ে যেত। একটা ভুল যেন সব ধ্বংস করে দিল। আজকাল রিদির কথাও সিঁথির খুব মনে পড়ে। বারবার জানতে ইচ্ছে করে রিদিকে কে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছিল। যদি একটা বার জানতে পারত তাহলে হয়তো মনে শান্তি পেত। রিদির অকাল মৃত্যুটাও সিঁথিকে বছর খানেক আগে বেশ ধাক্কা দিয়েছিল। নীলকে আজ কেউ বিশ্বাস করছে না। পুরো দুনিয়া নীলের বিরুদ্ধে এমনকি সিঁথির বাবা মাও, তবুও সে নীলকে বিশ্বাস করেছে। মনের গহীনে এখনও আলিঙ্গন করে রেখেছে তাকে। মাঝে মাঝে নীলকে কল্পনা করে। নীলকে নিয়ে সুখের সংসার কল্পনায় বুনে। সে কল্পনাতেও যেন কোনো এক কালো ছায়া এসে সব তছনছ করে দেয়। আজকাল কল্পনা করতেও সে ভুলে গেছে। ডায়রিটার পাতা ভর্তি করে মান অভিমানের শত কথা লিখে শেষ করল সিঁথি। এবার মাথাটা এলিয়ে দিল বিছানায়। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে বন্ধ হলো তার। ভীষণ অশান্তি হচ্ছে তার। পুরনো ক্ষতটা যেন আবারও তাজা হয়ে উঠেছে। এ ক্ষতের রক্তক্ষরণ যেন কমছেই না।
এদিকে রুবাইয়া কেমন জানি নীরব হয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে ভীষণ বড় একটা পাথর তার বুকে চেপে ধরেছে শত চেষ্টা করেও নামাতে পারছে না। একটু কাঁদলে হয়তো ভালো লাগত। তবে কান্না যেন নামছেই না চোখ দিয়ে। পাথরের মতো স্তবির হয়ে আছে সে। নিজের বাবার এমন করুণ পরিণতি শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কেন যে শুনতে গেল। এখন মনে হচ্ছে কিছু সত্য অপ্রকাশিত থাকলেই হয়তো ভালো হত।
মসজিদ থেকে আল্লাহু আকবার বলে আজানের শব্দ রুবাইয়া আর সিঁথির কানে আসলো। আজানের শব্দটা শুনেই সিঁথি তার গালে গড়িয়ে পড়া চোখের জলটা মুছে অজুর জন্য ওয়াশরুমে গেল। রুবাইয়াও নিজেকে সামলে ওয়াশ রুমে গিয়ে অজু করে নামাজে দাঁড়াল। ফজরের নামাজ শেষে দুহাত তুলে বলল
” হে আমার রব আপনাকে ডেকে আমি কখনও নিরাশ হয়নি। কখনও আপনি আমায় হতাশ করেননি। সবসময় আমার জীবনে যেটা উত্তম সেটা দিয়েছেন। আপনার শুকরিয়া আদায় করে শেষ করার ক্ষমতা আমার নেই। আপনি আমার একমাত্র রব। আপনাকে ছাড়া আমার চাওয়ার কেউ নেই। একমাত্র দেওয়ার মালিক আপনি। আল্লাহ আপনি তো রহমান, আপনি তো ক্ষমাশীল। আমাদের কোনো ভুল থাকলে ক্ষমা করে দিয়েন। আমার বাবাকে মুক্ত করে দিন। আমার বাবাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। আমি আমার বাবাকে দেখতে চাই। আমি অন্য সবার মতো বাবার বুকে মাথা রাখতে চাই। আমি জানি আপনি আপনার বান্দাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন। আমি এটাও জানি আপনি আপনার বান্দার নেক ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেন না। আপনার প্রিয় বান্দাদের কঠিন পরীক্ষা দেন। হয়তো আমার বাবা, মা আপনার প্রিয় তাই এত পরীক্ষা নিচ্ছেন। আল্লাহ আপনি দয়ালু আমার বাবা,মা কোনো ভুল করে থাকলে তাদের ক্ষমা করে এক করে দেন।”
বলতে বলতেই রুবাইয়া কান্নায় ভেঙে পড়ল।এতক্ষণের চাপা কান্না যেন এখন বিস্ফোরিত হয়ে বের হলো। মোনাজাত শেষে রুবাইয়া খাটে বসে শুধু বাবার কথায় ভাবতে লাগল।
অপরদিকে সিঁথি দুহাত তুলে বলল
– আল্লাহ আমি জানি আমার এ কষ্টের প্রহর অতিদ্রূত শেষ হবে। আমি সবর করতেছি আপনি আমাকে ধৈর্য দিন। আপনার কাছে একটায় চাওয়া শেষ অধ্যায়টা শুধু সুন্দর করে দিয়েন। আপনি মহান, আপনি আপনার এ অসহায় বান্দার সহায় হোন।
এদিকে নীলের বাবার রোজকার চাওয়াও তার ছেলের মুক্তি। সিঁথি নামাজটা শেষ করে চেয়ারটা টেনে বসলো। শরীরটা বিশেষ ভালো লাগছে না তার। মাইগ্রেনের ব্যথাটাও চড়াও দিচ্ছে। চোখ দুটো ফুলে আছে কাঁদতে কাঁদতে। এর মধ্যেই সিঁথির ফোনে একটা কল আসলো। সিঁথি কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে কিছুর আভাস পেল। রুবাইয়া তখন মায়ের রুমে এসেছে সবে। মায়ের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। ওপাশ থেকে কেউ হয়তো জটিল কিছু বলছে। সিঁথি মোবাইলটা রেখেই যেরকম ছিল সেরকমেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়তে নিল। রুবাইয়া তার মায়ের পিছু ডেকে বলল
– মা কোথায় যাচ্ছ?
সিঁথি শুধু একটা উত্তরেই দিল
– জীবনের শেষ অধ্যায় খুঁজতে যাচ্ছি।
চলবে?