#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_দ্বিতীয়
ডান পাশের গালটা খানিক ফুলে আছে৷ ফর্সা গালে হাতের ছাপ স্পষ্ট। লাল বেনারসিটা ভিজে একাকার অবস্থা। চুলগুলো এলোমেলো। মুখের মেকাপ পানিতে ধুয়ে গিয়ে বিশ্রি অবস্থা। চোখের কাজল লেপ্টে আছে। প্রিয়জনের থেকে ধোকা সহ্য করার মতো শক্তি বোধহয় পৃথিবীর কোনো প্রেমিকার নেই। গলার স্বরটা ক্রমশ কমে আসছে বেলীর। প্রায় খন্টা হয়ে আসল বেলী ভিজে অবস্থায় আছে। শরীর ঠান্ডা বরফ হয়ে আছে। ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে শরীর। তবুও বুকের ক্ষতটার জ্বা°লা এক বিন্দু কমেনি। বরং প্রতি সেকেন্ডে, প্রতি মিনিটে বেড়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো থেকে অঝোরে পানি ঝরছে। অনেকক্ষন ধরে নিশ্চুপে বসে আছে। দরজার ওপাশ থেকে এতক্ষন বিভিন্ন রকম আওয়াজ আসলেও এখন কমে গেছে। সবাই হয়ত ক্লান্ত হয়ে চুপ করে গেছে। এটাই ভালো। একটু একা থাকা প্রয়োজন মেয়েটার। নিজের সাথে নিজের অনেক হিসেব মিলানো বাকি৷ দেয়ালের সাথে মাথাটা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করতেই কিছু স্মৃতি ভেসে উঠল। কাল রাতেও মানুষটা কত খুশি ছিলো। তাহলে আজ হঠাৎ কি হলো?
“খোঁজ নেওয়ার দরকার নেই। ভেবে নিস, ম°রে গেছি”
কথাটুকু মনে উঠতেই মাথার দুই পাশের শিরা ফুলে উঠল। প্রচন্ড ব্যাথায় ছটফট করে উঠল। পা°গলের মতো চিৎকার করে বলতে শুরু করল,
“আমাকে এমন করে ছেড়ে না গেলেও পারতেন, নীলাভ্র ভাই। কী দোষ ছিলো আমার? আপনার বেলীপ্রিয়া আপনাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। আপনি তো সব জানেন। আপনার বেলীপ্রিয়া আপনাকে ছাড়া অসহায়। বড্ড অসহায়! তবুও ছেড়ে গেলেন। কেন? কেন? কেন? আপনি তো আমার মানসিক প্রশান্তি ছিলেন। আর সেই আপনি আমাকে এতটা মানসিক যন্ত্রণায় ফেলে চলে গেলেন? ক্ষমা করব না আপনাকে। কোনোদিন ক্ষমা করব না। আপনার বেলীপ্রিয়া আপনাকে ক্ষমা করবেনা।”
কান্নায় গলা আটকে আসছে। শব্দ বের হচ্ছেনা। তবুও শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আরো একবার চিৎকার করে উঠল,
“নীলাভ্র ভাই, শুনতে পারছেন আপনি। আপনাকে ক্ষমা করব না আমি।”
আর শব্দ বের হলো না। শরীর আর সাঁয় দিলো না। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসল। আঁকড়ে ধরে রাখা খন্ডিত চিঠির টুকরোটা রয়ে গেলো হাতের ভাঁজে। সেটা ভিজে ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম।
—
ড্রয়িং রুমে পায়চারি কয়ে যাচ্ছে ইশু আর মেরিনা। সীমাকে সামলাচ্ছে আইরিন। আর রিতা সোফার এক কোনায় বসে আছে পাথরের মতো। নীলাভ্রর বাবাও তার পাশে বসে আছে। অনেক ক্ষণ হয়ে গেছে সবার মাঝে নিরবতা। এবার আর ইশু কিছুতেই চুপ থাকতে পারল না। অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠল,
“তোমরা কি সবাই এখানে চুপ করে বসে থাকবে? মেয়েটা এক ঘণ্টা যাবৎ ওয়াশরুমে রয়েছে। ভেতরে কি অবস্থায়? কি করছে? কেউ জানিনা। তোমরা সবাই এভাবেই বসে থাকো। এবার বেলী সাড়া না দিলে দরজা ভে°ঙে ফেলব। তবুও চুপ করে বসে থাকব না।”
বলে বেলীর রুমের দিকে পা বাড়াল। মেরিনা ও ছুটল সেদিকে। রিতার যেন এবার হুশ ফিরল। সত্যিই তো মেয়েটার অনেক ক্ষণ যাবৎ কোনো সাড়া শব্দ নেই। বুকের ভেতরটা ভয়ে দুমড়ে এলো। ইশু আর মেরিনার পিছুপিছু ছুটল সে। ইশু আর মেরিনা দুজনেই ডেকেই চলেছে একাধারে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। রিতার ভয়টা যেন দ্বিগুণ হয়ে গেলো। কাঁপা স্বরে ডাকতে শুরু করল,
“বেলী, মা আমার। দরজাটা এবার খোল, মা। তুই তো জানিস, আমার তুই ছাড়া কেউ নেই। তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কি করে বাঁচব? দরজাটা খোল, মা। আমার ভয় হচ্ছে অনেক।”
নাহ! এবারও সাড়া নেই। কোনো শব্দ নেই। তিনজনের ভয়টাই যেন এবার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল চারদিক থেকে। ভয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে সবার। এর মাঝে রুমে উপস্থিত হলেন নীলাভ্রর বাবা। হাঁক ছেড়ে বললেন,
“তোরা সরে যা। আমি দেখছি।”
তিনি এসেও উচ্চস্বরে ডাঁকা শুরু করল। কিন্তু ফলাফল প্রতিবারের মতোই শূণ্য। মেরিনা ভয়ে চো°টে ফট করে বলে উঠল,
“বেলী আবার উল্টা-পাল্টা কিছু করে বসল না তো?”
রিতার কানে কথাটা যেতেই সে কয়েকপা পিছিয়ে গেলো। ইশু সাথে সাথে তাকে আকঁড়ে ধরে মেরিনার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাল। ধমকের স্বরে বলল,
“কী আবোল-তাবোল বলছিস তুই? একদম বাজে কথা মুখে আনবি না। আমাদের বেলী এতটাও দূর্বল না। এইসব ভুল সিদ্ধান্ত কখনো নিবে না। এটা আমার বিশ্বাস।”
কথাগুলো বলতে ইশুর গলাও কাঁপছিল। তবুও মনে সাহস রেখে বাবার উদ্দেশ্য বলে উঠল,
“বাবা তুমি কিছু একটা করো, প্লিজ। দেরি হয়ে যাচ্ছে। সময় চলে যাচ্ছে। ভেতর থেকে এখনো পানির শব্দ আসছে। এতক্ষণ যাবৎ মেয়েটা ভিজে অবস্থায় থাকলে ম°রে যাবে। প্লিজ, কিছু করো।”
উপায়ন্তর না পেয়ে নীলাভ্রর বাবা দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। আশ্চর্যজনক ভাবে দুই-তিনবার দরজায় আঘাত করতেই দরজাটা খুলে যায়। দরজাটা খুলে যেতেই বেলীকে সেন্সলেস অবস্থায় দেখে সবার হার্টবিট থেমে যাওয়ার উপক্রম। রিতা সাথে সাথে চিৎকার করে দৌড়ে গেলো বেলীর কাছে। ওদের চিৎকার শুনে সীমা আর আইরিনও রুমে এসে হাজির হলো। সীমার মুখে একরাস বিরক্ত ছাড়া আর কিছু নেই। ইশু আর মেরিনা ঠাঁই দাঁড়িয়ে। কিছু বলার শক্তি পাচ্ছে না। তবুও এগিয়ে গেলো বেলীর কাছে বেলীর সারা শরীর ভিজে ফ্যাকাসে হয়ে আছে। শরীরে হাত রাখতেই ঠান্ডায় কেঁপে উঠল ইশু। বরফের মতো ঠান্ডা শরীরটা। তাড়াতাড়ি করে পার্লস চেক করতেই দেখল খুব স্লো চলছে পার্লস। নিঃশ্বাসটাও ঠিক ভাবে পড়ছে না। রিতা বেলীকে সেই অবস্থায় ঝাপটে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ইশুর এবার জোরেই বলে উঠল,
“ফুপ্পি, ছাড়ো বেলীকে। এখন কান্নাকাটি করার সময় না। ওর পার্লস খুব স্লো চলছে। এক্ষুনি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। প্লিজ, বাবা তুমি গাড়ির ব্যবস্থা করো। তাড়াতাড়ি, প্লিজ।”
সবাই মিলে বেলীকে তুলে এনে খাটে রাখল। ইশু আর মেরিনা মিলে তাড়াতাড়ি বেলীর জামাকাপড় বদলে দিলো। হাতে-পায়ে তেল মালিশ করা শুরু করল। তবুও শরীর গরম হচ্ছে না কিছুতেই। গাড়ি আসতেই রওনা হলো হসপিটালের উদ্দেশ্য।
—
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে চারদিকে। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা পর বেলীর জ্ঞান ফিরেছে। বেলীর মাথার কাছেই রিতা, ইশু বসে আছে। কিন্তু, কোনো শব্দ করছে না। বেলী এক নজরে উপরের দিকে তাকিয়ে। কিছু একটা ভাবছে। রিতা মেয়েকে এমন অবস্থায় সহ্য করতে না পেরে প্রশ্ন করার জন্য মুখ খুলল। বলল,
“এখনো কথা বলবি না?”
বেলী সাথে সাথেই উত্তর দিলো,
“বলছি তো? বলো, কী বলবে?”
সাথে সাথে ইশু কান্নারত স্বরে প্রশ্ন করল,
“কতটা ভয় পেয়েছিলাম, জানিস?”
এবার বেলী দৃষ্টি ঘুরাল। ইশুর দিকে শান্ত নজর রেখে মুখে হাসি টানল। খানিকটা হেসে বলল,
“কেন? ভেবেছিলি আমি ম°রে গেছি।”
ইশু এবার অবাক হলো। বেলীর এমন কথায়। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“বেলী, ইয়ার্কি করছি না তোর সাথে। এতক্ষণ যাবৎ কেউ ভিজে অবস্থায় থাকে? শরীরের কি হাল করেছিস দেখ?”
বেলী হাসল। কেমন যেন হাসিটা। এই হাসিতে প্রাণ নেই। স্নিগ্ধতা নেই। আছে শুধু তাচ্ছিল্য। হাসি বন্ধ করে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
“এইযে এখন থেকে কয়েক ঘন্টা আগে যেই বেলী ছিলো। সে ম°রে গেছে। এখন যেই বেলীকে দেখছিস, সে নতুন কেউ। আগের বেলী বো°কা ছিল। অল্পতেই সবাইকে বিশ্বাস করে ফেলত। তাইতো বার বার ঠকেছে। আজ থেকে বেলী স্বার্থপর হবে। খুব স্বার্থপর। যে শুধু নিজের কথা ভাববে। নিজের ভালোর কথা ভাববে। অন্যের কথা ভেবে সময় নষ্ট করবে না। আর নিজের ক্ষ°তিও করবে না।”
বেলীর কথাগুলোতে ইশু স্পষ্ট রাগ দেখতে পেলো। রিতাও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে মনে প্রানে চায় তার মেয়েটা সত্যি সত্যি এবার শক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়াক। শিরদাঁড়া সোজা করে চলুক। মাথা উঁচু করে বাঁচুক। কেউ তাকে আর ঠকাতে পারবে না। কেউ আঘাত করে ভেঙে দিতে পারবে না। ইশু বলে উঠল,
“আমিও চাই, তুই লাভ্র ভাইকে ভুলে নতুন করে সবটা শুরু কর। যে তোকে ঠ…।”
কথাটা শেষ করতে পারল না ইশু। তার আগেই বেলী বিরক্তির স্বরে বলে উঠল,
“নীলাভ্র? নীলাভ্র কে? আমি কোনো নীলাভ্রকে চিনিনা। না আমার লাইফে এই নামে কেউ ছিলো না। আমার লাইফে একজন বিশ্বাসঘাতক ছিল। তাকে আমি যতটা ভালোবেসেছিলাম। আজ থেকে তার থেকেও দ্বিগুণ ঘৃণা করব। ম°রে গেছে সে।”
কথাগুলো ইশুর সহ্য হলো না। যতই হোক ভাই বলে কথা। তবুও সহ্য করে নিলো। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। বেলী শান্ত স্বরে পুনরায় বলল,
“আমাকে একটু একা থাকতে দাও, মা। তোমরা এখন আসো।”
বেলীর কথা শেষ হতে না হতেই ইশু বেড়িয়ে গেলো। রিতাও কিছু না বলে বেড়িয়ে গেলো। তারা চলে যেতেই বেলীর দুই চোখ বেয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু আবার সাথে সাথেই বেলী মুছে নিলো। শক্ত কণ্ঠে নিজে নিজেই বলতে লাগল,
“আজ থেকে নতুন বেলীর জন্ম হলো। যার সাথে আগের বেলীর কোনো মিল থাকবে না। তবে হ্যাঁ, নীলাভ্র ভাই আপনি যেখানেই থাকেন। শুনে রাখেন, বেলী আপনাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না। আপনি যেদিন ফিরে আসবেন। সেদিন বেলীর চোখে আর ভালোবাসা দেখবেন না। দেখবেন শুধু এক রাশ ঘৃণা। আপনার জন্য আমি যতগুলো তীক্ত কথা হজম করেছি। তা সব সুধে আসলে ফেরত দিব আপনাকে। কাল থেকে শুরু হবে বেলীর নতুন লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই। মাথা উঁচু করে বাঁচার লড়াই।”
#চলবে
[ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আজকের পর্বটা একটু প্যাঁচালো হয়েছে জানি। ক্ষমা করবেন। হ্যাঁ, কাল থেকে সত্যি সত্যি অন্য বেলীকে দেখবেন। আর আপনাদের কী মনে হয় বলুন তো, নীলাভ্র কোথায় যেতে পারে?]