তি আমো পর্ব -২০+২১

#তি_আমো
পর্ব ২০
লিখা- Sidratul Muntaz

অন্ধকার ঘরের দুই প্রান্তে দুইজন বসে আছি৷ অতিরিক্ত টেনশনে আমার নখ কামড়াতে ইচ্ছে করে। আপাতত আমি নখ কামড়াচ্ছি। ঈশানের দিকে চাইতেই দেখলাম সে শিষ বাজাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে বললাম,” আপনি মনে হয় খুব বিন্দাস আছেন? শিষ বাজাচ্ছেন কেন?”

ঈশান শিষ বাজানো থামিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,” তো কি করব?”

” একটা আইডিয়া বের করুন। কিভাবে এখান থেকে বের হওয়া যায়?”

ঈশান দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চিন্তা করতে লাগল। আমি ভাগ্যের উপর বিরক্ত হয়ে বললাম,” আপনার সাথে থাকলেই এমন হয়। সেদিন নিহাদের গ্যারেজে আটকা পড়লাম। আর আজ আমাদের চিলেকোঠায়। বার বার এসব কেন হচ্ছে?”

ঈশানের ফোন বেজে উঠল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঈশান বলল,” সাফিন ফোন করছে।”

আমি আফসোস করে বললাম,” আহারে, উনি মনে হয় এতোরাত পর্যন্ত আপনার জন্য জেগে বসে আছেন।”

ঈশান দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছিল। আমার কথা শুনে মাথা তুলে বলল,” ও তো আমার সঙ্গেই এসেছে।”

আমি চোখ প্রসারিত করে বললাম,” মানে? সাফিন ভাইয়া বাইরে?”

” হুম। গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে আমার। এজন্যই হয়তো ফোন দিচ্ছে অথচ আমি বের হতেও পারছি না।”

ঈশান মোবাইল রিসিভ করে সাফিন ভাইয়াকে সম্পূর্ণ ঘটনা শোনাতে লাগল। আমি বুদ্ধি পেয়ে যাওয়ার মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম,” একটা কাজ করলেই তো হয়৷ সাফিন ভাইয়াকে বলুন একটা রিকশা নিয়ে যেন এদিকে চলে আসে।”

” কেন? ও এসে কি করবে?”

” মই বেয়ে ছাদে উঠবেন। তারপর ভাইয়ার ঘর থেকে চাবি চুরি করে এনে আমাদের মুক্ত করবেন!”

ঈশান অবজ্ঞার স্বরে বলল,” আরে নাহ, পরে ধরা খেলে খবর আছে।”

আমি চঞ্চল কণ্ঠে বললাম,” ধরা খাবেন না উনি। ভাইয়ার ঘুম খুব গাঢ়। একবার ঘুমিয়ে পড়লে ভূমিকম্প হলেও টের পান না। একবার তো এমনও হয়েছিল যে ভূমিকম্প হচ্ছে আর আমরা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছি অথচ ভাইয়া টেরও পায়নি।”

ঈশান আমার কথায় কনভিন্স হলো না। অসন্তুষ্ট গলায় বলল,” এসব চাবি চুরির ঝামেলা বাঁধিয়ে লাভ নেই তারিন৷ খুব রিস্কি হয়ে যাবে ব্যাপারটা।”

” তাহলে সাফিন ভাইকে আসতে বলুন। তিনি এসে তালাটা ভাঙুক।”

ঈশান হেসে বিদ্রুপ করে বলল,” তালা ভাঙতে গেলে পুরো পাড়া জেগে উঠবে।”

আমি ঈশানের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে বললাম, ” হ্যালো সাফিন ভাইয়া, আপনার ফ্রেন্ড বিপদে পড়েছে। আপনি কি আসবেন না? আপনার জন্য আমি কত কিছু করেছি। সব কি ভুলে গেছেন? নিহা যখন আপনার সাথে কথা বলতে গিয়ে প্রথমবার আঙ্কেলের কাছে ধরা খেল, তখন আমি আপনাদের বাঁচিয়েছিলাম। আপনার সাথে নিহা পূর্বাচল ঘুরতে যাবে, অথচ বাসায় গিয়ে আন্টি-আঙ্কেলকে কনভিন্স করেছি আমি। ছুটির দিনে একটু শান্তিতে ঘুমাব তখনও নিহা ফোন করে বলেছে তারু, চলে আয়। আমিও চলে গেছি। কারণ আমি না গেলে নিহা বাড়ি থেকে বের হতে পারবে না৷ এতো এতো উপকার করলাম, তার কি কোনো প্রতিদান নেই? আজ আমি বিপদে পড়েছি বলে আপনি পিছু হাঁটছেন?”

ঈশান গালে হাত দিয়ে কথাগুলো শুনছে আর মুচকি হাসছে। সাফিন ভাইয়া মোলায়েম কণ্ঠে বলল,” আরে, আমি হেল্প করব না কখন বললাম? নিশ্চয়ই করব। তুমি শুধু বলো, আমাকে কি করতে হবে?”

আমি উৎফুল্ল কণ্ঠে বললাম,” সত্যি হেল্প করবেন? তাহলে আমাদের বাড়ির পেছনদিকে চলে আসুন। বিরাট কদম গাছের সাথে একটা সরু রাস্তা পাবেন।সোজা হাঁটলেই পাবেন মই। সেই মই বেয়ে ছাদে উঠবেন।”

সাফিন ভাইয়া দূর্বল কণ্ঠে বললেন,” ওকে। আমি আসছি। তুমি টেনশন কোরো না।”

আমি ফোন রেখে প্রশান্ত কণ্ঠে বললাম,” সাফিন ভাইয়া কত ভালো, কত কিউট। আর আপনি পুরো রাফ এন্ড টাফ একটা!”

ঈশান আমার দিকে ঘুরে বলল,” হোয়াট? আমি রাফ এন্ড টাফ আর সাফিন কিউট?”

ঈশানের চোখ থেকে ঈর্ষা ঠিকরে বের হচ্ছে। আমি মজা নিতে বললাম,” অবশ্যই। নিহার ভাগ্যটা কত ভালো আর আমার পোড়া কপাল..”

” তোমার পোড়া কপাল? কেন?”

” কারণ আমার কপালে আপনি আছেন। পোড়া কপাল হওয়ার জন্য এইটুকু কারণই যথেষ্ট। ”

ঈশান অভিমানে চোয়াল শক্ত করে বলল,” ওকে, ফাইন।”

আমি ঈশানের দিকে একটু ঝুঁকে এসে বললাম,” রাগ করেছেন?”

ঈশান আঁড়চোখে চেয়ে বলল,” এভাবে তাকিয়ো না আমার দিকে।”

“কেন?”

ঈশান ফিসফিস করে বলল,” খেয়ে ফেলব।”

আমি আৎকে উঠে বললাম,” ছিঃ, এগুলো কি ধরণের কথা?”

ঈশান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল,” গভীর রাত, শীতল বাতাস, অন্ধকার ঘর, পাশে তুমি, এই অবস্থায় এর চেয়ে সংযত কথা আমার পক্ষে বলা সম্ভব না।”

আমি আরক্ত হয়ে উঠলাম। ঈশানের ফোনটা হাতে নিয়ে অকারণেই গ্যালারিতে ঢুকে ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলাম। ঈশান আমার থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল,” কি করছ?”

আমি অকপটে বললাম,” টাইম পাস।”

ঈশান মোবাইলটা লক করে বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে বলল,” টাইম পাস না। এটাকে বলে টাইম ওয়েস্ট।”

আমি মাথা নিচু করে আওড়ালাম, ” তাহলে টাইম পাস কোনটা?”

” দেখবে?”

” না।”

আমি দৌড়ে দরজার কাছে চলে গেলাম। ঈশান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” ছুটোছুটি করে লাভ কি? দরজার বাহিরে তো আর যেতে পারবে না।”

আমি সতর্ক কণ্ঠে বললাম,” আপনিও আমার কাছে আসতে পারবেন না। তাহলে আমি চিৎকার করব।”

ঈশান হাত ভাজ করে সহজভাবে বলল,” করো চিৎকার। তোমার বাড়ির লোক সবাই। আমি বলে দেব যে তুমিই আমাকে ডেকেছ।”

আমি বিমূঢ় হয়ে বললাম,” ছিঃ, এই ছিল আপনার মনে? আপনি খুব খারাপ।”

” এখনও খারাপ কিছু করলাম না, তবুও খারাপ?”

” খারাপ কিছু করেননি মানে? তখনি তো করলেন। ঘরের বাহিরে…”

” সেটা তো ট্রেইলার ছিল। ফুল মুভি এখনও বাকি।”

বাইরে থেকে কেউ আওয়াজ দিল,” আর আমি যাচ্ছি মুভির টিকিট কাটতে। ”

আমি আর ঈশান দু’জনেই চমকে উঠলাম। সাফিন ভাইয়া হেসে বললেন,” জাস্ট কিডিং! আমি নিচে তারিনের ভাইয়ের ঘরে যাচ্ছি চাবি আনতে।”

ঈশান বলল,” আচ্ছা যা। সাবধানে।”

আমি দুইহাতে মুখ চেপে ধরলাম,” ওহ শিট! উনি সব শুনে ফেলেছে।”

ঈশান বিছানায় বসতে বসতে বলল,” শুনলে কি হয়েছে?”

” ছিঃ, আমার খুব অকওয়ার্ড লাগছে।”

একটু পরেই সাফিন ভাই কল দিলেন। ঈশান ফোন রিসিভ করায় তিনি বললেন,” তারুকে দে।”

ঈশান আমার দিকে ফোন বাডিয়ে দিল। আমি বললাম,” হ্যালো সাফিন ভাইয়া।”

” তারু, চাবি কোথায় থাকতে পারে?”

” আপনি ভাইয়ার ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে দেখুন। ”

” আচ্ছা, তুমি লাইনে থাকো।”

” ওকে।”

সাফিন ভাইয়া একটু পর ফিসফিস করে বললেন,” তারু, কোথাও পাচ্ছি না।”

” একটু ভালো করে খুঁজুন। তোষকের নিচে থাকতে পারে।”

” এখন তোষকের নিচে হাত দিব আমি?”

” হ্যাঁ। কিন্তু সাবধানে। যাতে ভাইয়া বুঝতে না পারে।”

কিছুক্ষণ ফ্যাচফ্যাচ শব্দ হলো। তারপর হঠাৎ করেই চিৎকার শুনলাম। আমি ফোন কান থেকে নামিয়ে নিথর হয়ে বললাম,” সাফিন ভাই ধরা পড়ে গেছে।”

ঈশান দাঁড়িয়ে বলল,” হোয়াট? আমি আগেই নিষেধ করেছিলাম।”

নিচ থেকে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ভাইয়া ভীষণ জোরে ‘চোর,চোর’ বলে চিৎকার করছে। আমি আর ঈশান হতবুদ্ধির মতো হয়ে গেলাম। কিভাবে সাফিন ভাইকে বাঁচানো যায়? একটু পর খেয়াল করলাম ধুপধাপ শব্দে কেউ ছাদে উঠছে। এরপরের ঘটনাগুলো একদম ঝড়ের মতো ঘটল। কিছু বোঝার আগেই শেষ। নিচে ভাইয়ার গগনবিদারী চিৎকার তখনও স্পষ্ট। সাফিন ভাইয়া ঝটপট করে চাবি দিয়ে তালা খুলেই বললেন,” ভাগ, ঈশান ভাগ! যেকোনো সময় উপরে কেউ চলে আসবে।”

ঈশান তেড়ে গেল মইয়ের দিকে। সাফিন ভাইয়া মই চেপে ধরে রাখলেন। ঈশান দ্রুত নামছে। আমি প্রশ্ন করলাম,” ভাইয়া কেন এভাবে চেঁচাচ্ছে?”

সাফিন ভাইয়া নামার আগে বললেন,” আই এম স্যরি তারিন। তোমার ভাইয়াকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছি৷”

” কি? আপনি ভাইয়াকে ল্যাং মারলেন?”

” ল্যাং না মারলে তোমার ভাই আমাকে চোরের মতো মারতো।”

আমি দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলাম। মা আর বুড়ি ঘুম থেকে উঠে গেছে। পুরো বাড়িতে আলো জ্বলছে। ভাইয়া কোমরের ব্যথায় কাতরাচ্ছে৷ আমাকে ছাদ থেকে নামতে দেখে ভাইয়া জিজ্ঞেস করল,” তুই উপরে কি করছিলি?”

আমি থতমত খেয়ে বললাম,” তোমার চিৎকার শুনে চোর ধরতে গিয়েছিলাম, ভাইয়া।”

ভাইয়া আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বলল,” এতো সাহস তোর? যদি কিছু হয়ে যেতো? আর তুই ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আমি দেখলাম না কেন?”

আমি নখে কামড় দিয়ে বললাম,” জানি না!”

মা কপাল চাপড়ে বলতে লাগল,” এ কোন বিপদ এলোরে! সদর দরজা বন্ধ। চোর তাহলে ঢুকল কিভাবে?”

ভাইয়া কোমরে ব্যথা নিয়েই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” আমি বুঝেছি। পেছনের রাস্তা দিয়ে ঢুকেছে চোরের বাচ্চা।”

এই কথা বলেই ভাইয়া দ্রুত ছুটল পেছনের রাস্তায়। মা আটকাতে চাইল। কিন্তু ভাইয়া কারো কথা শোনার মানুষ নয়। আমি অবশ্য হাঁফ ছাড়লাম৷ এতোক্ষণে ঈশান আর সাফিন ভাইয়ের চলে যাওয়ার কথা। মা অনেক অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু বুড়ি বুঝতে পারল এই চোর সেই চোর নয়। দূরে নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করল,” ঠিকমতো ভাগাইছোস? আবার ধরা খাইব নাতো?”

আমি নিশ্চিন্তে বললাম,” ধরা খাবে না। তুমি ভেবো না।” মা আর বুড়িকে শান্ত করে নিজের ঘরে ঢুকলাম আমি। বিছানায় গা এলাতে নিব, তখনি পেছন থেকে কেউ চাপা কণ্ঠে ডাকল,” তারিন।”

আমি চমকে উঠে পেছনে চাইলাম। সাফিন ভাইয়া অনুরোধ করে বললেন,” চিৎকার কোরো না প্লিজ।”

আমি নিজেই নিজের মুখ চেপে ধরলাম। বিস্ময় সামলে প্রশ্ন করলাম,” আপনি এখানে কি করছেন?”

সাফিন ভাইয়া অপরাধী কণ্ঠে বললেন,” স্যরি। মই থেকে নামতে গিয়ে মইয়ের স্টিক ভেঙে গেল। আমি ধপ করে নিচে পড়ে গেলাম। পেছনের রাস্তায় তোমার ভাইয়া দাঁড়িয়ে ছিল৷ তাই আর বের হতে পারিনি। ”

” এজন্য আপনি আমার বারান্দা দিয়ে আমার ঘরে চলে এলেন?”

” এক্সাক্টলি।”

” তাহলে ঈশান কই?”

” সে তো আমার আগেই চলে গেছে।”

” ওহ শিট!”

আমি গিয়ে দ্রুত দরজা বন্ধ করলাম। না জানি আজ কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলাম! এসব হচ্ছেটা কি? সাফিন ভাইয়া বললেন,” তোমার ভাইয়া একটু ঠান্ডা হোক। আমি দ্রুত চলে যাব।”

আমি বিনীত কণ্ঠে বললাম,” সমস্যা নেই। আপনি থাকুন। ঝামেলা মিটলে যাবেন।”

” তোমার সমস্যা না থাকলেও ঈশান আমাকে ছাড়বে বলে মনে হয় না।”

আমি দুশ্চিন্তার মধ্যেও হেসে ফেললাম। এর মাঝে ঈশান ফোন করল। সাফিন ভাই ফোন রিসিভ করতেই ঈশান উদগ্রীব কণ্ঠে প্রশ্ন করল, সাফিন শালা, কই তুই?”

সাফিন ভাইয়া ভীত কণ্ঠে বললেন,” আগে বল, তুই চেতবি না তো?”

” চেতবো কেন?”

” কারণ আমি এই মুহূর্তে তারিনের ঘরে।”

” হোয়াট রাবিশ! তুই তারিনের ঘরে কি করছিস?”

এমন সময় দরজায় খটখট শব্দ হলো। সাফিন ভাই ভয়ে বিছানার তলায় ঢুকে পড়লেন।

সব পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=175675935125922&id=100080505484003

চলবে#তি_আমো
পর্ব ২১
লিখা- Sidratul Muntaz

দরজার ওইপাশে ভাইয়া ভীষণ রেগে তীক্ষ্ণ গলায় আমাকে ডাকছে। আমি চড়ুইপাখির মতো আত্মা নিয়ে ভয়ে ভয়ে দরজা খুললাম। ভাইয়া হুড়মুড় করে আমার ঘরে ঢুকে চারিদিকটা দেখে বলল,

” সত্যি কথা বল, কে এসেছিল? ওই বদমাইশটা?”

আমি কম্পমান কণ্ঠনালী নিয়ে উচ্চারণ করলাম,” কে বদমাইশ?”

ভাইয়া আমার দিকে ঘুরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বলল,” ঈশান।”

আমার আত্মায় তখন একফোঁটাও পানি নেই। জোরপূর্বক হাসার ভাণ ধরলাম,” মানে? স্যার এখানে কেন আসবেন?”

ভাইয়া আমার বিছানায় বসে বলল,” তোর স্যারের কথা বলছি না৷ তার কথা কেন বলব? সে আসবে না তা জানি। আমি বলছিলাম ওই হারামজা*দার কথা। তোকে চিঠি দিয়েছিল সেই ঈশান।”

আমি অবাক হয়ে বললাম,” কিন্তু সে-ই বা কেন আসবে ভাইয়া?”

” সে যদি না আসে তাহলে তুই ছাদে কি করছিলি? চিলেকোঠার ঘর খোলা কেন? আমার ড্রয়ারে টাকা, দামী ঘড়ি, মোবাইল ছিল। সেসব না নিয়ে চোর নিল চিলেকোঠার ঘরের চাবি। কেন? এই চোর যে আদতে চোর নয় সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। ”

আমি বুদ্ধিহীনের মতো ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ যেন ভাইয়া কি বলছে তার কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না।ভাইয়া শাসিয়ে বলল,

” দ্যাখ তারু, খবরদার মিথ্যা বলবি না। তুই ইদানীং অনেক মিথ্যা বলা শিখেছিস। ঘটনা কি ঘটছে আমাকে সত্যি করে বল।”

” আমি কিছু জানি না ভাইয়া।”

ভাইয়া ক্রুর দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইল,” আসলেই জানিস না?”

আমি ভোলা-ভালা মেয়েটির মতো মাথা নাড়লাম। ভাইয়া সন্দিহান গলায় বলল,” চোর এসেছে ছাদের মাধ্যমে। ছাদের সাথে মইটা কে রাখল? মই তো থাকে ছাদের উপর। চোরের পক্ষে ছাদে না উঠে মই নেওয়া সম্ভব না। আবার সদর দরজাও যেহেতু খোলা হয়নি, তাহলে বোঝাই যাচ্ছে যে ঘর থেকেই কেউ মইটা নামিয়েছে। সেই কেউটা কে? ”

আমি বিড়বিড় করে বললাম,” তোমার এতো বুদ্ধি কেন ভাইয়া? ” তারপর ভাইয়ার দিকে চেয়ে দুঃখী গলায় বললাম,” তুমি আমাকে সন্দেহ কেন করছ ভাইয়া?”

ভাইয়া তপ্ত দৃষ্টিতে বলল,” কারণ আমি যখন চিৎকার করলাম তখন মা আর দাদী ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। কিন্তু তুই-ই একলা যে এলি ছাদ থেকে। তোকে তো আমি ঘর থেকে বের হতে দেখলাম না।”

আমি নিশ্চুপ। ভাইয়া নিজের হাঁটুতে মালিশ করতে করতে বলল,” এখন বল, সত্যিটা কি তুই বলবি নাকি আমিই বের করব?”

আমি তখনও কোনো কথা বলছি না। আসলে কি বলব বুঝতেই পারছি না। জীবনে কখনও এমন দোটানায় পড়িনি৷ ভাইয়া ঠান্ডা গলায় বলল,” আচ্ছা থাক, পরে বলিস। এখন আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। ”

হঠাৎ আমার চোখ পড়ল খাটের নিচে। সাফিন ভাইয়ের পা বেরিয়ে আছে। ভাইয়া পেছনে ঘুরলেই দেখবে। ভয়ে বুকের ভেতরটা যে কি পরিমাণ কাঁপছে! এই অবস্থায় পানি আনতে যাই কি করে? ভাইয়া ধমক দিল,” কি ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কি বললাম শুনতে পাস না?”

আমি তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। মনে মনে সূরা ইখলাস পড়ছি। আর ঘরে গিয়ে ভাইয়াকে কি জবাব দিব তাই নিয়ে ভাবছি। আমি ঘরে প্রবেশ করে এবার যে দৃশ্য দেখলাম তা হার্ট এট্যাক করার জন্য যথেষ্ট। সাফিন ভাইয়া দেয়ালের সাথে সেঁটে দাঁড়িয়ে আছেন। ভাইয়া বড় বড় দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক যেভাবে কাবাডি খেলা শুরু হওয়ার আগে প্রতিযোগী তার প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে চেয়ে থাকে। আমার হাত থেকে কাঁচের গ্লাসটা ধপ করে পড়ে ভেঙে গেল৷ কাঁচ ভাঙার শব্দে ভাইয়া পেছনে তাকানো মাত্রই সাফিন ভাইয়া দুনিয়া ভুলে বারান্দার দিকে দৌড় দিলেন। ভাইয়াও গর্জন করে তার পেছনে ছুটে গেল। আমি ক্লান্ত শরীর নিয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।

দিনটি ভয়ংকর ছিল। কিন্তু আজও মনে পড়লেই হাসি পায়। শেষমেষ ভাইয়া সাফিন ভাইকে ধরতে পারেনি সেদিন। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে আমাকেই জেরা শুরু করেছিল। আমি কেবল বলেছিলাম, লোকটিকে আমি চিনি না। সে কিভাবে আমার খাটের নিচে এলো তাও জানি না। ভাইয়া আমার কথা বিশ্বাস করেছিল কি-না বোঝা যায়নি। তবে পরে আমাকে এই নিয়ে আর প্রশ্নও করেনি।

আমি এই মুহূর্তে নিহাদের বাগানের বিশাল কাঠগোলাপের গাছ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কি অপূর্ব সুন্দর এই গাছ, গাছের ফুল। মন মাতানো মিষ্টি সুবাসে মো মো করছে চারদিক। ছমছমে অন্ধকারে হালকা আলোয় নিজেকেই ভালোমতো চোখে লাগেনা। কিন্তু ঝরে পড়া সাদা কাঠগোলাপগুলো সবুজ ঘাসে বিছিয়ে থাকায় মনে হচ্ছে যেন উজ্জল নক্ষত্রের মেলা!
আজ নিহার গায়ে হলুদ। আগামীকাল বিয়ে। রাতটা তাই এখানেই থাকছি। আমি একাই এসেছি। তারিফ ভাই আমাকে পৌঁছে দিয়েই চলে গেছে। বুড়িটার হঠাৎ জ্বর আসায় মাও আসতে পারেনি হলুদে।

কিছুক্ষণ আগেও চারদিকটা বেশ হৈ হুল্লোড়ে মেতে ছিল। কিন্তু এখন সব নিরব। মোহনা আন্টি একটু আগেও আমার সঙ্গে ছিলেন। এখন তিনি প্রস্থান করেছেন। আমাকে অনেক কথা বললেন। ডিভোর্সের পর থেকে নাকি ঈশান একবারও বাড়িমুখো হয়নি। মোহনা আন্টি আমাকে অনুরোধ করলেন আমি যাতে ঈশানকে বাড়ি যেতে রাজি করাই। আমার কথা নাকি ঈশান ফেলতে পারবে না। আমি হেসে প্রশ্ন করলাম,” আপনার এমন কেন মনে হয় আন্টি?”

মোহনা আন্টি আমার গাল স্পর্শ করে বললেন,” আমি কিছু জানি না ভেবেছ? সব বুঝি তোমাদের মধ্যে কি চলছে!”

আমার তখন লজ্জায় কথাই বন্ধ হয়ে গেল। ঈশান কি নিয়ে মোহনা আন্টির উপর রেগে আছে তা আমি জানি না৷ একবার অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু সে বলতে রাজি নয়। আর আমিও বার-বার তাকে প্রশ্ন করে মাথাখারাপ করতে চাই না। যখন সময় হবে, তখন ঈশান নিজেই হয়তো বলবে! আমি তার ইচ্ছার অপেক্ষায় আছি।

সবুজ ঘাসের উপর পা ফেলে ভারি আরাম করে বসলাম। ঝি ঝি পোকার ডাক কানে আসছে। এইখানে বসে থাকার একটা কারণ অবশ্য আছে। আমি সবার থেকে লুকিয়ে এখানে এসে বসেছি। ভেতরে সবাই রঙ আর হলুদ দিয়ে খেলছে। যেকোনো সময় আমাকেও রঙ লাগিয়ে ভূত বানিয়ে দেবে। সেই ভয়েই আমার লুকিয়ে থাকা। কিন্তু বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকা গেল না। সামিয়া ঠিক আমাকে খুঁজে ফেলল। দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে উঠল,” এই, সবাই এদিকে আসো। তারিন এখানে।”

মেঘলা সবার আগে ছুটে এলো। পিছু পিছু সাদিয়া, রিদিতা, আফরা। এরা সবাই আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ড। এক বালতি হলুদ মেশানো কালো রং আমার মাথায় ঢেলে দিল। তারপর কি উল্লাসের হাসি তাদের! আর আমি তব্দা লেগে দাঁড়িয়ে আছি। সামিয়া আমার চিবুক স্পর্শ করে বলল,” কি সুন্দর লাগছে! একদম কালি ভূত!”

আমি রাগে গজগজ করে বললাম,” এইসব কি হলো?”

মেঘলা হাসি-খুশি গলায় বলল,” আমরা সবাই যেভাবে রঙ মেখেছি, তোকেও মাখতে হবে। তুই কেন লুকিয়ে থাকবি? এজন্য এটা তোর শাস্তি।”

ঈশানকে দেখলাম পেছন থেকে বেরিয়ে এলো। পকেটে হাত গুজে বলল,” আরও এক বালতি ঢালো। একেবারে গোসল হয়ে যাক।”

আফরা আফসোস করে বলল,” আর তো নেই। সব শেষ হয়ে গেছে।”

” ওহহো!”

আমি হতবাক হয়ে বললাম,” আপনিও আছেন এদের সাথে?”

রিদিতা চোখ টিপে বলল,” ঈশান ভাই-ই তো তোমার খোঁজ দিয়েছে আমাদের। নাহলে আমরা তো খুঁজেই পাচ্ছিলাম না।”

আমি অগ্নিদৃষ্টিতে ঈশানের দিকে চাইলাম। ঈশান আমার কাছে এসে পকেট থেকে হাত বের করেই সেই হাত আমার গালে চেপে ধরল। সাথে সাথে আমার গাল গোলাপি রঙে রঙিন হয়ে উঠল। সবাই হৈহৈ করে হেসে দিল। শুধু খেয়াল করলাম সামিয়ার মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। আমি রাগে ঈশানকে ধাক্কা মেরে দৌড়ে চলে এলাম।

এই চুপচুপে ভেজা শরীর নিয়ে এখন আমি কি করি? রাত-বিরাতে গোসল করতে হবে। মনখারাপ করে নিহার ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। ঈশান আমার হাত টেনে ধরে একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এলো। আমি অভিমানে কঠিন গলায় বললাম,” ছাড়ুন আমাকে। আপনার জন্যই এই অবস্থা।”

ঈশান আবেগমাখা কণ্ঠে বলল,” তোমাকে সুন্দর লাগছে।”

” ইশ, ভূত লাগছে।”

” সত্যি সুন্দর লাগছে! ”

এই কথা বলে আমার চুলে কাঠগোলাপ গুজে দিল ঈশান৷ আমি অবাক হয়ে বললাম,” ওয়াও, গাছ থেকে ছিঁড়েছেন? নিচেরগুলো তো সব নোংরা ছিল।”

ঈশান আমার গলার পেছনে হাত বেঁধে একটু নিচু হয়ে বলল,” হুম গাছ থেকেই ছিঁড়েছি। তোমাকে কি আমি ঝরে পড়া ফুল দিতে পারি?”

আমি হাসলাম। ঈশান আমার গাল স্পর্শ করে ঠোঁটে চুমু দিতে চাইল। আমি অবাক হয়ে বললাম,” আরে মোহনা আন্টি আপনি যাননি?”

ঈশান ঝট করে সরে গেল। আমি হাসতে হাসতে পালিয়ে এলাম। ঘরে এসে দেখলাম নিহা বেচারি বড্ড কাহিল। আমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটাই তার অবশিষ্ট নেই। সাফিন ভাইয়ের সাথে ঘণ্টাখানেকের মতো মেলা বকবক করে এখন সে ঘুমাতে চায়। আমি গোসল সেরে ভেজা চুল নিয়ে কফি হাতে ছাদে চলে এলাম।

কিন্তু এখানে চলছে আরেক নাটক। গিটারের টুংটাং শব্দ তুলে জোৎস্না ঝরানো নিরব পরিবেশটাকে মাতিয়ে রেখেছে নিহাদের ভদ্রম্যান। তাকে ঘিরে গোল হয়ে জমেছে মেয়েদের মেলা। কমপক্ষে বিশজনের মতো মেয়ে এইখানে উপস্থিত হবে। কিন্তু ঈশান তো আমাকে বলেছিল সে নাকি মেয়েদের সংস্পর্শেই যায়না? তার নাকি বিরক্ত লজ্জা দুটোই প্রবল! তাহলে এখন আমি কি দেখছি? ছি, সব পুরুষ মানুষ এক।

আমি ছাদের একপাশে দাঁড়িয়ে কফিতে চুমুক দিতে লাগলাম৷ আর বলতে কি, ঈশানের উপরেও টুকটাক নজর রাখছি। সে অবশ্য এখনও আমাকে লক্ষ্য করেনি। এটাই মজা। আমিও নিজেকে আড়াল রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছি। একটা বিষয় নিয়ে আপাতত আমি ভীষণ ক্ষিপ্ত। ঈশান এতোরাতে ছাদে কেনো এলো? সে কি জানতো না ছাদের সাইড মেয়েদের জন্য বরাদ্দ? নাকি ইচ্ছে করেই এসেছে, কু মতলব নিয়ে! বাগানে তো তন্ময়, জারিফ, ফাহিম, সিয়াম, রিফাত সব ভাইয়ারা আছেন। ঈশান সেখানে কেন গেল না? অবশ্য যাবেই বা কিভাবে? সে তো মেয়েদের সাথে ন্যাকামোতে ব্যাস্ত। হুহ!

তারপর হঠাৎ করে একটা বিষয় আমার মাথায় নাড়া দিল। ছেলেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আজরাতে তারা ড্রিংক করার মাস্টারপ্ল্যান সাজিয়েছিল। সেইটা কি তবে সাকসেসফুল? আর সেই সুবাদেই ঈশান এখানে? সে মদ্যপান করবে না বলে নিজেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে যদি ছাদে এসে থাকে, তাহলে ঠিকাছে। কিন্তু মেয়েদের সাথে এমন ন্যাকামি আলাপে মেতে উঠার বিষয়টা একদম ঠিক নেই। আমার তো ইচ্ছে করছে প্রত্যেকটা মেয়ের চুল টেনে টেনে ছিঁড়তে। তারপর ঈশানের ঘাসের মতো চুলও ছিঁড়ে ফেলতে।কিন্তু কি করার? বেশি সংখ্যক মেয়েই আমার ক্লাসমেট। আর বাকি যারা আছে তারা সিনিয়র। চাইলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারি না। তাছাড়া আমার আর ঈশানের ভেতরকার সম্পর্কটাও নিহা বাদে এখানে কেউ জানে না।

আমি কফি খেতে খেতে হঠাৎ নিচের দিকে তাকাতেই যেটা দেখলাম, তাতে আমার চোখ নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও ঘুচে গেল। নাশফী আপু আর জারিফ ভাইয়ার প্রেমলীলা চলছে। একদিন হলিউডের নায়ক-নায়িকার মতো তারা একে-অন্যকে কিস করছে। আমি বুঝলাম না এরা কি সত্যিই হলুদের অনুষ্ঠানে এসেছে নাকি হানিমুনে? যে যার মতো যেটা ইচ্ছে করে যাচ্ছে। নিহা বলে না অভদ্র সোসাইটি? এইবার বুঝতে পারছি কেনো বলে। আমি আবার সামনের দিকে ঘুরে তাকালাম। তখন দেখলাম, অন্তরা ঈশানের চুল ঝেড়ে দিচ্ছে। সামিরা গাল টিপে দিচ্ছে। রিদিতা সেলফি তুলছে। হে আল্লাহ, এসব দেখার চেয়ে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মরে যাই তাও ভালো। আমি কফিটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কফি খাওয়া শেষ হলেই চলে গেলাম নিহার ঘরে, ঘুমাতে।

রাত চারটা না ভোর চারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে ঘড়ির কাটায় চারটা বাজে। চোখ ভেঙে ঘুম আসছে আমার। কিন্তু ঘুমানোর উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছি না। নিহা সেলফিশের মতো দরজা আটকে ঘুমিয়ে পড়েছে। হাজার ডেকেও তাকে জাগানো গেল না। আমি হাতে একটা বালিশ নিয়ে ঘুমো ঘুমো চোখে হাঁটছি। এতোবড় বাড়ি, অথচ আমার মতো ছোটোখাটো একটা মানুষের শোয়ার জায়গা হচ্ছে না। কি অদ্ভুত!
ড্রয়িং রুমের পেছন দিক থেকে ফ্লাশলাইটের আলো জ্বলছে। কেউ কি দাঁড়িয়ে আছে? মনে হচ্ছে আমাকে উদ্দেশ্য করেই কেউ লাইট মারছে। আমি মুখে চিন্তার ভাজ নিয়ে এগিয়ে যেতেই ঈশানকে খুঁজে পেলাম। দরজার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। আমি কোমরে এক হাত গুজে প্রশ্ন করলাম,” এখনও ঘুমাননি কেন?”

ঈশান বলল,” তুমিও তো ঘুমাওনি।”

” আমি ঘুমানোর জায়গা পাচ্ছি না।”

” এদিকে এসো।”

আমার হাত ধরে একটা ফাঁকা ঘরে নিয়ে এলো ঈশান। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,” ওয়াও, এই ঘর তো আমি আগে দেখিনি।”

ঈশান দরজা বন্ধ করতেই আমি আৎকে উঠে বললাম,” এসব কি হচ্ছে? দরজা খুলুন।”

ঈশান আমার কাছে এসে কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,” কেন? ভয় পাচ্ছ?”

আমি আত্মবিশ্বাসী গলায় বললাম,” না। কিসের ভয়? কিন্তু দিজ ইজ নট ফেয়ার।”

ঈশান ফিসফিস করে বলল,” এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।”

আমি তাকে ধাক্কা মেরে বললাম,” আজাইরা!”

ঈশান কাছে এসে আমাকে হঠাৎ কোলে তুলে ফেলল। আমি ডাঙায় তোলা মাছের মতো তড়পাতে লাগলাম। আতঙ্কিত হয়ে বললাম,” আমাদের কেউ দেখে ফেললে খবর আছে।”

ঈশান শান্ত গলায় বলল,” কেউ দেখবে না, তারিন৷ সবাই এখন ঘুমাচ্ছে।”

” তাই বলে আপনি এসব করবেন?”

ঈশান আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ঘোরমাখা কণ্ঠে বলল,” হলুদ ড্রেসে তোমাকে একদম সানফ্লাওয়ারের মতো লাগছে।”

তারপর সে আমাকে বিছানায় এনে শোয়ালো। আমি ছটফট করে বললাম,” ঈশান, প্লিজ স্টপ।”

ঈশান আমার চুলে মুখ ডুবিয়ে বলল,” এই সানফ্লাওয়ার,তুমি কি মধু খাও? এতো মিষ্টি কেন?”

” সত্যি করে বলুন তো, কি খেয়েছেন?”

” কিছু না। কিন্তু এখন খেতে ইচ্ছে করছে, তোমাকে।”

জানি না তখন আমার কি হয়েছিল। আমি ধপাশ করে ঈশানের গালে চড় মারলাম৷ আমার চড় খেয়ে ঈশান হতভম্ব; হতভম্ব আমি নিজেও। ঈশান ধীরে ধীরে উঠে বসল। আমিও উঠলাম। আলতো কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম,” স্যরি।”

ঈশান কোনো জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমি বেশ খানিকক্ষণ ওভাবেই বসে রইলাম। মাথাটা পুরো ফাঁকা লাগছিল। কি থেকে কি হয়ে গেল এসব! যে হাতে চড় মেরেছি সেই হাতটা ব্যাথা করছে, জ্বালাপোড়া করছে। তার থেকেও বেশি জ্বালাপোড়া করছে আমার মনে। জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিলাম আমি।

সকাল থেকেই নিহাদের বাড়ির পরিবেশ রমরমে হয়ে আছে। হাজার হাজার চেনা পরিচিত মানুষের ভীড়।কিন্তু এতো ভীড়ে আমি শুধু একটা মুখই খুঁজে বেড়াচ্ছি। ওই ঘটনার পর থেকে ঈশান আমার সাথে আর একবারও কথা বলেনি। প্রায় ৬/৭ ঘণ্টা কেটে গেছে। এটুকু সময়েই যেন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি মেনে নিতে পারছি না তার অবহেলা। যতবার তার সামনে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছি, সে নানা অযুহাতে আমাকে এড়িয়ে চলছে। আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে পর্যন্ত না। ব্যাপারটা আমার জন্য চুড়ান্ত কষ্টদায়ক!

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা, ঈশান মাহাথি ভাইয়ার সাথে ডেকোরেশনের লিষ্ট বানাচ্ছিল। সামিয়া, আনিকা, ওরাও সেখানে ছিল। অবশ্য এদের কাজই ঈশানের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করা। সকাল থেকেই দেখছি। আমি সামিয়া, আনিকার পাশে গিয়ে বসলাম। যদিও আমি ইচ্ছে করে যাইনি। ওরাই আমাকে ডেকেছিল। মেহেন্দির ডিজাইন চুজ করার জন্য। আমি ওখানে গিয়ে বসতেই ঈশান মাহাথি ভাইয়ার হাতে লিষ্ট ধরিয়ে চলে গেল। ঈশানের হুট করে চলে যাওয়ায় সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমিই তাকে ভাগিয়ে দিয়েছি। আমি চরম অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম।

একবার রুবা আন্টি মানে নিহার মা আমাকে বললেন ঈশানকে পুলসাইট থেকে ডেকে আনতে। জরুরি কাজ আছে। আমি খুশিমনে গেলাম। উদ্দেশ্য ছিল ঈশানকে একা পেলে আবার স্যরি বলব। আর প্রত্যাশিতভাবে একা পেয়েও গেলাম। সে ফোনে কারো সাথে কথা বলছিল, মুখে হাসি। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তার হাসোজ্জল মুখটা মেঘে ঢেকে গেল। আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইল। আমি সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের বাহু টেনে ধরলাম। কান্না জড়ানো কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম, ” স্যরি”। কিন্তু সে এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে চলে গেল। আমি উচ্চ গলায় বললাম, ” রুবা আন্টি আপনাকে খুঁজছেন।” ঈশান শুনল কি-না জানিনা। একটিবার পেছন ফিরে দেখলও না।

আমি উপলব্ধি করলাম, আমার গাল বেয়ে অশ্রুপাত হচ্ছে। এতোটা কষ্ট এর আগে কখনও হয়নি। কি দোষ ছিল আমার? কেনো এভাবে শাস্তি দিচ্ছে সে আমাকে? আমি তো নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত। ক্ষমাও চেয়েছি। যদিও তখন এইটা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলনা। সে যেটা করতে যাচ্ছিলেন সেটাও তো ভুল! তাহলে তারও কি আমার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ নয়? ভুল কি শুধু আমি একাই করেছি? সে নিজেও তো করেছে! তাহলে কিসের এতো অহংকার তার? আমি ঠিক করলাম, আর একবারও ক্ষমা চাইব না৷ সে কথা না বললে, আমিও বলব না। সুইমিংপুলের ভেজা ফ্লোরে বসে পড়লাম। টলটলে পানি পানিতে পা ভিজিয়ে।এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডাকল,

“তারি আপু, তুমি কি কর?”

আমি চট করে চোখের জল মুছে পেছনে তাকালাম। আরিশা কোমরে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা প্রচুর কিউট। বয়স ৫/৬ হবে। নিহার পিচ্চি কাজিন সে। এটুকু বয়সেও কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল মেয়েটার। ফরসা মুখে গাল দুটো টুকটুকে গোলাপী। ঠিক যেন সাদা পুতুল। দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। আমি আরিশার একহাত ধরে কাছে আনলাম। তাকে কোলের উপর বসিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে বললাম,

“আনিশা পরি, কেমন আছো তুমি?”

“আমি ভালো আছি। কিন্তু তুমি স্যাড কেনো তারি আপু?”

“কই স্যাড না তো! আমি খুব হ্যাপি! এইযে দেখো, আমি হাসছি।”

আরিশা অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। ঘন পলক ঝাকিয়ে বলল,

“আচ্ছা বুঝেছি। এখন বলো তো ঈশান কোথায়?”

আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, “ঈশান? ঈশানকে তুমি কেনো খুঁজছো বেবি?”

আরিশা ভ্রু কুচকে বলল, “ঈশান ইজ এল্ডার দেন ইউ। ইউ শুড কল হিম ভাইয়া। নট অনলি ঈশান।”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম। আমতা-অমতা করে বললাম, ” হ্যাঁ। ঠিকাছে। কিন্তু ঈশান তো তোমারও বড়। তুমি ভাইয়া বলছো না কেনো?”

আরিশা আমার কোল থেকে উঠে পরল। কোমরে হাত গুজে গম্ভীর গলায় বলল, ” তুমি আর আমি কি এক হলাম? ঈশান ইজ মাই ফিয়্যান্সে। আই ক্যান কল হিম ঈশান।”

আমি চোখ গোল করে তাকালাম,” মানে? ঈশান তোমার ফিয়্যান্সে?”

“হ্যা! মাম্মা বলেছে আমি যদি এক্সামে নাইন্টি পারসেন্ট মার্কস আনতে পারি, তাহলে ঈশানের সাথে আমার বিয়ে দিবে। ”

কথাটা শুনে আমার হিঁচকি উঠার উপক্রম। আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম,

” কিন্তু আরিশা বেবি! ঈশান তো তোমার ভাইয়া। ভাইয়াকে কি কেউ বিয়ে করে?”

আরিশা মাথা দুলিয়ে বলল, ” করাই যায়! ঈশান তো আমার কাজিন ভাইয়া। মানুষ তো কাজিনকে বিয়ে করেই। মাম্মা এন্ড বাপিও তো কাজিন ছিল। বাট দে আর কাপল নাউ। আমি আর ঈশানও কাপল হয়ে যাবো। ভেরি সুন! তোমাকেও দাওয়াত দিবো বিয়েতে। আমি আমার পারপেল লেহেঙ্গাটা পড়বো। তুমি তো খুব ভালো মেহেন্দি দিতে পারো রাইট? আমাকে বিয়ের দিন দিয়ে দিও?”

আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। আরিশা বলল,
“আচ্ছা এখন বায়। ঈশানকে খুঁজে দেখি। আমার জন্য চকলেট আনতে বলেছিলাম। যদি না আনে, তাহলে আজকেই ব্রেকআপ।”

শেষ কথাটা শুনে আমার হিঁচকি উঠেই গেল। মাথায় হাত দিয়ে উচ্চারণ করলাম, ” শাঁট, শাঁট! বালাইশাঁট! ”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here