তুমি অতঃপর তুমিই
২৭
Writer Taniya Sheikh
মুখোমুখি তিনজন বসে আছে লিভিং রুমে। সবার মুখ গম্ভীর, ম্লান। মোবারকের সকল ভাবনা এলোমেলো হয়ে আসছে৷ শানের মুখের দিকে চাইতেও তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। একটা মানুষ যখন দ্বারে দ্বারে ধোঁকা আর অবহেলা পায় তখন কেমন লাগে! মোবারকের ভাবতে তো বুক কাঁপে। ইমা সেই যে নত মুখে বসে আছে তো আছেই। মোবারক মৃদু কেশে গুমোট গম্ভীরভাব কাটানোর চেষ্টা করে। ইমা অসহায় মুখটা তুললেও শান আগের মতোই চোখ বন্ধ করে কপাল ধরে বসে আছে। আড়চোখে শানের দিকে তাকায় ইমা। চোয়ালের পেশি টান টান, ঠোঁট শক্ত করে বসে আছে সে। গত চারবছরের বিশ্বাস এক নিমেষেই ভেঙে গেল আজ।এই মিথ্যা বিশ্বাসের যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আনন্দ যেমন হচ্ছে, তেমনি কষ্টও হচ্ছে মিথ্যা আঁকড়ে ধরে থেকেছিল বলে। একে একে স্মৃতির পাতায় ভাস্বর হচ্ছে নিজের ভুল,শানের উপর করা অন্যায়। চোখের কোনা ছাপিয়ে জল উপচে পড়ে। সে শানকে ভালোবাসত একথা আজ বলতেও জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে আসছে,মস্তিষ্কে সূক্ষ্ম পীড়া অনুভব করছে ভাবতে গিয়ে। লজ্জায় মুখ নুয়ে নীরবে কাঁদছিল ইমা। মোবারক সেটা দেখতে পেয়ে বলল,
” ভাবি, কাঁদবেন না প্লিজ, আপনার আর কী দোষ?”
” আমারই সব দোষ, মোবারক ভাই, আমারই সব দোষ। আমি যোগ্যই না কারো। আমার মরে যাওয়া উচিত। ঘৃণা হচ্ছে নিজের উপর। এতো বোকা কেন? কেন সহজে সবার কথা বিশ্বাস করি? আমার কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।” ইমার কণ্ঠস্বর কেঁপে কেঁপে ওঠে। ফুঁপিয়ে ওঠে মুখে ওড়না চেপে। ইমাকে হতবিহ্বল করে শান আচমকা টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে ভুলে যায় ক্ষণিকের জন্য ইমা। শান এখনো চোখ মেলেনি। একইভাবে আধবসা হয়ে ব্যথাবিদির্ণ স্বরে বলে,
” মোবারক ঠিকই বলেছে। নিজেকে দোষী ভেবো না ইমা। যেখানে আমার মতো মানুষকে ওরা দিনের পর দিনের ধোঁকা দিয়েছে, সেখানে তুমি আর কী!”
এই সান্ত্বনার মাঝেও প্রবল অভিমান খুঁজে পেল ইমা। এতোকাছে থেকেও অভিমানের দেয়াল দুজনের মাঝে। ইমা দাঁত চেপে কান্না গিলে চুপচাপ বসে রইল শানের এক বাহুডোরে। মোবারক এদের দুজনকে বেশ চেনে। মিলন মাঝের এই শৈত্যপ্রবাহ ওর নজরে এড়ায় না। তারচেয়েও বড়োকথা শানের এই কঠিন নীরবতা, মোবারকের কিছুতেই হজম হয়না। শানের মতো মানুষ,যেকি’না নিজের উপর অন্যায় কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারে না। সে দুই দুইবার এমন গুরতর বিষয় নীরবে মেনে নিল! যারা তার সব শেষ করে দিল তাদের এতো সহজে ক্ষমা করে দিচ্ছে সে? মোবারক কিছু বলবে ভেবেও ইমাকে দেখে চুপ করে রইল। একটু পর শান ইমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
” কিছু খাবে তোমরা?”
মোবারক, ইমা পরস্পরের দিকে তাকায় শানের অভিব্যক্তিহীন রূপ দেখে। মানুষটার মনে কী চলছে কিছুতেই ঠাহর করতে পারল না৷ শান দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করে না ওদের দিকে তাকিয়ে। চুপচাপ গিয়ে দাঁড়ায় কিচেনে। ইমা দেখছে শানকে। শান ফিরেও তাকাচ্ছে না এদিক। ওর মুখে আষাঢ়ের মেঘ। বৃষ্টি নামতে চেয়েও যেন নামছে না৷ কালো,ঘন কালো মেঘে পৃথিবী ঢেকে গেলে যেমন দিনরাত ঠাহর করা যায়না,ঠিক তেমনটা শানের ক্ষেত্রে এমুহূর্তে। ইমা এভাবে বসে থাকতে নারাজ। সে এই রূঢ় নীরবতার অবসান চায়। তাতে যা হোক! তবুও শান মনের অনুক্ত কথা প্রকাশ করুক। ইমা উঠে দাঁড়াতেই মোবারক ভীত কণ্ঠে বলে,
” ভাবি এখন যাবেন না।”
” কেন?”
” আপনি জানেন কেন নিষেধ করছি। স্যারকে একটু সময় দিন। আপনার এখন ওখানে যাওয়া আগুনে ঘি ঢালার সমতুল্য হবে।”
ইমা চোখ রাঙিয়ে তাকায় মোবারকের দিকে। মোবারক ঘাড় গুঁজে নিচু গলায় বলে,
” প্লিজ ভাবি, এই একটা কথা শুনুন আমার। স্যারের অশান্ত মনকে একটু শান্ত হতে দিন। উপরে স্যার যতই নির্লিপ্ত ভাব ধরে থাক ভেতরে কিন্তু মোটেও এমনটা নেই তার। আর এ কথা যেমন আমি জানি,আপনিও জানেন বৈকি!” মোবারক অনুরোধ করে ধৈর্য্য ধরতে। ইমা অনিচ্ছা মনে বসে পড়ল। অস্থির চিত্ত তার বার বারই মিমাংসা চাচ্ছে। সব সত্যি জানার পর শানের দুরত্ব কিছুতেই বরদাস্ত হচ্ছে না। অধৈর্য্য মানুষদের নিয়ে যদি কোনো প্রতিযোগিতা হত তবে নিশ্চিত তাতে ইমা ফার্স্ট হতো। এই মেয়েটার মধ্যে প্রচণ্ড ধৈর্য্যশক্তির অভাব। এও বলা যেতে পারে আজ ওর এবং শানের এই দুরত্ব আংশিক ইমার অধৈর্য্যতারই ফল। ধারণা খুবই খারাপ জিনিস। তারচেয়েও খারাপ যাচাই বাছাই ছাড়া বিশ্বাস করা। ইমার সামনে যা তুলে ধরা হয়েছে সে তাই বিশ্বাস করেছে। একটিবার প্রয়োজনবোধ করেনি শানের মুখোমুখি হওয়ার। যতই ফুলন দেবী সেজে থাকুক। আদৌতে সে প্রচণ্ড আবেগী এক রমণী। এমন ধরনের আবেগী, যার আবেগকে ব্যবহার করে সহজেই তাকে কন্ট্রোল করা যায়। সামিরার মতো ধূর্ত নারীর এটুকু বুঝতে অবশ্য কষ্ট হয়নি। ইমার সবচেয়ে বড়ো দূর্বলতা ছিল ওর মা। বলতে গেলে ওর পৃথিবী ছিল। সামিরার প্রথম টার্গেট তিনিই ছিলেন৷ ওর জন্য প্লাস পয়েন্ট ছিল ইমতি, সামিরার কলেজ জীবনের প্রেম। সামিরার জীবনে বহুপুরুষ এসেছে, গেছে। এই আসা যাওয়ার মধ্যে ইমতিও ছিল একজন। উঠতি বয়সের প্রেম প্রচণ্ড আবেগময় হয়। ইমতির মতো সহজ-সরল ছেলের সেই আবেগকে সহজেই বশ করেছিল ধনীর দুলালী সামিরা। সামিরা মাহিবেরই ফিমেল সংস্করণ। চারিত্রিক দিক দিয়ে চাচাত ভাইবোন দুজন কেউ কারো চেয়ে কম নয়৷ আর ঠিক এ কারনেই এদের বাগদান সম্পন্ন হওয়ার পরও ব্যক্তিগত জীবন একই রকম ছিল,আছে। কেউ কারো লাইফে ইন্টারফেয়ার করেনা,জানে দিন শেষে একই পথের পথিক হবে। দোষ ধরার, নিষেধ করার মতো যুগল এরা নয়৷ সবসময় যেন প্রতিযোগিতায় থাকে কে কার চেয়ে বেশি অপকর্ম করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য মাহিব সামিরাকে কখনোই টেক্কা দিতে পারে না। তবে হ্যাঁ জেতার চেষ্টা, সামিরার সামনে ক্ষমতার দাপট দেখানোর চেষ্টা মাহিবের আগেও ছিল,এখনো আছে। তেমনি একটা ঘটনা ঘটে সামিরা কলেজে পড়াকালীন। সামিরা ইমতিকে ফাঁসিয়েছিল মাহিবকে জ্বালাবে বলে। উদ্দেশ্যে সফলও হয়েছিল। মাহিব জ্বলেছিল। ইমতি এবং ওর বাবা মাহিবের গায়ে হাত তুলেছে এমন একটা অভিযোগ করে বড়ো আব্বার কাছে। একমাত্র ছেলের রক্তারক্তি চেহারা কিছুতেই সহ্য করেননি মঈন খান৷ শান নিজেও তখন ছাত্র। সে মাহিব,সামিরার এই পৈশাচিক খেল কোনোদিন বোঝেনি৷ শানের চোখে ওরা দু’জন ছিল পরস্পরের শত্রু।শুধু শান কেন বাড়ির সবাই এমনটা ভাবত। শানকে আদেশ করা হয় বাপ ছেলেকে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে তুলে আনার। এই একবিংশ শতকে এসেও যে কেউ নিজেকে দাস ভাবে,শানকে তখন না দেখলে বোঝার উপায় ছিলনা৷ বলিবা মাত্রই করিতে বাধ্য থাকিবে,কথার মতোই তৈরি করে মঈন খান ওকে। অপরিণত বয়সী শান সেদিন জানত না এই দুজন তার প্রিয়তমার পরমাত্মীয়। মাহিব সুকৌশলে বাপ ছেলেকে খুন করে। এই খুনটাকে ক্রসফায়ারের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়। কাজটা করে ওদেরই হয়ে কাজ করা এক পুলিশ অফিসার। মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় নিরাপরাধ মৃত ইমতি এবং ওর বাবাকে। মৃত্যুরও পরও যাতে এ নিয়ে ওদের পরিবার কোনো একশন নিতে সাহস না করে সেজন্য হয়রানি শুরু করে। বিধবা বিভাকে নানা ভাবে অপদস্থ করা হয়। এই সব কিছু সচক্ষে দেখে ইমা। এরপর থেকেই পুলিশ নামক পেশাটার প্রতি যেমন ওর ঘৃণা তেমনি ভয়। বলেনা পৃথিবীতে খারাপ যেমন আছে ভালোও তেমন আছে। এক হাবিলদার ওদের সাহায্য করে। আসল ঘটনা বিভাকে খুলে বলে। এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। স্বামী -সন্তান হারিয়ে বিভা একেবারে অসহায় হয়ে পড়ে। মামলা মোকাদ্দমায় যাওয়ার সাহস পায়না। তাই হাবিলদারের পরামর্শ মতো চলে আসে বাপের বাড়ি। বটগাছ তুল্য পিতার ছায়া ছাড়া পৃথিবী কতটা স্বার্থপর,নিষ্ঠুর ইমা ধীরে ধীরে জেনেছে। কোমল হৃদয় তারই কারনেই হয়ে ওঠে কঠিন,রুক্ষ। সেই রুক্ষ জমিনে শ্রাবণ ধারা হয়ে এসেছিল শান। কতোটা মধুর ছিল দিনগুলো! ইমার চোখের কোনে জল চিকচিক করে। সেই দিনগুলো আবার ফিরে পেতে ছটফট করে মনটা। মোবারকের সামনে কাঁদতে চায়না আর ইমা। উঠে চলে আসে রুমে। বালিশ বুকে জড়িয়ে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
” আ’ম সরি শান। আ’ম সরি।”
কিচেনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে শান। চুলায় গরম পানি শুকিয়ে তলানি ছুঁই ছুঁই। দেরি দেখে লিভিং রুম ছেড়ে উঠে এসেছে মোবারক। যা ভেবেছিল তাই! শান ঠিক নেই,ঠিক হতেই পারেনা এতোকিছুর পরে। থমথমে মুখে স্থির দৃষ্টি মেলে বাইরে চেয়ে আছে।
” স্যার, ঠিক আছেন?” মোবারকের কণ্ঠস্বরে পলক ফেলে শান। তার মনের অস্থিরতা বাহিরে প্রকাশ পাচ্ছে এবার। চুলা নিভিয়ে আবার জ্বালাচ্ছে,কফির কৌটা সামনে রেখে এদিক ওদিক খুঁজছে। খুব খারাপ লাগল এসব দেখে মোবারকের। ইতস্তত করে শানের কাঁধ চেপে ধরতেই চিৎকার করে ওঠে শান,
” মোবারক আমার অপরাধ কী? কেন বার বার আমার সাথেই এমন হয়? আমার বিশ্বাস নিয়ে সবাই এভাবে কেন খেলে? আমি তো কাওকে বিশ্বাস করতে চাইনা,ভালোবাসতে চাইনা। কেন সবাই আসে আমার জীবনে? কেন এভাবে ভেঙেচুরে দেয় আমার হৃদয় বার বার!” শেষটা বলে শক্ত করে শরীর শান। কাঁদছে না সে। ধড়া কণ্ঠস্বর ক্রোধে,অভিমানে থমকে থমকে যাচ্ছে। মোবারক বিষন্ন মুখে বলে,
” সামিরা,,,। কথাটা বাড়েনা শানের ধমকে।
” নাম নিবি না ওর। ভেবেছিলাম ঐ বাড়িতে ও আমাকে বোঝে,আমাকে বন্ধু ভাবে,আপন ভাবে। কিন্তু না, মঈন খানেরই তো রক্ত। ধোঁকা ওদের রক্তে মিশে আছে। আমাকে এতিম করেছে,পদে পদে অপমান করেছে আর এখন শুনছি আমার ভূত ভবিষ্যতও নষ্ট করেছে। দারুন তাই না, বল?” কাষ্ঠহাসি হাসি হাসল কঠিন মুখে।
” ভবিষ্যত নষ্ট হয়েছে বলছেন কেন,স্যার? ভাবি,,”
মোবারকের কথা থামিয়ে দেয় শান হাত উঁচু করে৷ চোয়াল শক্ত করে বলে,
” আমাকে একা থাকতে দে।”
” স্যার!”
” মোবারক তোকে কী বলেছি আমি? একা থাকতে দে আমাকে। যা আমার সামনে থেকে।” মোবারক যায়না। শান অগ্নিদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
” তবে থাক তুই। আমিই যাচ্ছি।” শান বেরিয়ে যায় বাসা ছেড়ে। মোবারক পিছু নেয় গেট পর্যন্ত। উত্তর দিকে যাচ্ছে দেখে থেমে যায়। পাশে কৌতূহলে চেয়ে আছে মতিন।
মৌটুসি ব্যাগ হাতে মেইন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। আপাদমস্তক সেই গ্রাম্য সহজ-সরল সাজ। বার বার হাত ঘড়িটায় নজর বুলাচ্ছে। খবর মোতাবেক মিনিট দুইকের মধ্যে এই পথ দিয়ে যাবে ইমরোজের বাইক। একমিনিট ইতোমধ্যে পার হয়েছে বাকি এক মিনিটে যদি না দেখা মেলে! তবে আবার নতুন প্লান কষতে হবে। মৌটুসি বিরক্ত হচ্ছে ইমরোজের এমন এটিটিউডে। মাহিবকে বশ করতেও এতো ভোগান্তি পোহাতে হয়নি যতটা এই পুলিশটার মন গলাতে হচ্ছে। একবার ভাবে, এসব গ্রাম্য সাজের কারনেই হয়তো ভাও দিচ্ছে না। একটু বোল্ড সাজ দিলে সহজেই বশ করতে পারত। মাহিবটার জন্য সেটাও তো হবেনা। মাহিবের আচরণে মনে মনে তৃপ্ত হলেও মনে একটা শঙ্কা এখনো রয়ে গেছে। এই শঙ্কাটা পুরোপুরি না কাটানো পর্যন্ত লক্ষ্যে পৌঁছান যাবে না৷ মাহিবকে পাগল হতে হবে ওর জন্য, মৌই হবে আকাঙ্খার মানুষী। খানিকটা তো হয়েছে সে, বাকিটাও মৌটুসি করবেই। ঠোঁটের পার্শ্ব কঠিন হয়ে ওঠে মৌটুসির। সেটা সহসা সহজ হয় অদূরে ছুটে আসা ইমরোজের বাইক দেখে৷ চট করে মুখ ঘুরিয়ে অসহায় ভাব ফুটিয়ে শূন্য রাস্তায় তাকিয়ে রয়। ইমরোজ প্রথমে চিনতে পারেনা। কারফিউয়ের মধ্যে মেয়েটিকে একা দাঁড়ানো দেখে বাইক থামিয়ে নামে। ভালো করে তাকাতেই চিনতে পারে। একপ্রস্ত হাসি হেসে বলে,
” আপনি এখানে।”
মৌ এমনভাবে তাকায় যেন ইমরোজকে সে চিনতে পায়নি। একটু ভাবুক হওয়ার ভান ধরতেই ইমরোজ বলে,
” চিনতে পারলেন না?”
” ওহ, আপনি?” প্রসস্থ হাসি হেসে মুহূর্তে মুখটা কালো করে ফেলে। নত মুখে তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলছিল। তা দেখে ইমরোজ বলল,
” কী করছেন?”
” আপনার ব্লেজার বের করছি।”
” সবসময় ওটা নিয়ে ঘুরে বেড়ান বুঝি?”
ইমরোজের কৌতুকে মৌ মনে মনে রাগ হলেও দেখায় লজ্জিত ভাব। লজ্জায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ইমরোজ ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বলে,
” কোথাও যাচ্ছিলেন নাকি?”
মৌ কথা বলেনা। মুখটা আরো নামিয়ে নেয়। ইমরোজ হঠাৎ রুক্ষ গলায় বলে,
” আপনি জানেন না দেশের পরিস্থিতি? এই অবস্থায় বাইরে বেরিয়েছেন কোন আক্কেলে?”
মৌ এবার নিচু গলায় বলে,
” আমি বাড়ি ফিরে যাব।”
” বাড়ি ফিরে যাবেন বললেই হলো! গাড়ি বন্ধ জানেন না?”
” ওহ! তাহলে হেঁটে যাব।” ব্যাগ থেকে ইমরোজের ব্লেজারটা বের করে দিয়ে, ব্যাগ হাতে উল্টো দিকে হাঁটা ধরে মৌ। রাগ হচ্ছে এই ইমরোজের উপর। কেমন রূঢ়লি বিহেভ করে হঠাৎ হঠাৎ লোকটা! ইচ্ছা করে গুলি করে দিতে হৃদপিণ্ড বরাবর। এদিকে মনে ভীষণ অস্থিরতা বিরাজ করছে প্লান বিফলে যাচ্ছে দেখে। সেই অস্থিরতা একনিমিষে উত্তরের হাওয়া হয়ে গা হিম করে দিল ইমরোজ হাত ধরতেই।
” কোথায় যাচ্ছেন?”
” যেদিকে দু-চোখ যায়। আপনি হাত ছাড়ুন।” ইমরোজ হাত ছেড়ে সরি বলে। মৌ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর পলক নামা মুখটায়। চোখের সীমানা পেরিয়ে ঠিক মনে গিয়ে ছুঁয়ে এলো এই দেখার অনুভূতি। নিজেকে সামলে নিল মৌ। ছদ্মবেশের খোলস ছেড়ে কিছুতেই বেরোতে দেবে না নিজেকে সে। যদি বেরোয় তবে সেদিন হবে ওর মৃত্যুদিন। অভিনয় বহাল রেখে অভিমানী কণ্ঠে বলে,
” আর হ্যাঁ, এরপর থেকে কাওকে সাহায্যের অঙ্গিকার করার পূর্বে একটু ভেবে নেবেন। আপনাকে আমি শুধু ব্লেজার ফিরিয়ে দেব বলে কল করেছিলাম, অন্য কিছু নয়।” আরেকবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দুজন দুজনকে দেখে। মনের রুদ্ধ কবাট সহসা খুলে যায় ফাগুন হাওয়ার দোলে। সংকেত পেলেও দু’জনই প্রাপ্ত বয়স্ক, নিজের অনুভূতির লাগাম টানতে সিদ্ধহস্ত। মৌ কিছুদূর হেঁটে সামনে গিয়ে ভাবে,
” এই লোককে পটাতে আর কত দেরি হবে? উফ!” বিরক্তির রেশ কাটতে না কাটতেই ইমরোজ বাইক চালিয়ে পাশে এলো। বলল,
” আচ্ছা সরি।”
” সরি বলার প্রয়োজন নেই।”
” খুব রেগেছেন দেখছি।”
” না,মোটেও না।” মুখ ঘুরিয়ে বলতেই ইমরোজ হেসে ওঠে। বলে,
” চলুন আমার সাথে।”
” কোথায়?” চলতে চলতেই প্রশ্ন করল কিন্তু ফিরেও তাকাল না মৌ। ইমরোজ ওর সামনে বাইক থামিয়ে বলল,
” আমার বাসায়।”
” আপনার বাসা! কেন?” চমকে তাকায় মৌ। এতো সহজে চাওয়াটা পূরণ হবে সে ভাবেইনি। ইমরোজ সহজ গলায় বলে,
” কী যাবেন তো?”
” আমার মতো একজন অচেনা -অজানা মেয়েকে বাড়ি কেন নিতে চাচ্ছেন আপনি? পুলিশ হিসেবে এটা কী আপনার বোকামি হচ্ছে না?” কথাটা বলে নিজেই নিজেকে বকলো মনে মনে। ইমরোজ বাইক থেকে এমন ভাবে নামল যে, মৌ কিছুটা ঘাবড়ে গেল। ইমরোজ চিবুক চুলকে চোখ ছোটো করে বলল,
” কথা তো ঠিকই বলেছেন আপনি। তো কী করা যায় বলুন?”
” আ-আমি কী জানি? আমি আসছি।”
মৌ দু’কদম এগোতেই ইমরোজ এক হাত টেনে কাছে নিয়ে আসে।
” কোথায় পালাচ্ছেন ম্যাডাম? চলুন।”
একপ্রকার জোর করে বাইকে বসিয়ে বাসায় নিয়ে এলো মৌকে। আমেনা বেগম,আশা বিস্ময় চোখে চেয়ে আছে ছেলে এবং তার সাথে আগত অচেনা মেয়েটির দিকে। তবে কী ছেলে বিয়ে করে ফেলেছে? আমেনা বেগম কষ্ট পেলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে গেলেন।
” মা, উনি আমাদের মেহমান। কিছুদিন এখানে থাকবেন।” এরপর মা এবং বোনের সাথে মৌকে পরিচয় করে দিয়ে বেরিয়ে যায় ইমরোজ। আমেনা বেগম গম্ভীরমুখে মৌকে দেখেন। মেয়েটা সুন্দর তবে তার তেমন পছন্দ হলো না। এরচেয়ে ঐ বোনের মেয়েটাকেই বেশি মানায় ছেলের সাথে। এই মেয়েটির এখানে থাকা তিনি পছন্দ করলেন না। কিন্তু কিছু বলতেও পারলেন না মুখের উপর,ছেলের মেহমান বলে কথা। আশাকে রুম দেখাতে বলে অন্য রুমে চলে গেলেন। আশা হাসি মুখে নিজের রুমে নিয়ে এলো মৌকে। আশার মুখটা দেখে ছোটো বোনটার কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ মৌটুসির। আশার দিকে চেয়ে চেয়ে অজান্তেই কেঁদে ফেলল। মায়ের ডাকে আশা তখনই বাইরে চলে যাওয়ায় এ দৃশ্য দেখতে পেল না। এই ঘর- এই পারিবারিক পরিবেশে মৌ বার বার নিজের অতীত খুঁজে ফেরে। বার বার চোখ ভরে আসে জলে। একদিন এমন সুন্দর একটা পরিবার ছিল, আনন্দ ছিল। আজ কিছুই নেই।
তুমি অতঃপর তুমিই
২৮
Taniya Sheikh
মৌটুসী এখানে আসার পর থেকেই শুয়ে শুয়ে বেলাটা কাটিয়ে দিল। বহুদিন পর শান্তির ঘুম এলো এই বিছানায় শুয়ে। বহুদিন পর মনে হলো মনুষ্য জীবনে আছে। আজকাল তো ভুলেই যায় ও মানুষ। মনে হয় রক্ত মাংসে গড়া এক পিশাচী। নোংরা শরীর,নোংরায় ঢাকা আগাগোড়া সে। অথচ চার বছর আগেও সে পবিত্র ভাবত নিজেকে,নিজের ছোঁয়া প্রতিটি ব্যক্তি, বস্তুকে। আজ নিজেকে যেমন ঘৃণা হয় তেমনি ঘৃণা হয় সবকিছুকে। কিন্তু এই বাসায় এসে ঘৃণাভাব দমে আছে। ভালো লাগছে ওর৷ ভালোলাগাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মোবাইল ভাইব্রেট হচ্ছে। মৌ জানে কার কল। একজনই তো কল করে ওকে,মাহিব৷ মোবাইল বালিশের তলে রেখে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। হঠাৎ কী ভেবে তড়িঘড়ি মোবাইলটা হাতে নিল। চোখ দু’টো লাল হয়ে এসেছে ওর৷ কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে জবাব দিল,
” হ্যাঁ, জান বলো।”
” কোথায় তুমি?”
” এক মিনিট।” মৌ সতর্কে আশপাশে দেখে দরজা লাগিয়ে পুনরায় বিছানার কাছে এসে বলল,
” প্লান মোতাবেক আমি এখন ঐ পুলিশ অফিসারের বাসায়।”
” সত্যি! থ্যাংক গড, ইভরিথিং ইজ ওকে?”
” হ্যাঁ, কেন ভয় পাচ্ছ বুঝি?”
আজ কেন যেন হঠাৎ জেগে ওঠা প্রেমানুভূতির মিশ্রণে এই আবেগটা লুকাতে চাচ্ছে না মাহিব। স্বভাব বহির্ভূত ভাবে মৃদু হেসে বলল,
“তা তো হতেই হয়। হাজার হোক অর্ধাঙ্গিনী বলে কথা!”
” অর্ধাঙ্গিনী!” বেশ অবাক হলো মৌ। হৃদয়টা খানিক কাপল দমকা হাওয়ায় দোলা কলা পাতার ন্যায়। মাহিব অযাচিত আবেগটার লাগাম তো টানলই না বরং নিজেই সেই সাথে ভাসতে লাগল। তার ভালো লাগছে এসব ভাবতে,বলতে। সহজে নিজেকে প্রকাশ করার মানুষ সে নয়, হচ্ছেও না ঠিক। আবেগ প্রকাশে বড্ড আনাড়ি সে। অসংলগ্ন কথা বলতে আরম্ভ করল অতি আবেগে। বলল,
” অর্ধাঙ্গিনী মানেই কিন্তু সেই অর্ধাঙ্গিনী নয়। বিশ্বস্ত সঙ্গী, সহচরী। শামীমের পরে তুমিই তো আমার তেমন একজন। যাকে সহজে বিশ্বাস করতে পারি,ভরসা করতে পারি। সেই বিশ্বস্ত সঙ্গীর জন্য চিন্তিত হওয়াটা তো স্বাভাবিক, তাই না?”
মৌয়ের মাথা ধরে গেল মাহিবের এসব কথায়। তবুও প্রসন্ন হাসি হেসে বলল,
” হ্যাঁ, অবশ্যই।” মৌ বেশ বুঝতে পারছে লক্ষ্য অতি নিকটে। এমতাবস্থায় কোনো ভুল করা চলবে না। সুতরাং মাহিবের মন খারাপ হয় এমন কিছুই সে বলল না। হাসি,কথার ছলে মাহিবকে আরও কাবু করতে ব্যস্ত হলো। দূর থেকে মানুষকে চেনা যায়না। মানুষকে চিনতে হলে তার কাছে যেতে হয়। মৌ মাহিবের খুব বেশি কাছে গেছে। এতো কাছে যেখান থেকে মাহিবকে বশ করা যায়। নিষ্ঠুর, পাষণ্ড মাহিব আজ অস্ত্র,নারী, নেশা নিয়ে পড়ে নেই বরং মনের অনুভূতির জালে নিজেকে বাঁধতে চাচ্ছে। সারাক্ষণ ওর ইচ্ছা হয় মৌ-য়ের সাথে কথা বলতে। বাবা জীবিতকালে যে ইচ্ছা পোষণ করেছি আজ মাহিব নিজেও তাই চায়। সে একটা ছোট্ট সুখের সংসার চায়। যে সংসারের কর্তা সে হবে। তাকে ঘিরে থাকবে মৌ। যদিও এসব তার একান্ত ভাবনা। মৌ কিংবা কাওকেই বলা হয়নি। দরজার বাইরে কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে মৌ তড়িঘড়ি কল কেটে দেয়।মাহিবের মনের আকাশ জুড়ে ফের নেমে আসে নিঃসঙ্গের বিষাদ। মন খুলে কাওকে যদি এই আকাঙ্খার কথা বলা যেত! মাহিবের আজ খুব করে মনে পড়ছে শামীমকে। ছেলেটা শুধু ডান হাত নয় ওর পরম বিশ্বস্ত, আপন একজন ছিল। দু’বছর গত হয়েছে শামীম নেই। শামীমের শূন্যতা মাহিব কিছু দিয়েই পূরণ করতে পারে না, এমনকি মৌ-কে দিয়েও না।
দরজা নক পড়তেই ভাবনায় ছেদ পড়ে। গম্ভীরগলায় বলে,
” কে?”
দরজা ঠেলে যাকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে সে আর কেউ নয়, সামিরা। উগ্র সাজ, এলোমেলো পায়ে এগিয়ে আসছে। বোঝায় যাচ্ছে সামিরা খুব বেশি নেশা করেছে। এমনটা সচারচর করে না সামিরা। খুব চতুর মেয়েটা। আগের মাহিব হলে উঠে যেত। এই সুযোগ কাজে লাগাত কিন্তু আজ উঠল না। ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইল। আদিম উন্মত্তা জাগছে না, বিরক্তবোধ হচ্ছে সামিরাকে দেখে। সামিরা নগ্ন পদে ঢুলতে ঢুলতে এসে বসল ওর চেয়ারের সামনে,বিছানায়। পরনের টপসটার গলা নেমে গেছে সীমানা ছাড়িয়ে। মাহিব চেয়ে আছে ঐ স্পর্শকাতর স্থানে। অভ্যাস সহজে বদল হয়না। চোখের এই অভ্যাসটাও তাই না চাইতেও ওদিকে আকর্ষিত হলো। সামিরা ঝুঁকে বলল,
” হবে নাকি আজ?” মাহিব বিস্মিত হয়। ঘোর কাটে সামনে বসা রমণীর রক্ত মাংসের দেহের উপর থেকে। সে সামিরাকে চেনে। সামিরা স্বেচ্ছায় কোনোদিন ওর বিছানা সঙ্গী হয়নি,হয়তো কারোরই হয়নি শানকে ভালোবাসার পর। কিন্তু আজ এই অশোভন ইঙ্গিতের অর্থ কী দাঁড়ায়! বাবার পরে সেই এই এড়িয়ার অপরাধ জগতের গডফাদার। কাঁচা বুদ্ধি মোটেও তার নেই। সামিরাকে তাই কটাক্ষ করে বলল,
” অবশ্যই, তবে তার আগে শানকে একটা কল করলে জিনিসটা আরো ইনজয়বেল হবে,কী বলো?” সামিরা নেশায় বুঁদ হয়েও চোখ কঠিন করে তোলে। সে এমন জবাব প্রত্যাশা করেনি। শানকে পাওয়ার ব্যাকুলতা তাকে অধৈর্য্য করে তুলেছে কিন্তু পরাজয়ও স্বীকার করবে না। গোপন সূত্রে জেনেছে মাহিবের জীবনে স্পেশাল কেউ এসেছে। সামিরা সহজে বিশ্বাস করার দলে নয়। কথাটা কতখানি সত্যি তার যথার্থতা প্রমাণের জন্যই সামিরা এখানে এসেছে। নয়তো এ ঘরে ওর জুতা পর্যন্ত আসে না। মাহিবের দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে তোলে। মাহিব মৃদু হাসছে৷ এর অর্থ সে সামিরার চালাকি ধরে ফেলেছে। সামিরাও কম নয়। চট করে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। এই মাহিব তার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে বহুবার জোর খাটিয়েছে। অজ্ঞাতে তাকে ভোগ করেছে। এইবার মাহিবের শাস্তির পালা। তবে তার আগে সত্যিটা উৎঘাটন করতে হবে। এরপর পুরোপুরি শানের সে। আজ সামিরা অগ্নিপরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছে। কষ্টগুলোকে ভোদকার জলে বিক্ষিপ্ত করেছে। মাহিব হার মানে না৷ সে নিজেও সামিরাকে আর চাচ্ছে না, কিন্তু আগ বাড়িয়ে প্রত্যাখ্যান করাটা পরাজয়ের। তাছাড়া বাবা তার এই ভাতিজির নামে অর্ধেক সম্পত্তি উইল করে গেছেন। মাহিবের সেটাও চায়। মাহিব দ্বিধান্বিত এই মুহূর্তে। একদিকে মৌ- তার ভালোবাসা,অন্যদিকে পাওয়ার,সম্পদ- যা এই সামিরাকে ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। তাদের এই অপরাধের জগতের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড সামিরা। সে যদি শানের হয়ে যায় তবে মাহিবের পরাজয়। শানের আধিপত্য কিছুতেই মানতে পারবে না মাহিব৷ এই সামিরাই ছিল, যে পদে পদে শানকে দেখিয়ে তাকে অপমান, অপদস্থ করেছে। শাস্তির যোগ্য তো সামিরাও। মৌ আজও তার আছে,কালও থাকবে। না হোক স্ত্রী হয়ে সমাজের চোখে! মনের চোখে সেই হবে মাহিবের স্ত্রী, সহধর্মিণী। মাহিব পুরোনো স্বত্বায় ফিরে আসে। ঝাপিয়ে পড়ে নেশায় দূর্বল সামিরার উপর। সামিরার বুদ্ধির সাথে পেরে ওঠা মাহিবের পক্ষে সম্ভব নয়। সামিরা আজ বুঝে সুঝেই ঢুকেছিল এ ঘরে। মাহিবের হিংস্র রূপ দেখে দরজার ওপাশে দাঁড়ানো বডিগার্ডকে সংকেত দেয়। বিবস্ত্র হবার পূর্বেই গার্ড মাহিবকে ধাক্কা দিয়ে সামিরাকে উদ্ধার করে। আশানুরুপ ফল না পাওয়ায় নেশাচ্ছন্ন অবস্থায় রাগে জ্বলতে লাগল সামিরা৷ শরীরে বল পাচ্ছে না। ক্ষিপ্র হয়ে কোনোকিছু ভাঙতে পারছে না। অচিরেই গার্ডের বাহুতে অচেতন হয়ে পড়ে। সামিরার গার্ডের সাথে পেরে ওঠেনি মাহিব। বিশালদেহী, দীর্ঘকায় দানবটার এক হাতের ধাক্কায় সে ফ্লোরে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বা’কাঁধে যথেষ্ট ব্যথাও পেয়েছে অনুভব করল। তবুও হাসল। বলল,
” সামিরা,সামিরা, তুমি যা ভেবেছ তা কোনোদিন হবেনা৷ এই পিশাচের পিশাচী তুমি৷ তোমাকে ছাড়া আমার পিশাচ রাজ্য অসম্পূর্ণ। আমাকে অসম্পূর্ণ করে আমার জাতশত্রুকে তুমি সম্পূর্ণ করতে পারো না,সামিরা। তুমি আমার এবং আমারই হবে শেষপর্যন্ত। হোক স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। সেদিন তোমার ঐ দানবটাও আমার বিছানা থেকে তোমাকে তুলে নিতে সাহস করবে না। তোমার এক একটা দিন হবে নরক সমতুল্য। হা! হা! হা।” বাড়ি কাঁপিয়ে অট্টহাসি হাসে মাহিব।
খাবার টেবিলে সবার সাথে মৌটুসীও বসল।মনের কপটতা যেন এই সুখী, আন্তরিক মানুষগুলোকে দেখেই ম্লান হচ্ছে। না চাইতেও এদের সাথে মিশে গেল একসময়। ইমরোজের বাবা বেশ মজার মানুষ। মৌটুসী খুব হাসল তার কথায়। হাসতে হাসতে চোখের কোনে জল চলে এলো। নিজের বাবার কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। বাবাও খুব মজার ছিল। একসাথে পাটি বিছিয়ে যখন ওরা খেতে বসত, বাবা এমন এমন কথা বলত না হেসেই পারত না। সবচেয়ে বেশি হাসত আয়ুশী৷ ঠিক আশার মতো। ইমরোজের চোখ পড়ল সামনে বসা মৌটুসীর উপর। মেয়েটার চোখ ছলছল। ইমরোজ অপলক চেয়ে আছে। এমন মায়াভরা মুখ থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারেনা ও। আশাসহ সবাই বিষয়টা খেয়াল করে। বাপ- মেয়ে ঠোঁট টিপে হাসলেও আমেনা বেগম হাসেন না।
” কী হয়েছে তোমার,মেয়ে?”
মায়ের গম্ভীরগলা শুনে তন্ময়তা কাটে ইমরোজের। আশার দিকে তাকাতেই দেখল সে মিটিমিটি হাসছে। চোখ রাঙাতেই আশা হাসি বন্ধ করে মা’কে বলল,
” মনে হয় বাড়ির কথা মনে পড়েছে। আপু, আপনার বাড়িতে কে কে আছে?”
” কেউ নেই।” মৌটুসী সবাইকে অবাক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আহসান সাহেব বলেন,
” আরে করছ কী মা, বসো খেয়ে নাও।”
মৌটুসী একচিলতে ম্লান হেসে বলল,
” পেট ভরে গেছে আঙ্কেল।” শান্ত ভঙ্গিতে রুমে চলে যায় মৌ। খাবার টেবিলে কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা নেমে আসে। আমেনা বেগম এই মেয়ের আধিপত্য খাবার টেবিলে বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দেয় না। সবাইকে খাবার তাগাদা দিতে দিতে ইমরোজের জন্য ঠিক করা মেয়েটার প্রসঙ্গ তোলে। আমেনা খেয়াল করছে ছেলের এসবে মনোযোগ নেই। সে বার বার আশার রুমে তাকাচ্ছে। রাগে ফুঁসতে থাকেন ভেতরে ভেতরে তিনি।
রাত ঘন হচ্ছে অথচ শানের ফেরার নাম গন্ধ পাচ্ছে না ইমা। মনটা কু গাইছে। অস্থির হয়ে পায়চারি করছে লিভিং এড়িয়ায়। আজ নিজ হাতে ভালোমন্দ রান্না করেছে শানের জন্য। অপেক্ষা করছে কখন শান ফিরবে। ভুল যারই হোক আজ সব মিটিয়ে ফেলবে সে। শানকে আর কষ্ট দেবে না৷ সব জানার পর তো একেবারেই না৷ যা হারিয়েছে তা আর ফিরে পাবার নয়,কিন্তু যা আছে তাকে হারাতে দেওয়া বোকামি ছাড়া আর কি! মোবাইল বেঁজে ওঠায় ছুটে আসে ইমা। নিরাশ হয় স্ক্রিনে মোবারকের নাম দেখে।
” জি,মোবারক ভাই।”
” স্যার ফিরেছে?”
অভিমানে কন্ঠ ধড়ে আসে ইমার।
” না।”
মোবারক বলে,
” আপনি চিন্তা করবেন না,আমি আসছি।”
কিছুক্ষণ পর আসমা এবং মোবারক আসে। ইমাকে চিন্তিত দেখে দু’জনই সান্ত্বনা দেয়। এই মুহূর্তে সান্ত্বনা না শানকে চায় ইমার। সে বলে,
” সে কোথায়?”
মোবারক সোজা জবাব না দিয়ে বলে,
” স্যার ঠিকই আছে। দেখবেন কালই ফিরে এসেছে।”
ইমা বুঝতে পারে মোবারক শানের খবর জানে, হয়তো কোথায় গেছে সেটাও জানে। অধৈর্য্য গলায় বলে,
” আমি তার কাছে যাব মোবারক ভাই।”
মোবারক চমকে তাকায়। বলে,
” না, না। পাগলামো করবেন না৷ ধৈর্য্য ধরেন সময় হলেই স্যার ফিরে আসবে।”
” আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন নাকি তাই বলুন।”
ইমা হঠাৎই রেগে যায়। আসমা শান্ত করতে গেলে কাঁদো কাঁদো হয়ে আসমার হাতদুটো ধরে বলে,
” বোন, তোমার স্বামীকে বলো আমাকে যেন তার কাছে নিয়ে যায়। আমি আর এক মুহূর্ত তাকে ছাড়া থাকতে রাজি না। জেনে না জেনে অনেক ভুল হয়েছে আমাদের। এবার সবকিছুর সমাপ্তি টানব আমি। শানকে একা ছাড়ব না কিছুতেই আর।প্লিজ, তোমার স্বামীকে বলো আমাকে সত্যিটা বলতে।”
আসমা কী বলবে ভেবে পায়না। মোবারকের দিকে তাকাতেই মোবারক উঠে দাঁড়ায়। গম্ভীর মুখে বলে,
” ভাবি সবসময়ই অধৈর্য্য মানায় না। একটু তো সবুর করুন। বললাম তো রাগ পড়ে গেলে ফিরে আসবে স্যার, আর যদি না ফেরে আমি কাল নিয়ে যাব আপনাকে। এখন শুয়ে পড়ুন।”
আসমা স্বামীর এহেন রূঢ়তায় রুষ্ট হয়। ইমা কাঁদছে। অনুরোধ করেও যখন ফল হলো না সে টর্চ হাতে বাইরে বেরিয়ে এলো। ইমাকে থামাতে পিছু পিছু আসমা এবং মোবারকও গেল। গেটের সামনে এসে ইমা মতিনকে বলল,
” গেট খুলুন।”
শানের অবর্তমানে মোবারকের কথাতেই মতিন চলে। এখনো তাই সেদিকে তাকিয়ে আছে। ইমা সেটা দেখে ধমকে বলল,
” কী হলো খুলুন।”
মোবারকের সাড়া না পেয়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে মতিন। ইমা ক্রোধে কাঁপছে সবার দিকে তাকিয়ে। একসময় চোখের জ্বলে গলে ক্রোধ দূর্বল হয়ে পড়ে। মোবারককে ফের অনুরোধ করে ইমা। এবার আসমাও ইমার সাপোর্ট করল। মোবারক অবশেষে রাজি হয়। কিন্তু সমস্যাও তাতে কম নয়। সে শেষবারের মতো ইমাকে বোঝায়। এই নিশুতে উত্তর দিকে যাওয়াটা বিপদেরও হতে পারে। ওদিকটা একেবারে নির্জন। শ্বাপদসংকুলে ঘেরা। উত্তর দিকের কথা শুনে আসমাও ভয় পেল। সে নিজেও এবার এখন ওদিকে যাবার বিপক্ষে। সবকিছু জানার পরও ইমা নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল। সে শুধু পথটা দেখিয়ে দিতে বলল। মোবারক একথা শুনে বলে,
” পথ দেখিয়ে দেবো মানে?”
” হ্যাঁ, আমি একাই যাব। আপনার যাবার প্রয়োজন নেই।” পাশে দাঁড়ানো আসমার মুখে ভয়ের রেখা দেখেই কথাটা বলেছে ইমা। আসমা সেটা বুঝতে পেরে লজ্জিত হলো। মোবারক রেগে বলল,
” ভাবি, এটা কোনো সাধারণ স্থান নয়। লোকালয় ছাড়িয়ে একেবারে নির্জন বনজঙ্গলে ঘেরা স্থান। উত্তর দিকে একেবারে নির্জন। মাটির এবড়োথেবড়ো রাস্তা। গাড়িও যাবার সাধ্য নেই। এই রাতে পায়ে হেঁটে মাইল খানেক পথ পাড়ি দিয়ে শান স্যারের কাছে পৌঁছানো হিমালয় জয় করার সমান। বিপদ প্রতি মুহূর্তে সেখানে।”
ইমা একটুও ভয় পেল না নিজেকে নিয়ে বরং তার ভয় হচ্ছে শানের জন্য। এ পথ যদি এতোই ভয়ের হয় তবে শান কেমন আছে? তার কিছু হলো না তো! ইমা আগের চেয়ে বেশি অস্থির হয়ে ওঠে। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
” আমি এক্ষুনি বেরোব মোবারক ভাই। আপনাদের কারো যাবার প্রয়োজন নেই। দারোয়ানকে বলুন গেট খুলে দিতে।”
” ভাবি আপনাকে আমি কী ভাবে বোঝাব? পৃথিবীতে এমন কিছু জিনিস আছে যার ব্যাখ্যা নেই,অস্তিত্ব থেকেও নেই। শুধু অনুভব করা যায়। এই অনুভবেই মানুষ শেষ হয়ে যায় ভয়ে। আপনারা শহরের মানুষ। আপনাদের বললেও আপনারা এসব বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু তাতে তাদের উপস্থিতি নাই হবে না মোটেও।”
” মানে।”
আসমা ভয়ে ভয়ে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল ওদিকটায় নির্জন স্থান,দিন কিংবা রাতে অশরীরী থাকার কথা শুনেছে ওরা৷ দিনে তাদের দৌরাত্ম্য যতটা কম রাতে ততটাই বেশি। ইমা এবার সত্যিই ঘাবড়ে গেল। সে বলল,
” তাহলে তো তারও বিপদ।”
” না, মোটেও না।”
” আপনি কী করে বুঝলেন?” মোবারক মতিন,আসমার দিকে তাকিয়ে সে-কথার জবাব দিল না। শুধু বলল,
” ওতো কথা বলতে পারব না। শুধু জানুন শান স্যার ঠিক আছে। ভালো হবে আপনি ওদিকে এখন না গেলে।”
অবশেষে ইমার যাওয়া হলো না। মোবারক আশ্বস্ত করলো শান ঠিক আছে। ইমা ফিরে এলো রুমে। রাত যত বাড়ছে ওর চিন্তাও সেই সাথে সাথে বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটায় চারটা ছুঁই ছুঁই। ইমা তাহাজ্জুদে বসল। দু’হাত তুলে প্রার্থনা করে মহান আল্লাহর দরবারে। মিনিট খানেক বাদে উঠে এলো ছাঁদে। মনটাতে সাহস পাচ্ছে এখন। উত্তর দিকে যতদূর চোখ যায় ঘন অন্ধকার। সারি সারি জানা অজানা বৃক্ষ, গুল্মে ঘেরা জঙ্গলের মাথায় আঁধার নেমেছে। তাকালেও বুকটা ধ্বক করে ওঠে। ভোরের আযান শুনতে পায় ইমা। আশ্চর্য! আযান উত্তরদিক থেকেই আসছে। ইমার কৌতূহল হলো। মনে হতে লাগল মোবারক মিথ্যা বলেছে। ফজর আদায় করে ইমা সতর্কে বাইরে এলো। খামারের মুখে বাঁধা জার্মান শেফার্ডগুলো শুয়ে আছে। একটা পাতা পড়লেও কান খাড়া করছে ওগুলো। ইমা সাবধানে গেটের কাছে এলো। সারারাতের পাহারার পর ভোরবেলাটায় মতিনের কাকনিদ্রা গাঢ় হয়ে আসে। ইমা ওর নাক ডাকার শব্দ শুনতে পায়। গেট তালাবন্ধ। খুব সাবধানে চাবির গোছা থেকে চাবি তুলতেই মতিন চোখ মেলে। মতিন কিছু বোঝার পূর্বেই হাতের চাকু দেখিয়ে সরিয়ে দেয়। চাবি দিয়ে তালা খুলে ফেলে চট করে ইমা। মতিন থতমত খেয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। স্বাভাবিক হতেই গলা ছেড়ে মোবারককে ডাকে,
” ও মোবারক ভাই, ও ভাই দেখেন ম্যাডাম উত্তর দিকে যায়।”
শেফার্ড গুলো ইতোমধ্যে ঘেউ ঘেউ শুরু করে শিকল সহ লাফাতে লাফাতে। ইমা ভয়ে ওদিকে তাকিয়ে আবার মতিনের চেঁচানো দেখছে। কানে হাত দিয়ে ধমকায় মতিনকে,
” ঐ চুপ! একদম চুপ।”৷ ধমকে মতিনের গলার স্বর সাময়িক নিচু হলেও ফের আগের মতো চড়া হয়। সেই সাথে তাল মিলিয়ে শেফার্ডগুলোও ডাকে। ইমা সময় ব্যয় না করে গেট পার হয়ে বেরিয়ে গেল। মতিন বাঁধা দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও বিফল হয়। স্যারের বউ না হলে চ্যাংদোলা করে ভেতরে ঢুকিয়ে আনত কিন্তু এ যে সয়ং কর্তী। তাকে চ্যাংদোলা তো দূরে থাক ছুঁতেও সাহস পায় না মতিন। এমন অসহায়ত্বে নিজেকে ধিক্কার দেয়। তাড়াতাড়িতে ভেতরে ঢুকে মোবারককে খবর দিতে ছোটে। ইমা দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। রাতের আঁধার এখনো খানিকটা চারপাশে। খামার বাড়ি থেকে যত এগোচ্ছে ততই নির্জনতা চোখে পড়ে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে পাচ্ছে ঝোপের মধ্যে থেকে। হঠাৎ ভারী কিছু পড়ার শব্দে গা ছমছম করে ওঠে। পা নড়তে চায়না। পেছন ফিরে তাকায়। খাবার বাড়ি ভোরের কুয়াশায় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মোবারকের ডাক ভেসে আসতেই ইমা আরও জোরো পা চালায়। ভয়কে জয় করতে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম জপে। হঠাৎ ঝুপ করে কিছু পড়তেই ইমা দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘোরে মধ্যে সে অনেকটা পথ চলে এসেছে। ভোরের আলো বড়ো বড়ো গাছের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে। ইমা খেয়াল করল সে ফাঁকা রাস্তা ছেড়ে বনের মধ্যে ঢুকেছে। সামনে পায়ে হাঁটার রাস্তা নেই। এদিকে বসতি নেই এটাই বোঝা যাচ্ছে। কোনদিকে গন্তব্য তারও চিহ্ন ঠাহর করতে পারল না ইমা। চারিধারে বড়ো বড়ো শাল,মেহগনি, জারুল সহ বন্য গাছের সারি। লোকালয়ের মতো অন্ধকার সহজে কাটবে না এখানে। ইমা নিজের বোকামি বুঝে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। বার বার বিপদ দূরের দোয়া দরুদ পড়ছে। মাথা কাজ করছে না ভয়ে। দোয়ার আয়াত আঁটকে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। ঠিক তখনই বা’পাশ থেকে গা হিম করা কিছুর শব্দ পেল। মেয়েলী হাসি না অন্য কিছু সঠিকভাবে বুঝতে পারল না ইমা। ওর মনে হচ্ছে কেউ ওর দিকে সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে। না দেখেও বুঝতে পারছে সেই অশরীর বিভৎস মুখের ক্রুর হাসি। ইমা অনেক সাহস করে ঘুরে তাকাল। না, কেউ নেই। তবুও স্বস্তি পেল না। শিকারী ভীত শিকার নিয়ে খেলছে। খেলা শেষ হলেই বুঝি ঘাড় মটকে রক্ত শুষে নেবে। তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেবে কোনো গাছের মগডালে। কেউ খুঁজে পাবে না ওকে। শানের সাথে আর দেখা হবে না ভাবতেই ইমার কান্না পায় এবার। ঠক ঠক করে কাঁপছে তিন কুলহু পড়তে পড়তে। শব্দটা ফের শুনতে পেয়ে ইমা দিশাহীন দৌড়াতে লাগল, শান, শান ডাকের চিৎকার করে।
চলবে,,,
চলবে,,,,