#তুমিময়_আসক্তি_২
#আলো_ইসলাম (লেখিকা)
“২৭”
— কেটে যায় দুইমাস। এই দুই মাস রুদ্র বা দোলা কারো দেখা হয়নি। কিন্তু রুদ্রর পরিবারের সাথে প্রতিদিনই যোগাযোগ করা হয় দোলার। তানিয়া, রত্না চৌধুরী, তানভীর আহমেদ সবার সাথে কথা হয়৷ এমনকি তারা এসে এসে দেখে গেছে দোলাকে। কিন্তু দোলা একবারের জন্যও যায়নি রুদ্রর বাড়ি। আজ আশা আর রাজের বিয়ে৷ রাজ আর আশা দুজন দুজনকে প্রথম থেকেই পছন্দ করতো। এটা যখন সবাই জানতে পারে তখন সেটা বিয়েতে পরিণত দেয়। রাজের বাবা-মা নেই। অনেক আগেই মা/রা গেছেন তারা। রাজ তার চাচা-চাচির সাথে থাকতো। কিন্তু রাজের চাচিও গত হয়েছেন কয়েকবছর আগে। এখন মা হিসেবে সব দায়িত্ব রত্না চৌধুরীরই। রাজ দেখতে শুনতে ভালো, নিজস্ব ব্যবস্থা সব মিলিয়ে আশার পরিবার সন্তুষ্ট। তাই আর কোনো রকম আপত্তি জানাননি তারা।
– দুদিন বেশ হাসি আনন্দ! জমজমাট ভাবে কেটেছে। গায়ে হলুদ, মিষ্টি মুখ সব মিলিয়ে বেশ ভালো সময় যায়। দোলা দুদিন আগেই চলে এসেছে আশার বাড়ি। সাথে সজল ও রোকনও আছে। যেহেতু তারা কনে পক্ষ তাই এখানেই অবস্থান করছে। তানিয়া একসাথে দুটো বিয়ে উপভোগ করছে৷ কখনো রাজের বিয়ের উৎসব তো কখনো আশার বিয়েতে। একদিকে ভাইয়া আরেক দিকে ফ্রেন্ডের বিয়ে দুটোই যেনো ইঞ্জয় করছে খুব। রাজের বিয়েটা রুদ্রর বাড়ি থেকেই আয়োজন করা হয়। এই দুদিনে সজল আর তানিয়ার বেশ ভাব জমে উঠে। দেখামাত্র তারা দুজন দুজনকে একটা করে মুচকি হাসি উপহার দিয়ে গেছে প্রতিবারই। হয়তোবা ভালো লাগাও শুরু হয়ে গেছে দুজনের মধ্যে।
— আশাকে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। লাল টকটকে বেনারসি শাড়ি, ভারী গহনার ভার সাথে গাঢ় মেকাপের প্রলেপ। দোলাও আজ লাল শাড়ি পড়েছে। কারণটা আশা। আশার আবদারে লাল শাড়ি পড়ে দোলা। তাছাড়া দোলার লাল রং একদমই পছন্দ না(আমারও)। অনেক সুন্দর লাগছে দোলাকে লাল শাড়িতে
বর আসার অপেক্ষা এখন। হৈচৈ হট্টগোল বিয়ে বাড়ি জাঁকজমকপূর্ণ। বাচ্চাদের দৌড়ঝাপ বড়দের ছোটাছুটি সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ বিয়ে বাড়ি একটা। ব্যস্ত সময় যাচ্ছে সবার। বর যাত্রী আসবে তার আয়োজন চলছে। দোলার মধ্যে যেনো অস্থিরতা ভাব একটা। কারো জন্য দীর্ঘ প্রতিক্ষা৷ এই দুই-মাস রুদ্রকে না দেখতে পেয়ে দোলা যেনো মিস করতে শুরু করে। অপেক্ষা করছে রুদ্রকে একটিবার দুচোখ ভরে দেখার। রুদ্র আজ আসবে এই আশায় প্রতিক্ষীত দোলা। আচ্ছা উনি সত্যি আজ আসবেন তো? নিজের মধ্যেই প্রশ্নটা আওড়াই দোলা। নাহ আসবেন উনি! উনার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর বিয়েতে আসবে না এটা কি কখনো হয়। এইসব ভাবনায় মশগুল দোলা। কি রে এতো কি ভাবছিস শুনি? আশার কথায় ভাবনাচ্যুত হয় দোলার। মুখে মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে বলে তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে রে আশা। দোলার কথায় লাজুক হাসে আশা। এরপর আশাও মুচকি হেসে বলে লাল শাড়িতে দারুণ মানিয়েছে তোকে৷
– আচ্ছা বরযাত্রী কখন আসবে? হুট করে বলে উঠে দোলা। আশা ভ্রু কুচকে তাকায়৷ ওর তাকানো দেখে দোলা চকচকিয়ে উঠে বলে না মানে তানিয়া এখনো আসলো না৷ বর না আসলে তো সেও আসবে না। আশা দীর্ঘশ্বাস রেখে বলে মিস করছি তানিয়াটা কে। এরই মধ্যে পুরো বাড়ি জুড়ে একটি শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে। বর এসেছে বর এসেছে। সবাই যেনো নতুন করে ব্যস্ততার রঙে রঙ্গিন হয়। ছোট বড় সবাই বর দেখতে ছুটে। বরযাত্রীদের বসতে দেওয়া তাদের জন্য খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা এইসবে সবাই নতুনভাবে মেতে উঠে।
– আশার বুকের মধ্যে ধক করে উঠে কথাটা কর্ণপাত হতেই৷ দোলার মধ্যে আলোড়ন ফেলে দেয়। বর এসেছে কথাটা শুনে সে নড়েচড়ে বসে। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা দেখার অপেক্ষার অবসান হয় যেনো। আশার আশেপাশে থাকা আত্মীয় বা মেয়েরা ছুটে যায় বর দেখার জন্য। আশা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে আরো৷ নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়ে বসে।
– তুই বস আমি আসছি কথাটা বলে দোলা বেরিয়ে আসতে চাইলে আশা হাত চেপে ধরে দোলার। কৌতুহলী হয়ে বলে কোথায় যাচ্ছিস? দোলা হাসার চেষ্টা করে বলে বর সাঁজে রাজ ভাইয়াকে কেমন লাগছে দেখে আসি।
– রাজকে দেখার জন্য ছুটছিস নাকি অন্য কাউকে দোলা? চমকে উঠে দোলা আশার কথায়। ঘাবড়ে যাওয়া চোখে তাকিয়ে আমতাআমতা করে বলে কা-কাকে দেখার জন্য যাবো আবার? আমি তো রাজ ভাইয়াকে দেখতেই যাচ্ছি। নিজেকে শক্ত করে প্রকাশ করার চেষ্টা।
– তুই কেনো মিথ্যা বলছিস দোলা। আমি তোকে জানি তোকে বুঝি৷ তুই যে রুদ্র ভাইয়ার জন্য যাচ্ছিস এটা আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছি৷ আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড দোলা। সেই ছোট থেকে তোকে দেখছি আমি। তোকে চিনতে আমার অবশিষ্ট নেই।
– কি যা-তা বকছিস আশা তুই? এমন কিছুই না৷ আমি তো জাস্ট.. তুমি রুদ্র ভাইয়াকে মিস করছিস এবং তুই ভালো নেই রুদ্র ভাইয়াকে ছাড়া। তুই যে রুদ্র ভাইয়াকে ভালোবাসিস এটা কখনোই লুকাতে পারবি না তুই। দোলা অবাক চোখে তাকায় আশার দিকে।
– তুই যেমন ভালো নেই তেমন রুদ্র ভাইয়াও ভালো নেই তোকে ছাড়া। কেনো এমন করছিস দোলা। সবটা ঠিকঠাক করে নে-না৷ দেখ সবাই চাই তোরা একসাথে থাক আবার। সবার মধ্যে একটা হতাশার ছাপ তোদের জন্য। তুই কিন্তু চাইলেই সবটা মিটমাট করে নিতে পারিস৷ ভাইয়া তো অনুতপ্ত তার কাজের জন্য তাহলে কেনো এমন শাস্তি দিচ্ছিস৷
– চুপ কর আশা৷ দয়া করে এই ব্যাপারে আর কোনো কথা বলিস না। জীবনটা আমার তাই আমাকেই বুঝতে দে সব কিছু। আশা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে একটা দোলার কথায়৷ এর মাঝে তানিয়া উপস্থিত হয় সেখানে। তানিয়া সাদা শাড়ি পড়েছে আজ। তানিয়াকে দেখে দোলা একটা হাসি রাখে৷ আশাও মুচকি হাসে। তানিয়া মুখের হাসিটা গাঢ় করে বলে কি অবস্থা কনের?
– তোমাকে তো শুভ্র পরী লাগছে তানিয়া। হেসে বলে দোলা। আচ্ছা! আর তোমরা যে লাল পরী হয়ে আছো এটা বলো। ভাবি তোমাকে কিন্তু দারুণ লাগছে লাল শাড়িতে৷ তানিয়ার কথায় আশা মুখটা মলিন করে বলে শুধু দোলাকেই ভালো লাগছে আর আমি? ওর কথায় তানিয় আর দোলা ফিক করে হেসে উঠে।
– তুমি আজকে সবচেয়ে সুন্দরী হয়ে আছো। বিয়ের কনে বলে কথা৷ আশা লজ্জায় নুয়ে পড়ে যেনো। আচ্ছা তোমরা কথা বলো আমি আসছি একটু বলে দোলা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে । কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে।
– রাজকে তার আসনে বসানো হয়েছে৷ কিছুক্ষণ পর আশাকেও নিয়ে আসা হবে। দোলা দূর থেকে রুদ্রকে খুঁজছে৷ কিন্তু রুদ্রকে কোথাও দেখা যায়। রাজ আর তার কিছু বন্ধুরা কথা বলছে আর হাসাহাসি করছে৷ রাজ যেনো শুধুমাত্র দায়িত্ব পালনে মুখে হাসিটা বজায় রেখেছে। তার হাসির মধ্যে শুভ্রতা নেই আছে শুধুই মলিনতা। কিন্তু কেনো?
– উনি কি তাহলে আসেনি? দেখতে পাচ্ছি না কেনো?
পরোক্ষে হকচকিয়ে উঠে দোলা! কি হয়েছে আমার? আমি উনাকে নিয়ে এতো ভাবছি কেনো? আমার তো উনাকে নিয়ে ভাবার কথা নয়। তাহলে কেনো হচ্ছে এমন আমার সাথে। না না এমন ভেঙে পড়লে চলবে না৷ আমি কারো জন্য অপেক্ষা করবো না। নিজেকে নিজেই বোঝায় দোলা। নিজের কাছেও যেনো ধরা দিতে চাইনা সে৷
– ব্রোকে খুঁজছো ভাবি? হঠাৎ তানিয়ার এমন কথায় পিলে- চমকে পিছে তাকায় দোলা।
– ব্রো আসেনি ভাবি। আমরা অনেকবার বলেছি রাজ ভাইয়া অনেক রিকুয়েষ্ট করে কিন্তু লাভ হয়নি। ব্রো তোমাকে কথা দিয়েছে তোমার সামনে আসবে না তুমি না বলা পর্যন্ত! তাই সে আজ বিয়েতেও আসেনি।।কারণ ব্রো জানে এখানে আসলে তোমার মুখোমুখি হতে হবে৷ ব্রো দুর্বল হয়ে যাব তোমাকে দেখে। নিজেলে সামলাতে পারবে না। তাই সবচেয়ে কাছের বন্ধু তার বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়েটাও আসেনা সে। রাজ ভাইয়াকে দেখো ভাবি! আজকের দিনেও পুরোপুরি খুশি না মানুষটা৷ কারণ তার প্রিয় বন্ধুটাই কাছে নেই। আজকের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন তার প্রিয় বন্ধুটাকে বাদেই কাটাতে হচ্ছে।
– তানিয়ার কথায় দোলা আশাহত হয়। নতুন করে ভেঙে পড়ে আবারও। অপেক্ষার অবসান এইভাবে হবে ভাবেনি দোলা। চোখের মধ্যে পানি, নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা তার। চাপা আর্তনাদ হৃদয় জুড়ে।
— সুষ্ঠুভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে যায়। পুরোটা সময় দোলা চুপচাপ আর মনোক্ষুণ্ণ হয়ে ছিলো। কোনো কিছুই যেনো ভালো লাগছিলো না। তবে রুদ্রর প্রতি তার অনুরাগের জন্ম হয় নতুন করে। রুদ্রর এমন বিহেভ এই সিদ্ধান্ত নতুন করে অভিমানের সৃষ্টি করে দোলার মধ্যে। অভিমান বড়ই প্রকট। রাগের কিনারা থাকলেও অভিমান যেনো শক্ত ভীত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
—————————————————–
– প্রায় ১৬টা বছর অতিবাহিত হওয়ার পর!!
– বদলে গেছে সময় সেই সাথে বদলে গেছে অনেক কিছু৷ সময়ের হাত ধরে পরিবর্তীত সব কিছু। প্রকৃতি তার নতুন রুপে সেজে উঠেছে। শহর গুলো তাদের চাকচিক্যের ভীড়ে পুনরায় রঙ বদলাচ্ছে। সবাই এখন যে-যার মতো ব্যস্ত ঘর সংসার নিয়ে। পরিবার, কাছের মানুষগুলোর খেয়াল রাখা এইভাবে চলছে বেশ দিনগুলো। সময়ের হাত ধরে পরিবর্তন এসেছে দোলার মধ্যেও। চোখে গোল ফেমের চশমা জুড়ে গেছে, মাতৃত্ববোধ, আর দায়িত্বের ভার সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ একজন নারীতে গড়ে উঠেছে৷ রাশেদ মিয়া দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন বছর দুই আগে৷ রোকন, দোলা আর তার মেয়ে রোদ এই নিয়ে বেশ চলছে দোলার সংসার । দোলা সজলের অফিসে চাকরি করে। সজল নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ছোটোখাটো একটা ব্যবস্থা শুরু করেছিলো। যেটা আজ বৃহৎ আকার নিয়েছে। সফল ব্যবসায়ীদের মধ্যে সে একজন হয়ে নাম লিখিয়েছে। দোলা সজলের অফিসের ম্যানেজার পোস্টে আছে। তার কাজের দক্ষতায় আজ এতদুর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।
— মা! হঠাৎ চেনা কন্ঠস্বর পেতেই দোলা চমকে উঠে। সামনে তাকাতেই রাদের হাসিমুখ দেখতে পাই। দোলা সবে একটা ফাইল নিয়ে বসেছে চেক দেওয়ার জন্য। সময়টা দুপুরের পর। দোলা লাঞ্চ সেরে ফাইল নিয়ে বসে আর তখনই আগমন হয় রাদের৷
– রাদ মা তুই? চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে দোলা রাদকে। এতদিন পর মায়ের ছোঁয়া পেয়ে রাদও যেনো আপ্লুত হয়ে যায়। মায়ের সংস্পর্শ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে।
– তোমাকে অনেক মিস করছিলাম মা তাই চলে আসলাম। দোলা রাদকে ছেড়ে দিয়ে ভালো ভাবে দেখে বলে তুই আজও স্কুল থেকে এসেছিস রাদ? তোকে না কতবার বারণ করেছি এইভাবে আসবি না তুই। তোর আমার কাছে আসার হলে আমাকে বলতি নয়তো বাবাকে বলতিস৷ পাঠিয়ে দিতো গাড়ি করে। এইভাবে না বলে হুটহাট আসাটা ঠিক বল তুই? দোলার কথায় রাদ যেনো আনন্দ পাই৷ তাই মুখের হাসিটা গাঢ় করে বলে তুমি কি খুশি হওনি আমাকে দেখে৷ আমি যে তোমাকে মিস করছিলাম এটা দেখবে না। মুখটা এবার ফ্যাকাসে করে কিউট একটা ফেস ধরে বলে রাদ। দোলা আর মুখটা গম্ভীর করে রাখতে পারে না৷ হেসে উঠে বলে আচ্ছা যা হয়েছে হয়েছে। টিফিন খেয়েছিস তুই? মায়ের কথায় চমকে উঠে রাদ৷ ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আমতাআমতা করে বলে আসলে মা ইয়ে মানে! রাদের এই আমতাআমতা দেখে দোলা যা বোঝার বুঝে যায়।
– এবার আমি তোমায় খুব করে বকবো রাদ। আমি বলেছি তোমাকে এইভাবে আসবে না আমার কাছে৷ আর এসেছে ভালো কথা টিফিন খেয়ে তবে আসবে। কতটা সময় চলে গেছে খেয়াল আছে আর তুমি এখনো টিফিন খাওনি। রাদ বুঝতে পারছে দোলা প্রচন্ড রেগে গেছে এবার। কারণ দোলা যখনই রেগে যায় তখনই তুমি করে বলে।
– টিফিন খেতে গেলে তো দেরি হয়ে যেতো তোমার কাছে আসতে৷ তাছাড়া টিফিন পিরিয়ড শেষ হলে আমাকে কি আর বের হতে দেবে স্কুল থেকে। অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে রাদ। দোলা কিছুক্ষণ রাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে অনেক কথা হয়েছে এবার এসো খেয়ে নেবে। তোমাকে নিয়ে সত্যি আর পারিনা৷ দোলার কথায় রাদ খুশিতে উত্তেজিত হয়ে বলে আমি না ঠিক এই জন্য আরো খাইনি! কারণ আমি জানি তোমার কাছে আসলে তুমি আমায় খায়ে দেবে রাদের কথায় দোলা এবার সত্যি হেসে দেয়। এরপর রাদকে নিয়ে অফিসের ক্যানটিনে চলে যায়।
– বিদেশী ক্লায়েন্টের সাথে বড় একটা ডিল হচ্ছে রুদ্রর কোম্পানির। আর তারই মিটিং চলছে। রুদ্রর মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি বরং তার মধ্যে গাম্ভীরতার নতুনত্ব এসেছে। তবে রুদ্রর মধ্যে এখন দুটো মানুষ বাস করে। পরিবার, মেয়ের কাছে খুবই স্বাভাবিক আর সেনসিটিভ একটা মানুষ। কিন্তু বাইরে হার্ডলেস, গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ যেটা বরাবর সবাই জানে। রুদ্র সেই আগের মতোই আছে। তার এটিটুড তার মধ্যেকার যে এক্টিভিটি ছিলো সেটা আজও অক্ষত।
– বাবা” মিটিং চলাকালে রোদ ঢুকে পড়ে মিটিং কনফারেন্স রুমে। রোদকে দেখে রুদ্রর মুখে হাসি ফুটে৷ সবাই তো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রোদের দিকে। রাজের মুখে হাসি ফুটে রোদকে দেখে।
– রোদ মামনী এখানে মিটিং চলছে তুমি বাইরে এসো প্লিজ রুদ্রর পিএ বলে রোদকে। এতখন তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলো রোদকে এখানে আসা থেকে আটকাতে। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়৷ রুদ্রর মেয়ে যে রুদ্রর মতোই জেদি হবে এটাই স্বাভাবিক।
– ওহ আঙ্কেল তুমি যাও তো। আমি বাবার সাথে দেখা করতে এসেছি দেখা করে চলে যাবো। রুদ্র তার পিএ-এর দিকে তাকালে তিনি মাথা নিচু করে বলে স্যার আমি অনেক চেষ্টা করেছি রোদ মামনীকে আটকানোর কিন্তু সে আমার কোনো কথায় শুনেনি। এখানে চলে এসেছে।
– কে বলেছে তোমায় ওকে আটকাতে? রুদ্রর গম্ভীর কথায় ঘাবড়ে যায় তার পিএ।
– না মানে স্যার! আপনি তো বলেছিলেন মিটিং চলাকালীন কেউ যেনো ডিস্টার্ব না করে আপনাকে।
– কেউ মানে অন্য কেউ সেটা আমার মেয়েরা নয়। তোমাকে না বলেছি আমার মেয়েদের কখনো বারণ করবে না আমার কাছে আসতে আমি যেখানেই থাকি।
– সরি স্যার রুদ্রর কথায় আরো মাথা নুয়ে ফেলে।
” শাট আপ এন্ড গো নাউ। রুদ্রর কথায় পিএ চলে যায়।
– রোদের মুখের হাসিটা চওড়া হয়ে আসে আরো। সোজা গিয়ে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে। রুদ্র ও মেয়েকে সাদরে আগলে নেই।
– এটা কি করছেন মিস্টার চৌধুরী। এখানে অনেক বড় একটা ডিল হচ্ছে। কত গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে আর আপনি!
– বাকিটা রাজ সামলে নেবে। আপনারা ওর সাথেই সবটা ঠিক করে ফেলুন৷ রাজ মিটিংটা তুই এটেন্ড কর বলে রুদ্র রোদকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। সবাই যেনো হতভম্ব রুদ্রর কাজে। রাজ দাঁড়িয়ে যায়। এরপর মুচকি হেসে বলে কিছু মনে করবেন না৷ আসলে রুদ্র ওর মেয়েদের অনেক ভালোবাসে। সব কিছুর থেকে ইমপোর্টেন্ট ওর মেয়েরা ওর কাছে তাই কোনো কিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করে না ওদের। এবার মিটিং শুরু করা যাক তবে? রাজের কথায় সবাই একটা বড় নিশ্বাস ত্যাগ করে মিটিং-য়ে মনোযোগী হয়।
বাকিটা পরের পর্বে!!
#তুমিময়_আসক্তি_২
#আলো_ইসলাম(লেখিকা)
“২৮”
–রুদ্র মেয়েকে নিয়ে তার কেবিনে আসে। চেয়ারে বসতেই রোদ রুদ্রর গলা জড়িয়ে ধরলে রুদ্র বলে আজ আবারও স্কুল থেকে এসেছো। যদি মা জানতে পারে তাহলে কিন্তু খুব রাগ করবে মামনী। রুদ্রর কথায় রোদ ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলে উহু মা কিছু বলবে না। কারণ মা এখন তার আরেক মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত। রোদের কথায় রুদ্র ভ্রু কুচকে সন্দিহান হয়ে বলে তার মানে রাদ দোলার কাছে গেছে?
– হুম আমি আর রাদ প্ল্যান করে টিফিন পালিয়েছি কথাটা বলে স্বার্থক হাসি দেয় রোদ।
আচ্ছা তার মানে দুই দুষ্টু বুড়ি যুক্তি করে এই কাজ করেছো। কিন্তু মামনী তোমরা স্কুল থেকে আসলে কীভাবে। আমার জানা মতে তোমাদের স্কুল থেকে তো পালানোর সুযোগ নেই৷ রুদ্র বিস্ময় রেখে বলে।
– ওহ বাবা সে অনেক কাহিনি। বাদ দাও তো। আচ্ছা তুমি কি খুশি হওনি আমাকে দেখে মুখটা মলিন করে বলে রোদ। রুদ্র হাসে রোদের এমন বাচ্চামো দেখে।
আমার মা এসেছে আর আমি খুশি হবো না তাই কখনো হয়েছে যে আজ হবে সেটা৷ অনেক খুশি হয়েছি মা তোকে দেখে।
– রোদ আবারও সাদরে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে বলে আমিও হ্যাপি তোমাকে দেখে৷ অনেক মিস করছিলাম তোমায় আমি। তাই তো এইভাবে চলে আসলাম।
– তবে এটা একদম ঠিক নয় মামনি। যদি রাস্তায় কোনো বিপদ তখন কি হবে? তাছাড়া তোমার মা কিন্তু কষ্ট পাবে এইভাবে স্কুল ফাঁকি দিয়ে আসলে। তোমার যদি আমার কাছে আসতে ইচ্ছে করে আমাকে ফোন দিয়ে বলতে। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।
– তুমি কি এখন আমায় বকবে বাবা। আদর করবে না? গাল ফুলিয়ে বলে রোদ। রুদ্র আর কি করবে। মেয়েরা তো তার প্রাণ ভোমরা। মেয়েদের দুষ্টামি গুলো বেশ উপভোগই করে সে।
– আচ্ছা মামনী খেয়েছিস তুই কিছু? রুদ্রর কথায় রোদের মুখের হাসিটা মিলিয়ে যায়। রুদ্র ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে বলে টিফিন কোথায় দেখি?
– আসলে বাবা আমার টিফিনটা আমার একটা বন্ধুকে দিয়ে এসেছি। মাথাটা নিচু করে নুয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে রোদ।
দিয়ে এসেছো মানে? রুদ্রর কথায় রোদ বলে আসলে বাবা ওর খাবার টা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তো আমি যখন খাবোই না। তোমার কাছে আসছি তাই আমার খাবার টা ওকে দিয়ে এসেছি খেতে।
মেয়ের কথায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রুদ্র রোদের দিকে। এরপর মুচকি হেসে বলে কিন্তু না খেয়ে থাকলে তো শরীর খারাপ করবে মা। অনেকটা সময় চলে গেছে। চল আমি তোকে খাওয়াবো এরপর রুদ্র রোদকে নিয়ে ক্যানটিনে যায়। রোদ ও রুদ্রর সাথে হাসতে হাসতে চলে যায়।
আসুন এবার বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক!!!
–” রুদ্র আর দোলা কেউ কারো মুখোমুখি হয়নি এত বছরেও। তবে রুদ্র সব সময় দোলার খবর রেখেছে দূরে থেকে। দোলা যে রুদ্রর জন্য কখনো ভাবেনি বা ভাবেনা তা নয়। তবে দুজনই যেনো দুমেরু থেকে দুজনের সাথে আছে৷ শরীর দুইটা আলাদা থাকলেও হৃদয় যেনো সেই এক জায়গায় আবদ্ধ। শুধু কাছে আসাটাই হয়ে উঠেনি তাদের। একটা সম্পর্কে যদি ইগো নামক শব্দটা প্রবেশ করে তাহলে সে সম্পর্কের দুরত্ব টা বৃদ্ধি পাই সব সময়। ইগো শব্দটা যেনো একটা সম্পর্কে বিষবৃক্ষ ন্যায়। তেমন রুদ্র আর দোলার সম্পর্কে ইগো নামক শব্দটা জেঁকে বসে গেছে৷ যার ফলে তাদের আর কাছাকাছি আসা হয়ে উঠেনি কখনো। অবশ্য রুদ্রর দিক থেকে অপরাধ। যার ফলে সে কখনো আর দোলার সামনে আসার সাহস পাইনি৷ রুদ্র ভেবেছে দোলা একদিন হুট করে তার সামনে এসে দাঁড়াবে আর বলবে সব অপরাধের শাস্তি শেষ এবার একসাথে থাকা যাক। কিন্তু সেটা হয়নি যার ফলে তার অপেক্ষাও শেষ হয়নি।
তবে দোলা! দোলার মধ্যে বিষয় টা ছিলো আগে-পরে যাকে সহজ ভাবে আমরা ইগোতে চিনি। আবার সেই সাথে জুড়ে আছে অভিমান। দোলার মতে রুদ্র তার কাছে আগে আসবে আবারও বলবে সম্পর্কটা ঠিক করতে। দোলা তখন আর রুদ্রকে ফেরাবে না। কিন্তু সে কোনো ভাবেই আগে রুদ্রর সামনে যাবে না আর না বলবে চলো আবার সব ঠিক করে আমরা পাশাপাশি চলি একসাথে থাকি। দুজন মানুষের দু’ভাবনায় সম্পর্কটা ছন্নছাড়া হয়ে উঠে৷ যার জন্য এতটা সময় পরেও তারা এক হতে পারেনি৷ তবে রুদ্রর পরিবারের সাথে দোলার সম্পর্ক বরাবরই স্বাভাবিক আর নিবিড়। তেমন রুদ্রর ও দোলা বাদে সবার সাথে সম্পর্কটা ভালো। শুধু আসল দুজন মানুষেরই বোঝাপড়াটা হলো না৷ সত্যি বলতে বেশি বাড়াবাড়ি জিনিসটা কখনোই ভালো না৷ আবার বেশি বেশি কোনো জিনিস কখনোই সুফল বয়ে আনে না । রুদ্র আর দোলার যে দুরত্ব এটা সত্যি প্রকারের বাড়াবাড়ি বা বেশি বেশি। যার জন্য তাদের মধ্যেকার বন্ধুত্ব, পবিত্র বন্ধন সব আজ ঠুনকো হয়ে ইগো আর অপরাধের কাছে হেরে গেছে।
– দোলার জমজ বাচ্চা হয়৷ আর দুইটাই মেয়ে সন্তান। যাদের সম্পর্কে ইতি মধ্যে আপনারা জেনেছেন। রুদ্রর দুইটা মেয়ে সন্তান হয়েছে শোনার পর রুদ্রর মধ্যে যে খুশির আমেজ যে আনন্দ ছিলো সেটা প্রকাশ করার মতো না৷ দোলার ডেলিভারির আগ মুহুর্ত পর্যন্ত রুদ্র যেনো ছটফট করে গেছে৷ দোলার কষ্টে সেও যেনো অংশীদার ছিলো এমন একটা অনুভূতি ছিলো তার মধ্যে। রুদ্র আড়ালে থেকে সবটা করে গেছে দোলার জন্য। বেবি হওয়া পর দোলা প্রস্তাব রাখে রুদ্রকে একটা সন্তান দিতে চাই আর একটা সন্তান তার কাছে রাখতে চাই। তখন রুদ্র রাজী হয়না৷ তার মতে দুইটা মেয়েই দোলার কাছে থাকবে। কারণ মা-হারা কোনো ভাবেই করতে চাইনা রুদ্র তার মেয়েদের। রুদ্র ভেবেছিলো বেবি হওয়ার পর হয়তো দোলা সবটা মানিয়ে নেবে সন্তানদের জন্য হলেও। কিন্তু তখনো রুদ্রর ভাবনা ভুল ছিলো। দোলা কখনো নিজ থেকে ধরা দিতে আসেনি তার কাছে। একদিকে দোলার অনুপস্থিতি আরেক দিকে সন্তানদের আহাজারি সব কিছু মিলিয়ে রুদ্র যেনো আবারও উন্মাদ হয়ে যায়। দূর থেকে সন্তানকে দেখে আসা! আবার কখনো রত্না চৌধুরীকে দিয়ে নিয়ে আসতো ওদের। এইভাবে যায় এক বছর। কিন্তু রুদ্রর মধ্যে তার সন্তানদের জন্য ভালোবাসা মায়া বাড়তে থাকে দিন দিন। এটা যখন দোলা খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে পারে তখন আবারও দোলা বলে একজন কে নিয়ে যেতে। এবং সে সাথে জুড়ে দেয় বেশ কিছু অজুহাত।
– যেহেতু দোলার পড়াশোনা শেষ হয়নি। তাই কোনো চাকরি আপাতত সে করতে পারছে না। দ্বিতীয়ত রাশেদ মিয়া প্রায় অসুস্থ থাকায় ঠিক ভাবে কাজ করতে পারে না। রুদ্রর অফিস থেকে অনেক আগেই রিটায়ার নিয়েছে সে। রুদ্র চেয়েছিলো দোলার পরিবারের দায়ভার নিতে কিন্তু দোলা কখনো রাজী হয়নি। তাই দোলা জানায় যে একসাথে দুই সন্তানের খরচ বহন করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাই রুদ্র যেনো একজনকে নিয়ে যায়। আসলে এটা ছিলো সম্পুর্ণ মিথ্যা যেটা রত্না চৌধুরী খুব ভালো করে বুঝে গিয়েছিলো। দোলা চাইছিলো রুদ্র যেনো একজন কে তার কাছে রাখে। যাতে করে সে সুখে থেকে তার একটা সন্তানকে নিয়ে। একজন মা যতই অভাবী হোক না কেনো সন্তান কখনোই তার কাছে বোঝা হয়না। কিন্তু রুদ্রর জন্য এ-রুপ কথা বলতে হয় দোলাকে। রুদ্র সেটাই বিশ্বাস করে নেয় পরে। কারণ দোলাদের অবস্থা সত্যি ভালো ছিলো না সে-সময়। আবার রুদ্রর থেকেও কোনো রকম সাহায্য নিতে নারাজ ছিলো দোলা। তাই রাদের যখন এক বছর বয়স তখন রুদ্র তাকে নিয়ে চলে আসে তার কাছে। এরপর থেকে রোদ আর রাদ আলাদা হয়ে যায়। রুদ্রর দুই মেয়ের নাম রোদেলা চৌধুরী আর রুদ্রাণী চৌধুরী। সবাই ছোট করে রোদ আর রাদ বলে ডাকে। রোদ থাকে মায়ের কাছে আর রাদ তার বাবার কাছে। এইভাবেই চলছে তাদের সংসার তাদের জীবন। তবে দুই মেয়ে যাতে কখনোই বাবা-মায়ের অভাব ফিল না করে তাই তাদের জন্য রুদ্র বা দোলার কাছে আসা নিয়ে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। রোদ আর রাদ যখন থেকে একটু করে বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই দুজন যাওয়া আসা করে। রত্না চৌধুরী বা তানিয়া ওদের নিয়ে আসতো দিয়ে আসতো আবার দোলা নিজেও কখনো এসেছে৷ এইভাবে রোদ আর রাদ দুজন দুজনের ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে৷ তাদের সম্পর্কে যেনো বোনের না। খুব ভালো একটা বন্ধুত্বের। রোদ আর রাদ সবে অষ্টম শ্রেণীতে। রোদের তুলনায় রাদ অনেক দুষ্টু প্রকৃতির।
–সজল দোলাকে অনেক ভাবে সাহায্য করেছে। যার ফলে দোলা পড়াশোনা শেষ করে আজ এই পজিশনে আসতে পেরেছে। তানিয়া আর সজলের বিয়ে হয়েছে প্রায় ১৩ বছর হলো। ওদের ঘরেও একটা মেয়ে সন্তান আছে যার নাম তানজিলা। রাজ আর আশা বাইরে আছে। রাজ কোম্পানির কাজের জন্য এখন বাইরে থাকে বেশি। রাজ আর আশার একটা ছেলে সন্তান হয়। যার নাম আবির। সবাই বেশ ভালোই আছে স্ত্রী সন্তান নিয়ে৷ শুধু রুদ্র আর দোলার সম্পর্কটায় বিচ্ছেদে কাটিয়ে দিলো।
–” মা আমরা একসাথে থাকবো কবে? রোদ আমি বাবা তুমি কবে একসাথে হবো? হঠাৎ রাদের এমন কথায় চমকে উঠে দোলা। এটা যে আজ প্রথম শুনছে দোলা এমন নয়। প্রায় রোদ আর রাদ এমন কথা বলে আর দোলা ততবারই এড়িয়ে যায় কথাগুলো।
– দোলাকে চুপ থাকতে দেখে রাদ দোলার হাত ধরে ঝাকিয়ে বলে ওমা বলো না৷ কবে আসবে তুমি আমাদের বাড়ি। আমার ভালো লাগে না তোমাকে ছাড়া থাকতে। রোদের সাথে স্কুলে দেখা হয় শুধু আর মাঝে মাঝে ওই বাড়িতে গেলে। আমরা তো চাইলেই একসাথে থাকতে পারি মা। তাহলে কেনো তুমি আর রোদ আলাদা থাকো। জানো মা বাবাও ভালো নেই। তোমার ছবিকে দেখে প্রায় যেনো কি বলে আর কাঁদেও। আমি না বাবাকে অনেক বার কাঁদতে দেখেছি জানো৷ কিন্তু বাবা সবার সামনে এমন ভাবে থাকে যেনো বাবা খুব সুখী। এতটুকু মেয়ের মুখে এই কথা প্রায় শুনতে আর ভালো লাগে না দোলার৷ বুকটা যেনো ভারী হয়ে আসে। নিশ্বাসটাও আটকে আসে মাঝে মাঝে৷ এদিক থেকে রাদের বায়নাটা বেশি হয়েছে৷ রোদ যখন বলে তখন দোলা ধমকিয়ে চুপ করিয়ে দেয় বা অন্য কিছু বলে সে কথা চাপা দেয়৷ কিন্তু রাদকে দোলা চাইলেও বকতে পারে না৷ কারণ একে তো রাদ দূরে থাকে দোলার থেকে তাছাড়া মায়ের প্রতি যে তার অন্য রকম একটা ভাবনা আছে এটা দোলা বেশ ভালোই উপলব্ধি করতে পারে।
– রাদ সোনা৷ আমার একটা জরুরি কাজ আছে। তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও৷ এরপর তোমাকে মামা দিয়ে আসবে বাড়ি কেমন। ( রোকনও এই কোম্পানিতে চাকরি করে) রাদ মনটা খারাপ করে মাথা নিচু করে হ্যাঁ বলে। দোলা রাদের দিকে তাকিয়ে এক ফোঁটা পানি ফেলে আবার সেটা সঙ্গে সঙ্গে মুছেও ফেলে।
— রোদ মামনী খাবার খেয়ে তুমি বাড়ি যাবে কেমন? আমি তোমায় গাড়ি করে পাঠিয়ে দেবো। এরপর আমাকে আরেকটা মিটিং এটেন্ড করতে হবে। সামনে তো ফ্রাইডে আছে৷ আমি তোমাকে সেদিন নিয়ে আসবো ওকে?
তুমি যাবে আমাকে আনতে বাবা? রোদের কথায় ঘাবড়ে যায় রুদ্র। ভীতো চোখে তাকিয়ে সংকীর্ণ কন্ঠে বলে আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো মামনী।
– বাবা! তুমি আর মা কবে একসাথে হবে? রোদের একই প্রশ্নে থমকে যায় রুদ্র। অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে।
– জানো বাবা আমার না খুব ইচ্ছে করে তুমি মা রাদ আমরা একসাথে থাকবো। সবাই মিলে কত আনন্দ করবো। দাদিমা থাকবে আমাদের সাথে। সবার বাবা-মা একসাথে থাকে শুধু তুমি আর মা আলাদা। কিন্তু কেনো বাবা?
– রুদ্র চোখ ফিরিয়ে নেয় রাদের দিক থেকে। চাপা আর্তনাদ রুদ্রর মধ্যে।
– বাবা বলো না। কেনো আলাদা থাকো তোমরা? আবারও একই প্রশ্নে রুদ্র উঠে দাঁড়ায়। হাত ধুয়ে রোদকে ধরে উঠিয়ে বলে মামনী আমার মিটিং-এর সময় হয়ে গেছে৷ আজ তুমি যাও৷ আমি তোমাকে আবার নিয়ে আসবো। রোদও মন খারাপ করে হুম বলে রুদ্রর সাথে এগিয়ে আসে।
— এভাবে যায় আরো কয়েকটি দিন। আজ শুক্রবার। দোলার অফিস ছুটি। রোদ বায়না জুড়েছে ও বাড়ি যাবে। কারণ তানিয়া আসছে সেখানে আজ। যদিও তানিয়া ফোন দিয়ে দোলাকে যেতে বলে রুদ্রর বাড়ি। কিন্তু দোলার কিছু কাজ থাকায় যেতে পারবে না বলে। কিন্তু এটা রোদ শোনার পর থেকে একগুঁয়ে হয়ে বসে আছে৷ দোলাকে নিয়ে ওই বাড়ি যাবেই যাবে।
-আপু এমন করছিস কেনো যা-না ঘুরে আয়। তাছাড়া আন্টিও খুশি হবে তোকে দেখে। সেই তো অনেক দিন হলো এসেছিস ও বাড়ি থেকে। আন্টির শরীর খারাপ থাকায় সেও এখন আসতে পারে না তেমন। রোকনের কথায় আহত চোখে তাকায় দোলা। কারণ আজ ছুটির দিন হওয়াতে রুদ্রও আছে বাড়িতে। দোলা যতবার ওই বাড়ি গেছে ততদিন রুদ্র অফিসে ছিলো। দোলা কোনো ভাবেই রুদ্রর সামনে পড়তে চাইনা।
— তুই নিয়ে যা-না ভাই। আমার অনেক কাজ হাতে। একটা দিন পাই ছুটি। কত কাজ থাকে বাড়িতে জানিসই তো। দোলার কথায় রোকন শার্ট গায়ে দিতে দিতে বলে আমি বাইরে যাচ্ছি আপু। আমার একটা কাজ আছে। তুই নিয়ে যা রোদকে। নাহলে কিন্তু ও মন খারাপ করে থাকবে। পরে তোরই ভালো লাগবে না। কথাটা বলে রোকন বেরিয়ে যায়।
-দোলা ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রোদকে বলে রেডি হতে। অনেক দিন হলো রত্না চৌধুরীর সাথে দেখা নাই। শুধু ফোনেই যা কথা হয়৷ তাই দোলা আর না করলো না আজ।
— তানিয়া এসেছে কিছুক্ষণ আগে৷ সাথে তানজিলাও আছে৷ সজল বিকেলে এসে নিয়ে যাবে ওদের সেই সাথে বেড়িয়ে যাবে এখানে থেকে । তানভীর আহমেদ অনেক দিন পর মেয়ে আর নাতনি কে পেয়ে উৎফুল্ল।
— রুদ্র ওর ঘরেই ছিলো তানিয়া আসায় রাদ গিয়ে ডেকে আনে। সবাই মিলে ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছে। রত্না চৌধুরীর শরীরটা তেমন ভালো যায় না আজকাল। কারণ টা বয়স বাড়ার ফল। অতঃপর আগমন হয় দোলা আর রোদের। বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতেই রাদ দোলাকে দেখতে পাই। মা বলে চিৎকার করে উঠলে সবার দৃষ্টি সেদিকে যায়। রুদ্র আর দোলার চোখাচোখি হয়ে যায় পুনরায়। দীর্ঘ দিন পর দুজন দুজনের চোখে চোখ রাখলো আজ। রুদ্র তো হতভম্ব হয়ে গেছে দোলাকে সামনে থেকে দেখে। দোলা সে যেনো বাকরুদ্ধ, নিশ্বাস আঁটকে আসা ভাব। তানিয়া, রত্না চৌধুরী, তানভীর আহমেদের মুখে চওড়া হাসি দোলাকে দেখে। রোদ ছুটে এসে রত্না চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে দাদিমা বলে। রত্না চৌধুরী রোদের কপালে একটা ভালোবাসার পরশ দেয়। তানজিলা ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে আছে শুধু। তবে রোদকে দেখে সেও খুশি অনেক।
— রুদ্রর দিক হতে দোলা চোখ সরিয়ে নেয় আগে। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার ভঙ্গি । রুদ্র এখনো একই ভাবে তাকিয়ে আছে দোলার দিকে। কতদিনের পিপাসা যেনো আজ তৃপ্তি নিয়ে মেটাচ্ছে রুদ্র।
– চলবে…..
❌❌