তুমি কেন আগে আসোনি পর্ব ৬

“তুমি কেন আগে আসোনি?”

৬.
সায়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পারফিউম মাখছে একমনে। আয়নার ভেতরেই সিনথিয়ার দিকে তাকালো। একমনে কাজ করছে। সায়ান আবারও পারফিউম মাখতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। সিনথিয়া কাজ শেষ করে সায়ানের দিকে তাকালো। তারপর আবার ঘড়ির দিকে তাকালো। এখন রাত নয়টা বাজে। এখন সায়ান কোথায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সিনথিয়া ভেবে পেলো না। এরকম তো কখনো করেনি।

সিনথিয়া সায়ানের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

— “আপনি কি এখন কোথাও যাবেন?”
— “হ্যাঁ আমরা এখন পার্টিতে যাবো।”
— “আমরা বলতে কারা কারা?”
— “আমি এবং তুমি। তাড়াতাড়ি রেডি হও। তোমার জন্য একটা ব্লাক গাউন এনেছি।”

সিনথিয়া একেবারেই থতমত খেলো। সায়ান নিজেই শপিং ব্যাগ থেকে গাউনটা বের করে সিনথিয়ার সামনে ধরলো। গাউনটা দেখেই সিনথিয়ার শরীর হিমশীতল হয়ে গেলো। এরকম স্লিভলেস গাউন ও কিভাবে পরবে? তাছাড়া গাউনটার গলার অংশটাও খালি। সিনথিয়া এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো,

— “আমি এই গাউনটা পরবো?”
— “হ্যাঁ। তোমাকে কিন্তু খুব হট লাগবে।”
— “আমি গাউনটা আপনার সামনে পরি? কিন্তু এটা পরে আমি বাইরে যাবো না প্লিজ।”
— “আরে কিসব বলছো? এসব গাউন কেউ বাসায় পরে? পার্টিতে এসব গাউনে বেশ গর্জিয়াস লাগে। যাও তাড়াতাড়ি পরে এসো।”
— “আমি এটা পরে কোথাও যাবো না।” সিনথিয়া একরোখা ভাবে বললো।
— “কেনো?”
— “দেখুন আমি চাইনা অন্য পুরুষের সামনে পন্য হতে। তাছাড়া আপনি কিভাবে আপনার স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সামনে নিয়ে যেতে চাইছেন? আপনি বুঝতে পারছেন না তারা কিভাবে আমার দিকে তাকাবে? আমি চাইনা আপনি দাইয়ুস হন। প্লিজ আমার কথাটা রাখুন। আপনিও যাবেন না এসব পার্টিতে।”
— “উফ! আবার শুরু করলে তোমার মোল্লাগিরি। সিনথু প্লিজ নরমাল হও। নরমালি চিন্তা করো। এই গাউনে তোমাকে অনেক হট লাগবে। সেটা দেখে অন্যরা তোমার প্রসংশা করবে এটা তো আমার জন্য গর্বের বিষয়।”

সিনথিয়া দাঁত চেপে বললো,
— “আমার কোনো ইচ্ছে নেই এসব জামাকাপড় পরে আপনার গর্বের কারণ হতে। আপনি নিজেই যান।”

সিনথিয়া রাগ দেখিয়ে চলে আসতে চাইলে সায়ান ওর দুইহাত নিজের দুইহাতের মুষ্টিতে নিয়ে নিলো। সিনথিয়া বিরক্ত হয়ে বললো,

— “ছাড়ুন। যেই কাজে যাচ্ছিলেন সেই কাজে যান।”
— “তুমি জানো এখন তোমাকে কেমন লাগছে?”
— “না জানি না। জানতেও চাইনা। ছাড়ুন আমার হাত।”
— “তোমাকে এখন ডেলিসিয়াস চকলেট কেকের মতো লাগছে। আর চকলেট কেক আমার বরাবরই খুব পছন্দের ইউ নো!”
— “অসভ্যতারও একটা লিমিট থাকা উচিত। আপনি বরাবরই সেই লিমিট অতিক্রম করে গেছেন৷”

সায়ান সিনথিয়ার হাত ছেড়ে দিলো। ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বুকের বাম পাশে হালকা কিল মেরে বললো,

— “ইশ! তোমার এই রুপ একেবারে এখানে এসে লাগে।”
— “আর আপনার এই দিকটায় আমি খুব বেশি বিরক্ত হয়। লাফাঙ্গাদের মতো বিহেভ করেন আপনি।”
— “তাই?”

সায়ান সিনথিয়ার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে নেশাময় কণ্ঠে বললো। সিনথিয়া একটু ঘাবড়ে গেলো। রুম থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে সায়ানের বাহুডোরে বাধা পরলো। বেশ কিছুক্ষণ পর সায়ান সরে দাঁড়িয়ে বললো,

— “ওকে তুমি যেহেতু যাবে না আমিই যাই।”
— “আপনার কি একটুও ভয় লাগে না আল্লাহর পাকড়াওর?”

সায়ান কিছু বললো না। হেসে বেরিয়ে গেলো। সিনথিয়া হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পরেছে। সায়ানের হৃদয়টা যেনো পাথর। কোনো কিছুতেই আল্লাহর ভয় ওর মনের মধ্যে আসেনা।

.
রাত তিনটার দিকে রুমের দরজা খোলার আওয়াজে সিনথিয়ার ঘুম ছুটে গেলো। ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো দরজার দিকে। সায়ান কেমন হেলেদুলে হেটে আসছে ভেতরে। সিমথিয়া বুঝলো সায়ান ড্রিংকস করেছে। চোখের কোণে পানি জমে উঠলো সিনথিয়ার। আলতো করে চোখের কোণ থেকে নোনাপানি মুছে উঠে বসলো। ড্রিমলাইটের আলোতে সায়ানকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

সায়ান রুমে ঢুকে জুতাগুলো খুলে এদিক সেদিক ছুড়ে মেরে বেডে ধপ করে পরলো। তারপরই ঘুমিয়ে গেছে। সিনথিয়া মুখ চেপে ঢুকরে কেঁদে উঠে। এরকম নেশাখোর একজন ওর স্বামী ভাবলেই খুব কষ্ট হয়।

সিনথিয়া উঠে সায়ানের পায়ের মুজা খুলে দিলো। গায়ের কালো ব্লেজার খুলে দিলো। সিনথিয়া একটু খেয়াল করতেই দেখলো সায়ানকে বেশ এলোমেলো লাগছে এবং খুব ক্লান্ত। শার্টের বিভিন্ন অংশ কুচকানো। সিনথিয়া ভাবলো হয়ত সেখানে নাচ,গান আর ড্রিংকস করায় ক্লান্ত হয়ে গেছে। সায়ানের কাছ থেকে সরে এসে সোফায় বসলো। সায়ানের শরীর থেকে মদের গন্ধ আসছে। এতে সিনথিয়ার গা গুলিয়ে আসছে। সোফায় শুয়ে নিরবে চোখের পানি ফেলতো লাগলো।

.
পরপর তিনদিন সায়ান এভাবে পার্টিতে গেলো। আর ফিরে এলো খুব রাত করে। ফিরে এলেই সায়ান খুব ক্লান্ত এবং অগোছালো থাকে। সিনথিয়ার বিষয়টা নিয়ে খুব সন্দেহ হলো। বারবার মনে হচ্ছে সায়ান আবার পরকিয়ায় জড়িয়েছে। পরক্ষণে ভাবলো হয়ত ওর মনের ভুল। তাছাড়া সন্দেহ করাটা ইসলামে নেই। তাই সিনথিয়া ব্যাপারটা পুরোপুরি মন থেকে বের করে দিলো।

চায়ের কাপ নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো সিনথিয়া। সায়ানকে দেখলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সিনথিয়া ব্যস্ত হাতে চায়ের কাপ টেবিলের উপর রেখে বেরিয়ে আসতেই পা থেমে গেলো। সায়ানের বলা শেষ কথাটায় সিনথিয়ার পায়ের নিচে যেনো দুলতে শুরু করেছে।

সায়ান বারান্দায় দাঁড়িয়ে জেনির সাথে কথা বলছিলো। সিনথিয়াকে আসতে দেখে একপ্রকার ফিসফিস করে কথা বলছে।

— “আজ কোথায় আসবে?”
— “এমন ফিসফিস করে কথা বলছো কেনো? তোমার বউ আছে বুঝি আশেপাশে।”
— “হ্যাঁ। রুমে আছে।”
— “বাহ! সায়ান দেখছি তার বউকে ভয় পায়।”
— “আরে ও বেশকিছু দিন ধরেই আমাকে সন্দেহ করছে। কেমন যেনো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে আমাকে বাসায় আসলে।”
— “বাহ! গোয়েন্দা গিরি করছে তোমার বউ।” জেনি হেসে দিলো। সায়ান গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— “হয়েছে থামো। এবার বলো কোথায়া আসবে আজ?”
— “উম! তুমি বলো।”
— “তুমি তাহলে ‘ক’ হোটেলে আসো। আমরা একটুপর সেখানেই দেখা করবো।”
— “শুধু দেখা করবে বুঝি?”
— “তুমি যা বলবে তাই হবে।” সায়ান ঠোঁট কামড়ে হাসলো।
— “কত নাম্বার রুমে?
— “৬০৩.”
— “ওকে বাই।”
— “বাই।”

সিনথিয়া শেষের দিকের কথাগুলো শুনেছে। চোখের কোণে অশ্রু জমতে শুরু করেছে। সায়ানকে রুমে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। সিনথিয়া এবার বুঝে গেলো সায়ান তাহলে পরকিয়ায় জড়িয়েছে আবার। তাইতো প্রতিদিন রাতে এরকম ক্লান্ত আর এলোমেলো হয়ে ফিরে আসে। চারিদিকে অন্ধকার দেখতে লাগলো সিনথিয়া। শেষ পর্যন্ত এরকম চরিত্রহীন লোকের সাথে থাকতে হচ্ছে ওর।

একটু পরেই সিনথিয়া আবার রুমে গেলো। সায়ানের অফিসের যাবতীয় সব জিনিস গুছিয়ে দিলো। এটা সায়ানের হুকুম বলা যেতে পারে। সবকিছু গুছিয়ে না দিলে সায়ান বেশ রেগে যায়। সবশেষে সিনথিয়া এককোণে দাঁড়িয়ে সায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ পরিপাটি হয়ে এখন পারফিউম মাখছে শরীরে।

সিনথিয়া অন্যদিকে ফিরে চোখের পানি মুছলো। বাকিটা জীবন এই চরিত্রহীন লোকের সাথে কিভাবে থাকবে ওর জানা নেই। পিঠে স্পর্শ পেতেই সিনথিয়া ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। সায়ানকে দেখে ঘৃণা হচ্ছে ওর। কান্না চেপে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,

— “আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?”

সায়ান একটু অবাক হলো। সিনথিয়া হঠাৎ এরকম প্রশ্ন কেন করলো? তবে কি ও বুঝে ফেলেছে? মনে মনে এসব ভেবে সায়ান স্বাভাবিক ভাবে বললো,

— “সিনথু এটা কেমন প্রশ্ন করলে? তুমি জানো না আমি এই সময়ে কোথায় যাই?”
— “হ্যাঁ জানি। অফিসে যান। প্রতিদিন তো অফিসে ফরমাল ড্রেসাপে যান। আজ হঠাৎ পরিবর্তন। তাই জিজ্ঞেস করেছি।”
— “এখন দেখছি আমাকে বেশ নজরে রাখছো।”

সিনথিয়া কিছু বললো না। সায়ান এগিয়ে এলো সিনথিয়ার দিকে। সিনথিয়া হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,

— “আপনার অফিসের দেরি হচ্ছে। দেখুন অলরেডি দশ মিনিট লেইট আপনি।”
সায়ান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
— “ওহ শিট! আচ্ছা আসছি। আজকে কিন্তু আমরা স্পেশাল নাইট স্পেন্ড করবো। তোমার জন্য একটা বিউটিফুল ড্রেস নিয়ে আসবো আমি। ওকে?”

সিনথিয়া মাথা নাড়ালো শুধু। সায়ান সরে যেতেই সিনথিয়া বড় একটা নিঃশ্বাস নিলো। এতক্ষণ ঘিনঘিন লাগছিলো সায়ানের স্পর্শে। সিনথিয়া অসাড় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো এক জায়গায়। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ রুমের মধ্যে পায়চারি করলো সিনথিয়া। এরমধ্যেই ভেবে নিলো যদি আজকে সায়ানকে হাতেনাতে ধরতে পারে তাহলে বাবার বাড়ি জানিয়ে দিবে। এবং সায়ান থেকে মুক্তি নিবে। এই ভাবনাটা মাথায় আসতেই সিনথিয়া বোরকা পরে তৈরি হয়ে নিলো। বেশকিছু টাকা নিয়ে লুকিয়ে বেরিয়ে পরলো বাড়ি থেকে।

সিনথিয়া খুব চেষ্টা করেছে সবার চোখের আড়াল হয়ে বের হওয়ার জন্য কিন্তু তার আগেই আরশি দেখে ফেলেছে৷ সিনথিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আরশি বাঁকা হাসলো। রুমে এসে রকিং চেয়ারে বসে মাথায় কূটবুদ্ধি পাকাতে লাগলো।

.
হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে সিনথিয়া ঘাবড়ে গেলো। এরকম জায়গায় এই প্রথম এসেছে। যদিও এটা ফাইভ স্টার হোটেল। তারপরেও খুব নার্ভাস লাগছে। বারবার মনে হচ্ছে ও ভুল শুনেছে। সায়ান এই জায়গায় আসেনি। কিন্তু পার্কিং এরিয়ায় সায়ানের গাড়ি দেখে বুকের ভেতর যন্ত্রণা শুরু হলো। না জানি আজকে কোন সত্যির মুখোমুখি হতে হয় ওকে।

কাঁপা কাঁপা পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো সিনথিয়া। রিসিপশনের মেয়েটার থেকে জিজ্ঞেস করলো ৬০৩ নাম্বার রুম কোনদিকে। মেয়েটা মোবাইলে বেশ ব্যস্ত থাকায় দেখিয়ে দিলো রুমটা। ভুলে গেলো এটা স্পেশাল রুম।

সিনথিয়া এদিক সেদিক তাকিয়ে লিফটের ভেতরে দাড়ালো। ফোর্থ ফ্লোরে এসেই থমকে গেলো। একবার ভাবলো ফিরে গেলে ভালো হয়। পরে আবার মনকে শক্ত করে নিলো। আজ যা হবার হবে। ৬০৩ নাম্বার রুমের সামনে আসতেই সিনথিয়ার হার্টবিট কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। মনে হচ্ছে এখনই ফেটে যাবে। বারবার দোয়া করছে ওর ভাবনা যেনো ভুল হয়। ভেতরে যেনো সায়ান না হয়।

অনেক দ্বিধাবোধের পর অবশেষে সিনথিয়া নক করলো দরজায়। ভেতর থেকে কোনো রেসপন্স পেলো না। সিনথিয়া তখনই ভাবলো ফিরে যাবে। কিন্তু পারলো না। পা দুটো যেনো স্থির হয়ে আছে। আবারও নক করলো সিনথিয়া। পরপর কয়েকবার নক করার পর যখন সাড়াশব্দ পেলো না। সিনথিয়া নিজেকে বকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।

ঘাড় ফিরিয়ে দাড়াতেই দরজা খুলে গেলো। সিনথিয়া তড়িঘড়ি করে পেছন ফিরলো সরি বলার জন্য। কারণ সিনথিয়া ভেবেছে এখানে অন্য কোনো দম্পতি উঠেছে। তারপরই সিনথিয়া থমকে গেলো। চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা জমতে শুরু করেছে। এক নজর ভেতরে তাকিয়ে ঘৃণা ভরা নজরে সায়ানের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে এলো হোটেল থেকে।

দরজায় নক করায় সায়ান এতোই বিরক্ত হল যে, নিজেকে বস্ত্রে আবৃত করার কথা একেবারেই ভুলে গেলো। সিনথিয়া দুজনকেই বস্ত্রহীন দেখেছে। সায়ান সিনথিয়াকে দেখে বেশ চমকালো। এতোটাই চমকে গেছে যে এখনো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জেনির ডাকে সায়ানের হুশ ফিরলো। তড়িঘড়ি করে নিজেকে বস্ত্রে আবৃত করে বেরিয়ে এলো। জেনিকে কিছুই বলার সুযোগ দিলো না।

.
বাড়ি ফিরতেই সিনথিয়া আরশির মুখোমুখি হলো। সিনথিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহুর্তে ওর কিছুই ভালো লাগছে না। আরশি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

— “কোন নাগড়ের সাথে দেখা করতে গেছিলে? খুব বেশি সুখ দিয়েছে নাকি? এতো তাড়াতাড়ি করে ফিরে এলে যে? আরেকটু সময় কাটাতে।”
— “আপনার সাথে কথা বলতে বা আপনার কথা শুনতে আমার একটুও ভালো লাগছে না। সামনে থেকে সরুন।”
— “নষ্টামি করে এসে এখন বড়বড় কথা বলতে লজ্জা লাগে না তোর? বাজারের মা* কোথাকার।”

সিনথিয়ার কান দুটো গরম হয়ে এলো শেষ কথাটা শুনে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। আরশিকে পাশ কাটিয়ে সিনথিয়া রুমে চলে এলো। বোরকা খুলে বিছানায় বসতেই ওর ভেতরের আর্তনাদ এবার বাইরে প্রকাশিত হলো। শব্দ করেই কেঁদে উঠলো। বিছানার চাদর খামছে ধরেছে। ওদের এতো এতো অমানবিক অত্যাচারে, সায়ানের এমন হিংস্র অত্যাচারের পরেও সব মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু শেষে এসে কি পেলো?

এরমধ্যেই দরজা খোলার শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো সিনথিয়া। সায়ানকে দেখে ভেতরের প্রতিটা রন্ধ্র ক্ষোভে ফেটে পরে। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সায়ান এসেই সিনথিয়ার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

— “কেনো গেছিলে তুমি ওখানে? আমার জাসুসি করতে? আমার উপর নজর রাখছিলে?”
— “ছাড়ুন আমাকে। নষ্ট চরিত্রহীন লোক। লজ্জা করে না ঘরে স্ত্রী রেখে পরনারীতে মত্ত হতে?”
— “সাট আপ। আমার লাইফ আমি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই লিড করতে পারি। তুমি কেউ না আমার ব্যাপারে কিছু বলার।”
— “ছাড়ুন আমার ঘৃণা হয় আপনার ছোয়ায়। এতই যখন প্রেম চলছিলো আমাকে বিয়ে করার জন্য ছ্যাচড়ার মতো পিছনে পরে ছিলেন কেনো? ছ্যাচড়া কোথাকার।”
— “মুখ সামলে কথা বলো।”
— “চরিত্রে ঠিক নেই। তার আবার বড়বড় গলা। এটাকেই বলে চোরের মায়ের বড় গলা।”
— “সিনথিয়া!!”

সিনথিয়া ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো সায়ানকে। চিৎকার করে বললো,

— “এখন চিৎকার করছিস কেনো? এতোই যখন তোর উত্তেজনা জাগে আমাকে বিয়ে করেছিস কেনো? পরে থাকতি তোর রক্ষিতাদের নিয়ে। তখন কেউ তোকে বাধা দিতো না।”
— “আর একটা কথা বললে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

সিনথিয়া যেনো হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ও ভুলেই গেছে ওর মুখ থেকে বের হওয়া এক একটা কথা ওকে আবার ফেরত দিবে এই বাড়ির মানুষগুলো। সিনথিয়ার ধারণা নেই এই বাড়ির মানুষগুলো নোংরা প্ল্যান সাজাতে কতটা এক্সপার্ট। ওর বলা প্রতিটা কথা যে হিতে বিপরীত হতে পারে সেটা সিনথিয়া একেবারেই ভাবেনি। ওর বলা কথার জালেই যে ওকে ফাসিয়ে দিবে সেটা সিনথিয়ার ধারণায় বিলকুল ছিলো না। সিনথিয়া জোর গলায় বলে উঠলো,

— “তোর মায়ের স্বভাবও এমন ছিলো তাইনা? তাইতো স্বামী ছেড়ে চলে গেছে। সেই একই পেটের থেকে তোর জন্ম। ভালো চরিত্রের হবি কিভাবে?”

সায়ান সিনথিয়ের দিকে তেড়ে আসলে সিনথিয়া চড় বসিয়ে দিলো সায়ানের গালে। সায়ান থেমে গেলো। সিনথিয়ার দিকে তাকাতেই দেখলো রাগে হিসহিস করছে সিনথিয়া। সায়ান গালে হাত বুলিয়ে হাসলো। সায়ানের হাসি দেখে সিনথির ঘৃনার পরিমাণ আরো বেড়ে গেলো। এরমধ্যেই আরশি ভেতরে প্রবেশ করলো। আরশি এসেছিলো মূলত সায়ানকে ডাকতে। আজ হঠাৎ এই সময় বাসায় কেনো সেটা জানতেই এসেছিলো। রুমে এসে সিনথিয়াকে সায়ানকে চড় কারতে দেখে ক্ষেপে গেলো আরশি। তেড়ে এসে সিনথিয়ার হাত চেপে ধরলো। সিনথিয়া হাত ছাড়ানোর জন্য হাত মোচড়াতে লাগলো। আরশি গালি দিয়ে বললো,

— “মা* তোর নাগড়ের লগে সময় পার করতে পারস নাই বইলা আমার পোলার লগে দেমাগ দেখাস? এতো তেজ তোর? আমার পোলার লগে থাইকা তেজ মিটে না তোর? তোর শা*** তেজ মিটাইতে আবার বাইরে গিয়া নিজেরে বেচস।”

সিনথিয়া জোর করে নিজের হাত টান দিতেই আরশি নিচে পরে গেলো। সিনথিয়া হচকচিয়ে গেলো। সায়ান আরশিকে উঠিয়ে দাড় করালো। আরশি কিছু বলতে চাইলে সায়ান থামিয়ে দিয়ে বললো,

— “মা তুমি যাও।”
— “ও তোকে থাপ্পড় মারলো কোন সাহসে? ছাড় আমাকে ওর কেমন তেজ আছে সেগুলো আজ আমি বাইর করবো।”
— “মা। তুমি যাও। এটা আমাদের মধ্যকার ব্যাপার। তুমি এখানের মাঝে এসো না।”
— “তাই বলে..।”
— “মা তুমি যাও।”

সায়ানের কণ্ঠ বেশ স্বাভাবিক যেনো কিছুই হয়নি। সিনথিয়া বুঝে গেছে এই নরক থেকে ওর বের হওয়া আর সম্ভব না। ওর রাগ এখন একেবারেই হাওয়া হয়ে গেছে। রাগ কমতেই বুঝলো তখন এতোটা রেগে ওসব বলা ঠিক হয়নি। এসব কথা রেশ ধরে ওকে সামনে কতটা টর্চার করা হবে এটা এখন বুঝলো সিনথিয়া। নিজের প্রতি রাগ হলো। এতোটা রেগে না গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করলেই পারতো। আরশি চলে যেতেই সায়ান দরজা বন্ধ করে সিনথিয়ার সামনে এসে দাড়ালো। শান্ত কণ্ঠে বলল,

— “আমাদের সমস্যাটা এবার না হয় তোমার বাড়ির মানুষ এসেই সলভ করুক। কি বলো বউ?”

সিনথিয়া বোবা হয়ে গেলো। সায়ান হাসছে। সিনথিয়া বেশ ভালো করেই জানে এসব কথা ওর পরিবারে গেলে ওকেই হ্যারেস করবে সবাই। সিনথিয়ার চোখে মুখে অসহায় বোধ দেখে সায়ান যেনো তৃপ্তি পেলো। সিনথিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে বললো,

— “তখনের অসমাপ্ত কাজটা এখন সমাপ্ত করি কি বলো?”

সায়ানের কথা শুনে সিনথিয়ার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। অসহায় চোখে তাকালো সায়ানের দিকে। সায়ানের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে এখন ব্যস্ত নিজের হিংস্রতা ফলাতে।

____________________________
বাবার হুঙ্কারময় ডাক শুনে সিনথিয়া বেরিয়ে এলো গত একসপ্তাহে ঘটে যাওয়া নির্মম অতীত থেকে। আজ ওর জন্য বিচারসভা বসিয়েছে আরশি। সভায় ওর বাবা, দুইভাই এবং মা বিচারকের দায়িত্বে আছে। আর বাকিরা সবাই তামাশা দেখতে এসেছে। যদিও বিচার বসেছে সিনথিয়া এবং সায়ানের জন্য। কিন্তু সিনথিয়া ভালো করেই জানে আজ শুধু ওর বিচার হবে। যেখানে ও সম্পূর্ণ নির্দোষ। কারণ এখানে সবাই একপাক্ষিক বিচার করতে ভালোবাসে। দুর্বল পক্ষকে হেনেস্থা করে মজা পায়।

সিনথিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে তাকালো। চার জোড়া চোখ ওর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। আজ ঠিক কি কি হবে সিনথিয়া বুঝে গেছে সবার চাহনি দেখে। খুব অসহায় বোধ করলো সিনথিয়া। ইচ্ছাকৃত ভাবেই সব দোষ ওর উপর চাপিয়ে দিচ্ছে সবাই। সিনথিয়া এক নজর তাকালো স্বামী নামের পিচাশটার দিকে। সায়ান বুকে হাত গুজে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সিনথিয়া নজর সরিয়ে নিলো।

ওর বাবা বললো,

— “তাহলে এবার বল কি কি হয়েছে এখানে।”
সিনথিয়া এক নজর সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “বেশ কয়েকদিন ধরেই উনার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলাম আমি। বাসায় খুব রাত করে ফিরে আসতো, এলোমেলো হয়ে থাকতো, অনেক ক্লান্ত থাকতো। প্রথমে সন্দেহ হলেও মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিয়েছি। কাল সকালে উনার জন্য চায়ের কাপ নিয়ে রুমে গেলাম তখন উনি বারান্দায় কারো সাথে কথা বলছিলো। রুম থেকে বের হওয়ার সময় শুনি উনি একটা হোটেলের নাম এবং সেখানের ৬০৩ নাম্বার রুমের মধ্যে কাউকে উপস্থিত থাকতে বলেছেন। উনি যাওয়ার পর আমিও সেখানে যাই। সেই রুমের দরজায় নক করার পর উনিই দরজা খুলে তখন উনাকে আমি….একটা মেয়ের সাথে রুমে বাজে অবস্থায়…..দেখেছি।”

সিনথিয়ার কথায় ওর ঘরের সদস্যরা একটু অবাক হলো। সবাই সায়ানের দিকে তাকালো। সায়ান অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। সিনথিয়া আবার বললো,

— “এর আগেও উনার মোবাইলে কিছু ছবি দেখেছিলাম উনার কাজিন লিজার সাথে। খুবই… আপত্তিকর অবস্থায়।”

সিনথিয়ার বাবা আরশ অত্যন্ত অবাক হয়ে বললো,

— “এসব কি শুনছি আমি আরশি? সায়ান এসব কি? তোমাকে আমরা যথেষ্ট ভালো জানতাম। তাই সিনথিয়ার শত আপত্তি সত্ত্বেও তোমার কাছে তুলে দিয়েছি। আর তুমি কিনা পরকিয়ায় জড়িয়েছো?”

সায়ান চুপ করে আছে। আরশি দাঁত কটমট করে সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। এমন নয় যে সায়ানের কর্মের কারণে লজ্জা পাচ্ছে। বরং এই মোড়টা কিভাবে ঘুড়িয়ে দেয়া যায় সেটাই ভাবছে। এক নোংরা প্ল্যানিং করতে ব্যস্ত আরশি। সালেহা বানু মাঝে বললেন,

— “শুনো মেয়ে ছেলেদের এরকম একটু আধটু দোষ থাকে। তাই বইলা তুমি তোমার সোয়ামীর সবকিছু সবার সামনে বইলা দিবা?”
— “আজ যদি আমি এই জায়গায় থাকতাম আপনারা কেউ আমাকে এক চুল ছাড় দিতেন না। উলটো আরো বাড়িয়ে বলতেন। তাহলে আমি কেনো কম্প্রোমাইজ করবো?”
— “মাইয়াগো এরকম সহ্য করন লাগে। এতো তেজ দেহাইলে চলে না। বুঝলা।”
— “তাই বলে স্বামীর পরকিয়া মেনে নিবে? এটা আপনি কিভাবে সাপোর্ট করছেন দাদী?” সিনথিয়ার বড় ভাই বললো।

সিনথিয়া আশার আলো দেখতে পেলো। সবাই ঘৃণা ভরা নজরে দেখছে সায়ানকে। এরমধ্যেই ওর মা বললো,

— “এভাবে তো চলতে দেয়া যায়না। আমাদের সত্যিই এবার কোনো স্টেপ নেয়া উচিত।”

সিনথিয়া খুশি হয়ে যায়। মাত্রই মুখ খুলতে যাচ্ছিলো নিজের মুক্তির ব্যাপারে। কিন্তু পারলো না। সায়ান এবং আরশির নোংরা প্ল্যানের নোংরা আক্রমনে একেবারেই বিষ্মিত হলো সিনথিয়া। সবার নজর সায়ান থেকে সরে এবার সিনথিয়ার দিকে নিবদ্ধ হলো। এতেই সিনথয়া থতমত খেয়ে গেলো। প্রথম কয়েক মুহুর্ত কথা বলার মতো কোনো শব্দ খুজে পেলো না। পাথর বনে গেছে যেনো।

চলবে,,,
® ‘নুরুন নাহার’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here