তুমি আছো তুমি রবে পর্ব -০৯

#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ৯ #রেহানা_পুতুল
লোভনীয় খাবারের লোভ সামলানো যে কি কষ্টকর। তা ক্ষুধার্ত মানুষটিই কেবল অনুধাবন করতে পারে। যাক অন্তত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই। নয়নকেও করি কিছুটা স্বার্থক।

আচমকা ক্ষ্যাপা বাঘের ন্যায় তেড়ে আসা বেসামাল অনুভূতিকে কিয়ৎক্ষন বাদেই সামলে নিলো আরশাদ।
শেষ রাতের দিকে ঝিনুকের কপালে হাত রাখলো। জ্বর বেড়েই চলল। কপাল পুড়ে যাচ্ছে। যেন মাত্রই তার তরুণী বধুটি অগ্নিস্নান করে এলো। ঝিনুককে হাতের বাহু থেকে নামিয়ে বালিশে শোয়ালো অনুভূতির যতনে।

ডিম লাইটের মৃদু আলোতে উঠে থার্মোমিটার নিলো। জ্বর মেপে দেখলো একশো দুই ডিগ্রী। ভেবে পাচ্ছেনা কি করবে। এত রাতে সালেহা, আরিশা বা বাবা মাকে ডেকে উঠানো সমীচীন হবেনা। ওয়ারড্রবের ড্রয়ারের ভিতর থেকে একটা নাপা এক্সট্রা ট্যাবলেট নিয়ে ঝিনুককে খাইয়ে দিলো।

বেসিন থেকে একটি সুতি রুমাল ভিজিয়ে নিলো আরশাদ। ভেজা রুমালটি এপিঠ ওপিঠ করে কপালে জলপট্টি দিতে লাগলো। নিমিষেই রুমাল এতটাই গরম হয়ে যাচ্ছে যেন তাওয়ায় ভাজা রুটি। উঠে গিয়ে রুমাল আবার ভিজিয়ে আনলো। এভাবে কয়েকবার দিলো। জ্বরের তাপমাত্রা কিছুটা স্তিমিত হলো। আরশাদ এবার শুয়ে গেলো।

ডিম লাইটের হলদে আলোয় ঝিনুকের শুষ্ক বদন পানে ভাবলেশহীনভাবে চেয়ে রইলো আরশাদ। অবাক হয়ে গেলো নিজেই নিজেকে দেখে।

গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে লাগলো,
এ কি করে সম্ভব! যে কিনা এই প্রথম রাত জেগে কোন অসুস্থ মানুষের সেবা করে যাচ্ছে । তাও এমন একজনের । যে আমার হৃদয়টাকে বিষিয়ে দিয়েছে সময়ে অসময়ে। যখন তখন। যে আমাকে একাধিকবার অপ্রীতিকর শব্দে সম্বোধন করেছে। বানর,গুন্ডা,চোর,অমানুষ, ভূত, বলদ । আরো কতকিছু।

এই আমি কি সেই আমি। যে নিজেই গ্রামে যাওয়ার আগে প্ল্যান করেছি এই দস্যি মেয়েটাকে জীবন থেকে মুক্ত করে দিবো। এবং সেই প্ল্যান গ্রামে যাওয়ার পরেও অব্যাহত ছিলো। কিন্তু আজ তার শরীরের উষ্ণতা যেন আমাকে যাদু করেছে। পাশাপাশি আমার পরম প্রিয়জনদের সাথে তার মধুর ঘনিষ্ঠতাও আমাকে বিমুগ্ধ করেছে।

তুমি মোহাচ্ছন্ন করেছে আমায় হে বধু৷ আমি ভুলে গিয়েছি অতীতের সব৷ আমি যেন দিগন্ত হারা উদাসী পথিক। তুমি ছাড়া নিস্তার নাই। ঝিনুক ইউ আর এ রিয়েলি ম্যাজিশিয়ান।

ফজরের আযান কানে এলে আরশাদের যেন সম্বিৎ ফিরে এলো। কি অদ্ভুত মানব আমি! জ্বরে কাতরানো বধু নিয়ে মাখো মাখো কল্পনা করছি, বলেই উঠে দাঁড়ালো।

দরজা খুলে বের হলো। মা বাবা নামাজ পড়তে উঠে গিয়েছে। আরিশা বেলা করে উঠে। তাই মা বাবার রুমেই গেলো আরশাদ। চাপানো দরজার বাইরে থেকে মাকে ডাকলো আরশাদ।

এতো ভোরে ছেলের ডাক শুনে জোবেদা বেগমের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো। তিনি মাত্রই অজু করে এলেন নামাজের জন্য। দরজা একটানে খুলে ফেললেন। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কি হয়েছে বাবা?

মাঝ রাত থেকেই ঝিনুকের অনেক জ্বর আম্মু । তোমরা সবাই ঘুমিয়েছিলে বলে বিরক্ত করিনি।

জোবেদা বেগম চটে গেলেন ছেলের উপরে। পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলেন ছেলের রুমের দিকে। গলায় তেজ ঢেলে বললেন, মানুষ হবিনা আর। রাত হয়েছে তো কি হয়েছে। তোর ডাকা উচিত ছিলো। তিনি রুমে প্রবেশ করেই ঝিনুকের মাথার কাছে বসলেন। কপালে হাত রাখলেন।

হায় আল্লাহ। অনেক জ্বর। মাথায় পানি ঢালতে হবে। তুই থাক। আমি সালেহাকে ডেকে তুলি। একটু বাদেই আরিশা ও সালেহা এলো। বালতিতে করে পানি মগ আনলো। আরিশা ঝিনুকের মাথাকে বালিশের উপর বিছানো প্লাস্টিকের কাগজের উপর তুললো। সালেহা জলচৌকিতে বসে ঝিনুকের মাথায় পানি ঢালতে লাগলো। আরিশা ভেজা চুলের ভিতর হাত গড়িয়ে নিতে লাগলো।

বেলা হয়ে গেলে জামান খান বাসায় তাদের নির্ধারিত পরিচিত ডাক্তার ডাকলেন । অতিরিক্ত ঠান্ডা লেগে গিয়েছে। তাই জ্বর এসেছে। সমস্যা নেই। সেরে যাবে। ড্রাগ দিয়ে দিচ্ছি বলে, ডাক্তার ঔষধের নিয়ম ও মাথায় পানি কয়বার দিতে হবে বলে চলে গেলো।

জামান খান বলল,ঠান্ডা কিভাবে লাগলো মেয়েটার?

আব্বু ভাবি গ্রামে নাকি রোজ পুকুরে অনেক সময় সাঁতার কাটতো। পানিতে লাফালাফি ঝাঁপাঝাপি করতো। আবার বৃষ্টি হলেও ভিজতো।

এমন ঠান্ডায় নিউমোনিয়া হয়ে যায় কিন্তু। চিন্তিত কন্ঠে বললেন জামান খান।

ঘন্টা তিনেক পর জ্বরের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমে আসলো। আরশাদ তাদের ব্যাবসার কাজে ফ্যাক্টরিতে চলে গেলো। মাস্টার্স কমপ্লিট করে আরশাদ নিজেদের ব্যাবসায় মন দিলো পরিবারের সবার ইচ্ছেনুযায়ী। তার বাবা মা চাকরি মোটেও পছন্দ করেন না।

সালেহা ট্রেতে করে গরম আটার রুটি, সবজি ভাজি,গরুর কলজি ভুনা এনে দিলো। আরিশা ঝিনুককে উঠিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে মুখ ধুইয়ে দিলো। নিজের হাতে দুটো রুটি জোর করে খাইয়ে দিলো।

সবার আদর, সেবাযত্নে তিন চারদিনের মধ্যেই ঝিনুক সুস্থ হয়ে গেলো। এই কয়রাত আরশাদ তাকে স্পর্শ করেনি বললেই চলে। কারণ একদিকে ঝিনুক অসুস্থ। অপরদিকে ঝিনুকের অঙ্গে স্পর্শ লাগলেই আরশাদের ও তনুমন বিদ্যুৎতের মতো শক খায়। বেঁচে উঠা রিস্কি।

এটা ঝিনুককে যেদিন প্রথম জড়িয়ে ধরলো অর্থাৎ জ্বর আসার রাতে। তখনই উপলব্ধি করতে পারলো। যদিও ঝিনুক জড়িয়ে ধরতে অনুমতি সজ্ঞানে দেয়নি। এটা আরশাদ ভালো করেই অনুধাবন করতে পেরেছে।

তার দেখা ঝিনুক বেশ জেদি, স্পষ্টবাদী, প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন দৃঢ় চিন্তাচেতনার।
বেহায়াপনা, তেলানো, হিংসা, স্বার্থপরতা, মেনে নেয়া, এশব্দগুলো ঝিনুকের অভিধানে নেই।

তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলো যেদিন পুরোপুরি বাঁচতে পারবে। ঠিক সেদিনই ঝিনুককে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিবে বুকের মাঝে। নয়তো আধমরা হয়ে বাঁচতে হবে।

ঝিনুক কলেজে যাওয়া আসা করছে নিয়মিত। কোচিং ও করছে। কমার্সের ছাত্রী সে। মন দিয়ে পড়াশোনা ও করছে। গোটা শিক্ষা জীবনে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসটাই তুলনামূলক কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ । সময় কম। কিন্তু পড়ার চ্যাপ্টার বেশী। তার পড়াশোনায় নূন্যতম গাফিলতি হচ্ছেনা বেঘাত ও ঘটছেনা।

বাবার বাসায় মাঝে মাঝে ননদকে নিয়ে যায় একদিন থেকেই চলে আসে।
শ্বশুরের বাসায় তার কাজ করতে হয়না। সব কাজ একা হাতে সালেহা সামলিয়ে নিতে পারে। দুপুরে ছুটা বুয়া ও আসে একজন। তার মন চাইলে টুকটাক নাস্তা বানায় বিকেলে। কিংবা কখনো সখনো চা নয়তো কফি। এ ভিতরে একদিন তার মা বাবাসহ ঢাকায় বাস করা সকল আত্মীয়স্বজনকে বাসায় দাওয়াত দেওয়া হলো। তারা সাধ্যমতো উপহার সামগ্রী নিয়ে এলো। এবং তারা অনেক খুশী ঝিনুকের সুখীজীবন দেখে।

একদিন ঝিনুক কলেজে গেলে আরশাদ বাবা মায়ের কাছে গেলো।
বাবা একটা বিষয় আলাপ করতে চাচ্ছি।
কিই বল?

ধরো ঝিনুকের বাবা মানে পরশ চাচা,
কথার ফাঁকেই জোবেদা বেগম বললেন,
ওই হারামজাদা এখন কিসের পরশ চাচা। শুধু বাবা বলবি।

ওই হলো আম্মু। চাচা বাবা সেইম। যা বলছিলাম। আমাদের খুব নিকটাত্মীয়রা বাদে বাইরের কেউই জানেনা যে আমি আমাদের খামারবাড়ির ম্যানেজারের মেয়েকে বিয়ে করেছি। এবং বাইরের মানুষ এটা জানার সুযোগ ও ফাইভ পার্সেন্ট।

তাই বলছি উনাকে আলাদা কোন বিজনেস ধরিয়ে দিলে কেমন হয়। এতে আর কোন রিস্ক ও থেকে যাচ্ছেনা শোনার। ধরো মানুষতো। কারো মুখ কি চাপা দেওয়া যায়। হুট করে করতেই পারে একটা নেগেটিভ মন্তব্য।

জামান খান ও জোবেদা বেগম খুব খুশী হলেন পুত্রের উদারনৈতিক চিন্তা-চেতনায়।

স্বতঃস্ফূর্ত গলায় জামান খান বললেন,একদম ঠিক বলছিস। আমি দেখি কিভাবে কি করা যায়।

আচ্ছা বাবা বলে চলে গেলো আরশাদ।

জামান খান বললেন, ছেলে মনে হয় সিধা হয়ে গিয়েছে।

জোবেদা বেগম বললেন , যেখানে তার মেয়েকেই পারলে দূর দূর করে তাড়ায়,সেখানে তাকে নিয়েও ভাবে এখন। যাক আলহামদুলিল্লাহ।

আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া। আমার সম্মান রেখেছে বলে। নয়তো পরশের কাছে আমি মুখ দেখাতে পারতামনা কোনদিন।

_____
বর্ষাকালের কোন এক নির্জনতার রাত্রিতে ভর করে গগন কাঁপিয়ে মাটির বুকে অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি নামলো। ঝিনুক নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা। বৃষ্টি তার ভীষণ প্রিয়।

পড়ার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো। গ্রিলের বাইরে দুহাত বাড়িয়ে দিলো। প্রবল বৃষ্টির তোড়ে গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে তার সারা দেহ ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আনমনা হয়ে গেলো।

বৃষ্টি ভেজা নিশুতি রাতে নিরালায় গুনগুনিয়ে গাইতে লাগলো ,

” ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না। আমার এতো সাধের কান্নার দাগ ধুয়ো না…
সে যেন এসে দেখে,
পথ চেয়ে তার কেমন করে কেঁদেছি…”

আরশাদ খাটে শুয়ে ছিলো। মাথা তুলে ঝিনুককে না দেখে বারান্দায় আসলো। গান শুনে দুহাত দিয়ে পিছন থেকে ঝিনুকের কোমর চেপে ধরলো।

ঝিনুক চমকে উঠে বিষম খেলো। অসহিষ্ণু গলায় কি অসভ্যতামি হচ্ছে? ছাড়ুন বলছি । দিলেন তো গাইবার মুড় অফ করে।

তুমিতো বললে এসে যেন দেখি কেঁদেছো। আমি বিহনে তুমি একা। গাইবার মুড় হয় কি করে বধুয়া?

আমার কিন্তু কামড় দেওয়ার অভ্যাস রয়েছে।

ওহ নো। ছাড়ছি প্রমিজ। শুধু এই আনসারটা দাও। বর্ষাকালকে নাকি আলিঙ্গনের ঋতু, রোমান্টিক ঋতু বলা হয়। এটা কি সত্যি ঝিনুক?

ঝিনুক ঠোঁট বাঁকিয়ে, হুম সত্যি। হাজার সত্যি। এবার তো ছাড়ুন প্লিজ।

চলবে…৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here