তুমি সন্ধ্যারো মেঘ পর্ব -০২

#তুমি_সন্ধ্যারো_মেঘ
#আমিনা_আফরোজ

( কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ)

১.

–” যে নীল রঙ আমার এত প্রিয় ,সেই রঙ আজ থেকে আমার জন্য নিষিদ্ধ হোক রুদ্র ভাই । একেবারেই নিষিদ্ধ হোক।”

ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ফোনে কথা বলছিল রুদ্র। ঠিক তখনি রুদ্র পিছন থেকে শুনতে পেলো কথাগুলো। চমকে উঠল রুদ্র। দ্রুত হাতে রাখা সিগারেট ফেলে দিয়ে পিছন ফিরে ঘুরে তাকালো ও। রুদ্রর থেকে হাত দুয়েক দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা তরুনী। শ্যামলা তার গায়ের বরন,মাথা ভর্তি এলোমেলো লম্বা ঘন রেশমি চুল। মেয়েটিকে চিনে রুদ্র। সম্পর্কে রুদ্রর চাচাতো বোন হয়। নাম হৃদিতা। বাড়ির সকলে ডাকে হৃদি বলে।

রাতের দ্বিপ্রহরে ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে হৃদিকে দেখে একটু অবাক হলো রুদ্র। তাই কপাল কুঁচকে রুদ্র জিজ্ঞাসা করলো,

–” এতো রাতে তুই ছাদে এসেছিস কেন হৃদি?”

মেয়েটা আরো এক কদম এগিয়ে এলো রুদ্রর দিকে। চোখে চোখ রেখে বলল,

–” আপনি যা করার জন্য এতো রাতে ছাদে এসেছেন, আমিও তাই করতে এসেছি।”

–” মানে?”

–” আমিও আজ সিগারেট খাবো রুদ্র ভাই। সিগারেটের শুভ্র ধোঁয়া বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে আমিও আমার দুঃখ ভুলবো। আপনি বরং একটা সিগারেট দেন আমাকে।”

হৃদির কথায় রুদ্রর চোয়াল খানা আপনা আপনিই ঝুলে গেলো রুদ্রর । অবাকের সপ্তমতম দশায় অবস্থান করছে এখন ও । তবে নিজেকে সামলিয়ে রুদ্র বলল,

–” তোর আবার কি দুঃখ আছে রে? যে যার জন্য তোকে এই রাত দুপুরে সিগারেট খেতে ছাদে আসতে হয়েছে।”

–” আপাতত দুঃখের কারনটা আপনাকে বলতে পারছি না রুদ্র ভাই। দুঃখের কারণটা অতি গোপনীয়। কাউকেই বলা যাবে না।”

ভাবলেশহীন ভাবে কথাগুলো বলল হৃদি। হৃদির কথায় রুদ্রর মুখের পেশিগুলো শক্ত হয়ে গেল ক্ষনিকের মাঝেই। গম্ভির গলায় রুদ্র বলল,

–” রাতের বেলায় কি ধাপ্পর খাবার শখ হয়েছে তোর? তোর সাহস দেখে তো আমি অবাক।”

–” হাউ ফানি। এতে এতো অবাক হবার কি আছে রুদ্র ভাই। আপনার হাতের ধাপ্পর তো আমি যখন তখন ফ্রি তেই পাই। মানুষ উপহার পায় চকলেট আইসক্রিম আর আমি উপহার পাই আপনার হাতের ধাপ্পর।”

হৃদির কথায় রুদ্রর চোখ গোল হবার জোগাড়। রুদ্র তেড়ে এসে হৃদির চোয়াল চেপে রাগত গলায় বলল,

–” এই কিছু খেয়েছিস তুই?”

–” হুম খেয়েছি তো। এই যে আপনাকে পুরোপুরি খেয়ে নিয়েছি। একারণেই তো নেশা হয়ে গেছে আমার। আপনিময় নেশা হয়েছে আমার রুদ্র ভাই।”

রুদ্র আচমকাই ছেড়ে দিলো হৃদিকে। পিছিয়ে এলো খানিকটা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

–” অনেক রাত হয়েছে হৃদি , চলে যা।”

–” যাবার জন্য তো আসি নি রুদ্র ভাই। আমাকে সিগারেট দেন, খেয়েই চলে যাবো।”

হৃদি ছোট থেকেই একরোখা স্বভাবের। মাথায় যে ভুত চাপে তা না করে থামে না। রুদ্র দেখলো এভাবে বললে হৃদি শুনবে না তাই অন্য পথ অবলম্বন করলো ও।

–” ঠিক আছে, আমি কাকুকে গিয়ে বলি যে তার মেয়ের এই রাত দুপুরে সিগারেটের নেশা জেগেছে।”

–” ভয় দেখাচ্ছেন?”

–” মোটেও না। তুই খুব ভালো করেই জানিস হৃদি এই রুদ্র শাহরিয়ার কখনোই ফাঁকা আওয়াজ ছাড়ে না। তাই বলছি , ভালোই ভালোই চলে যা নয়তো……

–” নয়তো বাবাকে বলে দিবেন তাইতো? আমিও জেঠুকে বলে দিবো ।”

রুদ্র ছাদের রেলিং ঘেঁসে দাঁড়ালো। বুঝল ও এতো তাড়াতাড়ি হৃদির কবল থেকে মুক্ত হতে পারবে না আজ। তাই কপাল কুঁচকে বলল,

–” কি বলবি শুনি?”

–” বলবো আপনি রাস্তা ঘাটে মেয়েদের বিরক্ত করে বেড়ান।”

–” সিরিয়াসলি। তোর মনে হয় , বাবা তোর কথা বিশ্বাস করবে? শুধু বাবা কেনো, বাড়ির কেউই তোর কথা বিশ্বাস করবে না। কারন ওরা রুদ্র শাহরিয়ার এর ব্যাক্তিত্ব সম্পর্কে ওরা জানে।”

রুদ্রর কথা শেষ না হতেই ওর হাতে রাখা ফোনটা তাড়স্বরে বেজে উঠলো। রুদ্রর ফোনের স্কীনে ভেসে উঠল নীল শাড়ি পরিহিত একটি মেয়ের ছবি । এই মেয়েটিকে হৃদি আজ দেখেছে, সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে রুদ্রর হাত ধরে হাঁটতে। হৃদি ওর চোখ বন্ধ করে গম্ভির গলায় বলল,

–” রুদ্র ভাই এই মুহূর্তে আপনি চলে যান ছাদ থেকে। আমি এখন এখানে দুঃখ বিলাস করবো। আমি চাই না আমার দুঃখ বিলাসের সময় কেউ আমাকে দেখুক।”

হৃদির কথার বিপরীতে আর কোন কথা আসল না দেখে হৃদি চোখ করলো। দেখলো সুবিশাল ছাদে একায় দাঁড়িয়ে আছে ও, রুদ্রর ছায়াটুকুও নেই সেখানে। হৃদি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ছাদের রেলিং ঘেঁসে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে দূর সীমান্তে তাকালো। ঘোলা হাওয়া এসে দোল খেলে যাচ্ছে হৃদির গা জুড়ে। হৃদি ভেজা ভেজা কন্ঠে বলে উঠল,

–” কাউকে ভালোবাসলে কেনো এতো দুঃখ পেতে হয় রুদ্র ভাই? আপনি আমার জীবনে সন্ধ্যার মেঘ হয়েই রয়ে গেলেন রুদ্র ভাই। যাকে দেখা যাবে কিন্তু ছোঁয়া যাবে না। যার মিশমিশে কালো রঙে নিজেকে রাঙানো যাবে কিন্তু নিজের রঙিন রঙে তার ক্যানভাস রাঙানো যাবে না।”

অন্ধকারের বুক চিরে অস্ফুট ভাবে শোনা গেল কথাগুলো। তারপর আবারো একরাশ নিস্তব্ধতা একসময় চুপ হয়ে গেল হৃদির অস্ফুট কথাগুলোও।

পরেরদিন সকালে। সময় সকাল সাতটা বেজে কুড়ি মিনিট। কলেজ ড্রেস পড়ে ডাইনিং এ এসে দাঁড়ালো হৃদি। বাড়ির বেশিরভাগ সদস্য তখনো ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে বিছানায় গড়াগড়ি খেতে ব্যস্ত। হৃদি তড়িখড়ি করে টেবিল থেকে একটা আপেল নিয়ে দ্রুত জুতো হাতে বাহিরে বেরিয়ে এলো। এতো সকালে বাড়ির কাউকে বিরক্ত করতে চাই নি হৃদি। হৃদি এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। ওদের কলেজে ক্লাস শুরু হয় নয়টায়। কিন্তু হৃদি ইচ্ছে করেই আজ সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। কলেজর বাহানাতেও হৃদি আর রুদ্রকে বিরক্ত করতে চায় না। এ কারনেই এত তাড়াতাড়ি কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে সে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে পিচ ঢালা রাস্তায় হাঁটতে শুরু করল হৃদি। সবে দিনের শুরু হয়েছে। রাস্তায় আনাগোনা শুরু করছে যান্ত্রিক গাড়িগুলো। রাস্তার পাশের টিনের চাল তোলা টং দোকানগুলোর বেশ কয়েকটা তখনো বন্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সুনশান পিচ ঢালা রাস্তা। হৃদি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হেঁটে চলেছে সামনের দিকে। গন্তব্যে মিহিদের বাড়ি। হৃদিদের বাড়ি থেকে মিহিদের বাড়ি মিনিট পনেরোর পায়ে হাটা পথ। প্রতিদিন মিহির সাথে যাওয়া হয়ে উঠে না । কারন হৃদির বাবা আশরাফ সাহেব মেয়েকে কখনো একা ছাড়েন না। হৃদির সাথে তিনি বেশিরভাগ সময় রুদ্রকেই পাঠান। মেয়ের ব্যাপারে রুদ্রকে ছাড়া আর কাউকে তেমন একটা ভরসা করতে পারেন না তিনি।

হৃদি মিহিকে নিয়ে কলেজে এলো ঠিক আটটা বেজে ত্রিশ মিনিটে। হৃদির মনটা গতরাত থেকেই খারাপ ছিল তার ওপর কলেজে এসে এক বড়ো ভাইয়ের ধমক খেয়ে হৃদির মন খারাপের পাল্লা বেড়েছে আরো দ্বিগুন। সিনিয়র ভাইটির নাম নিশান। এইচএসসি তে পরপর দুবার ডাব্বা মেরে এখনো কলেজের গন্ডি পেরুতে পারেন নি তিনি। ছেলেটার পড়াশোনা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই হৃদির, হৃদির মাথাব্যথা ছেলের ছ্যাচড়ামো নিয়ে। এই দিন পনেরো আগে ছেলেটা একদিন হুট করে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ফেলে হৃদিকে। হৃদি অবশ্য নম্র ভাবেই সে প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল বটে কিন্তু ছেলেটা ওর পাগলামি থামায় নি । বরং এই পনেরো দিন অনেকভাবেই বিরক্ত করে গেছে হৃদিকে। হৃদি মুখ বন্ধ করে মেনে নিয়েছিল ছেলেটির সকল অত্যাচার । মুখ ফুটে বাড়ির কাউকেই কিছুই বলে নি ও। কারন হৃদি চায় না কলেজের কারো সাথে ওকে নিয়ে কোন ঝামেলা হোক। হৃদি ভালো করেই জানে এই ঘটনা ওর বাড়ির কারো কানে গেলো কি অশান্তির সৃষ্টি হবে। কিন্তু আজ নিশান নামের সিনিয়র ছেলেটি তার সকল ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। জনমানব ভরা মাঠে মধ্যে হাত টেনে ধরেছে হৃদি। শুধু তাই নয় হৃদি তার কাজের প্রতিবাদ করতে গেলো ভরা মাঠের সকলের সামনে বিশ্রি গালিগালাজ করেছে ওকে। বিশ্রি গালিগুলোর কথা মনে হতেই হৃদি চোখ পানিতে ভিজে উঠল। ঠিক তখনি হৃদি ওর পিছন থেকে শুনতে পেলো এক ভরাট কন্ঠস্বর। কেঁপে উঠল হৃদি। পিছনে ঘোরার সাহসটুকুও পেলো না ও।

চলবে

( এই গল্পটার পিছনে একটা মজার ঘটনা আছে। মজার ঘটনাটা নাহয় অজানাই থাক। পরে কখনো বলবো আপনাদের। গল্পটি কেমন লেগেছে আপনাদের জানাবেন আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here