#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ১৫ #রেহানা_পুতুল
কেউই আঁচটুকু করতে পারছেনা কি সেই অজানা ইতিহাস। শোনার অধীর আগ্রহ নিয়ে জামান খানের মুখপানে সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে হয়ে আছে।
প্রকৃতি কখনো কাউকে ঋণী করে রাখেনা। শোধ করার উপায় দেখিয়ে দেয়। এটা অনেক বড় সত্যি।
আজ হতে বিশ বছর আগের একরাতের ঘটনা। আমি উত্তরার একটি রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেটা মেইন রাস্তা ছিলনা। রিক্সা খুঁজছি বাসায় আসার জন্য। সেদিন দিনের বেলায় উত্তরার একটি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিলাম । সেই সময়ের দুইলক্ষ টাকা আজকের দিনের কোটি টাকার সমমূল্য। সম্ভবত তারা দুজন মানে হাইজ্যাকার শুরু থেকেই আমার গতিবিধি লক্ষ্য করছিলো।
আমার সামনে একটি মোটরবাইক এসে থামলো। অতঃপর দুজন আমার দুপাশে এসে দাঁড়ালো। সালাম দিয়ে স্যার বলে ডাকলো। আমি বুঝতেই পারিনি। হেসে সালাম নিলাম। খানিক বাদেই তারা আমার পকেটে থাকা টাকাগুলো দিয়ে দিতে বলল। এত পরিশ্রমের টাকার মায়া ছাড়তে কার মন চায়।
আমি জোরে ধমক দিলে তারা একজন আমাকে ধরে ফেলে। আরেকজন চুরি বের করেই প্যান্টের পকেটের মধ্যে টান দিলো। আশপাশের দুএকজন দেখেও তাদের প্রাণের ভয়ে এগিয়ে আসেনি। ওই মুহুর্তে আমি কি পরিমাণ নারভাস হয়েছি তা আজো ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। তারা টাকাগুলো হাতে নিয়েও নিলো।
অমনি ফেরেশতা হয়ে আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলো এই পরশ ভাই। তাদের হাত থেকে সমস্ত শক্তি দিয়ে পরশ ভাই টাকার খামটি আঁকড়ে ধরে। তখন আশেপাশের দুএকজন মানুষের এগিয়ে আসা দেখেই তারা ধারালো চুরি দিয়ে পরশ ভাইকে পরপর ছুরিকাঘাত করে বাইক নিয়ে পালিয়ে যায়। পরশ ভাই লুটিয়ে পড়ে রাস্তায়। শুনতে হয়তো নাটক সিনেমার কাহিনী মনে হচ্ছে। কিন্তু এটাই বাস্তবতা।
আমি দিশেহারা হয়ে যাই। হায়হুতাশ করতে থাকি পাগলের মতো। মানুষের সাহায্য নিয়ে পরশ ভাইকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে দিই। চার ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। সম্পূর্ণ খরচ বহন করি। আল্লাহর অশেষ রহমতে একমাসের মধ্যেই পরশ ভাই বেঁচে উঠে। তবে পুরোপুরো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে বেশ কয়েকমাস সময় লেগে গিয়েছে।
হাসপাতালে সার্বক্ষণিক পরশ ভাইয়ের সেবা যত্ন করার জন্য একজন আয়া নিযুক্ত করি। কারণ তখন পরশ ভাইয়ের পরিবার গ্রামে বাস করতো। গ্রামে তাদের জন্য মাসে মাসে খরচ পাঠাতাম পরশ ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে।
সুস্থ হলে পরশ ভাইয়ের সাথে পরিচিত হই। আমার ফ্যাক্টরিতে যোগ দিতে অনুরোধ করি। সেদিন পরশ ভাই নিজের জীবনের বাজি রেখে অপরিচিত আমাকে বাঁচালো। সেভ করলো আমার দুই লক্ষ টাকা।
তা না হলে কবেই তুমি হতে বিধবা। আমার দুই সন্তান হতো এতিম। তারা বড় হতো অন্যের দয়ায় আর উপেক্ষায়। সেই প্রতিদান হিসেবে পরশ ভাইকে কোনদিন কিছু দিতে পারনি।
সেদিন আরশাদের বিয়ের পাত্রী না আসা যেন মালিকের ইশারা ছিলো। সেদিন ও পরশ ভাই সাতপাঁচ না ভেবে আমার সম্মান রক্ষার্থে তার কন্যাকে দিয়ে দিলো। আমার কাছে পরশ এক মহানুভবতার নাম। এক মানবিকতার নাম। এই হলো আমার ইতিহাস।
কথাগুলো বলতে বলতে জামান খানের গলাটা বেশ ধরে এলো। টেবিলের উপরে থাকা পানির গ্লাসটি টেনে নিয়ে অর্ধেক পানি গিলে ফেলেন নিমিষেই।
এবার তোমরাই বল কে মহান? আমি না পরশ ভাই?
আরিশা বলল আংকেল মহান। জোবেদা বেগম বলল পরশ ভাই মহান।
আর ঝিনুককে জমি উপহার হিসেবে দিয়েছি স্নেহ করেই। বিশেষ করে ঝিনুকের কোরান পাঠ আমাকে কতটা শান্তি দেয় তা কেবল আমিই জানি। ঝিনুক যখন কোরান পড়ে। আমি হারিয়ে যাই আমার সেই ছোট্টবেলায়। আমার মা কোরান পাঠ করতো। আমি চৌকিতে শুয়ে শুয়ে মায়ের কোরান পাঠ শুনতাম।
জোবেদা বেগম ও আরিশা কেঁদে ফেললো পরশের প্রতি কৃতজ্ঞতায়। আরশাদ বেদনার্ত মুখে বসে আছে। সে কিছুই বলতে পারছেনা। সবাই এবার হাসিমুখে লাঞ্চ সেরে নিলো। একসাথে ঢাকায় চলে এলো। ঝিনুকের বাবাকে তার বাসার পাশে নামিয়ে দিলো।
তারা বাসায় পৌঁছালো সন্ধ্যার পর। সালেহা গেট খুললো। জামান খান সবাইকে নিয়ে নিজের রুমে গেলেন। বললেন,ঝিনুককে জমি দেয়াতে কারো আপত্তি আছে?
সবাই সমস্বরে জবাব দিলো। একদম নাহ। বরং এতবড় উপকার হিসেবে এ দান নস্যি হয়ে যায়। হাত মুখ ধুয়ে সবাই ফ্রেস হলো। জীবনমুখী নানা আলোচনা হলো।
জোবেদা বেগম রুষ্ট চোখে স্বামীর কাছে জানতে চাইলেন, কিন্তু এতবড় কাহিনী আমাকে ঠিকভাবে শোনালেন না কেন ?
তোমাকে সেই ঘটনা এক বছর পরে বলেছিনা? পরশ নামের একজন আমাকে বাঁচিয়েছে। এখন আমাদের ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। মনে করে দেখ।
শুধু টাকার বিষয়টা তোমার কাছে লুকিয়েছি । সেটার ও উপযুক্ত কারণ ছিল তাই। সালেহা সবার জন্য লেবুর শরবত নিয়ে এলো রুমের মধ্যে।
কিরে ঝিনুক কই?
খালাম্মা, অনেকক্ষণ ধরেই ভাবিজান কেঁদেকেটে নাকচোখ ফুলায়া ফেলল।
সবাই চিন্তিত হয়ে, ওমা কেন?
আরিশা গিয়ে ঝিনুককে ধরে আনল।আসামি হাজির। সবাই জেরা করো।
সালেহা রান্নাঘরে গিয়ে নাক সিঁটকে মনে মনে বলল,
সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। বড়লোকের ঢং দেখেলে মন চায় নিজের গায়ে আগুন লাগায়া দিই । কত আরামে আছে। তাও আকামে কান্দে। আর আমরা কামেও কাদঁতে পারিনা। গিলা ফেলতে হয় সব যন্ত্রণারে। নইলে ওই কান্দনের লাইগা ও চেঁচা খাইতে হয় স্বামীর ঘরে।
জোবেদা বেগম নিজের পাশে বসালেন ঝিনুককে?
কান্না করেছ কেন?
ফোঁপাতে লাগলো ঝিনুক।
সবাই জিজ্ঞেস করলো। আরেহ বলবা তো সমস্যা কি হয়েছে?
ম্যাড়মেড়ে গলায় অভিমানী কন্ঠে ,
বাবা এটা কি করলেন আপনি? কেন আমাকে জমি উপহার দিলেন ?
জামান খান চোখ কপালে তুলে, এজন্য কাঁদছো?
মাথা নাড়িয়ে বলল। হুম।
এতে তোমার কোন অসুবিধা আছে?
খুউব আছে?
আরিশা বলল যেমন? এক্সপ্লেইন করো ভাবি প্লিজ।
তোমার ভাইয়া যখন তখন আমাকে কোন আদেশ করলে এখন মানা করব কোন মুখে। নিজেই ছোট হয়ে গেলাম না?
আরিশা জিজ্ঞেস করলো, তার মানে ভাইয়ার সব কথা তুমি শুননা?
আরশাদ মনে মনে সুখ নিচ্ছে। নিজের কথার ফাঁদে নিজেই আটকা পড়েছ পাখি।
নাহ শুনিনা।
কেন শুননা?
জোবেদা বেগম থামালেন আরিশাকে। আরশাদ যদি এমন কোন সুযোগ নেয়। তুমি নিঃসংকোচে আরিশা বা আমাকে জানাবে। বাঁদরের চামড়া তুলে ফেলব।
আরশাদ উঠে চলে গেলো মিটমিট করে হাসতে হাসতে।
নানান গল্পগুজবে ঝিনুককে স্বাভাবিক করলো তারা। আরিশা নিজের রুমে চলে গেলো। জোবেদা বেগম ঝিনুককে নিজেদের রুমে যেতে আদেশ দিলেন।
ঝিনুক চলে গেলো। চুপচাপ হয়ে পড়তে বসে গেলো। আরশাদ মনে মনে অপেক্ষা করছে,
আজ নিশিতে হয়তো নিজ থেকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিবে আমাকে। আরশাদের ধারণা মিথ্যা হলো।
পরেরদিন রাত করে আরশাদ বাসায় আসলো। টলতে টলতে কোনমতে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হলো। বিছানায় এসেই ধপাশ করে শুয়ে গেলো। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। ঝিনুক ঢুলু ঢুলু চোখে তাকালো আরশাদের দিকে।
ডিনার করবেন না আপনি?
নাহ খেয়ে এসেছি। মাতলামো কন্ঠে জানালো আরশাদ।
কি খেয়েছেন?
যা খাওয়ার তা খেয়েছি।
সেটা কি?
বিয়ার খেয়েছি। চিনো বউ? খুব নেশা। সেই ফিলিংস।
আপনি এত বাজে? মদ ও খান?
হুম আমি খাই। রোজ খাবো। রোজ রাত করে বাসায় ফিরব। তোর কি? তুই খাবি? আনবো বাসায়?
ছিঃ কি আবোল তাবোল বকছেন। ঝিনুক কাত হয়ে ঘুমিয়ে গেলো। ঝড় শুরু হলো। আকাশে থেমে থেমে বজ্রপাত হচ্ছে। ঝিনুক ভয়ে আরশাদের বুকে মিশে গেলো কাঁথার নিচে। আরশাদের লোমশ বুকে মুখ ঘষতে লাগলো। আরশাদ কিছুটা চেতন অচেতনের ঘোরে আছে। চোখ বন্ধ রেখেই ঝিনুককে পেঁচিয়ে নিলো নিজের শরীরের সাথে। ঝিনুক হাঁসফাঁস করছে। নড়তেও পারছেনা। ঝিনুকের কোমল সরু গোলাপি দুটো ঠোঁটকে নিজের ঠোঁটের ভিতর ডুবিয়ে নিলো। ভালোবাসার স্বর্গীয় মুহুর্ত বিলীন হলো অনন্তকালে।
আরশাদ বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছে। ঝিনুক নিজেকে মুক্ত করে নিলো আরশাদের বাহুবন্ধী হতে।
পরেদিন সকালে আরশাদ রেডি হয়ে নিলো বের হওয়ার জন্য। গায়ে দামী পারফিউম ব্যবহার করলো। ঝিনুক পড়ার টেবিলে বসেই নেত্রদ্বয় বুঁজে ফেলল। মুখকে হালকা কাত করে নিঃশ্বাস টেনে সেই পারফিউমের গন্ধ নিল।
উহুম! কি নেশা জাগানিয়া খুশবু আসছে তার শরীর থেকে। চোখ ঘুরিয়ে আরশাদকে এক পলক দেখে নিলো ঝিনুক। নীল শার্ট, কালো জিন্স,হাতে সোনালি চেইনের ঘড়ি, মাথা ভর্তি ঘন চুল, গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে তোমাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে প্রেমিক। ঠিক যেমনটি আমি চাই। ছেলেদের এমন বোতাম খোলা লোমশ বুক আমাকে খুব টানে। এবারতো আমি খুন হয়ে যাচ্ছি প্রেমিক। তোমার উষ্ণতা আমাকে দেউলিয়া বানিয়ে দিয়েছে।
আরশাদ বের হয়ে গেলো। মনে মনে ঝিনুককে উদ্দেশ্য করে,
তোমার ঝলকানো রূপ-সুধার খনি থেকে এভাবেই একটু একটু করে ধন দৌলত কেড়ে নিতে হবে মহারানী। আজ রাতে শুধু নেশা আমিই করবোনা তোমাকেও গেলাবো বধু।
এই কয়দিনের মধ্যে একদিন নিলমের বাসা থেকে আরিশার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এলো । যেহেতু দুজনের প্রতি দুজনের গভীর প্রণয়। তাই দুই পরিবারই আপোষে রাজী হলো। কয়মাস পর কাবিন হবে। আরিশার অনার্স শেষ হলে ঘটা করে তুলে নিবে। এমন চূড়ান্ত আলোচনাই হলো দুই পরিবারের মুরুব্বিদের মাঝে।
জীবন পথ চলায় অজস্র বাঁক থাকে। এই বাঁকগুলো সবসময় মসৃণ হয়না। কিছু বাঁক হয় এবড়োখেবড়ো। কিছু বাঁক হয় কন্টককাকীর্ণ। চাইলেই অনায়াসে এসব বাঁক অতিক্রম করা যায়না।
আরিশা ফ্যালফেলিয়ে কেঁদে ফেললো মায়ের কাছে গিয়ে। তার বাবাও আছে। আরশাদ বাইরে থেকে এলো একটু আগেই। সালেহা ছুটে গিয়ে বলল, ভাইজান আরিশা আপা কাঁদতাছে কেন জানি।
ঝিনুকসহ আরশাদ দ্রত পায়ে বাবা মায়ের রুমের এলো। ঝিনুকের মাথায় হাত দিয়ে আরশাদ উৎকন্ঠার সাথে জানতে চাইলো,
কাঁদছিস কেন?
জোবেদা বেগম মেঘমুখে ছেলেকে জানালেন। নিলমের বাবা নাকি আরিশাকে তাদের ঘরে বউ করে নিতে রাজী নয়।
আরিশা তাই নাকি? কিন্তু কেন? কথাতো উনাদের সাথে ফাইনাল হলোই। কি এমন হলো যার জন্য এতবড় ডিসিশন তারা নিতে বাধ্য হলো?
ভাবীর জন্যই তারা আমাকে মেনে নিবেনা। আড়ভাঙ্গা গলায় বলল আরিশা।
আরশাদ চোখ বড় করে ঝিনুকের মুখে তাকিয়ে হোয়াট?
ঝিনুক ভুমিকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠলো। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে, আমি আবার কি করলাম?
বউমা কিভাবে জড়িত তোর বিয়ের সাথে? চিন্তাগ্রস্ত চোখে জিজ্ঞেস করলেন জোবেদা বেগম।
জামান খান কিছুই বললেন না। শুধু লম্বা করে আফসোসের স্বাস ছাড়লেন।
আরশাদ ঝিনুকের সামনে তেড়ে গিয়ে,
তোমার জন্য আমার একমাত্র বোনের বিয়ে ভেঙ্গে গেল? শুনে রাখো, উল্টাপাল্টা কিছু হলে তুমিও এই সংসারে থাকতে পারবেনা।
চলবে…১৫