#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী
|২০|
উৎসবের ডাকে হুশ ফিরে অর্নির। উৎসব তখনো বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। আর অর্নি বিছানার এক পাশে দাঁড়ানো। নিজের চিন্তা-ভাবনায় নিজেই বেশ বিরক্ত হলো অর্নি। ইশ্! কি লজ্জার বিষয়? উৎসব যদি বুঝতে পারে অর্নি এখন উৎসবকে জড়িয়ে ধরার কল্পনায় চলে গেছিলো তাহলে আজ আর রক্ষে থাকবে না। ক্ষেপিয়ে পাগল বানিয়ে ছাড়বে৷ উৎসব উঠে অর্নির সামনে দাঁড়ালো। বললো,
–“কি ভাবছো তখন থেকে?”
অর্নি আমতা আমতা করে বললো,
–“কি্ কিছু না তো।”
কথাটা কোনোমতে বলেই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। একপ্রকার পালিয়ে আসলো। ওর লজ্জা লজ্জা লাগছে ভীষণ। অবাধ্য মনটা আর কিছু ভাবতে পারলো না? বেছে শুনে সেই জড়িয়ে ধরার কথাটাই মাথায় এলো? ইশ্! কি বিচ্ছিরি কান্ড। অর্নির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে উৎসব ফোঁশ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই মেয়ে মনে হয় না কখনো নিজ মুখে ভালোবাসি বলবে ওকে। তবে মনে মনে উৎসব ঠিক করে নিলো যতক্ষণ না ভালোবাসি বলছে অর্নির সাথে কথা বলবে না৷ উৎসবও দেখতে চায় ওর কঠিন রুপটা অর্নি কিভাবে মেনে নেয়৷
নূরের বিছানায় বসে হাঁপাচ্ছে অর্নি। নূর ভ্রু কুঁচকে ফেললো। জিজ্ঞেস করলো,
–“এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন? মনে হচ্ছে কিছু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে পাবলিকের মারের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে এসেছিস।”
নূরের কথায় অর্নি তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো ওর দিকে। নূর বললো,
–“ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন? সত্যিটাই বলছি__আচ্ছা বাদ দে, কি হইছে সেটা বল।”
–“উৎসব ভাইয়ের ঘরে গেছিলাম।”
–“হ্যাঁ তো?”
–“তোর ভাইয়ের সে কি রাগ ভালোভাবে কথাই বললো না আমার সাথে। কেমন গম্ভীর স্বরে কথা বললো।”
–“এখন রাগ কমেছে?”
অর্নি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। নূর বললো,
–“এখনো রাগ কমলো না?”
অর্নি মাথা নাড়ালো। তারপর একে একে সব বললো। সবকিছু শুনে নূর হতাশ হলো বেশ৷ এই মেয়েকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। নূর হতাশ চোখে তাকিয়ে বললো,
–“কি এমন চেয়েছিলো ভাইয়া? জাস্ট তোর মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটাই তো শুনতে চেয়েছিলো। ভালোবাসি বললেই দেখতি ভাইয়ার পাহার সমান রাগ গলে পানি হয়ে যেতো৷ এইটুকু বলতে পারলি না?”
–“লজ্জা লাগে না আমার উৎসবের ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসি বলতে? আর উনি তো জানেনও আর বোঝেনও যে উনাকে আমি ভালোবাসি। তাহলে এরপরও মুখে বলতে হবে কেন?”
–“তুই তোর লজ্জা নিয়ে থাক। এদিকে অন্যকেউ এসে ভাইয়াকে নিয়ে যাক৷ তখন ভালো হবে।”
অর্নি কাঁদোকাঁদো চোখে তাকালো নূরের দিকে। নূর মুখ ঘুরিয়ে নিলো। অর্নি গিয়ে জাপ্টে ধরলো নূরকে। নূর নিজেকে ছাড়াতে গিয়েও ছাড়াতে পারলো না। অর্নি বললো,
–“দোস্ত একটা আইডিয়া দে না, কিভাবে উৎসব ভাইয়ের রাগ ভাঙানো যায়? তোর তো ভাই, আই হোপ তুই জানিস। বল না দোস্ত।”
–“আমার ভাই হলেও ইন ফিউচার তোর জামাই হবে জামাই। সো এখন থেকেই ব্রেন খাটিয়ে দেখ কিভাবে কি করলে আমার ভাইয়ের রাগ সহজেই কমে যাবে।”
–“এমন করিস কেন? তুই একটা আইডিয়া দে না প্লিজ। নেক্সট টাইম থেকে তোর ভাই রাগ করলে নিজের ব্রেন খাটিয়েই তোর ভাইয়ের রাগ ভাঙানোর আইডিয়া বের করবো আমি পাক্কা।”
নূর সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
–“তারমানে, এরপরও ভাইয়া যাতে রেগে যায় সেরকম কাজ করবি তুই?”
অর্নি আমতা আমতা করে বললো,
–“আমি আবার সে কথা কখন বললাম?”
নূর কিছু বললো না। শান্ত’র ফোন আসায় উঠে ব্যালকোনিতে চলে গেলো। এদিকে অর্নি বসে বসে ভাবতে লাগলো কি করে উৎসবের রাগটা ভাঙানো যায়?
–
শায়লা বেগম সন্ধ্যার নাস্তা বানাচ্ছেন। অর্নি গোমড়া মুখে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো৷ তা দেখে শায়লা বেগম বললো,
–“মুখটা ওমন করে রেখেছিস কেন?”
–“তোমার ছেলের রাগ তো কমছেই না আন্টি।”
–“সেকিরে, এখনো রাগ কমেনি?”
অর্নি গোমড়ামুখে না জানালো। শায়লা বেগম মুচকি হেসে অর্নির দিকে ঘুরলো। অর্নির গালে হাত রেখে বললো,
–“আমি একটা আইডিয়া দিবো? নাইনটি পার্সেন্ট কাজে দিবে।”
অর্নির চোখদুটো খুশিতে চিকচিক করে উঠলো। বলো,
–“বলো, বলো প্লিজ।”
শায়লা বেগম মৃদু হেসে কিছু একটা বললেন অর্নিকে। অর্নি সবটা শুনে বললো,
–“বলছো? এতে তোমার ওই গোমড়ামুখো ছেলের রাগ কমে যাবে তো?”
–“চেষ্টা করতে দোষ কোথায়?”
অর্নি আর কিছু বললো না। শায়লা বেগম নাস্তা বানানো শেষ করে অর্নিকে বললো,
–“এখন চল আমার সাথে।”
অর্নি বিনাবাক্য শায়লা বেগমের পেছন পেছন চলে গেলো। ঘন্টা খানেক বাদে অর্নি গুটিগুটি পায়ে নূরের রুমে গেলো। নূর তো অর্নিকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। অর্নি বললো,
–“আমি ছাদে যাচ্ছি, তোর ভাইকে একটু পাঠিয়ে দিস মিনিট পাঁচেক বাদে?”
নূর মুচকি হেসে সম্মতি জানালো। অর্নি এবার চলে গেলো ছাদে। মিনিট পাঁচেক বাদে নূর উৎসবের রুমের দিকে পা বাড়ালো। উঁকি দিয়ে দেখলো উৎসব সোফায় বসে অফিসের ফাইল দেখছে। ফাইলে দৃষ্টি রেখেই উৎসব বললো,
–“উঁকিঝুঁকি মারছিস কেন? যা বলার ভিতরে এসে বল।”
নূর ভিতরে গিয়ে সোফায় ভাইয়ের পাশে বসলো। তারপর বললো,
–“ভাইয়া অর্নি তোমাকে একটু ছাদে ডাকছে।”
–“কেন ও রুমে আসতে পারে না?”
–“ও আসবে না এখানে৷ তুমি ছাদে যাও।”
উৎসব ফাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“তোর ফ্রেন্ডকে এখানে আসতে বল। কাজ আছে আমার। উঠতে পারবো না এখন।”
নূর উৎসবের দুই হাত ধরে বললো,
–“ভাইয়া যাও না প্লিজ প্লিজ।”
উৎসব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফাইল বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো৷ তারপর এগিয়ে গেলো ছাদের দিকে। নূর অর্নিকে টেক্সট করে জানিয়ে দিলো উৎসব ছাদের দিকে যাচ্ছে।
–
ছাদে উঠে উৎসবের ভ্রু কুঁচকে গেলো। ছাদের কোথাও দেখলো না অর্নিকে। বিরক্ত হলো ক্ষানিকটা। যেই সিড়ির দিকে পা বাড়াবে অমনি পেছন থেকে এক-জোড়া হাত এসে জড়িয়ে ধরলো উৎসবকে। উৎসব বুঝতে পারলো এটা অর্নি-ই। উৎসব অর্নির হাত ছাড়িয়ে অর্নির দিকে ঘুরতে চাইলে অর্নি কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
–“পেছনে ঘুরবেন না প্লিজ।”
উৎসব অর্নির হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলো। শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো৷ অর্নি বেশ কিছুটা সময় নিয়ে ধীর গলায় বললো,
–“ভা্ ভালোবাসি উৎসব।”
চমকে উঠলো উৎসব৷ অর্নি নিজ মুখে ওকে ভালোবাসি বলছে? বুকের ভিতর কেমন একটা করে উঠলো। উৎসব এবার একটানে অর্নিকে নিজের সামনে নিয়ে এলো। অর্নির দিকে পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকাতেই থমকে গেলো উৎসব৷ নীল রঙা শাড়ি পড়ে আছে অর্নি। দুহাত ভর্তি চুড়ি৷ চোখে কাজল৷ আহামরি কোনো সাজ নেই আর। আজ দ্বিতীয় বারের মতো অর্নিকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখলো উৎসব। উৎসবের হার্টবিট যেন থমকে গেছে৷ বুকের মাঝে এক ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলো উৎসবের মনে। উৎসবকে নিজের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্নি একহাতে শাড়ি খামচে ধরে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো৷ উৎসব দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে পরপর কয়েকটা শ্বাস নিলো। তারপর অর্নির দিকে তাকিয়ে বললো,
–“শাড়ি পড়েছো হঠাৎ?”
–“হুম।”
–“কেন?”
–“আপনার জন্য।”
কথাটা বলে মাথা নিচু করে নিলো অর্নি। অর্নির কথায় উৎসব চমকালো। মেয়েটা ওর জন্য শাড়ি পড়েছে? ভাবতেই মনে অন্যরকম এক প্রশান্তি ছেয়ে গেলো৷ তবুও সেটা প্রকাশ করলো না মুখে। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
–“কেন ডেকেছিলে?”
অর্নি কাঁদোকাঁদো চোখে তাকিয়ে বললো,
–“আপনার এখনো রাগ কমেনি?”
উৎসব মুচকি হাসলো। অর্নির গালে হাত রেখে বললো,
–“চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখেও কেউ রেগে থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না৷ তার উপর যদি আবার সেই মানুষটা আমার জন্যই শাড়ি পড়ে আমার সামনে আসে তাহলে তো রেগে থাকার প্রশ্নই আসে না।”
অর্নি মাথা নিচু করে নিলো। লজ্জা পেলো বোধহয় ক্ষানিকটা। উৎসব অর্নির দুই গালে হাত রেখে অর্নির মুখ উঁচু করলো৷ দুজনের চোখে চোখ পড়লো৷ উৎসব বললো,
–“একটু আগেই কি বললে? আবার বলো না___”
অর্নি আবার মাথা নামিয়ে নিলো। কাঁপা স্বরে বললো,
–“ভা্ ভালোবাসি আপনাকে।”
–“শেষমেশ তাহলে ভালোবাসি বললে নিজ মুখে?
কথাটা বলে উৎসব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অর্নিকে। অর্নিও আলতো ভাবে হাত রাখলো উৎসবের পিঠে৷ অর্নিকে জড়িয়ে ধরেই উৎসব ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“আমিও ভালোবাসি তোমাকে। ”
উৎসবের বলা ভালোবাসি কথাটা অর্নিকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিলো। অদ্ভুত এক অনূভুতি সৃষ্টি হলো মনে।
–
ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অর্নি আর উৎসব। অর্নি উৎসবের কাঁধে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে৷ আকাশে আজ বড় করে চাঁদ উঠেছে। মাঝেমধ্যে মৃদু বাতাস বইছে চারিপাশে। বাতাসে অর্নির খোলা চুলগুলো উড়ে উৎসবের মুখে গিয়ে লাগছে। অর্নি ঠিকভাবে দাঁড়িয়ে চুলগুলো হাত-খোপা করতে গেলেই উৎসব অর্নির হাত ধরে আটকে দেয়। বলে,
–“খোপা করো না।”
–“কিন্তু আপনার চোখমুখে গিয়ে বারবার পড়ছে তো।”
–“পড়ুক, সমস্যা নেই। ভালোই লাগছে আমার।”
উৎসবের কথায় অর্নি আর খোপা করলো না চুল। খুলেই রাখলো৷ উৎসব অর্নির চুল আঙুলে পেচিয়ে আবার খুলে ফেলছে৷ এরকমই করছে অনেকটা সময় যাবত৷ অর্নি চাঁদের দিকে তাকিয়েই বললো,
–“আমায় দেখতে কেমন লাগছে বললেন না তো?”
উৎসব ক্ষানিকটা সময় নিরব থাকলো৷ তারপর বললো,
–“ভালো।”
অর্নি ভ্রু কুঁচকে তাকালো উৎসবের দিকে। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
–“শুধু ভালো?”
উৎসব লম্বা একটা শ্বাস টেনে বললো,
–“এখন শাড়ি পড়া অবস্থায় তোমায় কেমন লাগছে, কতটা সুন্দর লাগছে এটা যদি আমি বলতে যাই তাহলে তুমিই লজ্জা পাবে৷ তাই বলছি না।”
উৎসবের কথার আগামাথা বুঝলো না অর্নি। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। উৎসব বললো,
–“বুঝলে না?”
অর্নি মাথা নাড়ালো। উৎসব বললো,
–“আমি বলতে চাইছি না, তবুও যেহেতু তুমি বুঝতে পারছো না তাহলে বলতেই হচ্ছে আমায়। বলি তাহলে?”
অর্নি কিছু না বলে তখনো তাকিয়ে আছে উৎসবের দিকে৷ উৎসব অর্নিকে নিজের কিছুটা কাছে টেনে বললো,
–“আমার নিজেকে ধরে রাখতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে জানো? অবাধ্য মনটার নিষিদ্ধ কিছু পাওয়ার ইচ্ছে করছে বারবার।”
অর্নি ভ্রু কুঁচকে তাকালো উৎসবের দিকে। উৎসব তপ্ত শ্বাস ফেলে অর্নির কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
–“সহজ ভাবে বলতে গেলে, তুমি যদি এখন আমার বিয়ে করা বউ হতে না? তাহলে আর নিজেকে এত কষ্ট করে ধরে রাখতে হতো না৷ সরাসরি তোমায় কোলে তুলে নিয়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতাম।”
উৎসবের এহেন কথায় অর্নির সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো। লজ্জা পেয়ে গেলো ভীষণ। উৎসবকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে অর্নি। উৎসবের দিকে আর একবারও না তাকিয়ে পরপর কয়েকটা লম্বা শ্বাস টেনে দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো অর্নি।
চলবে~
[