মাঝরাতে দরজা বন্ধ করে আরশাদ বিছানার দিকে গেলো। তাকে দেখামাত্রই ভুত দেখার মতো ঘাবড়ে গেলো ঝিনুক।
ভিতু স্বরে তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করলো,
আপনি জামাই?
না আমি কারো জামাই না। তুমি কি আমাকে আগে থেকে চিনতে?
আপনি না গুন্ডা আশু?
হোয়াট! আরশাদ ক্ষেপে গেলো। কিন্তু অপরিচিত ঝিনুককে কিছুই বললনা।
ধড়াম করে দরজা খুলে ফেললো। মা… বলে গলা ছেড়ে ডাক দিলো।
জোবেদা বেগম সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে মাত্রই বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন।
ছেলের গলা শুনেই তড়িঘড়ি করে ছুটে গেলেন ছেলের রুমের সামনে।
কিরে কি হয়েছে?
কি মুখকাটা মেয়েকে বউ বানালে?
ছোটলোক কোথাকার। মুখের ভাষার লাগাম নেই। আজ রাতেই আমাকে বলে গুন্ডা আশু। বাকি জনমে কি করবে বুঝতে পারছো?
জোবেদা বেগম ঝিনুকের সামনে গিয়ে,
তুমি এটা কেন বললে আমার ছেলেকে?
আন্টি আমি যে স্কুলে পড়ি। সেই স্কুলের সব প্রোগ্রামের নেতৃত্ব দিতো উনি। আর একাধিকবার উনি আমাদের স্কুলের সামনে মারামারি করেছে। তারপর থেকেই স্কুলের অনেক ছেলেমেয়েই উনাকে গুন্ডা আশু বলে।
ওর কথা সত্যি আশু?
বাদ দাওনা মা। সেই কত আগের ঘটনা। মা দেখলে তোমাকে আন্টি বলে। কতবড় ফাজিল মেয়ে।
ঝিনুক ছোট্ট করে বলল,
উনি বলে উনি আমার জামাই না। তাহলে আপনাকে আমি আন্টি না বলে কি বলব? বলেন আন্টি?
আরশাদের সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে। সুতরাং আমি তোমার শাশুড়ি। স্নেহময় সুরে জানালো জোবেদা বেগম।
আচ্ছা শাশুড়ী।
আচ্ছা শাশুড়ী নয়। আচ্ছা মা বলতে হয়।
আচ্ছা মা।
এইতো মিষ্টি মেয়ে।
আর শুনো বিয়ের আসর থেকে বউ পালিয়ে যাওয়াতে আরশাদের মন খুব খারাপ। একটু বোঝার চেষ্টা করো তুমিও। সেই মেয়েকে আমরা সবাই পছন্দ করেছি। অথচ কিভাবে কি ঘটে গেলো বুঝলামনা ঠিক।
মা এই ধড়িবাজ মেয়েকে কোথা থেকে ধরে এনে আমার বউ বানিয়ে দিলে?
আরে বাবা তুই ও না কি সব বলছিস। ও হলো আমাদের খামারবাড়ির ম্যানেজার পরশের মেয়ে। তোর বাবা তাদের স্বপরিবারে দাওয়াত দিয়েছে। ও তোর বিয়েতে অতিথি হয়ে এসেছে তার বাবার সাথে। যখন শুনলাম বিয়ের পাত্রী নিখোঁজ হয়ে গেলো। তখন তোর বাবা পরশকে অনেক অনুরোধ করে তার এই মেয়েকে তোর সাথে বিয়ে দিতে রাজী করালো।
ও কি এভাবেই বিয়েতে এসেছে?
তোর মাথা খারাপ?
ও জামাকাপড় পরে এসেছে। পরে আমাদের কয়েকটা মেয়ে সেন্টার থেকে ওকে নিয়ে গিয়েছে পার্লারে। আর গয়না শাড়িও আমরা তোড়জোড় করে ম্যানেজ করে ফেলেছি।
কেননা বিয়ের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে শূন্য হাতে বউ ছাড়া ঘরে ফেরা বড় অমঙ্গল। বউ নিয়েই ঘরে ঢুকতে হয়। এছাড়া আর কোন গতি ছিলনা আমাদের। আর অমন পরিস্থিতিতে তোকে দেখানোর ও সুযোগ মেলেনি। তোর বাবা বলল,আমার পছন্দ করা মেয়ে আরশাদ ফেলে দিবেনা। বুঝলি এই হলো ঘটনা।
মা বুঝতে পেরেছি। এবার তুমি যাও।
আচ্ছা বাবা। কোন ঝামেলা করিসনা।
জোবেদা বেগম খোদার নাম জপতে জপতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। আরশাদ দরজা বন্ধ করে দিলো ভিতর থেকে।
আরশাদ বিছানার পাশে গিয়ে বসে,
এই মেয়ে তোমার নাম কি?
ঝিনুক।
হুম। আমার কিছু কথা মন দিয়ে শুনবে?
বলেন।
তুমি আমার থেকে যতটা সম্ভব দূরে দূরে থাকবে। তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছেনা। এবং বিষয়টা আমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্যরা যেন ভুলেও টের না পায়।
ঝিনুক অবোধ শিশুর মতো মাথা কাত করে সম্মতি জানায়। এতে আরশাদের জেদ কিঞ্চিৎ পশমিত হয়।
জিজ্ঞেস করলো তুমি কিসে পড়ো?
এবার এস এস সি দিবো।
ওহ। এখন তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আর পড়বে?
ঝিনুক নরম স্বরে জানালো, পড়বো। বাকিটা আপনার ইচ্ছা।
আমার ইচ্ছেকে জড়াচ্ছ কেন?
ওমা। স্বামীর ইচ্ছেকে সম্মান দিবনা?
ডিজগাস্টিং। কে তোমার স্বামী?
আপনার মা বলল আপনি আমার স্বামী।
হুম স্বামী। বাট তা শুধু নামেই। অর্থাৎ লোকদেখানো। লোকভুলানো।
ঝিনুকের সারামুখজুড়ে অমাবস্যার আঁধার নেমে এলো। অসহায়ের মতো ফুলসজ্জার বিছানা থেকে নেমে গেলো। বিয়ের শাড়ি না চেঞ্জ করেই সোফায় গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে শুয়ে গেলো।
কি ব্যাপার তুমি সোফায় কেন ঘুমাচ্ছ?
রুক্ষস্বরে জানতে চাইলো আরশাদ।
আপনার বিছানায় আপনিই ঘুমান আরশাদ ভাইয়া। সেখানে ঘুমানোর অধিকার আমার নেই। তাই ইচ্ছেটুকুও মরে গিয়েছে।
ঝিনুকের টনটনে ব্যক্তিত্ববোধ ও আত্মমর্যাদাবোধ দেখে আরশাদের ভালো লাগলো। ঝিনুককে ঘাটানো ঠিক হবেনা নিশ্চিত জেনে আরশাদ ও ফুলশোভিত বিছানায় ঘুমিয়ে গেলো।
ঝিনুক দুআঁখির কোনায় টলমল অশ্রু নিয়ে ঘুমিয়ে গেলো।
পরেরদিন পাখি ডাকা ভোরেই ঝিনুকের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। তবুও উঠতে ইচ্ছে করছেনা। ব্যথার অনুভূতিরা গুমরে গুমরে মরছে।
মনে মনে তার বাবার উপর অভিমানের ঝাঁপি তুলে ধরলো। বাবা কি চাইলেই পারতোনা আশুর বাবাকে না করে দিতে। নাকি বাবা লোভে পড়ে গেলো।
পরক্ষণেই বিপরীতমুখী ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। সব দোষ ললাটের। ললাটের লিখন যায়নাকো খণ্ডন। একথা দাদী প্রায়ই বলতো। জন্ম মৃত্যু বিয়ে এই তিন নাকি আল্লাহর হাতে। তাহলে বাবার আর দোষ কি। আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত। এদের সামান্য বেতনভুক্ত কর্মচারী আমার বাবা। তাদের এত বড় সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যখন বাবার উপর চাপিয়ে দিলো। তখন আসলে বাবার না করার কোন পথ ও ছিলোনা। মনিবের অনুরোধ ভৃত্য মানা করার দুঃসাহস দেখাবে কি করে। কিন্তু আমার ও বা কি দোষ।
কত শখ করেছি নিজের বিয়ে নিয়ে। হাতে পায়ে মেহেদী দিবো। অনেক গয়না পরবো। গায়ে হলুদে হলদে রানী সেজে থাকবো। লাজুক লাজুক বদনে বাসর করে বসে থাকবো। বর এসে চিবুক উঁচিয়ে ধরবে। আমি লাজুকলতার মত নুইয়ে পড়বো। অমনি সে ধরে ফেলবে।
আর এখন কি হলো। ওই গুন্ডা আশু সুন্দর করে কথাই বললোনা। উনার ও বা কি দোষ। বিয়ে করতে গেলো কাকে আর করতে হলো কাকে। আমার পড়াশোনার কি হবে। ঝিনুকের দীর্ঘ ভাবনায় ছেদ ঘটলো রুমের দরজার ঠকঠক আওয়াজে।
ঝিনুক দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
সুপ্রভাত ভাবি। থুক্কু। প্রভাত বহু আগেই গত হয়েছে। শুভসকাল ভাবি।
ঝিনুক অচেনা স্থির চোখে চেয়ে আছে মেয়েটির দিকে।
চিনতে পারছনা এইতো? আমি আরিশা। আরশাদ ভাইয়ার একমাত্র ছোট বোন। ভাইয়া উঠেছে?
ঝিনুক বলল,না উনি ঘুমাচ্ছে।
ওমা! সে কি কথা! উঠাও। ফ্রেস হতে বল। আর তোমার এখনো বিয়ের শাড়ি কেন পরনে? স্ট্রেঞ্জ! যাও ওয়াশরুমে। একটু পরেই নাস্তা নিয়ে আসছি আমি।
ঝিনুক শুধু একবার ভাবলো। এক গাছের ফল দুরকম ফ্লেভারের হয় বুঝি। বোনটা কত মায়াভরা কন্ঠে কথা বলে। শুনতেই মনটা ভরে যায়। আর ভাইটা হয়েছে আস্ত একটা ড্রাগন ফল। বাইরেই শুধু রূপের জৌলুশ। ভিতরটা পানসে ভরা।
ঝিনুক ডাক দেওয়ার আগেই আরশাদ বিছানায় উঠে বসলো। ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল করে নিলো অতিরিক্ত গরমের জন্য। বিয়েতে পরে আসা ড্রেসটা পরে নিলো।
আরশাদ ঝিনুকের দিকে চেয়ে মনে মনে উচ্চারণ করলো এ দেখি পিচ্চি মেয়ে। পিচ্চি হলে কি হবে। একেবারে ধানি মরিচ। খুব ঝাল। শাওয়ার নিয়ে আমার বড় উপকার করেছো। তবে তোমাকে এনিহাও মুক্ত করে দিবই বাবা মাকে ম্যানেজ করে।
এত ব্যকডেটেড মেয়েকে নিয়ে চলা মুশকিল। বউ ছাড়া ঘরে ঢোকা অমঙ্গল। বউ নিয়ে ঢুকলাম। কি এমন মঙ্গল হয় দেখবো। আমি বিয়ে করবো স্মার্ট মারিয়াকে। যে কালচার মেইনটেইন করে চলতে পারে।
আপনাকে দেখলে মনে হয় বানর বংশের একজন। ভুলে মানুষ হয়ে গিয়েছেন।
হঠাৎ ঝিনুকের মুখে এমন ব্যাঙাত্মক কিছু শুনে আরশাদ অগ্নিমূর্তি হয়ে যায়। নেমে তড়াক করে ঝিনুকের চুল চেপে ধরলো মুঠি করে। ঝিনুক কুঁকিয়ে উঠলো।
এটা কেন বললে?
ঝিনুক তার একটি আঙ্গুল তাক করে আরশাদের খোলা পায়ের দিকে ইঙ্গিত করলো।
আরশাদ মাথা নামিয়ে দেখলো , রোজরাতের মতো গতরাতেও সে শর্ট ট্রাউজার পরে ঘুমিয়েছে। তাই তার ঘনকালো লোমভর্তি উদাম পা দুটো দেখা যাচ্ছে। ছোটবেলায় তার পা দেখে বন্ধুরাও তাকে বানর বলতো। গোপনে সংকোচবোধ করলেও তা ঝিনুককে বুঝতে দিলোনা।
শুধু কাঠ কাঠ গলায় বললো,
নাস্তা খেয়ে জলদি তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে তোমাদের বাসায় পাঠিয়ে দিবো ড্রাইভার দিয়ে।
#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ১
#রেহানা_পুতুল