#তুমি_আসবে_বলে
#পর্ব_৯
#ইভা_রহমান
সাদা শাড়ি লাল পাড়ে নিজেকে রাঙিয়েছে আজ হিয়া। যদিও এই লাল সাদা রঙ টুকু পড়ে যে নিজেকে আলাদা করে সাজাতে হবে এই সময় টুকু তার হয়ে আসে নি। স্পর্শ যেনো আজ একটু বেশি তার মা ঘেঁষে আছে। বাড়িতে এতো অতিথি থাকার আনন্দে কোথায় সবার সাথে ঘুরে ঘুরে খেলবে তা না করে সবার ঔ নতুন নতুন মুখ দেখে ভয়ে সে তার হিয়া মা’র কাছেই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে ব্যস্ত। দাদমণি কতো করে বললো হিয়া একটু সেজেগুজে নে৷ ঠোঁটে একটু রঙ দে। চুলে একটা ফুল লাগা। আর কিছু না করিস অনন্ত কপালে একটা টিপ পড়। কিন্তু হিয়ার আর সেসময় কোথায়, স্যুটকেস থেকে মেকআপ বক্স টা বের করার সময় টা স্পর্শ তাকে দিলে না। উপরন্ত কাজের চাপে,ভ্যাপসা গরমের তেজে খুলে রাখা চুল গুলোও খোপা করে কাটা দিয়ে রাখলো সে। স্পর্শকে সকালের খাবারটুকু খাইয়ে হিয়া তাকে আজ বারোটার আগেই গোসল দিয়ে দিলো। পড়িয়ে দিলো একটা লাল সাদা ছোট্ট পাঞ্জাবি। স্পর্শের নাদুসনুদুস শরীরে বেশ মানালো সেটা। স্পর্শকে পাউডার দিয়ে তার কপালে একটা কালো টিপ পড়িয়ে দিলো হিয়া। সেটায় একটু পাউডার লাগিয়ে স্পর্শের গালে একটা ইয়া বড় চুমু আকঁলো সে। বাড়িতে আসা দুটো ছয় সাত বয়সী বাচ্চা স্পর্শকে নিতে আসলো নিচে তাকে নাকি সবাই ডাকছে। হিয়া বললো বেশ নিয়ে যাও কিন্তু সাবধানে। স্পর্শ যেতে চাইলো না কিন্তু তাকে ছাঁদের বায়না দিয়ে নিচে নিয়ে আসা হলো।
এদিকে উজান গোসল সেরে তৈরি হয়ে নিতে খেয়াল করলো তার বিছানায় রাখা একটা প্যাকেটের উপর। হাতে নিয়ে খুলতে গিয়েই দেখলো একটা লাল রঙা টুকটুকে পাঞ্জাবি। একটু অবাক হলো উজান। কারণ সে বরবরি হালকা রঙ পড়তে অভ্যস্ত। এরকম ডীপ কিছু না সে কখনো পড়েছে না কেউ তাকে গিফট করবার সাহস পেয়েছে। তাহলে কে দিয়ে গেলো এটা ওকে! পাঞ্জাবি টা ভালো করে দেখতে গিয়েই খেয়াল করলো সাইড পকেটে কি যেনো একটা ঝুলছে। উজান সেটা হাতড়াতেই বেড়িয়ে আসলো হিয়াকে গিফট করা সেই পায়েল টা। উজানের আর বুঝতে বাকি থাকলো না হিয়াই তাকে এ-ই পাঞ্জাবি টা গিফট দিয়েছে তাহলে। কিন্তু সে যে এতো কড়া রঙ কখনো পড়ে না। একবার তো দাদিমণিই তার জন্য নিয়ে এসেছিলো এরকমই কড়া রঙের দুটো শার্ট তখনো সে সেটা পড়েনি কিন্তু আজ! কিছুক্ষণ বাদে উজানের নাম্বারে একটা টেক্সট আসতেই উজান সেটা ব্যবসায়িক জরুরি কিছু ভেবে পড়তে গিয়েই দেখে হিয়ার নাম্বার! আরো অবাক হলো উজান। কারণ আজ অবধি একই বাড়িতে থাকার দরুন কখনো টেক্সট এ তাদের কথা বলতে হয়নি যা দরকার হতো সেটা ডিরেক্ট কল বা সামনাসামনি কথার মাধ্যমেই হয়ে উঠতো। আজ প্রথম হিয়া টেক্সট করেছে মানে স্পেশাল কিছু তো বটেই। উজান টেক্সট টা ওপেন করতেই মোটা মোটা বাংলা হরফে লেখা কয়েকটি লাইন বেরিয়ে এলো” দেখুন আমি এ কদিনে যেটুকু যা পেরেছি আমার সব দিয়ে আপনার জন্য এই পাঞ্জাবিটা নিজ হাতে সেলাই করেছি। এখন আপনি যদি না পড়েন তাহলে আপনার দেওয়া এই পায়েলো আমি পড়বো না। ওটা আপনি আপনার কাছেই রাখুন,হিয়া”
মুখটা বাংলার পাঁচের মতো হয়ে গেলো উজানের। চুপসে গিয়ে বেচারা ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। এক হাতে পাঞ্জাবি তো আরেক হাতে ফোন নিয়ে হিয়ার ঔ টেক্সট, বেচারা এখন হাসবে না কাঁদবে উপর মাবূদ ই ভালো জানেন।
!
!
নিচে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে বসে বাড়ির সব আত্নীয় স্বজন নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলো। সবার পড়নেই লাল সাদার সমাহার। নানা স্বাদের গল্পের ফুলঝুরিতে মেতে উঠেছে বড় থেকে মাঝবয়সী সবাই। দেখতে ভারী মিষ্টি লাগছে এ-ই মুহুর্ত টাকে যেনো সুখের রাজ্যের এক ফালি সুখ এসে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলছে শাহরিয়ার কুঞ্জকে। কিন্তু কে বলবে এই এতো আনন্দ মুখোর পরিবেশের আড়ালে লুকিয়ে আছে সবার কিছু পাওনার চাহিদা।
দাদিমণির পাশে স্পর্শকে কোলে নিয়ে সবার সাথে গল্পে হিয়াও মেতে উঠেছে। কেউ কেউ খুব বিনয়ী ভঙ্গিতে হিয়ার সাথে কথা বলছে কেউ বা গল্প করছে নিজেদের নিয়ে। মেহু ব্যস্ত তার সময়বয়সী এক কাজিনের সাথে তার গল্প সারতে। বাচ্চা গুলো ব্যস্ত ছোটাছুটি করতে। সবার এই গল্পের মাঝে উপর সিঁড়ি বেয়ে লাল পাঞ্জাবির হাতা টা গোটাতে গোটাতে নিচে নেমে আসছিলো উজান। উজানকে আসতে দেখে কথার মাঝে কথা থামিয়ে দিলো সবাই। লাল পাঞ্জাবি সাদা চুড়িদার হাতে একটা ব্লাক ঘড়ি চুল গুলোও নিয়ম করে আছড়ানো, এইতো ব্যাছ সুপুরুষ মার্জিত সাজে নিজেকে উপস্থাপন করতে তৈরি উজান। হিয়া উজানের দিকে তাকাতেই বুকে হালকা ব্যাথা অনুভব করলো মনে মনে বললো লোকটা এতো সুন্দর না হলেও পারতো ধুর। হিয়া মুচকি হাসলো উজানের চোখে চোখ পড়তেই মাথা নুইয়ে নিলো। উজান এসে সোজা বসে গেলো পাশেই অফিস ঘরের বড় চেয়ার টাতে। বাড়ির বাকি ছেলেরা এসে বসলো উজানকে ঘিরে। উজান নিবিড়ের দেওয়া ফাইলপএ গুলো খুলে দেখতে থাকলো। ফ্রেম বিহীন চিকন চশমা টা উজানের গাম্ভীর্য টাকে যেনো একটু বেশি বাড়িয়ে তুললো। খুব গভীর মনোযোগে উজান সবার কি পাওনা কতোটুকু বাকি আছে বুঝিয়ে দিতে থাকলো। এর মাঝে আবার স্পর্শ এক পা দু পা করে হেঁটে হেটে তার মামার কাছে এসে তার কোলে উঠবে বলে বায়না শুরু করলো। উজান স্পর্শকে কোলে নিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। স্পর্শ কখনো তার কলম কেড়ে নিচ্ছে কখনো বা উল্টে দিচ্ছে সব কাগজপত্র। হিয়া দৌড়ে আসলো। দৌড়ে এসে সবার মাঝে উপস্থিত হয়ে আমতাআমতা করতে থাকলো। ভুল সময়ে অফিস ঘরে এসে পৌঁছালো না তো! হিয়া স্পর্শকে কোলে নিতে চেয়েও হতাশ হতে হলো তাকে উপরন্তু অফিস ঘরের কোনায় গিয়ে স্পর্শ শুরু করলো হিয়ার সাথে তার লুকোচুরি খেলা। বড্ড অস্বস্তিতে পড়ে গেলো হিয়া। উজান আবার মনোযোগ দিলো তার কাজে। সবাই চুপ হয়ে শুনতে থাকলো সেই হিসাব। এদিকে উজানকে আজ যতো দেখছে ততোই অবাক হচ্ছে হিয়া৷ এতো সূক্ষ্ম করে সব কিছু পরিমাপ করে সে সবাইকে বিতরণ করছে,কি গাম্ভীর্য সেই কন্ঠে,কি শক্ত কিন্তু ন্যায়ের চাহনি উজানের চোখ দুটোতে,বসার ভঙ্গিটাও কতো পরিমার্জিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একটা মানুষ এতো পারফেক্ট না হলেও বুঝি কোনো কমতি থাকতো না। হিয়া উজানের থেকে চোখ নামিয়ে আবার মনোযোগ দিলো স্পর্শের দিকে। আজ বড্ড পাখা গজিয়েছে বাচ্চা টার বুঝি,ইয়া মার সাথে মজা করে খেলতে তার বেশ লাগছিলো। অনেক কষ্টে স্পর্শকে নিয়ে অফিস ঘর থেকে বের হতে সক্ষম হলো হিয়া। এরপর আর কিছুক্ষণ আলাপচারিতা চালানোর পর শেষ হলো পুরানো বছরের সব হিসাবনিকাশ। শুরু হলো নতুন হাল খাতার সূচনা। সেই সুবাদে উজান দাদিমণিকে বললো সবার মুখ মিষ্টি করিয়ে দেও। দাদিমণি সবাইকে মুখে মুখে মিষ্টি বিলিয়ে দিতে থাকলেন। কেউবা প্যাকেট হতে নিজেই হাত দিয়ে নিজের মিষ্টি টা তুলে মুখে ঢুকে নিলেন। দাদিমণি এবার প্যাকেট হতে একটা মিষ্টি তুলে হিয়াকে খাইয়ে দিতে যাবে ওমনি উজান দাদিমণিকে থামিয়ে দিলেন,হিয়া মুখ টা হা করেও পর মুহুর্তে বন্ধ করে নিলেন। মনটা খারাপ হয়ে আসলো তার। হিয়া ভাবলো হয়তো ওদের খুশির মিষ্টি তাই হয়তো ওর এতে কোনো ভাগ থাকতে নেই। হিয়া একটা মেকি হাসি দিয়ে ড্রয়িংরুম ত্যাগ করতে যাবে ওমনি উজান হিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
-কোথায় যাচ্ছেন আবার?_দেখি হা করুন _কি হলো হা করুন।
হিয়া একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসলো। একটু আগেই তো মিষ্টি খেতে দিবে না বলে বারণ করলো এখন আবার কিসের জন্য হা করতে বলছে উনি। উজানের আরেকবার মোটা গলা শুনেই হিয়া টপাটপ হা করে নিতেই উজান ওর হাতে থাকা মিষ্টির প্যাকেট থেকে একটা কালোজাম বের করে হিয়ার মুখে ঢুকে দিতে দিতে বললো,
-তুমি কি ভূলে গেছো দাদিমণি উনি সাদা মিষ্টি খেতে পছন্দ করেন না!
দাদিমণি হাসলো। সাথে চোখ বড় বড় করে তাকালো হিয়া। উজান কিছু বললো না। প্যাকেট টা আরেকটা সার্ভেন্টের হাতে দিয়ে উপরে চলে আসলো। এদিকে সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হিয়ার দিকে। মেহুর শরীর তো রাগে ঝনঝন করছে। সবার এরকম চাহনিতে হিয়া লজ্জায় পুরো তলিয়ে যেতে থাকলো। এ-ই কাজ টা উজান সবার সামনে না করলেও পারতো! হু
!
!
এদিকে সবার সাথে গল্প হাসি মজা করতে করতে কখন যে দুপুর দুটোর কাছাকাছি হয়ে আসলো কারোই তেমন হুঁশে নেই। সবাই বসে গেছে ডাইনিংএ বৈশাখের নিয়ম অনুযায়ী পান্তা-ইলিশ খেতে। যদিও দাদিমণি সহ কিছুজন পান্তাকে বেছে নিলেও বাকি সবাই গরম ভাত টাই পেফার করলো। ইলিশের মোহ মোহ গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো শাহরিয়ার কুঞ্জে। বাড়িতে তো মাছ রান্না হলেই কোথা হতে এক হুলোবেড়াল এসে লেজ তুলে তার অস্তিত্বের জানান দিতো, তার উপর আজ আরো দুটো বিড়াল রান্নাঘরের দেওয়া টপকে শাহরিয়ার কুঞ্জে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে অস্থির। যাগ এদের একটা বিড়ালকে মাছের লোভ দেখিয়ে তার সাথে খেলা করে স্পর্শকে খাওয়ানো তো যাবে। আপাতত ডাইনিং এ মহিলাদের রাজ চলছে, ছেলেরা বাহিরে সবার মাঝে মিষ্টি আর নতুন বস্এ বিতরণে ব্যাস্ত। সেই সব বিতরণের সমাপ্তি ঘটলে সবাই বাড়ি ফিরে। কেউ বা এসে বসে যায় পান্তা-ইলিশের মজা নিতে কেউ বা ভাজা ইলিশের সাথে সর্ষে ইলিশেরও স্বাদ মেটাতে। দাদিমণি উজানকে ডেকে বললো তুই ও তোর চাচাদের সাথে বসে যা” উজান বললো না তোমরা খেয়ে উঠে আমি উপর থেকে আসছি। সাথে চোখের ইশারায় জানতে চাইলো হিয়া কোথায় দাদিমণি? দাদিমণি কথার ছলে বলে দিলেন “এই হিয়াটাও না বড্ড অবাধ্য আমার,কতো করে বললাম একসাথে বসে খাই কিন্তু তারতো আগে স্পর্শকে খাওয়ানো চাই। এখন এই স্পর্শকে খাওয়ানো যে কখন হবে তার” উজান হাসলো। তারমানে ম্যাডাম উপরে স্পর্শকে খাওয়াচ্ছে। উজান উপরে আসতেই সোজা স্পর্শের রুমে আসলো। হিয়া উজানকে দেখেও চোখ নামিয়ে নিলো। লজ্জা রাগ দুটোই হচ্ছে তার আজ। কেনো উজান ডাইনিং এ সবার সামনে তখন ওরকম করলো। হিয়া একবার হুলোবেড়াল টাকে মাছের কাটা ছিটিয়ে দিচ্ছে তো কখনো সেই বেড়ালের লোভ দেখিয়ে স্পর্শের মুখে খাবার ঢুকে দিচ্ছে। উজান এসে বিছানায় বসে দেখতে থাকলো হিয়ার কান্ড। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে মাথা টা খোঁপা করে রাখা হিয়ার। কিছু চুল সামনে বের করে দেওয়া এ-ই যা। না আছে কোনো রঙের আবরণ না একটা টিপের ছোঁয়া। এতেই এ-ই লাল সাদা শাড়িতে স্নিগ্ধতার মতোই শীতল লাগছে হিয়াকে যেনো। স্পর্শকে খাওয়াতে গিয়ে কাহিল হিয়া। একটু দম নিয়ে এসে বসলো সে উজানের পাশে। উজানের এই বা সাইডের বাহু টা বড্ড প্রিয় হিয়ার। তাইতো আজো সেখানে কপাল ঠুকে দিলো হিয়া। উজান ওর ডান হাত রাখলো হিয়ার মাথায়!
– সকাল থেকে উঠে এতো ছোটাছুটি করছেন শরীর তো ক্লান্ত হবেই,একটু কি বসে থাকা যায় না।
হিয়া হাসলো। উজানের বাহু থেকে মুখ তুলে ক্লান্তি মুখে বললো,
-আমি ঠিক আছি আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আপনি ফিরলেন কখন? খেয়েছেন দুপুরে?
-না এখনো খাইনি,
-সেকি কটা বাজে। আপনি না ঠিক সময়ে খেতে না পারলে কতো রাগারাগি করেন। দাদিমণি নেই নিচে। আমি বলবো আপনাকে খেতে দিতে।
-ইচ্ছে নেই খাওয়ার।
-কেনো হঠাৎ। শরীর ঠিক আছে তো, দেখি?
– আমি একদম ঠিক আছি। আপনি অস্থির হবেন না। আসলে ইলিশে খুব কাটা আমি বাছতে পারি না। তবে কেউ যদি স্পর্শের মতো বেছে বেছে খাইয়ে দেয় তাহলে….
হিয়া কপাল কুঁচকে উজানের দিকে তাকালো। তারমানে সাহেবের আজ হিয়ার হাতে খেতে ইচ্ছে করছে। তা সেটা সোজাসুজি বললেই তো হচ্ছে না-কি। হিয়া হেঁসে দিয়ে বললো একটু বসুন আমি এক্ষুনি আসছি। হিয়া দৌড়ে গিয়ে উজানের জন্য আরো একটু গরম ভাত দুটো ইলিশ ভাজা আর একটা সর্ষে দেওয়া ইলিশ নিয়ে আসলো। মধুর হাতে,পরম যত্নে খাওয়াতে থাকলো উজান স্পর্শ দু’জনকেই। স্পর্শো লায় পেয়ে গেলো, মামার সাথে মজার সুখে খেতে থাকলো মাছ ভাজা। হিয়া তো বড্ড ভয় পাচ্ছে যদি একটা কাটা ঢুকে যায় বাচ্চাটার গলায়। কিন্তু কেউ শুনলে তো তার কথা। পাছে তো কেউ দেখে ফেলারো ভয় আছে প্রচন্ড। দু’জনকে খাইয়ে দিয়ে হিয়া প্রথমে স্পর্শের মুখ মুছে দিলো এরপর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিলো উজানের,,
-হয়েছে না খাওয়া। আমি তো ভাবলাম একটা মাছ খেয়েই আর খেতে চাইবেন না আপনি কিন্তু দেখুন পরপর তিনটেই গপ-গপ করে খেয়ে নিলেন। এতো রাক্ষস আপনি!
-আমি রাক্ষস! আর আপনি যে এতো স্বাদ করে খাইয়ে দিলেন লোভ সামলাতে পারলাম কোথায়.
– ওহ! স্বাদ করে খাইয়েছি বলে খেলেন আপনি। আর রান্না টা বোধহয় ভালো লাগেনি!
– রান্না টা আপনি করেছিলেন?
-না আমার ভূত করেছিলো। এবার যান তো এ রুম থেকে। অনেকক্ষণ হলো ঢুকেছেন এরপর কেউ দেখলেই বিপদ,
-কেউ কিচ্ছু বলবে না,
-আপনি তো সব জানেন তাই না। যাবেন কি! আমি এখন বাচ্চা টাকে ঘুম পাড়াবো।
-যাচ্ছি এতে এতো রেগে যাবার কি হলো। বিকেলে কিন্তু তৈরি থাকবেন বের হবো আপনাদের দু’জনকে নিয়ে।
-আমি বের হলে তো আপনার সাথে। যাবেন কি আপনি এবার না আমি তাড়িয়ে দেবো!যান নাআআ
!
!
স্পর্শকে দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে হিয়াও একটু তার শরীর টা বিছানায় মেলে দিতেই দাদিমণির গলা শুনে হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লো সে। নিচে নেমে এসেই শুনতে পেলো দাদামণি নিবিড় সাহেব কে বলে কিসের যেনো ঔষধ আনতে পাঠাচ্ছে। হিয়া ভয় পেয়ে গেলো কার আবার কি হলো এসময় হঠাৎ। হিয়া দৌড়ে এসে দাদিমনির কাছে জানতে চাইলো কি হয়েছে দাদিমণি।দাদিমণি উওর করলো,
– কি আর হবে। উজানের সাড়া শরীরে এ্যালার্জি ফুটে উঠেছে। কি রকম বড় বড় লাল চাকা হয়ে যাচ্ছে দেখলেই গা শিউরে উঠছে,
হিয়া হতবাক হয়ে গেলো,অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,
– হ হঠাৎ এরকম হলো কেনো। উনি উনি কোথায় এখন?
– কি জানি। ইলিশে তো ওর বড্ড এ্যালার্জি তাই জন্য তো আজ আলাদা করে অন্য মাছ রান্না করা হলো। ভূলে আবার খেয়ে নিয়েছে কি না কে জানে।
হিয়া থমকে গেলো। তাহলে এ-ই জন্যই। কিন্তু উজানকে খাইয়ে দেবার সময় সে তো কিছুই বললো না যে তার। হিয়া উপরে আসতেই দেখলো উজানকে ঘিরে ওর মা বোন চাচিরা সবাই অস্থির হয়ে কি থেকে কি না কি করছে। কেউ হলুদ এনে লাগাচ্ছে কেউ বা যা পাচ্ছে সেই ক্রীমই ডোলে দিচ্ছে উজানের শরীরে। হিয়া সাহস করে ভেতরে যেতেও পারছে না। এদিকে উজানের এ-ই করুন অবস্থার জন্য নিজেকে একমাত্র দায়ি মনে হচ্ছে তার। ইশশ তার একটা ভুলের জন্য কি না। হিয়ার তো খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো সবাইকে পাশ কাটিয়ে একটু উজানকে দেখতে। তাকে ছুঁইয়ে দেখতে সে ঠিক আছে তো। কিন্তু সে সাহস করে রুমে যেতে পারলো না। একটা অস্বস্তি এসে ঘিরে ধরতে শুরু করলো তাকে। আধাঘন্টা বাদে নিবিড় ঔষধ আর মলম নিয়ে আসতেই সেগুলো উজানকে দিয়ে তার শরীরে মলম লাগিয়ে দিলেন উজানের মা। উজান বললো হয়েছে এবার যাও তোমরা আমি একটু বিশ্রাম নিতে চাই। সবাই এক এক করে বেড়িয়ে নিজের রুমে বিশ্রামের জন্য চলে আসলো৷ সবাইকে নিজের রুমে বিশ্রামরত অবস্থায় দেখে হিয়া সুযোগ বুঝে পা টিপে টিপে উজানের রুমে আসলো। উজান তখন ওর হাতে ওঠা এ্যালার্জি টাকে খুতিয়ে দেখতে ব্যস্ত। উজানের গায়ে ছিলো না কোনো কাপড়। বুকে পিঠে সব জায়গায় ঔষধ মাখিয়ে রাখা। হিয়া আসতেই উজান উঠে গিয়ে ওর শার্ট খুঁজতে শুরু করলো। কিন্তু তার আগেই হিয়া অঝোরে কেঁদে উঠলো। উজান হিয়ার এই কান্নার কারণ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলো। দূত হাতে ঘরের গেট লাগিয়ে দিয়ে এসে হিয়াকে ধরতেই হিয়া তার সব কিছু উজার করে উজানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।
– সব আমার জন্য। আমি না বুঝে না জেনে আপনাকে। আপনি কেনো বললেন না যে ইলিশে আপনার এরকম এ্যালার্জি হয়। খুব খুব খুব খারাপ আপনি খুব বাজে। এটা আপনি একদমই ঠিক করেননি উজান। আজ যদি একটা বড় কিছু হয়ে যেতো আপনি জানেন কিছু কিছু এ্যালার্জি কতো খারাপ হয়। আমি ঔষুধ জ্যেঠুর সাথে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে এ-ই এ্যালার্জির জন্য কতো….
হিয়ার ননস্টপ কথাতে মাথা ঘুরে গেলে উজানের। মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু বলার আগে হিয়া আরো ডুকরে কেঁদে উঠলো। উজান হেঁসে দিলো অনেক কষ্টে হিয়াকে শান্ত করে নিজের বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজে নিচে বসে পড়লো। মুখটা আলতো করে রাখলো হিয়ার দু হাঁটুর উপর। হিয়া মাথা নুইয়ে নিলো। হাত দিয়ে নাক মুছতে মুছতে আবারো বলে উঠলো,
-কেনো আপনি আমাকে একেবারের জন্য বললেন না আপনার ইলিশে এ্যালার্জি। কতো কষ্ট হচ্ছে আপনার। আমার আরো সচেতন থাকা লাগতো। আমি কি করে..
-হিয়া হিয়া হিয়া চুপ। আর না। আমি যদি বলতাম আমার এরকম এ্যালার্জির কথা তাহলে নিশ্চয় আপনার হাত থেকে এ-তো সুন্দর করে খাইয়ে নেবার স্বাদ পেতাম না নিশ্চয়ই।
-একদম বাজে কথা বলবেন না। আমার হাতে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে তাহলে অন্য কিছু খেতেন তাই জন্য। দেখি। কি রকম হয়েছে। তখন তো আমি ঢুকতেই পারলাম না রুমে দেখি এখন,
হিয়া উঠে দাড়ালো। সাথে উজানো। হিয়া উজানের সারা শরীর খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে দেখতে শুরু করলো। ইসস সাদা শরীরে এ্যালার্জির লাল লাল চিহ্ন একটু বেশি মানিয়েছে মনে হয়। হিয়া চিন্তিত কিন্তু উজান লজ্জিত!
-মিস মুনতাসীর আপনি কিন্তু এবার আমাকে লজ্জা পাইয়ে দিচ্ছেন। এভাবে খালি গায়ে আমাকে দেখতে থাকলে কিন্তু আমিইই..
হিয়া হুঁশে ফিরলো। ধ্যাত কি করছিলো সে এতোক্ষণ। লজ্জায় রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে ধরবে ওমনি উজান হিয়ার হাত ধরে হিয়াকে থামিয়ে দিয়ে নিজের বুকের কাছে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দেয়। উজানের নিশ্বাস এসে পড়তে শুরু করে হিয়ার খোলা পিঠ জুড়ে। মুহুর্তে লজ্জার রক্তিম আভায় ছেয়ে যায় হিয়া। হিয়া উজানের থেকে পালাতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। উজান তাকে আরো কাছে নিয়ে এসে তার মুখ টা ছুঁইয়ে দেয় হিয়ার কানে আর বলতে থাকে,
– ঠিক করেছি বাড়িতে যখন সবাই আছেই তাই এরই মধ্যে দাদিমণিকে বলে আপনার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠিয়ে দিয়ে আসবো। কি রাজি তো আপনি?
হিয়া শিউরে উঠলো ভাললাগার পাশাপাশি এক অদ্ভুত অনুভূতি এসে ঘিরে ধরলো তাকে। হিয়া মুখ ঘুরিয়ে উজানের দিকে ফিরলো,
– উজান আপনি আমার থেকে অনেক ভালো কাউকে পাবার যোগ্যতা রাখেন। আমার অতীতটা জানলে আপনি কখনো আপনাকে.
-চুপ,আমি বলেছি না আপনার অতীত সম্পর্কে জানার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। এরপরো কেনো বারবার এ-ই কথাটা আপনি নিয়ে আসুন বলুন তো আমাদের মাঝে। দিলেন তো মুমেন্ট টা নষ্ট করে,
– আপনার ইচ্ছে না থাকলেও আজ আপনাকে সবটা শুনতে হবে। বিবাহের মতো একটা পবিএ সম্পর্কে যাবার আগে আপনার আমার সম্পর্কে সত্যি টা জানা উচিৎ। প্লিজ আপনি আজ সেটা শুনতে বারণ করবেন না।
-কি শুনবো বলুন তো,বারবার এক কথা আপনার। বলেছি না আপনার অতীত সম্পর্কে কোনো ইন্টারেস্ট নেই আমার,
-আমি যদি বলি অতীতে আমি একশোটা বিয়ে করেছি তাও না,
-আপনি যদি বলেন অতীতে আপনার একশোটা বাচ্চা ছিলো তাও না।
শুনে রেগে গেলো হিয়া। কেনো উজান ওর কথাটাকে গুরুত্ব না দিয়ে এরকম হেলাফেলা করছে। রাগান্বিত হিয়াকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো উজান। হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো যা হয়েছে সব ভুলে যান হিয়া। এতো কিসের চিন্তা আপনার আমি আছি তো৷ হিয়া কিছু বলতে গিয়েও উজান হিয়ার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলো। নিজের ঠোঁটে উজানের হাতের পরশ পেতে কেঁপে উঠলো হিয়া। কি অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে দেখো। উজান নিজের মুখ টা হিয়ার দিকে ঝুঁকে নিতেই হিয়া তার চোখ বন্ধ করে শাড়ির আঁচল চিপে ধরলো। দু’জনের নিশ্বাস জড়ো হতে হতে সেটা একসাথে বাঁধা পড়ার আগেই উজান তার ঠোঁট দুটোকে হিয়ার কপালে ছুঁইয়ে দিয়ে বললো “পাগলি,ছিচঁকাদুনে পাগলি একটা,চোখ গুলো কেঁদে ফুলে কেমন গোল হয়ে আছে দেখো” হিয়া হাসলো,বললো দরজা খুলুন এরপর কেউ এসে দেখলেই বিপদে পড়তে হবে। উজান আর কথা বাড়ালো না শার্ট টা গায়ে দিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো মেহু দাঁড়িয়ে। হাতে তার একটা ল্যাপটপ। একটা ডেভিলমার্কা হাসি দিয়ে মেহু ঘরে ঢুকতেই বলে উঠলো
-আমি জানতাম তুমি এ ঘরেই আছো,,, তা হিয়া দেখো তো এদিকে,এদেরকে চিনতে পারো কি না?
হিয়া অবাক চোখে ল্যাপটপের স্ক্রীনে তাকাতেই কেঁপে উঠলো। তার আর বিহানের একটা ছবি জ্বলজ্বল করছে সেই স্ক্রীনে। হিয়ার সাথে দাঁড়িয়ে ছবিটা দেখছে উজান নিজেও!
চলবে…