#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ছয়
নীলাভ্রর শার্টে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। হাত থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে নীলাভ্রর। রক্তে মাখা হাতটা অন্য হাতে ধরে গেট গিয়ে ঢুকছে নীলাভ্র। নিজের রুমের বেলকনিতে দাড়িয়ে ছিলো বেলী। হঠাৎ করেই গেটের দিকে নজর যেতেই বেলী আঁতকে উঠলো। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। নীলাভ্রর এমন অবস্থা হলো কি? ভেবে সময় নষ্ট করলো না। ছুটে বেড়িয়ে এলো রুম থেকে। ড্রয়িং রুমে সবাই বসে ছিলো। বেলীকে এমন করে ছুটে আসতে দেখে পেছন থেকে আইরিন আর রিতা ডেকে উঠলো। কিন্তু, কে শুনে কার কথা? বেলী দৌড়ে বাইরে যেতেই নীলাভ্রর মুখোমুখি হয়ে যায়। কিছুটা দৌড়ে আসায় এখন হাঁপাচ্ছে। হাঁপানোর জন্য মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। হঠাৎ বেলী সামনে এসে পড়ায় নীলাভ্র অবাক হলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
“এমন করে ছুটছিলি কেনো? কোন মহা কাজটা ভেসে যাচ্ছিলো শুনি?”
নীলাভ্রর কন্ঠস্বরে সামান্য রাগ মিশ্রিত ছিলো। বেলী সেদিকে নজর দিলো না। নীলাভ্রর রক্তমাখা হাতটা ধরে কাতর স্বরে বললো,
“এত রক্ত? অনেকটা কে’টে গেছে তো নীলাভ্র ভাই। কি করে কাটলো? ব্যাথা পেয়েছেন? নাকি কোনো ঝামেলা হয়েছিলো? কথা বলছেন না কেনো? বলুন না কি করে কাটলো?”
বেলি একনাগাড়ে প্রশ্ন গুলো করলো। কা’টা জায়গায় অনবরত ফুঁ দিয়ে যাচ্ছে। ওড়না দিয়ে পুরো হাতটা প্যাঁচিয়ে দিলো। আর নীলাভ্র ওর কান্ডে হা করে চেয়ে আছে ওর দিকে। বেলীর চেহারায় আঁতঙ্ক ফুটে উঠেছে। চোখ দুটো ছলছল করছে। অশ্রুধারা যেকোনো সময় নামবে। অবাধ্য অশ্রু ধারাকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছে বেলী। উপরের ঠোঁট দ্বারা নিচের ঠোঁটকে চেপে রেখেছে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ব্যাথাটা নীলাভ্রর থেকে ওর বেশি হচ্ছে। নীলাভ্রকে চুপ থাকতে দেখে বেলী নীলাভ্রর মুখ পানে তাকালো। দেখলো নীলাভ্র ওর দিকে বোবা চাহনী দিয়ে আছে। থমকে যাওয়া চোখ দুটো। হাজার প্রশ্ন জমে আছে এই চোখে। বেলী সেদিকে নজর দিলো না বেশিক্ষণ। প্রশ্ন করলো,
“বলছেন না কেনো? কি করে কে’টে গেছে এতটা? আর ডাক্তারের কাছে না গিয়ে বাড়িতে এসেছেন কেনো?”
নীলাভ্র সেকেন্ড কয়েক সময় নিলো। শান্ত কন্ঠেই উত্তর দিলো,
“আবার কে’টে দেখাব কি করে কা’টছে?”
বেলীর কপালে ভাঁজ পড়লো। বিষন্ন মুখটায় অবাকের রেখা দেখা দিলো। বললো,
“এভাবে উত্তর দিচ্ছেন যে?”
“যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর। ” ‘নিলাভ্র বললো’
বেলী ওর কথার পৃষ্ঠে কিছু বলতে যাবে, তখনি পেছন থেকে আইরিনের কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
“নীল বাবা তোর হাতে কি হয়েছে?”
আইরিনের কথা শুনে সীমা ছুটে আসলো। সীমার পেছন পেছন রিতা ও আসলো। সীমাকে দেখেই বেলী নীলাভ্রর হাতটা ছেড়ে দিলো। সীমা নীলাভ্রর দিকে এগিয়ে এসে চেঁচিয়ে,
“কত রক্ত পড়তাছে। তোর এমন হলো কি করে নীল? তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ফোন দে আইরিন। এক্ষুনি সেলাই করা লাগবে। কতটা জায়গা ডেবে গেছে।”
কথাগুলো বলে সে কান্না করে দিলো। মা তো। মায়েরা সন্তানের সামান্য কিছু সহ্য করতে পারেনা। বেলীর চোখের অবাধ্য অশ্রুকণা এতক্ষনে ঝড়ে পড়তে লাগলো। বেলী নিশ্চুপে দাড়িয়ে আছে। দুইহাতে বার বার অশ্রুকণা মুছে যাচ্ছে। নীলাভ্র এবার বিরক্ত স্বরে বললো,
“আমাকে ভেতরে যেতে দিবেনা নাকি? সবাই একসাথে এত প্রশ্ন করলে উত্তর দিবো কি করে?”
বলে সবাইকে সাইড কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আয়েশা খাতুন ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে ছিলো। নাতিকে এই অবস্থায় দেখেই আতঙ্কিত কন্ঠস্বরে বলে উঠলো,
“হায়! হায়! সব রক্ত পইড়া যাইতাছে তো। ডাক্তার রে ফোন লাগা রিতা। আমার দাদু ভাইডার কতরি কা’টছে।”
নীলাভ্র আয়েশা খাতুনের পাশে বসতে বসতে বললো,
“এতটা বিচলিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি দাদু। আমি আসার সময় ডাক্তারকে ফোন করে বলে দিয়েছি, বাসায় আসার জন্য। ”
নীলাভ্রর হাতে বেলীর ওড়না প্যাঁচানো। ওড়না ছাড়া এখন সবার সামনে আসতে বেলীর অস্বস্তি হচ্ছিলো। তখন না বুঝেই অর্ধেকটা প্যাঁচিয়ে দিয়েছিলো। নীলাভ্র ভেতরে ঢোকার সময় সম্পূর্ণটা টান লেগে চলে আসে। বেলী খোপা করা চুল গুলো ছেড়ে দিলো। দুই ভাগ করে দুই সাইডে দিয়ে ভেতরে ঢুকে আগে নিজের রুমে গেলো। ওড়না আনতে। রিতা নীলাভ্রর পাশে বসতে বসতে শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“কি করে কা’টলো বাবা? ব্যাথা পেয়েছিলি? নাকি কোনো এক্সিডেন্ট?”
রিতার প্রশ্নে নীলাভ্র ঝটপট উত্তর দিলো,
“রাস্তায় একটা ছোটখাটো এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। সেখানেই হাতটা কেটে গেলো। কিসের সাথে কা’টলো বুঝতে পারিনি?”
সীমা কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে নীলাভ্রর হাতটা ধরে বললো,
“ডাক্তার কখন আসবে? অনেক রক্ত বের হচ্ছে তো বাবা।”
নীলাভ্র এবার বেশ অধের্য গলায় উত্তর দিলো,
“মা একটু শান্ত হয়ে বসো। তেমন কিছু হয়নি।”
এমন সময় দরজা দিয়ে একজন মধ্যবয়স্ক ডাক্তার প্রবেশ করলেন। ডাক্তারকে দেখেই সবাই যার যার অবস্থান থেকে উঠে পড়লো। হাতের রক্ত গুলো পরিস্কার করে, বললো,
“দুইটা সেলাই লাগবে নীলাভ্র।”
বেলী সবে মাত্র এসে দাড়িয়েছিলো। সেলাইয়ের কথা কানে যেতেই ভয়ে শিউরে উঠলো। সেলাই লাগবে মানে? সেলাই করার সময় তো অনেক ব্যাথা হবে? ভাবতেই বেলী ভয়ে শিউরে উঠলো। ডাক্তার সেলানোর কাজে লেগে পড়লো। ব্যাথায় নীলাভ্রর চোখের চারপাশ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। চোখের কোনে পানি টলমল করছে৷ কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে৷ দাঁত,মুখ খিচে ব্যাথা সহ্য করার চেষ্টা করলো। নীলাভ্রর গায়ের রঙ ফর্সা হলে হয়তো মুখের লাল ভাবটা স্পষ্ট বোঝা যেতো। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখটা হালকা লাল আকার ধারণ করেছে। নিশ্চয়ই অনেক ব্যাথা হচ্ছে? আর হবে নাই বা কেনো? সেলাই করা কি চারটে খানেক কথা। বেলী সামনের দৃশ্যটা সহ্য করতে পারলো না। মায়ের কাঁধে মুখ লুকালো। রিতা ভাবলো হয়তো বেলী ভয় পাচ্ছে তাই? তাই মেয়ের মাথায় আলতো হাত বুলালো। সীমার কান্না থেমেছে কিন্তু চোখে এখনো পানি। সেলাই করা শেষ হতেই ডাক্তার সাদা ব্যান্ডেজে হাতটা প্যাঁচিয়ে দিলো। ব্যাথার ওষুধসহ, কিছু ওষুধ লিখে প্রেসক্রিপশনটা আইরিনের হাত দিয়ে চলে গেলো। ডাক্তার চলে যেতেই নীলাভ্র আর দাঁড়ালো না। নিজের রুমে চলে গেলো। নীলাভ্রকে চলে যেতে দেখে বেলী ওর পিছু পিছু যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তা দেখেই সীমা রাগে গজগজ করে বললো,
“একদম আমার ছেলের রুমে যাবিনা। তোর জন্য আমার ছেলেটার এই অবস্থা হলো। আমি কি সাধে আর তোকে অপয়া, ডিভোর্সি মেয়ে বলি।”
সীমার কথা শুনে বেলীর পা দুটো জমে গেলো। থেমে রইলো সেইজায়গায়। রিতা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“বড় ভাবি, কি বলছেন কি আপনি? আমার মেয়েকে অপয়া বলার আপনি কে?”
রিতার কথা শুনে সীমা দ্বিগুন রেগে বললো,
“আমার উপর চেঁচিয়ে কি লাভ রিতা? তোমার মেয়ে যা আমি তাই বলেছি। ভুল কিছু তো বলিনি।”
রিতা বরাবরেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পিছুপা হয়না। তাই থামলো না। উত্তর দিলো,
“আমার মেয়েকে এইসব বলার অধিকার আপনার নেই বড় ভাবি। আপনি মেয়ে হয়েই মেয়েদের সম্মান দিতে জানেন না। ভুলে যাবেন না আপনার ও একটা মেয়ে আছে। ”
সীমা রাগে কেঁপে উঠলো। হুংকার ছেড়ে বললো,
“আমাদের অন্ন ধ্বংস করে। আমাদের ছায়ায় থেকে আমার সাথে তর্ক করছো রিতা। নিজের ভাইয়ের মেয়ের দিকে আঙ্গুল তুলছো। নূন্যতম কৃতজ্ঞতা বোধ তোমার মধ্যে নেই।”
আয়েশা খাতুন আর আইরিন দুজনেই থামার জন্য বলছে। কিন্তু এরা কেউ কাউকে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। রিতা পুনরায় বললো,
“প্রথমতঃ আমি আপনার বা আপনাদের অন্ন খেয়ে বেঁচে নেই। প্রতি মাসে আমার ও আমার মেয়ের খাওয়ার টাকা আমি ভাইজানের হাতে তুলে দেই। আমি একজন স্কুলের শিক্ষিকা। নিজে ইনকাম করি। আপনাদের দয়া নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো দরকার নেই আমাদের। আর এটা আমার বাবার বাড়ি। তাই আপনাদের আশ্রয়ে নেই আমরা। আমি ইশুর দিকে আঙ্গুল তুলেনি। শুধু আপনাকে মনে করিয়ে দিলাম আপনার ও একটা মেয়ে আছে। অন্যের মেয়েকে কিছু বলার আগে দুইবার ভেবে নিবেন। আমার মেয়েকে আমি খাওয়াতে, পড়াতে পারলে আপনাদের সমস্যা কোথায়? আমার মেয়েকে নিয়ে আপনাদের চিন্তা না করলেও হবে। আমার মেয়ের জন্য আমি একাই যথেষ্ট। ”
কথাগুলো বলেই রিতা বেলীর হাত ধরে রুমে ধরে চলে গেলো। সীমা রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
“দেখলেন মা দেখলেন? আপনার মেয়ে আমাকে কতগুলো কথা শুনিয়ে গেলো।”
আয়েশা খাতুন উত্তর দিলেন না। চুপচাপ উঠে নিজের রুমে চলে গেলো। আইরিন কিচু না বলে থাকতে পারল না। বলেই উঠলো,
“আপা তো ভুল কিছু বলেনি ভাবী। আপনিই বা বেলীকে কেনো কথা শুনান ? বেলী দোষ না করলেও বেচারীকে দোষারপ করেন।”
আইরিন কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালো না। রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো। সীমা দাঁড়িয়ে রাগে ফুলতে লাগলো।
—
হাতের ব্যাথার যন্ত্রণায় নীলাভ্রর ধুম জ্বর। জ্বরে চোখের কোঠা ভয়ঙ্কর লাল। চোখে মেলে তাঁকাবার সাধ্যি নেই। সীমা বেশ কয়েকবার ছেলের মাথায় পানি ঢেলেছে সন্ধ্যা থেকে। এতক্ষণ বেলী নীলাভ্রর ধারে-কাছেও আসেনি। রাতে খাবার খেতেও যায়নি। সীমা তখনের পর সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে রেখেছে। নীলাভ্র ঘুমিয়ে যেতেই সীমা নিজের রুমে গিয়ে সুয়ে পড়লো। বেশ রাত হয়েছে। বেলী বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছে। কিছুতেই ঘুম আসচ্ছে। বার বার ভাবছে, ‘ব্যাথা কি বেড়েছে? জ্বর কি কমলো? ‘ অনেক ক্ষণ মন আর মস্তিষ্কের সাথে লড়াই করে উঠে পড়লো। ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নীলাভ্রর রুমের দিকে পা বাড়ালো। পুরো বাড়ি জুড়ে নিরবতা। সবাই হয়তো ঘুমে বিভোর। চারদিকে নজর বুলিয়ে নিলো। ধীর পায়ে এসে নীলাভ্রর রুমের বাইরে দাড়াল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। ড্রিম লাইটের আলোয় নীলাভ্রর মুষড়ে পড়া মুখটা দেখতে পেলো। নীলাভ্রর মাথার পাশে বসলো। অবাধ্য হাত চোখ আজকাল বড্ড বে’হায়া হয়েছে। যখন তখন ঝড়ে পড়ে শ্রাবণ ধারা। নীলাভ্রর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো বেলী। আনমনে বলে উঠলো,
“আপনাকে এভাবে মানায় না। চঞ্চল, হাসি, খুশি ছেলেটাকে এত শান্ত মানায় না। একদম মানায় না।”
হঠাৎ করেই নীলাভ্র নড়েচড়ে উঠলো। বেলীর হাতটাকে আঁকড়ে ধরলো। হয়তো জ্বরের ঘোরে বা ঘুমের ঘোরে বললো,
“বেলীপ্রিয়া তুই এসেছিস?”
বেলী বুঝতে পারলো না। চুপ মে’রে গেলো। শুনতে লাগলো নীলাভ্র কি বলে? আজ ও নির্বিক শ্রোতা। নীলাভ্র আবার মিনমিনিয়ে বললো,
“আমাকে একবার ভালোবাসবি বেলীপ্রিয়া। তোর ভালোবাসা পাওয়ার লোভে আজ কাল আমার চোখে ঘুমে আসে না রে।”
বেলী টের পেলো ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। নীলাভ্র এবার ও থামলো না৷ বললো,
“তোকে জড়িয়ে ধরার এক মারাত্মক অসুখ মস্তিষ্কে বাসা বেঁধেছে রে বেলীপ্রিয়া।”
নীলাভ্রর কথাটা শুনেই বেলীর বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। সবকিছু চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করলো। শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো। নীলাভ্র পুনরায় বললো,
” তোকে একটু জড়িয়ে ধরতে দিবি? প্রমিস করছি করছি শুধু জড়িয়ে ধরব। ”
কি নিঃসংকোচে আবেদন? আকুল কন্ঠের আবেদন ফিরিয়ে দেওয়ার মতো সাধ্য নেই। কারোর নেই। কি করে ফিরিয়ে দিবে এই আবেদন? বেলী ভাবতে লাগলো। এর মধ্যেই শুনতে পেলো,
“একটু জড়িয়ে ধরতে দে না রে। তোকে জড়িয়ে ধরলে আমার সব বিষাক্ত, যন্ত্রণাদায়ক অসুখ, সুখে পরিণত হবে।”
#চলবে
[