তুমি নামক প্রশান্তি ২ পর্ব -০৫

#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_পাঁচ

রাতের অন্ধকারে ফাঁকা রাস্তায় এলোমেলোহীন ভাবে দৌড়ে যাচ্ছে বেলী। কপাল বেয়ে যে র°ক্ত পড়ছে সে খেয়াল নেই। চোখে মুখে রয়েছে শুধু ভয়! অস্থিরতা! বেলীর পেছন পেছন রাকিব দৌড়াচ্ছে। চিৎকার করে ডেকে যাচ্ছে। কিন্তু বেলী শুনছে না। শুধু দৌড়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? কিছু জানেনা। হঠাৎ করে দেখতে পেলো, একটা চলন্ত গাড়ি দূরত্ব বেগে সামনে এগিয়ে আসছে। বেলী অতি দ্রুত থামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ব্যাথায় কিছুটা আর্তনাদ করে উঠল। তৎক্ষনাৎ গাড়িটা একদম বেলীর সামনে এসে পড়ে। ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। চোখের পলকে ঘটনাটা ঘটে যাওয়ায় রাকিব কিছু বুঝতে পারল না। শুধু বেলীকে পড়ে যেতে দেখে, ভয় পেয়ে গেলো। সাথে সাথে জোরে ‘বেলী’ বলে চিৎকার করে উঠল। দৌড়ে আসল বেলীর কাছে। গাড়িটা ব্রেক না কষলে হয়ত বেলী ভালো, মন্দ কিছু হয়ে যেতো। গাড়িতে থাকা ব্যক্তিটাকে রাকিব দেখতে পেলো না। বলা যায়, চেষ্টা করল না। শুধু দেখল বেলী নিচে পড়ে আছে। কপাল বেয়ে র°ক্ত পড়ছে। হাত বেশ খানিকটা ছি’লে থে’তলে গেছে। পায়ের গোড়ালিটা কে°টে র°ক্ত বের হচ্ছে। সেন্সলেস বেলীকে দেখে রাকিবের মায়া হলো। কষ্টে বুকটা কেঁপে উঠল। হাটু ভেঙে বসে পড়ল। বেলীর মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিলো। বেলীর গালে আস্তে আস্তে থা°প্পড় মে°রে ডাকতে লাগল…
“বেলী। চোখ খোল। দেখ, আমি এসেছি। প্লিজ দোস্ত, চোখ খুলে তাকা।”
রাকিব অনেক ক্ষণ ডেকে ক্লান্ত হয়ে গেলেও বেলীর জ্ঞান ফিরল না। এখন এই মাঝ রাস্তায় নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। এর মাঝেই পাশে কারোর উপস্থিতি টের পেতেই, চোখ তুলে তাকাল। সামনে থাকা ব্যক্তিটাকে দেখে বিস্ময়ে চোখ জোড়া বেরিয়ে আসতে চাইল। তবুও সামলে নিলো নিজেকে। অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি? আপনি এখানে কি করছেন?”
রাফিন হাসল বোধহয়। কেমন একটা রহস্যময় হাসি? আবার সেকেন্ডের মধ্যে মুখটাকে অসহায় করে ফেলল। হুড়মুড়িয়ে বসল বেলীর পাশে। বেলীর দিকে তাকিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“বেলী! বেলীর কী হয়েছে? ‘ও’ এমন পা°গলের মতো রাস্তায় ছুটছিল কেন? আমি যদি গাড়িটা ঠিক সময় ব্রেক না করতাম। তাহলে কি হতো ভাবতে পারছো?”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল একটা। উত্তরের আশায় রাকিবের দিকে চেয়ে আছে। রাকিব কী উত্তর দিবে? ভেবে পেলো না। তবুও কিছু একটা ভেবে বলল,
” আসলে বেলী অসুস্থ। হসপিটালে ছিল। হঠাৎ করেই ছুটে বেরিয়ে এলো এদিকে। বুঝতে পারছিনা কিছু।”
রাফিন আর উত্তর দিলো না। এ বিষয়ে কিছু বলার আগ্রহ দেখাল না। শুধু বলল,
“এখন তাড়াতাড়ি বেলীকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। আমার গাড়ি আছে সাথে। সমস্যা হবে না।”
বলেই বেলীকে কোলে তুলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়াল। কিন্তু তার আগেই রাকিব বেলীকে কোলে তুলে নিতে নিতে বলল,
“আমিই পারব।”
রাফিন শুধু ক্রুদ্ধ চোখে একবার তাকাল রাকিবের দিকে। পরক্ষণেই আবার মুখের ভঙ্গিমা পরিবর্তন করে নিলো। তারপর বেলীকে নিয়ে হসপিটালে রওনা দিলো।

প্রায় আধা ঘন্টা কে°টে গেছে বেলীর জ্ঞান ফিরেনি এখনো। রাকিব আর রাফিন দুজনেই করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। রাকিব হসপিটালের গেট দিয়ে ঢোকার সময় হঠাৎ দেখতে পায় বেলী পা°গলের মতো ছুটে বেরিয়ে গেলো। আর তখনেই রাকিব ও বেলীর পিছনে ছোটা শুরু করে। বার বার মস্তিস্ক প্রশ্ন করছে,
“কেনো বেলী ওইভাবে ছুটে গেলো। আর কপালেই বা আঘাত পেলো কী করে? নীলাভ্র কোথায় গেলো? কেন গেলো? বেলীকে কী সত্যি সত্যি ঠকাল না-কি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে?”
সব প্রশ্নের উত্তর কেমন যেন ধোয়াশা। কোনো প্রশ্নের উত্তর মিলাতে পারছে না। নিরবতার মাঝে রাফিন হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল,
“নীলাভ্র কোথায়? তাকে যে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। আজ তো নীলাভ্র আর বেলীর বিয়ে ছিল? তাহলে বেলীর এই অবস্থা হলো কী করে?”
রাকিব এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো। আমতা আমতা করতে লাগল। রাফিন ঠিক বুঝতে পারল রাকিব কিছু একটা লুকাচ্ছে। তাই একটু চে°পে ধরল। নাছোড়বান্দার মতো একটার পর একটা প্রশ্ন করে যেতে লাগল। শেষে বাধ্য হয়ে রাকিব সব বলল। রাকিবের কথা শেষ হতেই রাফিন একটু জোরেই বলে উঠল,
“হোয়াট? কী বলছো এসব? নীলাভ্র তো তার বেলীপ্রিয়া বলতে অন্ধ ছিলো। ওহ মাই গড! ভাবতে পারছি না কিছু। তার মানে নীলাভ্র বেলীর থেকে রিভেঞ্জ নিলো। ”
এইটুকু বলে থামল কিছুক্ষণ। তারপর আবারো জোর গলায় বলে উঠল,
“দেখেছো, আমি আগেই বলেছিলাম, ‘নীলাভ্র বেলীকে ভালোবাসে না’। শুধুই বেলীর সৌন্দর্যে আকৃষ্ট ছিলো। তখন তো আমাকে কেউ বিশ্বাস করোনি। বরং অপমান করেছিলে। আমি মানছি, আমি ভুল করেছিলাম। তারপর যখন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলাম। তখন সবটা ঠিক করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওই নীলাভ্রর জন্য কিছু ঠিক হয়নি। আমার থেকে বেলীকে সম্পূর্ণ কেড়ে নিলো। আর এখন নিজেই আবার বেলীকে ছেড়ে চলে গেলো। আ…।”
রাফিন আর কিছু বলার আগেই রাকিব থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
“এখন এইসব বলার সময় না।”
বলেই রাফিনকে সাইড কা°টিয়ে অন্য দিকে চলে গেলো। আর রাফিন মুচকি হেসে উঠল। মনে মনে বলে উঠল,
“যাক অবশেষে পথের কা°টা দূর হলো। এবার শুরু হবে নতুন অধ্যায়।”
রাফিনের মুখ থেকে যেন হাসি সরছে না। মনে মনে কিছু ভাবতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।


জানালা দিয়ে সূর্যের আলো চোখে পড়তেই বেলীর ঘুম ভে°ঙে যায়। সাথে সাথে চোখ দুটো খিচে নিলো। হাত দিয়ে মুখটা ঢাকার চেষ্টা করল। কপালে তীব্র ব্যাথা অনুভব করতেই একটু নড়ে উঠল। আস্তে আস্তে চোখ খুলে চারদিকটা একবার পর্যবেক্ষণ করল। নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখে একটু অবাক হলো। পূর্বের কথা মনে পড়ল না। উঠে বসার শক্তি পেলো না। তবুও দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে বসল। কপালে হাত দিয়েই ব্যান্ডেজের ছোঁয়া লাগল। চোখ বন্ধ করে কিছু মনে করার চেষ্টা করল। যখনি কানের মধ্যে ‘বেলীপ্রিয়া’ ডাকটা বাজল। তখনি বেলী ভয়ে কেঁপে উঠল। মনে পড়ে গেলো সবটা। কাল রাতে নীলাভ্র ফোন করেছিল। হ্যাঁ! বেলীর স্পষ্ট মনে পড়ছে। ওই কণ্ঠটা নীলাভ্রর ছিলো। এতদিনের চেনা কণ্ঠস্বর চিনতে বেলীর এক ফোঁটাও ভুল হয়নি। আস্তে আস্তে সবটা মনে করার চেষ্টা করল…
কাল ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই কেউ অসহায় স্বরে ওপাশ থেকে ডেকে উঠল,
“বেলীপ্রিয়া”
বেলী কণ্ঠস্বরটা শুনেই ‘থ’ হয়ে গেলো। উত্তর দেওয়ার মতো শব্দ বের হলো না আর। তবুও মানুষটাকে আরেকবার যাচাই করার জন্য, কিছু বলার জন্য মুখ খুলল। বলে উঠল,
“কে?”
ওপাশ থেকে তৎক্ষনাৎ ফিসফিসিয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
“বেলীপ্রিয়া, আমি তোকে ঠকা…।”
এইটুকু বলার সাথে সাথে জোরে কিছু একটা শব্দ ভেসে আসল বেলীর কানে। আর সাথে কারোর ব্যাথায় কুকিয়ে উঠার আর্তনাদ শুনতে পেলো। তখনি লাইনটা কে°টে গেলো। ভয়ে বেলীর বুকটা কেঁপে উঠল। জোরে ‘নীলাভ্র ভাই’ বলে চিৎকার করে উঠল। কোনো কিছু না ভেবেই ছুটতে লাগল। ছুটে বেরিয়ে আসার সময় কিছু একটার সাথে কপালে আঘাত লেগেছিল। তখনি হয়ত কপাল কে°টেছে। কিন্তু সেদিকে বেলীর হুঁশ নেই। তারপর আর কিছু মনে নেই…।
সবটা মনে হতেই বেলীর মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো। পা°গলের মতো চিৎকার করে কেঁদে উঠল। বেলীর চিৎকার কানে যেতেই রাকিব করিডোর থেকে দৌড়ে এসে ঢুকল কেবিনে। বেলী হাতের ক্যানোলা গুলা টেনে ছিড়ে ফেলছে। রাকিব দৌড়ে গিয়ে বেলীর হাত দুটো ধরে ফেলল। বলতে লাগল,
“কি করছিস তুই? পা°গল হয়ে গেছিস না-কি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে না-কি তোর?”
বেলী কাঁদতে কাঁদতে রাকিবের হাত দুটো আকঁড়ে ধরে বলতে লাগল,
“আমার নীলাভ্র। নীলাভ্র ভাই বিপদে আছে। প্লিজ কিছু একটা কর। বিশ্বাস কর, আমি শুনেছি। ওরা ওরা মা°রছে। ও…।”
বেলী হাঁপাচ্ছে। আর কিছু বলতে পারছে না। আর রাকিব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অবাক স্বরে বলে উঠল,
“কী বলছিস তুই? কারা? কে মা°রছে? কী সব আবোল-তাবোল বলছিস?”
বেলী কিছু বলার জন্য শান্ত হলো। হঠাৎ করে চোখ দরজার দিকে যেতেই আবার অশান্ত আচরণ শুরু করে দিলো। বেড থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল। দরজার দিকে ছুটে গেলো। রাকিব পেছন ফিরে দেখে দরজায় রাফিন দাঁড়িয়ে আছে। বেলী ছুটে গিয়েই রাফিনকে স°জোরে থা°প্পড় মে°রে বসল। ক্ষুধার্ত বা°ঘের ন্যায় হা°মলে পড়ল রাফিনের গায়ে। শক্ত করে কলার চে°পে ধরে বলতে লাগল,
“আমার নীলাভ্র কোথায়? আমি জানি, তুই আমার নীলাভ্রকে আটকে রেখেছিস। কোথায় আটকে রেখেছিস?”
রাফিন বেলীর এই আচরণে অবাকের শেষ সীমানায়। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে শুধু। এদিকে ক্রোধের আগুণে জ্ব°লছে বেলী। রাকিব শুধু দাঁড়িয়ে দেখছে। বেলীর কথা গুলো একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবল। তারপর মনে মনে বলে উঠল,
“সত্যিই তো! এই কথাটা তো এতক্ষণ আমার মাথায় আসেনি। রাফিন নীলাভ্র ভাইকে কিডন্যাপ করেনি তো? যদি কোনো ক্ষতি করে ফেলে?”
ভেবে রাকিব নিজেই আঁতকে উঠল। ঠান্ডায় মাথায় নিজেই কিছু অংক কষল। তারপর বেলীকে জোর করে ছাড়িয়ে নিলো রাফিনের কাছ থেকে। বেলী তবুও থামছে না। রাকিব কে অনুরোধ বাক্য বলল,
“রাকিব, তুই প্লিজ কিছু একটা কর। বিশ্বাস কর, আমি ভুল বলছি না। আমি একদম সত্যি কথা বলছি। আমি শুনেছি, নীলাভ্র ভাই আমাকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই কেউ আঘাত করে আর নীলাভ্র আর্তনাদ করে উঠে।”
রাফিন এবার তেড়ে আসল বেলীর দিকে। রাগী স্বরে বলল,
“তোমার দেখছি শোকে মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। আমি তো বাংলাদেশেই ছিলাম না। একটা কাজে ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম। কাল রাতে ফিরেছি। প্রমাণ দেখছে চাও? দেখাচ্ছি…।”
বলেই পকেট থেকে পার্সপোট। আরো কিছু কাগজ পত্র দেখাল। তার মানে রাফিন সত্যি বলছে। তাহলে…?

#চলবে

[আসসালামু আলাইকুম। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কাল সকালে বোনার্স পর্ব আসবে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here