তুমি আছো তুমি রবে পর্ব -০৬

#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ৬
#রেহানা_পুতুল
তড়িতেই আরশাদ পত্রিকাটি রেখে খপ করে ঝিনুকের মুখ চেপে ধরে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

ঝিনুক তার দুঠোঁটের উপর থেকে আরশাদের হাত টেনে সরানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হলো। সজোরে কামড় বসিয়ে দিলো আঙ্গুলে। আরশাদ চাপানো ব্যথা পেয়ে হাত সরিয়ে নিলো।

ঝিনুক বন্ধ দরজা খুলতে যাচ্ছিলো। আরশাদ ঝিনুকের হাত পিছন থেকে টেনে ধরলো। বিছানার উপর ফেলে দিলো তাকে।

মাথার উপর চারহাতার সিলিং ফ্যান ঘুরছে। তবুও আরশাদ ঘেমে টইটম্বুর হয়ে যাচ্ছে। গায়ে থাকা শার্টের উপরের তিনটা বোতাম খুলে ফেললো।

ভারী নিঃশ্বাস উঠানামা করছে। ঝিনুকের অপ্রত্যাশিত আচরণে রাগ চড়েছে মাথায়। তবুও নিজেকে দমন করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

এটা টিনের ঘর। পাশের রুম থেকে যেন কেউ না শুনতে পায়। তাই আরশাদ ঝিনুকের দিকে ঝুঁকে ধীর গলায় আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
আগের জনমে কুকুর ছিলে নাকি?

ঝিনুক স্বভাবজাতেই আপোষহীন মেয়ে। প্রতিউত্তর দিলো লক কোয়েশ্চেন করেই।

আপনিও কি পূর্বের জনমে থেকে মুরগী ধরা চোর ছিলেন নাকি?

আরশাদ থতমত খেয়ে গেলো। স্থিরতা নিয়ে জবাব দিলো হ্যাঁ চোর ছিলাম।

ঝিনুক ও বেশ তাল মেলাতে পটিয়সী। হ্যাঁ আমিও কুকুর ছিলাম। ভুল করে মানুষ হয়েছি।

আরশাদ বললো, আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়ার জন্য মানুষ হয়েছো।

এটা আপনার ধারণা না বিশ্বাস?
দুইশো পার্সেন্ট বিশ্বাস। তা না হলে কেউ নিজের হাজব্যান্ডকে দেখে না চেনার ভান করে? ভূত বলে গলা ফাটায়? বাকি মানুষগুলো কি ভাবছে শুনে?

যা ইচ্ছা ভাবুক। কে হাজব্যান্ড? কিসের হাজব্যান্ড? আমাকে না জানিয়ে আসার কুফল এটা।

আমার আসার কথা এখানের সবাই জানে শুধু একজন ছাড়া। আম্মু বললো এটা নাকি তার জন্য সারপ্রাইজড হবে।

কেন এসেছেন? আমাকে নিতে? আমি যাবনা আপনার সাথে।

আমি কাউকে নিতে আসিনি। এ গ্রামটা নাকি সুন্দর। তাই দেখতে এসেছি আরিশাকে নিয়ে।

আরিশা নামটি শুনেই ঝিনুকের মুখ চকচক করে উঠলো রূপোর থালার মতো।

দেখি আমি উঠবো। আরিশার সাথে দেখা করবো।

আরিশা চলে যাচ্ছেনা কোথাও। বলে আরশাদ কামড় দেওয়া হাতের আঙ্গুল
দুটো ঝিনুকের চোখের সামনে ধরলো। কি করলে এটা দেখো।

ঝিনুক ভালো করে চেয়ে দেখলো রাক্ষসের মতো তার সব দাঁতের চাপ বসে গিয়েছে আরশাদের হাতের আঙ্গুল দুটোর পেট বরাবর । লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে সর‍্যি বলল। বরফ এনে দিচ্ছি বলে উঠে গেলো।

সর‍্যি শব্দটা শুনে আরশাদের জিইয়ে উঠা রাগ মিইয়ে গেলো অস্তমিত সূর্যের ন্যায়।

আরিশা দরজা খুলে ফ্রিজের সামনে গেলো। বরফ ও একটা রুমাল এনে দিলো আরশাদের হাতে। দিয়েই বের হয়ে গেলো।

‘সর‍্যি’ শুনে আরশাদের পশমিত হওয়া রাগ পূনরায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।
আঙ্গুলে বরফ ঘষতে ঘষতে চিন্তা করতে লাগলো,
তার খালার বাড়ি এসেছি। সে ব্যথা দিয়েছে। অথচ ব্যথা উপসম করতে হচ্ছে আমাকে। আমার জন্য যার অন্তরে এতটুকু মানবিকতা নেই একজন মানুষ হিসেবে । তাকে নিয়ে একজনম পাড়ি দিতে হবে। ওহ গড! সেভ মি!

মারিয়া তোমার অনুভূতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে আমি শুধু তোমাকেই ঠকাইনি। নিজেকেও ঠকিয়েছি চরমভাবে। কত ঘুরেছো আমার পিছু পিছু মুরগীর ছানার মতো। কত অনুনয় করেছো। কত মেসেজ নামের রচনা লিখেছো ফেবুতে। হয়তো আজো আমায় নিয়ে দূরাশার মাঝে আশার আলো খুঁজতেছো নীড় হারা পাখির মতো।

আমি ছোটবেলা থেকেই জেনে আসছি আত্মীয়ের মাঝে বাড়তি আত্মীয়তার বন্ধন হওয়া একেবারেই অনুচিত।
কারণ হিসেবে জানি এতে নতুন সম্পর্কের ধরুন পুরাতন সম্পর্কে ফাটলে ধরে নিশ্চিতভাবে। ঠিক এই ভয়েই আমি তোমার হাতটা ধরতে পারিনি। ভাবলাম তার চেয়ে আমরা যা আছি তাই থাকা ভালো ।

ঝিনুক এসে পড়ায় আরশাদের কল্পনার অবসান হলো।

ভেজা রুমালটা নিতে এসেছি। দেন।
আমি রাতে কোথায় ঘুমাবো ঠিক করে দিও।
আচ্ছা জানাচ্ছি পরে।

ঝিনুক মনে মনে ভাবছে, এত ভালো রেজাল্ট করলাম একটা অভিনন্দন জানালোনা। না ফোনে। না এখন সামনে। একটা অমানবিক ।

এদিকে অন্যরুমে সবাই একত্র হয়ে ঝিনুকের অপেক্ষায় আছে। ঝিনুক পা রাখামাত্রই সবাই যার যার মতো করে নানান প্রশ্নবাণে ঝিনুকের কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে।

গাল ফুলিয়ে ঝিনুক বললো,
তোমাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তোমরা সব নারীরা বাংলার ঘসেটি বেগম আর পুরুষেরা মীর জাফর। আমাকে জানালে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো?

নানু তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে ঝিনুককে তার ভাষায় বুঝিয়ে নিলো মাথায় হাত বুলিয়ে।

আরিশা কোথায় জানতে চাইলো ঝিনুক। তার খালা বলল মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। জার্নি করে এসেছে। তাই ঘুম ধরে গিয়েছে শোয়ামাত্রই।

আপু চিৎকার করলে কেন তখন? জ্বলজ্বল দৃষ্টি নিয়ে জানতে চাইলো শায়লা।

ঝিনুক রুমের ভিতরের ইতিবৃত্ত জানালো সবাইকে। খালা ঝিনুককে সব উপহার সামগ্রী দেখালো। ঝিনুক খালার ফোন দিয়ে ভিডিও কল দিলো তার বাবার ফোনে। মায়ের সাথে কথা বলল। বোন জিনিয়া তাদের বাসায়। বোন ভাগিনার সাথেও কথা বলল। নানু তার মা বাবাকে সব কাপড় চোপড় মেলে ধরে দেখালো।

ঝিনুকের মায়ের চোখে পানি এসে গেলো মেয়ের আগত স্বর্গীয় সুখময় জীবনের কথা ভেবে। ঝিনুকের ছোট্ট মামাতো ভাই রাব্বি আঙ্গুলে গুনে গুনে খাবারের আইটেম সংখ্যা জানালো ফোনে তার মাকে। সবাই হেসে কুটিকুটি হলো সব নামগুলো তার মুখস্থ দেখে। আপা কাজ আছে বলে খালা ফোন রেখে দিলো।

ঝিনুক আলতো করে রাব্বির পেটে ঘুষি মেরে, খাদ্য তালিকার নাম আমাদের পেটুক বন্ধুর মনে না থাকলে কার থাকবে। ফুডিবয়। প্রচুর খাবার আনছে তোর ভাইয়া। তুই এগুলো শেষ না করে যাবিনা। যতদিন লাগে লাগুক।

তুমি পঁচা ঝিনুকপু। আমাকে সবার সামনে লজ্জা দিচ্ছো।

ওলে ওলে কি বলে। তাহলে আর খাইসনা।

আরিশা ঘুম থেকে উঠে গেলো। আরশাদ ও রুম থেকে বের হয়ে গেলো। বাড়ির সামনের পথ হেঁটে এলো মোবাইলের টর্চের আলো ফেলে। আরিশা ঝিনুককে সামনে দেখেই গলা জড়িয়ে ধরলো। কুশলাদি বিনিময় করলো। ঝিনুকের সাথে গিয়ে উঠানে নলকূপে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হলো।

সবাই বারবার বলা সত্ত্বেও আরিশা ও আরশাদ কিছুই খেলোনা। আরশাদ জানালো এমনিতেই বেশী খাওয়া হয়েছে। গ্রামের খাবারে অথেন্টিক স্বাদ পাওয়া যায়। যা শহরে পাওয়া যায় কালে ভদ্রে।

রাতে মুরুব্বিরা যার মতো করে গল্পগুজব করছে। সবার মনে আনন্দ এই ভেবে, নিজেদের মেয়ে ঝিনুকের কত ভালো পরিবারে বিয়ে হলো।

ঝিনুকের নানু বলছে শুধু ধন থাকলে হয়না মন ও থাকতে হয়। এদের যেমন ধন আছে তেমনি মন ও আছে। জামাই ও মাশাল্লাহ। যেমন উঁচা তেমন ফিটাদেহ। কি ভদ্র কথাবার্তা।

নানুর কথার মাঝে তার মামী বললো, শুধু তারা ভালো হলে হবেনা। ঝিনুকের ও তাদের মন জুগিয়ে চলতে হবে।

তার খালা বলল,আল্লাহ ভাবি থামো। ঝিনুক শুনতে পাবে। দেখনা আমরা কেউই ওকে এমন কিছু বলছিনা। ও তেল মেরে চলতে পারেনা। চলা পছন্দ ও করেনা। যতটুকু দরকার ততটুকু ঠিকই চলবে।

তার নানু বলল,হ ছোডকাল হতেই হেতি পাকনা তেঁতুল । নিজেও কম বুঝেনা।

ছোট ছোট বাচ্চারা টিভিতে কার্টুন দেখছে। ঝিনুক,শায়লা,আরিশা, ইতি পড়ারঘরে বড় লুডু ঘর নিয়ে খেলতে বসে গেলো।

আরশাদকে শায়লা ডাক দিলো। এইই ভাইয়া একলা কি করেন সোফায় বসে? এদিকে আসেন দোকলা হই। আরশাদ তাদের কাছে গেলো বোরনেস কাটানোর জন্য।

তারা খাটের উপর বসে খেলছে। আরশাদ খাটের সামনে চেয়ার টেনে বসলো। তাদের খেলা দেখছে আর মাঝে মাখে খোঁচা মেরে ঝিনুককে উদ্দেশ্য করে এটা ওটা বলছে। প্রথম ম্যাচে ঝিনুক হেরে গেলো। শায়লা চ্যাম্পিয়ন হলো।

আরশাদ শব্দ করেই বলল,
শুধু খেয়ে খেয়ে মোটা হলে হয়? এটা কোন গুণ নয়। খেলাধূলাও পারতে হয়।

ওরা বুঝে নিলো কথার বুলেট কোনদিকে ছুঁড়ে মারা হয়েছে।

দ্বিতীয় ম্যাচ শুরু হলো। এবার ঝিনুক চ্যাম্পিয়ন হলো। ফোঁড়ন কেটে বললো, কারো প্রথমবারের হেরে যাওয়া দেখে জাজমেন্ট করা মানুষগুলো আমার চোখে বলদ ছাড়া আর কিছুই নয়।

আরিশা বলল,ভাইয়া তুমি মুখ বন্ধ রাখবে?
আরশাদ আরিশার চোখের সামনে হাত মেলে ধরে বললো, দেখ কি করেছে কামড়ে।

ব্যাপারনা ব্রো। বি কুল। বিয়ে করলে অমন দু চারটা কামড় খাওয়া মজার।

আরশাদ চোখ বড় করে বোনের চিবুক ধরে, এইই তুই কি আমার বোন না অন্য কারো বোন? এত বশ হয়ে গেলি কিভাবে?

আমি একজন নারী। তাই নারীর সাপোর্টেই কথা বলতে ভালো লাগে।

আরশাদ ইতিকে বলল,ছোট আপু তুমি সরে যাও। আমি এক ম্যাচ খেলি। দেখি এবার প্রথম কে হয়।

শায়লা বলল। ওকে ডান। এই ইতি তুই এবার নিরব দর্শক।

ঝিনুক বলল,ইতি তোর কাজ হলো চোর ধরা। ভালো করে খেয়াল করবি কিন্তু। তাহলে গিফট পাবি।

আরিশা বলল, বাজি ধরি আসো। যদি ভাইয়া চ্যাম্পিয়ন হয় তাহলে ভাবিকে ভাইয়া যেটা বলবে ভাবি শুনতে বাধ্য। আর ভাবি হলেও একি রুলস ফলো করতে হবে ভাইয়ার ও। রাজি?

আমি রাজী। ঝিনুক আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল। আমিও রাজী। আরশাদ ও বীরদর্পে জানালো।

সব বাচ্চারা ও ফাইনাল ম্যাচ দেখতে এসে জড়ো হয়েছে খাটের উপরে। খেলার তৃতীয় ম্যাচ শুরু হলো। পজিশন একটু পরপর পাল্টে চারজনের দিকেই যাচ্ছে। টান টান উত্তেজনা। আরিশা বিড়বিড় করে বলল,বাসায় ত প্রায় আমিই চ্যাম্পিয়ন হই।

আরিশা চুপ কর। ভ্রুকুঁচকে আরশাদ ডাক দিলো।
হুম বুঝলাম কিছু।

ঝিনুক জিতে যাচ্ছে যাচ্ছে করেও পারলোনা। আরশাদ চ্যাম্পিয়ন হলো। শায়লা খুশিতে হাততালি দিতে থাকলো। ঝিনুকের সাথে সাথে আরিশার ও মন অতিশয় ভার হয়ে খেলো।

সামান্য কিছুও মানুষকে অসামান্য আনন্দ দিতে পারে। মনে এক সমুদ্র প্রশান্তি এনে দিতে পারে।

আরশাদের মন অধিক ফুরফুরে হয়ে গেলো। সে বুক টানটান করে,
উপস্থিত দর্শক। বিজয়ের মালা আমার গলায়। তাই আরোপিত বিষয়টা আমি পাবলিক প্লেসেই উত্থাপন করতে চাই। তার আগে বলতে চাই, আপনারা দেখেছেন আরিশা নামের একজন আমাকে একটু আগেও তিরষ্কার করেছে। ক্ষমতা এখন আমার হাতে। তাই তার শাস্তি অবধারিত। সে আজ রাতে এক ঘন্টা আমার পা টিপবে। সেবা করবে।

আর শর্তানুযায়ী বিরোধী নেত্রীর প্রতি আমার কড়া নির্দেশ হলো,আরিশা চলে যাওয়ার পর সে আমার রুমে ঢুকবে। দরজা বন্ধ করবে। বেডে উঠবে। তারপর যা করবে তা হলো,
চলবে…( ৬)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here