#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_আট
পা°গলের মতো হসপিটালের করিডোর দিয়ে দৌঁড়াচ্ছে বেলী। একবার বামদিকে ছুটছে তো, একবার ডানদিকে ছুটছে। চেহারা ভর্তি আঁতঙ্ক। মাথা ভর্তি দুশ্চিন্তা। বুকের ভেতরটা সবসময় এখন ধুকপুক করে। প্রতি মুহূর্তে কোনো খারাপ খবরের আশাঙ্কায় বুক কেঁপে উঠে। চোখের ঘুম তো দূর হয়ে গেছে সেদিনেই। এর মধ্যে কে°টে গেছে সাতদিন। বেলী আর নীলাভ্রর বাবার পার্সপোট থাকায় তারাই নীলাভ্রকে নিয়ে ইন্ডিয়া এসেছে। নীলাভ্র সেদিনের পর এখনো চোখ মেলে তাকায়নি। কোনো হুঁশ নেই। চেন্নাইয়ের উন্নত হসপিটাল গুলোর মধ্যে Fortis Mallar Hospital একটি। এখানে আজ দুইদিন হলো নীলাভ্র ভর্তি। কিন্তু এখন অব্দি কিডনির ব্যবস্থা হয়নি। সুস্থ, অসুস্থ কোনো ব্যক্তিই নিজের ইচ্ছায় কিডনি দিতে রাজি হয়নি। বেলী হাজার চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেনি। কিছুক্ষণ আগেই বেলীর কানে খবর আসল। এই হসপিটালের একজন এক্সি°ডেন্টের রুগী মা°রা গেছে। খবরটা শোনার সাথে সাথে বেলী ছুটল সেদিকে। যদি কিছু একটা করা যায়৷ হসপিটালের সিড়ি বেয়ে দৌড়ে নামার সময় ওড়না পায়ে প্যাঁচিয়ে পড়ে যাওয়ার সময় এক জোড়া হাত এসে আটকে দিলো। বেলী ভয় পেয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। এর মধ্যেই শুনতে পেলো,
“একটু আস্তেধীরে চলাফেরা করবি, তো। এখন কি আর সামলানোর জন্য নীলাভ্র ভাই আছে?”
হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠে এমন কথা শুনে বেলী থমকে গেলো। চোখ মেলে তাকাতেই রাকিবকে চোখের সামনে দেখে যেন, অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলো। সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিলো। বিস্ময়ের স্বরে প্রশ্ন করল,
“তুই! তাও আবার এখানে! কী করে?”
রাকিব হালকা হাসল। বেলীর মাথায় গাট্টা মে°রে বলে উঠল,
“নীলাভ্র ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার বউকে সামলানোর দায়িত্ব কার? আমারেই তো। তাই তো চলে আসলাম।”
বেলী সাথে সাথেই প্রশ্ন করল,
“কিন্তু, তুই…?”
বেলীকে থামিয়ে দিয়ে রাকিব বলে উঠল,
“তুই আমার কথা বাদ দে। এখন আগে বল, নীলাভ্র ভাই কেমন আছে?”
বেলীর মুখটা সাথে সাথে চুপসে গেলো। বিষন্ন স্বরে জবাব দিলো,
“কেমন আছে জানিনা? তবে বেঁচে আছে।”
বলতে বলতে চোখে অশ্রু জমা হলো। রাকিব প্রসঙ্গ এড়াতে বলল,
“তুই এমন পা°গলের মতো ছুটছিলি কেন? কোথায় যাচ্ছিলি?”
হঠাৎ করেই বেলীর আবার মনে পড়ল। রাকিবকে সবটা গুছিয়ে বলেই সাথে সাথে ছুটল আবার। রাকিব ও বেলীর পেছন পেছন গেলো। দুজনে মিলে ঘন্টা খানেক দৌড়াদৌড়ি করে সবটা ব্যবস্থা করল। পরিবারের কিছু মানুষ প্রথমে আপত্তি করেছিল ঠিকি। কিন্তু বেলীর আকুতি মিনতির কাছে হার মেনে শেষ অব্দি রাজি হলো। অবশেষে মৃ°ত ব্যক্তির কিডনিটা নীলাভ্রকে দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু হলো। ভাগ্যক্রমে নীলাভ্রর রক্তের গ্রুপ আর ছেলেটার রক্তের গ্রুপের মিল থাকায় আর কোনো সমস্যায় পড়তে হলো। কাল সকালে নীলাভ্রর কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হবে বলে ডাক্তার জানাল। সব কিছু এত সহজে হয়ে যাবে বেলী ভাবতেও পারছে না। সব ব্যবস্থা করে রাকিব আর বেলী নীলাভ্রর কেবিনে ফিরে আসল। নীলাভ্রর বেডের পাশেই নীলাভ্রর বাবা অসহায়গ্রস্ত চেহারায় বসে ছিল। বেলীকে দেখেই হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো। প্রশ্ন করল,
“কী হলো রে মা? ব্যবস্থা হলো কোনো? আমার ছেলেটাকে কি কেউ অন্তত একটা কিডনি দিতেও কী ভিক্ষে দিতে রাজি হলো না?”
বেলী নীলাভ্রর বাবার হাতটা আকঁড়ে ধরে হাসি মুখে বলে উঠল,
“সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে মামা। আল্লাহ, কাউকে খালি হাতে ফেরায় না। আল্লাহকে ভরসা করলে তিনি কাউকে হতাশ করেন না। তুমি আর চিন্তা করো না। তোমার ছেলে খুব শিঘ্রই সুস্থ হয়ে যাব। ইন’শা’আল্লাহ। তুমি শুধু দোয়া করো। বাবা-মার দোয়াই সবথেকে বড়, মামা।”
নীলাভ্রর বাবার চোখে খুশিতে নোনা জল এসে ভীড় করল। বেলীকে বুকে আকঁড়ে নিলো। বেলীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগল,
“আমার ছেলেটা সুস্থ হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে৷ তুই হারানো সব ফিরে পাবি। তোদের দুজনের জীবনটা আবার রঙিন হয়ে উঠবে। দেখে নিস তুই। আমি তোদের দুজনকে যে এভাবে সহ্য করতে পারছি না। এই বয়সে এসে ছেলে হারানোর শোক সহ্য করার মতো ক্ষমতা আমার নেই রে।”
বলেই কেঁদে দিলেন। আর বেলী শেষ কথাটা শুনে আঁতকে উঠল। সাথে সাথে বাঁধা দিয়ে বলে উঠল,
“এমন কিছু হবে না। কিছু হবে না তার৷”
বেলীর কথা শেষ হতেই রাকিব বলে উঠল,
“আপনি একদম চিন্তা করবেন না, আংকেল। নীলাভ্র ভাই, একদম সুস্থ হয়ে যাবে। তাকে যে সুস্থ হতেই হবে। আপনাদের জন্য, বেলীর জন্য। শাস্তিও পেতে হবে। এক বছর নিজেকে আড়াল করে রাখার জন্য।”
বলেই হাসল খানিক। সবার মাথা থেকে কিছুটা চিন্তা দূর হলো। এই শহরের অলিগলি কিছুই বেলী চিনেনা। তাই রাকিব আর নীলাভ্রর বাবাকে খাওয়ার জন্য পাঠাল। আর বেলী নীলাভ্রর পাশস চুপটি করে বসল। নীলাভ্রর হাতটা ধরে নিজের গালের সাথে লাগিয়ে চুপ করে চোখ বন্ধ করে নিলো। নিজে নিজেই বলতে লাগল,
“আর মাত্র কিছু ঘন্টা তারপর আপনি সুস্থ যাবেন। একদম সুস্থ হয়ে যাবেন। আমার যে আর সহ্য হচ্ছে না নীলাভ্র ভাই। আমি একা একা কিভাবে বাঁচব? আমি তো নিজেকে সামলে রাখতে পারিনা। জানেন, এই এক বছরে আমাকে কেউ একদিনও জিজ্ঞেস করেনি, ‘বেলীপ্রিয়া তুই ঠিক আছিস?’। এই এক বছরে কেউ আমাকে স্বান্তনা দিয়ে বলেনি ‘সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। তুই এতটা ভে°ঙে পড়িস না’। প্লিজ সুস্থ হয়ে উঠুন না। আমার দম আটকে যায় প্রতিমুহূর্ত। আপনাকে এতটা শান্ত মানায় না। আজ সাতদিন আপনি একবারের জন্য চোখ মেলে তাকাননি। আপনার বেলীপ্রিয়া আপনার এত কাছে। অথচ আপনি দেখেননি। আমি আর নিতে পারছিনা। আমি হাঁপিয়ে গেছি। দেখুন আমি এই সাতদিনেই হাঁপিয়ে গেছি। আর আপনি এই একটা বছর কী করে এইসব সহ্য করেছিলেন? একা একা কিভাবে লড়াই করেছিলেন? আপনার কি বেঁচে থাকার ইচ্ছা জন্মায়নি? আপনার কি একবার বেলীপ্রিয়াকে জানানোর প্রয়োজনবোধ হয়নি? কেন সেদিন নিজেকে সবার সামনে ছোট করার জন্য ওইরকম একটা চিঠি লিখেছিলেন? ক
এতসব কেনোর উত্তর কে দিবে আপনি ছাড়া? তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন তো।”
বলেই কান্না শুরু করল। আর কিছু বলল না। মেয়েটা যে এবার আর সত্যিই পারছে না। আর কত কি সহ্য করতে হবে মেয়েটার? ভালোবাসা এত কষ্টের কেন? সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষগুলো এত সহজে দুজন দুজনকে পেয়ে যায়না। পেতে হলে হাজারটা ঝড়ের সাথে মোকাবিলা করতে হয়।
—
সারারাত বেলী নীলাভ্রর পাশে নির্ঘুম রাত কা°টাল৷ বেলী ঘুমায়নি বলে রাকিবও সারারাত ঘুমায়নি। বার বার বেলীকে বুঝিয়েছে যে ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’। সত্যিকারের বন্ধুতো তারাই যারা সবরকম বিপদে পাশে থাকে। সাহস জোগায়। ভরসার হাত বাড়িয়ে দেয়। বেলীর এখন নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয় এমন দুজন বন্ধু পেয়েছি। একজনকে আল্লাহ কেড়ে নিয়েছে ঠিকই কিন্তু আরেকজনকে বিপদের বন্ধু করে পাশেই রেখেছে। তানিশা চলে যাওয়ার পর রাকিব প্রায় একমাস পা°গলের মতো ছিল। কারোর সাথে কথা বলত না। বাইরে বের হতো না। অনেকটা সময় লেগেছে ছেলেটার নিজেকে ঠিক করতে। এই এক বছরেও ছেলেটার লাইফে আর দ্বিতীয় নারীর ঠাঁই হয়নাই। স্বার্থপরের মতো ভুলে যায়নি নিজের ভালোবাসাকে। মনে রেখেছে। এমন দিন নেই যে ছেলেটা কষ্ট না পায়। তবে এখন আর প্রকাশ করে না। নিয়তিকে যে মেনে নিতেই হয়। ভোর হতেই বেলীকে জোর করে রাকিব এক কাপ চা খাওয়াল। চা খেতে খেতে বলে উঠল,
“আর মাত্র কিছু ঘন্টা। তারপর দেখিস, তোর ভালোবাসা তোর কাছেই ফিরবে। কারণ, ভালোবাসার মানুষটাকে চিরতরে হারানোর কষ্ট তো আমি বুঝি।”
রাকিবের মুখটা মুহূর্তেই কালো অন্ধকার হয়ে গেলো। চোখের কোনে মনে হলো অশ্রু। কিন্তু মুখে আছে হাসি। চোখে জল, মুখে হাসি। ব্যাপারটা খুবই ভয়ানক! বড্ড বাজে! বেলী শুধু এক নজরে তাকাল রাকিবের দিকে। তারপর বলল,
“আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য। তানিশা বেঁচে থেকে যেই নিদারুণ কষ্টটা সহ্য করেছে। সেই কষ্টটার থেকে তো মুক্তি মিলেছে। এটাই বা খারাপ কি বল?”
রাকিব উত্তর দিলো না। শুধু হাসল। প্রায় ঘন্টা খানেক পর নীলাভ্রকে “ও’টি” রুমে ঢুকানো হলো। বাইরে বেলী ডানা কা°টা পাখির মতো ছটফট করছে। একটা সুসংবাদের আশায় মুখ চেয়ে আছে। ভাগ্য কী সহায় হবে?
—
“ও’টি” রুম থেকে একজন ডাক্তার আর দুজন নার্সকে বের হতে দেখেই রাকিব আর নীলাভ্রর বাবা এগিয়ে গেলো। কিন্তু বেলী নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে রইল। নড়ল না। সাহস হলো না এগিয়ে যাওয়ার। ভয়ে বুকের ভেতরটা বার বার চে°পে আসছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে৷ মাথাটা ভার হয়ে আসছে। তবুও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নীলাভ্রর বাবা চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করল,
“আমার ছেলের কি অবস্থা?”
ডাক্তারটা চওড়া হাসল। ডাক্তারের হাসি দেখে রাকিব আস্তে করেই নীলাভ্রর বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
“উনি বাংলা বুঝতে পারছে না হয়ত আংকেল। আমি বলছি…।”
রাকিবের কথা শেষ হতে না হতেই ডাক্তারটা বাংলা ভাষাতেই উত্তর দিলো,
“আমি খাঁটি বাঙালি। কাজের সূত্রে এখানে আছি। আপনি বলেন?”
ডাক্তারটা কথায় নীলাভ্রর বাবা এবার বেশ আগ্রহ নিয়েই প্রশ্ন করল,
“আমার ছেলে মানে ভেতরে যে আছে সে কেমন আছে? সুস্থ হয়ে যাবে তো?”
ডাক্তারটা এবার ও হাসল। বেশ নম্র স্বরে বলল,
“কংগ্রাচুলেশন। আপনার ছেলে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি সম্পূর্ণ হয়েছে। এবং সে একদম সুস্থ আছে। শুধু ২৪ঘন্টা অবজারভেশনে রাখতে হবে। ঘন্টাখানেকের মাঝেই জ্ঞান ফিরে আসবে। চিন্তার কোনো কারণ নেই।”
নীলাভ্রর বাবা হাঁফ ছাড়ল। আর রাকিব সাথে সাথে আবার প্রশ্ন করল,
“আর কোনো সমস্যা নেই তো ডাক্তার?”
ডাক্তারটা নরম স্বরে অভয় বানী দিল,
“একদম না। শুধু শরীরকে নতুন কিডনি প্রত্যাখান করা থেকে বিরত রাখতে, প্রতিরোধ ব্যবস্থা দমন করার জন্য কিছু ওষুধ আজীবন গ্রহণ করে যেতে হবে।”
বলে সে চলে গেলো। বেলীর কানে কথাগুলো যেতেই যেন বেলীর কলিজায় পানি এলো। হাঁফ ছেড়ে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ল। চোখ ভর্তি পানিগুলো অনবরত পড়তে লাগল। বেলী মুখ চে°পে শব্দহীন কান্নায় মত্ত হলো। অবশেষে সব অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে….
#চলবে
#বিশেষ_নোটঃ- আমি এই চিকিৎসা সম্পর্কে যতটুকু জানি তাই দিয়েছি। ভুল হতে পারে তার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। পারলে দেখিয়ে দিবেন আমি ঠিক করে নিব। আর মাত্র কয়েক পর্ব। তারপরেই অনেকদিনের যাত্রা শেষ হতে চলেছে….